- বইয়ের নামঃ বিবিধ রচনা
- লেখকের নামঃ রাজশেখর বসু
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রায় সাতাশ বৎসর পূর্বে ভারতবর্ষ-পত্রিকায় দেবীমাহাত্ম্য নামে একটি গল্প পড়েছিলাম। লেখকের নাম ছিল না। রচনাটি অসাধারণ, পরিহাস ও করুণার আশ্চর্য সমন্বয়, ভাষার ভঙ্গীও নূতন, তখনকার কোনও লেখকের সঙ্গে মিল নেই। সাহিত্যগগনে নবোদিত জ্যোতিষ্কের কথা মাঝে মাঝে শোনা যায়। অকস্মাৎ আবির্ভূত এই অজ্ঞাতপূর্ব শক্তিমান লেখকের পরিচয় জানতে অনেকেরই আগ্রহ হল। পত্রিকা-সম্পাদক জলধর সেন মহাশয়কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি জানালেন–লেখক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চীন দেশের ফেরত, কাশীতে বা পূর্ণিয়ায় বাস করেন, রাজকার্য থেকে অবসর নিয়ে সাহিত্যচর্চা করছেন। তিনি পূর্বেও ছদ্মনামে অল্পস্বল্প লিখতেন, এখন পরিণত বয়সে গল্প লেখা আরম্ভ করেছেন। তার নবপ্রকাশিত গল্পটি পড়ে অনেকেই মুগ্ধ হয়েছেন এবং আরও চাই আরও চাই বলে আবদার করছেন।
কিছু দিন পরে কোষ্ঠির ফলাফল ক্রমশ প্রকাশিত হতে লাগল। এই ভ্রমণকাহিনীতে বর্ণিত নরনারী সকলেই অসাধারণ, কিন্তু কেউ অস্বাভাবিক নয়, পিকউইক-চরিত্রাবলীর সঙ্গে তাদের তুলনা করা চলে। তার পর ক্রমে ক্রমে তার অনেক লেখা প্রকাশিত হল। বাংলায় হাস্যরসের বহু রচয়িতা পূর্বেও ছিলেন পরেও হয়েছেন। কেদারনাথের আবির্ভাবে সকলেই বুঝলেন যে হাস্যের সহিত শান্ত ও করুণ রসের মিলনে তার প্রতিদ্বন্দ্বী কেউ নেই। ইংরেজীতে যাকে বলে milk of human kindness, সেই করুণার ক্ষীরধারাই তাঁর রচনাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
১৩৩৪ কিংবা ১৩৩৫ সালে দিল্লিতে যে প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন হয়, কেদারনাথ তার এক শাখার সভাপতি হন। শ্রীযুক্ত অমল হোম সেই অধিবেশন থেকে ফিরে এলে তার কাছে শুনলাম, কেদারনাথের প্রবন্ধ পেনশনের পরে শুনে শ্রোতারা আনন্দে উৎফুল্ল হয়েছিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, তাকে কিরকম দেখলেন? অমলবাবু উত্তর দিলেন, ভদ্রলোক যেন পাকা আমটি। কিছুকাল পরে কেদারনাথের সঙ্গে কয়েকবার আলাপের এবং তাঁর প্রীতিলাভের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সংস্কৃত সাহিত্যে পুরুষের বর্ণনায় সৌম্য শব্দটির বহু প্রয়োগ দেখা যায়, এখন বাংলাতেও খুব চলে। আমাদের দেশে সুদর্শন সাহিত্যিকের সংখ্যা বেশী নয়, কিন্তু কেদারনাথকে দেখেই মনে হয়েছিল–হ্যাঁ, এইরকম পুরুষকেই সৌম্য বলা সার্থক।
যাঁরা শুধুই লেখক, অর্থাৎ রাজনীতিক বা ব্যবসাদার নন, সাধারণে তাদের নির্বিবাদ শান্ত ভালমানুষ মনে করে। মৎস্যজাতিও নিরীহ, কিন্তু সুবিধা পেলে পরস্পরকে কামড়াতে ছাড়ে না। অখ্যাত না হলে সাহিত্যিককেও মাঝে মাঝে স্বজাতির দংশন সইতে হয়। জলধর সেন জলধর দাদা নামে খ্যাত ছিলেন, তার অন্য উপাধি ছিল অজাতশত্রু। কিন্তু তিনিও আক্রমণ থেকে নিস্তার পান নি। কেদারনাথের সৌভাগ্য এই যে তিনি আমরণ যথার্থ অজাতশত্রু ছিলেন। অনেক লেখকের রচনায় বিশেষ ভঙ্গী বা মুদ্রাদোষ থাকে, সকলের তা ভাল লাগে না। কেদারনাথের পদ্ধতিরও সমালোচনা হয়েছে, কিন্তু তাকে বিদ্রূপ করবার সাহস কারও হয় নি।
আমরা এক যশস্বী লেখক ও জনপ্রিয় সৎপুরুষকে হারিয়েছি, কিন্তু চিরস্থায়ী সম্পদ রূপে তাঁর রচনা তিনি আমাদের দান করে গেছেন। কেদারনাথ লিখে গেছেন, তার দুই আন্তরিক কামনা পূর্ণ হয়েছে শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শনলাভ, বন্ধুত্বলাভ রবীন্দ্রের। অধিকন্তু, ছিল যাহা আশাতীত, স্বাধীনতা,…তারও দেখা পেলাম আজ। তিনি পূর্ণকাম হয়ে মহাযাত্রা করেছেন, এই আমাদের সান্ত্বনা।
ছোটগল্প বলতে কি বোঝায়
ছোট গল্প বলতে কি বোঝায়–আপনার এই প্রশ্ন শুনেই মুখে উত্তর আসে–মানে তো স্পষ্ট, যেমন ছোট এলাচ ছোট সাহেব ছোট লোক, তেমনি ছোট গল্প। কিন্তু এ উত্তর অচল। কত ছোট? কিসের চাইতে ছোট? ছোট হলে শুধু আকার কমে যায়, না গুণও বদলায়? গল্প মানে কি?
আধুনিক বাংলা ভাষা ইংরেজীর অনুগামিনী ল্যাংবোট। ইংরেজী শব্দের যে অর্থব্যাপ্তি বা connotation, বাংলা প্রতিশব্দেরও ঠিক তাই হওয়া চাই। আজকাল প্রতিভার লক্ষণ লিখলে চলে না, Promise-এর মাছি-মারা নকলে লিখতে হবে প্রতিভার প্রতিশ্রুতি। ভবিষ্যতে হয়তো আমরা হিন্দীর বশে চলব, কিন্তু আপাতত ইংরেজীই বাংলার প্রভু। অতএব নভেল আর স্টোরি শব্দের মানে আগে বুঝতে হবে।
বাংলায় গল্প কথা কাহিনী সমার্থক। মহাভারতের প্রকাণ্ড আখ্যান গল্প, কথামালার ক্ষুদ্র আখ্যানও তাই। ইংরেজীর তরজমা করে আমরা নভেলকে উপন্যাস আর স্টোরিকে গল্প বলি। এককালে রোমান্স অর্থে রমন্যাস চলত, কিন্তু আজকাল শোনা যায় না। সমালোচকরা লিখে থাকেন–অমুক রচনাটি প্রকৃত পক্ষে বড় গল্প, উপন্যাস বলা চলে না। অতএব গল্প বড় হলেই উপন্যাস হয় না। কিন্তু উপন্যাস ছোট হলে কি গল্প হয়?
Concise Oxford Dictioneryco novel47 01fictitious prose narrative of sufficient length to fill one or more vol umes, portraying characters & actions representative of real life in continuous plot. ওই অভিধানে storyর অর্থ–tale of any length told or printed in prose or verse of actual or fictitious events, legends, myth, anecdote, novel, romance.
উক্ত সংজ্ঞার্থ অনুসারে রূপকথা পুরাণকথা কিংবদন্তী নকশা বা স্কেচ, নভেল প্রভৃতি ছোট বড় সব রকম আখ্যান স্টোরির অন্তর্গত, কিন্তু নভেলে বাস্তবতুল্য মানব-জীবনের একটানা বর্ণনা থাকা চাই। বাংলার উপন্যাস বললে মোটামুটি বোঝায় কয়েকজন পাত্রপাত্রীর জীবন ও চরিত্রের আনুপূর্বিক বিবরণ। উপন্যাসে মধ্য ঘটনাবলীই প্রধান, কিন্তু আদি ও অন্ত্য ঘটনারও অল্পাধিক বিবরণ আবশ্যক। পক্ষান্তরে গল্পে আদি মধ্য অন্ত্য যেখান থেকে হক এক খণ্ড ঘটনা দেখালেও চলে।
ইংরেজী স্টোরি শব্দ আজকাল অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে চলছে। অনেক ম্যাগাজিনে স্টোরি নামে এমনি রচনা ছাপা হয় যা সাধারণ বাঙালী পাঠকের বিচারে গল্প নয়। কৌতূহলজনক চিত্তাকর্ষক বা চিন্তার উদ্দীপক ক্ষুদ্র ঘটনার বিবরণও স্টোরি। বিষয়টি অসম্ভব হলেও ক্ষতি নেই। রবীন্দ্রনাথের কর্তার ভূত আর আপনার (বনফুলের) জ্যামিতিক গল্প ক খ গ নিঃসন্দেহে স্টোরি।
অতএব গল্প বা স্টোরির অর্থ উপন্যাস বা নভেলের চাইতে ব্যাপক। উপন্যাস গল্পের অন্তর্গত, কিন্তু গল্প মাত্রই উপন্যাস নয়। গল্পের আকার যাই হক, তার বিষয় অসংখ্য। অধিকাংশ উপন্যাসের উপজীব্য বিরহ-মিলন কথা। যাতে প্রেমিক-প্রেমিকার সম্পূর্ণ ও সবিস্তার বিবরণ থাকে তাই সবচেয়ে জনপ্রিয়। বহুকাল পূর্বে একটি ইংরেজী ছড়া শুনেছিলাম, কার তৈরি জানি না। এই ছড়াটিকে যাবতীয় মিলনান্ত প্রেমোপন্যাসের ঘনীভূত নির্যাস বলা যেতে পারে–
Mister Miss
Meet, kiss
More kisses
Mr. & Mrs.
প্রেম (মামুলী ও বিকৃত) বহুকাল কথাসাহিত্যের প্রধান অবলম্বন ছিল, কিন্তু এখন তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়েছে খুন চুরি প্রভৃতি অপরাধ এবং রোমাঞ্চকর রহস্য। ডিটেকটিভ কাহিনীর পাঠক সব দেশেই বেশী, কিন্তু বাঙালী রচয়িতা এখনও কোনান ডয়েল এডগার ওআলেস প্রভৃতির তুল্য মর্যাদা পান নি। ইংরেজী গল্পের বিষয়ের সীমা নেই, Erewhon, Perguin Island, Animal Farm প্রভৃতি রূপক গল্প খুব জনপ্রিয়। বাঙালী পাঠকের রুচির বৈচিত্র্যও পূর্বের তুলনায় বেড়ে গেছে।
সংস্কৃতে কবি বললে কথাকারও বোঝায়। যিনি রসের উপলব্ধি করেন এবং নিজ রচনার দ্বারা সেই রস অন্যের মনে সঞ্চারিত করেন তিনিই কবি। (ভাগ্যক্রমে রসের ইংরেজী নেই)। কাব্যকার আর কথাকার দুজনেই রসের ভাবক ও সঞ্চারক, যদিও তাদের কলাবিধি পৃথক। যে লেখক শুধু পাঠকের রুচির বশে চলেন তিনি পেশাদার মাত্র। যিনি নিজের নব নব রসানুভূতি ব্যক্ত করে পাঠকের রুচি প্রভাবিত করতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক।
বিষয়ের বৈচিত্র্যে আপনি আমাদের কথাকারদের মধ্যে অদ্বিতীয়। বাস্তব, কাল্পনিক, অসম্ভব, রূপক, প্রতীকময়, সব রকম রচনাই আপনার আয়ত্ত। আপনি যা লেখেন তা ছোট গল্প কি বড় গল্প কি উপন্যাস তার বিচার নিরর্থক। গদ্যপদ্যময় চম্পুকাব্য মৃগয়া, অলৌকিক রূপক বৈতরণী তীরে, বিচিত্র চরিত্রচিত্র যেমন নাথুনীর মা, ছোট লোক, বিজ্ঞান, দেশী ও বিলাতী, সবই আপনার সার্থক সৃষ্টি। অতিকায় প্রাণীর মতন কালবশে মহাকাব্য লোপ পেয়েছে। আমার বিশ্বাস, মহোপন্যাসও ক্রমশ লোপ পাবে, ছোট রচনাতেই সুধীজনের আকাঙ্ক্ষা তৃপ্ত হবে। ভূরিভোজী পাঠক-পাঠিকার জন্য আপনি জঙ্গম লিখে প্রচুর ক্যালরি সরবরাহ করুন। কিন্তু মিতাহারীও অনেক আছে, তাদের জন্য নানাবিধ জীবনীর রসও লঘুমাত্রায় পরিবেশন করতে থাকুন।
তামাক ও বড় তামাক
মানুষ ও জন্তুর মধ্যে প্রধান প্রভেদ এই যে, মানুষ নেশা করিতে শিখিয়াছে, জন্তু শেখে নাই। বিড়াল দুধ মাছ খায়, অভাবে পড়িলে হাঁড়ি খায়, ঔষধার্থে ঘাস খায়, কিন্তু তাকে তামাকের পাতা বা গাঁজার জটা চিবাইতে কেউ দেখে নাই। মানুষ অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করে, ঘর-সংসার পাতে, জীবন ধারণের জন্য যা-কিছু আবশ্যক সমস্তই সাধ্যমত সংগ্রহ করে, কিন্তু এতেই তার তৃপ্তি হয় না–সে একটু নেশাও চায়। অবশ্য গম্ভীর-প্রকৃতি হিসাবী লোকের কথা আলাদা। তাঁদের কাছে নেশা মাত্রই অনাবশ্যক; কারণ তাতে দেহের পুষ্টি হয় না, জ্ঞানেরও বৃদ্ধি হয় না, বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে অপকারই হয়। তথাপি বহু লোক কোনও অজ্ঞাত অভাব মিটাইবার জন্য নেশার শরণাপন্ন হয়।
নেশা বহু প্রকার, যথা তামাক গাঁজা মদ সঙ্গীত কাব্য উপন্যাস প্রভৃতি। সকলগুলির চর্চার স্থান এই ক্ষুদ্র পত্রিকায় নাই, সুতরাং তামাক ও গাঁজা সম্বন্ধেই কিঞ্চিৎ আলোচনা করা যাক।
তামাক আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই তার নিন্দক জুটিয়াছে। তামাক খাইলে ক্ষুধা নষ্ট হয়, বুদ্ধি জড় হয়, হৃৎপিণ্ড দূষিত হয়, ইত্যাদি। কিন্তু কে গ্রাহ্য করে? জগতের আবাল-বৃদ্ধ তামাকের সেবক, বনিতারাও হইয়া উঠিতেছেন। তামাকের বিরুদ্ধে যেসব ভীষণ অভিযোগ শোনা যায়, তামাক-খোর তার খণ্ডনের কোন প্রয়াসই করে না, শুধু একটু হাসে ও নির্বিকারচিত্তে টানে। • কিন্তু তাদের অন্তরে যে জবাব অস্ফুট হইয়া আছে, আমরা তার কতকটা আন্দাজ করিতে পারি। মশায়, তামাক জিনিসটা স্বাস্থ্যের অনুকূল না হইতে পারে, কিন্তু স্বাস্থ্যই কি সব চেয়ে বড়? একটু না হয় ক্ষুধা কমিল, চেহারায় পাক ধরিল, হৃৎপিণ্ড ধড়ফড় করিল, কিন্তু আনন্দটা কি কিছুই নয়? মোটের উপর লাভটাই আমাদের বেশী। লোকসানের মাত্রা যদি বেশী হইত, তবে আপনিই আমরা ছাড়িয়া দিতাম, উপদেশের অপেক্ষা রাখিতাম না। আমাদের শরীর মন বেশ ভালই আছে, ভদ্র-সমাজে কেউ আমাদের অবজ্ঞা করে না। হাঁ, কোন কোন অর্বাচীনের তামাক খাইলে মাথা ঘোরে তা মানি; কিন্তু দু-এক জনের দুর্বলতার জন্য আমরা এত লোক কেন এই আনন্দ হইতে বঞ্চিত হইব?
এই সময় গঞ্জিকাসেবীর বাজখাই গলার আওয়াজ শোনা গেল–ভায়া, আমরাও আছি। আমাদের তরফেও কিছু বল।
তামাক-খোর ধমক দিয়ে বলেন–দূর হ লক্ষ্মীছাড়া গেঁজেল! তোদের সঙ্গে আমাদের তুলনা?
গাঁজা-খোর ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিলেন–সে কি দাদা? তোমাতে আমাতে তো কেবল মাত্রার তফাত। তুমি খাও তামাক, আমি খাই বড়-তামাক। তোমরা শৌখিন বড়লোক, তাই বিস্তর আড়ম্বর,-রুপোর ফরসি, জমিদারি সটকা, সোনার সিগারেট-কেস, কলের চকমকি। আমরা গরীব, তাই তুচ্ছ সরঞ্জামের বড়বড় নাম রাখিয়াই শখ মিটাই। গাঁজা কাটিবার ছুরিকে বলি রতন-কাটারি, কাঠের পিঁড়িকে বলি প্রেম-তক্তি, ধোঁয়া ছাঁকিবার ভিজা ন্যাতাকে বলি জামিয়ার, গাঁজা ডলিবার সময় মন্ত্র বলিবোম্ শঙ্কর কঙ্কড় কি ভোলা! আমাদের নেশার আয়োজনেই কত কাব্য-রস–তোমরা তো পরের প্রস্তুত জিনিস টানিয়াই খালাস। আর, আনন্দের কথা যদি ধর, তবে তোমরা বহু পশ্চাতে। ত্বরিতানন্দ জান? আমরা তাই উপভোগ করি। স্বাস্থ্য? তার জবাব তো তোমরা নিজেরাই দিয়াছ। আমরা স্বাস্থ্যের উপর একটু বেশী অত্যাচার করি বটে, কিন্তু আনন্দটি কেমন? না হয় গলাটা একটু কর্কশ হইল, চোখ একটু লাল হইল, চেহারাটা একটু চোয়াড়ে হইল, কিন্তু মোটের উপর শরীর মন ঠিকই আছে।
হিসাবী সমাজহিতৈষী দুই তরফের কথা শুনিয়া বলিলেন–তোমাদের বচসা মিটানো বড়ই শক্ত কাজ। আমি বলি কি–তোমরা দু দলই বদ অভ্যাস ত্যাগ কর। শরবত খাও, ভাল ভাল জিনিস খাও, যাতে গায়ে গত্তি লাগে, যথা লুচি-মণ্ডা। প্রকৃত আনন্দ তাতেই আছে।
তামাক-খোর বলিলেন–শরবত খুব স্নিগ্ধ, লুচি-মণ্ডাও খুব পুষ্টিকর, সুবিধা পাইলেই আমরা তা খাই। কিন্তু এ সব জিনিসে আত্মা তৃপ্ত হয় না, আড্ডা জমে না। কিঞ্চিৎ নেশার চর্চা না করিলে মানুষে মানুষে ভাবের বিনিময় অসম্ভব। তামাক অবশ্য চাই, এইটিই নিরীহ প্রকাশ্য নেশা, আর সব নেশা অপ্রকাশ্য।
গাঁজা-খোর বলিলেন–ঠিক কথা। নেশা চাই বইকি, কিন্তু গাঁজাই পরাকাষ্ঠা। তোমাদের পাঁচ জনের উৎসাহ পাইলেই আমরা ভদ্র-সমাজে চালাইয়া দিতে পারি।
সমাজহিতৈষী চিন্তিত হইয়া বলিলেন–তাই তো, বড় মুশকিলের কথা। দেখিতেছি তোমরা কেউ-ই ধোঁয়া না টানিলে বাঁচিবে না। আচ্ছা, অক্সিজেন খুঁকিলে চলে না?
তামাক-খোর গাঁজা-খোর অবজ্ঞার হাসি হাসিয়া সমস্বরে কহিলেন– আজ্ঞে, ওটা অন্তিম কালে, হরিনামের সঙ্গে সঙ্গে। আপাতত কিছু সাকার সুগন্ধি সুস্বাদ মনোহারী ধোঁয়ার ফরমাশ করুন।
হিতৈষী নাচার হইয়া বলিলেন–তবে ঐ তামাক অবধি বরাদ্দ রহিল। তার উপর আর উঠিও না, ঐখানেই গণ্ডি টানিলাম।
গাঁজা-খোর অট্টহাস্যে বলিলেন–খুব বুদ্ধি আপনার! নেশার তত্ত্ব আপনি কিছুই বোঝেন না। ঐ তামাকই তো একটু একটু করিয়া বেমালুম ভাবে গাঁজায় পরিণত হইয়াছে–তামাক-তামা-তাজা-গাঁজা। মৌচাকএর শিশু পাঠকরাও এই তত্ত্ব জানে। কোথায় গণ্ডি টানিবেন?
সমাজহিতৈষী মহাশয় হতাশ হইয়া বলিলেন–তবে মর তোমরা পীত্বা পীত্বা পুনঃ পীত্ব। দিন কতক যাক, তারপর বুঝিব কার পরমায়ু কত কাল।
বঙ্গ-বিহার
মানুষ সব চেয়ে ভালবাসে আত্মীয়-স্বজনকে, তার পর যথাক্রমে নিজের সমাজ জাতি আর দেশের লোককে। বসুধার সকলকেই যাঁরা কুটুম্ব জ্ঞান করেন তারা সংখ্যায় নগণ্য। সাধারণ মানুষের প্রীতির ক্ষেত্র সংকীর্ণ, কিন্তু তা অপরাধ নয়। বিহারের যেসব জেলা প্রধানত বাংলাভাষী তা পশ্চিম বাংলার অন্তর্গত হক–এই কামনা বাঙালীর পক্ষে অতি স্বাভাবিক।
কিন্তু আজ যদি বিহার সরকার হঠাৎ উদার হয়ে বাঙালীর আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করেন তা হলেই কি আমাদের অভাব মিটবে, দেশে সমৃদ্ধি আসবে? নানা উপলক্ষ্যে পশ্চিম বাংলায় হিন্দীভাষীর প্রবেশ বহুকাল থেকে অব্যাহত আছে। শ্রমসাধ্য জীবিকায় এবং ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে বাঙালী পরাভূত হয়েছে, বিহারী ওড়িয়া পঞ্জাবী মারোয়াড়ী মাদ্রাজী গুজরাটী প্রভৃতির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, এবং এই সব বিদেশীর অনেকে স্থায়ী অধিবাসী হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম বাংলার প্রধান প্রধান নগরে যেসব অবাঙালী স্থায়ী ভাবে বাস করেন তাদের মধ্যে প্রবল প্রতিপত্তিশালী লোক অনেক আছেন। সম্প্রতি উদ্বাস্তুর আগমনে বাংলাভাষীর সংখ্যা কিছু বেড়েছে কিন্তু বাঙালীর প্রভাব বাড়ে নি। এমন সম্ভাবনা অমূলক নয় যে অদূর ভবিষ্যতে এদেশে অবাঙালীর সংখ্যা ও প্রভাব আরও বাড়বে। উত্তর আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সিংহল প্রভৃতি রাষ্ট্র আইন করে বিজাতির অনুপ্রবেশ দমন করেছে, কিন্তু ভারতের কোনও প্রদেশের এমন অধিকার নেই যে অন্য প্রদেশবাসীর আগমন রোধ করে। অতএব পশ্চিম বাংলা উত্তরোত্তর বহুভাষী বহুজাতির দেশে পরিণত হবে। বিহার প্রভৃতি প্রদেশেও অনেক বাঙালী আছেন, কিন্তু এককালে তাদের যে প্রভাব ছিল এখন তা নেই।
এ কথা অস্বীকার করা যায় না যে শ্রমসাধ্য কর্মে বিমুখতা, ব্যবসায়ে অপটুতা, এবং অন্য বহু ক্ষেত্রে উদ্যমের অভাবে প্রবাসে আর স্বদেশে বাঙালী ক্রমশ ক্ষীণবল হচ্ছে। অধিকাংশ বাঙালীর মনে এই ভয় আছে যে বঙ্গ-বিহার একরাজ্য হলে আমাদের আত্মরক্ষার যেটুকু রাজনীতিক শক্তি আছে তাও খর্ব হবে, এবং স্বাধীনতালাভের পূর্বে লীগ সরকারের আমলে হিন্দু বাঙালীর যে দুর্দশা হয়েছিল তাই ফিরে আসবে। লক্ষ্য করবার বিষয় সংযোগের প্রস্তাবে অধিকাংশ বাঙালী ভয় পেয়েছেন, কিন্তু অধিকাংশ বিহারী খুশী হয়েছেন।
যাঁদের উদ্যোগে স্বাধীন ভারত রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তারা কোনও প্রদেশের সংকীর্ণ নীতি বাঞ্ছনীয় মনে করেন না। প্রদেশ ভাগের প্রধান লক্ষ্য প্রশাসনের সৌকর্য, শিল্পের প্রতিষ্ঠা, কৃষির বিস্তার ইত্যাদি সর্বহিতকর কর্ম, ভাষার ঐক্য অপেক্ষাকৃত গৌণ। ভারতীয় প্রজা অবাধে সকল রাজ্যে প্রবেশ করবে, বসতি করবে, সর্বত্র সমান অধিকার পাবে, সেই সঙ্গে তার নিজের ভাষা আর সংস্কৃতিগত বৈশিষ্ট্য বজায় রাখবে–এই হচ্ছে সংযুক্ত ভারত রাষ্ট্রের নীতি। ভাষার ঐক্য অনুসারে প্রত্যেক প্রদেশ ভাগ করা অসাধ্য, একভাষী প্রদেশও কালক্রমে বহুভাষী হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। অতএব, বিভিন্ন ভাষা ধর্ম সংস্কৃতি ও আচারের একত্র অবস্থান উদারভাবে মেনে নেওয়াই সকল প্রদেশবাসীর কর্তব্য।
সংযুক্ত বঙ্গ-বিহার সম্বন্ধে শঙ্কার মূলে আছে–(১) জীবিকার নানা ক্ষেত্রে বাঙালীর উদ্যম আর পটুতার অভাব, (২) বিহারবাসীর সংখ্যাধিক্য জনিত প্রাধান্য। প্রথম কারণটি দূর হলে দ্বিতীয়টিরও গুরুত্ব থাকবে না। বাঙালী যদি অধিকাংশ ব্যবসায় আর শ্রমসাধ্য কাজ বিদেশীকে ছেড়ে দিয়ে চাকরি ওকালতি ডাক্তারি শিক্ষকতা গ্রন্থরচনা প্রভৃতি কয়েকটি বাছা বাছা বৃত্তি অবলম্বন করে, এবং অতিমাত্র ভাবালু হয়ে নাচ গান সিনেমা আর গুরু গুবী নিয়ে মেতে থাকে, তবে কেবল ভাষার গণ্ডি টেনে আত্মরক্ষা করতে পারবে না, নিজের দেশেও তাকে দুর্বল পরাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে। অতএব আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই বাঙালীকে উদ্যমী আর পরিশ্রমী হতে হবে। একভাষী বা বহুভাষী কোনও প্রদেশেই শক্তিশালী স্বাবলম্বী বাঙালীর ভয় থাকবে না।
আমার মনে হয়, বঙ্গ-বিহার একীকরণের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা উচিত নয়, আবার হঠাৎ একীকরণও বাঞ্ছনীয় নয়। একীকরণ আমাদের আদর্শ ও সাধনার বিষয় হয়ে থাকুক। দুই প্রদেশের সংযোগের ফলে বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এবং উভয়েরই কল্যাণ হবে। যদি ভবিষ্যতে আসাম উড়িষ্যা আর ত্রিপুরাও বঙ্গ-বিহারের সঙ্গে যুক্ত হয়, তবে আরও ভাল। কিন্তু সংযোগ এখনই সাধ্য নয়, তার ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় নি। আদর্শ মনে রেখে বাঙালী আর বিহারী ভবিষ্যৎ মিলনের জন্য সচেষ্ট হক। বিহারনিবাসী বাঙালীর ক্ষোভের যেসব কারণ আছে, বিহার সরকার তা দূর করুন। পশ্চিমবঙ্গনিবাসী বিহারীর যদি কিছু অভিযোগ থাকে, তারও প্রতিকার এদেশের সরকার করুন। হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করবার সঙ্কল্প অনির্দিষ্ট কালের জন্য মুলতুবী রাখা হক, তাতে বাঙালীর হিন্দীপ্রভুত্বের ভয় কমবে। অন্তত পাঁচ বৎসর বিহার আর পশ্চিম বাংলার কোর্টশিপ ও আত্মশুদ্ধি চলুক। এই পরীক্ষা-কালের মধ্যে যদি মনোমালিন্য দূর হয়, তবেই দুই প্রদেশের সংযোগ সাধ্য হবে। কতকগুলি সংলগ্ন রাজ্য নিয়ে যে মণ্ডল বা Zone গঠনের প্রস্তাব নেহরুজী করেছেন, তার দ্বারা ভবিষ্যৎ মিলনের পথ সুগম হবে।
মার্কিন যুক্তরাজ্যে যেসব ইওরোপীয় জাতি বসতি করেছে তারা দুই পুরুষের মধ্যেই মাতৃভাষা ভুলে গিয়ে ইংরেজী ভাষা আত্মসাৎ করেছে এবং অন্যান্য প্রজার সঙ্গে মিশে গেছে। ওলন্দাজ রুজভেল্ট এবং জার্মান আইজেনহাওয়ার অসম্পূর্ণভাবে মার্কিন হয়ে গেছেন। ভারতবাসী অত সহজে ভাষা আর সামাজিক প্রথা বদলাতে পারে না, সেকারণে সম্পূর্ণ একীভবন এখন অসম্ভব। কিন্তু চেষ্টা থাকলে কালক্রমে তাও ঘটতে পারে। ততদিন বৈচিত্র্যের মধ্যে মিলনই ভারতীয় প্রজার সাধনীয় হক, কিন্তু বৈচিত্র্যে যেন ভেদবুদ্ধি আর বিদ্বেষ না আসে। মার্কিন রাষ্ট্রের মতন সর্বাঙ্গীণ মিলন অসম্ভব হলেও দ্বিভাষী কানাডা আর ত্ৰিভাষী সুইৎসারল্যান্ডের মতন মিলন অসাধ্য হবে কেন?
