রায়মশাই একটু শ্লেষের হাসি হেসে বললেন, হবে না? পাপের প্রায়শ্চিত্ত। আমার ছেলের বিয়েতে যে বড়ো গোরু দিয়ে আমাকে অপমান করেছিলে?
চক্কোত্তিমশাই জিভ কেটে বললেন, ছি ছি, আপনাকে অপমান রাজামশাই? সেরকম চিন্তা আমাদের মরণকালেও হবে না। তা ছাড়া ব্রাহ্মণকে গো-দান করলে পাপ হয় বলে কোনো শাস্ত্রে নেই। গো-দান মহাপুণ্যকর্ম।
রায়মশায়ের নতুন সভাপন্ডিত কেশব ভট্টাচার্যও মাথা নেড়ে বললেন, কূট প্রশ্ন। কিন্তু কথাটা আপাতগ্রাহ্য।
রায়মশাই একটু নরম হয়ে বললেন, ইঁদারার কথা আমিও শুনেছি। সেবার আমার অগ্নিমান্দ্যের সময় গোবিন্দপুর থেকে পুরোনো ইঁদারার জল আনিয়ে আমাকে খাওয়ানো হয়। খুব উপকার পেয়েছিলাম। তা সে ইঁদারা কি শুকিয়ে গেছে নাকি?
চক্কোত্তিমশাই ট্যাঁক থেকে আর একটা হতুকি বের করে লুকিয়ে মুখে ফেলে বললেন, আজ্ঞে না। তাতে এখনও কাকচক্ষু জল টলটল করছে। কিন্তু সে জল হাতের কাছে থেকেও আমাদের নাগালের বাইরে। দড়ি বেঁধে ঘটি বালতি যা-ই নামানো যায়, তা আর ওঠানো যায় না। দড়ি কে যেন কেটে নেয়, ছিঁড়ে দেয়। লোহার শিকলও কেটে দিয়েছে।
রক্তচক্ষে রায়মশাই হুংকার দিলেন, কার এত সাহস?
এবার হুংকার শুনে গোবিন্দপুরের লোকেরা খুশি হল। নড়েচড়ে বসল। মাথার ওপর জমিদারবাহাদুর থাকতে ইঁদারার জল বেহাত হবে, এ কেমন কথা!
ঠাকুরমশাই বললেন, আজ্ঞে মানুষের কাজ নয়। এত বুকের পাটা কারও নেই। গোবিন্দপুরের লেঠেলদের কে না-চেনে! গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো মাথার ওপর আপনিও রয়েছেন। লেঠেলদের এলেমে না-কুলোলে আপনি শাসন করবেন। কিন্তু একাজ যাঁরা করছেন তাঁরা মানুষ নন। অশরীরী।
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার উপমা শুনে একটু রেগে উঠতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অশরীরীর কথা শুনেই মুহূর্তের মধ্যে কানে হাত চাপা দিয়ে ডুকরে উঠলেন রায়মশাই, ওরে, বলিস না, বলিস না!
সবাই তাজ্জব।
নায়েবমশাই রোষকষায়িত লোচনে গোবিন্দপুরের প্রজাদের দিকে চেয়ে বললেন, মুখ সামলে কথা বলো।
চক্কোত্তিমশাই ভয়ের চোটে দ্বিতীয় হস্তুকিটাও গিলে ফেলতে ফেলতে অতিকষ্টে সামাল দিলেন।
রায়মশাইয়ের বড়ো ভূতের ভয়। পারতপক্ষে তিনি ও নাম মুখেও আনেন না, শোনেনও না। কিন্তু কৌতূহলেরও তো শেষ নেই। খানিকক্ষণ কান হাতে চেপে রেখে খুব আস্তে একটুখানি চাপা খুলে বললেন, কী যেন বলছিলি?
চক্কোত্তিমশাই উৎসাহ পেয়ে বলেন, আজ্ঞে সে-এক অশরীরী কান্ড। ভূ–
বলিস না! খবরদার বলছি, বলবি না! রায়বাবু আবার কানে হাতচাপা দেন।
চক্কোত্তিমশাই বোকার মতো চারদিকে চান। সবাই এ-ওর মুখে চাওয়াচায়ি করে। নায়েবমশাই চোপ বলে একটা প্রকান্ড ধমক মারেন।
একটু বাদে রায়বাবু আবার কান থেকে হাতটা একটু সরিয়ে বলেন, ইঁদারার জলে কী যেন?
