—তবে কেবল আমাকে মুক্তি দিন, আমি কলিঞ্জরে গিয়ে বদলা—বদলির ব্যবস্থা করব।
বেশ, তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, যাতায়াতের জন্য একটা রথও দিচ্ছি। কিন্তু যদি সাত দিনের মধ্যে ফিরে না এস তবে তোমার প্রভুকে শূলে দেব।
কহোড়ভট্ট রথে চড়ে যাত্রা করলেন। এই সময় বিড়ঙ্গদেবও বিশাখসেনের দূত হয়ে বিদর্ভরাজ্যে আসছিলেন। মধ্যপথে দুই বন্ধুতে দেখা হয়ে গেল। কুশলপ্রশ্নের পর দুজনে অনেকক্ষণ মন্ত্রণা করলেন, তার পর যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানে ফিরে গেলেন।
বিদর্ভরাজমহিষী বিংশতিকলাকে কহোড় বললেন, মহাদেবী, আমার প্রিয়বন্ধু বিড়ঙ্গদেবের সঙ্গে মন্ত্রণা করে এই ব্যবস্থা করেছি যে কাল প্রাতঃকালে মহারাজ বিশাখসেন কলিঞ্জর থেকে বিদর্ভ রাজ্যে যাত্রা করবেন, এবং এখান থেকে মহারাজ কনকবর্মাও কলিঞ্জরে যাত্রা করবেন। যত ইচ্ছা রক্ষী সৈন্য আমাদের সঙ্গে দেবেন। অগস্ত্যদ্বারে উপস্থিত হয়ে যদি তারা দেখে যে মহারাজ আসেন নি, তবে আমাদের ফিরিয়ে আনবে।
মহিষী বললেন, ফিরিয়ে এনেই তোমাদের শূলে চড়াবে। বেশ, তোমার প্রস্তবে সম্মত আছি, কাল প্রভাতে যাত্রা ক’রো।
পরদিন প্রাতঃকালে কনকবর্মা ও কহোড়ভট্ট রথে চড়ে যাত্রা করলেন, এক দল অশ্বারোহী সৈন্য তাঁদের সঙ্গে গেল। অগস্ত্যদ্বারের দক্ষিণ মুখে এসে কনকবর্মা দেখলেন, বিশাখসেন ও বিড়ঙ্গদেবও উত্তর মুখে উপস্থিত হয়েছেন।
উল্লসিত হয়ে বিশাখসেন বললেন, সখা কনকবর্মা, আমার বিদর্ভ রাজ্যে সুখে ছিলে তো?
এত রোগা হয়ে গেছ কেন? তোমার সেবার ত্রুটি হয় নি তো?
কনকবর্মা বললেন, কোনও ত্রুটি হয় নি, তোমার মহিষী বিংশতিকলা যেমন রসিকা তেমনি গুণবতী। উঃ, কি যত্নই করেছেন! কিন্তু তোমাকেও তো বায়ুভুক তপস্বীর মতন দেখাচ্ছে। আমার কলিঞ্জর রাজ্যে তোমার যথোচিত সৎকার হয়েছিল তো?
অট্টহাস্য করে বিশাখসেন বললেন, সখা, আশ্বস্ত হও, সৎকারের কোনও ত্রুটি হয় নি। তোমার মহিষী কম্বুকঙ্কণাও কম রসিকা আর গুণবতী নন, তিনি আমাকে বিচিত্র চর্ব্য চুষ্য লেহ্য পেয় খাইয়েছেন। কিছুতেই ছাড়বেন না, তাঁকে অনেক সান্ত্বনা দিয়ে তবে চলে আসতে পেরেছি। যাক সে কথা। আমরা এই অগস্ত্যদ্বারে আবার মুখোমুখি হয়েছি। কে আগে যাত্রা করবে?