[প্রবন্ধটি বঙ্গ-বিহার সংযুক্তীকরণের প্রস্তাব প্রসঙ্গে লিখিত। ১৯৫৬ সালে ভাষাসমস্যা ও রাজ্য পুনর্গঠন নিয়ে সারা ভারতে অশান্তি দেখা দেয়। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডা: বিধানচন্দ্র রায় এই অশান্তি দূরীকরণের জন্য বঙ্গ বিহার সংযুক্তিকরণের প্রস্তাব দেন। বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই নিয়ে বহু মতানৈক্য দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত খেজুরী। উপনির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হলে এই প্রস্তাব প্রত্যাহূত হয়। –স:।]
বাংলা অক্ষরের সংস্কার
বাংলা অক্ষর সংস্কারের প্রস্তাব অনেক কাল থেকে হয়ে আসছে। এ বিষয়ে সম্ভবত যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি মহাশয় অগ্রণী। তার পদ্ধতি মোটামুটি এই।–স্বরান্ত ব্যঞ্জন একই রকমে লেখা হবে, যেমন কু শু পু হু, কূ শূ, কৃ; এবং যুক্তব্যঞ্জনের অঙ্গীভূত অক্ষরগুলি যথাসম্ভব অবিকৃত থাকবে, যেমন ক্ত ক খ। কিন্তু যে যুক্তব্যঞ্জনের বিকৃত উচ্চারণ হয় তার আকৃতি তিনি বদলান নি, যেমন ক্ষ। এছাড়া তিনি অনাবশ্যক বোধে এবং ব্যাকরণের সমর্থনে রেফের পর দ্বিত্ব বর্জন করেছেন। বিদ্যানিধি মহাশয়ের উদ্দেশ্য বর্ণের মূল রূপ যথাসম্ভব বজায় রাখা, ছাপার সুবিধা অসুবিধার উপর তিনি দৃষ্টি দেন নি। বহু বৎসর পূর্বে যে একলিপি বিস্তার-সমিতি স্থাপিত হয় তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা উড়িয়া গুজরাটী প্রভৃতি ভাষায় নাগরী অক্ষর চালানো। নাগরী-প্রচারিণী সভারও উদ্দেশ্য অনুরূপ। এই দুই সমিতি এখন প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে। গত দশ বৎসরের মধ্যে শিক্ষিত বাঙালীর অনেকে অক্ষর-সংস্কারে উৎসাহী হয়েছেন, তার ফলে নানারকম পরিকল্পনা প্রচারিত হয়েছে। প্রস্তাবকগণের লক্ষ্য সমান নয়, কেউ এক বিষয়ে কেউ অন্য বিষয়ে বেশী ঝোঁক দিয়েছেন।
আমাদের আলোচ্য কোন্ উদ্দেশ্যসাধনের জন্য বাংলা অক্ষরের সংস্কার আবশ্যক এবং কি উপায়ে তা সুসাধ্য হবে। কামাল আতাতুর্ক অল্পায়াসে তার রাষ্ট্রে আরবী লিপির বদলে রোমান লিপি চালাতে পেরেছিলেন তার কারণ শুধু জবরদস্তি নয়। দেশের সুশিক্ষিত জনমতের তিনি সমর্থন পেয়েছিলেন, অশিক্ষিত প্রজাবর্গও তাঁকে শ্রদ্ধা করত। আমির আমানুল্লা নিজের ক্ষমতা আর লোকপ্রিয়তা না বুঝেই হঠাৎ সমাজসংস্কার করতে গিয়ে বিতাড়িত হলেন। আমাদের দেশে এমন কোনও সর্বমান্য শক্তিমান্ নেতা নেই যাঁর হুকুমে অক্ষরের আমূল সংস্কার হতে পারে। সংস্কারের পরিকল্পনা যতই সরল ও যুক্তিসম্মত হক, লোকমত অগ্রাহ্য করে হঠাৎ তা চালানো যাবে না, সুতরাং শুধু কাগজে কলমে একটা সর্বগুণসম্পন্ন আদর্শলিপির খসড়া খাড়া করে লাভ নেই। এ কথাও মানতে হবে যে সকলকে বা অধিকাংশ লোককে খুশী করা অসম্ভব। অতএব ক্রমে ক্রমে সইয়ে সইয়ে পরিবর্তন করা ভিন্ন উপায় নেই। যদি জনকতক প্রতিষ্ঠাবান লেখক একমত হয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে নূতন পদ্ধতি মেনে নেন এবং ছাপাখানার কর্তারা তাদের সাহায্য করেন তবে সংস্কার ক্রমশ অগ্রসর হবে। যদি বিশ্ববিদ্যালয়, সাহিত্যপরিষৎ এবং বিশ্বভারতীর সমর্থন পাওয়া যায় তবে সংস্কার দ্রুততর হবে।
আদর্শ অক্ষরমালা কিরকম হবে সে সম্বন্ধে বোধ হয় বেশী মতভেদ নেই। এমন অক্ষর চাই যা চেনা পড়া ও লেখা সহজ, যাতে জটিলতা নেই, যার গঠনে রেখার বাহুল্য নেই, যার মোট সংখ্যা অল্প, যার যোজনপদ্ধতি সরল; যাতে শুধু বাংলা ভাষার সাধারণ শব্দাবলী নয়, ইংরেজী প্রভৃতি বিদেশী শব্দও মোটামুটি উচ্চারণ অনুসারে লেখা যায়; যা ছাপবার জন্য বিস্তর টাইপ দরকার হয় না, যার গড়ন এমন যে ছাপবার সময় সহজে টাইপ ভাঙে না; এবং যা টাইপরাইটারের উপযুক্ত।
আমাদের বাংলা লিপি সুশ্রী তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উল্লিখিত গুণাবলীর বড়ই অভাব। অক্ষরের জটিল গঠন ও যোতন পদ্ধতির জন্য শিক্ষার্থীকে বিশেষত শিশুকে অনেক কষ্টভোগ করতে হয়। একখানা বর্ণপরিচয় যথেষ্ট নয়, প্রথমভাগ ও দ্বিতীয়ভাগ চাই। ব্যঞ্জনের সঙ্গে যোগ করতে গেলেই স্বরবর্ণের রূপ বদলে যায়। অ-কার অন্তর্হিত হয়, আ-কার এবং ঈ-কার ব্যঞ্জনের পরে বসে, অথচ ই-কার এ-কার ঐ-কার আগে বসে। ও-কার এবং ঔ-কারের আধখানা আগে আধখানা পরে বসে। উ-কার ঊ-কার ঋ-কার সাধারণত নীচে বসে, কিন্তু স্থলবিশেষে ব্যঞ্জনের ডাইনে জোড়া হয়। কতকগুলি যুক্তব্যঞ্জনের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ একবারে বদলে গেছে। শিক্ষার্থীকে ৪৮টি মূল বর্ণ, ১৩/১৪ রকম স্বরচিহ্ন, য-ফলা রেফ র-ফলা প্রভৃতি ৭/৮টি ব্যঞ্জনচিহ্ন, এবং প্রায় ১৬০টি যুক্তব্যঞ্জন শিখতে হয়। তা ছাড়া অঙ্ক যতিচিহ্ন প্রভৃতি আছে। ছেলেবেলায় এই সমস্ত আয়ত্ত করতে কিরকম কষ্ট পেতে হয়েছিল তা হয়তো এখন আমাদের মনে নেই।
ছাপাখানার অক্ষরসমষ্টি আরও বেশী। ইংরেজী ছাপতে ক্যাপিটাল, স্মল, অঙ্ক এবং যতিচিহ্নাদি সমেত প্রায় ৭০টি টাইপে কাজ চলে, কিন্তু বাংলায় প্রায় ৫০০ টাইপ চাই। এত টাইপ কেন লাগে তা সংক্ষেপে বোঝানো অসম্ভব, সেজন্য তার আলোচনা করব না। আমাদের দেশে যারা টাইপের ছাঁদ উদ্ভাবন করেছে তারা সূক্ষ্মবুদ্ধি শিল্পী নয়, সাধারণ মিস্ত্রী মাত্র, কোনও দূরদর্শী অভিজ্ঞ লোক তাদের উপদেশ দেয় নি। তারা যথাসম্ভব হাতের লেখার নকল করেছে, নিজের রুচি অনুসারে একটু আধটু পরিবর্তন ও অলংকরণ করেছে, কিসে টাইপ সরল হয় তা মোটেই ভাবে নি, অনর্থক সংখ্যা বাড়িয়েছে। কতকগুলি অক্ষর এত জটিল যে ছাপায় প্রায় জুবড়ে যায়। সীসা-অ্যান্টিমনি-ঘটিত যে ভঙ্গুর ধাতুতে টাইপ গড়া হয় তার শক্তির উপর জুলুম করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে একটি টাইপ থেকে শাখা বেরিয়ে পাশের টাইপের মাথায় বা নীচে প্রসারিত হয়। এই শাখাগুলি ছাপাবার সময় প্রায় ভাঙে। ইংরেজীতে এইরকম kern টাইপের প্রয়োগ খুব কম।
বাংলা লিপির বদলে নাগরী লিপি চালালে একলিপিবিস্তারের সাহায্য হবে বটে, কিন্তু অন্য কোনও লাভ হবে না, কারণ নাগরী অক্ষর বাংলার তুল্যই দোষগ্রস্ত। আমরা যদি নিজের প্রয়োজনে নাগরী অক্ষর অল্পাধিক পরিবর্তিত করি তা হলে সে পরিবর্তন হিন্দী প্রভৃতি ভাষীর রুচিসম্মত না হতে পারে। সুতরাং নাগরীর মোহ ত্যাগ করাই কর্তব্য।
পণ্ডিতরা বলেন, প্রাচীন ফিনিশীয় লিপি থেকেই হিব্রু আরবী গ্রীক রোমান এবং ভারতীয় লিপিগুলি উদ্ভূত হয়েছে। ভারতীয় লিপির মূল যাই হক, আমাদের পরম সৌভাগ্য যে পশ্চিম দেশীয় বর্বর বর্ণমালা (alphabet) এদেশে আমল পায় নি। প্রাচীন ভারতের ব্যাকরণকার আলফা বিটা গামা, এ বি সি, আলিফ বে পে প্রভৃতি উদ্ধৃঙ্খল বর্ণক্রম পরিহার করে বিজ্ঞানসম্মত অ আ ক খ প্রভৃতি ক্রমে বর্ণমালা সাজিয়েছেন। আমাদের বর্ণসংখ্যা পশ্চিমদেশের চেয়ে বেশী, সেজন্য আমাদের অক্ষর অর্থাৎ বর্ণের লিখিত রূপও বেশী হয়েছে। পাশ্চাত্ত্য বা ভারতীয় কোনও অক্ষরমালা মুদ্রাযন্ত্র বা টাইপরাইটারের অপেক্ষায় সৃষ্ট হয় নি, লেখার জন্যই হয়েছে। দৈবক্রমে পাশ্চাত্ত্য অক্ষরের অল্পতা মুদ্রণের অনুকূল হয়েছে এবং ভারতীয় অক্ষরের বাহুল্য বাধাস্বরূপ হয়েছে। এতে পাশ্চাত্ত্য দেশের বাহাদুরি নেই, আমাদেরও লজ্জার কারণ নেই। বর্ণমালা এবং তার লিখিত রূপ বা লিপি এক জিনিস নয়, প্রথমটি অবিকৃত রেখেও দ্বিতীয়টি বদলানো যেতে পারে। এদেশে তা ঘটেছে। পাণিনির সময় বা তার পূর্ব থেকেই বর্ণমালা প্রায় অবিকৃত আছে, কিন্তু লিপি বা অক্ষরমালার আকৃতি কালে কালে বদলেছে। প্রাচীন সরল ব্রাহ্মী অক্ষরগুলি ক্রমে ক্রমে জটিল হয়ে বাংলা নাগরী প্রভৃতির বর্তমান রূপ পেয়েছে।
রোমান অক্ষর জটিলতাহীন, বহুপ্রচলিত, তাদের বিন্যাসরীতিও সরল, পর পর সাজালেই শব্দচনা হয়, বাংলা বা নাগরীর মতন একটা অক্ষরের সঙ্গে আর একটা জড়াতে হয় না। রোমান লিপির সুবিধা এবং কি উপায়ে তা বাংলা বর্ণমালার উপযোগী করা যায় তার বিশদ আলোচনা অধ্যাপক সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একাধিক প্রবন্ধে করেছেন। কিন্তু আমাদের অভ্যাস মজ্জাগত, আত্মাভিমানও প্রবল, সেজন্য অত্যন্ত উপযোগিতা সত্ত্বেও রোমান লিপি এখনই প্রচলিত হবার সম্ভাবনা নেই। এখন আমাদের যা আছে তারই যথাসম্ভব সংস্কারচেষ্টা কর্তব্য। এই সংস্কার ক্রমে ক্রমে করতে হবে যাতে অভ্যাস পীড়িত না হয় এবং বর্তমান রীতির সঙ্গে যোগসূত্র সহসা ছিন্ন না হয়।
অনেকে প্রস্তাব করেছেন যুক্তাক্ষরের পরিবর্তে হাইফেন-যোগে অক্ষর সংযুক্ত করা হক। এই পদ্ধতিতে লিখলে বা ছাপলে যোজিত অক্ষরগুলির মধ্যে যে ফঁক থাকবে তা দৃষ্টিকটু হবে এবং লোকে হাইফেনটিকে সংযোগচিহ্ন না ভেবে বিচ্ছেদচিহ্নই মনে করবে। বরং হচিহ্ন ভাল। অনেক শব্দে যুক্তাক্ষরের বদলে হচিহ্ন চলে, তার প্রয়োগ বাড়ালে অভ্যাসে তত বাধবে না। এই চিহ্ন যদি নীচে না দিয়ে অক্ষরগুলির প্রায় মাঝামাঝি বসানো হয় এবং কম হেলানো হয় তবে ফাঁক বেশী হবে না। কিন্তু সংস্কারের আরম্ভেই সমস্ত যুক্তাক্ষর তুলে দিয়ে হচিহ্ন চালানো কঠিন হবে।
কেউ কেউ বলেন, বাংলায় ঈ ঊ ঋ এবং তিন রকম শ ষ স রাখবার দরকার নেই। এই প্রস্তাব গ্রহণীয় মনে করি না। বাংলায় অসংখ্য সংস্কৃত শব্দ আছে, তাদের উচ্চারণ যতই বিকৃত হক ভারতীয় অন্যান্য ভাষার সঙ্গে বানানের সাম্য রাখা একান্ত বাঞ্ছনীয়। এদেশে সংস্কৃত ভাষার চর্চা লোপ পাবে না, সে কারণেও পূর্ণ অক্ষরমালা আবশ্যক। বিদেশী শব্দের sh এবং s-এর পৃথক উচ্চারণ বোঝাবার জন্য। শ এবং স-এর প্রয়োজন আছে।
আমার প্রস্তাব সংক্ষেপে নিবেদন করছি। অক্ষরসংস্কারের প্রথম ক্ৰম হিসাবে নিম্নলিখিত পদ্ধতি এখনই নেওয়া যেতে পারে।
(১) অনেক শব্দে যুক্তব্যঞ্জন স্থানে হচিহ্ন সহজেই চালানো যেতে পারে, তাতে চক্ষুপীড়া বা উচ্চারণের বাধা হবে না; যেমন ধিককার, বাগদেবী, খড়গ, তগত, সদ্ভাব, উদ্যোগ, প্রগম্ভ, বগা, সদ্ব্যয়। কিন্তু উদ্যান, বিদ্বান্ প্রভৃতি যথাবৎ লিখতে হবে। খণ্ড ত অনাবশ্যক। রেফের পর দ্বিত্ববর্জন করলে যুক্তব্যঞ্জন কমবে। বহু অসংস্কৃত শব্দে যুক্তব্যঞ্জন বাদ দেওয়া যেতে পারে, অনেক স্থলে হচিহ্নও না দিলে চলে যেমন নকশা, আড্ডা, সরদার, পরদা, উলটা। এর ফলে যুক্তব্যঞ্জন খুব না কমলেও হচিহ্ন প্রয়োগের অভ্যাস বাড়বে এবং ক্রমশ আরও বাড়ানো সম্ভবপর হবে।
(২) যুক্তব্যঞ্জনের অঙ্গীভূত অক্ষরগুলির মূল রূপ যথাসম্ভব অবিকৃত রাখতে হবে। এ বিষয়ে আচার্য যোগেশচন্দ্রের রীতি গ্রহণীয়। লাইনোটাইপে অনেকটা তা করা হয়েছে। জ্ঞ এবং ক্ষ এই দুই অক্ষরের বাংলা উচ্চারণ অত্যন্ত বিকৃত, সেজন্য এখন বর্তমান আকৃতিই রাখা ভাল।
(৩) হিন্দী মারাঠী প্রভৃতি ভাষায় বগীয় বর্ণের পূর্বে সেই বর্গের পঞ্চম বর্ণ যোগ হলে সাধারণত পঞ্চম বর্ণের প্রতীকস্বরূপ অনুস্বার দেওয়া হয়, যেমন রংগমংচ, পংডিত, নংদ, কংপ। অবশ্য উচ্চারণ পঞ্চম বর্ণ অনুসারেই হয়। আজকাল কয়েকজন সাহসী বাঙালী লেখক কবর্গের পূর্বে প্রায় সর্বত্র ঙ স্থানে অনুস্বার দিচ্ছেন, যেমন অংক, সংগে। এই রীতি সকল বর্গেই প্রচলনযোগ্য, কিন্তু উচ্চারণে বাধতে পারে। যদি অনুম্বারের পুচ্ছ বাদ দেওয়া যায় তবে গোল চিহ্নটি সকল পঞ্চম বর্ণের প্রতীকরূপে গণ্য হতে পারে, অনুস্বার বলে ভ্রম হবে না। এর ফলে ২০টি যুক্তব্যঞ্জন কমবে এবং নূতন পদ্ধতি অভ্যাস করতেও অসুবিধা হবে না।
(৪) তুচ্ছ কারণে ছাপাখানায় টাইপের বাহুল্য করা হয়েছে। শব্দের আদিতে মধ্যে ও শেষে দেবার জন্য দুরকম এ-কার আ-কার এবং ণ অনাবশ্যক। লাইনোটাইপে একই রকম অক্ষরে কাজ চলছে, সাধারণ টাইপেও চলবে। অনেক টাইপে ব্যঞ্জনের সঙ্গে ই-কার ঈ-কার উ-কার ঊ-কার ঋ-কার য-ফলা রেফ এবং চন্দ্রবিন্দু জোড়া আছে। এই বাহুল্য অনাবশ্যক। সর্বত্র ই-কার উ-কার য-ফলা প্রভৃতি পাশে বসিয়ে দিলেই কাজ চলে, যেমন লাইনোটাইপে।
(৫) লাইনোটাইপে এক নূতন উপায়ে অনেকগুলি যুক্তব্যঞ্জনের টাইপ কমানো হয়েছে। গ ণ দ ন প ম ল শ ষ স অক্ষরের ডান দিকের রেখাঁটি বাদ দিয়ে কতকগুলি অর্ধ-টাইপ করা হয়েছে। এইগুলির পাশে অন্য ব্যঞ্জনের পূর্ণ-টাইপ বসিয়ে দিলেই যুক্তাক্ষর তৈরি হয়, যেমন গ্ল ন্ট দগ দ ল্ক শ্চ স্ন ষ্ট। এই উপায়ে প্রায় ৭৬ টাইপ কমেছে। সাধারণ টাইপেও এই পদ্ধতি গ্রহণীয়।
অক্ষর সংস্কারের দ্বিতীয় ক্রমে অধিকাংশ যুক্তব্যঞ্জনের জায়গায় হচিহ্ন চালাতে হবে। য-ফলা, র-ফলা, রেফ, এবং যেসব যুক্তব্যঞ্জন শব্দের গোড়ায় বসে, যেমন ক্ল ক্ষ গ্ল জ্ঞ প্ল ব্ল ম্ল প্রভৃতি, তখনও হয়তো ছাড়া চলবে না। প্রায় এগার বৎসর পূর্বে শ্রীযুক্ত অজয়চন্দ্র সরকার এই রকম প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু সমস্ত যুক্তব্যঞ্জন বাদ দিয়েও আমরা আদর্শ লিপিতে পৌঁছতে পারব না। যদি মূল বর্ণগুলির আকৃতি সরল করা হয় এবং আ-কার ই-কার প্রভৃতির যোজ্য চিহ্ন তুলে দেওয়া হয়, অর্থাৎ অক্ষরমালার আমূল পরিবর্তন হয় এবং স্বরব্যঞ্জননির্বিশেষে সকল অক্ষর পাশাপাশি বসিয়ে শব্দরচনা হয়, তবেই সকল বাধা দূর হবে।
অক্ষর সংস্কারের শেষ পর্যায় কি? আশা করি তত দিনে আমাদের স্বরাজ্যলাভ এবং আত্মমর্যাদার প্রতিষ্ঠা হবে, উদ্যম বাড়বে, বুদ্ধি মোহমুক্ত হবে। তখন নানা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অক্ষরেরও চূড়ান্ত সংস্কার করতে দ্বিধাবোধ করব না। নূতন অক্ষর উদ্ভাবনের প্রয়োজন কি? রোমান লিপি আমাদের সুপরিচিত, বাংলা বর্ণমালার লিখিত রূপ হিসাবে এই রোমান অক্ষর চালানোই সুসাধ্য। বুদ্ধিমানের দৃষ্টিতে ক-অক্ষর বা k-অক্ষর কোনওটি গোমাংস নয়। যদি আমরা ক নাম দিয়েই k অক্ষর চালাই তাতে ক্ষতি কি? ইওরোপ যেমন সুবিধাজ্ঞানে ভারতীয় মঞ্চ এবং দশমিক গণনাপদ্ধতি নিয়েছে আমরাও সেইরকম রোমান লিপি আত্মসাৎ করতে পারি, তার জন্য দীনতার গ্লানি আমাদের স্পর্শ করবে না।
[হাতের লেখা আর ছাপার টাইপ সমান হতে পারে না। লেখার টানে অক্ষর অম্লাধিক জড়িয়ে যায়। কিন্তু ছাপায় অক্ষরের স্বাতন্ত্র্য অত্যাবশ্যক। শতাধিক বৎসর পূর্বে হাতে লেখা পুঁথির গোটা গোটা অক্ষরের নকলে টাইপের যে ছাঁদ হয়েছিল এখনও তাই চলছে। আধুনিক হাতের লেখার সঙ্গে তার অনেক প্রভেদ। যদি টাইপের ছাঁদ কিছু বদলানো হয় তবে এই প্রভেদ বাড়বে না।
এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় লক্ষণীয়, আজকাল বইএর মলাটে এবং পণ্য বস্তুর বিজ্ঞাপনে অনেক রকম বিকৃত অক্ষর দেখা যাচ্ছে। অক্ষরকার বোধ হয় মনে করেন যে দুপাঠ্যতাই আধুনিকতার লক্ষণ। কিছুকাল পূর্বে আমার কয়েকজন বন্ধু একটি পত্রিকার মলাটে ছাপা নামটি অনেক চেষ্টা করে পড়েছিলেন–তাড়ী। কিন্তু নামটি প্রাচী। এইরকম বিকৃত অক্ষরে বিজ্ঞাপনের উদ্দেশ্য পণ্ড হয়। ইংরেজী বিজ্ঞাপনে উৎকট অক্ষর দেখা যায় না।]
বাংলা ছন্দের মাত্রা
আমি ছন্দোবিশারদ নই, কিন্তু আমার একটা চলনসই কর্ণেন্দ্রিয় আছে। যার দ্বারা বোধ হয় যে অমুক পদ্যের ছন্দটা ঠিক, অমুকটার বেঠিক। হয়তো কানের বা পাঠের বা অভিজ্ঞতার দোষে মাঝে মাঝে ঠিক ছন্দেও ত্রুটি ধরি, বেঠিক ছন্দেরও পতন বুঝতে পারি না। তথাপি নিজের কানের উপর নির্ভর করে যথাবুদ্ধি বাংলা ছন্দ বিশ্লেষের চেষ্টা করছি। অনেকে ছন্দের রহস্য না জেনেও ভাল পদ্য লিখতে পারেন, অনেক সাধারণ পাঠকও ছন্দ বজায় রেখে পড়তে পারেন। আমি সেই সহজ সংস্কারবশেই ছন্দোজিজ্ঞাসায় প্রবৃত্ত হয়েছি।
চিত্রশাস্ত্রকার বিধান দিতে পারেন যে মানুষের মাথার যে মাপ হবে তার সঙ্গে চোখ নাক ধড় হাত পা প্রভৃতির এই এই অনুপাত থাকবে। আরও অনেক নিয়ম তিনি বিজ্ঞানীর মতন সূত্রাকারে বেঁধে দিতে পারেন। ঐসমস্ত নিয়ম অনুসারে কেউ যদি ছবি আঁকে তবে তা শাস্ত্রসম্মত হবে, কিন্তু ভাল নাও হতে পারে। যে যে লক্ষণ থাকলে চিত্র উত্তম হয় তার সম্পূর্ণ নির্দেশ দেওয়া শাস্ত্রের সাধ্য নয়। শাস্ত্রকার কেবল স্থূল নিয়ম দিতে পারেন। ছন্দঃশাস্ত্রেও এই কথা খাটে। ছন্দের স্থূল নিয়মের আলোচনাই সুসাধ্য।
ছন্দ শব্দের ব্যাপক অর্থ করা যেতে পারে–পর্বে পর্বে বিভক্ত সুপাঠ্য সুশ্রাব্য শব্দধারা। ধারার বিভাগ অর্থাৎ মাঝে মাঝে বিরাম বা একান্বয়ভঙ্গ (break of monotony) চাই, আবার বিভাগগুলির সংগতি বা সামঞ্জস্য (harmony)ও চাই। কেন সুশ্রাব্য হয়, কিসে সংগতি হয়, তা বলা আমার সাধ্য নয়। যে সকল ছন্দ সুপ্রচলিত তাদের স্পষ্ট ও সাধারণ লক্ষণগুলিই বিচার করে দেখতে পারি। ছন্দের চরণসংখ্যা, পর্ববিভাগ, যতি এবং স্থানবিশেষে স্বরাঘাত বা জোর(stress)ও আমার আলোচ্য নয়। বিভিন্ন ছন্দঃশ্রেণীর যা কঙ্কালস্বরূপ, অর্থাৎ মাত্ৰাসংস্থান বা মাত্রাগণনার রীতি, কেবল তার সম্বন্ধেই লিখছি। মাঝে মাঝে সংস্কৃত রীতির উল্লেখ করতে হয়েছে, কারণ বাংলা ছন্দের প্রকৃতি আলাদা হলেও ক্ষেত্রবিশেষে সংস্কৃতের সঙ্গে তার সাদৃশ্য আছে।
প্রথমেই কয়েকটি শব্দের অর্থ নির্দিষ্ট করা দরকার, নয়তো বোঝবার ভুল হতে পারে।
হরফ ও অক্ষর
অক্ষর শব্দ সাধারণত দুই অর্থে চলে। প্রথম অর্থ হরফ, যেমন অ ক্ ক কু কে ঐ ৎ ং :। দ্বিতীয় অর্থsyllable। এই প্রবন্ধে প্রথম অর্থে অক্ষর লিখব না, হরফ লিখব। দ্বিতীয় অর্থেই অক্ষর লিখব। এক শ্রেণীর বাংলা ছন্দকে অক্ষরবৃত্ত বলা হয়, সেখানে অক্ষর মানে হরফ। অক্ষরবৃত্ত নামটি ভ্রান্তিজনক, কিন্তু বহুপ্রচলিত, সেজন্য বজায় রেখেছি।
