- বইয়ের নামঃ পরশুরামের গল্প
- লেখকের নামঃ রাজশেখর বসু
- প্রকাশনাঃ তিতপাবন পাবলিশার
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
অক্রুরসংবাদ
অক্রুরসংবাদ
নমস্কার মশাই। আপনার পাশে একটু বসবার জায়গা হবে? ঢাকুরে লেকের ধারে একটা বেঞ্চে একলা বসে আছি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে দেখে ওঠবার উপক্রম করছি এমন সময় আগন্তুক ভদ্রলোকটি উক্ত প্রশ্ন করলেন। আমি উত্তর দিলুম, নিশ্চয় নিশ্চয়, বসবেন বই কি, ঢের জায়গা রয়েছে।
লোকটির বয়স পঞ্চাশ—পঞ্চান্ন, লম্বা রোগা ফরসা, মাথায় কাঁচা—পাকা চুল, সযত্নে সিঁথিকাটা, মওলানা আবুল কালাম আজাদের মতন গোঁফ—দাড়ি। পরনে মিহি ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি আর উড়ুনি, হাতে রুপো—বাঁধানো লাঠি। দেখলেই মনে হয় সেকেলে শৌখিন বড়লোক। পকেট থেকে একটা বড় কাগজ বার করে বেঞ্চের এক পাশে বিছিয়ে তার ওপর বসে পড়ে বললেন, আমি হচ্ছি অক্রুর নন্দী। মশায়ের নামটি জানতে পারি কি?
আমি বললুম, নিশ্চয় পারেন, আমার নাম সুশীলচন্দ্র চন্দ্র।
—আপনার কি বাড়ি ফেরবার তাড়া আছে? না থাকে তো খানিকক্ষণ বসুন না, আলাপ করা যাক। দেখুন, আমি হচ্ছি একটু খাপছাড়া ধরনের, লোকের সঙ্গে সহজে মিশতে পারি না, যার তার সঙ্গে বনেও না।
আমি হেসে প্রশ্ন করলুম, তবে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চাচ্ছেন কেন? যদি না বনে?
অক্রুর নন্দী ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে চেয়ে বললেন, আমি চেহারা দেখে মানুষ চিনতে পারি। আপনার বয়স চল্লিশের নীচে, কি বলেন?
—আজ্ঞে হাঁ।
—তা হলে বনবে। বুড়োদের সঙ্গে আমার মোটেই বনে না, তাদের হাড় চামড়া মন সব শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। ভাবছেন লোকটা বলে কি, নিজেও তো বুড়ো। বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু আমার মন শুকিয়ে যায় নি।
—অর্থাৎ আপনি এখনও তরুণ আছেন।
অক্রুরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, তরুণ ফরুন নই। আমি হচ্ছি একজন বোদ্ধা অর্থাৎ ফিলসফার, জগৎটাকে হ্যাংলা বোকার মতন গবগব করে গিলতে চাই না, চেখে চেখে চিবিয়ে চিবিয়ে ভোগ করতে চাই। চলুন না আমার বাড়ি, খুব কাছেই। রাত্রের খাবারটা আমার সঙ্গেই খাবেন, আমার জীবনদর্শনও আপনাকে বুঝিয়ে দেব।
ভদ্রলোকের মাথায় একটু গোল আছে তাতে সন্দেহ নেই। বললুম, আজ তো বাড়িতে বলে আসি নি, ফিরতে দেরি হলে সবাই ভাববে যে।
—বেশ কাল এই সময়ে এখানে আসবেন, আমি আপনাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাব, সেখানেই আহার করবেন। ভাবছেন লোকটা আবুহোসেন নাকি? কতকটা তাই বটে! একা একা থাকি, কথা কইবার উপযুক্ত মানুষ খুঁজে বেড়াই, কিন্তু লাখে একজনও মেলে না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনিও একজন বোদ্ধা। কি করা হয়?
—কলেজে ফিলসফি পড়াই।
—বাহা বাহা! তবেই দেখুন আমি কি রকম মানুষ চিনতে পারি।
সবিনয়ে বললুম, যা ভাবছেন তা নই, আমার বিদ্যা বুদ্ধি অতি সামান্য। পুরুত যেমন করে যজমানদের মন্ত্র পড়ায় আমিও তেমনি করে ছাত্রদের পড়াই। নিজেও কিছু বুঝি না, তারাও কিছু বোঝে না।
—ও কথা বলে আমাকে ভোলাতে পারবেন না। আচ্ছা, এখন আলোচনা থাক, আপনি বোধ হয় ওঠবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন, আপনাকে আর আটকে রাখব না। কাল ঠিক আসবেন তো?
অক্রুর নন্দী বাতিকগ্রস্ত বটে, কিন্তু শেক্সপীয়ার যেমন বলেছেন—এঁর পাগলামিতে শৃঙ্খলা আছে। লোকটিকে ভাল করে জানবার জন্য খুব কৌতূহল হল। বললুম, আজ্ঞে হাঁ, ঠিক আসব।
পরদিন যথাকালে উপস্থিত হয়ে দেখলুম অক্রুরবাবু বেঞ্চে বসে আছেন। আমাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আসুন আসুন সুশীলবাবু। এখানে সময় নষ্ট করে কি হবে, আমার বাড়ি চলুন। খুব কাছেই, এই সাদার্ন অ্যাভিনিউ—এর পাশ থেকে বেরিয়েছে হর্ষবর্ধন রোড, তারই দশ নম্বর হচ্ছে আমার বাড়ি।
যেতে যেতে আমি বললুম, যদি কিছু মনে না করেন তো জিজ্ঞাসা করি—মশায়ের কি করা হয়?
অক্রুরবাবু প্রতিপ্রশ্ন করলেন, আপনি আত্মা মানেন?
—বড় কঠিন প্রশ্ন। আমার একটা আত্মা জন্মাবধি আছে বটে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলেও যাচ্ছে, কিন্তু জন্মের আগেও সেই আত্মাটা ছিল কিনা তা তো জানি না।
—ও, আপনি হচ্ছেন আত্মাবাদী অ্যাগনস্টিক। আপনার বিশ্বাস আপনার থাকুক, তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জন্মান্তরীণ আত্মা মানি। আমার গত জন্মের আত্মাটি খুব চালাক ছিল মশাই, বেছে—বেছে বড়লোকের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছে।
—আপনি ভাগ্যবান লোক।
—তা বলতে পারেন। বাবা এত টাকা রেখে গেছেন যে, রোজগারের কোনও দরকারই নেই। অন্নচিন্তা থাকলে উচ্চচিন্তা করতে পারতুম না। আমি বেকার অলস লোক নই, দিনরাত গবেষণা করি কিসে মানুষের বুদ্ধি বাড়বে, সমাজের সংস্কার হবে। কিন্তু মুশকিল কি জানেন? আমি অন্তত দুশ বৎসর আগে জন্মেছি, এখনকার লোকে আমার থিওরি বুঝতেই পারে না।
—আমিই যে বুঝব সে ভরসা করছেন কেন?
—বুঝবেন, একটু চেষ্টা করলেই বুঝবেন। আপনার দুই কানের ওপরে একটু ঢিপি মতন আছে, ওই হল বোদ্ধার লক্ষণ। আসুন, এই আমার আস্তানা অক্রুরধাম। পৈতৃক বাড়িটি কাকারা পেয়েছেন, এ বাড়ি আমি করেছি।
অক্রুরধাম বিশেষ বড় নয় কিন্তু গড়ন ভাল। বারান্দায় চার—পাঁচ জন দারোয়ান চাকর ইত্যাদি একটা বেঞ্চে বসে গল্প করছিল, মনিবকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল। অক্রুরবাবু হাতের ইশারায় তাদের বসতে বলে আমাকে তাঁর বৈঠকখানা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটি মাঝারি, আসবাব অল্প, কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন।
ঘরে ঢোকবার সময় দরজার পাশের দেওয়ালে আমার হাত ঠেকে গিয়েছিল। দেখলুম একটু আঁচড়ে গেছে। অক্রুরবাবু তা লক্ষ্য করে বললেন, খোঁচা খেয়েছেন বুঝি? ভয় নেই ওষুধ দিচ্ছি। এই বলে তিনি আমার হাতে বেগনী কালির মতন কি একটা লাগিয়ে দিলেন।
আমি বললুম, আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, ও কিছুই নয়, একটু ছড়ে গেছে। বোধ হয় ওখানে একটা পেরেক আছে।
—একটা নয় মশাই, সারি সারি পিন বসানো আছে, হাত দিলেই ফুটবে। কেন লাগাতে হয়েছে জানেন? ভারতবর্ষ হচ্ছে বাঁকা শ্যাম ত্রিভঙ্গ মুরারির দেশ। এখানকার লোকে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে না, চাকর ধোবা গোয়ালা নাপিত যেই হ’ক—এমন কি অনেক শিক্ষিত লোকও—দরজায় বা দেওয়ালে হাতের ভর দিয়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। সে শ্রীকৃষ্ণের আমল থেকে চলে আসছে, অজন্টার ছবিতে আর পুরী মাদুরা রামেশ্বর প্রভৃতির মন্দিরে একটাও সোজা মূর্তি পাবেন না। বাড়ির চাকর আর আগন্তুক লোকদের গা—হাত লেগে দেওয়াল আর দরজা ময়লা হয়, কিছুতেই বদভ্যাস ছাড়াতে পারি না। নিরুপায় হয়ে মেঝে থেকে এক ফুট বাদ দিয়ে দেওয়াল আর দরজার ছ ফুট পর্যন্ত, মায় সিঁড়ির রেলিংএ সারি সারি গ্রামোফোন পিন লাগিয়েছি, প্রায় দু লক্ষ পিন। এখন আর বাছাধনরা অজন্টা প্যাটার্নে ত্রিভঙ্গ হয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে পারে না, দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে বসতেও পারে না।
—বাড়িতে চাকর টিঁকে থাকে কি করে?
—মাইনে আড়াইগুণ করে দিয়েছি। কেউ কেউ ভুলে ঠেস দিয়ে জখম হয়, তাই এক বোতল জেনশ্যান ভায়োলেট লোশন রেখেছি। খুব ভাল আণ্টিসেপটিক আর দাগও তিন—চার দিন থাকে, তা দেখে লোকে সাবধান হয়।
—কিন্তু বাচ্চাদের সামলান কি করে? বাড়িতে ছেলেপিলে আছে তো?
আট্টহাস্য করে অক্রুরবাবু বললেন, ছেলে হচ্ছি আমি, আর পিলে ওই চাকরগুলো।
—সেকি, আপনার সন্তানাদি নেই?
—দেখুন সুশীলবাবু, বিবাহ করব না অথচ সন্তানের জন্ম দেব এমন আহাম্মক আমি নই।
—কেন বিবাহ করেন নি?
—চেষ্টা ঢের করেছি, কিন্তু হয়ে ওঠে নি। তবে ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না।
—আপনার মতন লোকের এ পর্যন্ত পত্নীলাভ হয়নি এ বড় আশ্চর্য কথা। আপনি ধনী সুপুরুষ সুশিক্ষিত জ্ঞানী—
—আমার আরও অনেক গুণ আছে। নেশা করি না, পান তামাক চা প্রভৃতি মাদকদ্রব্য স্পর্শ করি না, মাছ মাংস ডিম পেঁয়াজ লঙ্কা হলুদ প্রভৃতি আমার রান্নাঘরে ঢুকতে পায় না। আমি গান্ধীজীর থিওরি মানি, তরকারির খোসা বাদ দেওয়া আর মসলা দিয়ে রাঁধা অত্যন্ত অন্যায়। তিনি রশুন খেতেন, আমি তাও খাই না। নুনও কমিয়ে দিয়েছি, তাতেও ব্লাড—প্রেশার বাড়ে।
—দুধ খান তো?
—তা খাই, কিন্তু বাছুরকে বঞ্চিত করি না। বাড়িতে তিনটে গরু আছে, বাছুরের জন্য যথেষ্ট দুধ রেখে বাকীটা নিজে খাই।
অক্রুরবাবুর কথা শুনে বুঝলুম আজ রাত্রে আমার কপালে উপবাস আছে। মনে পড়ল, বড় রাস্তার মোড়ে সাইনবোর্ড দেখেছি—ঔদরিক এম্পোরিয়াম। ফেরবার সময় সেখানেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যাবে।
অক্রুরবাবু বললেন, ও ঘরে চলুন, খেতে খেতেই আলাপ করা যাবে। শাস্ত্রে বলে, মৌনী হয়ে খাবে। তা আমি মানি না, বিলিতী পদ্ধতিতে গল্প করতে করতে ধীরে ধীরে খেলেই ভাল হজম হয়।
খাবার এল। অক্রুর নন্দী খেয়ালী লোক হলেও তাঁর কাণ্ডজ্ঞান আছে, আমার জন্য ভাল ভাল খাবারেরই আয়োজন করেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের জন্য এল খান কতক মোটা রুটি কিছু সিদ্ধ তরকারি, কিছু কাঁচা তরকারি আর এক বাটি দুধ।
অক্রুরবাবু বললেন, কোনও জন্তু ক্যালরি প্রোটিন ভাইটামিন নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমাদের গুহাবাসী পূর্বপুরুষরা জন্তুর মতনই কাঁচা জিনিস খেতেন, তাতেই তাঁদের পুষ্টি হত। সভ্য হয়ে সেই সদভ্যাস আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখন কাঁচা লাউ কুমড়ো অনেকেই হজম করতে পারে না, তাই আপনাকে দিই নি। আমি কিন্তু কাঁচা খাওয়া অভ্যাস করেছি, একটু একটু করে ঘাস খেতেও শিখছি। যাক ও কথা। আপনার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে একটা প্রশ্ন আপনার কণ্ঠাগত হয়ে আছে। চক্ষুলজ্জা করবেন না, অসংকোচে বলে ফেলুন।
আমি বললুম, কিছু যদি মনে না করেন তো জিজ্ঞাসা করি—আপনি বলেছেন যে, বিবাহের জন্য ঢের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু হয়ে ওঠে নি। কেন হয়ে ওঠে নি বলবেন কি?
—আরে সেই কথা বলতেই তো আপনাকে ডেকে এনেছি। শুনুন। দাম্পত্য হচ্ছে তিন রকম। এক নম্বর যাতে স্বামীর বশে স্ত্রী চলে, যেমন গান্ধী—কস্তুরবা। দু—নম্বর, যাতে স্বামীই হচ্ছে স্ত্রীর বশ, অর্থাৎ স্ত্রৈণ ভেড়ো বা হেনপেক, যেমন জাহাঙ্গীর—নূরজাহান। দুটোই হল ডিক্টেটারী ব্যবস্থা, কিন্তু দুক্ষেত্রেই দম্পতি সুখী হয়। তিন নম্বর হচ্ছে, যাতে স্বামী—স্ত্রী কিছুমাত্র রফা না করে নিজের নিজের মতে চলে, অর্থাৎ দুজনেই একগুঁয়ে। এই হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কিছুমাত্র রফা না করে নিজের মতে চলে, অর্থাৎ দুজনেই একগুঁয়ে। এই হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য—মূলক আদর্শ দাম্পত্য—সম্বন্ধ কিন্তু এর পদ্ধতি বা টেকনিক লোকে এখনও আয়ত্ত করতে পারে নি।
—আপনি নিজে কিরকম দাম্পত্য পছন্দ করেন?
তিন রকমেরই চেষ্টা করেছি, কিন্তু এ পর্যন্ত কোনওটাই অবলম্বন করতে পারি নি। তার ইতিহাস আপনাকে বলব। যখন বয়স কম ছিল তখন আর পাঁচ জনের মতন এক নম্বর দাম্পত্যই পছন্দ করতুম। যেমন বাঁদর ষাঁড় ছাগল মোরগ প্রভৃতি জন্তু তেমনি মানুষেরও পুংজাতি সাধারণত প্রবল, তারাই স্ত্রীজাতি শাসন করতে চায়। কিন্তু মুশকিল কি হল জানেন? কাকেও পীড়ন করা আমার স্বভাব নয়, কিন্তু আমার সংসারযাত্রার আদর্শ এত বেশী র্যাশন্যাল যে কোনও স্ত্রীলোকই তা বরদাস্ত করতে পারেন না।
—পরীক্ষা করে দেখেছিলেন?
—দেখেছিলুম বইকি। আমার বয়স যখন চব্বিশ তখন আমার মেজকাকী তাঁর এক দূর সম্পর্কের বোনঝির সঙ্গে আমার সম্বন্ধ করলেন, আমাদের সমাজে কোর্টশিপের চলন তখনও হয় নি, অভিভাবকরাই সম্বন্ধ স্থির করতেন। আমার বাপ—মা তখন গত হয়েছেন, কাকাদের সঙ্গেই থাকতুম। আমি মেজকাকীকে বললুম বিয়েতে মত দেবার আগে তোমার বোনঝিকে আমার মনের কথা জানাতে চাই। কাকী বললেন, বেশ তো, যত খুশি জানিও, আমি না হয় আড়ালে থাকব। তার পর একদিন মেয়েটিকে আনা হল। আমি তাকে একটি লেকচার দিলুম।—শোন উজ্জ্বলা, আমি স্পষ্টবক্তা লোক, আমার কথায় কিছু মনে ক’রো না যেন। তুমি দেখতে ভালই, ম্যাট্রিক পাশ করেছ, শুনেছি গান বাজনা আর গৃহকর্মও জান। ওতেই আমি তুষ্ট। তুমিও আমাকে বিয়ে করলে ঠকবে না, একটি সুশ্রী বলিষ্ঠ বিদ্বান ধনবান আর অত্যন্ত বুদ্ধিমান স্বামী পাবে আমার নতুন বাড়ির সর্বেসর্বা গিন্নী হবে, বিস্তর টাকা খরচ করতে পারবে। কিন্তু তোমাকে কতকগুলো নিয়ম মেনে চলতে হবে। দু—এক গাছা চুড়ি ছাড়া গহনা পরতে পাবে না, শৃঙ্গী নখী আর দন্তী প্রাণীর মতন সালংকরা স্ত্রীও ডেঞ্জারস। নিমন্ত্রণে গিয়ে যদি নিজের ঐশ্বর্য জাহির করতে চাও তো ব্যাঙ্কের একটা সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে যেতে পার। সাজগোজেও অন্য মেয়ের নকল করবে না, আমি যেমন বলব সেইরকম সাজবে। আর শোন—ছবি টাঙিয়ে দেওয়াল নোংরা করবে না, নতুন নতুন জিনিস আর গল্পের বই কিনে বাড়ির জঞ্জাল বাড়াবে না, গ্রামোফোন আর রেডিও রাখবে না। ইলিশ মাছ কাঁকড়া পেঁয়াজ পেয়ারা আম কাঁঠাল ত্যাগ করতে হবে, ওসবের গন্ধ আমার সয় না। পান খাবে না, রক্তদন্তী স্ত্রী আমি দু চক্ষে দেখতে পারি না। সাবান যত খুশি মাখবে, কিন্তু এসেন্স পাউডার নয়, ওসব হল ফিনাইল জাতীয় জিনিস দুর্গন্ধ চাপা দেবার অসাধু উপায়। এই রকম আরও অনেক বিধিনিষেধের কথা জানিয়ে তাকে বললুম, তুমি বেশ করে ভেবে দেখ, তোমার বাপ—মার সঙ্গে পরামর্শ কর, যদি আমার শর্ত মানতে পার তবে চার—পাঁচ দিনের মধ্যে খবর দিও। কিন্তু এক হপ্তা হয়ে গেল, তবু কোনও খবর এল না।
—বলেন কি!
—অবশেষে আমিই মেজকাকীকে জিজ্ঞাসা করলুম, ব্যাপার কি? তিনি পাত্রীর বাড়িতে তাগাদা পাঠালেন। তারপর আমি একটা পোস্টকার্ড পেলুম। পাত্রীর দাদা ইংরিজীতে লিখেছে—গো টু হেল।
—কন্যাপক্ষ দেখছি অত্যন্ত বোকা, আপনার মত বরের মূল্য বুঝল না।
—হাঁ, বেশীর ভাগই ওই রকম বোকা, তবে গোটাকতক চালাক কন্যাপক্ষও জুটেছিল। তাদের মতলব, ভাঁওতা দিয়ে আমার ঘাড়ে মেয়ে চাপিয়ে দেওয়া। তখন একটা নতুন শর্ত জুড়ে দিলুম—ভবিষ্যতে আমার স্ত্রী যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তবে তখনই তাকে বিদেয় করব। খোরপোষ দেব, কিন্তু আমার সম্পত্তি সে পাবে না। এই কথা শুনে সব ভেগে পড়ল। জ্ঞাতিশত্রুরাও রটাতে লাগল যে আমি একটা উন্মাদ। কিন্তু একটি মেয়ে সত্যই রাজী হয়েছিল। অত্যন্ত গরিবের মেয়ে, দেখতেও তেমন ভাল নয়। আমার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনে তখনই বললে যে, সে রাজী। আমি বললুম, অত তাড়াতাড়ি নয়, তোমার বাপ—মায়ের মত নিয়ে জানিও। পরদিন খবর এল বাপ—মাও খুব রাজী। আমার সন্দেহ হল। খোঁজ নিয়ে জানলুম, রূপ আর টাকার অভাবে তার পাত্র জুটছে না। বাপ—মা অত্যন্ত সেকেলে, মেয়েকে কেবল অভিশাপ দেয়। এখন সে শরৎ চাটুজ্যের অরক্ষণীয়ার মতন মরিয়া হয়ে উঠেছে, নির্বিচারে যার—তার কাছে নিজেকে বলি দিতে প্রস্তুত। মেয়ের বাপের সঙ্গে দেখা করে আমি বললুম, আপনার মেয়ে শুধু আপনাকে কন্যাদায় থেকে উদ্ধার করবার জন্যই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে, আমার শর্তগুলো মোটেই বিচার করে দেখে নি। এমন বিয়ে হতে পারে না। এই নিন পাঁচ হাজার টাকা, আমি যৌতুক দিলুম, মেয়েকে আপনাদের পছন্দ মত ঘরে বিয়ে দিন। বাপ খুব কৃতজ্ঞ হয়ে বললে, আপনিই খুকীর যথার্থ পিতা, আমি জন্মদাতা মাত্র। মেয়েটি ভাল ঘরেই পড়েছিল, বিয়ের পর বরের সঙ্গে আমাকে প্রণাম করতে এসেছিল।
আমি বললুম, আপনি মহাপ্রাণ দয়ালু ব্যক্তি।
—তা মাঝে মাঝে দয়ালু হতে হয়, টাকা থাকলে দান করায় বাহাদুরি কিছু নেই। তার পর শুনুন। আমার বয়স বেড়ে চলল, পঁয়ত্রিশ পার হয়ে বুঝলুম আমার আদর্শের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে এমন কৃচ্ছ্রসাধিকা নারী কেউ নেই। তখন আমার একটা মানসিক বিপ্লব হল, যাকে বলে রিভলশন। এক নম্বর দাম্পত্য যখন হবার নয়, তখন দু নম্বরের চেষ্টা করলে দোষ কি? আমার অনেক আত্মীয় তো স্ত্রীর বশে বেশ সুখে আছে। স্ত্রৈণতাও সংসারযাত্রার একটি মার্গ। জগতে কর্তাভজা বিস্তর আছে, তারা বিচারের ভার কর্তার ওপর ছেড়ে দিয়ে দিব্যি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে। যা করেন গুরুমহারাজ, যা করেন পণ্ডিতজী, যা করেন কমরেড স্তালিন আর মাও—সে—তুং। তেমনি গিন্নীভজাও অনেক আছে। তারা বলে, আমার মতামতের দরকার কি, যা করেন গিন্নী।
—কিন্তু আপনার স্বভাব যে অন্য রকম আপনার পক্ষে গিন্নীভজা হওয়া অসম্ভব।
—অবস্থাগতিকে বা সাধনার ফলে অসম্ভবও সম্ভব হয়। একটি সার সত্য আপনাকে বলছি শুনুন। যে নারী রাজার রানী হয়, বড়লোকের স্ত্রী হয়, নামজাদা গুণী লোকের গৃহিণী হয়, সে নিজেকে মহাভাগ্যবতী মনে করে, অনেক সময় অহংকারে তার মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু রানীকে বা টাকাওয়ালী মেয়েকে যে বিয়ে করে, কিংবা যার স্ত্রী মস্ত বড় দেশনেত্রী লেখিকা গায়িকা বা নটী, এমন পুরুষ প্রথম প্রথম সংকুচিত হয়ে থাকে। সে স্বনামধন্য নয়, স্ত্রীর নামেই তার পরিচয়, লোকে তাকে একটু অবজ্ঞা করে। কিন্তু কালক্রমে তার সয়ে যায়, ক্ষোভ দূর হয়, সে খাঁটি স্ত্রৈণ হয়ে পড়ে। এর দৃষ্টান্ত জগতে অনেক আছে।
—আপনিও সে রকম হতে চেষ্টা করেছিলেন নাকি?
