চিঠিটা নিয়ে খুঁটিয়ে সবটা পড়লেন। কালিটা পরীক্ষা করলেন। কাগজটা পরীক্ষা করলেন। আতসকাঁচ দিয়ে অক্ষরগুলি দেখলেন ভালো করে। তারপর নয়নচাঁদের দিকে চেয়ে বললেন, এটা কি জনার্দনেরই হাতের লেখা?
ঠিক বুঝতে পারছি না। জনার্দন কয়েকটা হ্যাঁণ্ডনোট আমাকে লিখে দিয়েছিল। সেই লেখার সঙ্গে অনেকটা মিল আছে।
বরদা বললে, হু, মনে হচ্ছে গামছাটা তেমন টেকসই ছিল না।
তার মানে কী বাবা? এখানে গামছার কথা ওঠে কেন?
গামছাই আসল। জনার্দন গলায় গামছা বেঁধে ফাঁসে লটকেছিল তো! মনে হচ্ছে, গামছা ছিঁড়ে সে পড়ে যায় এবং বেঁচেও যায়। এই চিঠি যদি তারই লেখা হয়ে থাকে তো, বিপদের কথা। আপনি বরং কটা দিন একটু ভালো খাওয়া-দাওয়া করুন। আমোদ-আহ্লাদও করে নিন প্রাণভরে।
তাঁর অর্থ কী বাবা! কী বলছ সব? আমি জীবনে কখনো ফুর্তি করিনি। তা জানো?
জানি বলেই বলছি। টাকার পাহাড়ের ওপর শকুনের মতো বসে থাকা কি ভালো? অমাবস্যার তো আর দেরিও নেই!
নয়নচাঁদ বাক্যহারা হয়ে চেয়ে রইলেন। তারপর বললেন, জনার্দন যে মরেছে, তার সাক্ষীসাবুদ আছে। লাশটা শনাক্ত করেছিল তার আত্মীয়রাই।
তবে তো আরও বিপদের কথা। এ যদি ভূতের চিঠি হয়ে থাকে, তবে আমাদের তো কিছুই করার নেই।
নয়নচাঁদ এবার ভ্যাক করে কেঁদে উঠে বললেন, প্রাণটা বাঁচাও বাবা বরদা, যা বলো তাই করি।
বরদা এবার একটু ভাবলেন। তারপর মাথাটা নেড়ে বললেন, ঠিক আছে দেখছি।
এই বলে বরদাচরণ বেরিয়ে গেলেন। ফিরে এলেন তিনদিন পর। মাথার চুল উসকোখুসকো, গায়ে ধুলো, চোখ লাল। বললেন, পেয়েছি।
নয়নচাঁদ আশান্বিত হয়ে বললেন, পেরেছ ব্যাটাকে ধরতে? যাক বাঁচা গেল।
বরদা মাথা নেড়ে বললেন, তাকে ধরা অত সোজা নয়। তবে জনার্দনের বউ-ছেলেমেয়ের খোঁজ পেয়েছি। এই শহরের একটা নোংরা বস্তিতে থাকে, ভিক্ষে-সিক্ষে করে, পরের বাড়িতে ঝি চাকর খেটে কোনোরকমে বেঁচে আছে।
অ, কিন্তু সে খবরে আমাদের কাজ কী?
বরদা কটমট করে চেয়ে থেকে বললেন চিঠিটা যদি ভালো করে পড়ে থাকেন, তবে নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, ভূতটার কেন আপনার ওপর রাগ! তার বউ-ছেলেমেয়ের ভিখিরি হয়ে যাওয়াটা সে সহ্য করতে পারছে না।
তা বটে।
যদি বাঁচতে চান তো, আগে তাদের ব্যবস্থা করুন।
কী ব্যবস্থা বাবা বরদা?
তাদের বাড়িঘর ফিরিয়ে দিন! আর যা সব ক্রোক করেছিলেন, তাও।
ওরে বাবা? তার চেয়ে যে মরাই ভালো।
আপনি চ্যাম্পিয়ন।
কীসে বাবা বরদা?
কিপটেমিতে। আচ্ছা আসি, আমার কিছু করার নেই কিন্তু।
দাঁড়াও দাঁড়াও। অত চটো কেন? জনার্দনের পরিবারকে সব ফিরিয়ে দিলে কিছু হবে?
