চলতে চলতে মানুষ কত কী আবিষ্কার করে। হঠাৎ মনে হতে লাগল আমার স্ত্রী-র নাকটা ভীষণ ফ্ল্যাট। মুখের অনেকটা জায়গা জুড়ে আনাড়ির হাতে তৈরি শিঙাড়ার খোলের মতো পড়ে আছে। চোখে কোনও বুদ্ধির দীপ্তি নেই। প্যাঁচার মতো গোলগোল। চুলে তেমন চেকনাই নেই। ঘোড়ার বালামচির মতো সোঁটা সোঁটা। হাতের রান্না তেমন ভালো নয়। সব কাজেই অপটু। শরীরে তেমন লাবণ্য নেই। কপালটা আবার উঁচু। (কী করে তখন যে প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতুম ঈশ্বরই জানেন। তখন বোধহয় অন্ধ ছিলুম। বেড়ালের চোখ ফোটে দেরিতে।)।
রাতে পাশাপাশিবিছানায় শুয়ে আছি। যে-কোনও কথারই ছাড়া কোনও উত্তর নেই। এক অক্ষরের আলাপন। শরীরে হাত ঠেকলেই খ্যাঁক করে ওঠে। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবি স্বামীর পাশে শুয়ে আছে না ভাসুরের পাশে। শোওয়ার সময় ভগবানের নাম নিতে হয়। হে করুণাময়! আমাকে সুনিদ্রার তটে প্রভাতের উজ্জ্বল আলোতে নিয়ে চলো। সে সব নেই। হঠাৎ অন্ধকারে বলে উঠল, চিনি ফুরোল, কাল সকালের চায়ের মতো পড়ে আছে। চা আনতে হবে। এবারের চায়ে তেমন লিকার ছিল না। তার মানে খরচ বেশি হয়েছে। পরশু তপুর ছেলের অন্নপ্রাশন। কিছু দিতে হবে! কী দেবে? সামনের শনিবার বিকাশের বিয়ে। কী দেবে? অবিরাম দেহি দেহি। যেন। ট্যাঁকশালের পাশে এসে শুয়েছে। সবসময় স্বার্থ। বিছানাটা আলাদা করে নিতে হবে। কী দরকার বাবা! ভুলে কোথাও হাতটাত পড়ে গেলে বড় অপমানিত হতে হয়। কপালে! ভীষণ মাথা ধরেছে। কাঁধে? সংসারের ভার। পেটে বোধহয় টিউমার। পায়ে গুঁপো। এ জিনিস বিছানায় কেন? ডাক্তারের টেবিলে শোয়া উচিত ছিল।
সোয়েটার থেকে অনেক দূরে এসেছি। না সরে আসতে পারিনি। শীত ফিরে ফিরে আসে। এক। মাঘে শীত যায় না। প্রথম শীতেই আমার সেই অফিসার মহিলা সুন্দর একটি সোয়েটার উপহার দিলেন। আমরা দুজনে একটা ইংরেজি ছবি দেখলাম। সিনেমা হলে সেই সোয়েটারটা তাঁর কোলে থেকে গরম হয়ে উঠল। নস্যি রঙের উলে নকশার বিনুনি হাত ধরাধরি করে চলেছে। হাতে নিলেই বোঝা যায় দামি উল। হালকা, নরম। ছবি দেখতে দেখতে মন খুশিতে নেচে উঠেছিল জয়ের আনন্দে। (মন জয় করার যে গর্ব। রাজত্ব জয় কোথায় লাগে!) নতুন এক মহাদেশে নৌকো নোঙর ফেলেছে। এক-একটি মন অজানা এক-একটি মহাদেশ। ইংরেজি বই চলার মাঝে মাঝেই মনে বাংলা গান গুমরে গুমরে উঠছে, আমার কী হবে তারিণী, ত্রিগুণধারিণী!
