দুপুরের দিকে খুব খিদে পেলে বাড়ি ফিরে লালটেম খায়।
কিন্তু সব দিন খাবার থাকে না। যেদিন থাকে না, সেদিন লালটেম টের পায়। তাই সেদিন সে বাড়ি ফেরে না। দুপুরে সে গোছের পাকা ডুমুর কি আমলকী পেড়ে খায়। বেলের সময়ে বেল পাড়ে, কখনো বা টক আম বা বাতাবি লেবু পেয়ে যায় বছরের বিভিন্ন সময়ে। তাই খায়। খেয়ে সবচেয়ে বুড়ো আর শক্ত চেহারার মোষ মহারাজার পিঠে উঠে চিৎপাত হয়ে ঘুমোয়।
ছোট্ট ইস্টিশনটার গা ঘেঁষে লালটেমদের ঝোঁপড়া। তার বাবা পেতলের থালায় সাজিয়ে পেড়া বিক্রি করে ট্রেনের সময়ে। বাজারে বড়ো-বড়ো কারবারিদের কাছে ভৈসা ঘি বেচে, দুধ দেয় বাড়ি-বাড়ি। তিনটে মোষের মধ্যে দুটো মেয়ে মোষ। মহারাজা পুরুষ। দুটো মেয়ে-মোষই বছরের কোনো-না-কোনো সময়ে দুধ দেয়। বুড়ো মোেষটার মরার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আর দুটোও বুড়ো হতে চলল। সামনে দুর্দিন। লালটেমদের সংসার বেশ বড়ো। মা ঘুঁটে বিক্রি করে, বাবা দুধ, পেঁড়া, ঘি বেচে। এই করে কোনোরকমে দশজনের সংসার চলে। লালটেমদের দাদু আছে, আরও ছয় ভাইবোন আছে। তারা কোনে লেখাপড়া শেখেনি, মাঝে মাঝে মোষের দুধ, ঘি বা পেড়া ছাড়া কোনো ভালো খাবার খায়নি, খাটো ধুতি বা শাড়ি ছাড়া ভালো জামাকাপড় পরেনি, তারা একসঙ্গে এক-শো টাকাও কখনো চোখে দেখেনি।
তবু লালটেম কারো পরোয়া করে না। দিনভর সে মোষ চরায়, সাথিদের সঙ্গে খেলা করে, আর চারদিককার আকাশ-বাতাস-আলো-পাহাড় দেখে চমৎকার সময় কেটে যায়।
একদিন একটি রোগা মানুষ ওপার থেকে শীতের নদীর হাঁটুভর জল হেঁটে পার হয়ে এল। লোকটার ময়লা চাদরে ঢাকা, পরনে একটা পাজামা, কাঁধে মস্ত এক পুটুলি। লালটেম আর তার সাথিরা অবাক হয়ে লোকটাকে দেখছিল। কারণ, নদীর ওপারের জঙ্গলে বাঘ আছে, বুনো মোষ, দাঁতাল শুয়োর আর গন্ডার আছে, সাপ তো কিলবিল করছে। ওদিকে কেউ যায় না, একমাত্র কাঠুরেরা ছাড়া। তারাও আবার দল বেঁধে যায়, সঙ্গে লাঠি থাকে, বল্লম থাকে, তির-ধনুক থাকে আর কুড়ল তো আছেই।
লোকটা জল থেকে উঠেই পোঁটলাটা মাটিতে রেখে একগাল হেসে বলল, একটা জিনিস দেখবে?
হ্যাঁ-অ্যাঁ–লালটেমরা খুব রাজি।
লোকটা ধীরে-আস্তে পুটলির গিট খুলে চাদরটা মেলে দিল। লালটেমা অবাক হয়ে দেখে, ভিতরে কয়েকটা ইট।
তারা সমস্বরে বলে ওঠে, এ তো ইট!
