মাঝেমধ্যে এমনই এক-একটা ছাড়পত্র নিয়ে আমি অতীতে বেড়াতে যাই। পুরোনো জিনিসপত্র রাখার ঘরে একদিন হঠাৎ জ্যাঠামশাইয়ের মাছ ধরার ছিপ আর ভাঙা হুইলটা পেয়ে গেলুম। ওইটাই আমার ছাড়পত্র। অতীতের সুড়ঙ্গ বেয়ে সোজা শৈশবে। কোনও এক সকাল। পুকুরধারে বসে আছেন জ্যাঠামশাই ফাতনার দিকে চেয়ে। পাশে গোটাকতক সিগারেটের টিন—কোনওটায় চার, কোনওটায় টোপ। কালো জলে থিরথির করে হাওয়া খেলছে। মাঝে মাঝে ঘাই মেরে উঠছে বড় মাছ। দিনের শেষে নির্জন পথে পেল্লায় মাছ হাতে আমরা ফিরছি। দরজার চৌকাঠে মা দাঁড়িয়ে আছেন মৎস্যশিকারিদের সংবর্ধনা জানাতে। মা-র কাঁধে হাত দিয়ে গায়ে গা লাগিয়ে জ্যাঠাইমা। ভাঙা হুইলটাই যেন কড়কড় শব্দ করে উঠল, মাছের টানে ছিপের মাথাটা বেঁকে। গেল। বদ্ধ ঘরেই পুকুরের ভিজে হাওয়া উঠল, ঝাঁঝি, শ্যাওলা, কচুরিপানার গন্ধ এল।
ওই ঘরেই পেলুম তারের খাঁচা। পাখিটা উড়ে গেছে বহুদিন। কোথায় গেছে? কোথায় কার সঙ্গে পেতেছে সংসার! ছেলেবেলার লাটাইয়ের দুটো চাকা পেলুম। আমার এগারো বছরের বয়েসটা হাফপ্যান্ট আর শার্ট পরে সামনে দিয়ে ছুটে দুপুরের ন্যাড়া ছাদে গিয়ে উঠল। তামার মতো আকাশে চিল উড়ছে, উড়ছে আমার ময়ূরপঙ্খি।
পুরোনো বইয়ের মধ্যে থেকে পুরোনো চিঠি বেরিয়ে আসে। যিনি লিখেছেন, তিনি আর লিখবেন না। কাকার চিঠি। অমুক তারিখে আমি আসছি। কাকা আসছেন, সঙ্গে আসছে কয়েকটা আনন্দের দিন। হই-হুল্লোড়, হাত দেখা, জ্যোতিষচর্চা, হিপনোটিজম। বিশাল ছাদে চাঁদের আলোয় মাদুর পেতে আশ্চর্য সব গল্প। শেষ যেদিন এলেন সেদিন গায়ে পাঞ্জাবির বদলে টেনিস শার্ট। জামাটা হ্যাঙারে না রেখে মেঝেতে ফেলে রাখলেন। তুলে রাখছি বলতে বললেন, অত যত্ন। করে কী হবে? ইঙ্গিতটা বুঝিনি। চায়ের সঙ্গে ভালো বিস্কুট দেওয়া হল, বললেন, দিচ্ছিস দে, খেয়ে যাই। গলাটা কেমন উদাস। অনেক রাতে বললুম, কাল সকালে কোষ্ঠীটা একবার। দেখবেন। বললেন, সকালে আর সময় হবে না রে, এখুনি দে। রসিকতা ভেবে ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে অফিসে যাওয়ার আগে বলে গেলুম, তাড়াতাড়ি ফিরে এসে দুজনে বসব। বললেন, তখন তো আমি থাকব না রে! বিশ্বাস করিনি। দুটোর সময় উদ্বিগ্ন মুখে বাবা অফিসে এলেন, শিগগির চল। তখনকার কলকাতার সবচেয়ে উঁচু বাড়ি থেকে লাফিয়ে পড়ে কাকা আত্মহত্যা করেছেন। চিঠিটা হাতে নিলেই সেই ভয়ংকর ঝড়ের রাত ফিরে আসে! আকাশ ভেঙে পড়েছে মর্গ। পোস্টমর্টেমের টেবিলে শুয়ে আছেন সদা হাস্যময় কাকা। গায়ে রক্তেভেজা টেনিস শার্ট। একটা পাদুমড়েমুচড়ে গেছে।
মামার চিঠি। আমাকে সাবধানে থাকতে বলে, শরীরের যত্ন নেওয়ার কথা বলে বসন্তের এক সন্ধ্যায় নিজেই চলে গেছেন।
