রাস্তার ওপারে চায়ের দোকানে রাতের কথার খই ফুটছে। ডিম ফোঁটাবার শব্দ আসছে। কে যেন বলছে ওমলেটটা একটু নরম থাকে যেন কার্তিক। ওমলেট আমিও ভালোবাসি। নরম ওমলেট খাবার আর সময় নেই। আবার খাওয়া যাবে অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে। মালাটা ছিঁড়ে গেছে। সমস্ত পুঁতি ছড়িয়ে পড়েছে। একটা একটা করে কুড়োতে পারি কি না দেখি! না বড় শক্ত কাজ।
দক্ষিণের ঘরের আটটা পেরেক নটা হবে। এটা নতুন, মাথাটা অন্যগুলোর চেয়ে চকচকে। চশমাটা কেউ খাপে ভরে রাখবে। কলমের মাথাটা বন্ধ করে রাখবে। বিয়ের গরদের পাঞ্জাবিটা পরিয়ে দেবে। নতুন ধুতিগুলো ছাপিয়ে শাড়ি করে নেবে। নতুন চটিজোড়া রাকে তুলে রাখবে। আমি তখন খাট থেকে ফুটতিনেক উঁচুতে ছবি হয়ে ঝুলব! সব মুহূর্ত খরচ করে আমি তখন চলে গেছি সময়ের ভাণ্ডারে আমার রিক্ত ঝুলি নতুন করে ভরে নিতে। আমার দু-পাটি বাঁধানো দাঁত আলমারির কাঁচের ওপাশ থেকে অবয়বহীন হাসি ছড়াবে ইন্টারন্যাল লাফ-এ গ্রিন উইদাউট এ ফেস।
পরিশিষ্ট
Time present and time past
Are both perhaps present in time future
And time future contained in time past.
If all time is eternally present
All time is unredeemable.
[T. S. Eliot.]
পেয়ালা পিরিচ
আমার একটা সোয়েটার ছিল। কারওর স্নেহের হাতের বোনা নয়। নীরস দোকান থেকে কেনা। সেই সোয়েটার আমার ছাত্রজীবনের শেষভাগ থেকে চাকুরে জীবনের প্রথম ভাগ পর্যন্ত শীতে আশ্রয় দিয়েছিল। তারপর স্ত্রীযোগে সোয়েটার বিয়োগ হল। প্রথম দিকে স্ত্রী-রা দু-এক বছর বড় মধুর ব্যবহার করে থাকেন। অঙ্গে বউভাতের রাতে পাওয়া কখনও নীল শাড়ি, কখনও লাল শাড়ি। এলোচুলে ফুলশয্যা আর গায়েহলুদের তত্বে পাওয়া গন্ধতেলের সুবাস। কপালে আঁকা যত্নের গোল টিপ। মুখে মৃদু ‘শুনচ, শুনচ’ সম্বোধন। স্বামীরাও তখন পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে। পোষা বেড়ালের মতো। ডাকের কী বাহার! সোহাগে জরজর, ‘হ্যাঁ গা।’ স্ত্রী আমার সেই পাটকেল রঙের সোয়েটারটিকে অবসর গ্রহণে বাধ্য করল। এ আবার মানুষে গায়ে দেয়! যেন এতকাল আমি জানোয়ার ছিলুম। বিবাহের পর মনুষ্য পদবাচ্য হয়েছি বছর চারেক পরে অবশ্য আবার আমি জানোয়ার হয়ে গেছি। এখন উঠতে উঠতে শুনি, জানোয়ারের হাতে পড়ে জীবনটা গেল। তার মানে স্বামী পুরোনো হলেই জানোয়ার হয়ে যায়। যেমন চামড়া পাকা হলে জুতো হয়।)।
প্রথমে আলমারির এক কোণে, তারপর আলমারির পেছনে, সব শেষে সেই সায়েটার এসে পড়ল কয়লার গাদায়। অবশেষে সেটির মালিক হল আমাদের বাড়িতে যে কাজ করে তার স্বামী। আর আমার স্ত্রী নস্যি রঙের উলের জমিতে হলুদ রঙের সাপ খেলিয়ে বেশ আহামরি গোছের। একটি বুকখোলা সোয়েটার বুনে দিলে। মেডেন সং-এর মতো মেডেন সোয়েটার। সেই প্রথম আর সেই শেষ। অমন পাপকর্ম সে আর দ্বিতীয়বার করেনি (পুরোনো স্বামীর মতো পাপী ব্যক্তি পুলিশের খাতাতেই নেই। ছুপা রুস্তম।)।