কহোড়ভট্ট আর বিড়ঙ্গদেব বললেন, দোহাই মহারাজ, আর বিবাদ করবেন না, আপনাদের যাত্রার ব্যবস্থা আমরাই করে দিচ্ছি। ওহে সারথিদ্বয়, তোমরা ঠিক গত বারের মতন রথ ঘুরিয়ে ফেল।…হয়েছে তো?…মহারাজ কনকবর্মা, এখন আপনি এ রথ থেকে ও রথে উঠুন। মহারাজ বিশাখসেন, আপনিও ও রথ থেকে এ রথে আসুন। মহামুনি অগস্ত্যের প্রসাদে এবং এই কহোড়—বিড়ঙ্গের বুদ্ধিবলে আপনারা সংকটমুক্ত হয়েছেন, আপনাদের প্রতিজ্ঞা শপথ মর্যাদা রাজ্য প্রাণ আর ভার্যা সবই রক্ষা পেয়েছে। এখন আর বিলম্ব নয়, দুই রথ যুগপৎ দুই দিকে শুভযাত্রা করুক।
১৩৫৯(১৯৫২)
অটলবাবুর অন্তিম চিন্তা
শয্যাশায়ী অটল চৌধুরী বললেন, দেখ ডাক্তার, আমি তোমার ঠাকুরদার চেয়েও বয়সে বড়, আমাদের ঠকিও না। মুখ খুলে বল মেজর হালদার কি বলে গেলেন। আর কতক্ষণ বাঁচব?
ডাক্তারবাবু বললেন, কেন স্যার আপনি ও কথা বলছেন, মরণ—বাঁচন কি মানুষের হাতে? আমরা কতটুকুই বা জানি। ভগবানের যদি দয়া হয় তবে আপনি আরও অনেক দিন বাঁচবেন।
—বাঁচিয়ে রাখাই কি দয়ার লক্ষণ? তোমাদের কাজ শেষ হয়েছে আর জ্বালিও না। এখন ডাক্তারি ধাপপাবাজি ছেড়ে দিয়ে সত্যি কথা বল। মরবার আগে আমি মনে মনে একটা বোঝাপড়া করতে চাই।
—বেশ তো, এখনই করুন না, দু—দশ বছর আগে করলেই বা দোষ কি।
—তুমি ডাক্তারিই শিখেছ, বিজনেস শেখ নি। আরে, বছর শেষ না হলে কি সাল—তামামী হিসেব—নিকেশ করা যায়? ঠিক মরবার আগেই জীবনের লাভ—লোকশান খতাতে চাই—অবশ্য যদি জ্ঞান থাকে।
এমন সময় পুরুত ঠাকুর হরিপদ ভটচাজ এসে বললেন, কর্তাবাবু, প্রায়শ্চিত্তটা হয়ে যাক, মনে শান্তি পাবেন।
—কেন বাপু, আমি কি মানুষ খুন করেছি, না পরস্ত্রী হরণ করেছি, না চুরি—ডাকাতি, জাল—জুয়াচুরি আর মাদুলির ব্যবসা করেছি?
হরিপদ জিব কেটে বললেন, ছি ছি, আপনার মতন সাধুপুরুষ কজন আছেন? তবে কিনা সকলেরই অজ্ঞানকৃত পাপ কিছু কিছু থাকে, তার জন্যই প্রায়শ্চিত্ত।
—দেখ ভটচাজ, আমি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির নই, ভদ্রলোকের যতটুকু দুষ্কর্ম না করলে চলে না ততটুকু করেছি। তার জন্য আমার কিছুমাত্র খেদ নেই, নরকের ভয়ও নাই। তবে প্রায়শ্চিত্ত করলে তোমরা যদি মনে শান্তি পাও তো করতে পার। কিন্তু এখানে নয়, নীচে পুজোর দালানে কর গিয়ে। ঘণ্টার আওয়াজ যেন না আসে।
হরিপদ ‘যে আজ্ঞে’ বলে চলে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, ওঃ কি পাষণ্ড! মরতে বসেছে তবু ধর্মে মতি হল না।
অটলবাবুর পৌত্রী রাধারানী এসে বললে, দাদাবাবু, বৃন্দাবন বাবাজী তাঁর কীর্তনের দল নিয়ে এসেছেন। মা জিজ্ঞাসা করলে, তুমি একটু নাম শুনবে কি?
—খবরদার। আমি এখন নিরিবিলিতে থাকতে চাই, চেঁচামেচি ভাল লাগে না। শ্রাদ্ধের দিন যত খুশি কীর্তন শুনিস—শীতল বাতাস ভাল লাগে না সখী, আমার বুকের পাঁজর ঝাঁজরা হল—যত সব ন্যাকামি।
রাধারানী ঠোঁট বেঁকিয়ে চলে গেল। ডাক্তার বললেন, সার, আপনি বড় বেশী কথা বলছেন। রাত হয়েছে, এখন চুপ করে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন।