আ মোলো! এ যে ভালো করতে এসে বিপদ হল।
আ-আপনি কী চান?
তোমার মতো গবেটদের কান দুটো মলে দিতেই চাই হে।
কিন্তু বিধি বাম সে উপায় নেই।
আমি কী করেছি? আপনি আমার ওপর রাগ করছেন কেন?
রাগ করব না? তিনটে কাঁচা মাথার ছোঁড়া তিন-তিনবার যে তোমাকে বোকা বানাল তা থেকে শিক্ষা পেয়েছ কি? কিছু করতে পারলে?
আজ্ঞে কী করব? তাদের হাতে যে ছোরা আর বন্দুক।
আর তোমার বুঝি কিছু নেই?
আজ্ঞে না।
কে বলল, নেই?
ইয়ে, আমার বন্দুক, পিস্তল বা ছোরাছুরি নেই। তবে আমার গিন্নির একখানা বঁটি আছে, আর আমার ছেলে ভুতোর একটা পেন্সিল কাটা ছুরি আছে, আর আমার মায়ের বেড়াল তাড়ানোর জন্য একখানা ছোটো লাঠি আছে।
আহা, ওসব জানতে চাইছে কে? বঁটি-লাঠির কথা জিজ্ঞেস করেছি কি তোমায়? বলি এসব ছাড়া তোমার আর কিছু নেই?
আজ্ঞে, মনে পড়ছে না। শুনেছি আমার ঠাকুর্দার একটা গাদা বন্ধুক ছিল।
গবেট আর কাকে বলে? বলি বন্দুক-টক ছাড়া আর কিছু নেই তোমার?
আজ্ঞে না।
বলি, বুদ্ধি বলে একটা বস্তু আছে জানো তো!
জানি।
তোমার সেটাও নেই?
আজ্ঞে, ঠিক বুঝতে পারছি না।
একটা দীর্ঘশ্বাসের আওয়াজ হল। তারপর গলার স্বরটা বলল, শোনো, এবার যখন ওই মর্কটগুলি তোমাকে পাকড়াও করবে তখন একটুও ঘাবড়াবে না। হাসি-হাসি মুখ করে শুধু জিজ্ঞেস করবে, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো!
শুধু এই কথা বললেই হবে?
বলেই দেখো না।
তৃতীয় মাসটাও কষ্টেসৃষ্টে কেটে গেল। আবারপয়লা তারিখ এল এবং হরসুন্দরবাবু আবার বেতন পেলেন।
বাড়ি ফেরার সময় বুকটা দুরুদুরু করছিল। যে-কথাটা বলতে হবে তা বারবার বিড়বিড় করে আওড়াচ্ছেন। হাত-পা-কাঁপছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। গলির মুখে একটু থমকে দাঁড়ালেন। তারপর দুর্গা বলে অন্ধকারে পা বাড়ালেন।
কয়েক পা যেতে না যেতেই তিন মূর্তি ঘিরে ফেলল তাঁকে। বুকে পিস্তল, পেটে আর পিঠে ছোরা।
পিস্তলওলা বলল, চেঁচাবেন না। যা আছে দিয়ে দিন।
জীবনে কোনোও সাহসের কাজ করেননি হরসুন্দরবাবু। আজই প্রথম করলেন। জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো?
ছেলে তিনটে হঠাৎ যেন থমকে গেল। আর তার পরেই দুড়দাড় দৌড়ে এমনভাবে পালাল যেন ভূত দেখেছে।
হরসুন্দরবাবু খুবই অবাক হয়ে গেলেন। এই সামান্য কথায় এত ভয় পাওয়ার কী আছে? যাক গে, এবার মাইনের টাকাটা তো বেঁচে গেল!
