তাঁর চোখের সামনে ছিলো গ্রিক ও ইংরেজি মহৎ নাট্যসৃষ্টিগুলো। তিনি তখনকার বাঙলা নাটকের দীনতায় দুঃখ বোধ করতেন। ১৮৫৮ সালে বেলগাছিয়া নাট্যশালায় মহাআড়ম্বরে অভিনীত হয় রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী। মধুসূদন দেখেন সেনাট্যাভিনয়। ওই নাটক দেখে অনেকটা উপহাস করেন তিনি। প্রতিজ্ঞা করেন অল্পকালের মধ্যে তিনি লিখে দেবেন সত্যিকার নাটক। লিখেও ফেলেন একটি নাটক, নাম তার শর্মিষ্ঠা। এটি বের হয় ১৮৫৯ অব্দে। এটি বাঙলা ভাষায় সত্যিকারের প্রথম আধুনিক নাটক। কাহিনীবিন্যাস, অঙ্ক ও দৃশ্যসজ্জা, ভাষা, নাটকীয়তা, সব মিলে এটি বাঙলা ভাষার প্রথম খাঁটি নাটক। মধুসূদন শর্মিষ্ঠা নাটকের শুরুতে সেকালের নাটকের গ্রাম্যতায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন :
অলীক কুনাট্যরঙ্গে মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।
বাঙলা নাটককে কুনাটকের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন মধুসূদন; তবে বাঙলার মঞ্চ আজো কুনাটকেরই দখলে।
মধুসূদন শর্মিষ্ঠা নাটকের কাহিনী নিয়েছিলেন মহাভারত থেকে। মহাভারতে যযাতি ও শর্মিষ্ঠার কাহিনী রয়েছে। মধুসূদন সে-পুরানো গল্পকে নতুন কালের মতো করে পরিবেশন করেন। নাটকটি মিলনমধুর। এরপরে মধুসূদন লেখেন দুটি প্রহসন : একেই কি বলে সভ্যতা?, ও বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ। প্রথম প্রহসনটিতে মধুসূদন বিদ্রুপের আঘাত করেন। সেকালের বিপথগামী তরুণদের এবং দ্বিতীয়টিতে আঘাত করেন ভীমরতিগ্রস্ত বুড়োদের। তখন বাঙলা ভাষায় প্রচলিত ছিলো মোটা রসিকতা। প্রহসন দুটিতে মধুসূদন রসিকতাকে করে তোলেন আধুনিক রুচিসম্মত।
১৮৬০-এ বেরোয় মধুসূদনের দ্বিতীয়, অভিনব, নাটক পদ্মবতী। তিনি শর্মিষ্ঠা নাটকের কাহিনী নিয়েছিলেন মহাভারত থেকে, পদ্মাবতীর কাহিনী নেন গ্রিক উপকথা থেকে। গ্রিক উপকথায় প্যারিসের বিচার’ নামে একটি গল্প আছে। গল্পটি চমৎকার। দেবী ডিসকর্ডিয়া তৈরি করে একটি সোনার আপেল। তার উদ্দেশ্য ভালো ছিলো না, সে চেয়েছিলো জুননা, প্যালাস এবং ভেনাস নামক তিন দেবীর মধ্যে বিরোধ বাধাতে। সে ওই আপেলটির গায়ে যে দেবী সবচেয়ে রূপসী সে পাবে এ-আপেল’ কথাটি লিখে আপেলটি ফেলে দেয় জুনো, প্যালাস এবং ভেনাসের সামনে। তিনজনই নিজেকে রূপসী ভাবে এবং কামনা করে আপেলটি। তাই তারা বিচারক মানে রাজপুত্র প্যারিসকে। তারা বলে, আপনি যাকে সবচেয়ে রূপসী বিবেচনা করেন, তাকে দিন এ-আপেলটি। প্যারিসকে একেক দেবী একেক লোভ দেখায়। প্যারিস সেকে দেয় আপেলটি। এ-নিয়ে পরে প্যারিস জড়িয়ে পড়েছিলো মহাসংকটে, সে-সংকটের কাহিনী আছে হোমারের ইলিয়াড কাব্যে। মধুসূদন এ-গ্রিক গল্পকে ভারতীয় রূপ দিয়ে লেখেন “পদ্মাবতী”।
তাঁর শ্রেষ্ঠ নাটক কৃষ্ণকুমারীনাটক। এটি তিনি লিখেছিলেন ১৮৬০-এর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে, আর এটি প্রকাশিত হয় ১৮৬১ অব্দে। এটি এক মর্মস্পর্শী ট্র্যাজেডি। উদয়পুরের রাজকন্যা কৃষ্ণকুমারীর জীবনের করুণ পরিণতি এর বিষয়। মধুসূদন এনাটকের কাহিনীর বীজ পেয়েছিলেন টডের লেখা রাজস্থানের কাহিনী গ্রন্থে। মধুসূদন এনাটকে পাশ্চাত্য ট্র্যাজেডির আদর্শ পুরোপুরি কাজে লাগান। এর কাহিনী এমন : উদয়পুরের রাজকন্যা কৃষ্ণকুমারী অপরূপ রূপসী। তার পিতা ভীমসিংহ। রাজ্য হিশেবে উদয়পুর দুর্বল। জয়পুরের রাজা জয়সিংহ কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। অন্যদিকে মরুদেশের রাজা মানসিংহও দেয় কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ের প্রস্তাব। তারা দুজনই উপযুক্ত। ভীমসিংহ জয়সিংহের সাথে বিয়ে দিতে চায় কৃষ্ণাকে। কিন্তু কৃষ্ণা অনুরাগী মানসিংহের। রাজা পড়ে বিপদে; সে কাকে দান করবে কন্যা? একজনকে দিলে আরেকজন আক্রমণ করবে রাজ্য। চারদিক থেকে আক্রান্ত হয় ভীমসিংহের দুর্বল রাজ্য উদয়পুর। রাজ্যরক্ষার এক ভয়াবহ প্রস্তাব রাজাকে দেয় মন্ত্রী। তা হচ্ছে যদি কৃষ্ণাকে হত্যা করা হয় তবে আর কোনো বিপদ থাকবে না। রাজা তাতে রাজি হয়। সেনাপতি বলেন্দ্ৰসিংহের ওপর ভার পড়ে কৃষ্ণকুমারীকে হত্যার। বলেন্দ্র হত্যা করতে গিয়ে নিজের আবেগে ব্যর্থ হয়; কিন্তু কৃষ্ণা নিজে বুকে তরবারি বিদ্ধ করে আত্মহত্যা করে। এ-কাহিনীকে এক বেদনাকরুণ রূপ দিয়েছেন মধুসূদন তাঁর নাটকে। কাহিনী যতোই এগিয়ে যায়, আমরা ততই এগিয়ে যাই বিষাদময় পরিণতির দিকে। নিজের ভাগ্যের জন্যে বিন্দুমাত্র দায়ী ছিলো না কৃষ্ণা। মধুসূদন তাকে এঁকেছেন সহজ সরল আকর্ষণীয় করে। তার মতো নিস্পাপ মেয়ে যে এরকম। পরিণতির মুখোমুখি দাঁড়াবে, তা নিয়তি ছাড়া আর কে বলতে পারে! তবে আমরা আর নিয়তিতে বিশ্বাস করি না। মধুসূদন এরপরে লিখেছিলেন আরেকটি নাটক; নাম মায়াকানন (১৮৭৪)। এটি বের হয় তাঁর মৃত্যুর পরে।
মধুসূদনের সাথেসাথে একজন দুঃসাহসী প্রতিভাবান নাট্যকার আসেন বাঙলা নাটকের ক্ষেত্রে। তিনি দীনবন্ধু মিত্র [১৮৩০-১৮৭৩)। তিনি অল্পায়ু ছিলেন, কিন্তু লিখেছিলেন। অনেকগুলো নাটক। তাঁর প্রথম নাটকটি আলোড়ন জাগায় দারুণভাবে। দীনবন্ধু মিত্র জন্মগ্রহণ করেন নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতার নাম কালাচাঁদ মিত্র। তাঁর পিতৃদত্ত নাম গন্ধর্বনারায়ণ মিত্র। দীনবন্ধু ডাকবিভাগে চাকুরি করতেন। কিন্তু সরকারি চাকুরি তাঁকে ভীত করতে পারে নি। তাঁর প্রথম নাটকের নাম নীলদর্পৰ্ণনাটক। নাটকটি বেরোয় ১৮৬০-এ। প্রকাশের সাথে সাথে এটি সাহিত্য এবং সমাজে জাগায় আলোড়ন। এটি এক বিপ্লবী রচনা। তখন বাঙলার গ্রামে গ্রামে নীলকরদের অত্যাচার চরমে উঠেছিলো। নীলকরদের অত্যাচার তিনি তুলে ধরেন এ-নাটকে। নাটকটি প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে। তখন নাটকে নাট্যকারের নাম ছিলো না, তিনি গোপন করেন নিজের নাম। এ-নাটকে তিনি নীলকরদের অত্যাচারে একটি পরিবারের ধ্বংসের কাহিনী বলেন। সেপরিবারটি নবীনমাধবদের। দীনবন্ধু তীব্র আবেগ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর নাটকে। নাটক হিশেবে এটি অসাধারণ হয়তো নয়, কিন্তু সামাজিক কারণে এটিকে অসাধারণ বলতে হয়। এ-নাটকে মৃত্যু ও বিলাপের বাড়াবাড়ি আছে, নাট্যগুণও সব অঙ্কে রক্ষা পায় নি। তবু নাটকটি একটি মহৎ সৃষ্টি। এটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন পাদ্রি লং এবং মধুসূদন। দীনবন্ধু মিত্রের অন্যান্য নাটক নবীন তপস্বিনী (১৮৬৩), সধবার একাদশী (১৮৬৬), বিয়ে পাগলা বুড়ো (১৮৬৬), লীলাবতী (১৮৬৭), জামাই বারিক (১৮৭২), কমলে-কামিনী (১৮৭৩)। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সধবার একাদশী। এ-নাটকে নিমচাঁদ নামক এক শিক্ষিত অথচ পতিত তরুণের বেদনাকে তুলে ধরা হয়েছে। নিমচাদের মেজাজ দেখে অনেকে মনে করেন এ-নাটকে তিনি নিমচাঁদের ছদ্মবেশে মধুসূদনের কথা বলেছেন।