নবীনবাবুর হৃদয় কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল। খানিকক্ষণ কালাচাঁদের সঙ্গে সুখ-দুঃখের কথা বলে তিনি ফিরে এলেন। গিন্নি ঘি আর গরম মশলা দেখে খুব খুশি। বললেন, ওগো, দোকানটা খোকাকে চিনিয়ে দিয়ে তো! দরকারমতো ওকেও পাঠাতে পারব। তা হ্যাঁগো, দোকানটা কি নতুন খুলেছে? আজ দাসবাড়ির গিন্নি গল্প করতে এসেছিল। কথায় কথায় তাকে কালাচাঁদের দোকানের কথা বললুম। কিন্তু সে তো আকাশ থেকে পড়ল, বলল, সাতজন্মে কালাচাঁদের দোকানের কথা শুনিনি।
হবে হয়তো, নতুনই খুলেছে। আমি খোঁজ নিয়ে বলবখন।
দু-দিন পর ফের কালোজিরে আর ময়দা আনতে গিয়ে নবীনবাবু বললেন, তা হ্যাঁ কালাচাঁদবাবু, আপনার দোকানটা কতদিনের পুরোনো?
কালাচাঁদ ঘাড়টাড় চুলকে অনেক ভেবে বলল, তা কম হবে না। ধরুন, এ-গাঁয়ের পত্তন থেকেই আছে।
নবীনবাবুর একটু খটকা লাগল। দোকান যদি এত পুরোনোই হবে তাহলে দাস-গিন্নি এ-দোকানের কথা শোনেনি কেন?
কালাচাঁদ যেন তাঁর মনের কথা পড়ে নিয়েই বলল, এ-গাঁয়ে আমার অনেক শত্রু। লোকের কথায় কান দেবেন না।
আচ্ছা, তাই হবে।
পরদিন নবীনবাবু এক বাড়িতে নারায়ণপুজোর নেমন্তন্ন খেয়ে ফেরার পরই গিন্নি বললেন, হ্যাঁগা, তোমার কালাচাঁদের দোকানটা কোথায় বলো তো! খোকাকে কুয়োর দড়ি আনতে পাঠিয়েছিলাম, সে তো দোকানটা খুঁজেই পেল না। পোস্ট অফিসের পিয়োন বিলাস এসেছিল। সেও বলল, ওরকম দোকান এখানে থাকতেই পারে না। বলল, নবীনবাবুর মাথাটাই গেছে।
নবীনবাবুর বুকের মধ্যে একটু যেন কেমন করল। মুখে বললেন, কালাচাঁদের সঙ্গে অনেকের শত্রুতা আছে কিনা, তাই ওরকম বলে।
পরদিন টর্চের ব্যাটারি আনতে গিয়ে নবীনবাবু একথা-সেকথার পর কালাচাঁদকে বললেন, তা। কালাচাঁদবাবু, আমার ছেলেও কাল আপনার দোকানটা খুঁজে পায়নি।
কালাচাঁদ বিনয়ের সঙ্গে বলল, আর কাউকে পাঠানোর দরকার কী? নিজেই আসবেন।
ইয়ে অন্যরা সব বলছে যে, কেউ নাকি এ-দোকানের কথা জানে না।
কালাচাঁদ তেমনই মৃদুমৃদু হেসে বলে, জানার দরকারই বা কী? আপনার ওসব নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।
নবীনবাবুর বুকটা একটু দুরদুর করে উঠল। বললেন, হ্যাঁ, তা আমি তো আমিই। কিন্তু আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনো খদ্দের কখনো দেখি না। দোকানটা চলে কী করে?
কালাচাঁদ বিনীতভাবে বলল, একজনের জন্যই তো দোকান।
অ্যাঁ!
কালাচাঁদ হাসল, আসবেন।
নবীনবাবু চলে এলেন। কিন্তু তারপর আবার পরদিনই গেলেন। মাসের শেষ, হাতে টাকা নেই। খুব সংকোচের সঙ্গে বললেন, কয়েকটা জিনিস নেব। ধারে দেবেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ, কেন নয়?
পরের মাসে মাইনে পেয়েই দিয়ে যাব।
তাড়া কীসের?
