ওরে বাবারে! বলে সোমনাথবাবু প্রাণপণে পাঁই পাঁই করে ছুটতে লাগলেন বাড়ির দিকে। কিন্তু পারলেন না। একটা সাঁড়াশির মতো যন্ত্র পট করে এগিয়ে এসে তাকে খপ করে ধরে সাঁ করে তুলে নিল সেই নৈবেদ্যর মধ্যে।
তারপর একটা ঝাঁকুনি আর তারপর একটা দুলুনি। সোমনাথবাবুর একটু মূৰ্ছার মতো হল। যখন চোখ চাইলেন তখন দেখেন নৈবেদ্যটা এক জায়গায় থেমেছে। দরজা খোলা। লোকটা একগাল হেসে বলল, আসুন, ডায়নোসর দেখবেন না! ওই যে।
দরজার কাছে গিয়ে সোমনাথবাবুর আবার মূৰ্ছা যাওয়ার জোগাড়। ছবিতে যেমন দেখেছেন হুবহু তেমনি দেখতে গোটা দশেক ডায়নোসর বিশাল পাহাড়ের মতো চেহারা নিয়ে ঘোরাফেরা করছে। আকাশে উড়ছে বিশাল টেরোড্যাকটিল এবং অন্যান্য বিকট পাখি।
ভয়ে চোখ বুজলেন সোমনাথ। আবার দুলুনি। এবার যেখানে যান থামল সেখানে সব চামড়া আর গাছের ছালের নেংটি পরা মানুষ পাথর ঘষে ঘষে অস্ত্র তৈরি করছে। মহাকাশযান দেখে তারা অস্ত্র নিয়ে তেড়ে এল। দু-চারটে তীক্ষ্ণ পাথরের টুকরো এসে লাগলও মহাকাশযানের গায়ে। লোকটা তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে তার গাড়ি ছেড়ে দিল।
এবারের গ্রহটা রীতিমতো ভালো। দেখা গেল রামচন্দ্র আর লক্ষ্মণভাই শিকার করতে বেরিয়েছেন। দুজনেই খুব হাসছেন। রামচন্দ্রকে জোড়হাতে প্রণাম করলেন সোমনাথবাবু। রামচন্দ্র বরাভয় দেখিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেন।
সোমনাথবাবু ঘামতে ঘামতে বললেন, এসব কি সত্যি? না স্বপ্ন দেখছি?
সব সত্যি। আরও আছে।
আমি আর দেখব না। যথেষ্ট হয়েছে। মশাই, পায়ে পড়ি, বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসুন।
লোকটা বিনীতভাবে বলল, যে আজ্ঞে। মাঝে মাঝে বেড়াতে আসবেন। আরও কত কী দেখার আছে।
মহাকাশযানটা ফের শূন্যে উঠল। সেই দুলুনি। কিছুক্ষণ পর জলার মাঠে নেমে পড়তেই সোমনাথবাবু প্রায় লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলেন। লোকটা পিছন থেকে চেঁচিয়ে বলল, দাদা, একটু মনে রাখবেন আমাকে, মাঝে মাঝে বিপদে পড়ে এসে পড়লে পরোটা-টরোটা যেন পাই। হবে, হবে। বলতে বলতে সোমনাথবাবু বাড়ির দিকে ছুটতে লাগলেন।
শিবেনবাবু ভালো আছেন তো
হরসুন্দরবাবু একটু নাদুসনুদুস, ধীর, স্থির, শান্ত প্রকৃতির মানুষ। তিনি কোঁচা দুলিয়ে ধুতি পরেন, ফুলহাতা জামার গলা অবধি বোতাম আঁটেন, কখনও হাতা গোটান না। শীত-গ্রীষ্ম সবসময়ে তিনি হাঁটু অবধি মোজা আর পাম্পশু পরেন। তাঁর বেশ মোটা এক জোড়া গোঁফ আছে। চুল পরিপাটি সিঁথি। হরসুন্দরবাবু খুব নিরীহ মানুষও বটে।
সেদিন মাসের পয়লা তারিখ। হরসুন্দরবাবু সেদিন বেতন পেয়েছেন। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরছেন। যে গলিটায় তিনি থাকেন সেটা বেশ অন্ধকার, পাড়াটাও ভালো নয়। হরসুন্দরবাবু গলিতে ঢুকে কয়েক পা এগোতেই তিনটে ছোকরা তাঁকে ঘিরে ফেলল। একজন বুকে রিভলভার ঠেকাল, একজন পেটে আর অন্যজন পিঠে দুটো ছোরা ধরল। রিভলভারওলা বলল, চেঁচাবেন না। যা আছে দিয়ে দিন।
হরসুন্দরবাবু খুবই ভয় পেলেন। ভয়ে তাঁর গলা কাঁপতে লাগল। বললেন, প্রাণে মেরো না ভাই। দিচ্ছি।
মাইনের পুরো টাকাটা নিয়ে তিনজন হাপিস হয়ে গেল। হরসুন্দবাবু ভয়ে চেঁচামেচি করলেন
যদি তারা ফিরে আসে! বাড়িতে ফিরেও কারও কাছে ঘটনাটা প্রকাশ করলেন না। ভাবলেন এ মাসটা ধারকর্জ করে চালিয়ে নিলেই হবে।
তা নিলেনও হরসুন্দরবাবু। একটা মাস দেখতে-দেখতে চলে গেল। আবার পয়লা তারিখ এল। হরসুন্দরবাবু আবার বেতন পেলেন।
ফেরার সময় যখন গলির মধ্যে ঢুকলেন তখন আচমকা ফের তিনটে লোক তাকে ঘিরে ধরল। বুকে রিভলভার, পেটে পিঠে ছোরা।
রিভলভারওলা বলল, যা আছে দিয়ে দিন। চেঁচাবেন না।
হরসুন্দরবাবু ফের ভয়ে কাঁপতে-কাঁপতে বললেন, প্রাণে মেরো না ভাই। দিচ্ছি।
মাইনের টাকা নিয়ে তোক তিনটে হাপিস হয়ে গেল।
হরসুন্দরবাবু এবারও বাড়ি ফিরে কাউকে কিছু বললেন না। ভাবলেন, এ মাসটাও কোনওরকমে চালিয়ে নেবেন।
কষ্ট হল যদিও, কিন্তু হরসুন্দরবাবু চালিয়ে নিলেন। ফের পয়লা তারিখ এল। হরসুন্দরবাবু বেতন পেলেন।
বাড়ি ফেরার সময় অন্ধকার গলিতে ঠিক আগের মতোই তিনটে তোক ঘিরে ধরল তাকে। বুকে-পিঠে-পেটে ঠিক একই জায়গায় রিভলভার আর ছেরো ধরল। একই কথা বলল, এবং বেতনের টাকাটা নিয়ে হাওয়া হল।
হরসুন্দরবাবুর আজ চোখে জল এল।
বাড়ি ফিরে তিনি গুম হয়ে রইলেন। রাতে ভালো করে খেলেন না। গভীর রাতে তিনি ছাদে উঠে চুপ করে অকাশের দিকের চেয়ে অসহায়ভাবে ভাবলেন, কী যে করব বুঝতে পারছি না।
কাছেপিঠে কে যেন একটা হাই তুলল, তারপর আঙুল মটকানোর শব্দ হল, তারপর বলল, হবি, হবি। হরসুন্দরবাবু চারদিকটা চেয়ে দেখলেন। ছাদ জনশূন্য, শীতকালের গভীর রাত্রে ছাদে আসবেই বা কে?
তিনি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কে?
ভেবে দেখতে হবে হে, ভেবে দেখতে হবে।
তার মানে?
কতবার জন্মেছি তার কি হিসেব আছে? কোন জন্মে কে ছিলুম তা যে গুবলেট হয়ে যায় বাপ। এ জন্মে বিশু তো ও জন্মে নিতাই, পরের জন্মে হয়তো চিনেম্যান চাঁই ছুঁই।
আ-আপনি কোথায়? দে-দেখতে পাচ্ছি না তো!
গলার স্বরটা খিঁচিয়ে উঠে বলল, দেখার চোখ আছে কি তোমার যে দেখবে? সারাদিনই তো তোমার ধারেকাছে ঘুরঘুর করি, দেখতে চেয়েছ কি কখনও?
আজ্ঞে, আমি যে কিছু বুঝতে পারছি না, ভয় পাচ্ছি, মাথা ঝিমঝিম করছে।