এবার নবীনবাবু নিত্যানন্দপুর বলে একটা জায়গায় বদলি হলেন। খবরটা পেয়েই গিন্নি বললেন, আমি যাব না, তুমি যাও। আমি এখানে বাসা ভাড়া করে থাকব। আর বদলি আমার পোষাচ্ছে না বাপু!
নবীনবাবু মাথা চুলকে বললেন, তাতে খরচ বাড়বে বই কমবে না। ওখানে আমারও তো আলাদা ব্যবস্থা করতে হবে। দুটো এস্টাব্লিশমেন্ট টানব কী করে?
গিন্নি বললেন, ঠিক আছে, যাব। কিন্তু তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে হবে এরপর বদলি করলে তুমি কিছুতেই বদলি হতে রাজি হবে না। সরকারকে পরিষ্কার জানিয়ে দিতে হবে যে, তুমি দরকার হলে মামলা করবে। তোমার মতো মেনিমুখো পুরুষদের পেয়েই তো নাকে দড়ি দিয়ে ওরা ঘোরায়।
নবীনবাবু মিনমিন করে বললেন, একখানা দরখাস্ত নিয়ে ওপরওয়ালার সঙ্গে দেখা করেছিলাম। তা তিনি বললেন, নিত্যানন্দপুর থেকে আর বদলি করবে না। দেখা যাক।
বাক্স-প্যাঁটরা গুছিয়ে সপরিবার এক শীতের সন্ধেবেলা নবীনবাবু নিত্যানন্দপুরে এসে পৌঁছোলেন। বেশ ধকল গেল। ট্রেন থেকে নেমে অনেকটা পথ গোরুরগাড়িতে এসে তারপর আবার নদী পেরিয়ে আরও ক্রোশ দুই পথ পেরোলে তবে নিত্যানন্দপুর। গঞ্জমতো জায়গা। তবে নিরিবিলি, ফাঁকা ফাঁকা।
রাত্রিটা পোস্টমাস্টার মশাইয়ের বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন একখানা বাসা ভাড়া করলেন। পাকা বাড়ি, টিনের চাল। উঠোন আছে, কুয়ো আছে।
জায়গাটা ভালোও নয়, মন্দও নয়। ওই একরকম। তবে ভরসা এই যে, আর বারবার ঠাঁইনাড়া হতে হবে না। ওপরওয়ালা কথা দিয়েছে, এখানেই বাকি চাকরির জীবনটা কাটাতে পারবেন নবীনবাবু।
তাঁর স্ত্রী অবশ্য নাক সিঁটকে বললেন, কী অখেদ্দে জায়গা গো! এ যে ধাপধাড়া গোবিন্দপুর! অসুখ হলে ডাক্তার-বদ্যি পাওয়া যাবে কিনা খোঁজ নিয়ে দেখো। দোকানপাটও তো বিশেষ নেই দেখছি। বাজারহাট কোথায় করবে?
নবীনবাবু বললেন, বাজার এখান থেকে এক ক্রোশ। তাও রোজ বসে না। হপ্তায় দু-দিন হাট।
তবেই হয়েছে। এখানে ইস্কুলটা কেমন খোঁজ নিয়েছ?
ইস্কুল একটা আছে মাইলটাক দূরে। কেমন কে জানে!
জায়গাটা এমন বিচ্ছিরি বলেই এখান থেকে তোমাকে আর বদলি না-করতে ওপরওয়ালা সহজেই রাজি হয়ে গেছে। এখন মরি আমরা এখানে পচে।
নবীনবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কী আর করা! নিত্যানন্দপুরেই মানিয়ে-গুছিয়ে নিতে হবে।
প্রথমদিন বাজার করতে দু-ক্রোশ দূরে গিয়ে বেশ দমেই গেলেন তিনি। জিনিসপত্রের দাম বেশ চড়া। প্রত্যন্ত গাঁ, এখানে জিনিস আনতে ব্যাপারীদের অনেক খরচ হয়। জিনিসপত্র তেমন ভালোও নয়। পাওয়া যায় না সব কিছু।
বাজারের হাল শুনে গিন্নি চটলেন। বললেন, আবার দরখাস্ত করে অন্য জায়গায় বদলি নাও। এ জায়গায় মানুষ থাকে? মা গো!