—করেছিলুম। কুইন ভিক্টোরিয়া, সারা বার্নহার্ড, ভার্জিনিয়া উলফ বা সরোজিনী নাইডুর মতন পত্নী যোগাড় করা অবশ্য আমার সাধ্য নয়, কিন্তু যদি একজন বেশ জবরদস্ত নামজাদা মহিলার কাছে চোখ কান বুজে আত্মসমর্পণ করতে পারি তবে হয়তো দু—নম্বর দাম্পত্যও আমার সয়ে যেতে পারে, আমার মত আর আদর্শও বদলে যেতে পারে।
—আপনার পক্ষে তা অসম্ভব মনে করি।
—আমি কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি করি নি। তখন আমার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, পুরীতে স্বর্গদ্বারের পূব দিকে নিজের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করাচ্ছি, ওশন—ভিউ হোটেলে আছি। আমার পুরোনো সহপাঠী ভূপেন সরকারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে তখন মস্ত গভর্নমেণ্ট অফিসার, ছুটি নিয়ে এসেছে, সঙ্গে আছে তার বোন সত্যভামা সরকার। দুজনে আমার হোটেলেই উঠল। সত্যভামা বিখ্যাত মহিলা, দু বার বিলাত ঘুরে এসেছে, হুণ্ডাগড়ের রানী সাহেবাকে ইংরিজী পড়ায় আর আদবকায়দা শেখায়, অনেক বইও লিখেছে। নাম আগেই শোনা ছিল, এখন আলাপ হল। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ, দশাসই চেহারা, মুখটি গোবদাগোছের, ড্যাবডেবে চোখ, নীচের ঠোঁট একটু বাইরে ঠেলে আছে। দেখলেই বোঝা যায় ইনি একজন জবরদস্ত মহীয়সী মহিলা, স্বামীকে বশে রাখবার শক্তি এঁর আছে। ভাবলুম, এই সত্যভামার কাছেই আত্মসমর্পণ করলে ক্ষতি কি। দু দিন মিশেই বুঝলুম, আমি যেমন তাকে বাজিয়ে দেখছি, সেও তেমনি আমাকে দেখছে।
—আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন শিকার কাহিনী শুনছি।
—কতকটা সেই রকম বটে। যেন একটা বাঘিনী ওত পেতে আছে, আর একটা বাঘ তার পিছনে ঘুরছে। তার পর একদিন আমার নতুন বাড়ি তদারক করতে গেছি, ভূপেন আর সত্যভামাও সঙ্গে আছে। সত্যভামা বললে, জানেন তো সমস্ত ইট বেশ করে ভিজিয়ে নেওয়া চাই, আর ঠিক তিন ভাগ সুরকির সঙ্গে এক ভাগ চুন মেশানো চাই, নয়তো গাঁথুনি মজবুত হবে না। আমার একটু রাগ হল। সাতটা বাড়ি আমি নিজে তৈরি করিয়েছি, কোনও ওভারশিয়ারের চাইতে আমার জ্ঞান কম নয়, আর আজ এই সত্যভামা আমাকে শেখাতে এসেছে!
—আপনার কিন্তু রাগ হওয়া অন্যায়, আপনি তো আত্মসমর্পণ করতেই চেয়েছিলেন। দু নম্বর দাম্পত্যে স্বামীকে স্ত্রীর উপদেশ শুনতেই হয়।
—তা ঠিক, কিন্তু হঠাৎ অনভ্যস্ত উপদেশ একটু অসহ্য বোধ হয়েছিল। তখনকার মতন সামলে নিলুম, কিন্তু পরে আবার গোল বাধল। রাত্রে হোটেলে এক টেবিলে খেতে বসেছি। সত্যভামা বললে, দেখুন মিস্টার নন্দী, আপনার খাওয়া মোটেই সায়েণ্টিফিক নয়, মাছ মাংস ডিম টোমাটো ক্যারট লেটিস এই সব খাওয়া দরকার, যা খাচ্ছেন তাতে ভাইটামিন কিচ্ছু নেই। এবারে আর চুপ করে থাকতে পারলুম না। ক্যালরি প্রোটিন অ্যামিনোঅ্যাসিড আর ভাইটামিনের হাড় হন্দ আমার জানা আছে, তার বৈজ্ঞানিক তথ্য আমি গুলে খেয়েছি, আর এই মাস্টারনী আমাকে লেকচার দিচ্ছে! রাগের বশে একটা অসত্য কথা বলে ফেললুম—দেখুন মিস সত্যভামা, ভাইটামিন আমার সয় না। সত্যভামা বললেন, সয় না কি রকম! উত্তর দিলুম, না, একদম সয় না, ডাক্তার বারণ করেছে। সত্যভামা ঘাবড়ে গিয়ে চুপ মেরে গেল।
—আপনার ধৈর্য দেখছি বড়ই কম।
—সেই তো হয়েছে বিপদ, উপদেশ আমার বরদাস্ত হয় না। তার চার দিন পরে যা হল একেবারে চূড়ান্ত। বিকেলে সমুদ্রের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখছি, শুধু আমি আর সত্যভামা, ভূপেন বোধ হয় ইচ্ছে করেই আসে নি। সত্যভামা হঠাৎ বললে, ওহে অক্রুর, তুমি গোঁফদাড়ি কালই কামিয়ে ফেল, ওতে তোমাকে মানায় না, জংলী জংলী মনে হয়। কি আস্পর্ধা দেখুন! যার ছাগল—দাড়ি বা ইঁদুরে খাওয়ার মতন বিশ্রী দাড়ি তার অবশ্য না রাখাই উচিত। কিন্তু আমার মতন যার সুন্দর নিরেট দাড়ি সে কামাবে কোন দুঃখে? সত্যভামার কথায় আমার মেজাজ গরম হয়ে উঠল। কোটি কোটি বৎসর ধরে পুরুষত্বের যে বীজ প্রাণিপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে এসেছে, যার প্রভাবে সিংহের কেশর, ষাঁড়ের ঝুঁটি, ময়ূরের পেখম আর মানুষের দাড়ি—গোঁফ উদভূত হয়েছে, সেই দুর্দান্ত পুং—হরমোন আমার মাংসে মজ্জায় কুপিত হয়ে উঠল, আমি ধমক দিয়ে বললুম, চোপ রও, ও কতা মুখে আনবে না, কামাতে চাও তো নিজের মাথা মুড়িয়ে ফেল। সত্যভামা একবার আমার দিকে কটমট করে তাকাল, তারপর উঠে চলে গেল। রাত্রে খাবার সময় ভাই বোন কাকেও দেখলুম না। পরদিন সকালের ট্রেনে আমি কলকাতা রওনা হলুম।
—তার পর আর কোথাও দু নম্বর দাম্পত্যের চেষ্টা করেছিলেন?
—রাম বল, আবার! বুঝতে পারলুম এক নম্বর দু নম্বর কোনওটাই আমার ধাতে সইবে না। তার পর হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলুম, দাম্পত্যের তিন নম্বরও আছে, যাতে স্বামী—স্ত্রী নিজের মতে চলে অথচ সংঘর্ষ হয় না। আবিষ্কারটা ঠিক আমি করি নি, রবীন্দ্রনাথই করেছিলেন—
—বলেন কি!
—হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথই করে গেছেন। কিন্তু লোকে তার গুরুত্ব বুঝতে পারে নি, তাঁর লেখা থেকে আমিই পুনরাবিষ্কার করেছি। তিনি কি লিখেছেন শুনতে চান?
অক্রুরবাবু পাশের ঘর থেকে ‘শেষের কবিতা’ এনে পড়তে লাগলেন—
অমিত রায় লাবণ্যকে বলছে—ওপারে তোমার বাড়ি, এপারে আমার।…একটি দীপ আমার বাড়ির চূড়ায় বসিয়ে দেব, মিলনের সন্ধ্যেবেলায় তাতে জ্বলবে লাল আলো, বিচ্ছেদের রাতে নীল।…অনাহুত তোমার বাড়িতে কোনো মতেই যেতে পাব না।…তোমার নিমন্ত্রণ মাসে এক দিন পূর্ণিমার রাতে।…পুজোর সময় অন্তত দু মাসের জন্যে দু জনে বেড়াতে বেরোব। কিন্তু দু জনে দু জায়গায়। তুমি যদি যাও পর্বতে আমি যাব সমুদ্রে। এই তো আমার দাম্পত্যের দ্বৈরাজ্যের নিয়মাবলি তোমার কাছে দাখিল করা গেল। তোমার কি মত? লাবণ্য উত্তর দিচ্ছে—মেনে নিতে রাজী আছি।…আমি জানি আমার মধ্যে এমন কিছুই নেই যা তোমার দৃষ্টিকে বিনা লজ্জায় সইতে পারবে, সেই জন্যে দাম্পত্যে দুই পারে দুই মহল করে দেওয়া আমার পক্ষে নিরাপদ।… তার পর লাবণ্য প্রশ্ন করছে—কিন্তু তোমার নববধূ কি চিরকালই নববধূ থাকবে? টেবিলে প্রবল চাপড় দিতে দিতে উচ্চৈচঃস্বরে অমিত বললে, থাকবে থাকবে থাকবে।
আমি বললুম, অমিত রায় হচ্ছে একটি কথার তুবড়ি। রবীন্দ্রনাথ পরিহাস করে তাকে দিয়ে যা বলিয়েছেন আপনি তা সত্য মনে করছেন কেন?
অক্রুরবাবু টেবিলে কিল মেরে বললেন, মোটেই পরিহাস নয়, একেবারে খাঁটি সত্য। তিনি সর্বদর্শী কবি ছিলেন, দাম্পত্যের যা পরাকাষ্ঠা সেই তিন নম্বরেরই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। তার ভাবার্থ হচ্ছে—স্বামী—স্ত্রী আলাদা বাড়িতে বাস করবে, কালেভদ্রে দেখা করবে, তবেই তাদের প্রীতি স্থায়ী হবে নববধূ চিরদিন নববধূ থাকবে।
—আপনি এরকম দাম্পত্যের চেষ্টা করেছিলেন?
একবার মাত্র চেষ্টা করেছিলুম, তা বিফল হয়েছে। কিন্তু বিফলতার কারণ এ নয় যে রবীন্দ্রনাথের থিওরি ভুল, আমার নির্বাচনেই গলদ ছিল। যাই হক, আর চেষ্টা করবার প্রবৃত্তি নেই।
—ঘটনাটা বলবেন কি?
—শুনুন। আমার বয়স তখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের ফরমূলাটি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে মনে হল, বাঃ, এই তো দাম্পত্যের শ্রেষ্ঠ মার্গ, চেষ্টা করে দেখা যাক না। আমার গোটাকতক বাড়ি আছে, ছোট—বড় ফ্ল্যাটে ভাগ করা, সেগুলো ভাড়া দিয়ে থাকি। একদিন একটি মহিলা আমার সঙ্গে দেখা করে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন। নাম বাগেশ্রী দত্ত, বয়স আন্দাজ চল্লিশ, কিন্নরবিদ্যাপীঠে গান বাজনা নাচ শেখান। দেখতে মন্দ নয়, আমার পছন্দ হল, ক্রমে ক্রমে আলাপও হল। ভাবলুম, এক নম্বর দাম্পত্যের আশা নেই, দু নম্বরেও রুচি নেই। এই বাগেশ্রীকে নিয়ে তিন নম্বরের চেষ্টা করা যাক। যখন আলাদা আলাদা বাস করব তখন তো আদর্শ আর মতামতের প্রশ্নই ওঠে না। তার সঙ্গে দেখা করে বললুম, শোন বাগেশ্রী, আমাকে বিয়ে করবে? আমি নিজের বসত বাড়িতে থাকব, তোমাকে আমার রসা রোডের বাড়িটা দেব, সেটাও বেশ ভাল বাড়ি। তোমাকে টাকাও প্রচুর দেব। তুমি নিজের বাড়িতে নিজের মত চলবে, আমার পছন্দ অপছন্দ মানতে হবে না। মাসে একদিন আমি তোমার অতিথি হব, আর একদিন তুমি আমার অতিথি হবে। এই শর্তে বিয়ে করতে রাজী আছ? বাগেশ্রী বললে, এক্ষুনি। খাসা হবে, আমার বাড়িতে আমার মা দিদিমা মাসী দুই ভাই আর চার বোনকে এনে রাখব, এই ফ্ল্যাটটায় তো মোটেই কুলয় না। আমি বললুম, তা তো চলবে না, তোমার বাড়িতে আমি গেলে ভিড়ের মধ্যে হাঁপিয়ে উঠব যে। বাগেশ্রী বললে তোমাকে সেখানে যেতে কে বলছে? নিজের বাড়িতেই তুমি থাকবে, আমিও তোমার কাছে থাকব। তুমি যা ন্যালাখ্যাপা মানুষ, আমি না দেখলে চাকর বাকর সর্বস্ব লোপাট করবে, বাপ রে, সে আমি সইতে পারব না। আমার পিশেমশায়ের ভাগনে প্রাণতোষ দাদাও আমার কাছে থাকবে, সেই সব দেখবে শুনবে, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। বাগেশ্রীর মতলবটি শুনে আমি তখনই সরে পড়লুম। তার পর সে তিন দিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আমি হাঁকিয়ে দিয়েছি।
আমি প্রশ্ন করলুম, উকিলের চিঠি পান নি।
অক্রুরবাবু বললেন, পেয়েছিলুম। উত্তরে জানালুম, ব্রীচ অভ প্রমিস হয় নি, আমি খেসারত এক পয়সাও দেব না। তবে বাগেশ্রী যদি দু মাসের মধ্যে তার প্রাণতোষ দাদা বা আর কাকেও বিবাহ করে তবে পাঁচ হাজার টাকা যৌতুক দিতে প্রস্তুত আছি। বাগেশ্রী তাতেই রাজী হয়েছিল।
—সকলকেই যৌতুক দিলেন, শুধু সত্যভামা বেচারী ফাঁকে পড়লেন।
—তিনিও একেবারে বঞ্চিত হন নি। পুরী থেকে চলে আসবার তিন মাস পরে একটা নিমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলুম—হুণ্ডাগড়ের খুড়া সাহেবের সঙ্গে সত্যভামার বিবাহ হচ্ছে। আমি একটি ছোট্ট পিকিনীজ কুকুর সত্যভামাকে উপহার পাঠিয়ে দিলুম, খুব খানদানী কুকুর, তার জন্য প্রায় আট শ টাকা খরচ হয়েছিল।
—এক দু তিন নম্বর সবই তো পরীক্ষা করেছেন, আপনার ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম কি?
—কিছুই স্থির করতে পারি নি। আপনি তো বোদ্ধা লোক একটা পরামর্শ দিন না।
—দেখুন অক্রুরবাবু, আপনার ওপর আমার অসীম শ্রদ্ধা হয়েছে। যা বলছি তাতে দোষ নেবেন না। আমি সামান্য লোক, শরীর বা মনের তত্ত্ব কিছুই জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি যে পুং—হরমোনের কথা বলছেন তা হরেক রকম আছে। একটাতে দাড়ি গজায়, আর একটাতে গুঁতিয়ে দেবার অর্থাৎ আক্রমণের শক্তি আসে, আর একটাতে সর্দারি করবার প্রবৃত্তি হয়। তা ছাড়া আরও একটা আছে যা থেকে প্রেমের উৎপত্তি হয়। বোধ হচ্ছে আপনার সেইটের কিঞ্চিৎ অভাব আছে। আপনি কোনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অক্রুরবাবু বললেন, তাই করা যাবে।
আমি নমস্কার করে বিদায় নিলুম। তার পরে আর অক্রুর নন্দীর সঙ্গে দেখা হয় নি। শুনেছি তিনি সমস্ত সম্পত্তি দান করে দ্বারাকাধামে তপস্বিনী জগদম্বা মাতাজীর আশ্রমে বাস করছেন। ভদ্রলোক শেষকালে আত্মসমর্পণই করলেন। আশা করি তিনি শান্তি পেয়েছেন।
১৩৫৯ (১৯৫২)
অগস্ত্যদ্বার
পঞ্চাশ—ষাট বছর আগে পাটনায় ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়ি ছিল। পুরনো শহরের গুলজারবাগ মহল্লা থেকে বাঁকিপুরের জজ—আদালত পর্যন্ত সিংগল লাইনে গাড়ি চলত। দুদিক থেকে যাতায়াতের বাধা যাতে না হয় তার জন্য এক মাইল অন্তর লুপ ছিল, অর্থাৎ লাইন থেকে একটা শাখা বেরিয়ে বিশ—পঁচিশ গজ দূরে আবার লাইনের সঙ্গে মিশত। প্রত্যেক গাড়ি লুপের কাছে এসে থামত এবং উলটো দিকের গাড়ি এলে লুপে গিয়ে পথ ছেড়ে দিত। কিন্তু সব সময় এই ব্যবস্থায় কাজ হত না। একটা গাড়ি লুপের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে, আধ ঘণ্টা হয়ে গেল তবু ও দিকের গাড়ির দেখা নেই। যাত্রীরা অধীর হয়ে বললে, চালাও গাড়ি, আর আমরা সবুর করতে পারি না। গাড়ি অগ্রসর হল, কিন্তু আধ মাইল যেতে না যেতে ও দিকের গাড়ি এসে পথরোধ করলে। তখন দুই তরফের গালাগালি শুরু হল। আরে গাধা তুই লুপে সবুর করিস নি কেন? আরে উল্লু তুই এত দেরি করলি কেন? যাত্রীরাও ঝগড়ায় যোগ দিলে, দুই গাড়ির চারটে ঘোড়াও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পা তুলে চিঁহিহি করতে লাগল। তামাশা দেখবার জন্য রাস্তায় লোক জমে গেল, ছোকরার দল হাততালি দিয়ে চেঁচাতে লাগল— হী লব লব লব। অবশেষে একজন যাত্রী বললে, ঝগড়া এখন থাক, গাড়ি চালাবার ব্যবস্থা কর। তখন দুই গাড়ির ঘোড়া খুলে পিছনে জোতা হল, এই গাড়ির যাত্রীরা ও গাড়িতে উঠল দুই গাড়িই যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে চলল। গাড়ি বদলের ফলে যাত্রীরাও তাদের গন্তব্য স্থানে পৌঁছে গেল।
এই ধরনের কিন্তু অতি গুরুতর একটা বিভ্রাট পুরাকালে ঘটেছিল। তারই ইতিহাস এখন বলছি।
একদা সত্যযুগে বিন্ধ্য গিরির অহংকার হয়েছিল, চন্দ্র—সূর্যের পথরোধ করবার জন্য সে ক্রমশ উঁচু হতে লাগল। তখন অগস্ত্য মুনি এসে তাকে বললেন, আমি দক্ষিণে যাত্রা করব, আমাকে পথ দাও। বিন্ধ্য বিদীর্ণ হয়ে একটি সংকীর্ণ পথ করে দিলে, যার নাম অগস্ত্যদ্বার। সেই গিরিসংকটের ওপারে গিয়ে বিন্ধ্যের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে অগস্ত্য বললেন, বৎস বিন্ধ্য, এ হচ্ছে কি, তুমি যে বাঁকা হয়ে বাড়ছ, ওলন ঠিক নেই, কোন দিন হুড়মুড় করে পড়ে যাবে। আমি ফিরে এসে শিখিয়ে দেব কি করে খাড়া হয়ে বাড়তে হয়, ততদিন তুমি উঁচু হয়ো না। বিন্ধ্য বললে, যে আজ্ঞে। তারপর অনেক কাল কেটে গেল কিন্তু অগস্ত্য ফিরলেন না। তখন বিন্ধ্য রেগে গিয়ে শাপ দিলে, এই অগস্ত্যদ্বারে যারা দু দিক থেকে মুখোমুখি প্রবেশ করবে তাদের বুদ্ধিভ্রংশ হবে। শাপের কথা একজন শিষ্যের মুখে শুনে অগস্ত্য বললেন, ভয় নেই, কিছুদিন পরেই বুদ্ধি ফিরে আসবে।
উক্ত পৌরাণিক ঘটনার বহু কাল পরের কথা বলছি। তখনও বিন্ধ্য পর্বতের নিকটবর্তী স্থান নিবিড় অরণ্যে আচ্ছন্ন, সেখানে লোকালয় ছিল না, কোনও রাজার শাসনও ছিল না। এই বিশাল নো ম্যানস ল্যাণ্ডের উত্তরে কলিঞ্জর রাজ্য। কলিঞ্জরের দক্ষিণে অরণ্য, তারপর দুর্লঙ্ঘ বিন্ধ্য গিরি, তারপর আবার অরণ্য, তারপর বিদর্ভ রাজ্য। কলিঞ্জরের রাজা কনকবর্মা আর বিদর্ভের রাজা বিশাখসেন দুজনেই তেজস্বী যুবক। তাঁদের মহিষীরা মামাতো—পিসতুতো ভগ্নী।
কলিঞ্জরপতি কনকবর্মা তাঁর রাজ্যের দক্ষিণস্থ বনে মাঝে মাঝে মৃগয়া করতে যেতেন। একদিন তাঁর ইচ্ছা হল বিন্ধ্য গিরি অতিক্রম করে আরও দক্ষিণে গিয়ে শম্বর হরিণ শিকার করবেন। তিনি তাঁর প্রিয় বয়স্য কহোড়ভট্টের সঙ্গে রথে চড়ে যাত্রা করলেন, পিছনে রথী পদাতিক গজারোহী অশ্বারোহী সৈন্যদল চলল।
দৈবক্রমে ঠিক এই সময়ে বিদর্ভরাজ বিশাখসেনেরও ইচ্ছা হল বিন্ধ্য পর্বত্যের উত্তরবর্তী অরণ্যে গিয়ে ব্যাঘ্রভল্লুকাদি বধ করবেন। তিনি তাঁর প্রিয় বয়স্য বিড়ঙ্গদেবের সঙ্গে রথারূঢ় হয়ে যাত্রা করলেন, চতুরঙ্গসেনা পিছনে পিছনে গেল।
বিন্ধ্যপর্বতমালা ভেদ করে একটি পথ উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে গেছে। এই পথটি বেশ প্রশস্ত, কিন্তু মাঝামাঝি এক স্থানে পূর্বোক্ত অগস্ত্যদ্বার নামক গিরিসংকট আছে, তা এত সংকীর্ণ যে দুটি রথ পাশাপাশি যেতে পারে না।
কলিঞ্জরপতি কনকবর্মা অগস্ত্যদ্বারের উত্তর প্রান্তে এসে দেখলেন রাজা বিশাখসেন সদলবলে দক্ষিণ প্রান্তে উপস্থিত হয়েছেন। দুই রাজরথ নিকটবর্তী হলে কনকবর্মা বললেন নমস্কার সখা বিশাখসেন, স্বাগতম। বিদর্ভ রাজ্যের সর্বত্র কুশল তো? চতুর্বর্গের প্রজা ও গবাদি পশু বৃদ্ধি পাচ্ছে তো? ধনধান্যের ভাণ্ডার পূর্ণ আছে তো? তোমার মহিষী আমার শ্যালিকা বিংশতিকলা ভাল আছেন তো?
