কালবোশেখির নিয়ম হল, সে বেশিক্ষণ থাকে না। আধঘণ্টা পরে ঝড় থামল, বৃষ্টি কমল। কিন্তু চারদিক ঘুরঘুটি অন্ধকার। কোথাও কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না।
দুজনে একটা জায়গায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।
গদাধর বলল, এ কোথায় এলুম!
ময়না বলল, কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না। আমার ভয় করছে।
জমিজমা আর টাকাপয়সা সব হাতছাড়া হওয়ায় গদাধরের আর ভয়ডর নেই। সে ময়নার হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরে বলল, আর ভয়টা কীসের?
ময়না বলল, চলো, ফিরে যাই।
গদাধর একটা শ্বাস ফেলে বলল, ফিরব বললেই কি ফেরা যায়? এ কোন জায়গাটায় এসে পড়লুম তাই বা কে জানে? পথঘাট আন্দাজ করা কি সোজা? ঝড়ের ধাক্কায় অনেকটা এসে পড়েছি। চলো, দেখি একখানা গ্রামট্রাম পাওয়া যায় কিনা!
অন্ধকারে ঝোঁপজঙ্গল ভেঙে তারা ধীরে ধীরে এগোতে লাগল। গ্রাম বা লোকবসতি পেলেই যে আশ্রয় মিলবে এমন ভরসা নেই। উটকো লোককে কেই-বা আদর করে ঘরে জায়গা দেয়? আজকাল যা চোর-ডাকাতের উপদ্রব।
একটা জঙ্গলমতো জায়গা পেরোতেই সামনে একটা আলো দেখতে পেল গদাধর। বলল, ওই তো আলো দেখা যাচ্ছে। চলো, দেখা যাক, মাথা গোঁজার জায়গা মেলে কিনা!
সামনে এগিয়ে একখানা মাঠকোঠা দেখা গেল বটে, তবে তার বেশ দৈন্যদশা। সামনের ঘরে একখানা হ্যারিকেন জ্বলছে। বন্ধ দরজায় খুটখুট শব্দ করে গদাধর ভারি বিনয়ের গলায় বলল, আমরা বড়ো দুঃখী মানুষ। মশাই, একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়া যাবে?
ভিতর থেকে বাজখাঁই গলায় কে যেন বলে উঠল, ভিতরে এসো, দরজা ভেজানো আছে।
দুজনে ভারি জড়সড়, ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকল। ঘরের কোনে রাখা হ্যারিকেনের আলোয় দেখা গেল, সামনে একটা তক্তপোশ, তাতে গোটানো বিছানা, কয়েকটা বাক্স-প্যাঁটরা, কিছু হাঁড়িকড়ি। কিন্তু ঘরে কেউ নেই।
গদাধর গলাখাঁকারি দিয়ে ভারি নরম সুরে বলল, আজ্ঞে, অপরাধ নেবেন না। উৎপাত করতেই এসেছি বলতে পারেন। তবে বিপদে পড়েই আসা। আমরা বড়ো দুর্দশায় পড়েছি কিনা!
কে যেন ভরাট গলায় বলে উঠল, দুর্দশার তো কিছু দেখছি না হে! কে বলল দুর্দশায় পড়েছ? একটু হাওয়া ছেড়েছিল আর দু-ফোঁটা বৃষ্টি পড়েছে, এই তো! তা চাষিবাসিকে তো ঝড়ে-জলে কতই কাজ করতে হয়।
তা বটে, বলে গদাধর হাত কচলাতে-কচলাতে বলল, যদি দয়া করে একটু আশ্রয় দেন তো দাওয়াতে বসেই রাতটা কাটিয়ে দেবখন।
দাওয়ায়! দাওয়ায় কেন হে? দিব্যি ঘরদোর রয়েছে, দাওয়ায় থাকবে কোন দুঃখে? ভিতরের ঘরে যাও, শুকনো কাপড়টাপড় পাবে। পরে নাও গে। উনুনে আঁচ দেওয়া আছে, খিচুড়ি চাপিয়ে দিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকো।
ময়না ফিসফিস করে বলল, গলা পাচ্ছি বটে, কিন্তু কাউকে দেখতে পাচ্ছি না কেন বলো তো!
গদাধরও ভড়কে গিয়ে বলল, তাই তো!
ময়না বলল, জিজ্ঞেস করো না!