বছর ঘুরতেই খোকা। আবার বছর ঘুরতেই খুকি। স্ত্রী হাতছাড়া হয়ে গেল। জননীর অনেক যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণার অংশীদার হয়েই জীবন কাটাতে হবে। সুখের সীমানা বড় সংকীর্ণ। সেই স্ত্রী এখনও সোয়েটার বোনে। তবে আমার নয়, ছেলেমেয়ের। ইতিমধ্যে তার নিজস্ব জগৎও বেশ। বড় হয়েছে। হাঁকডাক বেড়েছে। ঠাকুরপো-টাকুরপো গোটাকতক জুটেছে। তাদের জন্যেও মাঝে মাঝে সোয়েটার বোনার সময় করে নিতে পেরেছে। আমি তো ঘরকা মুরগি ডাল বরাবর। আমার স্বাদ কমে গেছে। আমার বাহবার তেমন দাম নেই। আমি খুশি হলেই বা কী। অখুশি হলেই বা কী। (স্বামীরা আসলে ক্লীব লিঙ্গ। সামান্য আশকারায় নিজেদের পুংলিঙ্গ ভেবে আস্ফালন প্রকাশ করে যথাস্থানে যথোচিত ঠোক্কর খেয়ে একপাশে চিত হয়ে পড়ে। অনেকটা বিরাট আকৃতির। গুবরে পোকার মতো। ঘরে ঢুকে জেট-প্লেনের মতো সগর্জনে খুব উড়ছে। ভীতু ভাবছে না জানি কী মাল। যার আয়তন আর আওয়াজ এত সাংঘাতিক তার কামড় নিশ্চয়ই মারাত্মক হবে। কিন্তু যে জানে সে জানে। উড়তে উড়তে এক সময় দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে চিত হয়ে পড়বে আর একবার চিত হলেই ভোলা মহেশ্বর। পড়ে পড়ে সারারাত শুড় নাড়বে। সকালে চিত থেকে সোজা করে। দাও গোঁ-গোঁ করে উড়ে বাইরে চলে যাবে। বিবাহিত মানুষের সঙ্গে অসাধারণ মিল। বাড়ি ঢুকল। গোঁ-গোঁ করতে করতে। স্ত্রী ছাড়া সকলেই তটস্থ। ঠ্যাকাস করে পয়লা ধাক্কাতেই ফ্ল্যাট। বাবু চিত হয়ে রইলেন। সকালে ঝাঁটা দিয়ে উপুড় করে দাও। সামনে এককাপ চা ধরো। তারপর দেখো। বাজার, দোকান সব ঠিকঠাক। ন’টার সময় উড়তে উড়তে কর্মস্থলে। অত বড় ক্ষমতাশালী মহাদেব। তাঁকে চিত করে সেই যে একবার মা কালী বুকে উঠে দাঁড়ালেন আজও তিনি সেইভাবে পড়ে আছেন আর উঠতে হল না।)
মানুষের জ্ঞানোদয় হলে তার আর কোনও দুঃখ থাকে না। আমারও নেই। প্রত্যাশাইদুঃখের মূল কারণ। আমি মূলোচ্ছেদ করে দিব্যি আছি। আমি আমার স্ত্রীর কাছ থেকে আর কিছুই আশা করি না। আমি জানি সকালের কুয়াশার মতোই স্ত্রীর প্রেম ক্ষণস্থায়ী। (শুনেছি জাপানে এক ধরনের। মারাত্মক বিষাক্ত মাছ পাওয়া যায়। সেই বিষ বের করে যারা রাঁধতে পারেন তাঁরা জানেন এর চেয়ে সুস্বাদু মাছ আর দ্বিতীয় নেই। স্ত্রীও অনেকটাই সেই রকম। বিষ বের করে যাঁরা নাড়াচাড়া করার কৌশল জানেন তাঁরা বলেন, ধনধনা ধন ধনা, এ ধন যার ঘরে নেই তার কীসের ধিনতাধিনা। সংসারে থাকবে ভারবাহী বলদের মতো। সৃষ্টিরক্ষার জন্যে ঈশ্বর তোমাকে ফাঁদে ফেলবেনই। তোমার নিজেরও কিছু মুখুমি থাকবে। সব মিলিয়ে ল্যাজে-গোবরে হয়ে জীবন কাটাতে হবে।