অক্ষর বা syllable শব্দে বোঝায়–শব্দের নূন্যতম অংশ যার পৃথক্ উচ্চারণ হতে পারে। আগে বা পরে স্বরবর্ণ না থাকলে ব্যঞ্জনবর্ণ উচ্চারণ করা যায় না, সেজন্য কেবল ব্যঞ্জনবর্ণে অক্ষর হতে পারে না। র ল শ ষ স স্বরযুক্ত না করেও উচ্চারণ করা যায় বটে, কিন্তু সাধারণ ভাষায় সেরকম প্রয়োগ নেই। প্রতি অক্ষরে থাকে–শুধুই একটি স্বর, অথবা একটিমাত্র স্বরের সঙ্গে এক বা একাধিক ব্যঞ্জন। অনুস্বার বিসর্গও ব্যঞ্জনস্থানীয়। অক্ষরের উদাহরণ–অ তু উৎ কন্ দ্বী প্রাং ন্তঃ। জল সংস্কৃতে ২ অক্ষরজ-ল, কিন্তু বাংলা উচ্চারণে জল হসন্ত সেজন্য ১ অক্ষর। জলছবি ৩ অক্ষরজল-ছ-বি, জলযোগ ৩ অক্ষরজ-ল-যোগ, জলকেলি ৪ অক্ষর–জ-ল-কে-লি। অন্তঃপাতী–অন্তঃ–পা-তী কিংবা অন্তঃ-পাতী। অধিষ্ঠাত্রী–অ-ধি-ঠাৎ-রী কিংবা অধিষ্ঠাত্রী।
একটিমাত্র স্বর থাকাই অক্ষরের সাধারণ লক্ষণ। শব্দে যতগুলি স্বর ততগুলি অক্ষর। কিন্তু বাংলায় কতকগুলি দ্বিস্বর অক্ষর চলে, যেমন এই, বউ, খাও। এইরকম জোড়াস্বর বা dipthong ঐ ঔ বর্ণের তুল্য এবং অক্ষরে এক স্বর রূপে গণনীয়। অথবা ধরা যেতে পারে যে দ্বিতীয় স্বরটি ব্যঞ্জনধর্মী, কারণ তার টান নেই।
মাত্রা, স্বরের হ্রস্বদীর্ঘ ভেদ, অক্ষরের লঘুগরু ভেদ
মাত্রার অর্থ–স্বরবর্ণের উচ্চারণকাল। ব্যঞ্জনবর্ণের মাত্রা নেই, ব্যঞ্জন যে স্বরকে আশ্রয় করে তারই মাত্রা আছে। ব্যঞ্জনের মাত্রা আছে মনে করলে অনর্থক বিভ্রাট হয়। সংস্কৃতে স্বরবর্ণের হ্রস্বদীর্ঘভেদ আছে, হ্রস্বস্বরের এক মাত্রা দীর্ঘস্বরের দুই মাত্রা। ছন্দে অক্ষরেরও ভেদ ধরা হয়। যে অক্ষরের অন্তর্গত স্বর হ্রস্ব তা লঘু, যার স্বর দীর্ঘ তা গুরু। সংস্কৃত ছন্দের নিয়মে হ্রস্ব স্বরও দীর্ঘতা পায়–যদি তার পরে অনুস্বর বা বিসর্গ থাকে অথবা হচিহ্নিত ব্যঞ্জন বা যুক্তব্যঞ্জন থাকে। তা ছাড়া দরকার হলে চরণের শেষের স্বরও দীর্ঘতা পায়–
সানুস্বারশ্চ দীর্ঘশ্চ বিসর্গী চ গুরুর্ভবেৎ।
বর্ণঃ সংযোগপূর্বশ্চ তথা পাদান্তগোপি বা৷
প্রথম ও তৃতীয় চরণের আদিতে যুক্তব্যঞ্জন থাকলে পূর্ববর্তী স্বরের উপর তার প্রভাব হয় না। বাংলায় হ্রস্বদীর্ঘ স্বরের স্বাভাবিক ভেদ নেই, কেবল স্থান বিশেষে ঐ ঔ দীর্ঘ হয়।
উক্ত সংস্কৃত নিয়ম অনুসারে এইসকল অক্ষরের অন্তর্গত স্বর হ্রস্ব, সেজন্য অক্ষরগুলি লঘু–অ চ কি তু নৃ প্র দ্বি ক্ষু। এইগুলি গুরু, কারণ অন্তর্গত স্বর দীর্ঘ–আ কা কী ভূ সে নৌ কিং নিঃ কিম্ পূর ন্যস্ ক্ষি। শিল্প শব্দের ই-কার দীর্ঘ, কারণ পরে যুক্তব্যঞ্জন আছে। . সংস্কৃত নিয়মে সূত আর সুপ্ত দুই এরই আদ্য স্বর দীর্ঘ–এবং অন্ত্য স্বর হ্রস্ব, সেজন্য আদ্য অক্ষর সূ, সু- গুরু এবং অন্ত্য অক্ষর–ত লঘু। কারু, দীন, শৌরি এবং সত্ত্ব, দুষ্ট, দীপ্তি, সৈন্য সবগুলিই ঐপ্রকার, একটির বদলে অন্য একটি বসালে দোষ হয় না। সূ- আর সু- অক্ষরের যে উ উ আছে তাদের উচ্চারণকাল বা মাত্রা সমান। কিন্তু সূ- আর সু- অক্ষরের ধ্বনির ওজনও কি সমান? সূ-এর উচ্চারণে টান আছে, সু-এ ঘাত বা ধাক্কা বা সহসা ধ্বনিরোধ আছে, দুটিই সমান হতে পারে না। উক্ত দুরকম অক্ষরের অনুষঙ্গী দুরকম দীর্ঘস্বরের পার্থক্যসূচক পরিভাষা আছে কিনা জানি না। কাজ চালাবার জন্য নাম দিচ্ছি–স্বতেদীর্ঘ, অর্থাৎ যে স্বর সংস্কৃতে স্বভাবত দীর্ঘ, যেমন সূতএর ঊ; পরতোদীর্ঘ, অর্থাৎ যে স্বর হ্রস্ব হলেও পরবর্তী যুক্তব্যঞ্জনাদির প্রভাবে দীর্ঘ হয়, যেমন সুপ্তএর উ। অক্ষরের ঐরকম ভেদসূচক নাম-স্বলতাগুরু, পরতোগুরু। সংস্কৃত ছন্দে এই ভেদ গ্রাহ্য হয় না–
রাগেণ বালারুণকোমলেন।
চুতপ্রবালোষ্ঠমলঞ্চকার।
প্রথম পঙক্তিতে যুক্তব্যঞ্জন নেই, দ্বিতীয়তে আছে, অথচ ছন্দ একই। বাংলা ছন্দের শ্রেণীভেদে পরতোগুরু অক্ষর মানা হয় কিন্তু ঐ ঔ ছাড়া স্বতোগুরু মানা হয় না, আবার কৃত্রিমগুরুও মানা হয়–সে কথা পরে বলব।
সংস্কৃত ছন্দে উক্ত ভেদের নিয়ম না থাকলেও নিপুণ কবি ধ্বনিবৈচিত্র্যের জুন্য স্বলতাগুরু বা পরতোগুরু অক্ষর নির্বাচন করে প্রয়োগ করেন। এই নির্বাচনের সূত্র কবির মাথাতেই থাকে, ছন্দঃশাস্ত্রে তা নেই।
অক্ষর ও মাত্রা সম্বন্ধে আর একটু বলবার আছে। কোনও শব্দের অক্ষরগুলি দুই রীতিতে পৃথক করে দেখানো যেতে পারে। প্রথম রীতি–শব্দের যুক্তব্যঞ্জন না ভাঙা, যেমন সু-প্ত, শ্রদ্ধা-বান্। কিন্তু এতে পরতোদীর্ঘতা প্রকাশ পায় না। সু- আর শ্র- এর স্বর পরতোদীর্ঘ, কিন্তু অক্ষরে তার লক্ষণ নেই। দ্বিতীয় রীতি–যথাসম্ভব যুক্তব্যঞ্জন বিশ্লেষ করা, যাতে স্বরের পরতোদীর্ঘতা (বা অক্ষরের পরতোগুরুতা) অক্ষর দেখলেই বোঝা যায়, যেমন সু-ত, শ্রদ্ধা-বান্। এই প্রবন্ধের উদাহরণে দ্বিতীয় রীতিই অনুসৃত হয়েছে। কিন্তু যে বাংলা ছন্দে যুক্তব্যঞ্জনের জন্য পূর্বস্বর দীর্ঘ হয় না সেখানে প্রথম রীতিতে অক্ষর ভাগ হয়েছে, যেমন জন্মেছিস।
সংস্কৃত ছন্দ
বাংলা ছন্দের আলোচনার আগে সংস্কৃত ছন্দের কিঞ্চিৎ পরিচয় আবশ্যক মনে করি, তাতে বাংলা ছন্দের সূত্রগঠন সহজ হবে। সংস্কৃত নিয়ম খুব বাঁধাধরা, পদ্যকারের স্বাধীনতা অল্প, সেজন্য নিয়মের সূত্র সরল। সংস্কৃতে দুই শ্রেণীর ছন্দ বেশী চলে–অক্ষরছন্দ বা বৃত্ত, এবং মাত্রাছন্দ বা জাতি।
অক্ষরছন্দের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা নিয়ত; মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাসও নিয়ত, অর্থাৎ ভেদে অক্ষর সাজাবার বাঁধা নিয়ম আছে। মিশ্র ছন্দও চলে, যেমন ইন্দ্ৰবজ্রা ও উপেন্দ্ৰবজ্রার মিশ্রণে উপজাতি ছন্দ। মন্দাক্রান্তা অমিশ্র ছন্দ, সব চরণ সমান। অক্ষর ভাগ করে তার উদাহরণ দিচ্ছি–
– ক-চিৎ কান্তা–বি-র-হ-গুরু-না স্বা-ধি-কা-র-র-মৎ-তঃ
শা-পে-না-তং-গ-মি-ত-ম-হি-মা বর্ষ-ভোগৃ-য়ে-ণ ভর-তুঃ।
প্রত্যেক চরণে অক্ষরসংখ্যা ১৭, মাত্ৰাসংখ্যা ২৭। উদাহরণের শব্দগুলির যথাক্ৰম অক্ষরবিন্যাস নীচে দেওয়া হল, লঘু অক্ষরের চিহ্ন ১, গুরু অক্ষরের ২–
২২ ২২১১১১১২ ২১২২১২২
২২২২১১১১১২ ২১২২১ ২২
মাত্রাচ্ছন্দের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা প্রায় অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত। যথা পজঝটিকা ছন্দে–
মূঢ় জহীহি ধনাগমতৃষ্ণাং ।
কুরু তনুবুদ্ধে মনসি বিতৃষ্ণা।
যল্লভসে নিজকর্মোপাত্তং
বিত্তং তেন বিনোদয় চিত্ত
যথাক্রমে চার চরণের অক্ষরসংখ্যা ১১, ১২, ১০, ১০। মাত্ৰাসংখ্যা প্রতি চরণে ১৬। অক্ষরবিন্যাস এইরকম–
২১ ১২১ ১২১১২২।
১১ ১১২২ ১১১ ১২২
২১১২ ১১২২২২
২২ ২১ ১২১১ ২২
সংস্কৃত পদ্যে চরণের শেষে মিল কম দেখা যায়। যা আছে তা প্রায় মাত্রাচ্ছন্দে, যেমন পজঝটিকায়, গীতগোবিন্দে, কজ্জলপূরিতলোচনভারে প্রভৃতি স্তোত্রে। কারণ বোধ হয় এই–অক্ষরচ্ছন্দে অক্ষরবিন্যাস ভেদে নিয়মিত, পর্যায়ক্রমে তার আবর্তন হয়। এমন ছন্দের মাধুর্য মিলের উপর নির্ভর করে না। মাত্রাচ্ছন্দে এই আবর্তনের অভাবে কিঞ্চিৎ আকাঙ্ক্ষা রয়ে যায়, তার পূরণের জন্যই মিলের চেষ্টা। অথবা এও হতে পারে যে চরণের মিল করতে গেলে অক্ষরচ্ছন্দের কড়া নিয়ম মানা শক্ত হয়, তাই পদ্যকার অপেক্ষাকৃত স্বাধীন মাত্রাচ্ছন্দের শরণ নেন।
বাংলা ছন্দ
বাংলা ছন্দের প্রচলিত শ্রেণী তিনটি। সাধারণত তাদের নাম দেওয়া হয়–অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত। তা ছাড়া সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণও কিছু চলে। বাংলায় স্বতেদীর্ঘ স্বর নেই, কিন্তু ছন্দের শ্রেণীবিশেষে ঐ ঔ দীর্ঘ হয় এবং পরতোদীর্ঘ ও কৃত্রিমদীর্ঘ স্বরও চলে।
বাংলা ছন্দের সাধারণ লক্ষণ–চরণের নিয়ত মাত্ৰাসংখ্যা, যেমন অধিকাংশ সংস্কৃত ছন্দে। অনেক আধুনিক ছন্দের চরণ অত্যন্ত অসমান, তথাপি তার জন্য সুশ্রাব্যতার হানি হয় না, বরং বৈচিত্র্য হয়। কিন্তু এইসব ছন্দের সূত্র-নিরূপণ অসম্ভব। শুধু বলা যেতে পারে যে অমুক পদ্যের শব্দগুলির মাত্রা অমুক শ্রেণীর রীতিতে ধরা হয়েছে। কিন্তু তাও আবার সর্বত্র স্থির করা যায় না।
অক্ষরবৃত্ত
অক্ষরবৃত্তের উদাহরণ সাধারণ পয়ার ত্রিপদী ইত্যাদি। এই শ্রেণীর ছন্দের প্রধান লক্ষণ–চরণের নিয়ত হরফ-সংখ্যা, যেমন পয়ারের প্রতি চরণে ১৪ হরফ। স্বরান্ত ব্যঞ্জন, হচিহ্নিত বা হসন্তবৎ উচ্চারিত ব্যঞ্জন, যুক্তব্যঞ্জন, অনেক স্থলে অনুস্বার পর্যন্ত নির্দিষ্ট সংখ্যার মধ্যে ধরা হয়, কেবল বিসর্গ ধরা হয় না। ঐ এক হরফ, কিন্তু ওই দু হরফ। সর্দার ৩ হরফ, কিন্তু দরকার হলে সরদার লিখে ৪ হরফ করা যায়। বান্দেবী আর বাগদেবী একই শব্দ, অথচ প্রথমটির ৩ হরফ দ্বিতীয়টির ৪ হরফ ধরা হয়। আসল কথা–হরফের হিসাব একটা কৃত্রিম চাক্ষুষ উপায়। ছন্দের ব্যঞ্জন মুখে, ধারণা কানে। মুখ আর কানের সাক্ষ্য নিয়েই সূত্রনির্ণয় করতে হবে।
পাখি সব করে রব রাতি পোহাইল,
কাননে কুসুমকলি সকলি ফুটিল!
যদি প্রত্যেক হরফ স্বরান্ত করে পড়া হয় তবে বলা যেতে পারে–প্রতি চরণে ১৪ হরফ, ১৪ অক্ষর, ১৪ মাত্রা। কিন্তু যদি সহজ রীতিতে পড়া হয় তবে হসন্ত উচ্চারণের উপর নজর রেখে এইরকমে অক্ষর ভাগ করা যেতে পারে
পা-খি সব ক-রে রব রা-তি পো-হা-ই-ল,
কা-ন-নে কু-সুম-ক-লি স-ক-লি ফু-টি-ল।
প্রথম চরণে ১২ অক্ষর, দ্বিতীয়তে ১৩। হসন্ত উচ্চারণের জন্য সব, রব,–সুম এই ৩ অক্ষর পরতোগুরু হয়েছে, অন্য অক্ষরগুলি লঘু। দুই চরণেই ১৪ মাত্রা। কিন্তু অক্ষরবৃত্তের সূত্র এত সহজে পাওয়া যাবে না। সকল পদ্যই যুক্তাক্ষরবর্জিত শিশুপাঠ্য নয়।
বহু পরিচর্যা করি পে-য়ে-ছি-নু তো-রে,
জন্মেছিস ভর্তৃহী-না জ-রালার ক্রোড়ে।
এখানে জন্মেছিস আর জবালার এই দুই শব্দের উচ্চারণ হসন্ত, সেজন্য–ছিস ও লার এই দুই অক্ষর পরতোগুরু। কিন্তু যুক্তব্যঞ্জনের প্রভাবে পরিচর্যা, জন্মেছিস, ভর্তৃহীনা শব্দে পরতোগুরু অক্ষর উৎপন্ন হয় নি। প রি-চর্যা ৪টিই লঘু অক্ষর। চ-এর অ-কারকে চেপে হ্রস্ব করে রাখা হয়েছে, তার ফলে পরিচর্যার উচ্চারণকাল পেয়েছিনুর সমান। জন্মেছিস, ভর্তৃহীনাও এইরকম। উপরের উদাহরণে যথাক্রমে দুই চরণের হরফ-সংখ্যা ১৪, ১৪, অক্ষরসংখ্যা ১৪, ১২, মাত্ৰাসংখ্যা ১৪, ১৪।
অক্ষরবৃত্তের রীতি–হসৃচিহ্নিত বা হসন্তবৎ উচ্চারিত ব্যঞ্জন বা পূর্বোক্ত দ্বিস্বর থাকলে অক্ষর পরতোগুরু হয়, কিন্তু যুক্তব্যঞ্জন বা ঐ ঔ থাকলে হয় না। বিসর্গের জন্যও হয় না, দুঃখএর দুই অক্ষরই লঘু। শব্দের মধ্যে অনুস্বার থাকলে প্রায় হয় না, কিন্তু শেষে থাকলে হয়। সংখ্যার দুই অক্ষরই লঘু, কিন্তু সুতরাংএর প্রথম দুই অক্ষর লঘু, শেষ অক্ষর গুরু।
উক্ত রীতির বশে অক্ষরবৃত্তের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা নিয়ত, অক্ষরসংখ্যা অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত এবং সাধারণত হরফসংখ্যার সমান। অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত।
যুক্তব্যঞ্জনের জন্য অক্ষরের গুরুতা হয় না বটে, কিন্তু তার ঘাত বা ধাক্কা নিপুণ কবিরা উপেক্ষা করেন না, উপযুক্ত স্থলে প্রয়োগ করে বৈচিত্র্যসাধন করেন। পাঠকও বিশেষ বিশেষ স্বরে জোর দিয়ে ঘাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করেন।
মাত্রাবৃত্ত
এই শ্রেণীর ছন্দে যুক্তব্যঞ্জন অবজ্ঞাত নয়, সেজন্য পরতোগুরু অক্ষর প্রচুর দেখা যায়। অনুস্বার, বিসর্গ, হচিহ্নিত বা হসন্তবৎ উচ্চারিত ব্যঞ্জন এবং যুক্তব্যঞ্জনের প্রভাবে অক্ষর পরতোগুরু হয়। যে অক্ষরে ঐ ঔ বা দ্বিস্বর আছে তাও গুরু। কিন্তু শব্দের আদিতে যুক্তব্যঞ্জন থাকলে তার প্রভাব পূর্ববর্তী শব্দের অন্ত্য স্বরে প্রায় হয় না।
মাত্রাবৃত্তের সূত্র–চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত। যথা
পল্ল বঘন আম্র–কা-ন-ন রা-খা-লের খে-লা-গে-হ,
স্তব্ধ অতল দিঘি-কা-লো-জল নিশীথ-শীতল স্নেহ।
যথাক্রমে দুই চরণের হরফ-সংখ্যা ১৮, ১৯, অক্ষরসংখ্যা ১৭, ১৬, মাত্ৰাসংখ্যা ২০, ২০।
অনেকে বলেন–মাত্রাবৃত্তে যুক্তব্যঞ্জন ২ মাত্রা। তাতে হিসাব মিলতে পারে, কিন্তু উক্তিটি ভ্রমাত্মক। পল্লব শব্দের ল্ল ২ মাত্রা বললে বোঝায় ম্ল এর অ-কার ২ মাত্রা। কিন্তু তা সত্য নয়, প-এর অ-কারই ২ মাত্রা, কারণ পরে যুক্তব্যঞ্জন আছে। পল্লব এইরকমে অক্ষরভাগ করলে মাত্রাবিপর্যয় ঘটে না। অনুরূপ–উৎ-সা-হ, সংহ-ত, দুঃসহ।
বাংলা মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে সংস্কৃত মাত্রাচ্ছন্দের সাদৃশ্য আছে। প্রভেদ এই–বাংলায় ঐ ঔ ছাড়া স্বতদীর্ঘ স্বর নেই। মাত্রাবৃত্তে যদি অক্ষরবিন্যাস ভেদে নিয়মিত করা হয় তবে তার সঙ্গে সংস্কৃত অক্ষরচ্ছন্দের সাদৃশ্য হয়। উদাহরণ শেষে আছে।
স্বরবৃত্ত
রবীন্দ্রনাথ এই শ্রেণীর বাংলা ছন্দের নাম দিয়েছেন–প্রাকৃত ছন্দ। গ্রাম্য ছড়ায় ও গানে প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যায়। স্বরবৃত্ত নামের উদ্দিষ্ট অর্থ কি ঠিক জানি না। কেউ কেউ বলেন–এতে প্রতি চরণে স্বরবর্ণের (অতএব অক্ষরের) সংখ্যা সমান রাখা হয়। অনেক স্থলে তা হয় বটে, কিন্তু শ্রেষ্ঠ কবির লেখাতেও ব্যতিক্রম দেখা যায় এবং তার জন্য ছন্দঃপাত হয় না। অতএব বলা চলে না যে নিয়ত স্বরসংখ্যাই এই শ্রেণীর লক্ষণ। স্বরবৃত্তের বিশিষ্টতা-মাত্ৰাসংখ্যা ঠিক রাখবার জন্য স্থানবিশেষে কৃত্রিম দীর্ঘ স্বরের প্রয়োগ।
বৃটি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান,
শিব-ঠাকুরের বিয়ে হবে তিন কনে দান।
যথাক্রমে দুই চরণের হরফ-সংখ্যা ১৭, ১৬, অক্ষরসংখ্যা ১৩, ১২, মাত্রাবৃত্তের রীতিতে গণিত মাত্ৰাসংখ্যা ১৮, ১৭। এই হিসাবে দ্বিতীয় চরণে এক মাত্রা কম পড়ে, কিন্তু চিহ্নস্থানে প্রথম চরণে ২টি স্বর এবং দ্বিতীয় চরণে ৩টি স্বর প্রসারিত করায় কৃত্রিমগুরু অক্ষর উৎপন্ন হয়েছে, তার ফলে প্রতি চরণে ২০ মাত্রা হয়েছে। এই ছড়া সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছন্দ পুস্তকে লিখেছেন–তিন গণনায় যেখানে ফাঁক, পার্শ্ববর্তী স্বরবর্ণগুলি সহজেই ধ্বনি প্রসারিত করে সেই পোড়ো জায়গা দখল করে নিয়েছে। অর্থাৎবৃষ্টি ৩ মাত্রা; শেষের এ-কার প্রসারিত করার ফলে পড়েও ৩ মাত্রা।
দিনের আলো নিবে এ-র্ল সু-যি ডো-র্বে ডো-বে,
আকাশ ঘি-রে মেঘ জুটেছে চা-দের লো-র্ভে লো-ভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে, রঙের উপর রঙ।
মন্-দি-রে-তে কাঁসর ঘন্টা বাজল ঠং ঠং।
উপরের ৪ পঙক্তিতে যথাক্রমে হরফ-সংখ্যা ১৫, ১৭, ১৯, ১৬, অক্ষরসংখ্যা ১৪, ১৪, ১৩, ১২, মাত্রাবৃত্তানুসারে মাত্ৰাসংখ্যা ১৬, ১৭, ১৯, ১৮। চিহ্নস্থানে চার পঙক্তিতে যথাক্রমে ৪, ৩, ১, ২, স্বর প্রসারিত করায় প্রতি পঙক্তিতে ২০ মাত্রা হয়েছে। প্রথম ঠং লক্ষণীয়–এখানে প্রসারণ ও অনুস্বার এই দুই কারণে অ-কার ৩ মাত্রা পেয়েছে।
স্বরবৃত্তের সূত্র-চরণের হরফ-সংখ্যা অনিয়ত, অক্ষরসংখ্যা অনিয়ত, মাত্ৰাসংখ্যা নিয়ত, অক্ষরবিন্যাস অনিয়ত। মাত্রাগণনায় মাত্রাবৃত্তের রীতি অনুসৃত হয়, কিন্তু অতিরিক্ত কৃত্রিমদীর্ঘ স্বরও ধরা হয়। কৃত্রিমদীর্ঘ স্বর (বা কৃত্রিমগুরু অক্ষর) থাকাতেই মাত্রাবৃত্তের সঙ্গে স্বরবৃত্তের প্রভেদ হয়েছে।
উল্লিখিত সংস্কৃত ও বাংলা বিভিন্ন ছন্দঃশ্রেণীর লক্ষণ এই সারণীতে সংক্ষেপে দেওয়া হল–
লক্ষণ
সংস্কৃত
বাংলা অক্ষরচ্ছন্দ মাত্রাচ্ছন্দ। অক্ষরবৃত্ত মাত্রাবৃত্ত স্বরবৃত্ত
নেই।
আছে আছে। নেই : অনিয়ত নিয়ত
নেই
স্বভোগুরু অক্ষর। পরতোগুরু অক্ষর কৃত্রিমগুরু অক্ষর হরফ-সংখ্যা অক্ষরসংখ্যা মাত্ৰাসংখ্যা অক্ষরবিন্যাস
নেই
আছে।
অল্প * অল্প* আছে। অল্প + আছে আছে।
আছে। অনিয়ত। নিয়ত অনিয়ত অনিয়ত প্রায় অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত নিয়ত নিয়ত নিয়ত নিয়ত
অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত অনিয়ত
নিয়ত
নিয়ত
অসম ছন্দ ও গদ্য ছন্দ
পূর্বোক্ত তিন শ্রেণীর বাংলা ছন্দে দেখা যায় যে একচরণের মাত্ৰাসংখ্যা পরবর্তী কোনও এক চরণের সমান। এইরকম দু-একজোড়া চরণ মিলিয়ে দেখলেই ছন্দের শ্রেণী ধরা পড়ে। কিন্তু যেখানে চরণগুলি অসমান সেখানে উপায় কি? শব্দাবলীর মাত্রাভঙ্গী থেকে অনেক স্থলে বলা যেতে পারে যে ছন্দটি অমুক শ্রেণীর। কিন্তু কতকগুলি ছন্দ, বিশেষত গদ্য ছন্দ, তিন শ্রেণীর কোনওটির সঙ্গে খাপ খায় না।
১। আমার দুর্বোধ বাণী
বিরুদ্ধ বুদ্ধির পরে মুষ্টি হানি
করিবে তাহারে উচ্চকিত
আতঙ্কিত
২। অধরা মাধুরী পড়িয়াছে ধরা
এ মোর ছন্দ বন্ধনে।
বলাকা পাঁতির পিছিয়ে পড়া ও পাখি,
বাসা সুদূরের বনের প্রাঙ্গণে।
৩। আমার পক্ষে বিয়ে করা বিষম কঠিন কর্ম,
কিন্তু গৃহধর্ম।
স্ত্রী না হলে অপূর্ণ যে রয়,
মনু হতে মহাভারত সকল শাস্ত্রে কয়।
উদ্ধৃত উদাহরণগুলির ভঙ্গী থেকে বলা যেতে পারে প্রথমটি অক্ষরবৃত্ত, দ্বিতীয়টি মাত্রাবৃত্ত, তৃতীয়টি স্বরবৃত্ত। প্রত্যেকটিতে যেন সমান মাত্রার এক একরকম ছন্দ থেকে এক একটি পঙক্তি তুলে এনে অসমান মাত্রার গোছা বাঁধা হয়েছে। এরকম ছন্দকে মিশ্রছন্দ বলা যেতে পারে। কিন্তু–
সন্ধ্যা এল চুল এলিয়ে
অস্তসমুদ্রে সদ্য স্নান করে।
মনে হল স্বপ্নের ধূপ উঠছে।
নক্ষত্রলোকের দিকে।
এই উদাহরণ একবারে স্বচ্ছন্দ, সাধারণ ছন্দের সঙ্গে সম্পর্ক নেই। রবীন্দ্রনাথ এরকম গদ্য ছন্দের পরিচয় দিয়েছেন–এতে পদ্যের ছন্দ নেই, এতে জমানো ভাবের ছন্দ। শব্দবিন্যাসে সুপ্রত্যক্ষ অলংকরণ নেই, তবুও আছে শিল্প।
সংস্কৃত ছন্দের অনুকরণ
