বারান্দায় পুবের বাঁকে যেখানে সকালের রোদ থইথই করে, সেখানে ছেলেবেলায় মা আমাকে রোজ স্নান করাতেন। কাঠের পিঁড়ে পেতে লোহার বালতি থেকে রোদের তাতে ঠান্ডা কমে যাওয়া জল ঘটি করে মাথায় ঢেলে দিতেন। জল ঢালতে ঢালতে একটা জলাশয় মতো হত, আমি তখন। সাঁতার কাটার চেষ্টা করতুম। মা তখন পিঠে ফুলো চড় মেরে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিতেন। মা-র হাতের চুড়ি কিনকিন করে উঠত। সেই বারান্দার বাঁকে এখনও সকালের রোদ জমা হয়। মা কিন্তু বহুদিন চলে গেলেন। এখন হাজার চেষ্টা করলেও শৈশব আর ফিরবে না, মা-ও আর ফিরে আসবে না। বারান্দার ও জায়গাটায় এখন নীল প্লাস্টিকের বালতিতে জল থাকে। রোদ খেলা করে জল থেকে ছিটকে ওঠে উলটো দিকের দেওয়ালে। ছেলেবেলায় জলটাকে দুলিয়ে দিয়ে দেওয়ালের গায়ে রোদের প্রতিফলনকে নৃত্যচঞ্চল করে ভোলা একটা মজার খেলা ছিল। এখন আর সে বয়স নেই। অথচ জলও আছে, রোদও আছে। কোনওভাবে তিরিশটা বছর পেছোতে পারলে আবার সেই মুহূর্তগুলো ফিরে পেতাম। সময় বড় একমুখী। নদীতে তবু জোয়ার-ভাটা আছে, জল যায় আবার ফিরে আসে, সময়ের নদীতে কেবলই ভাটার টান।
আমাদের ঠাকুরঘরের কুলুঙ্গিতে একটা মা লক্ষ্মীর পট আছে। চল্লিশ বছর আগে এক শীতের সকালে মা, জ্যাঠাইমা, পিসিমারা কালীঘাটে গিয়ে ওই পটটা কিনেছিলেন। মা লক্ষ্মী এখনও সেই কুলুঙ্গিতে আছেন। তলার দিকটা এক ধরনের পোকা তিল তিল করে খেয়ে চলেছে, তবু মুখের হাসি অম্লান। সেই পুরোনো পেতলের প্রদীপ সন্ধ্যায় কেঁপে কেঁপে জ্বলে। সারা ঘরে সেই একই ভাবে ছায়া কাঁপে। আজও কেউ না কেউ গলায় আঁচল দিয়ে হাঁটু মুড়ে প্রণাম করে; তবে সে আমার মা-ও নয়, জ্যাঠাইমাও নয়। অথচ এই একই ঘরে তিরিশ বছর আগে আমার শৈশব বসে থাকত বাবু হয়ে, একপাশে মা, একপাশে জ্যাঠাইমা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। প্রদীপ কাঁপত ছায়া নিয়ে দেওয়ালের গায়ে। উপাসনার বই খুলে জ্যাঠাইমা সুর করে পড়তেন, মাতঃ সরস্বতী, ভগবতী ভারতী। আমরাও সেই সুরে সুর মিলিয়ে সন্ধ্যাকে রাতের দিকে নিয়ে যেতুম। রাতের পর রাত পেরিয়ে আজ যেখানে এসে দাঁড়িয়েছি সেখানে সন্ধ্যা আছে, প্রদীপ আছে, পট আছে, এমনকী পাতা খোলা বিবর্ণ কীটদষ্ট উপাসনার বইটাও আছে, নেই কেবল শৈশব। অথচ মাঝে মাঝে মনে হয় শৈশবটা হারায়নি, কোথাও না কোথাও ফুলের দাগের মতো, সিঁদুরের টিপের মতো লেগে আছে। মাতৃজঠরের জ্বণের মতো প্রৌঢ় আমি-র সঙ্গে তার নাড়ির যোগ রয়েছে, জঠরের শিশুর মতো মাঝে মাঝে নড়েচড়ে উঠছে, কেবল ভূমিষ্ঠ হতে পারছে না। যেন বহুকাল আগে নদীর জলে হারিয়ে যাওয়া একটি মুদ্রা। স্তরে স্তরে পলি জমেছে তার ওপর। স্রোত খেলা করে চলেছে। অদৃশ্য হলেও আছে। শৈশবের কাঠিমেই পরতে পরতে জড়িয়েছে সময়ের সুতো। দৌড়োতে পারিনি বলেই সময় আমাকে ছেড়ে ক্রমশ দূর থেকে দূরেই চলে যাচ্ছে।