চক্কোত্তিমশাই এবার একটু ভয়ে ভয়েই বলেন, আজ্ঞে সে-এক সাংঘাতিক ভূতুড়ে ব্যাপার!
চুপ করো, চুপ করো! রাম রাম রাম রাম! বলে আবার রায়বাবুর কানে হাত। খানিক পরে আবার তিনি বড়ো বড়ো চোখ করে চেয়ে বলেন, রেখে ঢেকে বলো।
আজ্ঞে বালতি-ঘটির সব দড়ি তেনারা কেটে নেন। শেকল পর্যন্ত হেঁড়েন। তা ছাড়া ইঁদারার মধ্যে হাওয়া বয় না, বাতাস দেয় না, তবু তালগাছের মতো ঢেউ দেয়, জল হিলিবিলি করে ফাঁপে।
বাবারে! বলে রায়বাবু চোখ বুজে ফেলেন।
ক্রমে ক্রমে অবশ্য সবটাই রায়বাবু শুনলেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, দিনটাই মাটি করলি তোরা। নায়েবমশাই, আজ রাতে আমার শোবার ঘরে চারজন দারোয়ান মোতায়েন রাখবেন।
যে আজ্ঞে।
গোবিন্দপুরের প্রজারা হাতজোড় করে বলল, হুজুর, আপনার ব্যবস্থা তো দারোয়ান দিয়ে করালেন, এবার আমাদের দারার একটা বিলিব্যবস্থা করুন।
দারা বুজিয়ে ফেলগে। ও দারা আর রাখা ঠিক নয়। দরকার হলে আমি দারা বোজানোর জন্য গো-গাড়ি করে ভালো মাটি পাঠিয়ে দেবখন।
তখন শুধু গোবিন্দপুরের প্রজারাই নয়। কাছারিঘরের সব প্ৰজাই হাঁ হাঁ করে উঠে বলে, তা হয় না হুজুর, সেই ইঁদারার জল আমাদের কাছে ধন্বন্তরি। তা ছাড়া জল তো নষ্টও হয়নি পোকাও লাগেনি, কয়েকটা ভূত–।
রায়বাবু হুংকার দিলেন, চুপ! ও নাম মুখে আনবি তো মাটিতে পুঁতে ফেলব।
সবাই চুপ মেরে যায়। রায়বাবু ব্যাজার মুখে কিছুক্ষণ ভেবে ভট্টাচার্য মশাইয়ের দিকে চেয়ে বললেন, এ তো লেঠেলদের কর্ম নয়, একবার যাবেন নাকি সেখানে?
রায়মশাইয়ের আগের সভাপন্ডিত মুকুন্দ শর্মা একশো বছর পার করে এখনও বেঁচে আছেন। তবে একটু অথর্ব হয়ে পড়েছেন। ভারি ভুলো মন আর দিনরাত খাই-খাই। তাঁকে দিয়ে কাজ হয় না। তাই নতুন সভাপন্ডিত রাখা হয়েছে কেশব ভট্টাচার্যকে।
কেশব এই অঞ্চলের লোক নন। কাশী থেকে রায়মশাই তাঁকে আনিয়েছিলেন। তাঁর ক্ষমতা বা পান্ডিত্য কতদূর তার পরীক্ষা এখনও হয়নি। তবে লোকটিকে দেখলে শ্রদ্ধা হয়। চেহারাখানা বিশাল তো বটেই, গায়ের বর্ণ উজ্জ্বলতা সেও বেশি কথা কিছু নয়। তবে মুখের দিকে চাইলে বোঝা যায় চেহারার চেয়েও বেশি কিছু এঁর আছে। সেটা হল চরিত্র।
জমিদারের কথা শুনে কেশব একটু হাসলেন।
পরদিন সকালেই গো-গাড়ি চেপে কেশব রওনা হয়ে গেলেন গোবিন্দপুর। পিছনে পায়ে হেঁটে গোবিন্দপুরের শ-দুই লোক।