প্রতিনমস্কার করে বিশাখসেন বললেন, অহো কি সৌভাগ্য যে এই দুর্গম পথে প্রিয়সখার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! মহারাজ, তোমার শুভেচ্ছার প্রভাবে আমার রাজ্যের সর্বত্র কুশল। কলিঞ্জর রাজ্যের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল তো? তোমার মহিষী আমার শ্যালিকা কম্বুকঙ্কণা ভাল আছেন? সখা, এখন দয়া করে পথ ছেড়ে দাও, তোমার রথটি এই গিরিসংকটের একটু উত্তরে সরিয়ে রাখ। আমি সসৈন্যে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাই, তারপর তুমি তোমার সেনা নিয়ে অভীষ্ট স্থানে যাত্রা ক’রো।
কনকবর্মা মাথা নেড়ে বললেন, তা হতেই পারে না, আমি তোমার চাইতে বয়সে বড়, আমার অশ্ব—রথ—গজাদিও বেশী, অতএব পথের অগ্রাধিকার আমারই। তুমিই একটু দক্ষিণে হটে গিয়ে আমাকে পথ ছেড়ে দাও।
বিশাখসেন বললেন, অন্যায় বলছ সখা। তুমি বয়সে একটু বড় হতে পার, তোমার অশ্ব—গজাদিও প্রচুর থাকতে পারে, কিন্তু আমার বিদর্ভ রাজ্য অতি সমৃদ্ধ ও বিশাল, তার মধ্যে চারটে কলিঞ্জরের স্থান হয়। অতএব তুমিই আমাকে পথ দাও।
অনেকক্ষণ এই রকম তর্কবিতর্ক চলল। তারপর কনকবর্মা বললেন, ওহে বিশাখসেন তোমার বড়ই স্পর্ধা হয়েছে। এই শরাসন স্পর্শ করে শপথ করছি, কিছুতেই তোমাকে আগে যেতে দেব না, তোমার পূর্বেই আমি দক্ষিণে অগ্রসর হব। যখন মিষ্টবাক্যে বিবাদের মীমাংসা হল না তখন যুদ্ধই করা যাক। এই বলে তিনি তাঁর ধনুতে শরসন্ধান করলেন।
বিশাখসেন বললেন, ওহে কনকবর্মা, আমিও শপথ করছি, বাহুবলে আমার পথ করে নেব, তোমার পূর্বেই আমি উত্তর দিকে যাত্রা করব। এই বলে তিনি ধনুতে শরযোজনা করে জ্যাকর্ষণ করলেন।
তখন দুই রাজবয়স্য কহোড়ভট্ট আর বিড়ঙ্গদেব একযোগে হাত তুলে উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ভো নৃপতিযুগল, থামুন থামুন। মনে নেই, গত বৎসর মকরসংক্রান্তির দিনে আপনারা নর্মদায় স্নানের পর অগ্নিসাক্ষী করে মৈত্রীবন্ধন করেছিলেন? অপি চ, তখন উষ্ণীষ বিনিময় করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কিছুতেই আপনাদের সৌহার্দ ক্ষুণ্ণ হতে দেবেন না।
কনকবর্মা গালে হাত দিয়ে বললেন, হুঁ, ওই রকম একটা প্রতিজ্ঞা করা গিয়েছিল বটে!
বিশাখসেন বললেন, হুঁ, আমারও সে কথা মনে পড়েছে। তাই তো! এখন কি করা যায়? এক দিকে সৌহার্দরক্ষার প্রতিজ্ঞা, আর এক দিকে অগ্রযাত্রার শপথ। দুটোই বজায় থাকে কি করে? মহারাজ কনকবর্মা, তোমার মুখ্যমন্ত্রীকে সংবাদ পাঠাও, তিনি এখনই এখানে চলে আসুন। আমিও আমার মহামন্ত্রীকে আনাচ্ছি। দুই মন্ত্রী যুক্তি করে এমন একটা উপায় স্থির করুন যাতে আমাদের প্রতিজ্ঞা আর শপথ রক্ষিত হয়, মর্যাদারও হানি না হয়।
কনকবর্মা তাঁর এক অশ্বারোহী অনুচরকে বললে, খেটকসিংহ, তুমি এখনই দ্রুতবেগে গিয়ে আমার মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এস। বিশাখসেন, তুমিও লোক পাঠাও।
কহোড়ভট্ট বললেন, তার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই, অনর্থক বিলম্ব হবে। আমার পরম বন্ধু মহাপণ্ডিত বিড়ঙ্গদেব এখানে রয়েছেন, আমারও বিদ্যাবুদ্ধির প্রচুর খ্যাতি আছে। আমরা দুজনেই রাজবয়স্য। ঠিক মন্ত্রী না হই, উপমন্ত্রী তো বটেই। পত্নীর স্থান অন্তঃপুরে, পথে তিনি বিবর্জিতা, উপপত্নীই প্রবাসসঙ্গিনী হয়ে থাকে। তদ্রূপ মন্ত্রীর স্থান রাজধানীতে, কিন্তু পর্যটনে ও ব্যসনে উপমন্ত্রীই সহায়। আমরাই মন্ত্রণা করে কিংকর্তব্য স্থির করতে পারব।
দুই রাজা বললেন, উত্তম কথা, তাই কর। কিন্তু বিলম্ব না হয়, বেলা পড়ে আসছে।
কহোড় আর বিড়ঙ্গ রথ থেকে নেমে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন, তার পর একটি শিলাপট্টে বসে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পরে কহোড় বললেন, হে নরপতিদ্বয়, শুনতে আজ্ঞা হোক। আমরা দুই বন্ধুতে মিলে আপনাদের সমস্যার একটি উত্তম সমাধান স্থির করেছি, তাতে সৌহার্দের প্রতিজ্ঞা, অগ্রযাত্রার শপথ, এবং উভয়ের মর্যাদা সমস্তই রক্ষা পাবে।
উদগ্রীব হয়ে দুই রাজা বললেন, কি প্রকার সমাধান?
কহোড় বললেন, মহারাজ কনকবর্মা! আপনি রাজধানী থেকে এক দল নিপুণ খনক আনান, তারা অগস্ত্যদ্বারের তলা দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ খনন করুক। সেই সুড়ঙ্গপথে আপনি দক্ষিণ দিকে এবং উপরের পথে বিদর্ভরাজ বিশাখসেন উত্তরদিকে একই মুহূর্তে যাত্রা করবেন।
বিশাখসেন বললেন, যুক্তি মন্দ নয়। কিন্তু পবর্তের নীচে সুড়ঙ্গ করতে অন্তত এক বৎসর লাগবে। তত দিন আমরা কি করব? রথ থেকে আমি কিছুতেই নামব না তা বলে দিচ্ছি।
কহোড় বললেন, নামবেন কেন। রথে আরূঢ় থেকেই একটু কষ্ট করে এক বৎসর কাটিয়ে দেবেন, ওখানেই শৌচ—স্নানাদি পান—ভোজনাদি অক্ষক্রীড়াদি করবেন, ওখানেই নিদ্রা যাবেন। রাজধানী থেকে নর্তকীদের আনিয়ে নিন, তারা নৃত্যগীত করে আপনাদের চিত্তবিনোদন করবে।
কনকবর্মা বললেন, সুড়ঙ্গ টুড়ঙ্গ চলবে না। বিশাখসেন উপর দিয়ে যাবেন আর আমি মূষিকের ন্যায় তাঁর নীচে দিয়ে যাব এ হতে পারে না।
বিড়ঙ্গ বললেন, মহারাজ কনকবর্মা, আর এক উপায় আছে। আপনি কুবেরের আরাধনা করুন যাতে তিনি তুষ্ট হয়ে কিছুক্ষণের জন্য তার পুষ্পক বিমানটি পাঠিয়ে দেন। সেই বিমানে আপনি আকাশমার্গে দক্ষিণ দিকে যাবেন এবং বিদর্ভরাজ গিরিসংকট দিয়ে উত্তর দিকে যাবেন।
বিশাখসেন বললেন, উনি আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাবেন তা হতেই পারে না। তোমরা দুজনেই অত্যন্ত মূর্খ, সমস্যার সামাধান তোমাদের কর্ম নয়।
বিড়ঙ্গ বললেন, মহারাজ, ধৈর্য ধরুন আমরা আর এক বার মন্ত্রণা করছি।
দুই রাজবয়স্য আবার মন্ত্রণায় নিবিষ্ট হলেন, দুই রাজা অধীর হয়ে রথের উপর তাঁদের ধনুক ঠুকতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে কহোড় বললেন, হে নৃপতিযুগল, এবারে আমরা একটি অতি সাধু বিচিত্র ও যশস্কর সমাধান আবিষ্কার করেছি।
কনকবর্মা বললেন, বলে ফেল।
কহোড় বললেন, প্রথমে আপনাদের দুই রথের ঘোড়া খুলে ফেলা হবে, তা হলে সংকীর্ণ স্থানেও অনায়াসে রথ ঘোরানো যাবে। ঘোরাবার পর আবার ঘোড়া জোতা হবে, তখন দুই রথের মুখ বিপরীত দিকে থাকবে।
বিশাখসেন সক্রোধে বললেন, আমরা পরাঙমুখ হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যাব এই তুমি বলতে চাও?
—না না মহারাজ, ফিরবেন কেন? ঘোরাবার পর দুই রথ একটু পশ্চাতে সরে আসবে যাতে ঠেকাঠেকি হয়। তার পর মহারাজ কনকবর্মা পিছন দিক থেকে পা বাড়িয়ে টুপ করে বিদর্ভরাজের রথে উঠবেন এবং বিদর্ভরাজ কলিঞ্জরপতির রথে উঠবেন।
দুই রাজা সমস্বরে বললেন, তার পর, তার পর?
—রথ বদলের পর আর কোনও ভাবনা নেই। আপনারা যুগপৎ বিপরীত দিকে অর্থাৎ আপনাদের অভীষ্ট মার্গে যাত্রা করবেন।
কনকবর্মা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু আমাদের চতুরঙ্গ সৈন্যদলের কি হবে?
—তাদেরও বদল হবে। আপনার আগে আগে বিদর্ভসেনা এবং মহারাজ বিশাখসেনের আগে আগে কলিঞ্জরসেনা যাবে। তারা মুখ ঘুরিয়ে নেবে।
কনকবর্মা বললেন, সখা, সম্মত আছ?
বিশাখসেন বললেন, আমার সেনা তোমার হবে এবং তোমার সেনা আমার হবে এতে আপত্তি করবার কিছু নেই। কিন্তু বেলা যে শেষ হয়ে এল, মৃগয়া কখন করব?
কহোড় বললেন, আজ মৃগয়া নাই করলেন মহারাজ। আজ আপনাদের প্রতিজ্ঞা আর শপথ রক্ষিত হক, মৃগয়া এর পরে এক দিন করবেন।
বিশাখসেন বললেন, কিন্তু আজ যেতে যেতেই তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে, আমাদের অভিযানের শেষ হবে কোথায়? ফিরব কখন?
কহোড় বললেন, ফিরবেন কেন? কিচ্ছু ভাববেন না, সবই আমরা স্থির করে ফেলেছি। আপনাদের রাজ্যেরও বিনিময় হবে। মহারাজ কনকবর্মা বিদর্ভসেনার সঙ্গে যাত্রা করে বিদর্ভরাজ্যে অধিষ্ঠিত হবেন, এবং মহারাজ বিশাখসেন কলিঞ্জরসেনার সঙ্গে গিয়ে কলিঞ্জর সিংহাসন অধিকার করবেন।
কিছু কাল স্তব্ধ হয়ে থাকার পর কনকবর্মা বললেন, অতি জটিল ব্যবস্থা। আমাদের পিতৃপিতামহের রাজ্য হস্তান্তরিত হবে এ যে বড় বিশ্রী কথা।
কহোড় বললেন, মহারাজ, ক্ষত্রিয় নৃপতির প্রধান কর্তব্য প্রতিজ্ঞা, শপথ আর আত্মমর্যাদা রক্ষা, তার জন্য যদি রাজ্য বা প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তাও শ্রেয়। কিন্তু আমাদের ব্যবস্থায় আপনাদের রাজ্যনাশ বা প্রাণনাশ কিছুই হচ্ছে না, এক রাজ্যের পরিবর্তে আর এক রাজ্য পাচ্ছেন।
কনকবর্মা বললেন, এই বারে বুঝেছি, সখা, তুমি সম্মত আছ?
বিশাখসেন বললেন, অন্য উপায় তো দেখছি না। বেশ, তাই হোক।
সেকালের রথ কতকটা একালের এক্কার মতন। দুটি মাত্র চাকা, হালকা গড়ন, বেশী জায়গা নিত না। সারথি সামনে বসত, তার পাশে বা পিছনে রথী বসতেন। দুই রাজার আদেশে রথের ঘোড়া খুলে ফেলা হল। বোম খাড়া করে তুলে সেই সংকীর্ণ স্থানে সহজেই রথ ঘোরানো গেল। তারপর আবার ঘোড়া জোতা হল। একটু পিছনে হটাতেই দুই রথের পিছন দিক ঠেকে গেল, তখন রাজারা না থেমেই এক রথ থেকে অন্য রথে উঠলেন। দুই রাজবয়স্যও নিজ নিজ প্রভুর পশ্চাতে বসলেন।
অনন্তর কনকবর্মা পিছনে ফিরে বললেন, হে কলিঞ্জর সৈন্যগণ, ব্যাবর্তধ্বম (অর্থাৎ right about turn)। এখন থেকে তোমরা মহারাজ বিশাখসেনের অধীন, উনি তোমাদের সঙ্গে গিয়ে কলিঞ্জর রাজ্য অধিকার করবেন। আমিও বিদর্ভসেনার সঙ্গে গিয়ে বিদর্ভ রাজ্য অধিকার করব।
বিশাখসেনও অনুরূপ ঘোষণা করলেন।
সৈন্যরা অতি সুবোধ, সমস্বরে বললে, রাজাদেশ শিরোধার্য। তারপর কনকবর্মা আর বিশাখসেন একযোগে আজ্ঞা দিলেন, গম্যতাম (অর্থাৎ march)। বিদর্ভসেনা বিদর্ভের দিকে চলল, কনকবর্মার রথ তাদের পিছনে গেল। কলিঞ্জরসেনা কলিঞ্জরে ফিরে চলল, বিশাখসেনের রথ তাদের পিছনে গেল।
যেতে যেতে কনকবর্মা তাঁর বয়স্যকে বললেন, কাজটা কি ভাল হল? রাজ্য বদলের ফলে বিশাখসেনের লাভ আর আমার ক্ষতি হবে। আমার মহিষী তার মহিষীর চাইতে ঢের বেশী সুন্দরী।
কহোড় বললেন, মহারাজ, আপনি যে লোকবাহ্য কথা বলছেন, পরস্ত্রীকেই লোকে বেশী সুন্দরী মনে করে। সর্ব বিষয়ে আপনারই লাভ অধিক হবে। বিদর্ভমহিষী পুত্রবতী, কিন্তু আপনার মহিষী এখনও অনপত্যা। বিদর্ভরাজ্যের ধনভাণ্ডারও অতি বিশাল। ওখানকার অধিপতি হয়ে আপনি ধনে পুত্রে লক্ষ্মীলাভ করবেন।
কনকবর্মা যখন বিদর্ভরাজ্যে পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাঁর আদেশে কয়েক জন অশ্বারোহী আগেই রাজধানীতে গিয়ে সংবাদ দিয়েছিল যে রাজ্য বদল হয়ে গেছে, নূতন রাজা আসছেন। কনকবর্মা দেখলেন, তাঁর সংবর্ধনার কোনও আয়োজন হয় নি, পথে আলোকসজ্জা নেই, শাঁখ বাজছে না, হুলুধ্বনি হচ্ছে না, কেউ লাজবর্ষণও করছে না। তিনি অপ্রসন্ন মনে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে রথ থেকে নামলেন। কয়েকজন রাজপুরুষ নীরবে নমস্কার করে তাঁকে সভাগৃহে নিয়ে গেল, কহোড়ভট্টও সঙ্গে সঙ্গে গেলেন।
বিদর্ভরাজমহিষী বিংশতিকলা গম্ভীরমুখে সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁকে অভিবাদন করে কনকবর্মা বললেন, পট্টমহিষী, ভাল আছেন তো? পাঁচ বৎসর পূর্বে আপনার বিবাহসভায় আপনাকে তন্বী দেখেছিলাম। এখন আপনি একটু স্থূলাঙ্গী হয়ে পড়েছেন, তাতে আপনার রূপ ষোল কলা পেরিয়ে কুড়ি কলায় পৌঁছে গেছে। সকল সমাচার শুনেছেন বোধ হয়। এখন আমিই এই বিদর্ভরাজ্যের অধিপতি, অভিষেকের ব্যবস্থা কাল হবে। আমি আর আমার বয়স্য এই কহোড়ভট্ট অত্যন্ত শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়েছি, আজ ক্ষমা করুন, কাল আপনার সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপ করব। এখন আমাদের বিশ্রামাগার দেখিয়ে দিন এবং সত্বর আহারের ব্যবস্থা করুন।
একজন সশস্ত্র রাজপুরুষকে সম্বোধন করে মহিষী বিংশতিকলা বললেন, ওহে কোষ্ঠপাল, এই ধৃষ্ট নির্বোধ রাজা আর তার সহচরকে কারাগারে নিক্ষেপ কর। এদের শয়নের জন্য কিছু খড় আর ভোজনের জন্য প্রত্যেককে এক সরা ছাতু আর এক ভাঁড় জল দিও।
কহোড়ভট্ট করজোড়ে বললেন, সে কি রানী—মা, আমাদের এই পরমভট্টারক শ্রীশ্রীমহারাজ আপনার ভগ্নীপতি তো বটেনই, এখন বিদর্ভপতি হয়ে অধিকন্তু আপনার পতিও হয়েছেন। একে ছাতু খাওয়াবেন কি করে? ইনি নিত্য নানা প্রকার চর্ব্য চূষ্য লেহ্য পেয় আহার করে থাকেন।
বিংশতিকলা বললেন, তাই হবে। ওহে কোষ্ঠপাল, এই রাজমূর্খকে দু মুটো ছোলা, এক ছড়া তেঁতুল, একটু গুড়, আর এক ভাঁড় ঘোল দিও। ছোলা চিবুবে, তেঁতুল চুষবে, গুড় চাটবে, আর ঘোলের ভাঁড়ে চুমুক দেবে।
কোষ্ঠপাল বললেন, যথা আজ্ঞা মহাদেবী। আরক্ষিগণ, এদের কারাগারে নিয়ে চল।
কনকবর্মা হতভম্ব হয়ে নীরবে কারাগৃহে গেলেন এবং ক্লান্তদেহে বিষণ্ণ মনে রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন প্রাতঃকালে তিনি বললেন, ওহে পণ্ডিতমূর্খ কহোড়, তোমাদের মন্ত্রণা শুনেই আমার এই দুর্দশা হল। এই শত্রুপুরী থেকে উদ্ধার পাব কি করে?
কহোড় বললেন, মহারাজ, ভাববেন না। আমি সারা রাত চিন্তা করে উপায় নির্ধারণ করেছি।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কনকবর্মা বললেন, তোমার উপর আর ভরসা নেই। বিশাখসেন কেমন আছেন কে জানে, তিনি হয়তো কলিঞ্জর রাজ্যে খুব সুখে আছেন।
কহোড় বললেন, মনেও ভাববেন না তা। আমাদের মহাদেবী কম্বুকঙ্গণাও বড় কম যান না।
এই সময় একজন প্রহরী কারাকক্ষে এসে বললেন, আপনারা শৌচস্থানাদির জন্য ওই প্রাচীরবেষ্টিত উপবনে যেতে পারেন।
কহোড় বললেন, বৎস প্রহরী, শৌচাদি এখন মাথায় থাকুক, একবার রানীমার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দাও, মহারাজ তোমাকে পুরস্কার দেবেন।
প্রহরী বললে, আসুন আমার সঙ্গে।
রাজমহিষী বিংশতিকলার কাছে এসে কহোড় কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহাদেবী, ঢের হয়েছে, আমাদের মুক্তি দিন, ফিরে গিয়েই বিদর্ভরাজ বিশাখসেনকে পাঠিয়ে দেব।
মহিষী বললেন, আগে তিনি আসুন, তার পর তোমাদের মুক্তির বিষয় বিবেচনা করা যাবে।
—তবে কেবল আমাকে মুক্তি দিন, আমি কলিঞ্জরে গিয়ে বদলা—বদলির ব্যবস্থা করব।
বেশ, তোমাকে ছেড়ে দিচ্ছি, যাতায়াতের জন্য একটা রথও দিচ্ছি। কিন্তু যদি সাত দিনের মধ্যে ফিরে না এস তবে তোমার প্রভুকে শূলে দেব।
কহোড়ভট্ট রথে চড়ে যাত্রা করলেন। এই সময় বিড়ঙ্গদেবও বিশাখসেনের দূত হয়ে বিদর্ভরাজ্যে আসছিলেন। মধ্যপথে দুই বন্ধুতে দেখা হয়ে গেল। কুশলপ্রশ্নের পর দুজনে অনেকক্ষণ মন্ত্রণা করলেন, তার পর যেখান থেকে এসেছিলেন সেখানে ফিরে গেলেন।
বিদর্ভরাজমহিষী বিংশতিকলাকে কহোড় বললেন, মহাদেবী, আমার প্রিয়বন্ধু বিড়ঙ্গদেবের সঙ্গে মন্ত্রণা করে এই ব্যবস্থা করেছি যে কাল প্রাতঃকালে মহারাজ বিশাখসেন কলিঞ্জর থেকে বিদর্ভ রাজ্যে যাত্রা করবেন, এবং এখান থেকে মহারাজ কনকবর্মাও কলিঞ্জরে যাত্রা করবেন। যত ইচ্ছা রক্ষী সৈন্য আমাদের সঙ্গে দেবেন। অগস্ত্যদ্বারে উপস্থিত হয়ে যদি তারা দেখে যে মহারাজ আসেন নি, তবে আমাদের ফিরিয়ে আনবে।
মহিষী বললেন, ফিরিয়ে এনেই তোমাদের শূলে চড়াবে। বেশ, তোমার প্রস্তবে সম্মত আছি, কাল প্রভাতে যাত্রা ক’রো।
পরদিন প্রাতঃকালে কনকবর্মা ও কহোড়ভট্ট রথে চড়ে যাত্রা করলেন, এক দল অশ্বারোহী সৈন্য তাঁদের সঙ্গে গেল। অগস্ত্যদ্বারের দক্ষিণ মুখে এসে কনকবর্মা দেখলেন, বিশাখসেন ও বিড়ঙ্গদেবও উত্তর মুখে উপস্থিত হয়েছেন।
উল্লসিত হয়ে বিশাখসেন বললেন, সখা কনকবর্মা, আমার বিদর্ভ রাজ্যে সুখে ছিলে তো?
এত রোগা হয়ে গেছ কেন? তোমার সেবার ত্রুটি হয় নি তো?
কনকবর্মা বললেন, কোনও ত্রুটি হয় নি, তোমার মহিষী বিংশতিকলা যেমন রসিকা তেমনি গুণবতী। উঃ, কি যত্নই করেছেন! কিন্তু তোমাকেও তো বায়ুভুক তপস্বীর মতন দেখাচ্ছে। আমার কলিঞ্জর রাজ্যে তোমার যথোচিত সৎকার হয়েছিল তো?