আমাদের বাগানে একটা নিমগাছ আছে। আমাদের দুজনের বয়েসই প্রায় এক। আমার শৈশব এই গাছের তলায় এক সময় খেলা করত। হাত বাড়িয়ে নিমপাতা পাড়তুম। সেই গাছ এখন। বিশাল মহীরুহ। তার সমস্ত ডালপালা এখন আমার নাগালের বাইরে। ধুলোখেলার বয়স যখন ছিল তখন গাছটার কাণ্ডে একটা পেতলের ড্রপিং পিন মেরে দিয়েছিলুম। সেই পেতলের টিপ এখন চব্বিশ ফুট উঁচুতে। ছুটির দুপুরে গাছটার রোদ ছিটোনো পাতার দিকে তাকিয়ে মনটা যখন হু-হু করে ওঠে তখন গাছের সঙ্গে কথা বলি,—তুমি আছ কিন্তু অনেকেই নেই। তুমি আমার সহজ অঙ্ক। জীবনের বছরের হিসেবে সময়কে আমি তোমার জন্যেই ফুটে মাপতে পারছি। ওই যে পেতলের টিপ, ঊর্ধ্বে মাত্র চব্বিশ ফুট এগিয়েছে। চব্বিশ ফুটেই আমি রিক্ত, নিঃস্ব, পোড়োবাড়ির প্রৌঢ় পুরোহিত। সময় আর কয়েক ফুট এগোলেই আমার খেলা শেষ।
দক্ষিণের ঘরে একটা ইজিচেয়ার পাতা আছে। বহুকাল আগে জ্যাঠামশাই এই চেয়ারটায় বসতেন। শীতকালে গায়ে জড়ানো থাকত বাদামি রঙের কাশ্মীরী শাল। একটা হাঁটুর ওপর আমি চেপে বসতুম। সমানে চলত নানা আবদার।
ইজিচেয়ারটা এখনও পাতা আছে। হাতলে এখনও হয়তো জ্যাঠামশাইয়ের চায়ের কাপের তলা থেকে লেগে যাওয়া চায়ের শুকনো দাগ খুঁজলে পাওয়া যাবে। আমি মাঝে মাঝে নাট্যকারের মতো পুরোনো দৃশ্য সাজাবার চেষ্টা করেছি জ্যাঠামশাইকে ফিরিয়ে এনেছি, জ্যাঠাইমাকে বসিয়েছি ড্রেসিং টেবিলের সামনে চুল বাঁধতে। মাকে একই সময় বসিয়েছি খাটের পাশে, আমাকে রেখেছি ঘরের মেঝেতে জ্যাঠামশাইয়ের কালো চটি জোড়ার পাশে, হাতে দিয়েছিদম দেওয়া খেলনা—একটা জাপানি ট্যাঙ্ক। শূন্য ঘরে সময়কে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছি, পরমুহূর্তে শূন্যতা আরও বেড়েছে, হঠাৎ আলোর পর অন্ধকার আরও গভীর হয়েছে। আয়না আমারই বিষণ্ণ মুখ আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে, চেয়ার বলতে চেয়েছে—তুমিই এখন বোসো, এরপর অন্য কেউ বসবে। খাট বলেছে আমার স্মৃতি নেই, তাই আমি কাষ্ঠকঠিন।
বাদামি শালটার ওপর দিয়ে সময়ের স্রোত বয়ে গেলেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। শালটার গায়ে অস্পষ্ট একটু কালির দাগ লেগে আছে। এটা মঙ্গলার কাজ। মঙ্গলা আমার ছেলেবেলার। বেড়াল। মশারির চাল বেয়ে খড়খড় করে ওপরে উঠে গিয়ে দুষ্টু দুষ্টু মুখে নীচের দিকে তাকাত, তাল খুঁজত ঘাড়ে লাফিয়ে পড়ার। সেই মঙ্গলা কালির দোয়াত উলটে দিয়েছিল শালের ওপর। শালের মালিক এখন আর নেই। মঙ্গলাকে প্রচণ্ড প্রহার করা হয়েছিল। পরের দিন মঙ্গলা মারা। গেল। তার সঙ্গে আমার জীবনের যোগ রয়ে গেল এই কালির দাগে। অস্পষ্ট দাগটা যেন আমার কোলের কাছে শুয়ে থাকা গুটিশুটি মঙ্গলা। একদিন সে ছিল, এই দাগটা তার প্রমাণ।