না, এর পর থেকে হরসুন্দরবাবুকে আর ওদের পাল্লায় পড়তে হয়নি বটে, কিন্তু তাঁর ধাঁধাটা গেল না। এই তো সেদিন তাঁর অফিসের বড়োবাবু তাঁকে কাজের একটা ভুলের জন্য খুব বকাঝকা করে চার্জশিট দেন আর কী। হরসুন্দরবাবু শুধু হাসি-হাসি মুখ করে তাঁকে বলেছিলেন, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো! তাইতে বড়বাবু এমন ঘাবড়ে গেলেন, যে আর বলার নয়। তারপর থেকে খুবই ভালো ব্যবহার করে যাচ্ছেন।
সেদিন বাজার থেকে পচা মাছ এনেছিলেন বলে হরসুন্দরের গিন্নি তাঁকে খুবই তুলোধোনা করছিলেন। হরসুন্দরবাবু তাঁকেও বললেন, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো৷ গিন্নি একেবারে জল।
হ্যাঁ, এখন হরসুন্দরবাবু খুবই ভালো আছেন। কোনও উদবেগ, অশান্তি নেই, বিপদ দেখা দিলেই তিনি শুধু বলেন, আচ্ছা, শিবেনবাবু ভালো আছেন তো! মন্ত্রের মতো কাজ হয়।
শিবেনবাবুর ইস্কুল
সকালে বেড়াতে বেরিয়ে মহেন্দ্রবাবু একটা ভাঙা পরিত্যক্ত ইস্কুলবাড়ি দেখে দাঁড়িয়ে পড়লেন। স্কুলবাড়ি দেখলেই চেনা যায়। লম্বামতো বাড়ি, সার সার ঘর, মাঝখানে একটা উঠানমতো। তিনি ত্রিশ বছর নানা ইস্কুলে পড়িয়েছেন। এই সবে রিটায়ার করে হরিপুরে খুড়শ্বশুরের বাড়িতে কয়েকদিন বিশ্রাম নিতে এসেছেন।
একটা লোক সামনের মাঠে খোঁটা পুঁতছিল। তাকেই জিজ্ঞেস করলেন, বাপু হে, এটা যেন স্কুলবাড়ি বলে মনে হচ্ছে, তা এর এরকম ভগ্নদশা কেন?
ভগ্নদশা ছাড়া উপায় কী বলুন! শিবেন রায় ইস্কুল খুলেছিলেন, কিন্তু মোটে ছাত্তরই হয় না, তাই উঠে গেছে।
বল কী? তা ছাত্র হয় না কেন?
অ্যাজ্ঞে এ হল গরিবের গাঁ, ছেলেপুলেদেরও পেটভাতের জোগাড় করতে কাজে লেগে পড়তে হয়, পড়বার ফুরসত কোথায় বলুন?
তাহলে তো বড়োই মুশকিল, এক কাজ করলে হয় না? যদি বিকেল বা সন্ধ্যের দিকে ক্লাস করা হয় তাহলে?
লোকটা গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে বলে, তার জো নেই কর্তা, কেরোসিনের যা দাম হয়েছে তা কহতব্য নয়, শুধু দামই নয়, মাথা খুঁড়লেও তেল পাওয়া যায় না এখানে। তাই সন্ধ্যে হতে না হতেই গোটা গাঁ ঘুমে একেবারে ঢলাঢ়ল, সন্ধ্যের পর এ গাঁয়ে আলোর ব্যবস্থাই নেই, অন্ধকারে কি লেখাপড়া হয়?
মহেন্দ্রবাবু শিক্ষাব্রতী মানুষ, শিক্ষা জিনিসটা মানুষের জীবনে কত প্রয়োজন তা তিনি ভালোই জানেন, তাই বললেন, কিন্তু বাপু হে, শিক্ষারও তো একটা দাম আছে।
লোকটা একগাল হেসে বলে, তা আর নেই! শিক্ষা বড় উপকারী জিনিস মশাই, দু-চারটে ইংরিজি বুকনি ঝাড়লেই আমি দেখেছি গা বেশ গরম হয়ে ওঠে। শীতকালেও ঘামের ভাব হয়। তারপর ধরুন ইতিহাস, দু-পাতা পড়লেই এমন চমৎকার ঘুম এসে যায় যে, এক ঘুমে রাত কাবার, অঙ্ক কষতে বসলে খিদে চাগাড় দেবেই কী দেবে, একথালা পান্ত খেয়ে আঁক কষতে বসেই খিদের চোটে উঠে পড়তে হয়েছে।