গদাধর ফের হাত কচলে বলল, আপনি কোথা থেকে কথা বলছেন আজ্ঞে? সামনে এলে একটু পদধূলি নিতুম।
ও বাবা, পদধূলি বড়ো কঠিন জিনিস। খুঁটির গায়ে একটা হাতআয়না ঝুলছে দেখতে পাচ্ছ?
গদাধর ইতিউতি তাকিয়ে দেখল, ভিতরের দরজার পাশে কাঠের খুঁটিতে একটা ছোট্ট হাতআয়না ঝুলছে বটে।
আয়নাখানা পেড়ে ওর ভিতরে তাকাও।
গদাধর অবাক হয়ে তাড়াতাড়ি গিয়ে আয়নাটা পেড়ে তুলে ধরতেই এমন আঁতকে উঠল যে, একটু হলেই সেটা পড়ে যেত হাত থেকে। আয়নার ভিতরে একখানা সুড়ঙ্গে লম্বা মুখ। গোঁফ আছে। জুলজুলে চোখ। মাথায় বাবরি চুল। ভয়ের কথা হল, সে মুখের ঠোঁট নড়ছে আর কথা বেরিয়ে আসছে।
দুজনেরই ভিরমি খাওয়ার অবস্থা।
আয়নার লোকটা বলল, ওরে বাপ, আগে তো প্রাণ রক্ষে হোক, তারপর দাঁতকপাটি লেগে পড়ে থাকলে থেকো।
ময়না আর গদাধর কিছুক্ষণ বাক্যহারা হয়ে ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে রইল। এর পর ময়নাই প্রথম কথা কয়ে উঠল, আমরা বড্ড ভয় পাচ্ছি যে!
বলি ভয়টা কীসের, অ্যাাঁ। এই জন্যই বলে লোকের উপকার করতে যাওয়াটাই আহাম্মকি।
গদাধর সামলে নিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, না না, ওর উপর কুপিত হবেন না, আমরা না-হয় ভয়ডর সব গিলে ফেলছি।
ভালো। টপ করে ওসব ফালতু জিনিস গিলে পেটে চালান করে দাও। দিয়েছ?
ময়না আর গদাধর ঘনঘন ঢোক গিলে যেন একটু সামলে নিল। গদাধর বলল, নাঃ, এখন আর তেমন বুক ঢিবঢিব করছে না। তোমার করছে ময়না?
নাঃ। মাথাটা একটু ঝিমঝিম করছে, এই যা!
আয়নার লোকটা বলল, ওতেই হবে। এখন গিয়ে রান্নার জোগাড়যন্তর করে ফ্যালো।
গদাধর আমতা-আমতা করে বলল, ফস করে অন্দরমহলে ঢুকব? কেউ যদি কিছু বলে?
লোকটা হাঃ হাঃ করে হেসে বলল, বলার মতো আছেটা কে হে? এই আমি ছাড়া এ বাড়িতে আর জনমনিষ্যি নেই। যাও যাও, ভেজা কাপড়ে বেশিক্ষণ থাকলে নিউমোনিয়া ধরে ফেলবে।
কথা না-বাড়িয়ে তারা ভিতরের ঘরে এসে দেখল, দিব্যি ব্যবস্থা। আলনায় কয়েকখানা পাটভাঙা ডুরে শাড়ি, দুটো বোয়া ধুতি আর মোটা কাপড়ের কামিজ রয়েছে।
কুয়ো থেকে জল তুলে হাতমুখ ধুয়ে, ভেজা কাপড় বদল করে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল, উনুনে আঁচ উঠে গেছে। চালডাল খুঁজতেই বেরিয়ে পড়ল। আলু, লঙ্কা, ফোড়ন, তেল সবই অল্পস্বল্প রয়েছে।
ময়না বলল, হ্যাঁ গা, আয়নার জ্যাঠামশাইকে জিজ্ঞেস করো না, উনি আমাদের সঙ্গে খাবেন কিনা।
গদাধর গিয়ে আয়নাটা নিয়ে এল, তারপর সুড়ঙ্গে মুখখানার দিকে চেয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, আজ্ঞে, আপনি পেরসাদ করে না-দিলে কোন মুখে খিচুড়ি খাই বলুন। ময়নার বড়ো ইচ্ছে আপনাকেও একটু ভোগ চড়ায়।