দুপুর পেরিয়ে গাঁয়ে ঢুকে কেশব মোড়লের বাড়িতে একটু বিশ্রাম করে ইঁদারার দিকে রওনা হলেন। সঙ্গে গোবিন্দপুর আর আশপাশের গাঁয়ের হাজার হাজার লোক।
ভারি সুন্দর একটা জায়গায় ইঁদারাটি খোঁড়া হয়েছিল। চারদিকে কলকে ফুল আর ঝুমকো জবার কুঞ্জবন, একটা বিশাল পিপুলগাছ ছায়া দিচ্ছে। ইঁদারার চারধারে বড়ো বড়ো ঘাসের বন। পাখি ডাকছে, প্রজাপতি উড়ছে।
কেশব আস্তে আস্তে হাঁদারার ধারে এসে দাঁড়ালেন। মুখখানা গম্ভীর। সামান্য ঝুঁকে জলের দিকে চাইলেন। সত্যিই কাকচক্ষু জল। টলটল করছে। কেশব আস্তে করে বললেন, কে আছিস! উঠে আয়, নইলে থুতু ফেলব।
এই কথায় কী হল কে জানে। ইঁদারার মধ্যে হঠাৎ হুলুস্থুল পড়ে গেল। প্রকান্ড প্রকান্ড ঢেউ দিয়ে জল একেবারে হাঁদারার কানা পর্যন্ত উঠে আসতে লাগল। সেই সঙ্গে বোঁ বোঁ বাতাসের শব্দ।
লোকজন এই কান্ড দেখে দে-দৌড় পালাচ্ছে। শুধু চক্কোত্তিমশাই ভয়ে কাঁপতে কাঁপতেও একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছেন।
থুতু ফেলবেন না, থুতু ফেলবেন না। বলতে বলতে ইঁদারা থেকে শয়ে শয়ে ভূত বেরোতে থাকে। চেহারা দেখে ভড়কাবার কিছু নেই। রোগা লিকলিকে কালো কালো সব চেহারা, তাও রক্তমাংসের নয়–ধোঁয়াটে জিনিস দিয়ে তৈরি। সব কটার গা ভিজে সপসপ করছে, চুল বেয়ে জল পড়ছে।
কেশব তাদের দিকে চেয়ে গম্ভীর হয়ে বললেন, ঢুকেছিলি কেন এখানে?
আজ্ঞে ভূতের সংখ্যা বড়ই কমে যাচ্ছে যে! এই ইঁদারার জল খেয়ে এ তল্লাটের লোকের রোগবালাই নেই। একশো-দেড়শো বছর হেসে-খেলে বাঁচে! নামলে ভূত হয় কেমন করে? তাই ভাবলুম, ইঁদারাটা দখল করে থাকি।
বলে ভূতেরা মাথা চুলকোয়।
কেশব বললেন, অতিকূট প্রশ্ন। কিন্তু কথাটা আপাতগ্রাহ্য।
ভূতেরা আশকারা পেয়ে বলে, ওই যে চক্কোত্তিমশাই দাঁড়িয়ে রয়েছেন, ওঁরই বয়স এক-শো বিশ বছর। বিশ্বাস না-হয় জিজ্ঞেস করুন ওঁকে।
কেশব অবাক চোখে চক্কোত্তির দিকে তাকিয়ে বলেন, বলে কী এরা মশাই? সত্যি নাকি?
একহাতে ধরা পৈতে, অন্য হাতের আঙুলে গায়ত্রী জপ করে ধরে রেখে চক্কোত্তি আমতা-আমতা করে বলেন, ঠিক স্মরণ নেই।
কূট প্রশ্ন। কিন্তু আপাতগ্রাহ্য। কেশব বললেন।
ঠিক এই সময়ে চক্কোত্তির মাথায়ও ভারি কূট একটা কথা এল। তিনি ফস করে বললেন, ভূতেরা কি মরে?
কেশব চিন্তিতভাবে বললেন, সেটাও কূট প্রশ্ন।
চক্কোত্তি সঙ্গেসঙ্গে বললেন, কিন্তু আপাতগ্রাহ্য। ভূত যদি না-ই মরে, তবে সেটাও ভালো দেখায় না। স্বয়ং মাইকেল বলে গেছেন, জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে?
ভূতেরা কাঁউমাউ করে বলে উঠল, তা সে আমরা কী করব? আমাদের হার্ট ফেল হয় না, ম্যালেরিয়া, ওলাওঠা, সান্নিপাতিক, সন্ন্যাস রোগ হয় না– তাহলে মরব কীসে! দোষটা কি আমাদের?