সংস্কৃত ছন্দের সমস্ত নিয়ম বজায় রেখে কেউ কেউ বাংলা পদ্য লেখবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সুবিধা হয় নি, কারণ স্বতেদীর্ঘ স্বর বাংলা ভাষার প্রকৃতি-বিরুদ্ধ, তাতে রচনা কৃত্রিম হয়ে পড়ে। বলদেব পালিতের লেখা। থেকে উপজাতি ছন্দের নমুনা–
দৈবানুকূলে বলহীন শক্ত,
বলী অশক্ত প্রতিকূল দৈবে।
দৈবে হবে নির্জিত সূতপুত্র।
তোমার ভাগ্যে ঘটিবে জয়শ্রী।
প্রতি চরণে ১১ অক্ষর। প্রথম, তৃতীয় ও চতুর্থ চরণ ইন্দ্ৰবজ্রা, ১৮ মাত্রা; দ্বিতীয় চরণ উপেন্দ্ৰবজ্রা, ১৭ মাত্রা। অনুরূপ সংস্কৃত–
এষা প্রসন্নস্তিমিতপ্রবাহা
সরিদ বিদূরান্তরভাবতন্বী।
মন্দাকিনী ভাতি নগোপকণ্ঠে
মুক্তাবলী কণ্ঠগতেব ভূমেঃ ॥
রবীন্দ্রনাথের ছন্দ পুস্তকে দ্বিজেন্দ্রনাথ-রচিত একটি মন্দাক্রান্তার নমুনা আছে–
ইচ্ছা সম্যক ভ্রমণগমনে কিন্তু পাথেয় নাস্তি,
পায়ে শিকলী মন উড়ু উড় এ কি দৈবেরি শাস্তি।
সংস্কৃত মাত্রাচ্ছন্দের রীতিতে বাংলায় অনেক গান রচিত হয়েছে, যেমন দেশ দেশ নন্দিত করি, জনগণমন অধিনায়ক। এইসব গানে স্বতেদীর্ঘ স্বর থাকলেও তার ফল ভালই হয়েছে, কারণ গানের তালের সঙ্গে দীর্ঘস্বরের । টান সহজেই খাপ খায়।
বাংলা মাত্রাবৃত্তের নিয়মে, অর্থাৎ শুধু পরতোদীর্ঘ স্বর অবলম্বন করে কেউ কেউ সংস্কৃত অক্ষরচ্ছন্দের অনুকরণ করেছেন। কিন্তু স্বতেদীর্ঘ স্বরের জন্য সংস্কৃতে যে লালিত্য হয় অনুকরণে তা পাওয়া যায় না। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত রচিত বাংলা মাত্রাবৃত্তে মালিনী ছন্দের নমুনা–
উড়ে চলে গেছে বুলবুল, শূন্যময় স্বর্ণপিঞ্জর,
ফুরায়ে এসেছে ফাগুন, যৌবনের জীর্ণ নির্ভর।
প্রতি চরণে ১৫ অক্ষর, ২২ মাত্রা, অক্ষরবিন্যাস সংস্কৃত অক্ষরচ্ছন্দের রীতিতে, শুধু স্বলতাগুরু অক্ষর নেই। অনুরূপ সংস্কৃত–
শশিনমুপগতেয়ং কৌমুদী মেঘমুক্তং
জলনিধিমনুরূপং জন্ধু কন্যাবতীর্ণা।
সংস্কৃত মাত্রাচ্ছন্দে অক্ষরবিন্যাসের বাঁধাবাঁধি নেই, সেজন্য বাংলায় অনুরূপ রচনা আড়ষ্ট না করেও সংস্কৃত ছন্দের সঙ্গে অল্পাধিক সাদৃশ্য রাখা যেতে পারে। যথা রবীন্দ্রনাথের–
পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ এ কী সন্ন্যাসী,
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে।
দুই চরণে যথাক্রমে ২০, ১৪ মাত্রা (চরণের অন্ত্যস্বর দীর্ঘ)। অনুরূপ গীতগোবিন্দে–
বদসি যদি কিঞ্চিদপি দন্তরুচিকৌমুদী
হরতি দরতিমিরমতিঘোর।
ছন্দ পুস্তকে সংস্কৃত শিখরিণী অক্ষরচ্ছন্দের রবীন্দ্রনাথ-কৃত বাংলা রূপান্তরের একটি নমুনা আছে। এতে শুধু মাত্ৰাসংখ্যা ঠিক রাখা হয়েছে–
কেবলি অহরহ মনে মনে।
নীরবে তোমা সনে যা খুশি কহি কত;
সংস্কৃত নমুনা–
চলাপাঙ্গাং দৃষ্টিং/স্পৃশসি বহুশো বেপথুমতী
প্রতি ভাগে যথাক্রমে ১১, ১৪ মাত্রা। পরিশেষে বাংলা মাত্রাবৃত্ত-মন্দাক্রান্তার একটি উদ্ভট নমুনা দিচ্ছি–
মন্দ্রাক্রান্তায় রচিল কালিদাস কাব্য মেঘদূত চমৎকার,
বাংলায় তদ্রূপ বিভেদ নেই বলেই শক্ত একটু
যুক্তাক্ষর তাই যত পার চালাও আর দেদার দাও হসন্ত,
ঠিক ঠিক জায়গায় বসালে পাবে এই তকে কিঞ্চিৎ দুধের স্বাদ।
বাংলা বানানের নিয়ম
বাংলা বানানের রীতি নির্দিষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করেন। তদনুসারে নভেম্বর ১৯৩৫এ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বানান সংস্কার সমিতি গঠিত হয়। এতে ছিলেন–রাজশেখর বসু (সভাপতি), প্রমথনাথ চৌধুরী, মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী, রায়বাহাদুর খগেন্দ্রনাথ মিত্র, অধ্যাপক বিজয়চন্দ্র মজুমদার, দ্বারকানাথ মুখোপাধ্যায়, দুর্গামোহন ভট্টাচার্য, চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিজনবিহারী ভট্টাচার্য, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ, সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার ও চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য (সম্পাদক)।
সমিতি নির্ধারিত বানানের নিয়মাবলী সমর্থনে রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র নিম্নোক্ত মত প্রকাশ করেন।—
বাংলা বানান সম্বন্ধে যে নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট করিয়া দিলেন আমি তাহা পালন করিতে সম্মত আছি। —
১লা আশ্বিন ১৩৪৩
১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬
.
বানান যথাসম্ভব সরল ও উচ্চারণসূচক হওয়া বাঞ্ছনীয়, কিন্তু উচ্চারণ বুঝাইবার জন্য অক্ষর বা চিহ্নের বাহুল্য এবং প্রচলিত রীতির অত্যধিক পরিবর্তন উচিত নয়। অতিরিক্ত অক্ষর বা চিহ্ন চালাইলে লাভ যত হইবে তাহার অপেক্ষা লেখক, পাঠক ও মুদ্রাকরের অসুবিধা অধিক হইবে। ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক গ্রন্থে বা শব্দকোষে উচ্চারণ-নির্দেশের জন্য বহু চিহ্নের প্রয়োগ অপরিহার্য, কিন্তু সাধারণ লেখায় তাহা ভারস্বরূপ। প্রচলিত শব্দের উচ্চারণ লোকে অর্থ হইতেই বুঝিয়া লয়। আমাদের ভাষায় বহু শব্দের বানানে ও উচ্চারণে মিল নাই, যথা-গণ, বন, ঘন, জলখাবার, জলযোগ, আষাঢ়, গাঢ়; সহিত, গলিত, অশ্বতর, হ্রস্বতর, একদা, একটা; অচেনা, দেখা। এইপ্রকার শব্দের বানান-সংস্কার করিতে কেহই চান না, প্রদেশভেদে উচ্চারণের কিঞ্চিৎ ভেদ হইলেও ক্ষতি হয় না। সুপ্রচলিত শব্দের বানান সংস্কার যদি করিতে হয় তবে, বানানের জটিলতা না বাড়াইয়া সরলতা সম্পাদনের চেষ্টাই কর্তব্য।
নবাগত বা অল্পপরিচিত বিদেশী শব্দ-সম্বন্ধে বিশেষ বিচার আবশ্যক। এইপ্রকার শব্দের বাংলা বানান এখনও সর্বজনগৃহীতরূপে নির্ধারিত হয় নাই, অতএব সাধারণের যথেচ্ছতার উপর নির্ভর না করিয়া বানানের সরল নিয়ম গঠন করা কর্তব্য।
অসংখ্য সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হইয়া আছে। এবং প্রয়োজনমত এইরূপ আরও শব্দ গৃহীত হইতে পারে। এই সকল শব্দের বানান সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধানাদির শাসনে সুনির্দিষ্ট হইয়াছে, সেজন্য তাহাতে হস্তক্ষেপ অবিধেয়।
সমস্ত বাংলা শব্দের বানান এককালে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভবপর নয়। নিয়ন্ত্রণ ক্রমে ক্রমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। এই প্রবন্ধে বানানের কয়েকটি মাত্র নিয়ম দেওয়া হইয়াছে। নিয়মগুলি। সাধারণভাবে প্রযোজ্য, কিন্তু শব্দবিশেষে ব্যতিক্রম হইবে। কেবল নিয়ম রচনা দ্বারা সমস্ত বাংলা শব্দের বানান নির্দেশ অসম্ভব। নির্ধারিত বানান অনুসারে একটি শব্দতালিকা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে প্রকাশের ব্যবস্থা হইতেছে।
বলা বাহুল্য, পদ্যরচনায় সকল ক্ষেত্রে নিয়ম অনুসারে বানান করা সম্ভবপর নয়।
বানানের নিয়ম যাহাতে বর্তমান বাংলা ভাষার প্রকৃতির অনুকূল হয় সেই চেষ্টা করা হইয়াছে। বিশিষ্ট লেখকগণ অধিকাংশ শব্দ যে রীতিতে বানান করেন তদনুসারে ই ঈ উ ঊ জ ও-কার ং ও শ ষ স প্রভৃতি প্রয়োগের সাধারণ নিয়ম গঠিত হইয়াছে। কতকগুলি শব্দের প্রচলিত বানানে ব্যতিক্রম দেখা যায়। সামঞ্জস্যের জন্য এইগুলিকেও যথাসম্ভব সাধারণ নিয়মের অনুযায়ী করা হইয়াছে। পূর্বে কেবল খুসী, সয়তান, সহর, পালিস, ক্লাশ প্রভৃতি বানান দেখা যাইত, কিন্তু আজকাল অনেকে মূল শব্দ-সম্বন্ধে অবহিত হইয়া খুশী, শয়তান, শহর, পালিশ, ক্লাস লিখিতেছেন। এই রীতিতে সহজেই নিশা, শরবৎ, শরম, শেমিজ, জিনিস, শার্সি প্রভৃতি নিয়মানুযায়ী বানান প্রচলিত হইতে পারিবে। অবশ্য কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম না করিলে চলিবে না, কিন্তু ব্যতিক্রম যত কম হয় ততই ভাল। বিকল্প বাঞ্ছনীয় নয়, তথাপি যেখানে দুই প্রকার বানানের পক্ষেই প্রবল অভিমত পাওয়া গিয়াছে সেখানে বিকল্পের বিধান করিতে হইয়াছে। পূর্বে সস্ক্রান্তি, সঙ্খ্যা প্রভৃতি বানান দেখা যাইত, কিন্তু এখন কেবল সংক্রান্তি, সংখ্যা চলিতেছে। এই রীতিতে ভয়ঙ্কর, সঙ্গম প্রভৃতি স্থানে ভয়ংকর, সংগম লিখিলে বানান সহজ হইবে। কালক্রমে সরলতর বানানই চলিবে এই আশায় এই প্রকার শব্দে বিকল্পের বিধান দেওয়া হইয়াছে। এই প্রকার শব্দের সংখ্যা অধিক নয়, সেজন্য যদি কিছুকাল দুই প্রকার বানানই চলে (যেমন এখন অহংকার চলিতেছে) তবে ক্ষতি হইবে না।
বাংলার কয়েকটি বর্ণে রেফের পর দ্বিত্ব প্রচলিত আছে, সকল বর্ণে নাই, যথা–কৰ্ম্ম, সৰ্ব্ব, কিন্তু কর্ণ, সর্গ। হিন্দী মারাঠী প্রভৃতি ভাষায় দ্বিত্ব হয় না। এই অনাবশ্যক দ্বিত্ব বর্জন করিলে বাংলায় প্রচলিত অসংখ্য শব্দের বানান অপেক্ষাকৃত সরল হইবে। যে দুই শত বিশিষ্ট লেখক ও অধ্যাপক বানান-বিষয়ক প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়াছেন, তাহাদের দুই জন ব্যতীত সকলেই দ্বিত্ববর্জনের পক্ষে। কয়েকজন প্রবীণ লেখক বহুকাল হইতে তাহাদের লেখায় দ্বিত্ব পরিহার করিয়াছেন। আজকাল বঙ্গদেশে প্রকাশিত অনেক সংস্কৃত পুস্তকে দ্বিত্ব বর্জিত হইয়াছে।
তদ্ভব শব্দে অনেকে মূল অনুসারে ণ প্রয়োগ করেন, যথা-কাণ, সোণা। কিন্তু সকল শব্দে এই রীতি অনুসৃত হয় না, যথা–বামুন, গিন্নী। বাংলা ক্রিয়াপদেও ণত্ব হয় না, যথা–শোনা, করেন, করুন। বহু বিশিষ্ট লেখক কান, সোনা প্রভৃতি লিখিয়া থাকেন এবং এই রীতি ক্রমে ক্রমে বিশেষ প্রচলিত হইতেছে। কোরাণ, গভর্ণর প্রভৃতিতে ণত্ব করিবার কোনও হেতু নাই। যাঁহারা বানান-বিষয়ক প্রশ্নপত্রের উত্তর দিয়াছেন তাহাদের অধিকাংশ ণ বর্জনের পক্ষে। অ-সংস্কৃত শব্দে ণ বর্জন করিলে বানান সরল হইবে। রাণী বানান অনেকেই রাখিতে চান, এজন্য এই শব্দে বিকল্প বিহিত হইয়াছে।
সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ
১। রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব
রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা–অর্চনা, মূৰ্ছা, অর্জুন, কর্তা, কার্তিক, বার্তা, কর্দম, অধ, বার্ধক্য, কর্ম, কার্য, সর্ব।
সংস্কৃত ব্যাকরণ-অনুসারে রেফের পর দ্বিত্ব বিকল্পে সিদ্ধ; না করিলে দোষ হয় না, বরং লেখা ও ছাপা সহজ হয়।
২। সন্ধিতে স্থানে অনুস্বার
যদি ক খ গ ঘ পরে থাকে তবে পদের অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার অথবা বিকল্পে ঙ বিধেয়, যথা–অহংকার, ভয়ংকর, শুভংকর, সংখ্যা, সংগম, হৃদয়ংগম, সংঘটন অথবা অহঙ্কার, ভয়ঙ্কর ইত্যাদি।
সংস্কৃত ব্যাকরণের নিয়ম-অনুসারে বর্গীয় বর্ণ পরে থাকিলে পদের . অন্তস্থিত ম্ স্থানে অনুস্বার বা পরবর্তী বর্গের পঞ্চম বর্ণ হয়, যথা–সংজাত, স্বয়ংভু অথবা সঞ্জাত, স্বয়ম্ভ। বাংলায় সর্বত্র এই নিয়ম অনুসারেং দিলে উচ্চারণে বাধিতে পারে, কিন্তু কবর্গের পূর্বে অনুস্বার ব্যবহার করিলে বাধিবে না, বরং বানান সহজ হইবে।
অ-সংস্কৃত অর্থাৎ তম্ভব দেশজ ও বিদেশী শব্দ
৩। রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব
রেফের পর ব্যঞ্জনবর্ণের দ্বিত্ব হইবে না, যথা–কর্জ, শর্ত, সর্দার, চর্বি, ফর্মা, জার্মনি।
৪। হসচিহ্ন
শব্দের শেষে সাধারণত হচিহ্ন দেওয়া হইবে না, যথা–ওস্তাদ, কংগ্রেস, চেক, জজ, টন, টি-পট, ট্রাম, ডিশ, তছনছ, পকেট, মক্তব, হুক, করিলেন, করিস। কিন্তু যদি ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকে তবে হচিহ্ন বিধেয়। হ ও যুক্ত ব্যঞ্জনের উচ্চারণ সাধারণত স্বরান্ত, যথা–দহ, অহরহ, কাণ্ড, গঞ্জ। যদি হসন্ত উচ্চারণ অভীষ্ট হয় তবে হ ও যুক্ত ব্যঞ্জনের পর হস্-চিহ্ন আবশ্যক, যথা–শাহ্, তখ, জেমস্, বন্ড। কিন্তু সুপ্রচলিত শব্দে না দিলে চলিবে, যথা–আর্ট, কর্ক, গভর্নমেন্ট, স্পঞ্জ। মধ্য বর্ণে প্রয়োজন হইলে হচিহ্ন বিধেয়, যথা–উঁকি, সকা। যদি উপান্ত্য স্বর অত্যন্ত হ্রস্ব হয়, তবে শেষে হচিহ্ন বিধেয়, যথা–কক, খ, সার।
বাংলার কতকগুলি শব্দের শেষে অ-কার উচ্চারিত হয়, যথা–গলিত, ঘন, দৃঢ়, প্রিয়, করিয়াছ, করিত, ছিল, এস। কিন্তু অধিকাংশ শব্দের শেষের অ-কার গ্রস্ত অর্থাৎ শেষ অক্ষর হসন্তবৎ, যথা–অচল, গভীর, পাঠ, করুক, করিস, করিলেন। এই প্রকার সুপরিচিত শব্দের শেষে অ-ধ্বনি হইবে কি হইবে না তাহা বুঝাইবার জন্য কেহই চিহ্ন প্রয়োগ করেন না। অধিকাংশ স্থলে অ-সংস্কৃত শব্দে অন্ত্য হচিহ্ন অনাবশ্যক, বাংলাভাষার প্রকৃতি অনুসারেই হসন্ত উচ্চারণ হইবে। অল্প কয়েকটি বিদেশী শব্দের শেষে অ উচ্চারণ হয়, যথা–বাই-ল। কিন্তু প্রভেদ রক্ষার জন্য অপর বহু বহু শব্দে হচিহ্নের ভার চাপান অনাবশ্যক। কেবল ভুল উচ্চারণের সম্ভাবনা থাকিলে হসচিহ্ন বিধেয়।
৫৷ ই ঈ উ উ
যদি মূল সংস্কৃত শব্দে ঈ বা ঊ থাকে তবে তদ্ভব বা তৎসদৃশ শব্দে ঈ বা ঊ অথবা বিকল্পে ই বা উ হইবে, যথা–কুমীর, পাখী, বাড়ী, শীষ, উনিশ, চুন, পূব অথবা কুমির, পাখি, বাড়ি, শিষ, উনিশ, চুন, পুব। কিন্তু কতকগুলি শব্দে কেবল ঈ, কেবল ই অথবা কেবল উ হইবে, যথা-নীলা (নীলক), হীরা (হীরক), দিয়াশলাই (দীপশলাকা), খিল (কীল), পানি (পানীয়); চুল (চুল), তাড় (তর্দু), জুয়া (দ্যুত)।
স্ত্রীলিঙ্গ এবং জাতি, ব্যক্তি, ভাষা ও বিশেষণ বাচক শব্দের অন্তে ঈ হইবে, যথা–কলুনী, বাঘিনী, কাবুলী, কেরানী, ঢাকী, ফরিয়াদী, ইংরেজী, বিলাতী, দাগী, রেশমী। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ই হইবে, যথা–ঝি, দিদি, বিবি; কচি, মিহি, মাঝারি, চতি। পিসী, মাসী স্থানে বিকল্পে পিসি, মাসি লেখা চলিবে।
অন্যত্র মনুষ্যেতর জীব, বস্তু, গুণ, ভাব ও কর্মবাচক শব্দের এবং দ্বিরাবৃত্ত শব্দের অন্তে কেবল ই হইবে, যথা–বেঙাচি, বেঁজি, কাঠি, সুজি, কেরামতি, চুরি, পাগলামি, বাবুগিরি, তাড়াতাড়ি, সরাসরি, সোজাসুজি।
নবাগত বিদেশী শব্দে ঈ উ প্রয়োগ সম্বন্ধে পরে দ্রষ্টব্য।
৬। জ য
এই সকল শব্দে য না লিখিয়া জ লেখা বিধেয়–কাজ, জাউ, জাঁতা, জাঁতি, জুই, জুত, জো, জোড়, জোড়া, জোত, জোয়াল।
৭। ণ ন
অ-সংস্কৃত শব্দে কেবল ন হইবে, যথা–কান, সোনা, বামুন, কোরান, করোনার। কিন্তু যুক্তাক্ষর ন্ট, ণ্ঠ, ণ্ড, ণ্ট চলিবে, যথা–ঘুণ্টি, লণ্ঠন, ঠাণ্ডা।
রানী স্থানে বিকল্পে রাণী চলিতে পারিবে।
৮। ও-কার ও ঊর্ধ্ব-কমা প্রভৃতি
সুপ্রচলিত শব্দের উচ্চারণ, উৎপত্তি বা অর্থের ভেদ বুঝাইবার জন্য অতিরিক্ত ও-কার, ঊর্ধ্ব-কমা বা অন্য চিহ্ন যোগ যথাসম্ভব বর্জনীয়। যদি অর্থগ্রহণে বাধা হয় তবে কয়েকটি শব্দে অন্ত্য অক্ষরে ও-কার এবং আদ্য বা মধ্য অক্ষরে ঊর্ধ্ব-কমা বিকল্পে দেওয়া যাইতে পারে, যথা–কাল, কালো; ভাল, ভালো; মত, মতো; পড়ো প’ড়ো (পড়ুয়া বা পতিত)।
এই সকল বানান বিধেয়–এত, কত, যত, তত; তো, হয়তো; কাল (সময়, কল্য), চাল (চাউল, ছাত, গতি), ডাল (দাইল, শাখা)।
৯। ং ঙ
বাঙ্গলা, বাঙ্গালা, বাঙ্গালী, ভাঙ্গন প্রভৃতি এবং বাংলা, বাঙলা, বাঙালী, ভাঙন প্রভৃতি উভয়প্রকার বানানই চলিবে। হসন্ত ধ্বনি হইলে বিকল্পে ং বা ঙ বিধেয়, যথা–রং, রঙ; সং, সঙ; বাংলা, বাঙলা। স্বরাশ্রিত হইলে ঙ বিধেয়, যথা–রঙের, বাঙালী, ভাঙন।
ং ও ঙ-এর প্রাচীন উচ্চারণ যাহাই হউক, আধুনিক বাংলা উচ্চারণ সমান, সেজন্য অনুস্বার স্থানে বিকল্প ঙ লিখিলে আপত্তির কারণ নাই।রং-এর অপেক্ষা রঙের লেখা সহজ। রঙ্গের লিখিলে অভীষ্ট উচ্চারণ আসিবে না, কারণ রঙ্গ ও রং-এর উচ্চারণ সমান নয়, কিন্তু রং ও রঙ সমান।
১০। শ ষ স
মূল সংস্কৃত শব্দ-অনুসারে তদ্ভব শব্দে শ, ষ বা স হইবে, যথা–আঁশ (অংশু), আঁষ (আমিষ), শাঁস (শস্য), মশা (মশক), পিসী (পিতৃঃস্বসা)। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম হইবে, যথা–মিসে (মনুষ্য), সাধ (শ্রদ্ধা)।
বিদেশী শব্দে মূল উচ্চারণ-অনুসারে s স্থানে স, sh স্থানে শ হইবে, যথা–আসল, ক্লাস, খাস, জিনিস, পুলিস, পেনসিল, মসলা, মাসুল, সবুজ, সাদা, সিমেন্ট, খুশি, চশমা, তক্তাপোশ, পশম, পোশাক, পালিশ, পেনশন, শখ, শৌখিন, শয়তান, শরবৎ, শরম, শহর, শার্ট, শেম্পিয়র। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম হইবে, যথা–ইস্তাহার (ইশতিহার), গোমস্তা (গুমান্তাহ), ভিস্তি (বিহিস্তী), খ্রীষ্ট (christ)।
শ ষ স এই তিন বর্ণের একটি বা দুইটি বর্জন করিলে বাংলা উচ্চারণে বাধা হয় না, বরং বানান সরল হয়। কিন্তু অধিকাংশ তদ্ভব শব্দে মূল অনুসারে শ ষ স প্রয়োগ বহুপ্রচলিত এবং একই শব্দের বিভিন্ন বানান প্রায় দেখা যায় না। এই রীতির সহসা পরিবর্তন বাঞ্ছনীয় নয়। বহু বিদেশী শব্দের প্রচলিত বাংলা বানানে মূল-অনুসারে শ বা স লেখা হয়, কিন্তু কতকগুলি শব্দে ব্যতিক্রম বা বিভিন্ন বানান দেখা যায়, যথা-সরবৎ, শরবৎ; শরম, সরম; শহর, সহর; শয়তান, সয়তান; পুলিস, পুলিশ। সামঞ্জস্যের জন্য যথাসম্ভব একই নিয়ম গ্রহণীয়।
বিদেশী শব্দের s-ধ্বনির জন্য বাংলায় ছ অক্ষর বর্জনীয়। কিন্তু যেখানে প্রচলিত বাংলা বানানে ছ আছে এবং উচ্চারণেও ছ হয়, সেখানে প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা-কেচ্ছা, ছয়লাপ, তছনছ, পছন্দ।
দেশজ বা অজ্ঞাতমূল শব্দের প্রচলিত বানান হইবে, যথা–করিস, ফরসা (ফরশা), সরেস (সরেশ), উসখুস (উশখুশ)।
১১। ক্রিয়াপদ
সাধু ও চলিত প্রয়োগে কৃদন্ত রূপে করান, পাঠান প্রভৃতি অথবা বিকল্পে করানো, পাঠানো প্রভৃতি বিধেয়।
চলিত ভাষার ক্রিয়াপদের বিহিত বানানের কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হইল। বিকল্পে ঊর্ধ্ব কমা বর্জন করা যাইতে পারে এবং লাম বিভক্তি স্থানে লুম বা–লেম লেখা যাইতে পারে।
