মা মারা যাওয়ার পর একদিন বাক্স খুলে মা-র ফুল হাতা নীল সোয়েটারটা উলটে-পালটে দেখেছিলুম। যে অঙ্গে একদিন এই সোয়েটারটা উষ্ণতা দিত সে অঙ্গ বহুদিন আগে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘ্রাণ নিয়ে দেখলুম, মা-র গন্ধ লেগে আছে কি না। না, একটা পুরোনো ধুলো-ধুলো গন্ধ ছাড়া আর কিছু নিশ্বাসে পেলুম না। হঠাৎ আবিষ্কার করলুম পিঠের দিকে একটা লম্বা চুল জড়িয়ে আছে। সোঁয়া-সোঁয়া উলের সঙ্গে আটকে আছে। নিশ্চয়ই মা-র চুল। শেষ যে দিন সোয়েটার খুলে রেখেছিলেন, সেই দিন হয়তো আটকে গিয়েছিল। একগাছা চুল পড়ে আছে, মানুষটি কিন্তু বহুদিন চলে গেছেন। হঠাৎ যেন সময়ের উজান বেয়ে শৈশবকে ধরে ফেললুম। চলে গেলুম জামতাড়ার এক খোলা মাঠে। শীতের সকাল। দূরে একটা ঝাপসা পাহাড়। তিনটি চরিত্র সামনে এসে দাঁড়াল। বাবার যৌবন, আমার শৈশব, মা-র মৃত্যুর আগের বছর। মা আমার হাত ধরে ধীরে ধীরে শিশিরভেজা কাঁকুরে মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে চলেছেন। ক্লান্ত চলার ভঙ্গি। মাথায় সিল্কের স্কার্ফ। পেছন থেকে বাবা হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন,—সাপ, সাপ। মা আমার হাত ধরে ছিটকে সরে এলেন। কুচকুচে কালো রঙের একটা সাপ এঁকেবেঁকে চলেছে। মা। আমাকে জড়িয়ে ধরে কোলে তুলে নিতে চাইছেন, বুকের কাছে। অসুস্থ শরীর। শক্তি নেই। পেরেও পারছেন না। বাবার হাতে একটা পাথর। বলছেন ভয় নেই, ভয় নেই। সোয়েটার গায়ে ফেলে বত্রিশ বছর আগের মা-র স্পর্শ পাওয়ার জন্যে আমার প্রৌঢ় শরীর আকুল হয়ে উঠল। সময় হেসে বললে, অনেক দূরে চলে গেছি। তোমার জীবনের কোমল মুহূর্তটি তুমি চিরকালের গর্ভে ফেলে দিয়েছ, আর ফিরে পাওয়ার উপায় নেই।
ফিরে পাব না ছাত্রজীবনের সঙ্গীদের শিক্ষকদের। জীবনে বিকেল ঘুরে ঘুরে আসে কিন্তু সব বিকেলই এক নয়। গঙ্গার ধারে একদিন যাদের সঙ্গে বসে পালতোলা নৌকো দেখতুম, যে ছেলেটি চকখড়ি দিয়ে ঘাটের বাঁধানো পৈঠেতে ডেভিড কপারফিল্ডের, মিঃ ক্রিকলের ছবি আঁকত সুন্দর কার্টুনের ঢঙে, কিংবা যে ছেলেটি অপূর্ব সুরেলা গলায় বৈজু বাওরার গান গাইত, বচপনকে মহব্বতকো দিল সে না জুদা করনা, সেই শচীন, সেই নীতু আর কোনওদিনও ওই ঘাটের সেই জায়গাটায় এসে বসবে না। বহু গান, বহু হাসি, বহু আলোচনা ভেসে চলে গেছে। কে কোথায় ছিটকে গেছি জানি না।
বর্ষা গেছে, শীত এসেছে, গঙ্গা বয়ে চলেছে আজও; ঘাটের পৈঠেতে শ্যাওলা আরও পুরু হয়েছে। যেখানেই থাকুক নীতুর চুলে পাক ধরেছে, শচীন আছে কি নেই বলা শক্ত। পুরোনো রেকর্ডে বৈজু বাওরার গানটা যখনই কানে আসে, তখনই আমার ছাত্রজীবন সামনে এসে দাঁড়ায়। চোখের সামনে নীতুকে দেখতে পাই। বিষণ্ণ মুখ। ডেনরি-অন-শোন-এর ছেলে কলকাতায় এসেছিল পড়তে। থাকত মামার বাড়িতে, বড় কষ্ট করে। এখন কোথায় আছে? কোন নগরে, কোন বন্দরে! এখনও গান গায়, কে শোনে?
