ঘুম ভাঙতেই নয়নচাঁদ চারদিকে চেয়ে দেখলেন। রাত্রিবেলা এমনিতেই নানারকমের শব্দ হয়। ইঁদুর দৌড়য় আরশোলা খরখর করে, কাঠের জোড় পটপট করে ছাড়ে, হাওয়ায় কাগজ ওড়ে, আরও কত কী। তাই নয়নচাঁদ তেমন ভয় পেলেন না। তবে আধো ঘুমের মধ্যে তাঁর মনে। হয়েছিল শব্দটা হল জানলায়। জানালার শিক-এ যেন টুং করে কেউ একটা ঢিল মেরেছিল।
বিছানার মাথার দিকে জানালার পাশেই একটা টেবিল। তাতে ঢাকা দেওয়া জলের গেলাস। নয়নচাঁদ টর্চ জ্বেলে গেলাসটার দিকে হাত বাড়িয়েই থমকে গেলেন। টেবিলের ওপর একটা কাগজের মোড়ক পড়ে আছে।
নয়নচাঁদ উঠে বড়ো বাতিটা জ্বেলে মোড়কটা খুললেন। যা ভেবেছেন তাই। ঢিলে জড়িয়ে কে একখানা চিঠি পাঠিয়েছে তাঁকে, সাদামাটা একখানা কাগজে লাল অক্ষরে লেখা: নয়নচাঁদ, আমাকে মনে আছে? সামান্য দেনার দায়ে আমার ভিটেয় ঘুঘু চরিয়েছিলে। শেষ অবধি গলায় গামছা বেঁধে আমাকে আত্মহত্যা করতে হয়। আমার বউ আর বাচ্চারা ভিখিরি হয়ে সেই থেকে পথে-পথে ঘুরছে। অনেক সহ্য করেছি, আর না। আগামী অমাবস্যায় ঘাড় মটকাবো। ততদিন ভালোমন্দ খেয়ে নাও। ফুর্তি করো, গাও, নাচো, হাসো। বেশিদিন তো আর নয়–ইতি–তোমার যম, জনার্দন।
নয়নচাঁদ ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলেন। তাঁর শিথিল হাত থেকে চিঠিটা পড়ে গেল। চাকরবাকর, বউ, ছেলেমেয়েদের ডাকার চেষ্টা করলেন। গলা দিয়ে স্বর বেরোল না।
জনার্দনকে খুব মনে আছে নয়নচাঁদের। নিরীহ গোছের মানুষ। তবে বেশ খরচের হাত ছিল। প্রায়ই হ্যান্ডনোট লিখে নয়নচাঁদের কাছ থেকে সুদে টাকা ধার করত। কখনো টাকা শোধ দিতে পারেনি। নয়নচাঁদ মামলায় জিতে লোকটার বাড়িঘর সব দখল করে নেয়। জনার্দন সেই দুঃখে বিবাগী হয়ে কোথায় চলে যায়। মাসখানেক বাদে নদীর ওপাড়ে এক জঙ্গলের মধ্যে একটা আমড়া গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় তার পচা-গলা লাশটা পাওয়া যায়। তার বউ ছেলেপিলেদের কী হয়েছে, তা অবশ্য নয়নচাঁদ জানেন না। সেই ঘটনার পর বছর তিন-চার কেটে গেছে।
নয়নচাঁদের ভূতের ভয় আছে। তা ছাড়া অপঘাতকেও তিনি খুবই ভয় পান। খানিকক্ষণ বাদে শরীরের কাঁপুনিটা একটু কমলে, তিনি জল খেলেন এবং বাড়ির লোকজনকে ডাকলেন। রাত্রে আর কেউ ঘুমোতে পারল না। এই রহস্যময় চিঠি নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা-গবেষণা হতে লাগল।
পরদিন সকালে গোয়েন্দা বরদাচরণকে ডেকে পাঠানো হল। গোয়েন্দা বরদাচরণ পাড়ারই লোক।
বরদাচরণ লোকটা একটু অদ্ভুত। স্বাভাবিক নিয়মে কোনো কাজ করতে তিনি ভালোবাসতেন না। তাঁর সব কাজেই একটা বৈশিষ্ট্য আছে। এই যেমন কোনো বাড়িতে গেলে তিনি ককনো সদর দরজা দিয়ে সেই বাড়িতে ঢুকবেন না। এমনকী, খিড়কি দরজা দিয়েও না। তিনি হয় পাঁচিল টপকাবেন, নয়তো গাছ বেয়ে উঠে ছাদ বেয়ে নামবেন। এমনকী জানলা ভেঙেও তাঁকে ঢুকতে দেখা গেছে।
নয়নচাঁদের বাড়িতে বরদা ঢুকলেন টারজানের কায়দায়। বাড়ির কাছেই একটা মস্ত বটগাছ আছে। সেই বটের একটা ঝুরি ধরে কষে খানিকটা ঝুল খেয়ে, বরদা পাশের একটা জামগাছের ডাল ধরলেন। সেটা থেকে লাফিয়ে পড়লেন একটা চালতা গাছে। সেখান থেকে নয়নচাঁদের বাড়ির পাঁচিল ডিঙিয়ে অবশেষে একটা রেইন পাইপ ধরে তিনতলার জানালায় উঁকি দিয়ে হাসিমুখে বললেন, এই যে নয়নবাবু, কী হয়েছে বলুন তো?
