সোমনাথবাবু লোকটাকে দেখে বিশেষ সন্তুষ্ট হলেন না। কারণ, আজও দেখছেন বাহাদুর লোকটাকে আটকায়নি এবং কুকুরেরাও নির্বিকার। সোমনাথবাবু নিরুত্তাপ গলায় বললেন, এই যে! কী খবর?
আজ্ঞে খবর শুভ। আজও আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।
তার মানে আজও কি আপনার গাড়ি খারাপ হয়েছে?
হ্যাঁ। দূরের পাল্লায় চলাচল করতে হয়, গাড়ির আর দোষ কী?
তা বলে আমার বাড়িটাকে হোটেলখানা বানানো কি উচিত হচ্ছে? আর আপনার গতিবিধিও রীতিমতো সন্দেহজনক। আপনি এলে দারোয়ান ভুল দেখে, কুকুরেরাও ভুল বোঝে। ব্যাপারটা আমার সুবিধের ঠেকছে না।
লোকটা যেন বিশেষ লজ্জিত হয়ে বলে, আমাকে দেখতে হুবহু আপনার মতোই কিনা, ভুল হওয়া স্বাভাবিক।
সোমনাথবাবু একথা শুনে একেবারে বুরবক, তার মানে? আমাকে দেখতে আপনার মতো! আমি কি বেঁটে? আমার মাথায় কি টাক আছে?
লোকটা ঘন ঘন মাথা নেড়ে বলে, না না, তা নয়। আপনি আমার চেয়ে আট ইঞ্চি লম্বা, আপনার হাইট পাঁচ ফুট এগারো ইঞ্চি। আপনার মাথায় দু-লক্ষ সাতাশ হাজার তিনশো পঁচিশটা চুল আছে। আপনি দেখতেও অনেক সুদর্শন। তবু কোথায় যেন হুবহু মিলও আছে।
উত্তেজিত সোমনাথবাবু বেশ ধমকের গলায় বললেন, কোথায় মিল মশাই? কীসের মিল? লোকটা একটা রুমালে টাকটা মুছে নিয়ে বলল, সেটা ভেবে দেখতে হবে। এখন হাতে সময় নেই। আমার বড়ো খিদে পেয়েছে।
সোমনাথবাবু অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললেন, খিদে পেয়েছে তো হোটেলে গেলেই হয়। লোকটা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমার কাছে পয়সা নেই যে!
পয়সা নেই! এদিকে তো দিব্যি গাড়ি হাঁকিয়ে যাতায়াত করেন। তাহলে পয়সা নেই কেন?
লোকটা কাঁচুমাচু মুখে পকেটে হাত দিয়ে একটা কাঠি বের করে বলল, এ জিনিস এখানে চলবে?
তার মানে?
আমাদের দেশে এগুলোই হচ্ছে বিনিময় মুদ্রা। এই যে কাঠির মতো জিনিসটা দেখছেন এটার দাম এখানকার দেড়শো টাকার কাছাকাছি। কিন্তু কে দাম দেবে বলুন!
সোমনাথবাবু ভ্রু কুঁচকে বললেন, কাঠি! কাঠি আবার কোথাকার বিনিময় মুদ্রা হল? এসব তো হেঁয়ালি ঠেকছে।
লোকটা একটু কাতর মুখে বলল, সব কথারই জবাব দেব। আগে কিছু খেতে দিন। বড্ড খিদে।
সোমনাথবাবু রুষ্ট হলেন বটে, কিন্তু শেষ অবধি লোকটাকে খাওয়ালেনও। লোকটা যখন গোগ্রাসে পরোটা খাচ্ছে তখন সোমনাথবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, আপনার নাম বা ঠিকানা কিছুই তো বলেননি, কী নাম আপনার?
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, নামটা শুনবেন! একটু অদ্ভুত নাম কিনা, আমার নাম খ।
সোমনাথবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, শুধু খ! এরকম নাম হয় নাকি?
আমাদের ওখানে হয়।
আর পদবী?
খ মানেই নাম আর পদবী। খ হল নাম আর অ হল পদবী। দুয়ে মিলেই ওই খ।
ও বাবা! এ তো খুব অদ্ভুত ব্যাপার।
আমাদের সবই ওরকম।
তা আপনার বাড়ি কোথায়?
একটু দূরে। সাড়ে তিনশো আল হবে।
আল! আল আবার কী জিনিস?
ওটা হল দূরত্বের মাপ।
এরকম মাপের নাম জন্মে শুনিনি মশাই। তা আল মানে কত? মাইল খানেক হবে নাকি?