রোগা লোকটা হেসে বলল, ইট ঠিকই, তবে সাধারণ ইট নয়। প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরোনো একটা রাজবাড়ির জিনিস। ওই জঙ্গলের মধ্যে আমি সেই রাজবাড়ির খোঁজ পেয়েছি।
রাজা বা রাজবাড়ি সম্পর্কে লালটেমের ধারণা খুব স্পষ্ট নয়। তবে সে জানে, একজন রাজা সোনার রুটি খেতেন। তাঁর রানি যে শাড়ি পরতেন সেটা জ্যোৎস্নার সুতো দিয়ে বোনা।
লোকটা ইটগুলো পুঁটলিতে বেঁধে হাত ঝেড়ে বলল, সেই রাজবাড়িটায় অনেক কিছু মাটির নীচে পোঁতা আছে। যে পাবে, সে এক লাফে বড়োলোক হয়ে যাবে। তবে কিনা সেখানে যখেরা পাহারা দেয়, সাপ ফণা ধরে আছে। চারদিকে যাওয়া শক্ত।
লালটেম বলে, তুমি তাহলে বড়োলোক হলে না কেন?
লোকটা অবাক হয়ে বলে, আমি! আমি বড়োলোক হয়ে কী করব? দুনিয়াতে আমার কেউ নেই। দিব্যি আছি, ঘুরে-ঘুরে সময় কেটে যায়। রাজবাড়িটা দেখতে পেয়ে আমি শুধু লোককে দেখানোর জন্য কয়েকটা ইট কুড়িয়ে এনেছি। এইতেই আমার আনন্দ।
লালটেম বলে, তোমাকে বাঘে ধরল না? সাপে কাটল না? বুনো মোষ তাড়া করল না?
লোকটা ভালোমানুষের মতো বলে, জানোয়ারেরাও বন্ধু আর শত্রু চিনতে পারে। আমি নিরীহ মানুষ, ওরাও সেটা টের পেয়েছিল। তাই কিছু বলেনি।
লোকটা তারপর গান গাইতে-গাইতে মাঠ পেরিয়ে চলে গেল। লালটেম তার সাথিদের সঙ্গে খেলায় মেতে গেল।
পরদিন ভোরবেলায় কোদাল-গাঁইতি হাতে কয়েকজন লোক নদীর ধারে এসে হাজির। তাদের মধ্যে একজন লোককে লালটেম চেনে। সে হল এ অঞ্চলের নামকরা গুন্ডা আর জুয়াড়ি প্রাণধর। লালটেমকে ডেকে সে লোকটা বলল, এই ছোঁড়া, ওই জঙ্গলের মধ্যে যাওয়ার রাস্তা আছে?
লালটেম ভালোমানুষের মতো বলে, কাঠুরেদের পায়ে-হাঁটা রাস্তা আছে।
লোকটা কটমট করে চেয়ে বলে, আমরা যে এদিকে এসেছি, খবরদার কাউকে বলবি না।
লোকগুলো হেঁটে শীতের নদী পার হয়ে ওপাশের জঙ্গলের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল।
লালটেমরা মুখ-তাকাতাকি করে নিজেদের মধ্যে খেলা শুরু করে দেয়। কিন্তু একটু বাদেই আবার কোদাল-শাবল হাতে একদল লোক আসে। তারাও জঙ্গলের মধ্যে পথ আছে কিনা জিগ্যেস করে, তারপর লালটেমরা যাতে আর কাউকে না বলে সে বিষয়ে সাবধান করে দিয়ে নদী পার হয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়ে।
সারাদিন যে এভাবে কত লোক জঙ্গলের মধ্যে গেল, তার গোনাগুনতি নেই। তাদের মধ্যে কানা-খোঁড়া-বুড়ো-কচি-বড়োলোক-গরিব সবরকম আছে। চোরের মতো হাবভাব সবার। কী যেন গোপন করছে। এদের দলে লালটেম নিজের বাবাকেও দেখে ভারি অবাক হয়।
বাবা লালটেমকে দেখে কিছু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমার ফিরতে দুদিন দেরি হবে। সাবধানে থেকো। মোষগুলোকে যত্নে রেখো। বাড়ি-বাড়ি দুধ দিও পেঁড়া বেচো, ঘি বিক্রি করো।
বাবা গেল। কিছুক্ষণ পর একদল খুঁটেউলির সঙ্গে মাকেও জঙ্গলে যেতে দেখল লালটেম।
মা কাছে এসে তাকে টেনে নিয়ে বলল, আমার ফিরতে একটু দেরি হবে বাবা। একদিন বা দুদিন। তুমি সব সামলে রেখো।