শীত এল। যেমন আসে। মৃদু আমেজ। প্রথম কয়েকদিন আমার সেই পেটেন্ট সোয়েটার দিয়েই উদ্বোধন করা গেল। ঝলঝলে মাল। রং জ্বলে গেছে। যৌবন ঝরে গিয়ে বার্ধক্যের দশা। কাপ্তেনি করার বয়েস চলে গেছে বলে মানিয়ে যায়; বছরের পর বছর ধরে শুনে আসছি শীত চলে গেলেই ওটাকে আবার খুলে বোনা হবে। যেমন শোনা যায় রামরাজত্ব আবার আসবে। যাই হোক নতুন। সোয়েটারের তখনও তেমন প্রয়োজন হল না। চলছে চলুক। এরই মধ্যে একদিন বৃষ্টি হয়ে। শীতটা জাঁকিয়ে পড়ল। অফিসের সেই মহিলা বললেন, সোয়েটারটা এবার একদিন পরুন। তুলে রেখে রেখে পোকায় যে কেটে দেবে। গিন্নির ভয়ে পরছেন না বুঝি! (পৃথিবীতে কত রকমের ভয়! আরশোলার ভয়, সাপের ভয়, ছোঁয়াচে রোগের ভয়, মাসের শেষে কারওর বিয়ের ভয়, বড়কত্তার ভয়—সব সেরা গিন্নির ভয়।)।
উপলক্ষ্য একটা জুটে গেল। আজ অফিসের এক সহকর্মীর বউভাত। সদলে যেতে হবে। সামান্য মাঞ্জা দিলে ক্ষতি কী? সাদা প্যান্টের ওপর নতুন সোয়েটার। যথাস্থানে হাত চলে গেল। হাত ফিরে এল। প্যাকেট স্থানচ্যুত, আলমারি তোলপাড়। শীতল একটা গলা শোনা গেল, ‘কী খোঁজা হচ্ছে? সব যে বারোটা বেজে গেল। কী চাই আমাকে বললেই তো হয়। হাঁটকে পাঁটকে একশা!’
‘একটা প্যাকেট ছিল।’
‘কীসের?’
‘সোয়েটারের।’
‘ও সোয়েটার! নস্যি নস্যি রং। কার সোয়েটার?’
‘আমার, আবার কার?
‘কে বুনে দিলে?’
‘বউদি।’
‘তোমার আবার বউদি কোথা থেকে এল?’
‘তোমার একগাদা ঠাকুরপো থাকতে পারে আমার একজন বউদি থাকতে পারে না!’
‘রসের বউদি! তলে তলে আজকাল এইসব হচ্ছে। বুড়ো বয়েসে লজ্জা করে না! ছেলেমেয়ে বড় হচ্ছে। মুখ দেখাবে কী করে?’
‘তুমি যদি দেখাতে পারো আমিও পারব।’
‘তার মানে?’
‘বুঝে নাও।’ আবার আমি আলমারি হাঁটকাতে শুরু করলাম।
‘তার মানে আমিও তোমার মতো চরিত্রহীন!’
‘যে যেমন অর্থ করে।’
‘আচ্ছা-আ।’
‘আচ্ছা’ শব্দটা ধারালো ছুরির মতো হাওয়া কেটে গেল। আলমারির সব কিছু ঠিকঠাক রেখে সোয়েটার খোঁজার ধৈর্য আর নেই। দেরি হয়ে যাচ্ছে। দুমদাম করে সব ফেলতে লাগলুম। রাগে সর্বশরীর জ্বলছে।
‘সোয়েটার ওখানে নেই।’
‘কোন চুলোয় আছে।’
‘ভবানীপুরে।’
‘ভবানীপুরে?’
‘হ্যাঁ, ভবানীপুরে। তোমার ছোটশালা পরে চলে গেছে।’
‘বাঃ, বারে শ্বশুরবাড়ি। যেখানে যা পাবে হাতিয়ে নিয়ে চলে যাবে। দেওয়ার মুরোদ নেই, নেওয়ার বেলায় শত হস্ত।’
‘কী নিয়েছে শুনি? কী-ই বা তুমি দিয়েছ?
‘কী নেয় না শুনি! দেওয়া? দেওয়ার অপেক্ষা রাখে? তোমার ওই বাহারের ছোটভাইটি যেখানে যা পাবে ঝেড়ে নিয়ে চলে যাবে। যেন কর্পোরেশনের মাল রে! এই তো সেদিন একটা জামা নিয়ে হাওয়া হয়ে গেল। কী? না জামার রংটা ভীষণ ভালো। ভীষণ অ্যাপিলিং ইংরেজি শিখেছে, ইংরেজি। আমার আর ভালো কিছু পরে দরকার নেই, ছেঁড়া পরে ঘুরে বেড়াই। আর তুমি একটি গোমুখ্য। বাপের বাড়ি, বাপের বাড়ি করে সারাটা জীবন হেদিয়ে মলে।’
‘তাই তো বলবে! হ্যাদানোর কী দেখলে? আর তুমি যখন আমার শাড়ি ধরে টানাটানি করো?