লোকটা হাসল, একটু বেশি। হাতে সময় থাকলে চলুন না, আমার গাড়িটায় চড়ে আলের মাপটা দেখে আসবেন।
না না, থাক।
লোকটা অভিমানী মুখে বলে, আপনি বোধহয় আমাকে ঠিক বিশ্বাস করছেন না! আমি কিন্তু ভালো লোক। মাঝে মাঝে খিদে পায় বলে হামলা করি বটে, কিন্তু আমার কোনো বদ মতলব নেই।
সোমনাথবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন, আরে না না। ঠিক আছে, বলছেন যখন যাচ্ছি। তবে এসময়ে আমি একটু ব্যস্ত আছি কিনা, বেশি সময় দিতে পারব না।
তাই হবে চলুন, গাড়িটা পিছনের মাঠে রেখেছি।
মাঠে! ও তো ঠিক মাঠ নয়, জলা জায়গা, ওখানে গাড়ি রাখা অসম্ভব।
আমার গাড়ি সর্বত্র যেতে পারে। আসুন না দেখবেন।
কৌতূহলী সোমনাথবাবু লোকটার সঙ্গে এসে জলার ধারে পৌঁছে অবাক। কোথাও কিছু নেই।
কোথায় আপনার গাড়ি মশাই? বলে পাশে তাকিয়ে দেখেন লোকটাও নেই। সোমনাথবাবু বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেলেন।
অবশ্য বিস্ময়ের তখনও অনেক কিছু বাকি ছিল। ফাঁকা মাঠ, লোকটাও হাওয়া দেখে সোমনাথবাবু ফিরবার জন্য সবে পা বাড়িয়েছেন, এমন সময় অদৃশ্য থেকে লোকটা বলে উঠল, আহা, যাবেন না, একটা মিনিট অপেক্ষা করুন।
বলতে বলতেই সামনে নৈবেদ্যর আকারের একটা জিনিস ধীরে ধীরে ফুটে উঠতে লাগল। বেশ বড়ো জিনিস, একখানা ছোটোখাটো দোতলা বাড়ির সমান। নীচের দিকটা গোল, ওপরের দিকটা সরু।
এটা আবার কী জিনিস?
নৈবেদ্যর গায়ে পটাং করে একটা চৌকো দরজা খুলে গেল আর নেমে এল একখানা সিঁড়ি। লোকটা দরজায় দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে বলল, আসুন আসুন, আস্তাজ্ঞে হোক।
সোমনাথবাবু এমন বিস্মিত হয়েছেন যে, কথাই বলতে পারলেন না কিছুক্ষণ। তারপর অস্ফুট গলায় তোতলাতে লাগলেন, ভূ-ভূত! ভূ-ভূতুড়ে!…
লোকটা মাথা নেড়ে বলে, না মশাই না। ভূতুড়ে নয়। গাড়িটা অদৃশ্য করে না-রাখলে যে লোকের নজরে পড়বে। আসুন, চলে আসুন। কোনো ভয় নেই।
সোমনাথবাবু এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, ও বাবা, আপনি তো সাংঘাতিক লোক! আমি ও ফাঁদে পা দিচ্ছি না। আপনি যান, আমি যাব না।
লোকটা করুণ মুখে বলে কিন্তু আমি তো খারাপ লোক নই সোমনাথবাবু।
সোমনাথবাবু সভয়ে লোকটার দিকে চেয়ে বললেন, খারাপ নন, তবে ভয়ংকর। আপনি গ্রহান্তরের লোক।
আজ্ঞে, আপনাদের হিসেবে মাত্র দু-হাজার লাইট ইয়ার দূরে আমার গ্রহ। বেশ বড়ো গ্রহ। আমাদের সূর্যের নাম সোনা। সোনার চারদিকে দেড় হাজার ছোটো-বড়ো গ্রহ আছে। সব কটা গ্রহই বাসযোগ্য। আপনাদের মতো মোটে একটা গ্রহে প্রাণী নয় সেখানে। সব কটা গ্রহেই নানা প্রাণী আর উদ্ভিদ। কোনো কোনো গ্রহে এখন প্রস্তরযুগ চলছে, কোনোটায় চলছে ডায়নোসরদের যুগ, কোথাও বা সভ্যতা অনেকদূর এগিয়ে গেছে, কোনো গ্রহে ঘোর কলি, কোনোটাতে সত্য, কোনোটাতে ত্রেতা, কোথাও বা দ্বাপর–সে এক ভারি মজার ব্যাপার। বেশি সময় লাগবে না, এ গাড়ি আপনাকে সব দেখিয়ে দেবে।