সময় শুধু নেয় না, কিছু মানুষকে দেউলে করে ঝুলিয়ে রাখে। সময়ের সবচেয়ে বড় রসিকতা। সময় ধার করে বেঁচে থাকা। শূন্য পাত্র হাতে নিয়ে একপাশে বসে দিন গোনা। শরীরের সন্ধিতে সন্ধিতে মৃত্যুর পরোয়ানা। চোখে সাদা পরদা, কোঁচকানো দেহত্বক বৃদ্ধ পিতাকে দেখলে মনে হয় সময়ে ফকির। ভাঁটার নদী। তারছেড়া তানপুরা। সময়ের ভীমরুল সব শুষে নিয়েছে। অ্যালবামে বিভিন্ন সময়ের ছবিতে এই দেউলে মানুষটির বহতা জীবনের ছবি আছে। পুরীর সমুদ্রতীরে, মুসৌরীর গানহিলে, সাহেবগঞ্জের পাহাড়ে। চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে দৃপ্ত ভঙ্গিতে বসে আছেন আমার যুবক বাবা। বাবার জীবনে আমার জীবনের মিলন যেন প্রবাহ পথে দুটো নদীর। মিলন। দুটো নদীই এক হয়ে চলেছে মোহনার দিকে। একজন পথের শেষে, সামনে মহাশূন্য হা হা করছে। পশ্চিম আকাশে আগুন ঢেলে সূর্য ডুবছে। আর একজন আসছে পেছনে পেছনে। দূর থেকে দেখলে লাল আকাশের পটে টিলার ওপর একটি রিক্ত মানুষের অপেক্ষার ভঙ্গিতে বসে থাকা সিয়েট। হঠাৎ দেখবে নেই। তখন সে পৌঁছে যাবে পথের শেষে।
দক্ষিণের ঘরের মেঝেতে শুয়ে হঠাৎ একদিন আটটা পেরেকের মাথা আবিষ্কার করেছি। সবকটা মেঝেতে পোঁতা। এক-একটি পেরেক এক-একটি মৃত্যুর হিসেব। ষাটটা বছর স্থির হয়ে আছে আটটা পেরেকের মাথা। দক্ষিণের এই ঘরটা হল মৃত্যুর ঘর। সিঁড়ির কাছাকাছি। দেউলে। মানুষদের বিছানা পড়ে এই ঘরে। বাঁ-দিকের দরজাটা খুলে দিলেই একটু চাতাল মতো জায়গা, সিঁড়ি নেমে গেছে ঘুরে ঘুরে। ওই তো যাওয়ার পথ। মাথার কাছে খাটের পাশে সাইড-টেবিল। ফিডিংকাপ থাকবে, দু-একটা লেবু থাকবে। ওষুধের শিশি থাকবে। স্টোর থেকে বেরোবে বেডপ্যান। থাকবে একটা চেয়ার। রাতের দিকে গম্ভীর মুখে ডাক্তার এসে বসবেন। গলায় স্টেথিসকোপ। সময়ের হিসেব নেবেন। প্রেসক্রিপশান লিখবেন। তিরিশ বছর আগে আসতেন জয়ন্ত ডাক্তার। এখন হয়তো আসবেন ডাক্তার কুশারী। ঘাড় ঘোরালেই দেখা যাবে তিনি নেমে যাচ্ছেন সিঁড়ি দিয়ে ধীর পায়ে। গায়ে উদাসীনতার সাদা কোট। নেমে যাচ্ছে আশা। সন্ধেবেলা ঘরে কেউ ধুনো দিয়ে যাবে। অনেকদিনের অসুখ-অসুখ গন্ধ যদি একটু কাটে। দেয়ালে ঝুলছে আগে আগে যাঁরা গেছেন তাঁদের ভরা-দিনের ছবি।
হঠাৎ একদিন দরজার বাইরে ফিশফিশ কথা শোনা যাবে। লোকটির সময় শেষ হয়েছে। একটা রাত কাটে কি না সন্দেহ। মাথার কাছের জানলা ধরে দাঁড়িয়ে আছে রাতের উদার আকাশ। টিপটিপ করে জ্বলছে সময়ের রাজারা হাজার হাজার বছর ধরে যারা পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে, আরও লক্ষ লক্ষ বছর থাকবে। তন্দ্রার ঘোরে সারাজীবন একবার ঘুরে যাবে। ওই তো সেই শিশু, মা-র কোলে, সন্ধ্যার শাঁখ বাজছে। ওই তো সেই কিশোর, বাবার হাত ধরে প্রথম স্কুলে যাচ্ছে। ওই তো সেই যুবক, কলেজে চলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের করিডরে একটি মেয়ের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলছে—প্রথম প্রেম। ওই তো বসেছে বিয়ের পিঁড়িতে। গলায় রজনীগন্ধার মালা। ফুলশয্যার বিছানা। চলে যাওয়া জীবন, চলে যাওয়া মুহূর্তের স্রোত উলটো বইছে।