খানিকক্ষণ চেষ্টার পর যখন জয়চাঁদ হাল ছেড়ে দিতে যাচ্ছিল তখন লোকটার গলা দিয়ে একটা অস্ফুট আওয়াজ বেরিয়ে এল। উঃ বা আঃ গোছের। জয়চাঁদ দ্বিগুণ উৎসাহে লোকটাক কিছুক্ষণ দলাই-মলাই করল। প্রায় আধঘণ্টা পর লোকটার চেতনা ফিরে এল যেন।
লোকটি বলল, কে বটে তুমি?
আমাকে চিনবেন না। গাঙ পেরোবার জন্য দাঁড়িয়েছিলুম, হঠাৎ আপনার ডিঙিটা চোখে পড়ল।
লোকটা উঠে বসল। ঝড়ের বেগটা একটু কমেছে। বৃষ্টির তোড়টাও যেন আগের মতো নয়। লোকটা কোমর থেকে গামছা খুলে চোখ চেপে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলল, ও বড্ড ফাড়া গেল আজ। প্রাণে যে বেঁচে আছি সেই ঢের। তা তুমি যাবে কোথা?
জয়চাঁদ হতাশ গলায় বলল, যাবো ক্যাওটা গাঁয়ে। ওপার থেকে পাঁচ-সাত মাইল পথ। মেয়েটার বড্ড অসুখ খবর পেয়েই যাচ্ছিলুম। তা সে আর হয়ে উঠল না দেখছি।
লোকটা বলল, হু। কেমন অসুখ?
ভেদবমি হয়েছে শুনেছি। কলেরা কিনা কে জানে। গিয়ে জ্যান্ত দেখতে পাব কিনা বুঝতে পারছি না।
লোকটা বলল, মেয়েকে বড্ড ভালোবাসো, না?
তা বাসি। বড্ডই বাসি। মেয়েটাও বড্ড বাবা-বাবা করে।
লোকটা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। বলল, চলো তাহলে।
জয়চাঁদ অবাক হয়ে বলল, কোথায়?
তোমাকে পৌঁছে দিই।
খেপেছেন নাকি? কোনোরকমে প্রাণে বেঁচেছেন, এখন নৌকা বাইতে গেলে মারা যাবেন নির্ঘাত। আমার মেয়ের যা হওয়ার তা হয়েই গেছে। আর এই দুর্যোগে নদী পেরোনো সম্ভবও নয়।
রোগা লোকটা গামছাটা কোমরে বেঁধে নিয়ে বলল, ওহে, বাঁচা-মরা তো আছেই, সে কি আমাদের হাতে? আমাদের হাতে যা আছে তা হল, চেষ্টা। চলো, নৌকায় উঠে পড়ো, তারপর ভগবান যা করেন।
লোকটার গলার স্বরে কী ছিল কে জানে, জয়চাঁদ উঠে পড়ল।
বুড়ো লোকটা নৌকার খোল থেকে একটা বৈঠা তুলে নিয়ে গলুইয়ে বসল। অন্য প্রান্তে জয়চাঁদ। উত্তাল ঢেউয়ে নৌকাটা ঠেলে দিয়ে লোকটা বৈঠা মারতে লাগল।
ডিঙিটা একটা ঢেউয়ের মাথায় উঠে পরমুহূর্তেই জলের উপত্যকায় নেমে যাচ্ছিল। আবার উঠল, আবার নামল। ওঠা আর নামা। মাঝ দরিয়ায় জলের প্রচন্ড তুফানে উত্তাল ঢেউয়ে ডিঙিটা যেন ওলট-পালট খেতে লাগল। কিন্তু জয়চাঁদ দুহাতে শক্ত করে নৌকার দুটো ধার চেপে ধরে অবাক চোখে দেখল, জীর্ণ বৃদ্ধ মানুষটা যেন শাল খুঁটির মতো দাঁড়িয়ে। হাতের বৈঠা যেন জলকে তোলপাড় করে সব বাধা ভেঙে নৌকাটাকে তীরগতিতে নিয়ে চলেছে।
একটা বিশাল দোতলা সমান ঢেউ তেড়ে আসছিল বাঁ-দিক থেকে। জয়চাঁদ সেই করাল ঢেউয়ের চেহারা দেখে চোখ বুজে ফেলেছিল।
কে যেন চেঁচিয়ে বলল, জয়চাঁদ, ভয় পেও না।
অবাক হয়ে জয়চাঁদ ভাবল, আমার মান তো এর জানার কথা নয়।
ঢেউয়ের পর ঢেউ পার হয়ে এক সময়ে নৌকাটা ঘাটে এসে লাগল। লোকটা লাফ দিয়ে নেমে ডিঙিটাকে ঘাটের খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেলে বলল, এ ঘাট চেনো জয়চাঁদ?