জানালায় আচমকা বরদাচরণকে দেখে নয়নচাঁদ ভিরমি খেয়ে প্রথমটায় গোঁ-গোঁ করতে লাগলেন। চোখেমুখে জলের ঝাঁপটা দিয়ে তাঁকে ফের সামাল দেওয়া হল। বরদাচরণ ততক্ষণ ধৈর্যের সঙ্গে জানালার বাইরে পাইপ ধরে ঝুলে রইলেন।
অবশেষে যখন ঘটনাটা বরদাচরণকে বলতে পারলেন নয়নচাঁদ, তখন বরদা খুব গম্ভীর মুখে বললেন, তাহলে এই জানালাটাই! এটা দিয়েই ঢিলেবাঁধা চিঠিটা ছোঁড়া হয়েছিল তো?
হ্যাঁ বাবা বরদা।
জানালাটা খুব নিবিষ্টভাবে পরীক্ষা করে বরদা বললেন, হুম, অনেকদিন জানালাটা রং করাননি দেখছি।
না। খামোকা পয়সা খরচ করে কী হবে? জানালা রং করালেও আলো-হাওয়া আসবে না করালেও আসবে। ঝুটমুট খরচ করতে যাব কেন?
তার মানে আপনি খুব কৃপণ লোক, তাই না?
কৃপণ নই বাবা, লোকে বাড়িয়ে বলে। তবে হিসেবি বলতে পারো।
কাল রাতে আপনি কী খেয়েছিলেন?
কেন বাবা বরদা, রোজ যা খাই, তাই খেয়েছি। দু-খানা রুটি আর কুমড়োর হেঁচকি।
বরদাচরণ গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি খুবই কৃপণ। ভীষণ কৃপণ।
না বাবা, কৃপণ নই। হিসেবি বলতে পারো।
আমার ফিস কত জানেন? পাঁচশো টাকা, আর খরচপাতি যা লাগে!
নয়নচাঁদ ফের ভিরমি খেলেন। এবার জ্ঞান ফিরতে তাঁর বেশ সময়ও লাগল।
বরদা বিরক্ত হয়ে বললেন, কৃপণ বা হিসেবি বললে আপনাকে কিছুই বলা হয় নাঃ আপনি যাচ্ছেতাই রকমের কৃপণ। বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে কৃপণ লোক আপনিই।
নয়নচাঁদ মুখখানা ব্যাজার করে বললেন, পাড়ার লোক হয়ে তুমি পাঁচশো টাকা চাইতে পারলে? তোমার ধর্মে সইল?
আপনার প্রাণের দাম কি তার চেয়ে বেশি নয়?
কিছু কমই হবে বাবা। হিসেব করে দেখছি আমার প্রাণের দাম আড়াইশো টাকার বেশি নয়।
তবে আমি চললুম, ভিজিট বাবদ কুড়িটা টাকা আমার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবেন।
নয়নচাঁদ আঁতকে উঠে বললেন, যেও না বাবা বরদা, ওই পাঁচশো টাকাই দেবোখন।
বরদাচরণ এবার পাইপ বেয়ে নেমে সিঁড়ি বেয়ে ঘরে এসে উঠলেন। হাত বাড়িয়ে বললেন, চিঠিটা দেখি।