চক্কোত্তি সাহসে ভর করে বলেন, তাহলে দোষ তো আমাদেরও নয় বাবা-সকল।
কেশব বললেন, অতিকূট প্রশ্ন।
চক্কোত্তি বলে উঠলেন, কিন্তু আপাতগ্রাহ্য।
শ-পাঁচেক ছন্নছাড়া, বিদঘুঁটে ভেজা ভূত চারদিকে দাঁড়িয়ে খুব উৎকণ্ঠার সঙ্গে কেশবের দিকে তাকিয়ে আছে। কী রায় দেন কেশব!
একটা বুড়ো ভূত কেঁদে উঠে বলল, ঠাকুরমশাই, জলে ভেজানো ভাত যেমন পান্তা ভাত, তেমনি দিনরাত জলের মধ্যে থেকে থেকে আমরা পান্তা-ভূত হয়ে গেছি। ভূতের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এত কষ্ট করলুম, সে-কষ্ট বৃথা যেতে দেবেন না।
এও অতিকূট প্রশ্ন। কেশব বললেন।
চক্কোত্তিমশাই এবার আর আপাতগ্রাহ্য বললেন না। সাহসে ভর করে বললেন, তাহলে ভূতেরও মৃত্যুর নিদান থাকা চাই। না-যদি হয় তবে আমিও ইঁদারার মধ্যে থুতু ফেলব। আর তারই বা কী দরকার! এক্ষুনি আমি সব ভূত বাবা-সকলের গায়েই থুতু ফেলছি।
চক্কোত্তিমশাই বুঝে গেছেন, থুতুকে ভূতদের ভারি ভয়। বলার সঙ্গে সঙ্গে ভূতেরা আঁতকে উঠে দশ হাত পিছিয়ে চেঁচাতে থাকে, থুতু ফেলবেন না! থুতু দেবেন না!
কেশব চক্কোত্তিমশাইকে এক হাতে ঠেকিয়ে রেখে ভূতেদের দিকে ফিরে বললেন, চক্কোত্তিমশাই যে কূট প্রশ্ন তুলেছেন, তা আপাতগ্রাহ্যও বটে। আবার তোমাদের কথাও ফেলনা নয়। কিন্তু যুক্তি প্রয়োগ করলে দেখা যায় যে, ভূত কখনও মরে না। সুতরাং ভূত খরচ হয় না, কেবল জমা হয়। অন্যদিকে মানুষ দুশো বছর বাঁচলেও একদিন মরে। সুতরাং মানুষ খরচ হয়। তাই তোমাদের যুক্তি টেকে না।
ভূতেরা কাঁউমাউ করে বলতে থাকে, আজ্ঞে অনেক কষ্ট করেছি।
কেশব দৃঢ় স্বরে বললেন, তা হয় না। ঘটি-বাটি যা সব কুয়োর জলে ডুবেছে, সমস্ত তুলে দাও, তারপর ইঁদারা ছাড়ো। নইলে চক্কোত্তিমশাই আর আমি দুজনে মিলে থু–
আর বলতে হল না। ঝপাঝপ ভূতেরা ইঁদারার লাফিয়ে নেমে ঠনঠন ঘটি-বালতি তুলতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে ঘটি-বালতির পাহাড় জমে গেল ইঁদারার চারপাশে।
পুরোনো ইঁদারায় এরপর আর ভূতের আস্তানা রইল না। ভেজা ভূতেরা গোবিন্দপুরের মাঠে রোদে পড়ে থেকে থেকে ক-দিন ধরে গায়ের জল শুকিয়ে নিল। শুকিয়ে আরও চিমড়ে মেরে গেল। এত রোগা হয়ে গেল তারা যে, গাঁয়ের ছেলেপুলেরাও আর তাদের দেখে ভয় পেত না।
কালাচাঁদের দোকান
নবীনবাবু গরিব মানুষ। পপাস্ট অফিসের সামান্য চাকরি। প্রায়ই এখানে-সেখানে বদলি হয়ে যেতে হয়। আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের ভাবসাব নেই। প্রায়ই ধারকর্জ হয়ে যায়। ঋণ শোধ দিতে নাভিশ্বাস ওঠে। নবীনবাবুর গিন্নি স্বামীর ওপর হাড়ে চটা। একে তো নবীনবাবুর ট্যাঁকের জোর নেই, তার ওপর লোকটা বড্ড মেনিমুখো আর মিনমিনে। এই যে যখন-তখন যেখানে-সেখানে বদলি করে দিচ্ছে, নবীনবাবু যদি রোখাচোখা মানুষ হতেন তবে পারত ওরকম বদলি করতে? বদলির ফলে ছেলেপুলেগুলোর লেখাপড়ার বারোটা বাজছে। আজ এ-স্কুল কাল অন্য স্কুল করে বেড়ালে লেখাপড়া হবেই বা কী করে?