হ-ধাতু– হয়, হন, হও, হস, হই। হচ্ছে। হয়েছে। হক, হন, হও, হ। হল হলাম। হত। হচ্ছিল। হয়েছিল। হব (হবো, হবে। হয়ো, হস। হতে, হয়ে হলে, হবার, হওয়া।
খা-ধাতু– খায়, খান, খাও, খাস, খাই। খাচ্ছে। খেয়েছে। খাক, খান, খাও, খা। খেলে, খেলাম। খেত। খাচ্ছিল। খেয়েছিল। খাব (খাবো), খাবে। খেয়ো, খাস। খেতে, খেয়ে, খেলে, খাবার, খাওয়া।
দি-ধাতু।– দেয়, দেন, দাও, দিস, দিই। দিচ্ছে। দিয়েছে। দিক, দিন, দাও, দে। দিলে, দিলাম। দিত। দিচ্ছিল। দিয়েছিল। দেব (দেববা), দেবে। দিও, দিস। দিতে, দিয়ে, দিলে, দেবার, দেওয়া।
শু-ধাতু– শোয়, শোন, শোও, শুস, শুই, শুচ্ছে। শুয়েছে। শুক, শুন, শোও, শশা। শুল, শুলাম। শুত। শুচ্ছিল। শুয়েছিল। শোব (শোব), শোবে। শুয়ো, শুস। শুতে, শুয়ে, শুলে, শোবার, শোয়া।
কর-ধাতু– করে, করেন, কর, করিস, করি। করছে। করেছে। করুক, করুন, কর, কর। করলে, করলাম। করত। করছিল। করেছিল? করব (করবো), করবে। করো, করিস। করতে, করে, করলে, করবার, করা।
কাট-ধাতু– কাটে, কাটেন, কাট, কাটিস, কাটি। কাটছে। কেটেছে। কাটুক, কাটুন, কাট, কাটু। কাটলে, কাটলাম। কাটত। কাটছিল। কেটেছিল। কাটব (কাটবো), কাটবে। কেটো, কাটিস। কাটতে, কেটে, কাটলে, কাটবার, কাটা।
লিখ-ধাতু– লেখে, লেখেন, লেখ, লিখিস, লিখি। লিখছে। লিখেছে। লিখুক, লিখুন, লেখ, লেখ। লিখলে, লিখলাম। লিখত। লিখছিল। লিখেছিল। লিখব (লিখবো), লিখবে, লিখো, লিখিস। লিখতে, লিখে, লিখলে, লেখবার, লেখা।
উঠ ধাতু– ওঠে, ওঠেন, ওঠ, উঠিস, উঠি। উঠছে। উঠেছে। উঠুক, উঠুন, ওঠ, ওঠ। উঠল, উঠলাম। উঠত। উঠছিল। উঠেছিল। উঠব (উঠবো), উঠবে। উঠো, উঠিস। উঠতে, উঠে, উঠলে, ওঠবার, ওঠা।
করা-ধাতু– করায়, করান, করাও, করাস, করাই। করাচ্ছে। করিয়েছে। করাক, করান, করাও, করা। করালে, করালাম। করাত। করাচ্ছিল। করিয়েছিল। করাব (করাবো), করাবে। করিও, করাস। করাতে, করিয়ে, করালে, করাবার, করান (করানো)।
১২। কতকগুলি সাধু শব্দের চলিত রূপ
কুয়া, সুতা, মিছা, উঠান, উনান, পুরান, পিছন, পিতল, ভিতর, উপর প্রভৃতি কতকগুলি সাধুশব্দের মৌখিকরূপ কলিকাতা অঞ্চলে অন্যপ্রকার। যে শব্দের মৌখিক বিকৃতি আদ্য অক্ষরে তাহার সাধুর রূপই চলিত ভাষায় গ্রহণীয়, যথা–পিছন, পিতল, ভিতর, উপর। যাহার বিকৃতি মধ্য বা শেষ অক্ষরে তাহার চলিত রূপ মৌখিক রূপের অনুযায়ী করা বিধেয়, যথা–কুয়ো, সুতো, মিছে, উঠন, উনন, পুরনো।
নবাগত ইংরাজী ও অন্যান্য বিদেশী শব্দ
Cut-এর u, cat-এর a, f, v, w, z প্রভৃতির প্রতিবর্ণ বাংলায় নাই। অল্প কয়েকটি নূতন অক্ষর বা চিহ্ন বাংলা লিপিতে প্রবর্তিত করিলে মোটামুটি কাজ চলিতে পারে। বিদেশী শব্দের বাংলা বানান যথাসম্ভব উচ্চারণসূচক হওয়া উচিত, কিন্তু নূতন অক্ষর বা চিহ্নের বাহুল্য বর্জনীয়। এক ভাষার উচ্চারণ অন্য ভাষার লিপিতে যথাযথ প্রকাশ করা অসম্ভব। নবাগত বিদেশী শব্দের শুদ্ধিরক্ষার জন্য অধিক আয়াসের প্রয়োজন নাই, কাছাকাছি বাংলা রূপ হইলেই লেখার কাজ চলিবে। যে সকল বিদেশী শব্দের বিকৃত উচ্চারণ ও তদনুযায়ী বানান বাংলায় চলিয়া গিয়াছে, সে সকল শব্দের প্রচলিত বানানই বজায় থাকিবে, যথা–কলেজ, টেবিল, বাইসিকেল, সেকেন্ড।
১৩। বিবৃত অ (cut-এর u)
মূল শব্দে যদি বিবৃত অ থাকে, তবে বাংলা বানানে আদ্য অক্ষরে আ-কার এবং মধ্য অক্ষরে অ-কার বিধেয়, যথা–ক্লাব (club), বাস (bus), বাল্ব (bulb), সার (sir), থার্ড (third), বাজেট (budget), জার্মন (German), কাটলেট (cutlet), সার্কস (circus), ফোকস (focus), রেডিয়ম (radium), ফসফরস (Phosphorus), হিরোডোটস (Herodotus)।
১৪। বক্র আ (বা বিকৃত এ। cat-এর a)
মূল শব্দে বক্র আ থাকিলে বাংলায় আদিতে অ্যা এবং মধ্যে া বিধেয়, যথা–অ্যাসিড (acid), হ্যাট (hat)।
এইরূপ বানানো ‘্যা’কে য-ফলা+আ-কার মনে না করিয়া একটি বিশেষ স্বরবর্ণের চিহ্ন জ্ঞান করা যাইতে পারে, যেমন হিন্দীতে এই উদ্দেশ্যে ঐ-কার চলিতেছে hat = ।ৈ নাগরী লিপিতে যেমন অ-অক্ষরে ও-কার যোগ করিয়া ও সী হয়, সেরূপ বাংলায় অ্যা হইতে পারে।
১৫। ঈ উ
মূল শব্দের উচ্চারণে যদি ঈ ঊ থাকে, তবে বাংলা বানানে ঈ ঊ বিধেয়, যথা–সীল (seal), ঈস্ট (east), উস্টার (worcester), শূল (spool)।
১৬। f v
f ও v স্থানে যথাক্রমে ফ ভ বিধেয়, যথা–ফুট (foot), ভোট (vote)। যদি মূল শব্দে v-এর উচ্চারণ তুল্য হয়, তবে বাংলা বানানে ফ হইবে, যথা–ফন (Von)।
১৭। w
w স্থানে প্রচলিত রীতি অনুসারে উ বা ও বিধেয়, যথা–উইলসন (wilson), উড (wood), ওয়ে (way)।
১৮। য়
নবাগত বিদেশী শব্দে অনর্থক য় প্রয়োগ বর্জনীয়। মেয়র, চেয়ার, রেডিয়ম, সোয়েটার প্রভৃতি বানান চলিতে পারে, কারণ য় লিখিলেও উচ্চারণ বিকৃত হয় না। কিন্তু উ-কার বা ও-কারের পর অকারণে য়, য়া, গো লেখা অনুচিত। এডোয়ার্ড, ওয়ারবন্ড না লিখিয়া এড়ওয়ার্ড, ওঅর-বন্ড লেখা উচিত। হার্ডওয়ার (hardware) বানানে দোষ নাই।
১৯। s, sh
১০ সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য।
২০। st
নবাগত বিদেশী শব্দে st স্থানে নূতন সংযুক্ত বর্ণ স্ট বিধেয়, যথা স্টোভ (stove)।
২১। z
z স্থানে জ বা জ বিধেয়।
২২। হসচিহ্ন।
৪ সংখ্যক নিয়ম দ্রষ্টব্য।
বাংলা ভাষার আধুনিক রূপ
২৪।১২।১৯৪০
শ্ৰীযুক্ত সুস্থিরকুমার বসু
সাধারণ সম্পাদক, প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন
জামসেদপুর
সবিনয় নিবেদন,
আপনি জানতে চেয়েছেন বাঙ্গালা ভাষার আধুনিক রূপ ও তাহা সর্বজনমান্য করিবার উপায় সম্বন্ধে আমার অভিমত কি। অনুমান করি আমার উত্তর আগামী সম্মেলনে পড়া হবে। সময় অল্প, সেজন্য সংক্ষেপে লিখছি। বহুদিন পূর্বে সাধু ও চলিত ভাষা নামে এক প্রবন্ধ লিখেছিলাম, তা থেকে কিছু কিছু নিয়েছি।
সভায় আলোচ্য বিষয়–বাংলা ভাষার আধুনিক রূপ। তার মানে এই বুঝেছি লিখিত বা সাহিত্যিক বাংলা ভাষার চেহারা কিরকম হলে আধুনিক প্রয়োজনের উপযোগী হবে। অর্থাৎ সাহিত্যের বাহনই আলোচ্য, বাহিত বিষয় অপ্রাসঙ্গিক।
ভাষার রূপের তিন অঙ্গ-(১) লিপি বা বর্ণমালার আকৃতি, (২) শব্দাবলীর প্রকার বা form, এবং (৩) বানান। প্রথম অঙ্গটির আলোচনা করব না, কারণ তার এখনও তেমন তাগিদ নেই।
শব্দাবলীর প্রকার নিয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে, এখনও তা থামে নি। সাধুভাষা ভাল না চলিতভাষা ভাল? তার ভঙ্গী কিরকম হওয়া উচিত– বঙ্কিমীয়, প্রাচীন রবীন্দ্রীয়, আধুনিক রবীন্দ্রীয়, না অত্যাধুনিক তরুণ বিক্ৰীড়িত?
যদি সংজ্ঞার্থ (definitions) ঠিক না থাকে তবে বিতর্কে বৃথা বাক্য ব্যয় হয়, সেজন্য প্রথমেই মৌখিক, লৈখিক, সাধু আর চলিত এই কটি সংজ্ঞার অর্থ বিশদ হওয়া দরকার। আমার একটা অযত্নলব্ধ মৌখিক ভাষা আছে, তা রাঢ়ের বা পূর্ববঙ্গের বা অন্য অঞ্চলের। যদি কথাবার্তায় প্রাদেশিকতা বর্জন করতে চাই তবে এই ভাষাকে অল্পাধিক বদলে কলকাতার মৌখিক ভাষার অনুরূপ করে নিতে পারি, না পারলেও বিশেষ অসুবিধা হয় না। কিন্তু আমার মুখের ভাষা যেমনই হক, আমাকে একটা লৈখিক বা লেখাপড়ার ভাষা শিখতেই হবে–যা সর্বসম্মত, যার দ্বারা বাঙালীর সঙ্গে আমার সাহিত্য বা সহযোগ হয়, অর্থাৎ যা সাহিত্যের উপযুক্ত।
মুখের ভাষা যে অঞ্চলেরই হক, মুখের ধ্বনিমাত্র, তা শুনে বুঝতে হয়। লৈখিক ভাষা দেখে অর্থাৎ পড়ে বুঝতে হয়। মৌখিক ভাষার উচ্চারণই সর্বস্ব। লৈখিক ভাষার চেহারাটাই আসল, উচ্চারণ সকলে একরকম না করলেও ক্ষতি নেই, মানে বুঝতে পারলেই যথেষ্ট। লৈখিক ভাষা সবর্সধারণের সাহিত্যের ভাষা, সেজন্য বানানে মিল থাকা দরকার, উচ্চারণ যাই হক।
আজকাল বাংলা সাহিত্যে যে ভাষা চলছে তার দুই ধারা–সাধু ও চলিত। প্রথম ধারা অবশ্য প্রবলতর, কিন্তু তার কিছু পরিবর্তন যে দরকার তা অনেকেরই মনে হয়েছে। পৌষ মাসের প্রবাসী পত্রিকায় সম্পাদক মহাশয়ও এইরূপ মত প্রকাশ করেছেন।
সাধুভাষার মানে সৎলোকের বা সভ্যলোকের ভাষা নয়; চলিত ভাষার মানে প্রচলিত ভাষা নয়। বাংলা ভাষার বিশেষণ হিসাবে সাধু ও চলিত দুটিই রূঢ় শব্দ, দুইভাষাই লৈখিক বা সাহিত্যিক। সাধু ও চলিত ভাষার প্রধান প্রভেদ সর্বনাম ও ক্রিয়াপদের জন্য, যথা–তাহারা বলিলেন, কিংবা তারা বললেন; এবং কতকগুলি অসংস্কৃত ও সংস্কৃতজ শব্দের জন্য, যথা–উঠান, একচেটিয়া, মিছা, সুতা, কিংবা উঠন, একচেটে, মিছে, সুতো। আর যা প্রভেদ দেখা যায়- তা লেখকের ভঙ্গীগত। কেউ বা বেশী সংস্কৃত শব্দ ও সমাস, কেউ বা বেশী আরবী ফারসী শব্দ চালান; কেউ বা পদবিন্যাসে কিঞ্চিৎ নূতনত্বের চেষ্টা করেন। কিন্তু এসকল ভঙ্গী সাধু বা চলিত ভাষার বিশেষ লক্ষণ নয়।
একটা ভ্রান্ত ধারণা অনেকের আছে যে চলিত ভাষা আর পশ্চিম বাংলার মৌখিক ভাষা একই। এর ফলে বিস্তর অনর্থক বিতণ্ডা হয়েছে। সাদৃশ্য এই পর্যন্ত আছে, যে চলিত ভাষার সর্বনাম ক্রিয়াপদাদি উল্লিখিত কতকগুলি শব্দের বানান ভাগীরথীতীরস্থ কয়েকটি জেলার মৌখিক ভাষার শিষ্ট উচ্চারণের সঙ্গে মোটামুটি মেলে। কিন্তু ঐসব জেলাবাসী লেখক যখন চলিত ভাষায় লেখেন তখন তিনি তার মুখের ভাষার যথাযথ অনুসরণ করেন না। তিনি তার বন্ধুকে হয়তো বলেন–গ্যালো রোববারে কোথা গেশলে হ্যাঁ? কিন্তু লেখেন–গেল রবিবারে কোথা গিয়েছিলে হে। লেখবার সময় লোকে যতটা সাবধান হয়, কথাবার্তায় ততটা হতে পারে না।
সাধু বা চলিত যাই হক, সাহিত্যের ভাষা মুখের ভাষার সমান হতে পারে না। তথাপি কোনও এক অঞ্চলের মৌখিক ভাষার ভিত্তিতেই লৈখিক ভাষা গড়ে ওঠে, এবং কালক্রমে একের পরিবর্তনের ফলে অপরের পরিবর্তন আবশ্যক হয়। এই পরিবর্তন বিনা বিতর্কে বিনা পরামর্শে সাধু ভাষায় কিছু কিছু ঘটেছে। রামমোহন রায় লিখতেন তাহারদিগের, তা থেকে ক্রমে তাহাদিগের, তাহাদের হয়েছে। এখন অনেকে সাধুভাষাতেও তাদের লিখছেন। লিখা, শিখা, শুনা, ঘুরা, লতানিয়া, জলুয়া, হয়েন, যায়েন স্থানে এখন সাধুভাষাতেও লেখা, শেখা, শোনা, ঘোরা, লতানে, জলো, হন, যান চলছে। এই পরিবর্তন জীবন্তভাষার লক্ষণ এবং তা সাধারণের অজ্ঞাতসারে হয়েছে। ভাষার গতি বুঝে সজ্ঞানে সবিচারে আরও অগ্রসর হলে ক্ষতি হবে না।
লৈখিক ভাষার অবলম্বন হিসাবে পশ্চিম বাংলার মৌখিক ভাষারই যোগ্যতা বেশী, কারণ, এ ভাষার পীঠস্থান কলকাতা সকল সাহিত্যিকের মিলনক্ষেত্র, রাজধানীও বটে। কিন্তু যদি পশ্চিম বাংলার মৌখিক ভাষার উচ্চারণের উপর অতিমাত্র পক্ষপাত করা হয় তবে প্রগতি না হয়ে বিপ্লব হবে। শত চেষ্টা সত্ত্বেও উচ্চারণ আর বানানের সংগতি সর্বত্র বজায় রাখা সম্ভবপর নয়। ও-কার আর হচিহ্নের বাহুল্যে লেখা কণ্টকিত করায় কিছুমাত্র লাভ নেই, অর্থবোধ থেকেই উচ্চারণ আসে। লৈখিক বা সাহিত্যের ভাষার রূপ ও পদ্ধতি নিরূপিত ও সহজে অধিগম্য হওয়া আবশ্যক, নতুবা তা সর্বমান্য হয় না, শিক্ষারও বাধা হয়। সুতরাং একটু রফা ও কৃত্রিমতা– অর্থাৎ সকল মৌখিক ভাষা হতে অম্লাধিক প্রভেদ–অপরিহার্য।
সাধু আর চলিত দুরকম ভাষার পৃথক অস্তিত্বের আর প্রয়োজন আছে। মনে হয় না। দুইএর সমন্বয় অসাধ্য নয়। এমন লৈখিক ভাষা চাই যাতে বর্তমান সাধুভাষার আর মার্জিতজনের মৌখিকভাষা দুইএরই সদ্গুণ বজায় থাকে। সংস্কৃত সমাসবদ্ধ পদের দ্বারা যে বার্সংকোচ লাভ হয় তা আমরা চাই, আবার মৌখিক ভাষার সহজ প্রকাশশক্তিও ছাড়তে চাই না। আমার প্রস্তাব সংক্ষেপে নিবেদন করছি।
(১) ক্রিয়াপদ আর সর্বনামের সাধুরূপের বদলে চলিত রূপ গৃহীত হক।
(২) অন্যান্য অসংস্কৃত ও সংস্কৃতজ শব্দের কতকগুলির সাধুরূপ আর কতকগুলির চলিত রূপ গৃহীত হক। যে শব্দের সাধু ও মৌখিক রূপের ভেদ আদ্য অক্ষরে, তার সাধু রূপই বজায় থাকুক, যথা–ওপর, পেছন, পেতল, ভেতর না লিখে উপর, পিছল, পিতল, ভিতর। যার ভেদ মধ্য বা অন্ত্য অক্ষরে, তার মৌখিক রূপই নেওয়া হক, যথা–কুয়া, মিছা, উঠান, একচেটিয়া স্থানে কুয়ো, মিছে, উঠন, একচেটে।
(৩) যে সংস্কৃত শব্দ বর্তমান চলিতভাষায় অচল নয়, অর্থাৎ বিখ্যাত লেখকগণ যা চলিতভাষায় লিখতে দ্বিধা করেন না, তা যেন বিকৃত করা না হয়। সত্য, মিথ্যা, নূতন, অবশ্য স্থানে যেন সত্যি, মিথ্যে, নোতুন, অবিশ্যি লেখা না হয়।
(৪) বর্তমান সাধুভাষার কাঠামো বা অন্বয়পদ্ধতি বা syntax বজায় থাকুক। ইংরেজী ভগীর অন্ধ অনুকরণ অথবা অকারণে বিশেষ্য সর্বনাম ক্রিয়াপদের বিপর্যয় বর্জনীয়।
এ ভাষায় অনুবাদ করলে সংস্কৃত রচনার ওজোগুণ নষ্ট হবে, অথবা এতে দর্শন বিজ্ঞান লেখা যাবে না এমন আশঙ্কা অমূলক। দুরূহ সংস্কৃত শব্দ এবং সমাসের সঙ্গে মৌখিক ক্রিয়াপদ আর সর্বনাম চালালেই গুরুচণ্ডাল দোষ হবে না।
ভাষার তৃতীয় অঙ্গ বানান। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বানানের কতকগুলি নিয়ম সংকলন করে যে পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন তা সকল সাহিত্যসেবীকেই পড়ে দেখতে অনুরোধ করি। রবীন্দ্রনাথের সমর্থন ও তার লিখিত দৃষ্টান্তের প্রভাবে নূতন বানানগুলি ধীরে ধীরে প্রচলিত হচ্ছে। সবিস্তার আলোচনা না করে নূতন বানানের কয়েকটি প্রধান বিধি জানাচ্ছি।
(১) হিন্দী মরাঠী গুজরাটী প্রভৃতি সংস্কৃতজাত ভাষায় রেফাক্রান্ত ব্যঞ্জন বর্ণের দ্বিত্ব হয় না। ব্যাকরণ অনুসারেও দ্বিত্ব আবশ্যক নয়। বাংলাতেও দ্বিত্ব বর্জনীয়। কার্য লিখতে একটা য যথেষ্ট।
(২) কতকগুলি বাংলা শব্দের শেষে অ-কার উচ্চারিত হয়, যেমন–ছিল, বড়, কত; কিন্তু অধিকাংশ শব্দে হয় না, যেমন–ছিলেন, তোমার, কেমন। শেষোক্ত শব্দগুলিতে হস্ চিহ্ন দেওয়া হয় না, যদিও উচ্চারণ হসন্ত। যদি ভুল উচ্চারণের আশঙ্কা না থাকে তবে অসংস্কৃত শব্দে অন্ত্য হস্ চিহ্ন বর্জনীয়। ওস্তাদ, পকেট, হক, ডিশ প্রভৃতি শব্দে হস্ চিহ্নের কোনও দরকার নেই।
(৩) অসংস্কৃত শব্দে ণ থাকবে না, কেবল ন। কান, বামুন, কোরান, করোনার প্রভৃতিতে ন। এই প্রথা নূতন নয়, অনেক খ্যাতনামা লেখক বহুকাল থেকে এইরকম লিখছেন।
(৪) ফারসী আরবী ইংরেজী প্রভৃতি বিদেশী শব্দের মূল উচ্চারণ অনুসারে বাংলা বানানে s স্থানে স এবং sh স্থানে শ হবে। যথা–জিনিস, সরকার, ক্লাস, নোটিস দন্ত্য স; শরম, শুরু, শাগরেদ, পালিশ তালব্য শ। হিন্দী প্রভৃতি ভাষাতেও এই রীতি চলে। অনেক বাঙালী মুসলমানও এইরকম। বানান করেন।
(৫) নবাগত বিদেশী শব্দে অনর্থক য় বর্জনীয়। war ওয়ার নয়, ওআর। কিন্তু wire ওয়ার।
(৬) বক্র আ বা বিকৃত এ বোঝাবার জন্য আদিতে অ্যা এবং মধ্যে বা অন্তে া বিধেয়, যথা–অ্যাসিড, হ্যাট, নিউম্যান।
(৭) পৌষমাসের প্রবাসী পত্রিকায় সম্পাদক মহাশয় চলিত ক্রিয়াপদের খামখেয়ালী বানানের নিরূপণ চেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়কৃত নিয়মে তা আছে; বল্লেন, কছিল নয়, বললেন, করছিল।
কেউ কেউ বলেন–এই নিয়মের কতকগুলি পালন করতে গেলে নানা ভাষায় জ্ঞান দরকার। জিনিস-এর মূল জি, সাগরেদ-এর মূল শার্গি তা কত লোক জানে? আমি বলি, জানবার বিশেষ দরকার নেই। ব্যুৎপত্তি না জেনেও আমরা শিখি যে উজ্জ্বলএ ব-ফলা আছে কিন্তু কজ্জলএ নেই। যারা জানেন এবং যাঁদের উৎসাহ আছে তারা নির্দেশ দেবেন এবং সাধারণে ক্রমে ক্রমে শিখবে।
বিনীত
রাজশেখর বসু
বিদ্যালয়ের বাংলাভাষা
এই নাম দিয়ে শ্রীযুক্ত কৃষ্ণদয়াল বসু একটি প্রবন্ধ সম্প্রতি শিক্ষা ও সাহিত্য পত্রিকায় লিখেছেন। কথাসাহিত্য আষাঢ় সংখ্যায় তার সম্বন্ধে আলোচনা আছে। তারই জের টেনে আমি কিছু বলছি। শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা : আমার মোটেই নেই। কিন্তু বহু কাল আগে যখন স্কুলে পড়তাম তখন বাংলা ভাষা শিক্ষার যে ব্যবস্থা ছিল তার দোষ-গুণ আমার মনে আছে। সেজন্য লেখকের যুক্তি বুঝতে আমার বাধা হয় নি।
কৃষ্ণদয়ালবাবুর এই কালোচিত প্রবন্ধটি শিক্ষাধিকারের কর্তাদের অবশ্যপাঠ্য। যাঁরা বাংলা শিক্ষায় গোড়া থেকে সুব্যবস্থা চান তাদের সকলেরই লেখকের মত ও প্রস্তাবগুলি সযত্নে বিচার করে দেখা উচিত। আলোচনার সুবিধার জন্য মূল প্রবন্ধ থেকে কিছু কিছু তুলে দিচ্ছি–
আমি নিজে বাংলা চলিতভাষার অনুরাগী। কিন্তু বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা চলিতভাষার মোহ ত্যাগ করে তাদের প্রত্যেকটি রচনা সাধুভাষায় লেখা অভ্যাস করুক এই আমি চাই।..ছেলেবেলা থেকেই যেসব ছাত্র চলিতভাষা লিখতে শুরু করে তারা স্বভাবতই তদ্ভব দেশজ ও বিদেশী শব্দ আর বড়জোর গোটাকতক অতিপরিচিত সহজ সরল তৎসম শব্দ দিয়ে কাজ চালিয়ে যায় বলে অধিকাংশ তৎসম শব্দ অপ্রয়োজনে ও অব্যবহারে তাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। এর অনিবার্য পরিণাম…বাংলা সাহিত্যের বহু শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ, বহু ক্লাসিক শ্রেণীর রচনা ছাত্রদের অনধিগম্য ও অপঠিত থেকে যায়।..আমার মতে বিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষে ভাষাশিক্ষার প্রয়োজনটাই মুখ্য, সাহিত্যদীক্ষার প্রয়োজন গৌণ।..বিদ্যালয়ে চলিত ভাষা যদি আদৌ না চালানো হয় তা হলে ছাত্রদের ব্যাকরণ শিক্ষার চাপটা অনেকখানি কমে যায়।…চলিতভাষা এখন কেবল গড়ে উঠছে, তার ব্যাকরণ এখনও সবটা লেখাই হয় নি।…নিম্নতম শ্রেণী থেকে অষ্টম মান পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের গদ্যাংশ সাধুভাষায় লেখা হওয়া চাই–একটি নিবন্ধও চলিত ভাষায় লেখা হলে চলবে না।…নবম ও দশম মানের জন্য একখানি সংকলন-পুস্তক এতকাল যেমন চলে আসছিল তেমনি চলুক।
.
