সাতটা কুঠুরির সব-শেষটায় ঢুকে লালটেম দেখে, ধুলোর ওপর উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা মানুষের কঙ্কাল! ভীষণ ভয় পেয়ে লালটেম দরজার দিকে পিছু হটে সরে এল।
হঠাৎ কঙ্কালটা নড়ে উঠল। একটা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ করে কঙ্কালটা বলল, লালটেম, যেও না।
লালটেম ভয় পেয়েও দাঁড়াল।
একবোঝা হাড় নিয়ে খটমট শব্দ করে আস্তে-আস্তে কঙ্কালটা উঠে বসে। লালটেম দেখে, কঙ্কালটার পাঁজরের মধ্যে একটা কালো সাপ, মাথার খুলির ভিতর থেকে চোখ আর নাকের ফুটো দিয়ে কাঁকড়া বিছে বেরিয়ে আসছে, আর সারা গায়ে লাল পিঁপড়ে থিকথিক করছে।
কঙ্কালটা হাত তুলে বলে, আমার দশা দেখেছ?
দেখছি।
ভয় পেও না। এখানে যা কিছু দেখছ, সব সোনাদানা মোহর-গয়না, এ সবই তোমার। নিয়ে যাও।
লালটেম মাথা নেড়ে বলে, নিয়ে কী হবে?
অভাব থাকবে না। খুব বড়োলোক হয়ে যাবে। নাও।
বাইরে থেকে গম্ভীর গলায় মহারাজা ডাকল, হাংগা।
লালটেম চমকে উঠে বলল, আমার মোষটার জল তেষ্টা পেয়েছে। আমি যাই।
যেও না লালটেম। কিছু নিয়ে যাও।
মহারাজা আবার ডাকে, আঃ-আঃ।
লালটেম ছটফট করে বলে, বেলা বয়ে যাচ্ছে। আমি যাই।
তোমার মোষগুলো বুড়ো হয়েছে লালটেম, একদিন মরবে। তখন বড়ো দুর্দিন হবে তোমাদের। এইবেলা বড়োলোক হয়ে যাও।
মহারাজা বাইরে ভীষণ দাপিয়ে চেঁচায় গাঁ…গাঁ।
লালটেম একটু হেসে বলে, আমার দিন খারাপ যায় না। বেশ আছি।
কঙ্কালটা রেগে গিয়ে বলে, গাঁ-গঞ্জের হাজারো মানুষ যে রাজবাড়ি খুঁজে-খুঁজে হয়রান, সেই রাজবাড়ি পেয়েও তুমি বড়োলোক হবে না?
লালটেম একটু ভেবে বলে, না, আমি তো বেশ আছি। চারদিকে কত আনন্দ! কত ফুর্তি! সাপটা ফোঁস করে কঙ্কালটার পাঁজরায় একটা ছোবল দিল। উঃ করে কঙ্কালটা পাঁজর চেপে ধরে বলল, গত এক-শো বছর ধরে রোজ ছোবলাচ্ছে রে বাপ।…ইঃ, ওই দেখ, মাথায় ফের কাঁকড়াবিছেটা হুল দিল…কী যন্ত্রণা!…আচ্ছা লালটেম, বল তো, বোকা লোকগুলো রাজবাড়িটা খুঁজে পায় না কেন? তোমাদের এত কাছে, জঙ্গলের প্রায় ধার ঘেঁষেই তো রয়েছে তবু খুঁজে পায় না কেন? আর যে দু-একজন খুঁজে পায়, সেগুলো একদম তোমার মতোই আহাম্মক। লালটেম, লক্ষ্মী ছেলে, যদি একটা মোহরও দয়া করে নাও, তবে আমি মুক্তি পেয়ে যাই। নেবে?