মনে হয় হবে। তারপর আমি তো আছিই।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নয়নচাঁদ বললেন, তাহলে তাই হবে বাবা।
অমাবস্যার আর দেরি নেই। মাঝখানে মোটে সাতটা দিন। নয়নচাঁদ জনার্দনের ঘরবাড়ি, জমিজমা, ঘটিবাটি এবং সোনাদানা সবই তার পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিলেন। জনার্দনের বউ আনন্দে কেঁদে ফেলল। ছেলেমেয়েগুলি বিহ্বল হয়ে গেল।
বরদা নয়নচাঁদকে বললেন, আজ রাতে রুটির বদলে ভালো করে পরোটা খাবেন। সঙ্গে ছানার ডালনা আর পায়েস।
বলো কী?
যা বলছি, তাই করতে হবে। আপনার প্রেশার খুব লো। শক-টক খেলে মরে যাবেন।
তাই হবে বাবা বরদা। যা বলবে করব। শুধু প্রাণটা দেখো।
নয়নচাঁদ পরোটা খেয়ে দেখলেন, বেশ লাগে। কোনোদিন খাননি। ছানার ডালনা খেয়ে আনন্দে তাঁর চোখে জল এসে গেল। আর পায়েস খেয়ে পূর্বজন্মের কথাই মনে পড়ে গেল তাঁর। না, পৃথিবী জায়গাটা বেশ ভালোই।
সকালবেলাতেই বরদা জানালা দিয়ে উঁকি মারলেন।
এই যে নয়নচাঁদবাবু কেমন লাগছে?
গায়ে বেশ বল পাচ্ছি বাবা। পেটটাও ভুটভাট করছে না তেমন।
আপনার কাছারিঘরে বসে কাগজপত্র সব দেখলাম। আরও দশটা পরিবার আপনার জন্য পথে বসেছে। তাদের সব সম্পত্তি ফিরিয়ে না দিলে কেসটা হাতে রাখতে পারব না।
বলো কী বাবা বরদা? এরপর আমিই পথে বসব।
প্রাণটা তো আগে।
কী আর করেন, নয়নচাঁদ বাকি দশটা পরিবারের যা কিছু দেনার দায়ে দখল করেছিলেন, তা সবই ফিরিয়ে দিলেন। মনটা একটু দমে গেল বটে, কিন্তু ঘুমটা হল রাতে।
অমাবস্যা এসে পড়ল প্রায়। আজ রাত কাটলেই কাল অমাবস্যা লাগবে।
সন্ধেবেলা বরদা এসে বললেন, কেমন লাগছে নয়নচাঁদবাবু, ভয় পাচ্ছেন না তো!
ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছি বাবা!
ভয় পাবেন না। আজ রাত্রে আরও দুখানা পরোটা বেশি খাবেন। কাল সকালে যত ভিখিরি আসবে, কাউকে ফেরাবেন না। মনে থাকবে?
নয়নচাঁদ হাঁপ-ছাড়া গলায় বললেন, তাই হবে বাবা, তাই হবে। সব বিলিয়ে দিয়ে লেংটি পরে হিমালয়ে চলে যাব, যদি তাতে তোমার সাধ মেটে।
পরদিন সকালে উঠে নয়নচাঁদের চক্ষু চড়কগাছ। ভিক্ষে দেওয়া হয় না বলে, এই বাড়িতে কখনো ভিখিরি আসে না। কিন্তু সকালে নয়নচাঁদ দেখেন, বাড়ির সামনে শয়ে-শয়ে ভিখিরি জুটেছে। দেখে নয়নচাঁদ মূৰ্ছা গেলেন। মূৰ্ছা ভাঙার পর ব্যাজার মুখে উঠলেন। সিন্দুক খুলে টাকা বের করে চাকরকে দিয়ে ভাঙিয়ে আনালেন। ভিখিরিরা যখন বিদেয় নিল, তখন নয়নচাঁদের হাজার খানেক টাকা খসে গেছে।
নয়নচাঁদ মাথায় হাত দিয়ে বসে রইলেন অনেকক্ষণ। হাজার টাকা যে অনেক টাকা।
দুপুরে একরকম উপোস করেই কাটালেন নয়নচাঁদ। টাকার শোক তো কম নয়!