আমার বিশ্বাস, সাধুভাষা ক্রমশ অচল হয়ে আসছে, ভবিষ্যতে কেবল চলিতভাষাতেই বাংলা সাহিত্যের সকল প্রয়োজন মিটবে। এই বিশ্বাস সত্ত্বেও কৃষ্ণদয়ালবাবুর সমস্ত প্রস্তাব আমি গ্রহণীয় মনে করি। সাধুভাষায় সাহিত্য রচনা একদিন বন্ধ হবে। খবরের কাগজও চলিত ভাষায় লেখা হবে, কিন্তু গত দেড় শ বৎসরে সাধুভাষায় যে বিশাল বাংলা সাহিত্য গড়ে উঠেছে তার একটা বড় অংশ চিরায়ত বা ক্লাসিক হয়ে থাকবে। এই কারণে সাধুভাষা প্রত্ন হয়ে গেলেও তার চর্চা লোপ পাবে না।
এখন সাধু আর চলিত দুই রীতিতেই বাংলা ভাষা লেখা হচ্ছে। যদি ভবিষ্যতে চলিতভাষাই একমাত্র সাহিত্যিক ভাষা হয় তবে অষ্টম মান পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে তা বর্জিত হবে কেন? কৃষ্ণদয়ালবাবু তার কারণ দেখিয়েছেন। তার যুক্তির পরিপূরকরূপে কিছু বলছি।
বাংলা সাধুভাষা বহুজনের চেষ্টায় বহু কালে তার সর্বজনীন রূপ পেয়েছে। চট্টগ্রামের নবীনচন্দ্র সেন, ঢাকার কালীপ্রসন্ন ঘোষ, কলকাতার রমেশচন্দ্র দত্ত, মহারাষ্ট্রের সখারাম গণেশ দেউস্কর একই ভাষায় লিখেছেন। বিদ্যাসাগর, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ, অক্ষয়কুমার দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র প্রভৃতি যে রীতির প্রবর্তন করেছেন পরবর্তী লেখকরা তারই অনুসরণ করেছেন। ভঙ্গীর বা স্টাইলের ভেদ থাকলেও তাদের রীতি একই। চলিতভাষার প্রভাবে, নূতনত্বের প্রয়াসে এবং গ্রাম্যতার সংক্রমণে আজকাল সাধুভাষাতেও কিছু বিকার এসেছে, তথাপি চলিতভাষার তুলনায় তা অধিকতর শৃঙ্খলিত। এই শৃঙ্খলা থাকায় সকল জেলার বাঙালীর পক্ষেই সাধুভাষা আয়ত্ত করা সহজ। এ ভাষার ব্যবহার ক্রমশ কমে গেলেও বহুকাল চলবে, সুতরাং বিদ্যালয়ের শিক্ষায় এই ভাষাই প্রশস্ত। আর সঙ্গে যদি চলিত ভাষাও শেখানো হয় তা হলে অল্পবয়স্ক ছাত্ররা দোটানায় পড়বে।
সাধুভাষার তুল্য সুশৃঙ্খল আর সর্বসম্মত হলে চলিতভাষাই বাংলা শিক্ষার একমাত্র বাহন হবে। তখন উচ্চতর শ্রেণীতে সাধুভাষা শেখালেই চলবে। কিন্তু বাংলাভাষার এই পরিবর্তন শীঘ্র হবে এমন সম্ভাবনা দেখি না। চলিতভাষার যতই প্রসার হক, এখনও তা নিয়ন্ত্রিত হয় নি। এই ভাষার যাঁরা প্রধান সংস্থাপক–রবীন্দ্রনাথ ও প্রমথ চৌধুরী, তাঁদেরও শব্দাবলীতে সর্বত্র ঐক্য দেখা যায় না (করলাম, করলেম, করলুম, তাঁদের, তাদেরকে, কাকে, কাউকে ইত্যাদি)।
চলিত ভাষার লক্ষণ সম্বন্ধে অনেকের ধারণা স্পষ্ট নয়। সর্বনাম, ক্রিয়াপদ, এবং কয়েকটি অসংস্কৃত বিশেষ্য বিশেষণ আর অব্যয় ছাড়া সাধুভাষার সঙ্গে তার কোনও প্রভেদ নেই। তৎসম শব্দ বেশী থাকলেই সাধুভাষা, আর তদ্ভব দেশজ বা বিদেশজ শব্দ বেশী থাকলেই চলিতভাষা হয় না। অনেকে মনে করেন, কলকাতা অঞ্চলের মৌখিক ভাষাই চলিতভাষা। এই ধারণা একবারেই ভুল। যেমন সাধুভাষা, তেমনি চলিতভাষাও সাহিত্যিক প্রয়োজনে উদ্ভূত ব্যবহারসিদ্ধ বা conventional লৈখিক ভাষা, ভাগীরথীতটবর্তী স্থানের মৌখিক ভাষার সঙ্গে তার কিছু সাদৃশ্য থাকলেও ঐক্য নেই। খাস কলকাতাবাসীর মুখের বুলি–গ্যালো রোববারে কোথায় ছেলে হ্যাঁ? ভের বেতে বরযাত্তর গেশলে বুঝি? এই কথাই সাহিত্যোচিত চলিতভাষায় লেখা হবে–গেল (বা গত) রবিবারে কোথায় ছিলে হে? ভাইএর বিয়েতে বরযাত্র গিয়েছিলে বুঝি?
অনেক লেখক মনে করেন, তৎসম শব্দ যত বাদ দেওয়া যায় ততই ভাল। ভারতের বিভিন্ন ভাষাগুলির একমাত্র যোগসূত্র সংস্কৃত বা তৎসম শব্দাবলী। বহু অবাঙালী বাংলা সাহিত্য পড়ে থাকেন। তাদের অনেকের কাছে শুনেছি–বাংলা লেখায় সংস্কৃত শব্দ বেশী থাকলে তাদের বোঝবার সুবিধা হয়, বাংলায় বিকৃতরূপে আর বিকৃত অর্থে যে উর্দু বা আরবী-ফারসী শব্দ চলে তাতে তাদের সাহায্য হয় না। তৎসম শব্দ কমালে বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে যে যোগসূত্র আছে তা ছিন্ন হবে, বাংলা ভাষার প্রসার কমে যাবে।
চলিতভাষা একটা স্বতন্ত্র ভাষা নয়, সাধুভাষারই কালক্ৰমিক সংস্করণ। সাধুভাষার পদ্ধতির সঙ্গে অনেক রফা করতে হবে, গ্রাম্যতা একবারে বাদ দিতে হবে, তবেই চলিতভাষা সর্বসম্মত প্রামাণিক সাহিত্যিক ভাষায় পরিণত হবে। অবশ্য সাহিত্যে সকল ভঙ্গীরই স্থান আছে। হুতোম পেঁচার সেকেলে বৈঠকী ভাষা, সম্বুদ্ধ লিখিত কয়েকটি গল্পের বরিশালী ভাষা, সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের সিলেটী-আরবী-ফারসী-জার্মন-ফ্রেঞ্চের বুকনি দেওয়া বিচিত্র আলাপের ভাষা, রূপদর্শীর স্ল্যাং-বহুল আড্ডার ভাষা–সবই উপভোগ্য এবং সাহিত্যে স্থায়িত্ব পাবার যোগ্য। কিন্তু এ ধরণের লঘু ভাষা রসাত্মক হলেও সর্বার্থসাধক নয়, পাঠ্যপুস্তকের যোগ্যও নয়। যাঁরা খ্যাতনামা সাহিত্যিক এবং গম্ভীর চলিত ভাষাতে লিখে থাকেন, তাদের মধ্যেও এমন লেখক বেশী নেই যাঁদের রচনায় সংস্কৃতেতর শব্দাবলীর ঐক্য আছে–যেমন ঐক্য সাধুভাষার অধিকাংশ লেখকদের রচনায় পাওয়া যায়। অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েদের পাঠ্যপুস্তকে সাধুভাষা আর চলিত ভাষা দুইই দিলে তারা দিশেহারা হয়ে একটা খিচুড়ি ভাষায় অভ্যস্ত হবে। রাজনীতি আর চলিত ভাষা দুটোই অপরিহার্য, কিন্তু একটু বেশী বয়সে চর্চা করাই নিরাপদ।
কৃষ্ণদয়ালবাবু নিম্ন শ্রেণীতে ব্যাকরণের চাপ কমাতে বলেছেন। এই প্রস্তাব সমীচীন মনে করি। শিশু যেমন শুনে শুনে মৌখিক ভাষা শেখে, অল্পবয়স্ক ছাত্র তেমনি বই পড়ে সাহিত্যিক বা লৈখিক ভাষা শিখবে। ব্যাকরণ একটি analytical শাস্ত্র, ব্যাকরণ-এর ব্যুৎপত্তিগত অর্থই বিশ্লেষণ। আগে সংঘটন অর্থাৎ বাক্যরচনা, তার পর বিশ্লেষণ বা ব্যাকরণ শেখাই যুক্তিসংগত। ছাত্র যা পড়বে তা থেকেই বানান, শব্দরূপ, ধাতুরূপ, সন্ধিসমাসবদ্ধ পদ, বাক্যরীতি ইত্যাদি শিখবে। প্রাথমিক ব্যাকরণে কৃৎ তদ্ধিত আর সমাস প্রকরণের দরকার দেখি না। ইংরেজী ভাষাতেও নানারকম সমাস আছে (ষষ্ঠীতৎপুরুষ-sunlight, কর্মধারয়-hot bag, বহুব্রীহি–blockhead, অলুক্s on-in-law ইত্যাদি। কিন্তু ইংরেজী প্রাথমিক ব্যাকরণে সমাস-প্রকরণ থাকে না অথবা সংক্ষেপে থাকে। ছাত্র যদি ভবিষ্যতে সাহিত্যিক হয় এবং নূতন নূতন শব্দ আর সমাসবদ্ধ পদ রচনা করতে চায়, তবে তাকে ভাল করে ব্যাকরণ শিখতেই হবে। কিন্তু এই শিক্ষা উচ্চতর শ্রেণীতে হওয়াই ভাল।
[বনফুলকে লিখিত চিঠি। এই সময়ে প্রকাশিত বনফুলের গল্পসংগ্রহ গ্রন্থের ভূমিকারূপে মুদ্রিত।–স:]
ব্রজেন্দ্রনাথের সাধনা
যিনি কৃতকর্মা এবং যাঁর কাছ থেকে আরও অনেক কৃতি লোকে আশা করে, তিনি যদি কর্মে রত থেকেই সহসা মারা যান তবে লোকে বলে, ইন্দ্ৰপাত হল। ব্রজেন্দ্রনাথ খ্যাতনামা দেশনেতা শিল্পপতি বা আচার্য ছিলেন না, বিদ্যাবত্তাসূচক উপাধিও তার ছিল না, দেশের অল্প লোকই তার কাজের খবর রাখত। তথাপি বললে অত্যুক্তি হবে না যে তাঁর মৃত্যুতে ইন্দ্রপাত হয়েছে।
ব্রজেন্দ্রনাথ জীবদ্দশাতেই প্রচুর প্রশংসা পেয়েছেন। কিন্তু তার সাহিত্যকর্মের মান সর্বসম্মতভাবে নির্ধারিত হয়েছে এমন বলা যায় না। সাহিত্য শব্দের প্রাচীন অর্থ আজকাল প্রসারিত হয়েছে, শুধু কাব্য আর কথাগ্রন্থ নয়; দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস রাজনীতি প্রভৃতি বিষয়ক রচনাও সাহিত্য। কিন্তু অনেকে মনে করেন, creative art ভিন্ন প্রকৃত সাহিত্য হয় না। কাব্য গল্প বা সুখপাঠ্য প্রবন্ধ সাহিত্যের শ্রেণীতে পড়ে, কিন্তু প্রাচীন রচনার উদ্ধার বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যা লেখা হয় তা সাহিত্য নয়, সংকলন-জাতীয় কর্ম। এঁদের মতে ব্রজেন্দ্রনাথ সাহিত্যস্রষ্টা নন, সাহিত্যের উদ্ধারক ও সংরক্ষক।
ব্রজেন্দ্রনাথ যা করেছেন তা সৃষ্টিকর্ম কি স্থিতিকর্ম, সাহিত্যিকগণের কোন্ শ্রেণীতে তার স্থান, তার মর্যাদা কবি বা কথাকারের চাইতে বেশী কি কম, ইত্যাদি আলোচনায় লাভ নেই। তিনি যদি শুধু সাহিত্য-পরিষদের কর্ণধার ও উন্নতিসাধক হতেন, অথবা শুধু পত্রিকাসম্পাদক বা পুস্তক প্রকাশক হতেন, তবে বলা চলত যে তিনি ঠিক সাহিত্যিক নন, সাহিত্যসহায়ক মাত্র। কিন্তু ব্রজেন্দ্রনাথ আজীবন গ্রন্থ প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর এই কর্ম কি সাহিত্যরচনা নয়, শুধুই মোহিতলাল-কথিত খনিত্ৰ-কর্ম?
মানুষের স্বাভাবিক জ্ঞানস্পৃহা আছে, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান সম্বন্ধে কৌতূহল আছে, সর্বপ্রকার সৌন্দর্য ও আনন্দ উপভোগের অর্থাৎ প্রেয় ও শ্রেয় লাভের আগ্রহ আছে। এই স্পৃহা কৌতূহল ও আগ্রহই মনুষ্যত্বের বিশিষ্ট লক্ষণ, এবং ভাষা দ্বারা তা প্রকাশ বা চরিতার্থ করবার চেষ্টার নামই সাহিত্য। তথ্যমূলক রচনা অপেক্ষা রস- বা কল্পনা-মূলক রচনা শ্রেষ্ঠ–এই ধারণা সংকীর্ণ বুদ্ধির লক্ষণ।
ব্রজেন্দ্রনাথ যে সাহিত্য রচনা করেছেন তার অবলম্বন ইতিহাস। প্রথম জীবনে তিনি মোগল যুগ সম্বন্ধে অনেক লিখেছেন, কিন্তু পরে তিনি তাঁর মাতৃভূমি বাংলা দেশেই ইতিহাসের প্রচুর উপকরণ খুঁজে পেয়েছেন। গত দেড় শ বৎসরে এদেশে যে সাহিত্যিক অভ্যুদয় হয়েছে এবং বাঙালী সমাজে যে পরিবর্তন এসেছে, ব্রজেন্দ্রনাথ তারই ঐতিহাসিক ভিত্তি রচনা করেছেন। সাহিত্য-সেবকগণের সংক্ষিপ্ত জীবন-চরিত লিখে তিনি তাদের বিস্মৃতি থেকে উদ্ধার করেছেন। বঙ্গীয় নাট্যশালার ইতিহাস, বাংলা সাময়িক পত্র এবং আরও অনেক গ্রন্থ তিনি লিখেছেন। কিন্তু আমার মনে হয় তার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক কৃতি সংবাদপত্রে সেকালের কথা।
এই গ্রন্থ রচনায় তিনি যে পরিশ্রম করেছেন তাকে তপস্যা বলা চলে। ইংরেজ প্রভৃতি জাতি নরম্যান টিউডর ইত্যাদি আমলের জীর্ণ ঘর-বাড়ি সযত্নে রক্ষা করে। শুধু মন্দির মূর্তি ও চিত্র নয়, প্রাচীন গ্রন্থ, চিঠিপত্র, অস্ত্র, গৃহসজ্জার আসবাব, তৈজস দ্রব্য, পরিধেয়, অলঙ্কার ইত্যাদি অতীত যুগের বিবিধ নিদর্শন মহামূল্য জ্ঞানে সঞ্চয় করে। প্রাচীনের প্রতি আমাদের এই । মমতা নেই। দেবমন্দির ও তৎসংক্রান্ত বস্তু রক্ষায় কতকটা আগ্রহ আছে বটে, রাজাদের হতাশাখানাতেও অনেক সেকেলে জিনিস রাখা হয়, কিন্তু সাধারণ লোকের বাড়িতে দু-এক শ বছর আগেকার আসবাব অলংকার বাসন ইত্যাদি খুঁজে পাওয়া শক্ত।
ইংরেজী বিদ্যা শিখে আমাদের ধারণা হয়েছিল যে ইতিহাস মানে শুধু রাজা-রাজড়ার কীর্তি বা অকীর্তি, যুদ্ধ, আর অসংখ্য সন-তারিখ। ব্রজেন্দ্রনাথ এই মোহ কাটিয়ে উঠে স্বজাতির সাহিত্যচেষ্টা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে মন দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছেন–পূর্বপুরুষের কার্যকলাপের নিদর্শনগুলি সযত্নে রক্ষা করিবার আগ্রহ আমাদের নাই।..সরকারী দলিলপত্রে ও গ্রন্থাগারগুলিতে ইংরেজ-শাসিত বাংলা দেশে বাঙালী কি ভাবে জীবন কাটাইতেছিল, কি চিন্তা করিতেছিল, তাহার বড় একটা প্রমাণ নাই। এই উদাসীনতার প্রতিকার ব্রজেন্দ্রনাথ করেছেন। বলা যেতে পারে সংবাদপত্রে সেকালের কথা গ্রন্থে ভূমিকা ছাড়া তার নিজের লেখা তো কিছুই নেই, শুধু খবরের কাগজ থেকে সংকলন। এর জন্যই তাঁকে ইতিহাসকার আর সাহিত্যকার বলতে হবে?