বাইরে মহারাজা ভীষর রেগে চেঁচায়, গাঁ-অ্যাঁ।
লালটেম মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বলে, নিলেই তো তোমার মতো দশা হবে।
এই বলে লালটেম বেরিয়ে আসে গটগট করে। মহারাজা তাকে দেখে খুশি হয়ে কান লটপট করে গা শোঁকে, পা দাপিয়ে আনন্দ জানায়।
পরদিন থেকে আবার লালটেম মোষ চরাতে থাকে। সাথিদের সঙ্গে খেলে। পাহাড়, জঙ্গল নদী, মাঠ, চা-বাগান দেখে তার ভারি আনন্দ হয়। রোদ আর আলো, মেঘ আর বৃষ্টি, বাতাস আর দিগন্ত তাকে কত আদর জানায় নানাভাবে।
কোনোদিন তার খাবার থাকে। কোনোদিন থাকে না। যেদিন খাবার জোটে না, সেদিন সে মহারাজার পিঠে শুয়ে আকাশ দেখে। তার মনে হয়, সে বেশ আছে। খুব ভালো আছে। তার কোনো দুঃখ নেই।
লোকটা
সোমনাথবাবু সকালবেলায় তাঁর একতলার বারান্দায় বসে কাগজ পড়ছেন। সামনেই মস্ত বাগান, সেখানে খেলা করছে তাঁর সাতটা ভয়ংকর কুকুর। কুকুরদের মধ্যে দুটো বকসার বুলডগ, দুটো ডবারম্যান, দুটো অ্যালসেশিয়ান, একটা চিশি সড়ালে। এদের দাপটে কেউ বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে না, তার ওপর গেটে বাহাদুর নামের নেপালি দারোয়ান আছে। তার কোমরে কুকরি, হাতে লাঠি। সদাসতর্ক, সদাতৎপর। সোমনাথবাবু এরকম সুরক্ষিত থাকতেই ভালোবাসেন। তাঁর অনেক টাকা, হিরে-জহরত, সোনাদানা।
কিন্তু আজ সকালে সোমনাথবাবুকে খুবই অবাক হয়ে যেতে হল। ঘড়িতে মোটে সাতটা বাজে। শীতকাল। সবে রোদের লালচে আভা চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক এই সময়ে বাগানের ফটক খুলে বেঁটেমতো টাকমাথার একটা লোক ঢুকল। দারোয়ান বা কুকুরদের দিকে ক্ষেপও করল না। পাথরকুচি ছড়ানো পথটা দিয়ে সোজা বারান্দার দিকে হেঁটে আসতে লাগল। আশ্চর্যের বিষয়, দিনের আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেয়েও বাহাদুর তাকে বাধা দিল না এবং কুকুরেরাও যেমন খেলছিল তেমনিই ছোটাছুটি করে খেলতে লাগল। একটা ঘেউ পর্যন্ত করল না।
সোমনাথবাবু অবাক হয়ে চেয়েছিলেন। আশ্চর্য! খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার!
লোকটার চেহারা ভদ্রলোকের মতোই, মুখখানায় একটা ভালোমানুষিও আছে, তবে পোশাকটা একটু কেমন কেমন, মিস্তিরি বা ফিটাররা যেমন তেলকালি লাগার ভয়ে ওভারল পরে, অনেকটা সেরকমই একটা জিনিস লোকটার পরনে। পায়ে এই শীতকালেও গামবুট ধরনের জুতো। কারও মাথায় এমন নিখুঁত টাকও সোমনাথবাবু কখনও দেখেননি। লোকটার মাথায় একগাছি চুলও নেই।
বারান্দায় উঠে আসতেই সোমনাথবাবু অত্যন্ত কঠোর গলায় বলে উঠলেন, কী চাই? কার হুকুমে এ বাড়িতে ঢুকেছেন?
লোকটা জবাবে পালটা একটা প্রশ্ন করল, আপনি কি সকালের জলখাবার সমাধা করেছেন?
সোমনাথবাবু খুব অবাক হয়ে বললেন, না, তো-ইয়ে-মানে আপনি কে বলুন তো?
লোকটা মুখোমুখি একটা বেতের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ে বলল, আমার, খুবই খিদে পেয়েছে। হাতে বিশেষ সময়ও নেই।
লোকটার বাঁ-কবজিতে একটা অদ্ভুত দর্শন ঘড়ি। বেশ বড়ো এবং ডায়ালে বেশ জটিল সব ছোটো ছোটো ডায়াল ও কাঁটা রয়েছে।