সোমনাথবাবু একটা গলা খাঁকারি দিয়ে রাগটাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে বললেন, দেখুন, আপনি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন। অচেনা বাড়িতে ফস করে ঢুকে পড়া মোটেই ভদ্রতাসম্মত নয়। তার উপর বিনা নিমন্ত্রণে খেতে চাইছেন এটাই বা কেমন কথা?
লোকটা অবাক হয়ে বলে, আপনার খিদে পেলে আপনি কী করেন?
আমি! আমি খিদে পেলে খাই, কিন্তু সেটা আমার নিজের বাড়িতে।
আমিও খিদে পেলে খাই। এই বলে লোকটা মিটিমিটি হাসতে লাগল।
সোমনাথবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, আপনি নিজের বাড়িতে গিয়ে খান না।
লোকটা হাসি হাসি মুখ করেই বললেন, আমার নিজের বাড়ি একটু দূরে। আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় এখানে একটু আটকে পড়েছি।
সোমনাথবাবু বিরক্তির ভাবটা চেপে রেখে বললেন, আপনি আমার দারোয়ানকে ফাঁকি দিয়ে কুকুরগুলোর চোখ এড়িয়ে কী করে ঢুকলেন সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। এ বাড়িতে কোনো লোক কখনও খবর না-দিয়ে ঢুকতে পারে না।
লোকটা ভালোমানুষের মত মুখ করে বলে, সে-কথা ঠিকই, আপনার দারোয়ান বা কুকুরেরা কেউই খারাপ নয়। ওদের ওপর রাগ করবেন না। আচ্ছা, আপনার কি সকালের দিকে খিদে পায় না? খেতে খেতে বরং দু-চারটে কথা বলা যেত।
এই বলে লোকটা এমন ছেলেমানুষের মতো সোমনাথবাবুর মুখের দিকে চেয়ে রইল যে সোমনাথবাবু হেসে ফেললেন, তারপর বললেন, আপনি একটু অদ্ভুত আছেন মশাই, আচ্ছা, ঠিক আছে, জলখাবার খাওয়াচ্ছি একটু বসুন।
সোমনাথবাবু উঠে ভিতর বাড়িতে এসে রান্নার ঠাকুরকে জলখাবার দিতে বলে বারান্দায় ফিরে এসে স্তম্ভিত হয়ে দেখলেন, তাঁর ভয়ংকর সাত-সাতটা কুকুর বারান্দায় উঠে এসে বেঁটে লোকটার চারধারে একেবারে ভেড়ার মতো শান্ত হয়ে বসে মুখের দিকে চেয়ে আছে। আর লোকটা খুব নিম্নস্বরে তাদের কিছু বলছে।
সোমনাথবাবুকে দেখে লোকটা যেন একটু লজ্জা পেয়েই বলল, এই একটু এদের সঙ্গে কথা বললুম আর কী। ওই যে জিমি কুকুরটা, ওর কিন্তু মাঝে মাঝে পেটে ব্যাথা হয়, একটু চিকিৎসা করাবেন। আর টমি বলে ওই যে অ্যালসেশিয়ানটা আছে, ও কিন্তু একটু অপ্রকৃতিস্থ, সাবধান থাকবেন।
সোমনাথবাবু এও বিস্মিত যে মুখে প্রথমটায় কথা সরল না। বিস্ময় কাটিয়ে উঠে যখন কথা বলতে পারলেন তখন গলায় ভালো করে স্বর ফুটছে না, আপনি ওদের কথা বুঝতে পারেন? ভাবই বা হল কী করে?
লোকটাও যেন একটু অবাক হয়ে বলে, আপনি কুকুর পোষেন অথচ তাদের ভাষা বা মনের ভাব বোঝেন না এটাই বা কেমন কথা? ওরা তো আপনার কথা দিব্যি বোঝে। দু-পায়ে দাঁড়াতে বললে দাঁড়ায়, পাশের ঘর থেকে খবরের কাগজ নিয়ে আসতে বললে নিয়ে আসে। তাই না? ওরা যা পারে আপনি তা পারেন না কেন?
সোমনাথবাবুকে স্বীকার করতে হল যে কথাটায় যুক্তি আছে। তারপর বললেন, কিন্তু ভাব করলেন কী করে?
ওরা বন্ধু আর শত্রু চিনতে পারে! সোমনাথবাবু আমতা আমতা করে বললেন, কিন্তু বাহাদুর! বাহাদুর তো আমার মতোই মানুষ। তার ওপর ভীষণ সাবধানি লোক। তাকে হাত করা তো সোজা নয়।
লোকটা মিটিমিটি হেসে বলে, আমি যখন ঢুকছিলাম তখন বাহাদুর হাসিমুখে আমাকে একটা সেলামও করেছিল। শুধু আপনিই কেমন যেন আমাকে বন্ধু বলে ভাবতে পারছেন না।
সোমনাথবাবু একটু লজ্জা পেয়ে বললেন, মানে-ইয়ে যাকগে, আমার এখন আর কোনো বিরূপ ভাব নেই।
আমার কিন্তু খুবই খিদে পেয়েছে।
শশব্যস্তে সোমনাথবাবু বললেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, ব্যবস্থা হয়েছে। আসুন।
লোকটার সত্যিই খুব খিদে পেয়েছিল, গোগ্রাসে পরোটা আর আলুর চচ্চড়ি খেল, তারপর গোটা পাঁচেক রসগোল্লাও। চা বা কফি খেল না। খাওয়া শেষ করে উঠে পড়ে ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, আর সময় নেই, ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই রওনা হতে হবে।
সোমনাথবাবু ভদ্রতা করে বললেন, আপনি কোথায় থাকেন?
বেশ একটু দূরে। অনেকটা পথ।
গাড়িটা কি মেরামত হয়ে গেছে? নইলে আমি আমার ড্রাইভারকে বলে দেখতে পারি, সে গাড়ির কাজ খানিকটা জানে।
লোকটা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ল, এ গাড়ি ঠিক আপনাদের গাড়ি নয়। আচ্ছা চলি। লোকটা চলে যাওয়ার পর সোমনাথবাবু বাহাদুরকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, যে লোকটা একটু আগে এসেছিল তাকে তুই চিনিস! ফস করে ঢুকতে দিলে যে বড়ো!
বাহাদুর তার ছোটো চোখ দুটো যথাসম্ভব বড়ো বড়ো করে বলল, কেউ তো আসেনি বাবু।
আলবাত এসেছিল, তুই তাকে সেলামও করেছিস।
বাহাদুর মাথা নেড়ে বলে, না, আমি তো কাউকে সেলাম করিনি। শুধু সাতটার সময় আপনি যখন বাড়ি ঢুকলেন তখন আপনাকে সেলাম করেছি।
সোমনাথবাবু অবাক হয়ে বললেন, আমি! আমি সকালে আজ বাইরেই যাইনি তা ঢুকলুম কখন? ওই বেঁটে বিচ্ছিরি টেকো লোকটাকে তোর আমি বলে ভুল হল নাকি?
সোমনাথবাবু তাঁর কুকুরদের ডাকলেন এবং একতরফা খুব শাসন করলেন, নেমকহারাম, বজ্জাত, তোরা এতকালের ট্রেনিং ভুলে একজন অজ্ঞাতকুলশীলকে বাড়িতে ঢুকতে দিলি! টু শব্দটিও করলি না!
কুকুররা খুবই অবোধ বিস্ময়ে চেয়ে রইল।
মাসখানেক কেটে গেছে। বেঁটে লোকটার কথা একরকম ভুলেই গেছেন সোমনাথবাবু। সকালবেলায় তিনি বাগানের গাছগাছালির পরিচর্যা করছিলেন। তাঁর সাতটা কুকুর দৌড়ঝাঁপ করছে বাগানে। ফটকে সদাসতর্ক বাহাদুর পাহারা দিচ্ছে। শীতের রোদ সবে তেজী হয়ে উঠতে লেগেছে।
একটা মোলায়েম গলাখাঁকারি শুনে সোমনাথবাবু ফিরে তাকিয়ে অবাক। সেই লোকটা। মুখে একটু ক্যাবলা হাসি।