অবশ্যই বলতে হবে। ব্রজেন্দ্রনাথ যে উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন তা থেকে একটা মৌলিক গ্রন্থ তিনি অল্পায়াসেই লিখতে পারতেন। তা হয়তো ধারাবাহিক ইতিহাস হত কিন্তু নিচ্ছিদ্র হত না। সেরকম গ্রন্থ রচনার লোভ সংবরণ করে তিনি সকল ত্রুটি আর বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠেছেন! তাঁর গ্রন্থ স্বতঃপ্রমাণ ঐতিহাসিক প্রদর্শভাণ্ডার। সেকালের বাঙালী কিভাবে জীবন যাপন করত, কি চিন্তা করত তা ব্রজেন্দ্রনাথ নিজে বলেন নি, তাঁর সংগ্রহই বলেছে। অতীতকে তিনি কথা কইয়েছেন। তাঁর উদ্যম ও পদ্ধতি অভিনব, কিন্তু তাঁর সাধিত কর্ম ইতিহাসও বটে সাহিত্যও বটে।
ব্রজেন্দ্রনাথ তার ভূমিকায় বলেছেন, সংবাদপত্রের মধ্যেও সত্য মিথ্যা দুইই আছে। দেশকাল পাত্র বিবেচনা করিয়া, সত্য মিথ্যা যাচাই করিয়া লইবার দায়িত্ব ইতিহাসলেখকের। তিনি আরও বলেছেন, এ যুগের– সংবাদপত্র বিগত শতাব্দীর সংবাদপত্র অপেক্ষা অনেক বেশী মিথ্যাচারী। তার মুখে শুনেছিলাম, আরও এই উপাদান সংগ্রহ হলে একটি ধারাবাহিক ইতিহাস লেখবার ইচ্ছা তার আছে।
আশা করি ব্রজেন্দ্রনাথের অনুবর্তীগণ আরও উপাদান সংগ্রহ করবেন এবং অচির ভবিষ্যতে কোনও যোগ্য লেখক সমস্ত উপকরণ যাচাই আর অবলম্বন করে সেকালের বাঙালী সমাজের একটি প্রামাণিক ইতিহাস লিখবেন।
ভুল নাম ও নকল জিনিস
সম্প্রতি দিল্লিতে লোকসভায় একজন সদস্য প্রশ্ন করেছিলেন, বনস্পতিকে ভেজিটেবল ঘি বলা চলবে কিনা। ডক্টর রঘুবীর তার উত্তরে বলেন, ভেজিটেবল ঘি নামে কোনও বস্তু নেই, জিনিসের ভেজালের চাইতে নামের ভেজাল বেশী অনর্থকর।
নামের ভেজাল অর্থাৎ শব্দের অপ্রপ্রয়োগ চিরকালই চলে আসছে। অনেক ভুল নাম কালক্রমে ভাষায় স্থায়িত্ব পায় এবং সাধারণত তাতে বিশেষ ক্ষতি হয় না। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে ভুল নামের সুযোগে নিকৃষ্ট নকল জিনিস বাজারে প্রচলিত হয়।
তৈল শব্দের মূল অর্থ তিল থেকে উৎপন্ন, অর্থাৎ তিল তৈল। ইংরেজী অয়েল শব্দের উৎপত্তি, লাটিন অলিয়ম থেকে, যার মৌলিক অর্থ অলিভজাত, অর্থাৎ অলিভ অয়েল। কিন্তু কালক্রমে অর্থ প্রসারিত হয়েছে, এখন স্নেহদ্রব্য বা তত্ত্বল্য বস্তুমাই তৈল বা অয়েল, সরষের তেল তার্পিন কেরোসিন সবই এই নামে চলে। তালবৃন্তের মূল অর্থ তালগাছের ডাল, তা থেকে হল তালপাতার পাখা; তার পর সংস্কৃত ভাষায় পাখামাত্রই তালবৃন্ত নাম পেল।
অজ্ঞতার জন্য অনেক ভুল নাম চালানো হয়। কয়েকটি ইংরেজী অভিধানে ট্যাবলয়েড শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছিল–ঔষধাদির চাকতি, অর্থাৎ ট্যাবলেট। ট্যাবলয়েড শব্দের যাঁরা প্রবর্তক তাঁরা উকিলের চিঠি দিয়ে জানালেন যে ওই নামে শুধু তাদের তৈরি জিনিস বোঝায়, অভিধানে ব্যাপক অর্থ দিয়ে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। তখন অভিধান সংশোধিত হল।
একটি বিশেষ কম্পানির প্রস্তুত বীজঘন বস্তুর পেটেন্ট নাম ফিনাইল। কিন্তু সাধারণ লোকে ওই রকম সকল বস্তুকেই ফিনাইল বলে। থার্মস একটি বিশেষ কম্পানির প্রস্তুত জিনিসের নাম, কিন্তু সাধারণ লোকে সব ভ্যাকুয়ম ফ্লাস্ককেই থার্মস বলে। ভ্যাসেলিন নাম একটি আমেরিকান কম্পানির পেটেন্ট, কিন্তু লোকে অনুরূপ সকল বস্তুকেই ওই নাম দিয়েছে। প্রায় পঁচিশ বৎসর পূর্বে কেড়স নামক এক আমেরিকান কম্পানির ক্যাম্বিসের জুতো এদেশে আসত। এখন আর আসে না, কিন্তু অনেক শিক্ষিত লোকেরও ধারণা, কেডস মানেই ক্যাম্বিসের জুতো।
কাগজে দশ-বারো টাকা দামের নাইলন (বা নিলন) শাড়ির বিজ্ঞাপন দেখতে পাই। ও দামে একজোড়া নাইলনের মোজাও হয় না। রেয়ন বা নকল রেশমের শাড়িকে নাইলন নাম দিয়ে ক্রেতাকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
ময়রাকে যদি প্রশ্ন করি, মিষ্টান্নে যে হলদে রং দাও তা কি জিনিস? সে বলে, জাফরান। অনেক ময়রাই মনে করে হলদে রং মাত্রই জাফরান। কুঙ্কুম শব্দের অর্থ জাফরান। যেমন চন্দন ঘষে তিলকচর্চা হয় তেমনি এককালে মেয়েরা কুঙ্কুম অর্থাৎ জাফরান বেটে তার টিপ পরত। বাইশ বৎসর আগে মাদ্রাজের মেয়েদের তা পরতে দেখেছি। আধুনিক বাঙালী মেয়ে যাকে কুঙ্কুম বলে তাতে জাফরানের লেশ নেই, যে-কোনও খয়ের রঙের পিষ্ট বস্তু এই নামে চলে। অজ্ঞতার ফলে কুঙ্কুম শব্দের মানে বদলে গেছে।
খাঁটি সোনা খুব নরম, অল্পাধিক খাদ না মেশালে অলংকার গড়া যায় না। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আজকাল যে জগত্তারিণী স্বর্ণপদক দেন তা নাইন ক্যারাট গোল্ডের, অর্থাৎ তার ভরিতে দশ আনা খাদ। এই ভেজাল সোনার মেডালকে গোল্ড মেডালই বলা হয়। কিন্তু দোকানদার যদি সের পিছু দশ ছটাক ভেজাল দেওয়া জিনিসকে ঘি নামে চালায় তবে সে আইন অনুসারে দণ্ডনীয় হবে। মেডাল খাবার জিনিস নয়, সেজন্য তাতে ভেজাল থাকলে আইন ভঙ্গ হয় না।
অনেক ভুল নাম প্রয়োগসিদ্ধ বা আইনসম্মত। অনেক নামে অজ্ঞতা প্রকাশ পেলেও ক্ষতি বিশেষ কিছু হয় না। কিন্তু সাগুদানা বা এরারুট নামের অপপ্রয়োগ অনর্থকর। স্টার্চ (শ্বেতসার বা পালো) অনেক রকম উদ্ভিজ্জ বস্তু থেকে প্রস্তুত হয়, যেমন আলু চাল গম ভুট্টা টাপিওকা (কাসাভা বা শিমুল-আলু), শটি ইত্যাদি। যদি সুশোধিত হয় তবে গুণের বেশী তারতম্য দেখা যায় না। তাল-বর্গীয় সাগু গাছের মজ্জা থেকে যে স্টার্চের দানা প্রস্তুত হয় তাই সাগুদানা। ক্যানা বা সর্বজয়া শ্রেণীর এক রকম গাছের মূল থেকে তৈরি স্টার্চের নাম এরারুট (অ্যারারুট)। আসল সাগু আর এরারুট অন্যান্য শোধিত স্টার্চের তুলনায় বেশী লঘুপাক কিনা তার বোধ হয় কোনও বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা হয় নি। সাধারণে গতানুগতিক ভাবে বিশ্বাস করে যে চিনির চাইতে মিছরি বেশী উপকারী, তাল-মিছরি আরও উপকারী; তেমনি। মনে করে, সুপাচ্যতায় সাগু আর এরারুট শ্রেষ্ঠ। সম্ভবত এই শ্রেষ্ঠতা কাল্পনিক, সকল বিশুদ্ধ স্টার্চই প্রায় সমান পাচ্য।
কিন্তু গুণের তারতম্য থাকুক বা না থাকুক, সাগু আর এরারুট নামে অন্য স্টার্চ বিক্রয় করা প্রতারণা। অনেক বৎসর পূর্বে কোনও অসাধু ব্যবসায়ীর মাথায় এল–আসল সাগুর দরকার কি, টাপিওকার পালো থেকে দানা তৈরি করলেই চলবে, দেখতে আর খেতে একই রকম হবে। এককালে এই নকল জিনিস কোনও কোনও দোকানে কেচুয়া দানা নামে বিক্রি হত, কিন্তু পরে তা সাগুদানা নামেই চলে গেল। এখনকার অনেক দোকানদারও জানে না যে সে নকল জিনিস বেচছে। সাগুদানা নামে লোকে যা কেনে তা টাপিওকার দানা আর এরারুট নামে যা কেনে, তা ভুট্টার স্টার্চ (কর্ন ফ্লাওআর) অথবা টাপিওকার স্টার্চ।
দোকানদার আর জনসাধারণ যাতে সাগুদানা আর এরারুট নামের অপপ্রয়োগ না করে তার ব্যবস্থা হওয়া উচিত। টাপিওকার দানা আর ভুট্টা প্রভৃতি থেকে তৈরি স্টার্চ নিষিদ্ধ করার দরকার নেই, কারণ কোনওটি অখাদ্য নয়। কিন্তু এমন আইন হওয়া উচিত যাতে খাদ্যবস্তু মাত্রই যথার্থ নামে বাজারে চলে। টাপিওকা-দানা, কাসাভা-দানা, শিমুল-দানা বা পালো দানা নাম চলতে পারে। সবরকম স্টার্চের সাধারণ নাম শ্বেতসার বা পালো দিলে দোষ হবে না।
ভারত সরকার সিন্থেটিক রাইস নাম দিয়ে চালের অনুকল্প তৈরির চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি বিলাতী নেচার পত্রে তার গবেষণার বৃত্তান্ত ছাপা হয়েছে। এর প্রধান উপাদান টাপিওকার পালো আর চীনাবাদামের খোেল। এই নকল চালের রূপ আর পুষ্টিগুণ নাকি চালের মতই হবে। তথাপি এ জিনিসকে সিন্থেটিক রাইস নাম দেওয়া অন্যায়। আজকাল রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় যে নীল (ইন্ডিগো), কর্পূর, মেন্থল প্রভৃতি প্রস্তুত হচ্ছে তার আণবিক গঠন আর গুণ স্বভাবজাত বস্তুর সমান বা প্রায় সমান, সেজন্য সিন্থেটিক (সংশ্লেষিত) বিশেষণ সার্থক। কিন্তু সিন্থেটিক চাল ডাল মাছ মাংস ডিম প্রস্তুত করা মানুষের অসাধ্য। নকল চাল যতই সুখাদ্য হক, তা সিন্থেটিক হতে পারে না, তাকে ইমিটেশন রাইস বা নকল চালই বলা উচিত।
রবীন্দ্ররচনার বানান
বাংলা ভাষার এক বিশেষ সমস্যা অগণিত শব্দের ব্যাকরণ সম্মত একাধিক বিকল্প বানান–যা এই ভাষা শিক্ষা, রচনার শুদ্ধি রক্ষা ও মুদ্রণ পদ্ধতিকে জটিল ও বিশৃঙ্খল করে তুলছিল। এর সমাধান ও নিয়মাবলী সুনির্দিষ্ট করার জন্য রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৬ সালে বানান-সংস্কার সমিতি গঠন করেন, যার যোগ্যতম সভাপতিরূপে নির্বাচিত হন রাজশেখর বসু। সাধারণের প্রবল বিরোধ বিতর্ক ও মতানৈক্য পার হয়ে সমিতি-নির্দিষ্ট নিয়মাবলী প্রকাশিত হয়–এর বিশদ বিবরণ বানানের নিয়ম প্রবন্ধে আছে।
রবীন্দ্র রচনাবলী প্রকাশের সময় বিশ্বভারতী এই বানানের সমতা ও সরলতা সম্বন্ধে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন অনুভব করেন, কারণ বহু বৎসরব্যাপী রচিত এই বিপুল সম্ভারে অবশ্যম্ভাবীরূপে বিস্তর বানান-পার্থক্য দেখা দিয়েছে কবি স্বয়ং তা স্বীকার করে কারণস্বরূপ ভাবনা ও অভ্যাসএর মধ্যে বৈষম্য নিয়ে খেদ প্রকাশ করেছেন। এই সমস্যা অতিক্রম করে সমতা ও সরলতা আনার প্রায় শেষকথা রাজশেখরকে তাই চিঠি দিয়ে মতামত চেয়েছিলেন বিশ্বভারতী গ্রন্থন বিভাগ থেকে শ্রীকানাই সামন্ত। চিঠিটা পাই নি, তাই প্রশ্ন অনুপস্থিত। কিন্তু প্রায় সব উত্তরই স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং প্রায় এই নির্দেশ মেনেই আজও মুদ্রিত হয়ে চলেছে রবীন্দ্র রচনাবলী।
এই উত্তরমালাও এক সুরচিত প্রবন্ধ। –স:।
শ্ৰীযুক্ত কানাই সামন্তর প্রশ্নের উত্তর
১। কবির সকল বই-এর বানান ইত্যাদি সমান হওয়া বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তিনি নিজে একই পদ্ধতিতে চলেন নি, সর্বমান্য কোনও পদ্ধতি নেই। ভাষায় খুঁটিনাটি এত বেশী যে কবির গ্রন্থাবলীর জন্য একটা সম্পূর্ণ পদ্ধতি খাড়া করাও বৃহৎ ব্যাপার। সুতরাং যথাসম্ভব সংগতিরক্ষার চেষ্টা করা ভিন্ন উপায়ান্তর দেখি না।
কবি ইলেক পছন্দ করতেন না। ৫/৬ বৎসর আগে আমি একবার তাকে বলি-ও-কার লেখার চেয়ে ইলেক দেওয়া ঢের সোজা, আর তাতে শুধু দরকার মতন উচ্চারণ বোঝানো যায়, শব্দের পূর্বরূপ বিকৃত হয় না। কবি এই যুক্তি মেনেছিলেন। কিন্তু তখন হক হন ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করা হয় নি। আমার ধারণা–ক্রিয়াপদের একটি বড় ফর্দ কবির সামনে ধরলে তিনি সংগতিরক্ষার উপায়স্বরূপ এই বানান মেনে নিতেন।
করি না, করি নে। গরু গোরু দুইই ঠিক মনে করি।
২। কি, কী।–কবির অভিপ্রায় মোটামুটি এই বুঝেছি।–অব্যয় কি (তাই কি? তাই নাকি, হাঁ কি না)। সর্বনাম কী (কী চাই, বল কী!)। বিশেষ ক্রিয়াবিশেষণ কী (কী জিনিস, কী করিয়া, কী বুদ্ধি!)। বোধ হয় সর্বত্র এই নিয়ম মানেন নি।
৩। দুই শব্দের মাঝে হাইফেন থাকবে, কি ফাঁক হবে, কিংবা জুড়ে দেওয়া হবে তার নিয়ম বাঁধা বোধ হয় অসম্ভব। ইংরেজীতেও সংগতি নেই। কবির কোনও নির্দিষ্ট মত ছিল বোধ হয় না। সংগতির আশা ত্যাগ করে আপনাদের পছন্দমত ছাপবেন। আমার পছন্দ-পরে বহুবচনবাচক শব্দ থাকলে জোড়া হবে (লোকগুলো, যেসকল)। দ্বিরুক্ত শব্দে ফাঁক (বার বার, ধীরে ধীরে)। কিন্তু দ্বিতীয় শব্দটি অর্থহীন বা ইত্যাদিসূচক হলে জোড়া (কাপড়চোপড়, গাছপালা)। অনুকার শব্দে জোড়া (চকচক, ঝনঝন)। ক্রিয়াবিশেষণ বা বিশেষণ বাচক হলে অনেক স্থলে জুড়লে ভাল হয়। (এজন্য, যেহেতু, যেরকম, সবচেয়ে, সবসুদ্ধ, হয়তো)। জোড়া বা না জোড়া অনেকটা উচ্চারণের উপর নির্ভর করে–যেকেউ, যে মানুষ (বা যে-মানুষ)। হাইফেন যথাসম্ভব কম হলে ভাল।
৪। কবি অসংস্কৃত শব্দে ঈ-কারের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তার আগেকার লেখায় ব্যতিক্রম আছে (চয়নিকা ৩০ সং।)–কাঙালিনী, বিজুলী, বিজুলি, পাখী, পশ্চিমী, বাঙালী, চখা চখীরে, চাহনী, ময়ূরকণ্ঠী, মাসী, বাঁশরী, হিন্দুস্থানী, গয়লানী)।
৫। কবির পুরনো বইএ ইংরাজি ইংরেজি দুইই। কিম্বা প্রভৃতি শব্দে করির যেখানে ং স্থানে ম লিখেছেন সেখানে বদলাবার দরকার নেই।
৬। কবি আমাকে বলেছিলেন বাংলা প্রয়োগে শব্দের শেষের বিসর্গ অনাবশ্যক (সংস্কৃতে মনঃ, দুর্বাসা, স্বতঃ, বাংলায় মন, দুর্বাসা, স্বত)।
৭। হস্-চিহ্ন সম্বন্ধে কবির মত জানি না। বোধ হয় সংস্কৃত শব্দে অধিকাংশ স্থলে হচিহ্ন বজায় রাখা ভাল (ব্যতিক্রম–ভগবান, বলবান, (বুদ্ধিমান, বিপদ, দিক ইত্যাদি বহু শব্দ)। অসংস্কৃত শব্দে নিতান্ত দরকার না হলে হচিহ্ন বর্জনীয় (পটকা, বালতি, আচমকা, চটকানো)। খণ্ড-ত আমার পছন্দ নয়, বাংলা ছাড়া কোনও ভাষায় নেই। কিন্তু জগৎ স্থানে জগত লিখলে লোকে খেপে উঠবে। চলন্তিকা ৪র্থ সংস্করণে অনেক অসংস্কৃত শব্দে ৎ স্থানে ত দিয়েছি (ওত, তফাত, মেরামত, শরবত)। বুদবুদ, প্রগম্ভ–হচিহ্ন আবশ্যক। সংস্কৃতে ষড়দর্শন, ষড়যন্ত্র; বাংলায় সাধারণে হচিহ্ন দেয় না।
৮। কার্তিক, বর্তিকা শুদ্ধ, পাণিনিসম্মত। বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ঢাকার গোবর্ধন শাস্ত্রী প্রমাণ দিয়েছেন। পাশ্চাত্য অনেকে লেখেন। সামান্য একটু পরিবর্তনে যদি শব্দটিকে শুদ্ধ করা যায় তবে ত্ত্য লিখতে দোষ কি? (বাংলায় ও হরফ আছে বলেই ত্ত লিখতে হবে কেন?)
৯। যদি দৃষ্টিকটু না হয় তবে যুক্তাক্ষর কিছু কমানো ভাল (উদ্গত, উদ্ঘাটন, ধিক্কার)। তন্ময় দৃষ্টিকটু। বাংলায় দ-এর পর ব-ফলা বা য-ফলার দুরকম উচ্চারণ। যেখানে স্পষ্ট উচ্চারণ (চ বা তুল্য) সেখানে হস্ চিহ্ন দিতে চাই, অন্যত্র যুক্তাক্ষর রাখতে চাই (উন্ধন, উদাহু, তবিধ, উদ্যোগ, উদ্যাপন, বিদ্বান, অদ্বৈত, উদ্যত, উদ্যান)। রচনাবলীতে অবশ্য এরকম করা হয় নি।
কবি আমাকে বলেছিলেন–বাংলায় ঐ ঔ তুলে দেওয়া উচিত (পইতা, বউ, মউমাছি)। আমি বলেছিলাম–সর্বত্র তা হবে কি? উত্তরকেন হবে না। পৌষ সংস্কৃত শব্দ, বাংলাতে উচ্চারণ বদলায় নি, সুতরাং পউষ বর্জনীয়। ঔষধ ঔউষধ হয় নি।
আমার মতে ঐ (that) স্থানে সর্বত্র ওই লিখলে দৃষ্টিকটু হবে।
১০। বানানসমিতি কেবল কয়েকটি শব্দে য-এর বদলে জ-এর ব্যবস্থা করেছেন (কাজ, জাউ, জাঁতা, জাতি, জুই, জো, জোড়, জোড়া, জোত, জোয়াল)। অন্য শব্দে জ কিংবা য আপনারা স্থির করবেন। খৃষ্ট স্থানে খ্রীষ্ট বা খ্রীস্ট লেখা ভাল। নবাগত অসংস্কৃত শব্দে রি বা রী স্থানে ঋ লেখা অনুচিত, কারণ ঋকারের মূল উচ্চারণ তা নয়। আমরা যা ভুল করে আসছি তা আর বাড়াবার দরকার কি। বাংলা উচ্চারণে শ ষ স সমান, কিন্তু নবাগত notice লিখতে নোটিশ বানান করা ঠিক নয়। নোটিস, বার্নিশ ঠিক।
১১। মর্ত, মর্ত; অর্ঘ, অর্ঘ্য–সবই শুদ্ধ। বাংলায় মর্ত্য বেশী চলে। অর্ঘ, অর্ঘ্য–কিছু অর্থভেদ আছে।
১২। ১নং উত্তর দ্রষ্টব্য।
১৩। ইলেক দেওয়া না দেওয়া ইচ্ছাধীন।
১৪। অর্থবোধে বাধা হলে হাইফেন দেওয়া ভাল। উদাহরণগুলিতে হাইফেন না দিলেও চলে।
১৫। বাংলায় যেসকল শব্দে অ্যা উচ্চারণ আছে অথচ বানানে এ-কার বহুপ্রচলিত, সেখানে কবির রীতি অনুসারে দেওয়া উচিত।
১৬। কবির লেখায় আগে? এবং! চিহ্ন খুব থাকত, শেষে প্রায় বাদ দিয়েছিলেন। বোধ হয় সর্বত্র বাদ দিলে মানে বোঝা শক্ত হবে। কমা-চিহ্ন সম্বন্ধেও ঐ কথা। বাক্যের প্রথমে এমন কি, অর্থাৎ, আর, কিন্তু থাকলে হলবিশেষে কমা দিলে ভাল হয়।
—-রাজশেখর বসু
৩০/৪/৪৩
লোকহিতৈষী প্রফুল্লচন্দ্র
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে আপনারা যত জানতেন, অন্য অল্প লোকেই তাঁকে। ততটা জানত, এজন্য তার সম্বন্ধে নূতন বেশী কিছু বলার নেই। কোনও লোক যখন নানা কারণে বিখ্যাত হন তখন অনেক ক্ষেত্রে তার সবচেয়ে বড় গুণটি অন্যান্য গুণের আড়ালে পড়ে যায়। আমার মনে হয়, প্রফুল্লচন্দ্রের বেলা তাই হয়েছে। তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী, বিখ্যাত শিল্প প্রতিষ্ঠাতা–এই কথাই লোকে বেশী বলে। এদেশে অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী আর শিল্পকর্তা আছেন, সুতরাং এই দুই দলে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে ফেললে তার গৌরব বাড়ে না। তার মহত্ত্বের সবচেয়ে বড় পরিচয়–তিনি নিঃস্বার্থ লোকহিতৈষী। এই গুণে তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর বৈজ্ঞানিক আর সাহিত্যিক বিদ্যা, শিল্পপ্রসারের জন্য তার আগ্রহ–এসব তিনি শিক্ষা বা চর্চার দ্বারা পেয়েছিলেন। কিন্তু লোকহিতের প্রবৃত্তি তার স্বভাবসিদ্ধ ছিল। তিনি বেশী রোজগার করেননি, সেজন্য তার দানের পরিমাণ ধনকুবেরদের তুল্য নয়। তথাপি তিনি দাতাদের অগ্রগণ্য, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় মহাশয় তাকে দধীচির সঙ্গে সার্থক তুলনা করেছেন। সংসারচিন্তা এবং সব রকম বিলাসিতা ছেড়ে দিয়ে তিনি নিজের সমস্ত ক্ষমতা ভাবনা আর অর্থ জনহিতে লাগিয়েছিলেন। দেশে দুর্ভিক্ষ বা বন্যা হয়েছে, আচার্য তৎক্ষণাৎ ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। কোনও হাসপাতাল বা অনাথ আশ্রম বা স্কুল বা কলেজে টাকার অভাব, আচার্য তার নিজের পুঁজি নিঃশেষ করে দান করলেন। কোনও ছোকরা এসে বললে, আমার মাথায় একটা ভাল মতলব এসেছে, ময়রার দোকান খুলব কিংবা ট্যানারি করব কিংবা কাপড়ের ব্যবসা করব, কিন্তু হাতে টাকা নেই। আচার্য তখনই মুক্তহস্ত হলেন। নূতন শিল্প স্থাপনের জন্য, তিনি অনেক লিমিটেড কম্পানিতে টাকা দিয়েছিলেন ডিরেক্টারও হয়েছিলেন। অনেক কোম্পানী ফেল হওয়ায় বিস্তর টাকা খুইয়েছেন, সময়ে সময়ে বদনামও পেয়েছেন, কিন্তু ভূক্ষেপ করেননি। কোনও কম্পানি টাকা ধার করবে, উনি অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে জামিন হয়ে দাঁড়ালেন। তারপর কম্পানি ফেল হলে অম্লানবদনে দণ্ড দিলেন। অনেকক্ষেত্রে আইন অনুসারে তিনি টাকা দিতে বাধ্য ছিলেন না, তার হিতার্থীরাও তাকে বারণ করেছিলেন, তবু তিনি টাকা দিয়েছিলেন–পাছে তার সাধুতায় কলঙ্ক হয়। মহাভারতে আছে–সকল শৌচের মধ্যে অর্থশৌচ শ্রেষ্ঠ। একথা তার চেয়ে কেউ বেশী বুঝত না, টাকাকড়ির দায়িত্ব সম্বন্ধে তিনি শুচিবায়ুগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু তার কাছে টাকা ধার নিয়ে গাপ করবার লোকের অভাব হয়নি।
বেঙ্গল ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফেল হওয়ায় আমাদের কম্পানির অনেক টাকা মারা যায়। শেয়ারহোল্ডার মিটিংএ একজন বলেছিলেন–দেশী ব্যাঙ্কে বিশ্বাস নেই, সেখানে আর যেন টাকা না রাখা হয়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র উত্তর দিলেন–অবশ্যই রাখা হবে, দশবার টাকা মারা গেলেও রাখা হবে; আমাদের এই দেশী কারবারকে লোকে বিশ্বাস করে, আমাদেরও অন্য দেশী কারবারকে বার বার বিশ্বাস করতে হবে।
তাঁর স্মৃতিরক্ষা বা তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্য আমরা কি করতে পারি? এই কারখানায় তার মূর্তি প্রতিষ্ঠা বা চিতাভস্ম রক্ষার জন্য চৈত্যস্থাপন বেশী কিছু নয়। কিন্তু মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার শ্রেষ্ঠ উপায় তার প্রিয়কার্যসাধন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের অনেক ইচ্ছার মধ্যে একটি ছিল–এই কম্পানি বড় থেকে আরও বড় হবে, এতে নানা রাসায়নিক দ্রব্য তৈরি হবে, এতে বহু লোক শিক্ষিত উৎসাহিত পুরস্কৃত প্রতিপালিত হবে। এই ইচ্ছার পূরণ কেবল ডিরেক্টারদের চেষ্টায় হবে না, শেয়ারহোল্ডাররা লাখ লাখ টাকা মঞ্জুর করলেও হবে না, আপনাদের সকলের সমবেত চেষ্টাতেই তা হতে পারবে।
[আচার্য রায়ের মৃতুর (১৬.০৬.১৯৪৪) পর বেঙ্গল কেমিক্যালে শোকসভায় পঠিত।]
সমালোচনা
০১. জীবনস্মৃতি–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, ২, বঙ্কিম চাটুজ্যে স্ট্রীট, কলিকাতা। আকার ৯২ x ৬৪ ইঞ্চ, ২২৩ পৃষ্ঠা। মূল্য সাড়ে তিন টাকা।
এই রচনা পুস্তকাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩১৯ সালে, তার পর এ পর্যন্ত আরও ছ বার ছাপা হয়েছে। বর্তমান সংস্করণের একটি বৈশিষ্ট্য এই যে, গ্রন্থে উল্লিখিত অনেক ব্যক্তি, বিষয় এবং ঘটনা সম্বন্ধে পাদটীকা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় এবং প্রধান বৈশিষ্ট্যগ্রন্থের শেষে যোজিত একান্ন পৃষ্ঠা ব্যাপী গ্রন্থপরিচয়, কবির বংশলতা, এবং বর্ণমিক উল্লেখপঞ্জী।
রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতির সূচনায় লিখেছেন–এই স্মৃতির মধ্যে এমন কিছু নাই যাহা চিরস্মরণীয় করিয়া রাখিবার যোগ্য।…নিজের স্মৃতির মধ্যে যাহা চিত্ররূপে ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাকে কথার মধ্যে ফুটাইতে পারিলেই তাহা সাহিত্যে স্থান পাইবার যোগ্য।…এই স্মৃতিগুলি সেইরূপ সাহিত্যের সামগ্রী। ইহাকে জীবন-বৃত্তান্ত লিখিবার চেষ্টা হিসাবে গণ্য করিলে ভুল করা হইবে। সে হিসাবে এ লেখা নিতান্ত অসম্পূর্ণ এবং অনাবশ্যক।
রবীন্দ্রনাথ যাই বলুন, পাঠকবর্গের কাছে এই রচনা শুধুই সাহিত্য নয়। জীবনবৃত্তান্ত হিসাবে এ লেখা নিতান্ত অসম্পূর্ণ হতে পারে; কিন্তু অনাবশ্যক মোটেই নয়। কেউ যদি নিজের সম্বন্ধে কোনও কথা নাও বলেন তথাপি নানা উপায়ে তার জীবনের একটা ইতিহাস সংকলন করা যেতে পারে। অধিকাংশ জীবনবৃত্তান্ত এই রকম। কিন্তু এসব বৃত্তান্ত যতই উত্তম হক, তা মূলত বাহ্যদৃষ্ট জীবনচরিত, অর্থাৎ কীর্তি বা আচরণের ইতিহাস। মানসিক ইতিহাস বা স্বভাবের প্রকৃত পরিচয় জানবার শ্রেষ্ঠ উপায় আত্মচরিত, তা যতই অসম্পূর্ণ হক। জীবনস্মৃতির একটি পরিত্যক্ত পাণ্ডুলিপির সূচনায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন–সম্প্রতি নিজের জীবনটা এমন এক জায়গায় আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যখন পিছন ফিরিয়া তাকাইবার অবকাশ পাওয়া গেছে–দর্শকভাবে নিজেকে আগাগোড়া দেখিবার যেন সুযোগ পাইয়াছি। ইহাতে এইটে চোখে পড়িয়াছে যে, কাব্যরচনা ও জীবনরচনা ও-দুটো একই বৃহৎ রচনার অঙ্গ। এই পশ্চাদর্শন বা restrospectionএর জন্যই জীবনস্মৃতি অমূল্য গ্রন্থ।
বর্তমান সংস্করণের শেষে যে গ্রন্থপরিচয় সন্নিবিষ্ট হয়েছে তা মূল গ্রন্থের পরিপূরক এবং অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। যাঁদের চেষ্টায় এই সুদৃশ্য সুমুদ্রিত তথ্যবহুল সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছে তারা অশেষ প্রশংসার যোগ্য।
৫/৪/৪৪
০২. শরৎচন্দ্রের পত্রাবলী–শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কর্তৃক সংকলিত। প্রকাশক-বুকল্যান্ড লিমিটেড। ৭ X ৫ ইঞ্চ। ৩৯০ পৃষ্ঠা। মূল্য তিন টাকা।
কীর্তিমানের শ্রেষ্ঠ পরিচয় তাঁর কীর্তি। আর কিছু না জানলেও আমাদের বিশেষ ক্ষতি হয় না। কিন্তু কীর্তিই সমগ্র পরিচয় নয়। তার আকৃতি প্রকৃতি পছন্দ অপছন্দ প্রভৃতিও লোকে জানতে চায়। বিশেষত যিনি জনপ্রিয় গল্পলেখক এবং বিচিত্র চরিতাবলীর স্রষ্টা, তিনি স্বয়ং কি রকম সে সম্বন্ধে লোকের কৌতূহলের অন্ত থাকে না।
মৃত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ পরিচয় পাবার শ্রেষ্ঠ উপায় তার চিঠিপত্র। শরৎচন্দ্রের পত্রাবলী তাঁর গল্পের মতই চিত্তাকর্ষক। এই চিঠিগুলির বেশীর ভাগ তিনি স্বচ্ছন্দে বিশ্বস্ত জনকে লিখেছিলেন। ভবিষ্যতে ছাপা হবে এমন চিন্তা তার মনে ছিল না। সতর্কভাবে লেখা না হলেও এগুলি তাঁর বিশিষ্ট প্রতিভায় মণ্ডিত। এই সংকলনে আমরা যে ব্যক্তির পরিচয় পাই তিনি সরল, বন্ধুবৎসল, স্নেহাকাঙ্ক্ষী, একটু অভিমানী, বিনয়ী ও পরিহাসপ্রিয়। তিনি খোলাখুলি মতামত প্রকাশ করেন, তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ করেন। পরের দুঃখে কাতর হন, বাড়ির পশুপক্ষীর মৃত্যুও সইতে পারেন না। প্রায়ই অসুখে ভোগেন, ছবি আঁকেন, বিস্তর বই পড়েন, হার্বার্ট স্পেনসারের দর্শন সম্বন্ধে আলোচনা করতে ইচ্ছা করেন, আবগারী ব্যাটাদের হার মানিয়েছিলাম বলে গর্ব করেন, কারও কাছে অপরাধ করেছেন মনে করলে অসংকোচে মার্জনা চান। তিনি জানিয়েছেন যে তিনি ethics বোঝেন, কারও চেয়ে কম বোঝেন বলে মনে করেন না। শুধু গল্প নয়, সকল বিষয়েই তিনি প্রবন্ধ লিখতে পারেন, কেবল পদ্য পারেন না। আরও লিখেছেন-আমার বাংলা ভাষার উপর দখল নেই বললেই চলে, শব্দসঞ্চয় খুব কম। কাজেই আমার লেখা সরল হয়; আমার পক্ষে শক্ত করে লেখাই অসম্ভব।
৬/৩/৪৮
সরকারী পরিভাষা
অধ্যাপক শ্রীযুক্ত নির্মলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় মহাশয়ের প্রবন্ধ সরকারী কার্যে ব্যবহার্য পরিভাষা–পড়িয়া সুখী হইলাম, তিনি সংস্কারমুক্ত হইয়া বিচারের চেষ্টা করিয়াছেন। নূতন পরিভাষা সম্বন্ধে অনেকেরই কৌতূহল আছে। তাঁহাদের প্রতি এই অনুরোধ–বিচারকালে তাঁহারা যেন এই কয়টি বিষয় মনে রাখেন।
(১) বর্তমান ইংরেজী পরিভাষা ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক সমগ্র ভারতে প্রবর্তিত হইয়াছে, কোনও বিশেষ প্রদেশের জন্য রচিত হয় নাই। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় কতকগুলি প্রতিশব্দ চলে বটে (যেমন–আদালত, দারোগা, হিসাব অধিকারি, মাসুল, কোতোয়াল, কানুন, মুখসর, মুসন্না ইত্যাদি), কিন্তু কেবল ইংরেজী পরিভাষাই সর্বভারতে সাধারণভাবে রাজকার্যে চলে।
(২) যদি ইংরেজী শব্দ বর্জন করা হয় তবে তৎস্থানে এমন শব্দ নির্বাচন করিতে হইবে যাহা সর্বভারতে গ্রাহ্য হইতে পারে, কেবল প্রদেশবিশেষের উপযোগী করিলে চলিবে না। এই সর্বভারতীয় পরিভাষা রচনার উদ্যোগ কেন্দ্রীয় সরকারেরই করা উচিত ছিল, কিন্তু এখন পর্যন্ত তাহারা এদিকে মন দেন নাই। পশ্চিমবঙ্গ, মধ্যপ্রদেশ ও যুক্তপ্রদেশে পরিভাষা সংকলিত হইতেছে। শুনিতেছি বোম্বাই বিহার ও উড়িষ্যাতেও শীঘ্র আরম্ভ হইবে।
(৩) সর্বভারতীয় পরিভাষা যেমনই হউক, এখন যেমন সংবাদপত্রাদিতে এবং লৌকিক প্রয়োজনে কতকগুলি প্রাদেশিক প্রতিশব্দ চলে (আইন আদালত, দারোগা ইত্যাদি) ভবিষ্যতেও সেরূপ চলিবে। বাজেট, পুলিস প্রভৃতি অনেক ইংরেজী শব্দও চলিবে, অবশ্য কালক্রমে এইরূপ শব্দের অনেকগুলি লুপ্ত হইবে। যেমন পূর্বপ্রচলিত বহু ফারসী শব্দের এখন এই গতি হইয়াছে, অধ্যাপক নির্মলচন্দ্র তাহা দেখাইয়াছেন। আরও মনে রাখা উচিত–যে শব্দ বাঙালীর বোধ্য তাহা সর্বভারতের উপযোগী না হইতে পারে। বাংলায় সরবরাহ supply, কিন্তু হিন্দীতে এ অর্থ চলে না।
(৪) নূতন পরিভাষা সুবোধ্য হইবে, অর্থাৎ তাহা শুনিলেই উদ্দিষ্ট অর্থের জ্ঞান হইবে এমন আশা করা বৃথা। বর্তমান ইংরেজী পরিভাষা কি শুনিলেই বোধগম্য হয়? Administrator-general & Official Trusteeর অর্থ কয়জন জানে? সকল ক্ষেত্রে শব্দের ব্যুৎপত্তি বা বাচ্যার্থ হইতে উদ্দিষ্ট অর্থ বোঝা যায় না, প্রয়োজনের বশেই আমরা নূতন শব্দের প্রয়োগ শিখি। সিনেমা কাহাকে বলে তাহা সাধারণে স্বচক্ষে দেখিয়া বা পরের মুখে শুনিয়া শিখিয়াছে, শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ গতি, তাহা জানিবার প্রয়োজন হয় নাই। ব্ল্যাকআউট, সেলট্যাক্স, বেসামরিক সরবরাহ বিভাগ, কালোবাজার, মুদ্রাস্ফীতি, প্রভৃতির অর্থ দশ বৎসর পূর্বে কয়জন বুঝিতে পারিত? আমরা দায়ে পড়িয়া এগুলির অর্থ শিখিয়াছি। সর্বভারতীয় পরিভাষার সমস্ত (বা অধিকাংশ) শব্দ সর্ব প্রদেশে সুবোধ্য করা অসম্ভব, যাহাতে সর্ব প্রদেশে গ্রহণযোগ্য হয় সেই চেষ্টাই করা উচিত। নূতন শব্দ লোকে কালক্রমে ধীরে ধীরে শিখিবে, যেমন এক কালে ফারসী শব্দ এবং তাহার পর ইংরেজী শব্দ শিখিয়াছে।
(৫) বর্তমান ইংরেজী শব্দগুলির প্রতিশব্দে খাপছাড়া ভাবে নির্বাচন করিলে চলিবে না, এক-একটি নাম হইতে উদ্ভূত অন্যান্য নামেরও প্রতিশব্দ করিতে হইবে। শুধু Inspector নয়, Sub-Inspector, Inspector general, Deputy Inspector-general প্রভৃতির সুসংগত প্রতিশব্দ চাই।
(৬) প্রকৃতি-প্রত্যয়যোগে এবং সন্ধি-সমাসের সাহায্যে সংক্ষেপে পরিভাষা রচনার অসামান্য শক্তি সংস্কৃত ভাষার আছে। ফারসীরও অনেকটা আছে। সংস্কৃত-ফারসী মিশ্রিত খিচুড়ি পরিভাষাও হইতে পারে, কিন্তু তাহা গ্রাহ্য হইবার সম্ভাবনা অল্প। সংস্কৃত বা ফারসী বর্জন করিয়া পরিভাষা রচনার শক্তি কোনও প্রাদেশিক ভাষার নাই। সংস্কৃত ভাষা ভারতের সকল প্রদেশে মান্য এবং সংস্কৃত শব্দ সকল প্রাদেশিক ভাষাতেই সহজে স্থান পাইতে পারে। তামিল তেলেগু প্রভৃতি ভাষা সংস্কৃতজাত না হইলেও প্রচুর সংস্কৃত শব্দ আত্মসাৎ করিয়াছে। ভারতবর্ষে সংস্কৃতের যে প্রভাব ফারসীর তাহা নাই, বিশেষত দক্ষিণ ভারতে নগণ্য। শ্রীযুক্ত দুর্গামোহন ভট্টাচার্য মহাশয় তাহার পারিভাষিক শব্দের গঠন প্রবন্ধে (আনন্দবাজার পত্রিকা, ২রা ফাল্গুন ১৩৫৪) সংস্কৃত ভাষার উপযোগিতা সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন। বিদেশীর শাসনকালে ভারতীয় প্রজা বিদেশী পরিভাষায় ক্রমে ক্রমে অভ্যস্ত হইয়াছে। নব ভারতে যাঁহাদের সংস্কৃতের সহিত সম্পর্ক নাই তাহারাও কালক্রমে সংস্কৃতজাত পরিভাষা শিখিবেন। ইহার জন্য ভাষাজ্ঞান বা ব্যুৎপত্তিজ্ঞান অনাবশ্যক। ফারসী আরবী না জানিয়াও আমরা বহু ফারসী আরবী শব্দ শিখিয়াছি।
(৭) পশ্চিমবঙ্গে, মধ্যপ্রদেশে ও যুক্তপ্রদেশে সংস্কৃতের ভিত্তিতেই পরিভাষা সংকলিত হইতেছে। নির্বাচিত শব্দগুলি সকল ক্ষেত্রে সমান না হইলেও একই পদ্ধতি অনুসৃত হইতেছে। ইহা সুখের বিষয়, কারণ, উদ্দেশ্য ও আদর্শ যখন সমান, তখন ভবিষ্যৎ মিলিত আলোচনার ফলে একই শব্দাবলী গৃহীত হইবার সম্ভাবনা আছে। (৮) উক্ত প্রদেশগুলিতে যে শব্দাবলী সংকলিত হইতেছে তাহা চূড়ান্ত নহে, মিলিত যুক্ত-আলোচনার ফলে অনেক পরিবর্তন হইবে, অতএব এক-একটি শব্দ সম্বন্ধে আপত্তি তুলিয়া এখন বিশেষ লাভ নাই। কেন্দ্রীয় সরকারের সম্মতি ভিন্ন সর্বভারতীয় পরিভাষার প্রতিষ্ঠা হইবে না। কেন্দ্রীয় কর্তাদের অভিরুচি কি প্রকার তাহা এখনও অজ্ঞাত। রাষ্ট্রভাষা হিন্দী হইবে কি হিন্দুস্থানী হইবে তাহা লইয়া এখনও বিবাদ চলিতেছে। গণপরিষদে হিন্দীর জয় হইলে সরকারী পরিভাষা সংস্কৃতপ্রধান হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। হিন্দুস্থানীর জয় হইলে ফারসী শব্দের বাহুল্য হইবে এবং সেরূপ পরিভাষা বাঙালী ওড়িয়া মারাঠী গুজরাটী দ্রাবিড়ী প্রভৃতির পক্ষে সংস্কৃত অপেক্ষা সুখবোধ্য সুখোচ্চার্য বা সুশ্রাব্য হইবে না। ইহাও সম্ভবপর যে প্রবল মতভেদের ফলে বর্তমান ইংরেজী পরিভাষাই বজায় থাকিবে। কেরানী, কনস্টেবল, নির্মাণবিৎ ভাল, কিংবা করণিক, আরক্ষিক, বাস্তুকার ভাল এ বিতর্ক এখন তুচ্ছ। ভাবিবার বিষয় এই–ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজভাষার উপর কোন্ ভারতী ভর করিবেন, সংস্কৃত না ফারসী, না ইংরেজী?
সাহিত্য-সংস্কার
সব দিকে শুভলক্ষণ দেখা যাইতেছে। হিন্দু-মুসলমানের বিবাদ মিটিয়াছে, মিস মেয়ো অনুতাপে দগ্ধ হইতেছেন, স্টেটসম্যান বর্জন ও ইংলিশম্যানের অর্জন জোর চলিতেছে, রিফর্ম কমিশনও নিশ্চয় বয়কট হইবে। কিন্তু আসল কাজই বাকী রহিয়াছে–খুড়ার গঙ্গাযাত্রা।
সজ্ঞানে তীরস্থ করার উপযোগী খুড়া পাওয়া দুর্লভ। কিন্তু বিস্তর লেখক আছেন, ছোট বড় মাঝারি,–তাদের দুরস্ত করাই এখন মস্ত কাজ। লেখকগণের নিজের চরিত্র সংশোধনের কথা বলিতেছি না। কিন্তু তাদের সৃষ্ট নায়ক-নায়িকার চরিত্র, তারা কি বলে কি করে, তাহা উপেক্ষার বিষয় নয়।
গীতায় ভগবান একটি খাঁটী কথা বলিয়া গেছেন-কিং কর্ম কিং অকর্মেতি কবয়োইপাত্র মোহিতাঃ–অর্থাৎ কি কর্ম আর কি অকর্ম সে বিষয়ে কবিদের কাণ্ডজ্ঞান নাই। এই কাণ্ডজ্ঞানের অভাবে যে সব অনর্থ ঘটিয়াছে বা ঘটিতে পারে তার প্রতিকার আবশ্যক। আমাদের প্রথম কর্তব্য–বড় বড় লেখকগণ যা লিখিয়া ফেলিয়াছেন তার একটা গতি করা। দ্বিতীয় কর্তব্য– ভবিষ্যতে যাঁরা লিখিবেন তাদের জন্য একটি আদর্শ-নির্দেশ।
ছোট-খাটো লেখকগণ ধর্তব্য নন, কারণ তাদের লেখা কালক্রমে আপনিই মুছিয়া যাইবে। কিন্তু যাঁরা সম্রাট, তাদের লেখা আবশ্যক মত সংস্কার করা অবশ্যকর্তব্য। শুনিয়াছি রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখা দূরে থাক তার গানের সুরেও কাহাকেও হস্তক্ষেপ করিতে দিতে চান না। যদি সত্য হয় তবে দুঃখের বিষয়। স্টিভেনশন প্রথমে যে রেলগাড়ির এঞ্জিন সৃষ্টি করেন তার চিমনি ছিল চার হাত, হেলিয়া দুলিয়া কোনও গতিকে গজেন্দ্রগমনে ঘণ্টায় পাঁচ-দশ মাইল চলিত। আর এখনকার পঞ্জাব বম্বে মেলের এঞ্জিন দেখ, কি পরিবর্তন। কিন্তু স্টিভেনশনের মর্যাদা কিছুই কমে নাই। যদি রবীন্দ্রনাথের বাউলের সুর ওস্তাদ-পরম্পরায় সংস্কৃত হইয়া বাগেশ্রী-চৌতালে পরিণত হয়, তবে তার ক্ষুণ্ণ হওয়া অনুচিত, কারণ ক্রমোন্নতিই জগতের নিয়ম। যদি কোন দক্ষ ব্যক্তি গোরার উন্নত সংস্করণে পরেশবাবুর বড় মেয়ে লাবণ্যর সঙ্গে পানুবাবুর বিবাহ দেয়, তবে দেখিতে শুনিতে ভালই হয়। অধিকন্তু, যদি রেললাইনের উপরেই সানাই বাজাইয়া মোটর চালানো যায়, অর্থাৎ নরেশচন্দ্রের কমলের সঙ্গে যদি শরৎচন্দ্রের কিরণময়ীর শুভবিবাহ সংঘটিত হয় এবং তদুপলক্ষে যতীন্দ্র সিংহ মহাশয়ের চাকারভর্তি সাহেব সঙ্গত রচনা করেন, তবে মস্ত একটা সামাজিক সমস্যার সমাধান হইয়া যায়। এই উপায়ে প্রবীণ নবীন সমস্ত বড় বড় লেখকদের রচনা অদল বদল করিয়া ছাঁটিয়া তালি দিয়া নির্দোষ চিরস্থায়ী সাহিত্যে পরিণত করা যাইতে পারে।
আমাদের দ্বিতীয় কর্তব্য–ভবিষ্যতের জন্য আদর্শ-নির্দেশ। এই আদর্শ এমন হওয়া চাই যাতে আর্ট ও সমাজ দুই বজায় থাকে।
আর্ট কি? এক কথায় বলা যাইতে পারে–যা ভাল লাগে তাই আর্টের অঙ্গ বা রসবস্তু, এবং তা ভদ্রজনের মুখরোচক করিয়া পরিবেশন করাই আর্ট। অবশ্য একই বস্তু সকলের ভাল না লাগিতে পারে, অতএব আর্টের সৃষ্টি ও উপভোগ কতকটা ব্যক্তিগত। কিন্তু এমন জিনিস অনেক আছে যা অনেকেরই ভাল লাগে কেবল মাত্রার তারতম্য লইয়াই বিবাদ। সকলেই বলে–দুধ অতি উপাদেয় বস্তু, কিন্তু কেউ ঢকঢক করিয়া খায়, কেউ একটু আধটু খায়। পেঁয়াজের দুর্গন্ধ প্রসিদ্ধ, মাত্রা-ভেদে ভদ্র-অভদ্র অনেকেরই রুচিকর। অতএব দুধ ও পেঁয়াজ দুই অপরিহার্য রসবস্তু! তথাপি, সমাজ মনে করে–দুধ যত খাওয়া যায় ততই বলবৃদ্ধি হয়, কিন্তু পেঁয়াজ বেশী মাত্রায় বিকট। তাই আমরা গতানুগতিক ভাবে দুধ-খোরকে বলি সাত্ত্বিক, পেঁয়াজ খোরকে বলি নেড়ে। ইহা অন্ধ সমাজের কথা, আমাদের অন্তরের কথা নয়। দয়া দাক্ষিণ্য ভক্তি প্রীতির কথা শুনিতে আমাদের বেশ ভাল লাগে তা অবশ্য মানি, কিন্তু কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি, খুনোখুনি-ব্যভিচার, নরমাংস, নারীমাংস –এ সকলও উপযুক্ত অনুপানের সহিত কম উপভোগ্য নয়।
সর্বভুক পাঠক হাঁ করিয়া আছে, ওস্তাদ রসস্রষ্টা কাহাকেও বঞ্চিত করিতে, কিছুই বাদ দিতে পারেন না। তিনি শান্ত করুণ রসের স্রোত বহাইবেন, আবার ষড়রিপুর বিচিত্র খেলা দেখাইয়াও তাক্ লাগাইয়া দিবেন। কিন্তু নিন্দকের মুখ বন্ধ করিবেন কোন্ উপায়ে? পূর্বাচার্যগণ তাহা দেখাইয়া গেছেন। ভারতচন্দ্র পায়সান্ন পরিবেশনের সঙ্গে কালীনামের গরম মসলা দিয়া শুটকী মাছ চালাইয়াছিলেন। কিন্তু এ যুগে তাহা চলিবে না, কারণ উক্ত মাছের নূতনত্ব নাই, কালীনামেরও আর তেমন হজম করাইবার ক্ষমতা নাই। মনীষী রেনল্ডস ও তাঁর ভারতীয় শিষ্যগণ উৎকৃষ্টতর উপায় অবলম্বন করিয়াছেন, তাঁরা যথাসাধ্য আর্টের কেরামতি করিয়া অবশেষে দেখাইয়াছেন ধর্মের জয়, অধর্মের ক্ষয়। ইহাই নিন্দকের প্রকৃষ্ট প্রত্যুত্তর। এখন আর্টের সীমা আরও বর্ধিত হইয়াছে, প্রাচীন লেখকগণ যা স্বপ্নেও ভাবেন নাই এমন নব নব রসবস্তু আবিষ্কৃত হইয়াছে, আলকাতরা হইতে স্যাকারিন, বানরের অঙ্গে নব যৌবনের গ্রন্থি, ছাগলের মনের গোপন কোণে উদ্দাম প্রেমের আদিধারা। কিছুই বাদ দিবার দরকার নাই, যা কিছু ব্যাপার হইয়া থাকে বা ঘটিতে পারে তা-ই আর্টের গণ্ডিতে পড়ে। কিন্তু শেষ রক্ষা চাই। যত ইচ্ছা নরক মন্থন করিয়া রত্ন উদ্ধার কর, কিন্তু উপসংহারে সমস্ত পাপাত্মার নাক কাটিয়া দাও।
একটি উদাহরণ দিয়া বুঝাইয়া দিব, কিন্তু প্লট মনে আসিতেছে না। অপরের প্লট যে আত্মসাৎ করিব তার জো নাই,–আজকালকার ছোকরারা অতি চালাক, রুশিয়া হইতে চুরি করিলেও ধরিয়া ফেলিবে। অতএব ঋণ স্বীকার করিয়াই চন্দ্রশেখর হইতে দু-একটি চরিত্র লইব। বঙ্কিমচন্দ্র শৈবলিনীকে মন্দ আঁকেন নাই, তবে প্রায়শ্চিত্তটা বেশী হইয়াছে,–আজকাল অত না হইলেও চলে। কিন্তু আধুনিক আর্টের ব্যাপ্তি না জানায় প্রতাপকে তিনি একেবারে পঙ্গু করিয়া ফেলিয়াছেন। এই প্রতাপের চরিত্র আমূল সংশোধিত করিয়া কিঞ্চিৎ নমুনা দেখাইতেছি।–
প্রতাপ রায় মরে নাই। ঘা সারিবামাত্র সে চন্দ্রশেখরের বাড়ি আসিয়া হাঁকিল ভটচায, ও ভটচার্য।
চন্দ্রশেখর নামাবলী গায়ে খড়ম পায়ে আসিয়া বলিলেন,-কে ও, প্রতাপ যে। বেশ সেরেচ বাবা?
প্রতাপ একটি তাড়ি-রঙের ধুতির উপর তাড়ির ভাঁড়ের রঙের মেরজাই পরিয়া আসিয়াছে। তার চোখ লাল, দৃষ্টি উদভ্রান্ত। টলিতে টলিতে বলিল– শৈবলিনীকে ডেকে দিন।
চন্দ্রশেখর মাথা নীচু করিয়া একটু ভাবিয়া বলিলেন–নাই বা দেখা করলে।
–দেখা করতে আমি আসি নি, একেবারে নিয়ে যেতে এসেছি। ডাকুন শীগগির।
–সে কি প্রতাপ? তিনি যে কুল-বধূ।
-হলেনই বা, এক কুল ছেড়ে অন্য কুলে যাবেন, আমি তো আর লরেন্স ফস্টর নই। সব ঠিক করেছি, তোকি খ প্রস্তুত, তাজই শৈবলিনীকে মোছলমান বানিয়ে দেবে, তার পর আপনাকে তাল্লাক, আমার সঙ্গে নিকে। আমার নাম এখন আফতাব খাঁ। ভয় নেই ঠাকুর, জাত যাবে না, কালই আবার রামানন্দ স্বামীকে ধরে দুজনে শুদ্ধি নিয়ে নেব।
চন্দ্রশেখর বসিয়া পড়িয়া বলিলেন–তুমি কি জাল-প্রতাপ?
প্রতাপ বজ্রনিনাদে বলিল–আমি জাল! মূর্খ ব্রাহ্মণ, কাহার সম্পত্তি তুমি ভোগ করিতে চাও? একই বৃন্তে দুটি ফুল কে ছিঁড়িয়াছিল? (মূল গ্রন্থ দেখ) ভণ্ড জ্যোতিষী, শৈবলিনীর অন্তরের কথা বিবাহের পূর্বে গণিয়া দেখ নাই?
চন্দ্রশেখর কাতর কণ্ঠে কহিলেন–খুবই অন্যায় হয়ে গেছে বাবা। স্ত্রী চরিত্র তো জ্যোতিষে গণা যায় না। এই কলিকালে যে বিবাহের পূর্বে প্রেম হতে পারে তা জানতুমই না। যেতে দাও বাবা, যেতে দাও–যা হবার হয়ে গেছে। বেচারী এখন শান্তিতে আছে, সংসারধর্ম করচে, পুরনো কথা সব ভুলেচে। আহা, আর তাকে উদ্ব্যস্ত করো না।
প্রতাপ উন্মত্তের ন্যায় হাসিয়া বলিল–এই বিদ্যে নিয়ে তুমি পণ্ডিতি কর? যে অন্তরে অন্তরে আমারই, তাকে তুমি কোন্ অধিকারে আটকে রাখবে? বল ব্রাহ্মণ, বল বল। যে আমার শৈশব-সঙ্গিনী, সে আজু কঁহা মেরী হৃদয়কী-ঈ-ঈ-(স্টার থিয়েটার দেখ)।
চন্দ্রশেখর ভীত হইয়া বলিলেন–একটু ঠাণ্ডা হও বাবা। আমি বুঝিয়ে দিচ্চি।–পাপের স্পর্শ হতে কেউ রক্ষা পায় না, শৈবলিনীও ছেলেবেলায় পাপে পড়েছিলেন।
–অ্যাঁ! পূর্বরাগ পাপ?
–সর্বত্র পাপ নয় বাবা। কিন্তু যেখানে স্বাধীন বিবাহ চলিত নেই, সেখানে পূর্বরাগের ফলে পরে শান্তিভঙ্গ হতে পারে, সেজন্যই পাপ।
–তবে পাপীয়সীকে ছেড়ে দাও না ঠাকুর।
–খাপ্পা হয়ো না বাবা। পাপ হলই বা–ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথিনি,–অমন একটু-আধটু পাপ আমরা সবাই করে থাকি। কিন্তু সেটা নির্মূল করাও যায়। শৈবলিনী মন্ত্রলাভ করেছেন, যে মন্ত্রবলে চিরপ্রবাহিত নদী অন্য খাতে চালানো যায়। (মূল গ্রন্থ দেখ)
-বুঝেচি বুঝেচি, বুজরুকি করে তাকে আটকে রাখতে চাও! ও চলবে না ঠাকুর, তুমি তাকে আটকাবার কে? আমার শৈবলিনীকে চাই, এক্ষুনি এক্ষুনি। উচাটন মন যারে ধরিবারে ধায়, তারে কেন-ক্যানও-কেন নাহি পায়! (স্টার থিয়েটার দেখ)
চন্দ্রশেখর খাড়া হইয়া উঠিয়া বলিলেন–ক্যানও নাহি পায় তা আমি বুঝিয়ে দিচ্চি। রামচরণ, অ রামচরণ–
রামচরণ এখন ভটচা-বাড়িতেই কাজ করে। সাড়া দিল–আজ্ঞে।
–ওরে নিয়ে আয় তো আমার ছড়িটা, সেই বেতের লিলিকে ছড়ি। বাঁশের লাঠিটা নয়, বুঝেচিস্?
প্রতাপ বলিল–ছড়ি কি হবে, ভটচায?
–তোমায় লাগাব। দু-এক ঘা খেলেই বুদ্ধি সাফ হয়ে যাবে। রামচরণ, জদি
প্রতাপ লাফাইয়া উঠিয়া বলিল–আঁ, মারবে? প্রতাপ রায়ের গায়ে হাত? তবে রে পাজী, শুয়ার–
–অ রামচরণ, বেতের ছড়িতে হবে না রে, বাঁশের লাঠিটাই আ—
প্রতাপ সদর্পে পলায়ন করিল। আর্ট ও সমাজধর্ম দুই বজায় রহিল, অথচ লাঠি ভাঙিল না।
[চিরকুমার সভা সম্বন্ধে দুটো আপত্তি জানিয়েছিলেন। এমন মজার একটা ঘটনায় কবি কেন এক বালবিধবা চরিত্র রাখলেন–শৈলবালা-অবলাকান্তবাবু। দ্বিতীয় ব্যাপারটি ভয়ানক–কবি ভাবলেন না ফেণী পূর্ণকে বিয়ে করে চলে গেলে একা বৃদ্ধ চন্দ্রবাবুকে কে দেখবে; উচিত ছিল ওঁরও একটা বিয়ে দেওয়া। জগত্তারিণী হলেও চলত। এটি বলেছিলেন ওঁর দৌহিত্রী, আমার মাকে। –স:।]