জয়চাঁদ অবাক হয়ে অন্ধকারে একটা মস্ত বটগাছের দিকে চেয়ে বলল, কী আশ্চর্য! এ তো আনন্দপুরের ঘাট। এ ঘাট তো আমার গাঁয়ের লাগোয়া! এখানে এত তাড়াতাড়ি কী করে এলাম? নৌকায় আনন্দপুর আসতে তো সাত-আট ঘণ্টা সময় লাগে।
ঝড়ের দৌলতে আসা গেছে বাবু।
জয়চাঁদ মাথা নেড়ে বলল, না। ঝড় তো উলটোদিকে। যা হোক, পোঁছে তো গেছ।
জয়চাঁদ একটু দ্বিধায় পড়ে হঠাৎ বলল, আপনি কে?
আমি! আমি তো একজন মাঝি। তোমার দয়ায় প্রাণ ফিরে পেয়েছি।
জয়চাঁদের চোখে জল এল। মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে প্রাণ ফিরে দিতে পারি তেমন ক্ষমতা আমার নেই। আপনি আসলে কে?
বাড়ি যাও জয়চাঁদ। মেয়েটা তোমার পথ চেয়ে আছে।
জয়চাঁদ চোখের জল মুছে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যেতেই লোকটা পা সরিয়ে নিয়ে বলল, কিরো কী জয়চাঁদ, করো কী? বাড়ি যাও জয়চাঁদ।
গিয়ে?
মেয়ের কাছে যাও। সে ভালো আছে। অসুখ সেরে গেছে।
জানি মাঝি, আপনি যাকে রক্ষা করেন তাকে মারে কে? বুড়ো মাঝি একটু হাসল। তারপর, উত্তাল ঝড়ের মধ্যে বিশাল গাঙে তার ছোটো ডিঙিটা নিয়ে কোথায় যে চলে গেল কে জানে?
লালটেম
লালটেম কারও পরোয়া করে না। সে আছে বেশ। সকালবেলা সে তিনটে মোষ নিয়ে চরতে বেরোয়। এ জায়গাটা ভারি সুন্দর। একদিকে বেঁটে-বেঁটে চা-বাগানের দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তার। অন্য ধারে বড়ো একটা মাঠ। মাঠের শেষে তিরতিরে একটা ঠাণ্ডা জলের পাহাড়ি নদী–তাতে সবসময়ে নুড়ি-পাথর গড়িয়ে চলে। নদীর ওপারে জঙ্গল। আর তার পরেই থমথম করে আকাশ তক উঠে গেছে পাহাড়। সামনের পাহাড়গুলো কালচে-সবুজ। দূরের পাহাড়গুলোর শুধু চূড়ার দিকটা দেখা যায়–সেগুলো সকালে সোনারঙের দেখায়, দুপুরে ঝকঝকে সাদা। আর সন্ধের মুখে-মুখে ব্রোঞ্জের মতো কালোয় সোনার রং ধরে থাকে। আর চারপাশে সারাদিন মেঘ-বৃষ্টি-রোদ আর হাওয়ার খেলা। গাছে-গাছে পাখি ডাকে, কাঠবেড়ালি গাছ বায়, নদীর ওপাশে সরল চোখের হরিণ অবাক হয়ে চারদিক দেখতে-দেখতে আর থমকে-থমকে থেমে জল খেতে আসে।
লালটেম বেশ আছে। মোষ নিয়ে সে মাঠে গিয়ে ছেড়ে দেয়। এক জায়গায় বসে কোঁচড় থেকে মুড়ি খায়। নদীর জল খায়। তারপর খেলা করে। তার সঙ্গীসাথি কিছু কম নেই। তারাও সব মোষ, গোরু বা ছাগল চরাতে আসে। যে যার জীবজন্তু মাঠে ছেড়ে দিয়ে চোর-চোর খেলে, ডান্ডাগুলি খেলে; নদীতে নেমে সাঁতরায়, আরও কত কী করে।