অট্টহাস্য করে বিশাখসেন বললেন, সখা, আশ্বস্ত হও, সৎকারের কোনও ত্রুটি হয় নি। তোমার মহিষী কম্বুকঙ্কণাও কম রসিকা আর গুণবতী নন, তিনি আমাকে বিচিত্র চর্ব্য চুষ্য লেহ্য পেয় খাইয়েছেন। কিছুতেই ছাড়বেন না, তাঁকে অনেক সান্ত্বনা দিয়ে তবে চলে আসতে পেরেছি। যাক সে কথা। আমরা এই অগস্ত্যদ্বারে আবার মুখোমুখি হয়েছি। কে আগে যাত্রা করবে?
কহোড়ভট্ট আর বিড়ঙ্গদেব বললেন, দোহাই মহারাজ, আর বিবাদ করবেন না, আপনাদের যাত্রার ব্যবস্থা আমরাই করে দিচ্ছি। ওহে সারথিদ্বয়, তোমরা ঠিক গত বারের মতন রথ ঘুরিয়ে ফেল।…হয়েছে তো?…মহারাজ কনকবর্মা, এখন আপনি এ রথ থেকে ও রথে উঠুন। মহারাজ বিশাখসেন, আপনিও ও রথ থেকে এ রথে আসুন। মহামুনি অগস্ত্যের প্রসাদে এবং এই কহোড়—বিড়ঙ্গের বুদ্ধিবলে আপনারা সংকটমুক্ত হয়েছেন, আপনাদের প্রতিজ্ঞা শপথ মর্যাদা রাজ্য প্রাণ আর ভার্যা সবই রক্ষা পেয়েছে। এখন আর বিলম্ব নয়, দুই রথ যুগপৎ দুই দিকে শুভযাত্রা করুক।
১৩৫৯(১৯৫২)
অটলবাবুর অন্তিম চিন্তা
শয্যাশায়ী অটল চৌধুরী বললেন, দেখ ডাক্তার, আমি তোমার ঠাকুরদার চেয়েও বয়সে বড়, আমাদের ঠকিও না। মুখ খুলে বল মেজর হালদার কি বলে গেলেন। আর কতক্ষণ বাঁচব?
ডাক্তারবাবু বললেন, কেন স্যার আপনি ও কথা বলছেন, মরণ—বাঁচন কি মানুষের হাতে? আমরা কতটুকুই বা জানি। ভগবানের যদি দয়া হয় তবে আপনি আরও অনেক দিন বাঁচবেন।
—বাঁচিয়ে রাখাই কি দয়ার লক্ষণ? তোমাদের কাজ শেষ হয়েছে আর জ্বালিও না। এখন ডাক্তারি ধাপপাবাজি ছেড়ে দিয়ে সত্যি কথা বল। মরবার আগে আমি মনে মনে একটা বোঝাপড়া করতে চাই।
—বেশ তো, এখনই করুন না, দু—দশ বছর আগে করলেই বা দোষ কি।
—তুমি ডাক্তারিই শিখেছ, বিজনেস শেখ নি। আরে, বছর শেষ না হলে কি সাল—তামামী হিসেব—নিকেশ করা যায়? ঠিক মরবার আগেই জীবনের লাভ—লোকশান খতাতে চাই—অবশ্য যদি জ্ঞান থাকে।
এমন সময় পুরুত ঠাকুর হরিপদ ভটচাজ এসে বললেন, কর্তাবাবু, প্রায়শ্চিত্তটা হয়ে যাক, মনে শান্তি পাবেন।
—কেন বাপু, আমি কি মানুষ খুন করেছি, না পরস্ত্রী হরণ করেছি, না চুরি—ডাকাতি, জাল—জুয়াচুরি আর মাদুলির ব্যবসা করেছি?
হরিপদ জিব কেটে বললেন, ছি ছি, আপনার মতন সাধুপুরুষ কজন আছেন? তবে কিনা সকলেরই অজ্ঞানকৃত পাপ কিছু কিছু থাকে, তার জন্যই প্রায়শ্চিত্ত।
—দেখ ভটচাজ, আমি ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির নই, ভদ্রলোকের যতটুকু দুষ্কর্ম না করলে চলে না ততটুকু করেছি। তার জন্য আমার কিছুমাত্র খেদ নেই, নরকের ভয়ও নাই। তবে প্রায়শ্চিত্ত করলে তোমরা যদি মনে শান্তি পাও তো করতে পার। কিন্তু এখানে নয়, নীচে পুজোর দালানে কর গিয়ে। ঘণ্টার আওয়াজ যেন না আসে।
হরিপদ ‘যে আজ্ঞে’ বলে চলে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, ওঃ কি পাষণ্ড! মরতে বসেছে তবু ধর্মে মতি হল না।
অটলবাবুর পৌত্রী রাধারানী এসে বললে, দাদাবাবু, বৃন্দাবন বাবাজী তাঁর কীর্তনের দল নিয়ে এসেছেন। মা জিজ্ঞাসা করলে, তুমি একটু নাম শুনবে কি?
—খবরদার। আমি এখন নিরিবিলিতে থাকতে চাই, চেঁচামেচি ভাল লাগে না। শ্রাদ্ধের দিন যত খুশি কীর্তন শুনিস—শীতল বাতাস ভাল লাগে না সখী, আমার বুকের পাঁজর ঝাঁজরা হল—যত সব ন্যাকামি।
রাধারানী ঠোঁট বেঁকিয়ে চলে গেল। ডাক্তার বললেন, সার, আপনি বড় বেশী কথা বলছেন। রাত হয়েছে, এখন চুপ করে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন।
—বেশী কথা তোমরাই বলছ। আর দেরি ক’র না, যা জিজ্ঞাসা করেছি তার স্পষ্ট উত্তর দাও।
ডাক্তার তাঁর স্টেথোস্কোপের নল চটকাতে চটকাতে বললেন, দু—চার ঘন্টা হতে পারে, দু—চার দিনও হতে পারে, ঠিক বলা অসম্ভব। ইনজেকশনটা দিয়ে দি, আপনি অক্সিজেন শুঁকতে থাকুন, কষ্ট কমবে।
যথাকর্তব্য করে ডাক্তার অটলবাবুর বিধবা পুত্রবধূকে বললেন, হুঁশিয়ার হয়ে থাকতে হবে, আজ রাত বোধ হয় কাটবে না। নার্স ওঁর ঘরে থাকুক, আমি এই পাশের ঘরে রইলুম।
অটলবাবু অত্যন্ত হিসাবী লোক, আজীবন নানারকম কারবার করেছেন। তাঁর বয়স আশি পেরিয়েছে, শরীর রোগে অবসন্ন, কিন্তু বুদ্ধি ঠিক আছে। মরণ আসন্ন জেনে তিনি মনে মনে ইহলোকের ব্যালান্স—শীট এবং পরলোকের একটা আন্দাজী প্রসপেকটস খাড়া করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
সুখং হি দুঃখান্যনুভূয় শোভতে
ঘনান্ধকারেষ্বিব দীপদর্শনম।
সুখাত্তু যো যাতি নরো দরিদ্রতাং
ধৃতঃ শরীরেণ মৃতঃ স জীবতি।।
—দুঃখ অনুভবের পরই সুখ শোভা পায়, যেমন ঘোর অন্ধকারে দীপদর্শন। কিন্তু যে লোক সুখভোগের পর দরিদ্রতা পায় সে শরীর ধারণ করে মৃতের ন্যায় জীবিত থাকে।
অটলবাবু ভাবলেন, ভুল, মস্ত ভুল। তিনি প্রথম ও মধ্য জীবনে বিস্তর সুখভোগ করেছেন, কিন্তু শেষ বয়সে অনেক দুঃখ পেয়েছেন। তাঁকে স্ত্রীপুত্রাদি আত্মীয়বিয়োগের শোক এবং ব্যবসায়ে বড় রকম লোকসান সইতে হয়েছে, সর্বস্বান্ত না হলেও তিনি আগের তুলনায় দরিদ্র হয়েছেন। বয়স যত বাড়ে সময় ততই ছোট হয়ে যায় ; অন্তিম কালে অটলবাবুর মনে হচ্ছে তাঁর সমস্ত জীবন মুহূর্তমাত্র, সমস্ত সুখ দুঃখ তিনি এক সঙ্গেই ভোগ করেছেন এবং সবই এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুখভোগের পর দুঃখ পেয়েছেন—শুধু এই কারণেই সুখের চেয়ে দুঃখকে বড় মনে করবেন কেন? জীবনের খাতায় লাভ—লোকসান দুইই পাকা কালিতে লেখা রয়েছে, তাতে দেখা যায় তাঁর খরচের তুলনায় জমাই বেশী, মোটের উপর তিনি বঞ্চিত হন নি। অন্য লোকে যাই বলুক, তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারেন।
কিন্তু একটা খটকা দেখা যাচ্ছে। তিনি নিজে ভাগ্যবান হলেও যারা তাঁর অত্যন্ত প্রিয়জন ছিল তারা হতভাগ্য, অনেকে বহু দুঃখ পেয়ে অকালে মরেছে। তাদের দুঃখ অটলবাবু নিজের বলেই মনে করেন এবং তা লোকসানের দিকে ফেললে লাভের অঙ্ক খুব কমে যায়। শুধু তাই নয়, অন্যান্য যে সব লোককে তিনি আজীবন আশেপাশে দেখছেন তাদেরও অনেকে কষ্ট ভোগ করেছে। পূর্বে তাদের কথা তিনি ভাবেন নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তারাও নিতান্ত আপনজন। তাদের দুঃখও যদি নিজের বলে ধরেন তবে জমাখরচ কষলে লোকসানই দেখা যায়।
অটলবাবু স্থির করতে পারলেন না তিনি জীবনে মোটের উপর সুখ বেশী পেয়েছেন কি দুঃখ বেশী পেয়েছেন। তিনি যদি ভক্ত হতেন তবে বলতে পারতেন—’ধন্য হরি রাজ্যপাটে, ধন্য হরি শ্মশানঘাটে’। ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন—এই খ্রীষ্টানী প্রবোধবাক্যে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন নি। অটলবাবু শুনেছেন, যিনি পরমহংস তিনি সমস্ত জীবের সুখদুঃখ নিজের বলেই মনে করেন ; সুখ আর দুঃখে কাটাকাটি হয়ে যায়, তার ফলে তিনি সুখীও হন না দুঃখীও হন না। কিন্তু অটলবাবু পরমহংস নন, তা ছাড়া তিনি জগতে সুখের চেয়ে দুঃখই বেশী দেখতে পান। তিনি যদি দুঃখের দিকে পিছন ফিরে জীবন উপভোগ করতে পারতেন তবে রবীন্দ্রনাথের মতন বলতে পারতেন—
এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি—
অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি
এই মহামন্ত্রখানি
চরিতার্থ জীবনের বাণী।
দিনে দিনে পেয়েছিনু সত্যের যা—কিছু উপহার
মধুরসে ক্ষয় নাই তার।
তাই এই মন্ত্রবাণী মৃত্যুর শেষের প্রান্তে বাজে—
সব ক্ষতি মিথ্যা করি অনন্তের আনন্দে বিরাজে।
আরও বলতে পারতেন—
আমি কবি তর্ক নাহি জানি,
এ বিশ্বেরে দেখি তার সমগ্র স্বরূপে—
লক্ষ কোটি গ্রহ তারা আকাশে আকাশে
বহন করিয়া চলে প্রকাণ্ড সুষমা,
ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুর নাহি বাধে,
বিকৃতি না ঘটায় স্খলন…..
ভাগ্যদোষে অটলবাবু ভক্ত নন, কবি নন, ভাবুক নন, দার্শনিক নন, সরল বিশ্বাসীও নন। তিনি নানা বিষয়ে ঠোকর মেরেছেন কিন্তু কিছুই আয়ত্ত করতে পারেন নি। আজীবন সংশয়ে কাটিয়েছেন কিন্তু কোনও বিষয়েই নিষ্ঠা রাখতে পারেন নি। তাঁর মূলধন কি তাই তিনি জানেন না, লাভ—লোকসান খতাবেন কি করে? শুধু এইটুকুই বলতে পারেন—অনেকের তুলনায় তিনি ভাগ্যবান, অনেকের তুলনায় তিনি হতভাগ্য। এ সম্বন্ধে আর তিনি বৃথা মাথা ঘামাবেন না, জ্ঞান থাকতে থাকতে তাঁর ভবিষ্যৎটা একটু আন্দাজ করার চেষ্টা করবেন। তাঁর আর বাঁচবার ইচ্ছা নাই। তিনি মরলে কারও আর্থিক ক্ষতি বা মানসিক দুঃখ হবে না, যে অল্প আয় আছে তা বন্ধ হবে না, বরং ইনশিওরান্সের একটা মোটা টাকা ঘরে আসবে। তিনি এখন আত্মীয়দের গলগ্রহ মাত্র, তারা বোধ হয় মনে মনে তাঁর মরণ কামনা করে।
অটলবাবু কি আবার জন্মাবেন? তাঁর গতজন্মের কথা কিছুই মনে নেই। জাতিস্মর লোকের বিবরণ মাঝে মাঝে খবরের কাগজে পাওয়া যায়, কিন্তু তা মোটেই বিশ্বাস্য নয়। মালবীয়জীর যখন কায়কল্প চিকিৎসা চলছিল তখন এক বিখ্যাত সংবাদপত্রের নিজস্ব সংবাদদাতা খবর পাঠাচ্ছিলেন—পণ্ডিতজীর পাকা চুল সমস্ত কাল হয়ে গেছে, নূতন দাঁতও উঠছে। নির্জলা মিথ্যা কথা লিখতে এঁদের বাধে না। যদি পুনর্জন্মের কথা মনে না থাকে তবে এক জন্মের রামবাবুই যে অন্য জন্মে শ্যামবাবু হয়েছেন তার প্রমাণ কি? তারপর স্বর্গ মর্ত্য। তিনি এক পাদ্রির কাছে শুনেছিলেন, যিশু খ্রীষ্টের শরণ নিলে অনন্ত স্বর্গ, না নিলে অনন্ত নরক। এ রকম ছেলেমানুষী কথায় ভুলবেন অটলবাবু এমন বোকা নন। আমাদের পুরাণে আছে, যার পাপ অল্প সে আগে অল্পকাল নরকভোগ করে, তারপর দীর্ঘকাল স্বর্গভোগ করে, পুণ্যক্ষয় হলে আবার জন্মায়। যার পুণ্য অল্প সে অল্পকাল স্বর্গবাসের পর দীর্ঘকাল নরকবাস করে, তার পর আবার জন্মায়। এই মত খ্রীষ্টানী মতের চেয়ে ভাল, কিন্তু মানুষের পাপ—পুণ্য, মাপা হবে কী করে? পাপ—পুণ্য তো যুগে যুগে বদলাচ্ছে। পঞ্চাশ—ষাট বৎসর আগে মুরগি খেলে পাপ হত, এখন আর হয় না। পুরাকালের হিন্দুরা অন্যান্য নিষিদ্ধ মাংসও খেত, ভবিষ্যতে আবার খাবে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সবাই বলে নরহত্যা মহাপাপ, কিন্তু এই সেদিন শান্ত শিষ্ট ভদ্রলোকের ছেলেরাও বেপরোয়া খুন করেছে, বুড়োরা উৎসাহ দিয়ে বলেছে—এ হল আপদধর্ম, সাপ মারলে পাপ হয় না, কে ঢোঁড়া কে কেউটে তা চেনবার দরকার নেই। পাপ—পুণ্যের যখন স্থিরতা নেই তখন স্বর্গনরক অবিশ্বাস্য।
তবে কি অটলবাবু স্পিরিচুয়ালিস্টদের পরলোকে যাবেন—যা স্বর্গও নয় নরকও নয়? আজকাল ইওরোপ— আমেরিকার বৃত্তান্তের মতন পরলোকের বৃত্তান্তও অনেক ছাপা হচ্ছে। দুর্বলচিত্ত লোকে বিপদে পড়লে যেমন কবচ—মাদুলি ধারণ করে, জ্যোতিষী বা গুরুর শরণাপন্ন হয়, তেমনি শান্তির প্রত্যাশায় পরলোকের কথা পড়ে। অনেক বৎসর পূর্বে অটলবাবু একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন, এখন তা মনে পড়ে গেল। —তিনি বিদেশে এক বন্ধুর বাড়ি অতিথি হয়েছেন। রাত্রিতে আহারের পর তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে শুতে যাবার সময় দেখলেন, পাশে একটি তালা—লাগানো ঘর আছে। শোবার কিছুক্ষণ পরে শুনতে পেলেন, পাশের ঘরের তালা খোলা হল, আবার বন্ধ করা হল। তারপর অটলবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। একটু পরেই গোলমালে ঘুম ভেঙে গেল, পাশের ঘরে যেন হাতাহাতি মারামারি চলছে। অনেক রাত পর্যন্ত এই রকম চলল, অটলবাবু ঘুমুতে পারলেন না। পরদিন বাড়ির কর্তা তাঁকে বললেন, আপনার নিদ্রার ব্যাঘাত হয়েছে তার জন্য আমি বড় দুঃখিত। ব্যাপার কি জানেন—আমার একটি ছেলে অল্প বয়সে মারা যায়; তার গর্ভধারিণী রোজ রাত্রে থালায় ভরতি করে তার জন্য ওই ঘরে খাবার রাখেন। কিন্তু ছেলে খেতে পায় না, তার পূর্ব পুরুষরা দল বেঁধে এসে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করেন।
এই স্বপ্নের কথা মনে পড়ার পর অটলবাবু একটি বিভীষিকা দেখলেন। মনে হ’ল তাঁর বাবা বলছেন, অটলা, প্রণাম কর, এই ইনি তোর পিতামহ, ইনি প্রপিতামহ, ইনি বৃদ্ধ প্রপিতামহ, ইনি অতিবৃদ্ধ—ইত্যাদি ইত্যাদি। অটলবাবু দেখলেন, তাঁর বংশের অসংখ্য ঊর্ধ্বতন স্ত্রীপুরুষ প্রণাম নেবার জন্য সামনে কিউ করে দাঁড়িয়ে আছেন। ওই তাঁর পাঁচ নম্বর পূর্বপুরুষ—প্রবলপ্রতাপ জমিদার, মাথায় টিকি, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, গলায় রুদ্রাক্ষ, কাঁধে পইতের গোছা, পায়ে খড়ম—দেখলেই বোধ হয় ব্যাটা ডাকাতের সর্দার, নরবলি দিত। ওই উনি, যাঁর দাঁতে মিসি, নাকে নথ, কানে মাকড়ির ঝালর, পায়ে বাঁকমল, কোমরে গোট, অটলবাবুর অতিবৃদ্ধ প্রমাতামহী—ও মাগী নিশ্চয় ডাইনী, সতিনপোকে বিষ খাইয়ে মেরেছিল। দলের মধ্যে সাধুপুরুষ আর সাধ্বী স্ত্রীও অনেক আছেন, কিন্তু অটলবাবু তো ভাল মন্দ বেছে প্রণাম করতে পারেন না। তা ছাড়া তাঁর বয়স এত হয়েছে যে কোনও গুরুজন আর বেঁচে নেই, তিনি প্রণাম করাই ভুলে গেছেন। ছেলেবেলায় তিনি তাঁর বাবাকে দেখলে হুঁকো লুকোতেন, কিন্তু এখন এই পঙ্গপালের মতন পূর্বপুরুষদের খাতির করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তাঁর প্রিয়জন এবং অপ্রিয়জনও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কেউ হাসিমুখে কেউ ছলছল চোখে কেউ ভ্রূকুটি করে তাঁকে দেখছে। শুধু মানুষ নয়, মানুষের পিছনে অতি দূরে জন্তুর দলও রয়েছে, পশু সরীসৃপ মাছ কৃমি কীট কীটাণু পর্যন্ত। এরাও তাঁর পূর্বপুরুষ, এরাও তাঁর জ্ঞাতি, সকলের সঙ্গেই তাঁর রক্তের যোগ আছে। কি ভয়ানক, ইহলোকের জনকয়েক আত্মীয়বন্ধুর সংশ্রব ত্যাগ করে তাঁকে কি পরলোকের প্রেতারণ্যে বাস করতে হবে? ওখানে সঙ্গী রূপে কাকে তিনি বরণ করবেন, কাকে বর্জন করবেন? অটলবাবু অস্পষ্টস্বরে বললেন, দূর হ, দূর হ।
নার্স কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলে, আমাকে ডাকছেন? অটলবাবু আবার বললেন, দূর হ, দূর হ। নার্স বিরক্ত হয়ে তার চেয়ারে গিয়ে বসল এবং আবার ঢুলতে লাগল।
বিকারের ঘোর কাটিয়ে উঠে অটলবাবু ভাবতে লাগলেন—পুনর্জন্ম নয়, স্বর্গ নয়, স্পিরিচুয়াল প্রেতলোকও নয়। কোথায় যাবেন? মৃত্যুর পর দেহ পঞ্চভূতে মিলিয়ে যায়, দেহের উপাদান পৃথিবীর জড় বস্তুতে লয় পায়। মৃত ব্যক্তির চেতনাও কি বিরাট বিশ্বচেতনায় লীন হয়? আমিই অটল চৌধুরী—এই বোধ কি তখনও থাকবে? অটলবাবু আর ভাবতে পারেন না, মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
শেষরাত্রে অটলবাবুর নাড়ী নিঃশ্বাস আর বুক পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, ঘণ্টাখানেক হল গেছেন। আশ্চর্য মানুষ, হরিনাম নয়, রামধুন নয়, তারকব্রহ্মনাম নয়, কিছুই শুনলেন না, ভদ্রলোক লাভ—লোকসান কষতে কষতেই মরেছেন। বোধ হয় হিসেব মেলাতে পারেন নি, দেখুন না, ভ্রূ একটু কুঁচকে রয়েছে!
পুত্রবধূ বললেন, তা বেশ গেছেন, নিজেও বেশীদিন ভোগেননি, আমাদেরও ভোগাননি। চিকিৎসার খরচও তো কম নয়।
অটলবাবুর কাগজপত্র হাঁটকে দেখে তাঁর পৌত্র বললে, এঃ, বুড়ো ঠকিয়েছে, যা রেখে গেছে তা কিছুই নয়।
অনুরক্ত বন্ধুরা বললেন, একটা ইন্দ্রপাত হল। এমন খাঁটি মানুষ দেখা যায় না। ইনি স্বর্গে যাবেন না তো যাবে কে? কি বলেন দত্ত মশাই?
