আশ্চর্য এই যে, দর আর উঠল না।
একুশ হাজার টাকায় আলমারিটা কিনে মহানন্দে বাড়ি ফিরলেন মদনবাবু। যদিও মনে-মনে বুঝলেন, দরটা বড্ড বেশি হয়ে গেল।
পরদিন সকালে আলমারিটা কুলিরা ধরাধরি করে পৌঁছে দিয়ে গেল। দোতলার হলঘরের উত্তরদিকের জানালার পাশেই সেটা রাখা হল। বেশ ভারি জিনিস। দশটা কুলি গলদঘর্ম হয়ে গেছে এটাকে তুলতে।
নিলামওয়ালার দেওয়া চাবি দিয়ে আলমারিটা খুলে ফেললেন মদনবাবু।
নীচে আর ওপরে কয়েকটা ড্রয়ার। মাঝখানে ওয়ার্ডরোভ। মদনবাবু অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে দেখলেন জিনিসটা, বৰ্মা-সেগুন কাঠের তৈরি ভালো জিনিস। কিন্তু একুশ হাজার টাকা দরটা বেজায় বেশি হয়ে গেছে। তার আর কী করা! এ নেশা যার আছে তাকে মাঝে-মাঝে ঠকতেই হয়।
একুশ হাজার টাকা ভাবতে-ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন মদনবাবু। গভীর রাতে ম্যাকফারলন সাহেবকে স্বপ্নে দেখলেন। বুড়ো তাঁকে বলছে, তুমি মোটেই ঠকোনি হে, বরং জিতেছ।
মদনবাবু ম্লান হেসে বললেন, না সাহেব, নিছক কাঠের আলমারির জন্য দর হাঁকাটা আমার ঠিক হয়নি।
ম্যাকফারলন শুধু মাথা নেড়ে বলল, না-না আমার তা মনে হয় না! আমার তা মনে হয় না…
মদনবাবু মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে একবার জল খান রোজই। আজ ঘুম ভাঙল। পাশের টেবিল থেকে জলের গেলাসটা নিতে গিয়ে হঠাৎ শুনলেন, পাশের হলঘর থেকে যেন একটু খুটুর-খুটুর শব্দ আসছে। ওই ঘরে তাঁর সব সাধের পুরোনো জিনিস। মদনবাবু তাড়াতাড়ি উঠে টর্চ নিয়ে পাশের ঘরে হানা দিলেন।
টর্চটা জ্বালাতে যাবেন এমন সময় কে যেন বলে উঠল, দয়া করে বাতি জ্বালাবে না, আমার অসুবিধে হবে।
মদনবাবু ভারি রেগে গেলেন, টর্চের সুইচ টিপে বললেন, আচ্ছা নির্লজ্জ লোক তো! চুরি করতে ঢুকে আবার চোখ রাঙানো হচ্ছে! কে হে তুমি?
চোরটা যে কে বা কেমন লোক তা বোঝা গেল না। কারণ টর্চটা জ্বলল না। মদনবাবু টর্চটা বিস্তর ঝাঁকালেন, নাড়লেন, উলটে-পালটে সুইচ টিপলেন, বাতি জ্বলল না।
এ তো মহা ফ্যাসাদ দেখছি!
কে যেন মোলায়েম স্বরে বলল, অত ঘাবড়াচ্ছেন কেন?
মদনবাবু চোরকে ধরার জন্য আস্তিন গোটাতে গিয়ে টের পেলেন যে, তাঁর গায়ে জামা নেই, আজ গরম বলে খালি গায়ে শুয়েছিলেন হেঁড়ে গলায় একটা হাঁক মারলেন, শিগগির বেরও বলছি, নইলে গুলি করব। আমার কিন্তু রিভলবার আছে।
নেই।
কে বলল নেই?
জানি কি না।
কিন্তু লাঠি আছে।
খুঁজে পাবেন না।
কে বলল খুঁজে পাব না?
অন্ধকারে লাঠি খোঁজা কি সোজা?
আমার গায়ে কিন্তু সাংঘাতিক জোর, এক ঘুষিতে নারকেল ফাটাতে পারি।
কোনোদিন ফাটাননি।
কে বলল ফাটাইনি।
জানি কিনা। আপনার গায়ে তেমন জোরও নেই।
আমি লোক ডাকি, দাঁড়াও।
কেউ আসবে না। কিন্তু খামোকা কেন চেঁচাচ্ছেন?