ধারে প্রচুর জিনিস নিয়ে এলেন নবীনবাবু। পরের মাসে ধার শোধ করতে গেলে কালাচাঁদ জিভ কেটে বলল, না না, অত নয়। আমার হিসেব সব লেখা আছে। পাঁচটি টাকা মোটে পাওনা। তাও সেটা দু-দিন পর হলেও চলবে। বসুন, একটু সুখ-দুঃখের কথা কই। টাকাপয়সার কথা থাক।
নবীনবাবু খুবই অবাক হলেন! পাঁচ টাকা পাওনা! বলে কী লোকটা? তিনি অন্তত দেড়শো টাকার জিনিস নিয়েছেন।
তা এভাবেই চলল। চাল, ডাল, মশলাপাতি, ঘি, তেল সবই কালাচাঁদের দোকান থেকে আনেন নবীনবাবু। মনোহারী জিনিস, বাচ্চাদের খেলনা, পোশাক, শাকসবজিও ক্রমে-ক্রমে আনতে লাগলেন। মাছমাংসও পাওয়া যেতে লাগল কালাচাঁদের আশ্চর্য দোকানে। গিন্নি খুশি। নবীনবাবুর মাইনে অর্ধেকেরও ওপর বেঁচে যাচ্ছে।
নবীনবাবু একদিন গিন্নিকে বললেন, ওগো, নিত্যানন্দপুর থেকে বদলি হওয়ার দরখাস্তটা আর জমা দেওয়া হয়নি।
দিয়ো না। হ্যাঁগো, কালাচাঁদের দোকানটা ঠিক কোথায় বলো তো! আমাকে একদিন নিয়ে যাবে?
নবীনবাবু শশব্যস্তে বললেন, না, না, তোমাদের কারও যাওয়ার দরকার নেই। সকলের কী সব সয়?
গিন্নি চুপ করে গেলেন।
নবীনবাবু নিত্যানন্দপুরেই রয়ে গেলেন।
কালীচরণের ভিটে
কালীচরণ লোকটা একটু খ্যাপা গোছের। কখন যে কী করে বসবে, তার কোনো ঠিক নেই। কখনো সে জাহাজ কিনতে ছোটে, কখনো আদার ব্যবসায় নেমে পড়ে। আবার আদার ব্যাবসা ছেড়ে কাঁচকলার কারবারে নেমে পড়তেও তার দ্বিধা হয় না। লোকে বলে, কালীচরণের মাথায় ভূত আছে। সেকথা অবশ্য তার বউও বলে। রাত তিনটের সময় যদি কালীচরণের পোলাও খাওয়ার ইচ্ছে হয় তো, তা সে খাবেই।
তা, সেই কালীচরণের একবার বাই চাপল। শহরের ধুলো-ধোঁয়া ছেড়ে দেশের বাড়ির প্রাকৃতিক পরিবেশে গিয়ে বসবাস করবে। শহরের পরিবেশ ক্রমে দূষিত হয়ে যাচ্ছে বলে রোজ খবরের কাগজে লেখা হচ্ছে। কলেরা, ম্যালেরিয়া, জণ্ডিস, যক্ষ্মা–শহরে কী নেই?
কিন্তু কালীচরণের এই দেশে গিয়ে বসবাসের প্রস্তাবে সবাই শিউরে উঠল। কারণ, যে গ্রামে কালীচরণের আদি পুরুষরা বাস করত, তা একরকম হেজেমজে গেছে। দু-চারঘর নাচার চাষাভুষো বাস করে। কালীচরণদের বাড়ি বলতে যা ছিল, তাও ভেঙেচুরে জঙ্গলে ঢেকে ধীরে-ধীরে মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সেই বাড়িতে গত পঞ্চাশ বছর কেউ বাস করেনি, সাপখোপ, ইঁদুর-দুচো, চামচিকে, প্যাঁচা ছাড়া।
কিন্তু কালীচরণের গোঁ সাংঘাতিক। সে যাবেই।
তার বউ বলল, থাকতে হয় তুমি একা থাক গে। আমরা যাব না।
বড়ো ছেলে মাথা নেড়ে বলল, গ্রাম! ও বাবা, গ্রাম খুব বিশ্রি জায়গা।
মেয়েও চোখ বড়ো বড়ো করে বলে গ্রামে কি মানুষ থাকে?