তারিণী জানতেন, ব্যাটাচ্ছেলে তোর কী হবে। প্যাকেট বগলে বাস-এর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি। বলদাত্রী, সোয়েটারদাত্রী চলে গেছেন। পরে আছি স্ত্রীর হাতে বোনা প্রেমের তাজমহল। সম্পর্কের শুরু ও শেষের উল-ফলক (মর্মর ফলকের মতোই, হেথায় চিরশায়িত সেই মানুষটির প্রেম। আমি তো তোমারে চাহিনি জীবনে, ঘাড়ে ধরে পিতা গছিয়েছেন। ভুল করে বোনা সোয়েটার ভুলে অঙ্গে চেপে বসেছে। গায়ের সোয়েটার যেন বগলের সোয়েটারকে প্রশ্ন করছে, কোথায় চললে? কেন, তোমার সঙ্গে! তুমি যে ইললিগ্যাল মানিক। ঝাঁটা খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে বুঝি। তুমি কোন উৎস হইতে উঠিয়া কোথায় চলিয়াছ? বাঘের ঘরে কি ঘোগ বাসা বাঁধিতে চলিয়াছে? তুমি তো আমার সতীন হে। একটু ভয় ভয় ভাব যে হচ্ছে না তা নয়। অফিস থেকে সিনেমা, সোয়েটার উপহার, অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে পাশাপাশি বসে থাকা, রেস্তোরাঁ, খানা— এতক্ষণে বেশ ঘোরে ছিলুম। এইবার একা একা বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনটা যেন ক্রমশই এলিয়ে পড়ছে। সে শক্তি আর নেই। চোখের আড়ালে আত্মিক অনুসন্ধানে বিপদের ঝুঁকি কম। বামাল বাড়ি ঢুকলে চুলোচুলি তো হবেই। সোয়েটার তো আর আশমান থেকে পড়ে, ছেলেরাও বোনে না। কোন মহিলার এই কীর্তিকীসের এত খাতির (যার ওপর দুর্ব্যবহার করা হয় তাকে সব সময় চোখে রাখতে হয়। মার খেতে খেতে পালিয়ে না যায়। অন্য কোথাও ছিটকে গিয়ে আদরে না থাকে। আমার পাঁঠা। ন্যাজে কাটব, মুড়োয় কাটব।) হঠাৎ তোমাকে কেন সোয়েটার বুনে দেওয়া। সোহাগ না থাক সজাগ দৃষ্টি ঠিক আছে। (কুস্তিগির খেটেখুটে, তেল ঢেলে জমি তৈরি করে, তার ওপর নিত্য দাপাদাপি করার জন্যে। এর নাম আখড়া। স্বামীরা হল। স্ত্রীদের আখড়া। যে যার আখড়ায় কুস্তি করবে। অন্যের প্রবেশ নিষেধ।) এমন জিনিস রাস্তায় তো আর ফেলে দিতে পারি না। তা ছাড়া এর প্রতিটি বুনোনে ভালো লাগা, ভালোবাসা। যা হয় হোক সতীন বগলেই বাড়ি ঢুকব। ঠান্ডা লড়াই একদিন গরম লড়াই হবেই। যত তাড়াতাড়ি ফয়সালা হয়ে যায় স্নায়ুর পক্ষে ততই ভালো। ধিকিধিকি তুষের আগুনের মতোনা জ্বলে দাউদাউ করে জ্বলে উঠুক। (অশান্তিটাও এক সময় বিলাস হয়ে দাঁড়াল। উট যেমন কাঁটা চিবিয়ে রক্তাক্ত হতে ভালোবাসে।)
সোয়েটার বগলে বাড়ি ঢোকার দিনটিতে তেমন কিছু হল না। কারণ আমার আসা, আমার যাওয়া তেমনভাবে আর কারওর নজরে পড়ে না। সে ছিল প্রথম দিকে। ফিরতে একটু দেরি হলে দূর থেকেই দেখতে পেতুম জানালায় একটি মুখ। আমি পথ চেয়ে রব। বেরোনোর সময় ফিশফিশে অনুরোধ, তাড়াতাড়ি ফিরো। বেশি রাত কোরো না। (আমাদের সেই মঙ্গলা গরুটার মতো। দেশের বাড়িতে দেখেছি। সকালে চরতে বেরোল। জানা আছে বিকেলে ঠিক ফিরে আসবে। যেখানেই থাকুক। কোনও চিন্তা নেই। মাঝে কেউ একবার গোয়ালে উঁকি মেরে আসত। মঙ্গলা শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। মঙ্গলা দুধ দিত আমি টাকা দিই এই যা তফাত।) সুতরাং নিঃশব্দে। বাড়ি ঢুকে প্যাকেটটা আলমারিতে গুঁজে রাখলাম। শীত আসুক তখন সাদা প্যান্টের সঙ্গে পরা। যাবে। আর তখনই হবে ধুমধারাক্কা। ততদিন সম্পর্কটা আরও বিষিয়ে উঠবে। ফোঁড়া থেকে কার্বঙ্কল।