হারাধন দত্ত মশাই পরলোকতত্ত্বজ্ঞ ; যদিও পরলোক দেখবার সুযোগ এখনও পান নি। তিনি একটু চিন্তা করে বললেন, উঁহু, স্বর্গে যাওয়া অত সহজ নয়, দরজা খোলা পাবেন না ; উনি যে কিছুই মানতেন না। অ্যাস্ট্রাল প্লেনেই আটকে থাকবেন, ত্রিশঙ্কুর মতন।
হরিপদ ভটচাজ মনে মনে বললেন, তোমরা ছাই জান, পাষণ্ড এতক্ষণ নরকে পৌঁছে গেছে।
অটলবাবু কোথায় গেছেন তা তিনিই জানেন। অথবা তিনিও জানেন না।
১৩৫৫ (১৯৪৮)
অদল বদল
কালিদাসের মেঘদূত ব্যাপারটা কি বোধ হয় আপনারা জানেন। যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাই একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি। কুবেরের অনুচর এক যক্ষ কাজে ফাঁকি দিত, সেজন্য প্রভুর শাপে তাকে এক বৎসর নির্বাসনে থাকতে হয়। সে রামগিরিতে আশ্রম তৈরি করে বাস করতে লাগল। আষাঢ়ের প্রথম দিনে যক্ষ দেখল, পাহাড়ের মাথায় মেঘের উদয় হয়েছে, দেখাচ্ছে যেন একটি হস্তী বপ্রক্রীড়া করছে। অঞ্জলিতে সদ্য ফোটা কুড়চি ফুল নিয়ে সে মেঘকে অর্ঘ্য দিল এবং মন্দাক্রান্তা ছন্দে একটি সুদীর্ঘ অভিভাষণ পাঠ করল। তার সারমর্ম এই। —ভাই মেঘ, তোমাকে একবার অলকাপুরী যেতে হচ্ছে। ধীরে সুস্থে যেয়ো, পথে কিঞ্চিৎ ফুর্তি করতে গিয়ে যদি একটু দেরি হয়ে যায় তাতে ক্ষতি হবে না। অলকায় তোমার বউদিদি আমার বিরহিণী প্রিয়া আছেন, তাঁকে আমার বার্তা জানিয়ে আশ্বস্ত ক’রো। ব’লো আমার শরীর ভালোই আছে, কিন্তু চিত্ত তাঁর জন্য ছটফট করছে। নারায়ণ অনন্তশয্যা থেকে উঠলেই অর্থাৎ কার্তিক মাস নাগাদ শাপের অবসান হবে, তারপরেই আমরা পুনর্মিলিত হব।
কালিদাস তাঁর যক্ষের নাম প্রকাশ করেন নি, শাপের এক বৎসর শেষ হলে সে নিরাপদে ফিরতে পেরেছিল কিনা তাও লেখেন নি। মহাভারতে উদ্যোগপর্বে এক বনবাসী যক্ষের কথা আছে, তার নাম স্থূণাকর্ণ। সেই যক্ষ আর মেঘদূতের যক্ষ একই লোক তাতে সন্দেহ নেই। কালিদাস তাঁর কাব্যের উপসংহার লেখেন নি, মহাভারতেও যক্ষের প্রকৃত ইতিহাস নেই। কালিদাস আর ব্যাসদেব যা অনুক্ত রেখেছেন সেই বিচিত্র রহস্য এখন উদঘাটন করছি।
যক্ষপত্নীকে যক্ষিণী বলব, কারণ তার নাম জানা নেই। পতির বিরহে অত্যন্ত কাতর হয়ে যক্ষিণী দিনযাপন করছিল। একটা বেদীর উপর সে প্রতিদিন একটি করে ফুল রাখত আর মাঝে মাঝে গুনে দেখত ৩৬৫ পূরণের কত বাকী। অবশেষে এক বৎসর পূর্ণ হল, কার্তিক মাসও শেষ হল, কিন্তু যক্ষের দেখা নেই। যক্ষিণী উৎকণ্ঠিত হয়ে আরও কিছুদিন প্রতীক্ষা করল, তারপর আর থাকতে না পেরে কুবেরের কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল।
কুবের বললেন, কে গা তুমি? খুব সুন্দরী দেখছি, কিন্তু কেশ অত রুক্ষ কেন? বসন অত মলিন কেন? একটি মাত্র বেণী কেন?
যক্ষিণী সরোদনে বলল, মহারাজ, আপনার সেই কিংকর যাকে এক বৎসরের জন্য নির্বাসনদণ্ড দিয়েছিলেন, আমি তারই দুঃখিনী ভার্যা। আজ দশ দিন হল এক বৎসর উত্তীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এখনও আমার স্বামী ফিরে এলেন না কেন?
কুবের বললেন, ব্যস্ত হচ্ছ কেন, ধৈর্য ধর, নিশ্চয় সে ফিরে আসবে। হয়তো কোথাও আটকে পড়েছে। তার জোয়ান বয়েস, এখানে শুধু নাক—থেবড়া যক্ষিণী আর কিন্নরীই দেখেছে, বিদেশে হয়তো কোনও রূপবতী মানবীকে দেখে তার প্রেমে পড়েছে। তুমি ভেবো না, মানবীতে অরুচি হলেই সে ফিরে আসবে।
সজোরে মাথা নেড়ে যক্ষিণী বলল, না না, আমার স্বামী তেমন নন, অন্য নারীর দিকে তিনি ফিরেও তাকাবেন না। এই সেদিন একটি মেঘ এসে তাঁর আকুল প্রেমের বার্তা আমাকে জানিয়ে গেছে। প্রভু, আপনি দয়া করে অনুসন্ধান করুন, নিশ্চয় তাঁর কোনও বিপদ হয়েছে, হয়তো সিংহব্যাঘ্রাদি তাঁকে বধ করেছে।
কুবের বললেন, তুমি অত উতলা হচ্ছ কেন? তোমার স্বামী যদি ফিরে নাই আসে তবু তুমি অনাথা হবে না। আমার অন্তঃপুরে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে, আমি তোমাকে খুব সুখে রাখব।
যক্ষিণী বলল, ও কথা বলবেন না প্রভু, আপনি আমার পিতৃস্থানীয়। আপনার আজ্ঞায় আমার স্বামী নির্বাসনে গিয়েছিলেন, এখন তাঁর দণ্ডকাল উত্তীর্ণ হয়েছে, তাঁকে ফিরিয়ে আনা আপনারই কর্তব্য। যদি তিনি বিপদাপন্ন হন তবে তাঁকে উদ্ধার করুন, যদি মৃত হন তবে নিশ্চিত সংবাদ আমাকে এনে দিন, আমি অগ্নিপ্রবেশ করে স্বর্গে তাঁর সঙ্গে মিলিত হব।
বিব্রত হয়ে কুবের বললেন, আঃ তুমি আমাকে জ্বালিয়ে মারলে। বেশ, এখনই আমি তোমার স্বামীর সন্ধানে যাচ্ছি, রামগিরি জায়গাটা দেখবার ইচ্ছাও আমার আছে। তুমিও আমার সঙ্গে চল। ওরে, শীঘ্র পুষ্পক রথ জুততে বলে দে। আর তোরা দুজন তৈরি হয়ে নে, আমার সঙ্গে যাবি।
রামগিরি প্রদেশে একটি ছোট পাহাড়ের উপর যক্ষ তার আশ্রম বানিয়েছিল। সেখানে পৌঁছে কুবের দেখলেন, বাড়িটি বেশ সুন্দর, দরজা জানালাও আছে, কিন্তু সবই বন্ধ। কুবেবের আদেশে তাঁর এক অনুচর দরজায় ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ওহে স্থূণাকর্ণ, এখনই বেরিয়ে এস, মহামহিম রাজরাজ কুবের স্বয়ং এসেছেন, তোমার বউও এসেছে।
কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। কুবের বললেন, বাড়িতে কেউ নেই মনে হচ্ছে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া যাক।
যক্ষিণী বলল, অমন কাজ করবেন না মহারাজ। আমার স্বামী এই বাড়িতেই আছেন, আমি মাছ ভাজার গন্ধ পাচ্ছি, নিশ্চয় উনি রান্নায় ব্যস্ত আছেন, কেউ তো সাহায্য করবার লোক নেই। আমিই ওঁকে ডাকছি। ওগো, শুনতে পাচ্ছ? আমি এসেছি, মহারাজও এসেছেন। রান্না ফেলে রেখে চট করে বেরিয়ে এসো।
একটি জানালা ঈষৎ ফাঁক হল। ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে উত্তর এলো, অ্যাঁ, প্রিয়ে তুমি এসেছ, প্রভু এসেছেন? কি সর্বনাশ, তাঁর সামনে আমি বেরুব কি করে?
আশ্চর্য হয়ে কুবের বললেন, কে গো তুমি? এখনই বেরিয়ে এসো নয় তো বাড়িতে আগুন লাগাব।
তখন দরজা খুলে একটি অবগুণ্ঠিতা নারীমূর্তি বেরিয়ে এল। কুবের ধমক দিয়ে বললেন, আর ন্যাকামি করতে হবে না, তোমার ঘোমটা খোল।
মাথা নীচু করে ঘোমটাবতী উত্তর দিল, প্রভু, এ মুখ দেখাব কি করে?
কুবের বললেন, পুড়িয়েছ নাকি? ভেবো না, শিব যাতে চড়েন সেই বৃষভের সদ্যোজাত গোময় লেপন করলেই সেরে যাবে।
যক্ষিণী হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে এক টানে ঘোমটা খুলে ফেলল। মাথা চাপড়ে নারীমূর্তি বলল, হায় হায়, এর চাইতে আমার মরণই ভাল ছিল।
কুবের প্রশ্ন করলেন, কে তুমি? সেই স্থূণাকর্ণ যক্ষটা কোথায় গেল? তুমি তার রক্ষিতা নাকি?
—মহারাজ, আমিই আপনার হতভাগ্য কিংকর স্থূণাকর্ণ, দৈবদুর্বিপাকে এই দশা হয়েছে, কিন্তু আমার কোনও অপরাধ নেই। প্রিয়ে, আমরা নিতান্তই হতভাগ্য, শাপান্ত হলেও আমাদের মিলন হবার উপায় নেই।
যক্ষিণী বলল, মহারাজ, ইনিই আমার স্বামী, ওই যে, জোড়া ভুরু রয়েছে, নাকের ডগায় সেই তিলটিও দেখা যাচ্ছে। হা নাথ, তোমার এমন দশা হল কেন? কোন দেবতাকে চটিয়েছিলে?
যক্ষ বলল, পরের উপকার করতে গিয়ে আমার এই দুরবস্থা হয়েছে। এই জগতে কৃতজ্ঞতা নেই, সত্যপালন নেই।
যক্ষিণী বলল, তুমি মেয়েমানুষ হয়ে গেলে কি করে?
কুবের বললেন, এ রকম হয়ে থাকে। বুধপত্নী ইলা আগে পুরুষ ছিলেন, হরপার্বতীর নিভৃত স্থানে প্রবেশের ফলে স্ত্রী হয়ে যান। বালী—সুগ্রীবের বাপ ঋক্ষরজা এক সরোবরে স্নান করে বানরী হয়ে গিয়েছিলেন। যাই হক, স্থূণাকর্ণ, তুমি সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করে বল।
যক্ষ বলতে লাগল। —মহারাজ, প্রায় তিন মাস হল কিছু শুনো কাঠ সংগ্রহের জন্য আমি নিকটবর্তী ওই অরণ্যে গিয়েছিলাম। দেখলাম, গাছের তলায় একটি ললনা বসে আছে আর আকুল হয়ে অশ্রুপাত করছে।
যক্ষিণী প্রশ্ন করল, মাগী দেখতে কেমন?
—সুন্দরী বলা চলে, তবে তোমার কাছে লাগে না। কাটখোট্টা গড়ন, মুখে লাবণ্যেরও অভাব আছে। মহারাজ, তারপর শুনুন। আমি সেই নারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভদ্রে, তোমার কি হয়েছে? যদি বিপদে পড়ে থাক তবে আমি যথাসাধ্য প্রতিকারের চেষ্টা করব।
সে এই আশ্চর্য বিবরণ দিল। —মহাশয়, আমি পঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা শিখণ্ডিনী, কিন্তু লোকে আমাকে রাজপুত্র শিখণ্ডী বলেই জানে। পূর্বজন্মে আমি ছিলাম কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা। স্বয়ংবরসভা থেকে ভীষ্ম আমাদের তিন ভগিনীকে হরণ করেছিলেন, তাঁর বৈমাত্র ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য। আমি শাল্বরাজের প্রতি অনুরক্তা জেনে ভীষ্ম আমাকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। শাল্ব বললেন, রাজকন্যা, আমি তোমাকে নিতে পারি না, কারণ ভীষ্ম তোমাকে হরণ করেছিলেন, তাঁর স্পর্শ নিশ্চয়ই তোমাকে পুলকিত করেছিল। তখন আমি ভগবান পরশুরামের শরণ নিলাম। তিনি ভীষ্মকে বললেন, তোমারই কর্তব্য অম্বাকে বিবাহ করা। ভীষ্ম সম্মত হলেন না। পরশুরাম তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করলেন, কিন্তু কোনও ফল হল না। ভীষ্মের জন্যই আমার নারীজন্ম বিফল হল এই কারণে ভীষ্মের বধকামনায় আমি কঠোর তপস্যা করলাম। তাতে মহাদেব প্রীত হয়ে বর দিলেন—তুমি পরজন্মে দ্রুপদকন্যা রূপে ভূমিষ্ঠ হবে, কিন্তু পরে পুরুষ হয়ে ভীষ্মকে বধ করবে। মহাদেবের বরে দ্রুপদ গৃহে আমার জন্ম হল। কন্যা হলেও রাজপুত্র শিখণ্ডী রূপেই আমি পালিত হয়েছি, অস্ত্রবিদ্যাও শিখেছি। যৌবনকাল উপস্থিত হলে দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে আমার বিবাহ হল। কিন্তু কিছুদিন পরেই ধরা পড়ে গেলাম। আমার পত্নী দাসীকে দিয়ে তার মায়ের কাছে বলে পাঠাল—মাগো, তোমাদের ভীষণ ঠকিয়েছে, যার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছ সে পুরুষ নয়, মেয়ে।
এই দুঃসংবাদ শুনে আমার শ্বশুর হিরণ্যবর্মা ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি দূত পাঠিয়ে আমার পিতা দ্রুপদকে জানালেন, দুর্মতি, তুমি আমাকে প্রতারিত করেছ। আমি সসৈন্যে তোমার রাজ্যে যাচ্ছি, চারজন চতুরা যুবতীও আমার সঙ্গে যাচ্ছে, তারা আমার জামাতা শিখণ্ডীকে পরীক্ষা করবে। যদি দেখা যায় যে সে পুরুষ নয় তবে তোমাকে আমি অমাত্যপরিজনসহ বিনষ্ট করব।
পিতার এই দারুণ বিপদ দেখে আমি গৃহত্যাগ করে এই বনে পালিয়ে এসেছি। আমার জন্যই স্বজনবর্গ বিপন্ন হয়েছেন, আমার আর জীবনে প্রয়োজন কি। আমি এখানেই অনাহারে জীবন বিসর্জন দেব।
যক্ষরাজ, শিখণ্ডিনীর এই ইতিহাস শুনে আমার অত্যন্ত অনুকম্পা হল। আমি তাকে বললাম, তুমি কি চাও বল। আমি ধনপতি কুবেবের অনুচর, অদেয় বস্তুও দিতে পারি।
শিখণ্ডিনী বলল, যক্ষ, আমায় পুরুষ করে দাও।
আমি বললাম, রাজকন্যা, আমার পুরুষত্ব কয়েক দিনের জন্য তোমাকে ধার দেব, তাতে তুমি তোমার পিতা ও আত্মীয়বর্গকে দশার্ণরাজের ক্রোধ থেকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই তুমি এখানে এসে আমার পুরুষত্ব ফিরিয়ে দেবে। আমার শাপান্ত হতে আর বিলম্ব নেই, প্রিয়ার সঙ্গে মিলনের জন্য আমি অধীর হয়ে আছি, অতএব তুমি সত্বর ফিরে এসো।
মহারাজ, শিখণ্ডিনী সেই যে চলে গেল তারপর আর আসে নি। সেই মিথ্যাবাদিনী দ্রুপদনন্দিনী ধাপ্পা দিয়ে আমার পুরুষত্ব আদায় করে পালিয়েছে, তার বদলে দিয়ে গেছে তার তুচ্ছ নারীত্ব।
যক্ষের কথা শুনে যক্ষিণী বলল, একটা অজানা মেয়ের কান্নায় ভুলে গিয়ে তোমার অমূল্য সম্পদ তাকে দিয়ে দিলে! নাথ, তুমি কি বোকা, কি বোকা!
কুবের বললেন, তুমি একটি গজমূর্খ গর্দভ গাড়ল। যাই হক, এখনই আমি তোমার পুরুষত্ব উদ্ধার করে দেব। চল আমার সঙ্গে।
সকলে পঞ্চাল রাজ্যে উপস্থিত হলেন। রাজধানী থেকে কিছুদূরে এক নির্জন বনে পুষ্পক রথ রেখে কুবের তাঁর এক অনুচরকে বললেন, দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডীকে সংবাদ দাও—বিশেষ প্রয়োজনে ধনেশ্বর কুবের তোমাকে ডেকেছেন, যদি না আস তবে পঞ্চাল রাজ্যের সর্বনাশ হবে।
শিখণ্ডী ব্যস্ত হয়ে তখনই এসে প্রণাম করে বললেন, যক্ষরাজ, আমার প্রতি কি আজ্ঞা হয়?
কুবের বললেন, শিখণ্ডী, তুমি আমার কিংকর এই স্থূণাকর্ণকে প্রতারিত করেছ, এর প্রিয়ার সঙ্গে মিলনে বাধা ঘটিয়েছ, যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে তা রক্ষা কর নি। যদি মঙ্গল চাও তবে এখনই এর পুরুষত্ব প্রত্যর্পণ কর।
শিখণ্ডী বললেন, ধনেশ্বর, আমি অবশ্যই প্রতিশ্রুতি পালন করব, আমার বিলম্ব হয়ে গেছে তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। এই যক্ষ আমার মহোপকার করেছেন, কৃপা করে আরও কিছুদিন আমায় সময় দিন।
কুবের বললেন কেন, তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি?
—যক্ষরাজ, যে বিপদ আসন্ন ছিল তা কেটে গেছে। দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার সঙ্গে যে যুবতীরা এসেছিল তারা আমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে তাঁকে বলেছে, আপনার জামাতা পূর্ণমাত্রায় পুরুষ এবং ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা। এই কথা শুনে শ্বশুর মহাশয় অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে আমার পিতার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং বিস্তর উপঢৌকন দিয়ে সদলবলে প্রস্থান করেছেন। যাবার সময় তাঁর কন্যাকে বোকা মেয়ে বলে ধমক দিয়ে গেছেন। আমি এই যক্ষ মহাশয়ের কাছে আর এক মাস সময় ভিক্ষা চাচ্ছি, তার মধ্যেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সমাপ্ত হবে। ভীষ্মকে বধ করেই আমি স্থূণাকর্ণের ঋণ শোধ করব।
কুবের বললেন, মহারথ ভীষ্মকে তুমি বধ করবে এ কথা অবিশ্বাস্য। তিনিই তোমাকে বধ করবেন, সেই সঙ্গে তোমার পুরুষত্বও বিনষ্ট হবে। ও সব চলবে না, তুমি এই মুহূর্তে স্থূণাকর্ণের পুরুষত্ব প্রত্যর্পণ কর এবং তোমার স্ত্রীত্ব ফিরিয়ে নাও। নতুবা আমি সাক্ষীপ্রমাণ নিয়ে এখনই তোমার শ্বশুরের কাছে যাব। তোমার প্রতারণার কথা জানলেই তিনি সসৈন্যে এসে পঞ্চাল রাজ্য ধ্বংস করবেন।
ব্যাকুল হয়ে শিখণ্ডী বললেন, হা, আমার গতি কি হবে!
কুবের বললেন, ভাবছ কেন, তোমার ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন আছেন, পঞ্চপাণ্ডব ভগিনীপতি আছেন, পাণ্ডবসখা কৃষ্ণ আছেন। তাঁরাই ভীষ্মবধের ব্যবস্থা করবেন।
শিখণ্ডী বললেন, তা হবার জো নেই। ভীষ্ম পাণ্ডবদের পিতামহ, আর দ্রোণ তাঁদের আচার্য। এই দুই গুরুজনকে তাঁরা বধ করবেন না, এই কারণে ভীষ্মবধের ভার আমার উপর আর দ্রোণবধের ভার ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর পড়েছে।
কুবের কোনও আপত্তি শুনলেন না। অবশেষে নিরুপায় হয়ে শিখণ্ডী যক্ষকে পুরুষত্ব প্রত্যর্পণ করে নিজের স্ত্রীত্ব ফিরিয়ে নিলেন। তখন কুবেরের সঙ্গে যক্ষ আর যক্ষিণী পরমানন্দে অকালপুরীতে চলে গেল।
বিষণ্ণমনে অনেকক্ষণ চিন্তা করে শিখণ্ডী (এখন শিখণ্ডিণী) কৃষ্ণসকাশে এলেন। দৈবক্রমে দেবর্ষি নারদও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কৃষ্ণ বললেন, একি শিখণ্ডী, তোমাকে এমন অবসন্ন দেখছি কেন? দুদিন আগেও তোমার বীরোচিত তেজস্বী মূর্তি দেখেছিলাম এখন আবার কোমল স্ত্রীভাব দেখছি কেন?
শিখণ্ডী বললেন, বাসুদেব, আমার বিপদের অন্ত নেই।
নারদ বললেন তোমরা বিশ্রম্ভালাপ কর, আমি এখন উঠি।
শিখণ্ডী বললেন, না না দেবর্ষি, উঠবেন না। আপনি তো আমার ইতিহাস সবই জানেন, আপনার কাছে গোপনীয় কিছু নেই।
সমস্ত ঘটনা বিবৃত করে শিখণ্ডী বললেন কৃষ্ণ, তুমি পাণ্ডব আর পাঞ্চালদের সুহৃদ, আমার ভগিনী কৃষ্ণা তোমার সখী। আমাকে সংকট হতে উদ্ধার কর। বিগত জন্ম থেকেই আমার সংকল্প আছে যে ভীষ্মকে বধ করব, মহাদেবের বরও আমি পেয়েছি। কিন্তু পুরুষত্ব না পেলে আমি যুদ্ধ করব কি করে?
কৃষ্ণ বললেন, তোমার সংকল্প ধর্মসংগত নয়। নারী হয়ে জন্মেছ, অলৌকিক উপায়ে পুরুষ হতে চাও কেন? ভীষ্মকে বধ করবার ভার অন্য লোকের উপর ছেড়ে দাও। দেবর্ষি কি বলেন?
নারদ বললেন, ওহে শিখণ্ডী, কৃষ্ণ ভালই বলেছেন। শাল্বরাজ আর ভীষ্ম তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাতে হয়েছে কি? পৃথিবীতে আরও পুরুষ আছে। তুমি যদি সম্মত হও তবে আমি তোমার পিতাকে বলব, তিনি যেন কোন সৎপাত্রে তোমাকে অর্পণ করেন। তাতেই তোমার নারীজন্ম সার্থক হবে। তোমার পত্নীরও একটা গতি হয়ে যাবে সে তোমার সপত্নী হয়ে সুখে থাকবে।
শিখণ্ডী বললেন, অমন কথা বলবেন না দেবর্ষি। মহাদেব আমাকে যে বর দিয়েছেন তা অবশ্যই সফল হবে। কৃষ্ণ, তোমার অসাধ্য কিছু নেই, তুমি আমাকে পুরুষ করে দাও।
কৃষ্ণ বললেন, আমি বিধাতা নই যে অঘটন ঘটাব। সেই যক্ষের মতন কেউ যদি স্বেচ্ছায় তোমার সঙ্গে অঙ্গ বিনিময় করে তবেই তুমি পুরুষ হতে পারবে। কিন্তু সেরকম নির্বোধ আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। দেবর্ষি, আপনি তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরে বেড়ান, আপনার জানা আছে?
নারদ বললেন, আছে, তুমিও তাঁকে জান। শোন শিখণ্ডী, বৃন্দাবন ধামে কৃষ্ণের এক দূর সম্পর্কের মাতুল আছেন। তিনি গোপবংশীয়, নাম আয়ান ঘোষ। অতি সদাশয় পরোপকারী লোক, কিন্তু বড়ই মনঃকষ্টে আছেন, ধর্মকর্ম নিয়েই থাকেন, সংসারে আসক্তি নেই। তুমি তাঁর শরণাপন্ন হও।
শিখণ্ডী বললেন, বাসুদেব, তুমি আমার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করে শ্রীআয়ানকে একটি পত্র দাও, তাই নিয়ে আমি তাঁর কাছে যাব।
কৃষ্ণ বললেন, পাগল হয়েছ? আমার নাম যদি ঘুণাক্ষরে উল্লেখ কর তবে তখনই তিনি তোমাকে বিতাড়িত করবেন। দেখ শিখণ্ডী, আমার অদৃষ্ট বড় মন্দ, অকারণে আমি কয়েকজনের বিরাগভাজন হয়েছি—কংস, শিশুপাল, আর আমার পূজ্যপাদ মাতুল এই আয়ান ঘোষ। এমন কি, আমার পুত্র শাম্বের শ্বশুর দুর্যোধনও আমার শত্রু হয়েছেন।
শিখণ্ডী বললেন, তবে উপায়?