চেঁচাব না? আমার এত সাধের সব জিনিস এ-ঘরে, আর এই ঘরেই কিনা চোর!
চোর বটে, কিন্তু এলেবেলে চোর নই মশাই।
তার মানে?
কাল সকালে বুঝবেন। এখন যান গিয়ে ঘুমোন। আমাকে ডিস্টার্ব করবেন না।
মদনবাবু ফের ঘাবড়ে গিয়ে ফিরে এলেন ঘরে। দুরুদুরু বুকে বসে থেকে পাশের ঘরের নানা বিচিত্র শব্দ শুনতে লাগলেন। তাঁর সাধের সব জিনিস বুঝি এবারে যায়!
দিনের আলো ফুটতেই মদনবাবু গিয়ে হলঘরে ঢুকে যা দেখলেন তাতে ভারি অবাক হয়ে গেলেন। ম্যাকফারলনের সেই কাট গ্লাসের পানপাত্রের সেট আর একটা গ্র্যাণ্ড ফাদার ক্লক হলঘরে দিব্যি সাজিয়ে রাখা। এ দুটো জিনিস কিনেছিল দুজন আলাদা খদ্দের। খুশি হবেন কি দুঃখিত হবেন তা বুঝতে পারলেন না মদনবাবু। কিন্তু অনেক ভেবেচিন্তে শেষে খুশি-খুশিই লাগছিল তাঁর।
আবার রাত হল। মদনবাবু খেয়েদেয়ে শয্যা নিলেন। তবে ঘুম হল না। এপাশ-ওপাশ করতে করতে একটু তন্দ্রা মতো এল। হঠাৎ হলঘরে আগের রাতের মতো শব্দ শুনে তড়াক করে উঠে পড়লেন। হলঘরে গিয়ে ঢুকে টর্চটা জ্বালাতে চেষ্টা করলেন।
কে?
তা দিয়ে আপনার কী দরকার? যান না গিয়ে শুয়ে থাকুন। আমাদের কাজ করতে দিন।
মদনবাবু একটু কাঁপা গলায় বললেন, তোমরা কারা বাবারা?
সে কথা শুনলে আপনি ভয় পাবেন।
ইয়ে তা আমি একটু ভীতু বটে। কিন্তু বাবারা, এসব কী হচ্ছে, একটু জানতে পারি না।
খারাপ তো কিছু হয়নি মশাই। আপনার তো লাভই হচ্ছে।
তা হচ্ছে, তবে কিনা চুরির দায়ে না পড়ি। তোমরা কি চোর?
লোকটা এবার রেগে গিয়ে বলল, কাল থেকে চোর-চোর করে গলা শুকোচ্ছেন কেন? আমরা ফালতু চোর নই।
তবে?
আমরা ম্যাকফারলন সাহেবের সব চেলা-চামুন্ডা। আমি হলুম গে সর্দার, যাকে আপনি কিনেছেন একুশ হাজার টাকায়।
আলমারি?
আজ্ঞে। আমরা সব ঠিক করেই রেখেছিলুম, যে খুশি আমাদের কিনুক না কেন আমরা শেষ অবধি সবাই মিলেমিশে থাকব, তাই–
তাই কি?
তাই সবাই জোট বাঁধছি, তাতে আখেরে আপনারই লাভ।
মদনবাবু বেশ খুশিই হলেন। তবু মুখে একটু দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে বললেন, কিন্তু বাবারা, দেখো যেন চুরির দায়ে না পড়ি।
মেলা ফ্যাচফ্যাচ না করে, যান না নাকে তেল দিয়ে শুয়ে থাকুন গে। কাজ করতে দিন।
মদনবাবু তাই করলেন। শুয়ে খুব ফিচিক-ফিচিক হাসতে গেলেন, হলঘরটা ভরে যাবে, দোতলা তিনতলায় যা ফাঁকা আছে, তাও আর ফাঁকা থাকবে না। এবার চারতলাটা না তুললেই নয়।
ভূত ও বিজ্ঞান
সন্ধে হয়ে আসছে। পটলবাবু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবেন বলে বেশ জোরেই হাঁটছেন, জোরে হাঁটার আরও একটা কারণ হল আকাশে বেশ ঘন কালো মেঘ জমেছে, ঝড়বৃষ্টি এলে একটু মুশকিল হবে। তিনি আজ আবার ছাতাটা নিয়ে বেরোননি।