সবই যখন জানি তখন একটা সোয়েটার নিয়ে এত ধানাইপানাই কেন? মানুষের ভ্রম হয়, মতিভ্রম হয়। আমার মতিভ্রম হয়েছিল। হাঁড়ির একটা চাল তুলে টিপে দেখে সব চালের অবস্থা বুঝেও বুঝিনি। একটু স্নেহটেহ, প্রেমট্রেম খুঁজতে আবার ছিপ ফেলেছিলুম। আমার মনে হয়েছিল জীবনটা অনেকটা কম্বিনেশন তালার মতো। ঘোরাতে ঘোরাতে এক সময় নম্বরে নম্বর মিলে গেলেই খুলে যাবে। এই মহিলাটির সঙ্গে মিল হয়নি, কুছ পরোয়া নেই। কম্বিনেশন মেলাতে পারিনি, তাই সংসারের ফটকে টাম্বলার তালার মতো গোমড়া মুখে ঝুলতেই থাকবে সারা জীবন। থাকুক। কত কিছুই তো খোলে না জীবনে। সংসারের কত শিশি থাকে যার ঢাকনা খোলা যায় না। আড়পাঁচ হয়ে পড়ে থাকে। গরম জলে চুবিয়ে, আগুনের ছেকা দিয়েও খোলা যায় না। বিজ্ঞানীরা বলে, ট্রায়াল অ্যান্ড এরর মেথড। ভুল হতে হতে এক সময় মিলে যাবে। স্ত্রী-রা প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুলের মাশুল। মুষল বিশেষ। সংসারের মোহ-মুদগর। বিবাহের পরই বোঝা যায় এ-তালার চাবি আমার হাতে নেই। আমি হলাম অন্য তালার চাবি।
সেই তালাটি যে অফিসে আমার চেয়ারের তিনটি চেয়ার পরে এতকাল বসে বসে ফাইল নাড়তেন। তা কি আমি জানতুম; (বিবাহ না করিলে মানুষের দৃষ্টি খোলে না)! পৃথিবীতে স্ত্রী-নিগৃহীত স্বামী। যেমন আছে তেমনি স্বামী-নিগৃহীত স্ত্রীও আছেন। বিধাতার কৌতুকে সবলে দুর্বলেই জোড় বাঁধে। কদাচিৎ সবলে সবলে মোলাকাত যে হয় না তা নয়। পাড়ার এই রকমের দম্পতি দু-একটি দেখা যায়, শোনাও যায়। শোনা যাবে না কেন, তাঁরা এতই সরব এবং রোষযুক্ত যে তাদের সৌরভ যোজন বিস্তৃত। যাই হোক, এরকম হাম ভি মিলিটারি তোম ভি মিলিটারি গোছের মিলন বিধাতার হাত ফসকেই বেরিয়ে যায়। (আমি মাঝনদীতে একবার একটা নৌকো দেখেছিলুম। হাল, দাঁড়। ফেলে দুই মাঝিতে পাটাতনে দাঁড়িয়ে মল্লযুদ্ধ করছে। নৌকো ভেসে চলেছে স্রোতের টানে। জীবনও তো তাই। হাল ধরি আর না ধরি ভাসতে ভাসতে ঠিক চলে যায় মৃত্যু মোহনায়।)
তা সেই শান্ত চেহারার, মিষ্ট স্বভাবের মহিলাটির সঙ্গে সামান্য উশখুশেই একটা হৃদ্যতা জন্মে। গেল। জন্মাতেই পারে। এক পালকের পাখি এক জায়গায় জড়ো হয়। আমার তো কোনও দোষ ছিল না। আমার স্ত্রী-র উপেক্ষাতেই আমার বিপথে গমন। এ তো জানা কথাই, ছেলেমেয়েরা স্নেহ ভালোবাসা না পেলেই কুসঙ্গে চলে যায়। আমি স্বামী হলেও ছেলে তো, আর যার সঙ্গে আমার ভাব-ভালোবাসা সে অন্যের স্ত্রী হলেও মেয়ে তো। এ যুক্তি জজেও মানবে। আর দুজনেই ঘা। খাওয়া প্রাণী। তা ছাড়া ‘ঘৃতশাস্ত্রে’ বলেছে—অগ্নি সমীপে ঘতের অবস্থানে অগ্নি উদ্দীপিত হয়। পুরুষ আর নারী সেই অগ্নি ও ঘৃত। কে অগ্নি, কে ঘৃত তা জানি না। শাস্ত্রবাক্যে সাবধান না হয়ে কর্মস্থলের কর্তৃপক্ষ দহনশীল ও দাহ্য বস্তু দুটিকে এত পাশাপাশি রাখলেন কেন? দোষ আমার নয়। দোষ যখন আমার নয় বিবেক তখন মুক্ত। বেশ করেছি ভালো করেছি। (কার বাপের কী? বললে, শ্বশুরমশাইকে বোঝায়। নিগৃহীত স্বামী হলেও আমি অভদ্র নই) নিজের স্ত্রী-র