নারদ বললেন, উপায় তোমারই হাতে আছে। নারীর ছলাকলা আর পুরুষের কূটবুদ্ধি দুটিই তোমার স্বভাবসিদ্ধ, তাই দিয়েই কাজ উদ্ধার করতে পারবে। চল আমার সঙ্গে, শ্রীআয়ানের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব।
বৃন্দাবনের এক প্রান্তে লোকালয় হতে বহু দূরে যমুনাতীরে একটি কুটীর নির্মাণ করে আয়ান ঘোষ সেখানে বাস করেন। বিকাল বেলা নদীপুলিনে বসে তিনি রাবণরচিত শিবতাণ্ডব স্তোত্র আবৃত্তি করছিলেন, এমন সময় শিখণ্ডীর সঙ্গে নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন।
সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে আয়ান বললেন, দেবর্ষি, আমি ধন্য যে আপনার দর্শন পেলাম। এই সুন্দরীকে তো চিনতে পারছি না।
নারদ বললেন, ইনি পঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা শিখণ্ডিনী। ভগবান শূলপাণি একটি কঠোর ব্রত পালনের ভার এঁর উপর দিয়েছেন। সেই ব্রত উদযাপিত না হওয়া পর্যন্ত এঁকে অনূঢ়া থাকতে হবে। কিন্তু কোনও সদাশয় ধর্মপ্রাণ পুরুষের সাহায্য ভিন্ন এঁর সংকল্প পূর্ণ হবে না। মহামতি আয়ান, আমি দিব্যচক্ষুতে দেখছি তুমিই সেই ভাগ্যবান পুরুষ। এঁর অনুরোধ রক্ষা কর, ব্রত সমাপ্ত হলেই এই অশেষ গুণবতী ললনা তোমাকে পতিত্বে বরণ করবেন, তোমার জীবন ধন্য হবে।
একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করে আয়ান বললেন, হা দেবর্ষি, আমার জীবন কি করে ধন্য হবে? আমার সংসার থাকতেও নেই, গৃহ শূন্য। লোকে আমাকে অবজ্ঞা করে, অপদার্থ কাপুরুষ বলে, অন্তরালে ধিককার দেয়। তাই জনসংস্রব বর্জন করে এই নিভৃত স্থানে বাস করছি। এই বরবর্ণিনী রাজকন্যা আমার ন্যায় হতভাগ্যের কাছে কেন এসেছেন?
শিখণ্ডী মধুর কণ্ঠে বললেন, গোপশ্রেষ্ঠ মহাত্মা আয়ান, আপনার গুণরাশি শুনে দূর থেকেই আমি মোহিত হয়েছিলাম, এখন আপনাকে দেখে আমি অভিভূত হয়েছি, আপনার চরণে মনঃপ্রাণ সমর্পণ করেছি।
আয়ান বললেন, আমার বঞ্চিত ধিককৃত জীবনে এমন সৌভাগ্যের উদয় হবে তা আমি স্বপ্নেও আশা করি নি। মনোহারিণী শিখণ্ডিনী, তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নেই। আমার কাছে তুমি কি চাও বল।
শিখণ্ডী বললেন, দেবর্ষি, আপনিই এঁকে বুঝিয়ে দিন।
ব্রতের কথা সংক্ষেপে জানিয়ে নারদ বললেন, গোপেশ্বর আয়ান, মহাদেবের বরে শিখণ্ডিনী অবশ্যই সিদ্ধিলাভ করবেন, তোমাকে কেবল এক মাসের জন্য এঁকে তোমার পুরুষত্ব দান করতে হবে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তার মধ্যেই সমাপ্ত হবে, ভীষ্মও স্বর্গলাভ করবেন, তার পরেই রাজা দ্রুপদ তাঁর এই কন্যাকে তোমার হস্তে সম্প্রদান করবেন, পঞ্চাল রাজ্যের অর্ধ অংশ ও বিস্তর সবৎসা ধেনুও যৌতুক স্বরূপ দেবেন। বৃন্দাবনের অপ্রিয় স্মৃতি পশ্চাতে ফেলে রেখে তুমি নূতন পত্নীসহ নতুন দেশে পরম সুখে রাজত্ব করবে।
ক্ষণকাল চিন্তার পর আয়ানের দ্বৈধ দূর হল, তিনি তাঁর ভাবী বধূর প্রার্থনা পূর্ণ করলেন। পুনর্বার পুরুষত্ব লাভ করে শিখণ্ডী হৃষ্টচিত্তে নারদের সঙ্গে চলে গেলেন। আর স্ত্রীরূপী আয়ান কুটীরের দ্বার রুদ্ধ করে অসূর্যম্পশ্যা হয়ে শিখণ্ডিনীর প্রত্যাশায় দিন যাপন করতে লাগলেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দশম দিনে শিখণ্ডীর বাণে জর্জরিত হয়ে ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করলেন। তার আটদিন পরে যুদ্ধ সমাপ্ত হল। কিন্তু শিখণ্ডী আয়ানের কাছে এলেন না, তাঁর আসবার উপায়ও ছিল না। অশ্বত্থামা গভীর নিশীথে পাণ্ডবশিবিরে প্রবেশ করে যাঁদের হত্যা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শিখণ্ডীও ছিলেন।
আয়ানের ভাগ্যে রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব লাভ হল না, তাঁর পুরুষত্বও শিখণ্ডীর সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর জীবন বিফল হল এমন কথা বলা যায় না। কালক্রমে আয়ানের এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক পরিবর্তন হল। তিনি মনঃপ্রাণ শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করে আয়ানী নামে খ্যাত হলেন, শ্রীখোল বাজাতে শিখলেন, এবং ব্রজমণ্ডলে যে ষোলো হাজার গোপিনী বাস করত তাদের নেত্রী হয়ে নিরন্তর কৃষ্ণকীর্তন করতে লাগলেন।
১৮৭৯ শক (১৯৫৭)
আতার পায়েস
চুরির জন্যই যে চুরি তাতে একটা অনিবর্চনীয় আনন্দ পাওয়া যায়। দেশের কাজে চুরি, সরকারি কনট্রাক্টে চুরি, তহবিল তসরুফ, পকেট মারা, ইত্যাদির উদ্দেশ্য যতই মহৎ হক, তাতে আনন্দ নেই, শুধু স্থূল স্বার্থসিদ্ধি। গীতায় যাকে কাম্যকর্ম বলা হয়েছে, এসব চুরি তারই অন্তর্গত। কিন্তু যে চুরি অহেতুক, যা শুধু অকারণ পুলকে করা হয়, তা নিষ্কাম ও সাত্ত্বিক, অনাবিল আনন্দ তাতেই মেলে। যশোদাদুলাল শ্রীকৃষ্ণ ভালই খেতেন, কার্বোহাইড্রেট প্রোটিন ফ্যাট কিছুরই তাঁর অভাব ছিল না, তথাপি তিনি ননি চুরি করতেন। তাঁর কটিতটের রঙিন ধটী যথেষ্ট ছিল, বস্ত্রাভাব কখনও হয় নি, তথাপি তিনি বস্ত্রহরণ করেছিলেন। এই হল নিষ্কাম সাত্ত্বিক চুরির ভগবৎপ্রদর্শিত নিদর্শন। রামগোপাল হাইস্কুলের মাস্টার প্রবোধ ভটাচায একবার এইরকম চুরিতে জড়িয়ে পড়েছিল।
প্রবোধ মাস্টারের বয়স ত্রিশ, আমুদে লোক, ছাত্ররা তাকে খুব ভালবাসে। পূজোর বন্ধর দিন কতক আগে পাঁচটি ছেলে তার কাছে এল। তাদের মুখপাত্র সুধীর বললেন, সার, মহা মুশকিলে পড়েছি।
প্রবোধ জিজ্ঞাসা করলেন, ব্যাপারটা কি?
—গেল বছর আমার বড়—দার বিয়ে হয়ে গেল জানেন তো? তার শ্বশুর ভৈরববাবু খুব বড়লোক, দেওঘরের কাছে গণেশমুণ্ডায় তাঁর একটি চমৎকার বাড়ি আছে। বউ—দি বলেছে, সে বাড়ি এখন খালি, পুজোর ছুটিতে আমরা জনকতক স্বচ্ছন্দে কিছুদিন সেখানে কাটিয়ে আসতে পারি।
—এ তো ভাল খবর, মুশকিল কি হল?
—ভৈরববাবু বলেছেন, আমাদের সঙ্গে যদি একজন অভিভাবক যান তবেই আমাদের সেখানে থাকতে দেবেন।
—তোমার বড়—দা আর বউ—দিকে নিয়ে যাও না।
—তা হবার জো নেই, ওরা মাইসোর যাচ্ছে। আপনিই আমাদের সঙ্গে চলুন সার। ক্লাস টেনের আমি, ক্লাস নাইনের নিমাই নরেন সুরেন আর ক্লাস এইটের পিণ্টু আমরা এই পাঁচ জন যাব, আপনার কোনো অসুবিধে হবে না।
—সঙ্গে চাকর যাবে তো?
—কোনও দরকার নেই। সেখানে দারোয়ান আর মালী আছে, তারাই সব কাজ করে দেবে। খাবার জন্যে ভাববেন না সার। আমরা সঙ্গে স্টোভ নেব, কারি পাউডার নেব, চা চিনি গুঁড়ো দুধ আর বিস্কুটও দেদার নেব। ওখানে সস্তায় মুরগি পাওয়া যায়, বউ—দি কারি রান্না শিখিয়ে দিয়েছে। ওখানকার দারোয়ান পাঁড়েজী ভাত রুটি যা হয় বানিয়ে দেবে, আমরা নিজেরা দু বেলা ফাউল কারি রাঁধব। তাতেই হবে না?
প্রবোধ বললে, সব তো বুঝলুম, কিন্তু আমাকে নিয়ে যেতে চাও কেন? মাস্টার সঙ্গে থাকলে তোমাদের ফুর্তির ব্যাঘাত হবে না?
সজোরে মাথা নেড়ে সুধীর বললে, মোটেই একদম একটুও কিচ্ছু ব্যাঘাত হবে না, আপনি সে রকম মানুষই নন স্যার। আপনি সঙ্গে থাকলে আমাদের তিন ডবলফুর্তি হবে।
নিমাই নরেন সুরেন সমস্বরে বললে, নিশ্চয় নিশ্চয়।
পিণ্টু বললে, সার, কোনান ডয়েলের সেই লস্ট ওয়ার্ল্ড গল্পটা ওখানে গিয়ে বলতে হবে কিন্তু।
প্রবোধ যেতে রাজী হল।
দেওঘর আর জসিডির মাঝামাঝি গণেশমুণ্ডা পল্লীটি সম্প্রতি গড়ে উঠেছে। বিস্তর সুদৃশ্য বাড়ি, পরিচ্ছন্ন রাস্তা, প্রাকৃতিক দৃশ্যও ভাল। ভৈরববাবুর অট্টালিকা ভৈরব কুটীর আর তার প্রকাণ্ড বাগান দেখে ছেলেরা আনন্দে উৎফুল্ল হল এবং ঘুরে ঘুরে চার দিক দেখতে লাগল। বাগানে অনেক রকম ফলের গাছ। গোটা কতক আতা গাছে বড় বড় ফল ধরেছে, অনেকগুলো একেবারে তৈরি, পেড়ে খেলেই হয়।
প্রবোধ বললে, ভারী আশ্চর্য তো, ভৈরববাবুর দারোয়ান আর মালী দেখছি অতি সাধু পুরুষ।
সুধীর বললে, মনেও ভাববেন না তা, আমি এখানে এসেই সব খবর নিয়েছি সার। দারোয়ান মেহী পাঁড়ে আর মালী ছেদী মাহাতো এদের মধ্যে ভীষণ ঝগড়া। দুজনে দুজনের ওপর কড়া নজর রাখে তাই এ পর্যন্ত কেউ চুরি করবার সুবিধে পায় নি।
প্রবোধ বললে, আত্মকলহের ফলই এই। পাঁড়ে আর মাহাতো যদি একমত হত তবে স্বচ্ছন্দে আতা বেচে দিয়ে লাভটা ভাগাভাগি করে নিতে পারত।
নিমাই বললে, আচ্ছা স্যার, আমাদের দেশনেতাদের মধ্যে তো ভীষণ ঝগড়া তবুও চুরি হচ্ছে কেন?
সুধীর বললে, যা যাঃ, জেঠামি করিস নি। আগে বড় হ, তারপর পলিটিক্স বুঝবি।
নিমাই বললে, যদি দু—তিন সের দুধ যোগাড় করা যায় তবে চমৎকার আতার পায়েস হতে পারবে। আমি তৈরি করা দেখেছি, খুব সহজ।
সুধীর বললে, বেশ তো, তুই তৈরি করে দিস। ও পাঁড়েজী, তুমি কাল সকালে তিন সের খাঁটী দুধ আনতে পারবে?
পাঁড়ে বললে, জরুর পারব হুজুর।
নাওয়া খাওয়া আর বিশ্রাম চুকে গেল। বিকেল বেলা সকলে বেড়াতে বেরুল। ঘণ্টা খানিক বেড়াবার পর ফেরবার পথে সুধীর বললে, দেখুন সার এই বাড়িটি কি সুন্দর, ভীমসেন ভিলা। গেটের ওপর কি চমৎকার থোকা থোকা হলদে ফুল ফুটেছে!
আকাশের দিকে হাত বাড়িয়ে পিণ্টু চেঁচিয়ে উঠল— ওই ওই একটা নীলকণ্ঠ পাখি উড়ে গেল।
নিমাই বললে, এদিকে দেখুন স্যার, উঃ কি ভয়ানক পেয়ারা ফলেছে, কাশীর পেয়ারার চাইতে বড় বড়। নিশ্চয় এ বাড়িরও দারোয়ান আর মালীর মধ্যে ঝগড়া আছে তাই চুরি যায় নি।
ফটকে তালা নেই। সুধীর ভিতরে ঢুকে এদিক ওদিক উঁকি মেরে বললে, কাকেও তো কোথাও দেখছি না, কিন্তু ঘরের জানালা খোলা, মশারি টাঙানো রয়েছে। বোধ হয় সবাই বেড়াতে গেছে। দারোয়ান, ও দারোয়ানজী, ও মালী!
কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। তখন সকলে ভিতরে এসে ফটকের পাল্লা ভেজিয়ে দিল।
নিমাই বললে, একটা পেয়ারা পাড়ব সার?
প্রবোধ বললে, বাজারে প্রচুর পেয়ারা দেখেছি, নিশ্চয় খুব সস্তা, খেতে চাও তো কিনে খেয়ো। বিনা অনুমতিতে পরের দ্রব্য নিলে চুরি করা হয় তা জানো না?
—জানি সার। চুরি করব না, শুধু একটা চেখে দেখব কাশীর পেয়ারার চাইতে ভাল কি মন্দ।
প্রবোধ পিছন ফিরে গম্ভীর ভাবে একটা তালগাছের মাথা নিরীক্ষণ করতে লাগল। মৌনং সম্মতিলক্ষণম ধরে নিমাই গাছে উঠল। পেয়ারা পেড়ে কামড় দিয়ে বললে, বোম্বাই আমের চাইতে মিষ্টি!
সুধীর বললে, এই নিমে, স্যারকে একটা দে।
নিমাই একটা বড় পেয়ারা নিয়ে হাত ঝুলিয়ে বললে, এইটে ধরুন স্যার, একটু চেখে দেখুন, চমৎকার।
পেয়ারায় কামড় দিয়ে প্রবোধ বললে, সত্যিই খুব ভাল পেয়ারা। আর বেশী পেড়ো না, তা হলে ভারী অন্যায় হবে কিন্তু। লোভ সংবরণ করতে শেখ।
ততক্ষণ নিমাই—এর সব পকেট বোঝাই হয়ে গেছে, তার সঙ্গীরাও প্রত্যেকে দু তিনটে করে পেয়েছে। সুধীর বললে, এই নিমে, শুনতে পাচ্ছিস না বুঝি? সার রাগ করছেন, নেমে আয় চট করে, এক্ষুনি হয়তো কেউ এসে পড়বে।
হঠাৎ ক্যাঁচ করে গেটটা খুলে গেল, একজন মোটা বৃদ্ধ ভদ্রলোক আর একটি রোগা মহিলা প্রবেশ করলেন। দুজনের হাতে গামছায় বাঁধা বড় বড় দুটি পোঁটলা। নিমাই গাছের ডাল ধরে ঝুলে ধুপ করে নেমে পড়ল।
বৃদ্ধ চেঁচিয়ে বললেন, অ্যাঁ, এসব কি, দল বেঁধে আমার বাড়ি ডাকাতি করতে এসেছ! ভদ্রলোকের ছেলেরএই কাজ? ঝব্বু সিং, এই ঝব্বু সিং—বেটা গেল কোথায়!
পোঁটলা দুটি নিয়ে মহিলা বাড়ির মধ্যে ঢুকলেন। ঝব্বু সিং এক লোটা বৈকালিক ভাঙ খেয়ে তার ঘরে ঘুমুচ্ছিল, এখন মনিবের চিৎকারে উঠে গাঢ় চোখ রগড়াতে রগড়াতে বেরিয়ে এল। সে হুঁশিয়ার লোক, গেটে তাড়াতাড়ি তালা বন্ধ করে লাঠি ঠুকতে ঠুকতে বললেন, হুজুর, হুকুম দেন তো থানে মে খবর দিয়ে আসি। হো বৈজনাথজী, ছিয়া ছিয়া, ভদ্দর আদমীর ছেলিয়ার এহি কাম!
হুজুর বললেন, খুব হয়েছে, ডাকাতরা চোখের সামনে লুটে নিলে আর তুমি বেহুঁশ হয়ে ঘুমুচ্ছিলে। তারপর, মশায়দের কোত্থেকে আগমন হল? এরা তো দেখছি ছোকরা, বজ্জাতি করবারই বয়েস, কিন্তু তুমি তো বাপু খোকা নও, তুমিই বুঝি দলের সদ্দার?
প্রবোধ হাত জোড় করে বললে, মহা অপরাধ হয়ে গেছে স্যর। এই নিমাই, সব পেয়ারা দারোয়ানজীর জিম্মা করে দাও। আমরা বেশী খাই নি স্যার, মাত্র দু—তিনটে চেখে দেখেছি। অতি উৎকৃষ্ট পেয়ারা।
—কৃতার্থ হলুম শুনে। এরা বোধ হয় স্কুলের ছেলে। তোমার কি করা হয়? নাম কি?
—আজ্ঞে, আমার নাম প্রবোধচন্দ্র ভট্টাচার্য, মানিকতলার রামগোপাল হাই স্কুলের মাস্টার। এরা সব আমার ছাত্র, পুজোর ছুটিতে আমার সঙ্গে বেড়াতে এসেছে।
—খাসা অভিভাবকটি পেয়েছে, খুব নীতিশিক্ষা হচ্ছে! আমাকে চেন? ভীমচন্দ্র সেন, রিটায়ার্ড ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। রায়বাহাদুর খেতাবও আছে, কিন্তু এই স্বাধীন ভারতে সেটার আর কদর নেই। বিস্তর চোরকে আমি জেলে পাঠিয়েছি। তোমার স্কুলের সেক্রেটারিকে যদি লিখি—আপনাদের প্রবোধ মাস্টার এখানে এসে তার ছাত্রদের চুরিবিদ্যে শেখাচ্ছে, তা হলে কেমন হয়?
—যদি কর্তব্য মনে করেন তবে আপনি তাই লিখুন সার, আমি আমার কৃতকর্মের ফল ভোগ করব। তবে একটা কথা নিবেদন করছি। কেউ অভাবে পড়ে চুরি করে, কেউ বিলাসিতার লোভে করে, কেউ বড়লোক হবার জন্যে করে। কিন্তু কেউ কেউ, বিশেষত যাদের বয়েস কম, নিছক ফুর্তির জন্যেই করে। আমি অবশ্য ছেলেমানুষ নই, কিন্তু এই ছেলেদের সঙ্গে মিশে, এই শরৎ ঋতুর প্রভাবে, আর আপনার এই সুন্দর বাগানটির শোভায় মুগ্ধ হয়ে আমারও একটু বালকত্ব এসে পড়েছে। এই যে পেয়ারা চুরি দেখছেন এ ঠিক মামুলী কুকর্ম নয়, এ হচ্ছে শুধু নবীন প্রাণরসের একটু উচ্ছলতা।
—হুঁ। ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা, পুচ্ছটি তোর উচ্চেচ তুলে নাচা। রবি ঠাকুর তোমাদের মাথা খেয়েছেন। বিয়ে করেছ?
—করেছি স্যার।
—তবে পুজোর ছুটিতে বউকে ফেলে এখানে এসেছ কি করতে? বনে না বুঝি?
—আজ্ঞে, খুবই বনে। কিন্তু তিনি তাঁর বড়লোক দিদি আর জামাইবাবুর সঙ্গে শিলং গেলেন, আমি এই ছেলেদের আবদার ঠেলতে পারলুম না তাই এখানে এসেছি! সার, যে কুকর্ম করে ফেলেছি তার বিচার একটু উদারভাবে করুন। আপনি ধীর স্থির প্রবীণ বিচক্ষণ ব্যক্তি, ছেলেমানুষী ফুর্তির বহু ঊর্ধ্বে উঠে গেছেন—
—কে বললে ঊর্ধ্বে উঠে গেছি? আমাকে জরদগব গিধড় ঠাউরেছ নাকি?
—তাহলে আশা করতে পারি কি যে আমাদের ক্ষমা করলেন? আমরা যেতে পারি কি?
—পেয়ারাগুলো নিয়ে যাও, চোরাই মাল আমি স্পর্শ করি না। আচ্ছা, এখন যেতে পার, এবারকার মতন মাপ করা গেল।
এমন সময় মহিলাটি বাইরে এসে বললেন, কি বেআক্কেল মানুষ তুমি, এরা তোমার এজলাসের আসামী নাকি? তুমি এদের মাপ করবার কে? তোমাকে মাপ করবে কে শুনি? এখন যেয়ো না বাবারা, এই বারান্দায় এসে একটু ব’স।
ভীমবাবু বললেন, এদের খাওয়াবে নাকি? তোমার ভাঁড়ার তো ঢু ঢু, চা পর্যন্ত ফুরিয়ে গেছে, হরি সরকার বাজার থেকে ফিরলে তবে হাঁড়ি চড়বে।
—সে তোমাকে ভাবতে হবে না, যা আছে তাই দেব। মিনিট দশ সবুর করতে হবে বাবারা।
গৃহিণী ভিতরে গেলে ভীমবাবু বললেন, উনি ভীষণ চটে গেছেন, না খাইয়ে ছাড়বেন না, অগত্যা ততক্ষণ এই এজলাসেই তোমরা আটক থাক। এখানে উঠেছ কোথায়?
প্রবোধ বললে, ভৈরব কুটীরে, স্টেশনের দিকে যে রাস্তা গেছে তারই ওপর।
ভীমবাবু বললেন, কি সর্বনাশ। যার ফটকের পাশে বেগনী বুগনভিলিয়ার ঝাড় আছে সেই বাড়ি?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। বাড়িটার কোন দোষ আছে?
—নাঃ, দোষ তেমন কিছু নেই। তোমরা ওখানে উঠেছ তা ভাবি নি।
নিমাই বললে, ভূতে পাওয়া বাড়ি নাকি?
—ভূত কোন বাড়িতে নেই? এ বাড়িতেও আছে। ও পাড়াটায় বড্ড চোরের উপদ্রব, এ পাড়ার চাইতে বেশী।
একটু পরে ভীমবাবুর পত্নী একটা বড় ট্রেতে বসিয়ে একটি ধূমায়মান গামলা এবং গোটাকতক বাটি আর চামচ নিয়ে এলেন। ভীমবাবু একটি টেবিল এগিয়ে দিয়ে বললেন, এ কি এনেছ, আতার পায়েস যে! এর মধ্যেই তৈরি করে ফেললে?