‘তোমার শাড়ি? তোমার ত্রিসীমানায় যেতে আমার ঘেন্না করে। আমি জানি, আপনার চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বন ভালো।’
‘তা ঠিক। পর তো ভালো হবেই। বাইরে বাইরে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত ফস্টিনস্টি। তাদের তো আর অন্য কোনও দায়দায়িত্ব নিতে হবে না। ঘরেরটাকে জিইয়ে রেখে বাইরের এক একটাকে ধরে একটু খেলু খেলু। বাবুর খেলা হচ্ছে। খেলা। হাজারবার তাগাদার পর একটা শাড়ি এল। না পরে তুলে রাখলাম। তারপর যেই একটা বিয়ে এল বাবুর অমনি নাকে কান্না, মাসের। শেষ, বড় টানাটানি, কী করা যায়, তোমার ওই শাড়িটা দিয়েই এ যাত্রা ম্যানেজ করি। তোমাকে। আরও ভালো শাড়ি কিনে দেব। ব্যস হয়ে গেল। ফুর্তিতে টাকা ওড়ালে সংসারের এই হালই হয়। তোমার রকমসকম দেখে আমারও ঘেন্না ধরে গেছে। তোমার ত্রিসীমানায়, তোমার কোনও কিছুতে থাকতে ইচ্ছে করে না।’
‘থাকার দরকার নেই। এসেছি একলা যাবও একলা। তোমার ভাইকে এই সোয়েটারটা, এই শালটা, এই জামাটা, এই প্যান্টটা, এই কলারওলা গেঞ্জিটা দয়া করে নিয়ে যেতে বোলো। আমি সন্ন্যাসী হয়েই দিন কাটাব।’
সব টেনে টেনে, ছুড়ে ছুড়ে মেঝেতে ফেলে দিলুম। ভেতরটা বেশ খোলসা হল। কোষ্ঠকাঠিন্যের পরের আনন্দ। অফিসে বেরোবার তাড়া না থাকলে বেশ ভালোভাবে লড়া যেত। যাক, তবু কিছুটা লণ্ডভণ্ড করা গেছে। ক্রোধে শরীরের রক্তসঞ্চালন ভালো হয়। কল্পনার স্বপ্নজগৎ থেকে বাস্তবে বেশ কিছুদিনের জন্যে ফিরে আসা সম্ভব। গণ্ডারের মতো গোঁ গোঁ করে গোঁত্তা মারার জায়গার দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। মুহ্যমান ভাব কেটে যায়। কাজে-কর্মে গতি আসে।)
অফিসে আমার সেই বান্ধবী বললেন, ‘কী হল? কাল নতুন সোয়েটার পরার কথা বলায় একেবারে উদোম হয়ে চলে এলেন যে?’
বাহুল্য বর্জন। বলতে পারলুম না যে, আপনার সযত্নে বোনা সোয়েটার ভবানীপুরের এক মাল পরে আশুতোষ কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে শিকার করছে।
‘ঠান্ডা লেগে যাবে যে? আজ ফিরতে অনেক রাত হবে তো!’
‘বিকল্প ব্যবস্থা আছে।’
‘সেটা কী?
‘ছিলিম। বিকেলে বেরিয়ে বটতলার বাবাজির কাছে উবু হয়ে বসে টান মেরে যাব।’
ঠান্ডা লাগার কথা আমার বউও বলেছিল তবে বাঁকা করে। ‘ঠান্ডা লেগে নিমোনিয়া হলে সেবা করতে পারব না কিন্তু।’ সেবার নমুনা তোমার দেখা আছে। ছেলেবেলায় আমাদের পড়তে বসার মতো। এদিক তাকাচ্ছি, ওদিক তাকাচ্ছি, কাগজের গোল্লা তৈরি করছি, পেনসিল চিবোচ্ছি। শেষে হাওয়ায় বইয়ের পাতা উড়ছে, পড়ুয়া মাঠে দৌড়োচ্ছে। তোমার সেবাও তো তাই। আমার কপাল রইল কপালে। তোমার হাত রইল হাতে। মুখে বারকতক বললে, কপালে হাত বুলিয়ে দোব? কপালে?