গঙ্গার পাতায় আজও মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা ভাঙা নৌকো। নৌকোটা ছিল রজনী মাঝির। ঘাটে বাঁধা থাকত। ঢেউয়ের দোলায় দুলত। পরীক্ষার পর পড়ার চাপ যখন কম থাকত তখন। জ্যোৎস্না রাতে আমরা নৌকোটায় বসে জলের আওয়াজ শুনতুম, ভবিষ্যৎ জীবনের পরিকল্পনা তৈরি করতুম। এক সময় লণ্ঠন হাতে রজনী পাড়ে এসে দাঁড়াত। হেঁকে বলত—জোয়ার আসছে নৌকো খোলো। রজনী মারা গেছে বহুকাল। তার ঘরের চাল উড়ে গেছে, দেওয়াল পড়ে গেছে। তার ঘরের সব গোপন অংশ বাইরের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে। চালের বাতায় রজনীর হুঁকোটা এখনও বাঁধা আছে। দাওয়ার পাশে পাতা উনুনের একপাশ ধসে পড়েছে। দীর্ঘকালের। রান্নার স্মৃতি দেওয়ালের গায়ে কালো হয়ে আছে। মাছ ধরার জালটা মাকড়সার জালের মতো একপাশে ঝুলছে। কখনও কখনও শৈশব খুঁজতে গঙ্গার ধারে সন্ধ্যার অন্ধকারে গেলে রজনীর নৌকোটাকে মনে মনে তুলে আবার জলে ভাসাই। সঙ্গীসাথীদের ডেকে ডেকে জড়ো করি। কান খাড়া করে থাকি কখন রজনীর ডাক শুনব—মাঝি নৌকো ভাসাও জোয়ার আসছে।
দেয়ালের হুকে একটা তম্বুরা ঝুলছে। ছুটির দিনের দুপুরে আমাকে চুপিচুপি কাছে ডাকে। সময়ের জলাশয় থেকে কুড়ি বছর আগের কয়েকটা মুহূর্ত বড়শি গেঁথে তুলে আনি। দক্ষিণের। বারান্দা দিয়ে ঝুঁকে আছে একটি যুবক রাস্তার দিকে। আমারই যৌবন। দূরে রাস্তার মোড়ে দেখা যাচ্ছে দীর্ঘকায়, গৌরবর্ণ এক বৃদ্ধ হনহন করে এগিয়ে আসছেন, বগলে তম্বুরা। আমার দাদু। কানাইবাবুর দোকান থেকে পুরোনো তম্বুরা কিনে আনছেন দাদু। হাঁটুগেড়ে বসে সুর বাঁধছেন। চোখ বুজিয়ে সুর ছাড়তে ছাড়তে বলছেন আহা, যেন কাঁসর-ঘণ্টা বাজছে, ওঁকার ধ্বনি উঠছে। দাদু গাইছেন আমার দিন যে আগত দেখি জগৎ জননী। দু-চোখ বেয়ে জলের ধারা নামছে।
টাটায় গিয়ে দাদু মারা গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, রোজ একটু করে ধুলো ঝেড়ো পান্তুরানি। আমাকে আদর করে ওই নামেই ডাকতেন। আমি ভালো হয়ে এসে আবার গান। শোনাব, ওঠো মা করুণাময়ী খোল গোকুটির দ্বার। দাদু আর ফিরলেন না, মৃত্যুর পাঁচ মিনিট আগে পুত্রবধূকে বললেন—তুলে বসিয়ে দাও, পান্তুরানিকে বলো তানপুরাটা দিতে, গানটা গাই। ইউরেমিয়ার যে কণ্ঠ প্রায় বুজে এসেছিল হঠাৎ ছেড়ে গেল। দাদু গাইতে গাইতে চলে গেলেন—ওঠো মা করুণাময়ী খোল গো কুটির দ্বার, আঁধারে হেরিতে নারি হৃদি কাঁদে অনিবার।