গৃহিণী বললেন, আর তো কিছু নেই, এই দিয়েই একটু মিষ্টিমুখ করুক।
ভীমবাবু বললেন, সবটাই এনেছ নাকি?
—হ্যাঁ গো হ্যাঁ, আর লোভ ক’রো না বাপু। ছেলেরা যে পেয়ারা পেড়েছে তাই না হয় একটা খেয়ো। চিবুতে না পার তো সেদ্ধ করে দেব।
সুধীর সহাস্যে বলল, স্যার, আমাদের ওখানে বিস্তর আতা ফলেছে, ইয়া বড় বড়। কাল সকালে পায়েস বানিয়ে আপনাদের দিয়ে যাব।
ভীমবাবু বললেন, না, না, অমন কাজটি ক’রো না। আতা আমার সয় না।
ভৈরব কুটীরে ফিরে এসে নিমাই বললে, একি, গাছের বড় বড় আতাগুলো গেল কোথায়?
সুধীর বললে, বোধহয় পাঁড়েজী সদ্দারি করে পেড়ে রেখেছে। ও পাঁড়ে, আতা কি হল?
পাঁড়ে ব্যস্ত হয়ে এসে মাথায় একটু চাপড় মেরে করুণ কণ্ঠে বললে, কি কহবো হুজুর, বহুত ঝামেলা হয়ে গেছে! এক মোটা—সা বুঢ়াবাবু আর এক দুবলা—সা বু ঈ মাঈ এসেছিল। বাবু পটপট সব আতা ছিঁড়ে লিলে। হামি মানা করলে খাফা হয়ে বললে, চোপ রহো উল্লু! আমার ডর লাগল, শায়দ কোই বড়া অপসর উপসরকা বাবা উবা হোবে—
সুধীর বললে, হাতে লাল গামছা ছিল?
—জী হাঁ, উসি মে তো বাঁধ কে লিয়ে গেল।
হাসির প্রকোপ একটু কমলে নিমাই বললে, হলধর দত্তর ‘চোরে চোরে’ গল্পের চাইতে মজার।
প্রবোধ বললে, যাক, আমরা ঠকি নি, আতার পায়েস খেয়েছি, পেয়ারাও পেয়েছি। কিন্তু ভীমচন্দ্র সেন মশায়ের জন্য দুঃখ হচ্ছে, তাঁর গিন্নী তাঁকে বঞ্চিত করেছেন।
নিমাই বললে, ভাববেন না স্যার, দিন দুই পরেই আবার বিস্তর আতা পাকবে, তখন পায়েস করে ভীমসেন মশায় আর তাঁর গিন্নীকে খাওয়াব।
১৩৬০ (১৯৫৩)
আনন্দ মিস্ত্রী
বিশ্বকর্মা এঞ্জিনিয়রিং ওআর্কসের কর্তা রঘুপতি রায় নিবিষ্ট হয়ে একটি জটিল নকশা পর্যবেক্ষণ করছেন এমন সময় তাঁর কামরার দরজায় মৃদু ধাক্কা পড়ল। রঘুপতি বললেন, আসতে পার।
ফোরম্যান প্রসন্ন সামন্ত দরজা খুলে ঘরে এল। তার পিছনে আরও আট—দশ জন ঠেলাঠেলি করছে দেখে রঘুপতি বললেন, ব্যাপার কি?
প্রসন্ন বলল, আমাদের একটি আরজি আছে বাবু, এরা তাই নিবেদন করতে এসেছেন।
রঘুপতি বললেন, সবাই ভেতরে এস।
চল্লিশ বৎসর আগেকার কথা। এখনকার তুলনায় তখন ধনিক বেশী শোষণ করত, শ্রমিক বেশী শোষিত হত, কিন্তু কর্মী আর কর্মকর্তার মধ্যে হৃদ্যতার অভাব ছিল না। বিশ্বকর্মা কারখানার লোকে বলত, রঘুপতি রায় কড়া মনিব কিন্তু মানুষটা অবুঝ নয়, দয়ামায়া আছে।
কারখানায় নানা বিভাগ থেকে এক—এক জন এসেছে, কেরানী আর কারিগর দুইই উপস্থিত হয়েছে। রঘুপতি প্রশ্ন করলেন, কি চাও তোমরা?
ফোরম্যান প্রসন্ন সামন্ত মুখপাত্র হয়ে এসেছে, কিন্তু সে একটু তোতলা, মাঝে মাঝে কথা আটকে যায়। বাইসম্যান অনন্ত পালকে সামনে ঠেলে দিয়ে প্রসন্ন বলল, তুই বল রে অনন্ত, বেশ গুছিয়ে বলবি।
অনন্তর বয়স বাইশ—তেইশ, ছাত্রবৃত্তি পাস, সুশ্রী চেহারা, ঝাঁকড়া চুল, শখের যাত্রায় নায়ক সাজে, বেহালাও বাজায়। সে নমস্কার করে ঢোক গিলে বলল, আমাদের আরজিটা হচ্ছে সার—আনন্দ মিস্ত্রীকে জবাব দিতে হবে।
রঘুপতি আশ্চর্য হলেন। ফিটার মিস্ত্রী আনন্দ মণ্ডল অতি নিুণ কারিগর, সকল যন্ত্রেই তার সমান হাত, কোন কাজে কিছুমাত্র খুঁত রাখে না। বয়স বত্রিশ—তেত্রিশ, কথা কম বলে, নেশা করে না, অন্য দোষও শোনা যায় না। কারখানার সকলেই তাকে ভালবাসে, কেবল ফোরম্যান প্রসন্ন আর টার্নম্যান এককড়ির তার ওপর একটু ঈর্ষা আছে। আজ দল বেঁধে এতলোক আনন্দকে তাড়াতে চাচ্ছে কেন? রঘুপতি বললেন, তার অপরাধ কি?
একসঙ্গে কয়েকজন বলে উঠল, অতি বদ লোক বাবু, তার সঙ্গে আমরা কাজ করতে পারব না।
অনন্ত বলল, তোমরা চুপ কর, যা বলবার আমি বলছি। শুনুন সার। আনন্দ মিস্ত্রীর বউ আছে, বুড়ী নয়, কানা খোঁড়া নয়, কুচ্ছিতও নয়, কাজকর্মে তাঁর জুড়ি মেলে না। আমরা তাঁকে বউদিদি বউমা কাকী এই সব বলি। পাঁচ বছরের একটি ছেলে আর দু বছরের একটি মেয়েও আছে। আনন্দ তবু আর একটা বিয়ে করবে। খিদিরপুরের মেকেঞ্জি কোম্পানির কারখানায় মুকুন্দ মিস্ত্রী ছিলেন না? চৌকস কারিগর, খুব নাকডাক। আনন্দ তাঁর কাছে কাজ শিখেছিল। সেই মুকুন্দ ঘোষ মাস খানিক হল মারা গেছেন। তাঁরই মেয়েকে আনন্দ বিয়ে করবে, আসছে মাসেই বিয়ে। সামন্ত মশায় তাকে বিস্তর বুঝিয়েছেন—ছি ছি আনন্দ, এই কুবুদ্ধি ছাড়, তোমার ঘরে অমন সতীলক্ষ্মী রয়েছে, বিনা দোষে তাঁর ঘাড়ে একটা সতিন চাপাতে চাও কেন?
টার্নম্যান এককড়ি নশকর বলল, শুধু সতিন? শুনেছি সতিনের মাকে পর্যন্ত নিজের বাড়িতে এনে রাখবে। আনন্দর মতিচ্ছন্ন হয়েছে, আমাদের কোনও কথা শুনবে না, বিয়ে করবেই। তাই আমরা বললাম, আচ্ছা বিয়ে কর, কিন্তু সতীলক্ষ্মীর মনে যে কষ্ট দিচ্ছ সেই পাপ আমরা সইব না, ম্যানেজার বাবুকে বলে তোমার চাকরিটি মারব। আমাদের এতজনের কথা বাবু কখনও ঠেলবেন না।
রঘুপতি বললেন, আবার একটা বিয়ে করা আনন্দর খুবই অন্যায় হবে। আমি তাকে বোঝাবার চেষ্টা করব। কিন্তু সে যদি আমার কথা না শোনে তবে কি করতে পারি? আনন্দের সঙ্গে আমাদের শুধু কাজের সম্পর্ক, সে দুটো বিয়ে করছে কি চারটে বিয়ে করছে তার বিচারের অধিকার আমার নেই।
পাকা দাড়িওয়ালা টিণ্ডেল দিলাবর হুসেন কারখানার বয়লার—এঞ্জিন চালায়। সে এগিয়ে এসে বলল, এখতিয়ার আপনার জরুর আছে হুজুর, আপনি হলেন আমাদের ওআলিদ মায়—বাপ, আমাদের বেচাল দেখলে আপনি সাজা দেবেন।
রঘুপতি হেসে বললেন, ওহে দিলাবর, তোমাদের সমাজে তো চারটে বিবি ঘরে আনবার ব্যবস্থা আছে, তবে আনন্দর বেলা দোষ ধèছ কেন? হিন্দুমতে শুধু চারটে নয়, যত খুশি বিয়ে করা যেতে পারে।
রং—মিস্ত্রী বেলাত আলী বলল, সে কি একটা কাজের কথা হল বাবু মশায়? যার বিস্তর টাকা সে যত খুশি বিয়ে করলে কসুর হয় না, কিন্তু আমাদের মতন গরিব লোকের একটার বেশী জরু আনা খুব অন্যায়। মুসলমানদের মধ্যেও জাস্তি শাদির রেওয়াজ কমে আসছে। দু—চার জন সেকেলে লোক করছে বটে, কিন্তু হিঁদুর বাড়িতে তো বেশী বউ দেখা যায় না। যাদের যেমন রীতি তাই তো মানতে হবে বাবু। মুসলমান মুরগি খেতে পারে, কিন্তু হিঁদু কেন খাবে। হিঁদু কচ্ছপ খেতে পারে, কিন্তু মুসলমান কেন খাবে?
রঘুপতি বললেন, তোমরা সকলেই কি এই চাও যে আনন্দ যদি আর একটা বিয়ে করে তবে তাকে বরখাস্ত করতেই হবে?
সকলে একসঙ্গে বলে উঠল, হাঁ, তাই আমরা চাই, অন্যায় আমরা বরদাস্ত করব না।
রঘুপতি বললেন, আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। কারও নাম করব না, কিন্তু এই কারখানায় এমন লোক দু—তিন জন আছে যারা খুব নেশা করে, মাইনে পাবার পর তিন—চার দিন বুঁদ হয়ে কামাই করে, শুনেছি স্ত্রীকে মারধরও করে। তাদের তাড়াতে চাও না কেন?
এককড়ি নশকর বলল, সে তো বাবু মদের ঝোঁকে করে, নেশা ছুটে গেলেই আবার যে—কে—সেই সহজ মানুষ। কিন্তু বাড়িতে সতীলক্ষ্মী স্ত্রী থাকতে তার ঘাড়ে একটা সতিন চাপানো যে বারমেসে অষ্টপ্রহর জুলুম।
রঘুপতি বললেন, বেশ, তোমরা সবাই যখন একমত তখন আনন্দকে আমি বলব, আবার একটা বিয়ে করার মতলব ছাড়, না হয় চাকরি ছাড়।
সকলে তুষ্ট হয়ে নিজের নিজের কাজে ফিরে গেল।
যোগেন হাজরা এই কারখানার নকশা—বাবু অর্থাৎ ড্রাফটসম্যান, সে সকলের সব খবর রাখে। রঘুপতি তাকে ডেকে বললেন, ওহে যোগেন, ব্যাপারটা কি? আনন্দ হঠাৎ আর একটা বিয়ে করতে চায় কেন, আর আনন্দর বউ—এর ওপরেই বা কারখানা সুদ্ধ লোকের এত দরদ কেন?
যোগেন বলল, শুনেছি আনন্দের ছেলেবেলায় মা—বাপ মারা গেলে খিদিরপুরের মুকুন্দ মিস্ত্রীই তাকে মানুষ করে। আনন্দর যত কিছু বিদ্যে সব সেই মুকুন্দর কাছে শেখা। বামপন্থী স্ক্রু কাটা, ড্রিল দিয়ে চৌকো ছেঁদা করা, নরম লোহার ওপর কড়া ইস্পাতের ছাল ধরানো, এসব কাজ মুকুন্দর কাছেই আনন্দ শিখেছে, কারখানার আর কেউ এসব পারে না। গুরুর ওপরে আনন্দর ভক্তি থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু স্ত্রী থাকতে মুকুন্দর মেয়েকে বিয়ে করবার কি দরকার বুঝি না। হয়তো কিছু গোলমাল আছে, কারখানার কেউ তা জানে না, আনন্দও কিছু ভাঙতে চায় না। আর, আনন্দর বউএর ওপর সকলের দরদ কেন জানেন? খুব পরোপকারী কাজের মেয়ে, যেমন রাঁধিয়ে তেমনি খাটিয়ে, দেখতেও সুশ্রী। এই সেদিন তালের বড়া করে আমাদের সবাইকে খাওয়ালে। বিশ্বকর্মা পূজোর যোগাড় আর তিন—চার শ লোকের ভোজের রান্নাও সে প্রায় একাই করে। কিন্তু ভারী কুঁদুলী। কারিগররা তার ভক্ত বটে, কিন্তু তাদের বউরা তাকে দেখতে পারে না।
—কি রকম ভক্ত তা বুঝি না। আনন্দর চাকরি গেলে তার বউএর তো ক্ষতি হবে।
—কি জানেন? সতীর পুণ্যে পতির স্বর্গবাস, কিন্তু পতির পাপে সতীর সর্বনাশ। তবে এখানকার চাকরি গেলেও আনন্দের কাজের অভাব হবে না।
আনন্দ মণ্ডলকে ডাকিয়ে এনে রঘুপতি বললেন, এসব কি শুনছি হে আনন্দ? তুমি নাকি আর একটা বিয়ে করবে?
মাথা নীচু করে আনন্দ বলল, আজ্ঞে হাঁ।
—সে কি। তোমার স্ত্রী তো খুব ভাল মেয়ে শুনতে পাই, বিনা দোষে তার ঘাড়ে একটা সতিন চাপাবে? এই কুমতলব ছাড়।
—ছাড়বার উপায় নেই বাবু। মুকুন্দ মিস্ত্রী মশায়ের মেয়েকে আমার বিয়ে করতেই হবে?
—মুকুন্দ মিস্ত্রী তোমার বাপের মতন ছিলেন, তাঁর কাছে তুমি কাজ শিখেছ, এসব আমি জানি। কিন্তু তোমার স্ত্রী থাকতে আবার বিয়ে করা অন্যায় নয় কি?
—উপায় নেই বাবু।
—উপায় নেই এ যে বিশ্রী কথা আনন্দ। দেখ, তুমি কাজের লোক, তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়। কিন্তু তোমার কুমতলব শুনে কারখানার সবাই খেপে উঠেছে, তাদের আপত্তি আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না। তুমি আমাকে কথা দাও যে বিয়ে করবে না। তাতে রাজী না হও তো কাজে ইস্তফা দিতে হবে।
—যে আজ্ঞে। আজ মাসের বিশ তারিখ, মাস কাবারের সঙ্গে সঙ্গে কাজ ছেড়ে দেব।
আনন্দ নমস্কার করে চলে গেল।
রঘুপতি রায় কারখানারই এক অংশে বাস করেন। সন্ধ্যাবেলা তিনি বারান্দায় বসে আছেন আর বিষণ্ণ মনে আনন্দের কথা ভাবছেন, এমন সময় বাইসম্যান অনন্ত এসে বলল, সার, আনন্দ মিস্ত্রীর স্ত্রী যশোদা বউদি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।
রঘুপতি বললেন, এখানে নিয়ে এস।
একটি ঘোমটাবতী মেয়ে ভূমিষ্ট হয়ে প্রণাম করল। অনন্ত তাকে বলল, লজ্জা ক’রো না বউদি, যা বলবার বাবু মশায়কে বল।
ঘোমটার ভেতর থেকে তীক্ষ্ন কণ্ঠে যশোদা বলল, এ কেমন ধারা বিচার বাবু মশায়? আমার সোয়ামী দুটো বিয়ে করুক দশটা করুক, সে আমি বুঝব। কারখানার অলপ্পেয়েদের তার জন্যে মাথাব্যথা কেন? মানুষটার কাজে কোন গলদ নেই, আপনি তাকে স্নেহও করেন, তবে কিসের জন্যে তার অন্ন মারবেন? আমরা আট—দশ বছর বরানগরে এই কারখানায় আছি, এ জায়গা ছেড়ে এখন কোথায় যাব?
রঘুপতি বললেন, কারখানা সুদ্ধ লোকের আপত্তি আমি অগ্রাহ্য করতে পারি না। তাদের রাগ হবারই কথা, তোমার মতন ভাল মেয়ের একটা সতিন আসবে, কারখানার কেউ তা সইতে পারছে না।
ঘোমটা খুলে ফেলে যশোদা হাত নেড়ে বলল, আ মর! সতিন কি কারখানার না আমার? আমার সতিন আমি বুঝব, ঝাঁটাপেটা করে সিধে করে দেব, তোরা হতভাগারা এর মধ্যে আসিস কেন? হাঁ রে অনন্ত, তুইও ওদের দলে নেই তো? কি আমার দরদী লোক সব। আপনি কারু কথা শুনো নি বাবু, মিস্ত্রী যেমন কাজ করছে করুক।
রঘুপতি বিব্রত হয়ে বললেন, তোমার কথা বিবেচনা করে দেখব। আচ্ছা, এখন এস বাছা।
পরদিন সন্ধ্যার সময় অনন্ত রঘুপতির কাছে এসে বলল, মুকুন্দ মিস্ত্রী মশায়ের স্ত্রী আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
রঘুপতি বললেন, তোমার ভাবগতিক তো বুঝতে পারছি না অনন্ত। আনন্দর বিরুদ্ধে তুমিই কাল বলেছিলে, আবার তার স্ত্রীকে নিয়ে আমার কাছে এসেছিলে, আজ আবার মুকুন্দ স্ত্রীর সঙ্গে এসেছ। তোমার ইচ্ছেটা কি?
অনন্ত বলল, আমার একার ইচ্ছে অনিচ্ছাতে কি হবে সার, কারখানার সকলের যা ইচ্ছে আমারও তাই। তবে কিনা মেয়েদেরও বলবার অধিকার আছে, তাই তাঁদের সঙ্গে আমাকে আসতে হয়েছে।
মুকুন্দ মিস্ত্রীর স্ত্রী সিন্ধুবালা রঘুপতিকে প্রণাম করে বলল, বাবুমশায়, আপনি সব কথা শুনে ন্যায্য বিচার করবেন এ ভরসায় খিদিরপুর থেকে বরানগরে ছুটে এসেছি। ওই যে আপনাদের আনন্দ মণ্ডল, আমার সোয়ামীই ওকে মানুষ করেছেন। মিস্ত্রী মশায় বলতে আনন্দ অজ্ঞান, তাকে গুরুঠাকুরের মতন ভক্তি করত, এখনও করে। ওর যা কিছু বিদ্যে সব কর্তার কাছে শেখা। মারা যাবার সময় তিনি আনন্দকে বলে গেছেন—আনন্দ, আমার পুঁজি তো কিছু নেই, ছেলেটাও লক্ষ্মীছাড়া, কোথায় থাকে কি করে কেউ জানে না। আমি কোম্পানির কোআটারে থাকি, মরবার পর আমার পরিবারের এখানে স্থান হবে না। আমার স্ত্রী আর মেয়ে সুশীলার কি দশা হবে? আনন্দ, তুমি যদি এদের ভার নাও তো আমি নিশ্চিন্ত হয়ে মরতে পারি। তাই শুনে আনন্দ বলল, মিস্ত্রী মশায়, আপনার পা ছুঁয়ে দিব্যি করছি, আমি এঁদের ভার নিলাম। কর্তা গত হলে আনন্দ আমায় বলল, মা, ভাববেন না, মেয়েকে নিয়ে আমার বাসায় চলে আসুন।
রঘুপতি বললেন, আনন্দ ভালই বলেছ। কিন্তু তার স্ত্রী থাকতে আপনার মেয়েকে বিয়ে করবে কেন? মেয়ের বিয়ে তো অন্য লোকের সঙ্গে দিতে পারেন।
কপাল চাপড়ে সিন্ধুবালা বলল, তা যে হবার জো নেই বাবু, উপায় থাকলে সতিনের ঘরে মেয়ে দেব কেন?
—উপায় নেই কেন?
—আমার মেয়েকে আর কে নেবে বাবা? সে রূপে গুণে লক্ষ্মী কিন্তু বোবাকে কেউ চায় না। ছেলেবেলায় ছ মাস জ্বরে ভোগার পর থেকে সে আর কথা কইতে পারে না।
—ভারী দুঃখের কথা। কিন্তু আনন্দর সঙ্গে তার বিয়ে দেবার দরকার কি? আনন্দর বউ—এর অনিষ্ট কেন করবেন? আপনারা না হয় আনন্দর বাড়িতেই থাকবেন, কিন্তু মেয়ের তো অন্য পাত্র জুটতে পারে। না হয় যোগাড় করতে কিছুদিন দেরি হবে।
—সোমত্ত আইবুড়ো মেয়েকে আনন্দর বাড়িতে রাখলে যে বদনাম হবে বাবা। আমাদের জাতের লোক ভারী নচ্ছার, আনন্দ আমাদের ওখানে আনাগোনা করে তাইতেই আত্মীয় কুটুমরা নানা কথা রটিয়েছে।
রঘুপতি বললেন, আজ আপনি আসুন। আমি একটু ভেবে দেখি, অন্য উপায় হতে পারে কিনা। দু—এক দিনের মধ্যে এই অনন্তকে দিয়ে আপনাকে খবর পাঠাব।
পরদিন রঘুপতির আজ্ঞায় প্রসন্ন সামন্ত সদলে তাঁর কামরায় উপস্থিত হল, আনন্দ মণ্ডলও এল। মুকুন্দ মিস্ত্রীর স্ত্রীর কাছে যা শুনেছেন। সব বিবৃত করে রঘুপতি বলেলেন, আচ্ছা আনন্দ মুকুন্দর মেয়ের জন্যে যদি একটি পাত্র যোগাড় করতে পারি তা হলে কেমন হয়?
আনন্দ বলল, তার চাইতে ভাল কিছুই হতে পারে না বাবু। কিন্তু পাত্র পাবেন কোথায়? মকুন্দ মিস্ত্রী মশায় ঢের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বোবা মেয়েকে কেউ নিতে রাজী হয় নি।
রঘুপতি বললেন, আমার প্রস্তাবটা তোমরা মন দিয়ে শোন। শুনেছি মেয়েটি সুশ্রী, কাজকর্মও সব জানে, শুধু কথা বলতে পারে না। তোমরা সবাই তার জন্যে একটি ভাল পাত্রের সন্ধান কর। যদি এই কারখানায় একটি কাজ দেওয়া হয় আর ভাল যৌতুক দেওয়া হয় তবে পাত্র পাওয়া অসম্ভব হবে না। আমি যৌতুকের জন্যে এক শ টাকা চাঁদা দেব, তোমরাও যা পার দাও।
যারা এসেছিল তারা মৃদুস্বরে কিছুক্ষণ জল্পনা করল। তারপর এককড়ি নশকর বলল, বাবু মশায় যা বললেন, তা খুব ন্যায্য কথা। মুকুন্দ মিস্ত্রীকে আমরা সবাই ভক্তি করতাম, তাঁর মেয়ের বিয়ের যোগাড় আমাদেরই করা উচিত। আমরা সবাই মাইনে থেকে টাকায় দু পয়সা হিসেবে চাঁদা দিতে রাজী আছি, তাতে আন্দাজ তিন শ টাকা উঠবে, আপনার টাকা নিয়ে হবে চার শ। যৌতুক ভালই হবে, তার ওপর আপনি এখানে একটা কাজ তো দেবেন। আমরা সাধ্যমত পাত্রের খোঁজ করব, কিন্তু সুপাত্র পাওয়া বড় শক্ত হবে বাবু!