নবীনবাবু ফাঁপরে পড়লেন। এখন কী করা যাবে তাই ভাবতে লাগলেন।
একদিন সন্ধেবেলা গিন্নি এসে বললেন, ওগো, খুকি তেলের শিশিটা ভেঙে ফেলেছে। একটি ফোঁটাও তেল নেই আর। রাতে রান্না হবে কী দিয়ে?
দেখো না একটু খুঁজেপেতে। অনেক গেরস্তবাড়িতে ছোটোখাটো জিনিস পাওয়া যায় শুনেছি।
অগত্যা নবীনবাবু বেরোলেন। বেশি লোকের সঙ্গে চেনাজানা হয়নি এখনও। কার বাড়ি যাবেন ভাবছেন। ডানহাতি পথটা ধরে হাঁটছেন। ডান ধারে একটু জঙ্গলমতো আছে। হঠাৎ দেখতে পেলেন, জঙ্গলের একটু ভেতর দিকে একটা আলোই যেন জ্বলছে মনে হল। নবীনবাবু কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ঠাহর করে দেখলেন, একখানা ঝাঁপতোলা দোকান বলেই যেন মনে হচ্ছে। নবীনবাবু এগিয়ে গিয়ে দেখলেন, দোকানঘরই বটে। দীনদরিদ্র চেহারা হলেও দোকানই। কালো রোগাপানা কণ্ঠধারী একজন লোক দোকানে বসে আছে। বিনয়ী মানুষ। নবীনবাবুকে দেখেই টুল থেকে উঠে বলল, আজ্ঞে আসুন।
নবীনবাবু খুশি হলেন। আজকাল বিনয় জিনিসটা দেখাই যায় না। সরষের তেলের খোঁজ করতেই লোকটা বলল, আছে। ভালো ঘানির তেল।
কত দাম?
লোকটা হেসে মাথা চুলকে বলল, দাম তো বেশ চড়া। তবে আপনার কাছ থেকে বেশি নেব না। ছ-টাকা করেই দেবেন।
নবীনবাবু খুবই অবাক হলেন, দু-ক্রোশ দূরের বাজারে তেল দশ টাকা। নবীনবাবু আড়াইশো গ্রাম তেল কিনে আনলেন। গিন্নি তেল পরীক্ষা করে বললেন, বা, এ তো দারুণ ভালো তেল দেখছি। কোথায় পেলে গো?
নবীনবাবু বললেন, আরে, কাছেই একটা বেশ দোকানের সন্ধান পেয়েছি। লোকটা বড়ো ভালো।
লোকটা যে সত্যিই ভালো তার প্রমাণ পাওয়া গেল দু-দিন পরেই। ডাল ফুরিয়েছে। সন্ধের পর সেই দোকানে গিয়ে হানা দিতেই বিনয়ী লোকটা প্রায় অর্ধেক দামে ডাল দিল। বলল, আপনাকে দাম দিতে হবে না।
নবীনবাবু ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার নামই তো জানি না এখনও।
আজ্ঞে কালাচাঁদ নন্দী। কালো বলেই ডাকবেন।
আপনি কি সব জিনিসই রাখেন কালোবাবু?
যে আজ্ঞে। তবে সন্ধের পর আসবেন। দিনমানে আমি দোকান খুলি না। ও-সময়ে আমার চাষবাস দেখতে হয়।
দিন দুই পর গিন্নি হঠাৎ বললেন, ওগো, আজ একটু পোলাও খাওয়ার বায়না ধরেছে ছেলে মেয়েরা। ঘি আর গরম মশলা লাগবে। এনে দেবে নাকি একটু?
কালোর দোকানে ঘি বা গরম মশলা পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছিল না নবীনবাবুর। দোনোমনো করে গেলেন।
কালাচাঁদ বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কেন পাবেন না? এক নম্বর ঘি আছে, আর বাছাই গরমমশলা।
দাম?
দাম তো অনেক। তবে আপনাকে অত দিতে হবে না। দশ টাকা করেই দেবেন।