যখন সময় নেই, মেজাজ নেই, তখন অন্যের বাতিল স্ত্রীর সঙ্গে ভাব বিনিময়ে দোষের কিছু নেই। (সমাজ এখন অনেক লিবার্যাল) কথা বলতে গেলেই সংসারের কথা। হরেক উপদেশ। পিতার কর্তব্য কী? কন্যার বিবাহ। অমুকের তমুক। গুষ্টির পিণ্ডি। মুখ খুলেই মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চুলোচুলি, খুনোখুনি, দক্ষযজ্ঞ। (স্ত্রীরা কত আপনজন ল্যাজে পা পড়লেই বোঝা যায়। স্বরূপ বেরিয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে। কোন ব্যাটা বলেছে বিবাহবন্ধন জন্মের বন্ধন, সাতপাকে বাঁধা। কিস্যুই তিনি। জানতেন না। এলো সুতোয় একতে ঘুড়ি ঝোড়ো হাওয়ায় উড়ছে। পান থেকে চুন খসলেই শ্বশুরমহাশয়ের কন্যার অন্য রূপ। কে ওই বামা এলোচুলে! বড় পলকা বন্ধন। ঘাঁটাঘাঁটি না করলে বেশ আছে। ঘাঁটালেই ভিমরুলের চাকে খোঁচা। স্ত্রীর পিরিত চাকের মধু। চাকেই থাক।) অন্যের সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য চেহারা। হাসিহাসি মুখ। উজ্জ্বল চোখ। ডগমগ অবস্থা। (রামকৃষ্ণ বলতেন, অদ্বৈতজ্ঞান আঁচলে বেঁধে লড়ে যাবে। লড়ে যাবে বলেননি, সংসার করতে বলেছিলেন। তার মানে স্বামীকে আঁচলে বেঁধে দাপটে সংসার। আর প্রবাদ আছে, যার শিল যার নোড়া তারই ভাঙে দাঁতের গোড়া।) আমি পিতা হতে পারি, বাজার সরকার হতে পারি, মুদ্দোফরাশ হতে পারি, ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো হতে পারি, পারি না কেবল স্নেহভাজন স্বামী হতে। শাস্ত্রে আছে যেমন কুকুর তেমন মুগুর, আছে বাঘা ওল বুনো তেঁতুল। সুতরাং এই জাতীয় একস্ট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ার্স-এ আমার অধিকার আছে। আমার বিবেকের সমর্থন আছে। তা ছাড়া পার্শ্ববর্তিনী মহিলাটির সঙ্গে এমন কিছু করছি না যা অসামাজিক।
দুজনে অবসর সময়ে সুখ-দুঃখের আলোচনা করি। কে ক-ঘা খেলুম। কে কেমন আঁচড়ালে। অন্যমনস্ক চিনেবাদাম দাঁতে কাটতে কাটতে দীর্ঘশ্বাস ফেলা। একই চাতালে দাঁড়িয়ে ক্ষত অনুসন্ধান আর লেহন। অনেকটা কুকুরের মতো। কামড়াকামড়ি, ঝটাপটির পর একপাশে বসে বসে কেমন তারিয়ে তারিয়ে চাটে। এইভাবে মনের দুঃখ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে এক। ধরনের সান্নিধ্য গড়ে উঠল। দুজনেরই মনে হতে লাগল এ জীবনে যা হওয়ার নয় তাই হলে একটা সুখের সংসার গড়ে উঠত। একটা খুব ভালো প্লট কাঁচা লেখকের হাতে পড়ে নষ্ট হয়ে গেল। সমবেদনায় বেদনামাখা দুটো মন এক হয়ে গেল। আমরা অফিস ছেড়ে ছুটির পর মাঝেমধ্যে পার্কে গিয়ে পাশাপাশি বসতে শুরু করলুম। একে বলে সংযত প্রেম। যৌবনের ফোঁসফোঁসানি নেই, আবেগ নেই। টুকটাক কথা, ভাঁড়ে চা, মাঝেমধ্যে একটু দর্শন আলোচনা আর আশেপাশে জোড়ায় জোড়ায় যুবক-যুবতিদের দেখে তাদের ভবিষ্যৎ ভেবে আঁতকে ওঠা। একটা-দুটো সিনেমাও হত। সেকেন্ড হ্যান্ড প্রেমের একটা আলাদা মাধুর্য। কোনও দাবি নেই, বন্ধন নেই। তিক্ততা নেই, এক সময় যে যার চুল্লিতে ফিরে যাও। পরের দিন মিলিয়ে দেখো কে কতটা ঝলসালে।