অনন্ত পাল বলল, পাত্র খোঁজবার দরকার নেই, আমিই বিয়ে করব।
প্রসন্ন সামন্ত চুপি চুপি বলল, সে কি রে অনন্ত, আমার সেই শিবপুরের শালীর মেয়েকে বিয়ে করবি নি? টাকার লোভে বোবা মেয়ে নিবি?
অনন্ত চেঁচিয়ে বলল, টাকা চাই না, অমনিই বিয়ে করব।
অনন্তর পিঠ চাপড়ে রঘুপতি বললেন, বাহবা অনন্ত! উপস্থিত সকলে খুশী হয়ে কলরব করে উঠল।
দুদিন পরে রঘুপতির কামরার দরজা একটু ফাঁক করে আনন্দ মিস্ত্রী বলল, আসতে পারি বাবু? সামন্ত মশায় লিলুয়া জুট মিলে ক্রেন খাটাতে গেছেন, তাই আমাকেই এরা বলবার জন্যে ধরে এনেছে। আমাদের একটা আরজি আছে বাবু।
রঘুপতি বললেন, সবাই ভেতরে এস। আবার কিসের আরজি? কাকে তাড়াতে চাও?
আনন্দ বলল, আমাদের সকলের নিবেদন—বাইসম্যান অনন্ত পালের মাইনেটা কিছু বাড়িয়ে দিতে আজ্ঞা হ’ক।
—সে তোমাদের বলতে হবে না। আসছে মাসেই তো তার বিয়ে? ওই মাস থেকেই তার মাইনে বাড়বে।
শারদীয় ‘গল্প—ভারতী’
১৩৬১ (১৯৫৪)
____________
‘কৃষ্ণকলি’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত নয়।
আনন্দীবাঈ
বহু কারবারের মালিক ত্রিক্রমদাস করোড়ী তাঁর দিল্লির অফিসের খাস কামরায় বসে চেক সহি করছেন। আরদালী এসে একটা কার্ড দিল—এম. জুলফিকার খাঁ। ত্রিক্রমদাস বললেন, একটু সবুর করতে বল।
কিছুক্ষণ পরে সহি করা চেকের গোছা নিয়ে কেরানী ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ত্রিক্রমদাস ঘণ্টা বাজিয়ে আরদালীকে ডেকে কার্ডখানা দিয়ে বললেন, আসতে বল।
জুলফিকার খাঁ এসে বললেন, আদাব আরজ। শেঠজী, আমি ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে আসছি।
উদ্বিগ্ন হয়ে শেঠজী প্রশ্ন করলেন, ইনকমট্যাক্স নিয়ে আবার কিছু গড়বড় হয়েছে নাকি?
—তা আমার মালুম নেই। আমার ডিপার্টমেন্টে আপনার নামে একটা সিরিয়স চার্জ এসেছে।
—কেন, আমার কসুর কি?
—আপনি তিনটি শাদি করেছেন।
একটু হেসে ত্রিক্রম বললেন, য়হ বাত? যদি করেই থাকি তাতে আমার কসুর কি? আমি তো হিন্দু সৈকড়োঁ শাদি করতে পারি, আপনাদের মতন চারটি বিবিতে আটকে থাকবার দরকার নেই।
খাঁ সাহেব হাত নেড়ে বললেন, হায় হায় শেঠজী, আপনি রুপায়ই কামাতে জানেন, মুলুকের খবর রাখেন না। হিন্দু বৌদ্ধ জৈন আর শিখ একটির বেশি শাদি করতে পারবে না—এই আইন সম্প্রতি চালু হয়ে গেছে তা জানেন না?
—বলেন কি! আমি নানা ধান্দায় ব্যস্ত, সব খবর রাখবার ফুরসত নেই। নতুন ট্যাক্স কি বসল, নতুন লাইসেন্স কি নিতে হবে, এই সবেরই খোঁজ রাখি। কিন্তু আপনার খবরে বিশ্বাস হচ্ছে না, আমার ফুফা (পিসে) ইরচন্দজী দুই জরু নিয়ে বহুত মজে মে আছেন, তাঁর নামে তো চার্জ আসে নি।
—আইন চালু হবার আগে থেকেই তো তাঁর দুই জরু আছে, তাতে দোষ হয় না। কিন্তু আপনি হালে তিন শাদি করেছেন, তার জন্যে কড়া সাজা হবে, দশ বৎসর জেল আর বিস্তর টাকা জরিমানা হতে পারে।
শেঠজী ভয় পেয়ে বললেন, বড়ী মুশকিল কি বাত, এখন এর উপায় কি?
—দেখুন শেঠজী, আপনি মান্যগণ্য আমীর আদমী, আপনাকে মুশকিলে ফেলতে আমরা চাই না। এক মাস সময় দিচ্ছি, এর মধ্যে একটা বন্দোবস্ত করে ফেলুন।
—কত টাকা লাগবে?
—আপনি একটি জরুকে বহাল রেখে আর দুটিকে ঝটপট খারিজ করুন। তার জন্যে কত খেসারত দিতে হবে তা তো আমি বলতে পারি না, উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করবেন। আর এদিকে কত টাকা লাগবে সে তো আপনার আর আমার মধ্যে, তার কথা পরে হবে।
মাথা চাপড়ে ত্রিক্রমদাস বললেন, হো রামজী, হো পরমাৎমা, বাঁচাও আমাকে । একটিকে সনাতনী মতে বিবাহ করেছি, আর একটিকে আর্যসমাজী মতে, আর একটির সঙ্গে সিভিল ম্যারিজ হয়েছে। খারিজ করব কি করে?
—ঘাবড়াবেন না শেঠজী, আপনার টাকার কমি কি? দু—চার লাখ খরচ করলে সব মিটে যাবে। দুটি স্ত্রীকে মোটা খেসারত দিয়ে কবুল করিয়ে নিন যে তারা আপনার অসলী জরু নয়, শুধু মুহব্বতী পিয়ারী। তারপর আমরা ব্যাপারটা চাপা দিয়ে দেব। দেরি করবেন না, এখনই কোনও ভাল উকিল লাগান। আচ্ছা, আজ আমি উঠি, হপ্তা বাদ আবার দেখা করব। আদাব।
ত্রিক্রমদাসের বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশী। তাঁর বৈবাহিক ইতিহাস অতি বিচিত্র। দু বৎসর আগে তাঁর একমাত্র পত্নী কয়েকটি ছেলে মেয়ে রেখে মারা যান। তার কয়েক মাস পরে তিনি আনন্দীবাঈকে বিবাহ করেন। তারপর সম্প্রতি তিনি আরও দুটি বিবাহ করেছেন কিন্তু তার খবর আত্মীয়—বন্ধুদের জানান নি। এখনকার পত্নীদের প্রথমা আনন্দীবাঈ হচ্ছেন খজৌলি স্টেটের ভূতপূর্ব দেওয়ান হরজীবনলালের একমাত্র সন্তান, বহু ধনের অধিকারিণী। হরজীবন মারা গেলে তাঁর এক দূর সম্পর্কের ভাই অভিভাবক হয়ে ভাইঝিকে ফাঁকি দেবার চেষ্টায় ছিলেন, কিন্তু মেয়ের মামাদের সাহয্যে ত্রিক্রমদাস আনন্দীকে বিবাহ করে তাঁর সম্পত্তি নিজের দখলে আনলেন। আনন্দীবাঈএর বয়স আন্দাজ পঁচিশ, দেখতে ভাল নয়; একটু ঝগড়াটে, উচ্চবংশের অহংকারও আছে।
ত্রিক্রমদাসের ব্যবসার কেন্দ্র আর হেড অফিস দিল্লিতে, তা ছাড়া বোম্বাই আর কলকাতায় তাঁর যে ব্রাঞ্চ অফিস আছে তাও ছোট নয়। তিনি বৎসরে তিন—চার বার ওই দুই শাখা পরিদর্শন করেন। আনন্দীর সঙ্গে বিবাহের কিছুকাল পরে তিনি বোম্বাই যান। সেখানকার ম্যানেজার কিষনরাম খোবানী একদিন তাঁর মনিবকে নিমন্ত্রণ করে নিজের বাসায় নিয়ে গেলেন। তিনি সিন্ধের লোক দেশ ত্যাগের পর দিল্লি চলে আসেন, তারপর শেঠজীর ব্র্যাঞ্চ ম্যানেজার হয়ে বোম্বাইএ বাস করছেন। কিষনরাম শৌখিন লোক, তাঁর ফ্ল্যাট বেশ সাজানো। তিনি তাঁর স্ত্রী আর শালীর সঙ্গে নিজের মনিবের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
শেঠজী সেকেলে লোক, আধুনিক মহিলাদের সঙ্গে তাঁর মেশবার সুযোগ এ পর্যন্ত হয় নি। কিষনরামের শালী রাজহংসী ঝলকানীকে দেখে তিনি মোহিত হয়ে গেলেন। কি ফরসা রং, কি সুন্দর সাজ! পরনে ফিকে নীল সালোয়ার আর ঘোর নীল কামিজ, তার উপর চুমকি বসানো ফিকে সবুজ দোপাট্টা ঝলমল করছে। কথাবার্তা অতি মধুর, কোনও জড়তা নেই, হেসে হেসে এটা খান ওটা খান বলে অনুরোধ করছে।
খাওয়া শেষ হল। কিষনরামকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে শেঠজী রাজহংসী ঝলকানীর সব খবর জেনে নিলেন। মেয়েটির বাপ মা নেই। একমাত্র ভাই সিংগাপুরে ভাল ব্যবসা করে, কিন্তু বোনের কোনও খবর নেয় না, অগত্যা কিষনরাম তাঁর শালীকে নিজের কাছে রেখেছেন। সে ভাল অভিনয় করতে পারে, গাইতে পারে, সিনেমায় নামবার ইচ্ছা আছে, কিন্তু কিষনরাম ও তাঁর স্ত্রীর মত নেই।
শেঠজী তখনই মতি স্থির করে বললেন, আমার সঙ্গে রাজহংসীর বিবাহ দাও, ওকে আমি খুব সুখে রাখব। এই বোম্বাই শহরেই আমার জন্যে জলদি একটা বাড়ি কিনে ফেল, রাজহংসী সেখানে থাকবে, আমিও বৎসরের বেশীর ভাগ বোম্বাইএ বাস করব। এখানকার কারবার ফালাও করতে চাই।
আনন্দীবাঈ—এর কথা শেঠজী চেপে গেলেন। কিষনরাম জানতেন যে তাঁর মালিক বিপত্নীক, সুতরাং তিনি খুশী হয়ে সম্মতি দিলেন। রাজহংসীও রাজী হলেন, শেঠজীর বেশী বয়সের জন্যে কিছুমাত্র আপত্তি প্রকাশ করলেন না। আর্যসমাজী পদ্ধতিতে বিবাহ হয়ে গেল। তার পর নূতন বাড়িও কেনা হল, রাজহংসী সেখানে বাস করতে লাগলেন।
কিছুদিন পরে ত্রিক্রমদাস তাঁর কলকাতার কারবার পরিদর্শন করতে গেলেন। ওখানকার ম্যানেজার পরিতোষ হোড়—চৌধুরী খুব কাজের লোক, আলিপুরে সাহেবী স্টাইলে থাকেন। তিনি তাঁর মনিবকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। সেখানে পরিতোষের স্ত্রী আর ভগ্নীর সঙ্গে ত্রিক্রমদাসের পরিচয় হল। মিস বলাকা হোড়—চৌধুরীকে দেখে শেঠজী অবাক হয়ে গেলেন। রাজহংসীর মতন রূপসী নয় বটে, কিন্তু শাড়ি পরবার ভঙ্গীটি কি চমৎকার, আর বাত—চিত আদব কায়দাও কি সুন্দর! মেমসাহেবদের মতন ইংরেজী উচ্চারণ করে, আর হিন্দী বলতে ভুল করে বটে কিন্তু সেই ভুল কি মিষ্টি! শেঠজী একেবারে কাবু হয়ে পড়লেন। পরিতোষ হোড়—চৌধুরী তাঁকে জানালেন, বলাকা এম. এ.পাস, নাচ—গানে কলকাতায় ওর জুড়ী নেই, সিনেমাওয়ালারা ওকে পাবার জন্যে সাধাসাধি করছে, কিন্তু পরিতোষের তাতে মত নেই। ত্রিক্রমদাস নিজেকে সামলাতে পারলেন না, বলে ফেললেন, মিস বলাকা, মৈ তুমকো শাদি করুংগা।
বলাকা সহাস্যে উত্তর দিলেন, তা বেশ তো, কিন্তু দিল্লির গরম তো আমার সইবে না, আর আপনাদের দাল—রোটি ভাজী দহিবড়া আমার হজম হবে না।
শেঠজী বললেন, আরে দিল্লি যেতে তোমাকে কে বলছে? আমি এই আলিপুরে একটা মোকাম কিনব, তুমি সেখানে তোমার দাদার কাছাকাছি বাস করবে। আমি বছরের আট—ন মাস এখানেই কাটাব, কলকাতার কারবার ফালাও করতে চাই। তোমাকে দাল—রোটি খেতে হবে না, মচ্ছি—ভাতই খেয়ো। মচ্ছি খেতে আমিও নারাজ নই, কিন্তু বড় বদবু লাগে।
বলাকা বললেন, আমি গোলাপী আতর দিয়ে ইলিশ মাছ রেঁধে আপনাকে খাওয়াব, মনে হবে যেন কালাকন্দ খাচ্ছেন।
বলাকা তাঁর দাদার কাছে শুনেছিলেন যে শেঠজী বিপত্নীক। তিনি তখনই বিবাহে রাজী হলেন। কুড়ি দিন পরে সিভিল ম্যারিজ হয়ে গেল।
ত্রিক্রমদাস পালা করে দিল্লি থেকে বোম্বাই আর কলকাতা যেতে লাগলেন, তাঁর দাম্পত্যের ত্রিধারায় কোনও ব্যাঘাত ঘটল না। পরমানন্দে দিন কাটাতে লাগল। তার পর অকস্মাৎ একদিন জুলফিকার খাঁ দুঃসংবাদ দিয়ে শেঠজীর শান্তিভঙ্গ করলেন।
উকিল খজনচাঁদ বি. এ. এল এল বি. ত্রিক্রমদাসের অনুগত বিশ্বস্ত বন্ধু, ইনকমট্যাক্সের হিসাব দাখিলের সময় তাঁর সাহায্য না নিলে চলে না। শেঠজী সেই দিনই সন্ধ্যার সময় খজনচাঁদের কাছে গিয়ে নিজের বিপদের কথা জানালেন।
খজনচাঁদ বললেন, শেঠজী,আপনি নিতান্ত ছেলেমানুষের মতন কাজ করেছেন। আমাকে আপনি বিশ্বাস করেন, কিন্তু ওই মুম্বইবালী আর কলকাত্তাবালীকে কথা দেবার আগে একবার আমাকে জানালেন না, এ বড়ই আফসোস কি বাত।
শেঠজী হাত জোড় করে বললেন, মাফ কর ভাই বুড়ো বয়সে একটা স্ত্রী থাকতে আরও দুটো বিয়ে করবার লোভ হয়েছে এ কথা লজ্জায় তোমাকে বলি নি। এখন উদ্ধারের উপায় বাতলাও।
কিছুক্ষণ ভেবে খজনচাঁদ বললেন, আনন্দীবাঈকে কিছু বলবার দরকার নেই, শুনলে উনি দুঃখ পাবেন, কান্নাকাটি করবেন। আর দুজনকে একে একে আপনি সব কথা খুলে বলুন। ওঁরা হচ্ছেন মর্ডান গার্ল, আত্মমর্যাদাবোধ খুব বেশী। আপনার কুকর্ম জানলে রেগে আগুন হবেন, আপনার মুখ দেখতে চাইবেন না। তাতে আমাদের সুবিধাই হবে, মোটা খেসারত দিলে আর আপনার দুই ম্যানেজারকে কিছু খাওয়ালে সব মিটে যাবে। দু—চার লাখ খরচ হতে পারে, কিন্তু আপনার তা গায়ে লাগবে না।
এই পরামর্শ ত্রিক্রমদাসের পছন্দ হল না। তিনি বললেন, খজন—ভাই তুমি আমার প্রাণের কথা বুঝতে পারছ না। আমি বিজনেস বাড়াতে চই, তার জন্যে নামজাদা লোকের সঙ্গে মেশা দরকার। আমি যদি মন্ত্রী আর বড় বড় অফিসারদের পার্টি দিই তবে আমার বাড়ির কোন লেডী অতিথিদের আপ্যায়িত করবে? আনন্দী? রাম কহো। রাজহংসী আর বলাকা হচ্ছে এই কাজের কাবিল। বাতিল করতে হলে আনন্দীকেই করতে হবে, তাতে আমার কলিজা ফেটে যাবে, অনেক টাকার সম্পত্তি ছাড়তে হবে, কিন্তু তার জন্যে আমি প্রস্তুত আছি। মুশকিল হচ্ছে—রাজহংসী আর বলাকার মধ্যে কাকে রাখব কাকে ছাড়ব তা স্থির করা বড় শক্ত, তবে আমার বেশী পছন্দ কলকাত্তাবালী বলাকা দেবী। ওকে যদি নিতান্ত না রাখতে পারি তবে ওই মুম্বইবালী রাজহংসী। টাকার জন্যে ভেবো না, দশ—পনড্র লাখ তক খরচ করতে আমি তৈয়ার আছি।
খজনচাঁদ অনেক বোঝালেন যে আনন্দীবাঈ তাঁর আইনসম্মত স্ত্রী, তাঁর দাবী সকলের উপরে। তাঁকে ত্যাগ করতে হলে অনেক জুয়াচুরির দরকার হবে, তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি ছেড়ে দিতে হবে, তার ফলে মোট লোকসান খুব বেশী হবে, আনন্দীবাঈ—এর সেই বদমাশ কাকার শরণাপন্ন হতে হবে। কিন্তু ত্রিক্রমদাস কিছুতেই তাঁর সংকল্প ছাড়লেন না। অগত্যা খজনচাঁদ বললেন, বেশ, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আপনি দেরি না করে তিনজনকেই সব কথা খুলে বলুন। ওঁদের মনের ভাব দেখে আমি যা করবার করব।
কালবিলম্ব না করে ত্রিক্রমদাস এয়ারোপ্লেনে বোম্বাই গেলেন এবং সোজা রাজহংসীর বাড়িতে উপস্থিত হলেন। রাজহংসী তাঁর ড্রইংরুমে বসে একটি সুবেশ যুবকের সঙ্গে গল্প করছিলেন। আশ্চর্য হয়ে বললেন, আরে শেঠজী, হঠাৎ এলে যে! কোনও খবর দাও নি কেন? এঁকে তুমি চেন না, ইনি হচ্ছেন মিস্টার ঝুমকমল মটকানী, দূর সম্পর্কে আমার ফুফেরা (পিসতুতো) ভাই হন, হিসাবের কাজে ওস্তাদ। এখানকার অফিসের অ্যাকাউণ্টেণ্ট তো বুড়ো হয়েছে, তাকে বিদায় করে এই ঝুমক—মলকে সেই পোস্টে বসাও।
ত্রিক্রমদাস বললেন, আমি ভেবে দেখব। রাজহংসী, তোমার সঙ্গে আমার একটা জরুরী কথা আছে।
ঝুমকমল চলে গেলে ত্রিক্রমদাস ভয়ে ভয়ে তাঁর তিন বিবাহের কথা প্রকাশ করলেন। কিন্তু তার রিঅ্যাকশন যা হল তা একেবারে অপ্রত্যাশিত। রাজহংসী হেসে গড়িয়ে পড়ে বললেন, বাহবা শেঠজী, তুমি দেখছি বহুত রঙ্গীলা আদমী! তোমার আরও দুই জরু আছে তাতে হয়েছে কি, আমি ওসব গ্রাহ্য করি না, তুমি নিশ্চিন্ত থাক সব ঠিক হৈ। তবে কথাটা যেন জানাজানি না হয়। …হ্যাঁ ভাল কথা, এই বাড়িটা জলদি আমার নামে রেজিস্টারি করা দরকার, মিউনিসিপ্যালিটি বড় হয়রান করছে।
শেঠজী বললেন, আচ্ছা, তার ব্যবস্থা হবে। আজ আমি থাকতে পারব না, জরুরী কাজে এখনই কলকাতা রওনা হব।
কলকাতায় পৌঁছে ত্রিক্রমদাস সোজা আলিপুরে বলাকার কাছে গেলেন। ড্রইংরুমে একজন সুদর্শন ভদ্রলোক পিয়ানো বাজাচ্ছিলেন আর বলাকা তালে তালে নাচছিলেন। ত্রিক্রমকে দেখে বলাকা বললেন, একি শেঠজী, হঠাৎ এলে যে! এঁকে বোধ হয় চেন না, ইনি হচ্ছেন লোটনকুমার ভড়, দূর সম্পর্কে আমার মাসতুতো ভাই, নাচের ওস্তাদ। এঁর কাছে আমি কবুতর—নৃত্য শিখছি। দেখবে একটু?
ত্রিক্রম বললেন, এখন আমার ফুরসত নেই। বলাকা, তোমার সঙ্গে আমার বহুত জরুরী কথা আছে।
লোটনকুমার উঠে গেলে ত্রিক্রমদাস কম্পিত বক্ষে তাঁর তিন বিবাহের কথা প্রকাশ করলেন। বলাকা গালে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললেন, ওমা তাই নাকি! ওঃ শেঠজী, তুমি একটি আসল পানকৌড়ি, নটবর নাগর। তা তুমি অমন মুষড়ে গেছ কেন তিনটে বউ আছে তো হয়েছে কি? ঠিক আছে, তুমি ভেবো না, আমি হিংসুটে মেয়ে নই। কিন্তু তুমি যেন সবাইকে বলে বেড়িয়ো না। …হ্যাঁ ভাল কথা, দেখ শেঠজী, একটা নতুন মোটরকার না হলে চলছে না, পুরানো অস্টিনটা হরদম বিগড়ে যাচ্ছে। তুমি হাজার কুড়ি টাকার একটা চেক আমাকে দিও, তার কমে ভাল গাড়ি মিলবে না।
ত্রিক্রমদাস বললেন, আচ্ছা, তা ব্যবস্থা হবে। আমি এখন উঠি, আজই দিল্লি যেতে হবে।
ত্রিক্রমদাস দিল্লিতে এসেই খজনচাঁদের কাছে গিয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালেন। তার পর তাঁকে সঙ্গে করে নিজের বাড়িতে এনে ড্রইংরুমে অপেক্ষা করতে বললেন।
অন্দরমহলে গিয়ে ত্রিক্রম আনন্দীবাঈকে শোবার ঘরে ডেকে আনলেন। আনন্দী বললেন, তিন দিন তোমার কোনও পাত্তা নেই, চেহারা খারাপ হয়ে গেছে, ব্যাপার কি, গভরমেণ্টের সঙ্গে আবার কিছু গড়বড় হয়েছে নাকি?
ত্রিক্রমদাস মাথা হেঁট করে তাঁর গুপ্তকথা প্রকাশ করলেন। আনন্দী কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলেন, তারপর কোমরে হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে বললেন, ক্যা বোলা তুম নে?
শেঠজী একটু ভয় পেয়ে বললেন, আনন্দী, ঠন্ডা হো যাও, সব ঠিক হো জাগা।
বাংলা সাহিত্য যতই সমৃদ্ধ আর উঁচুদরের হক, হিন্দী ভাষায় গালাগালির যে শব্দসম্ভার আছে তার তুলনা নেই। আনন্দীবাঈ হাত—পা ছুড়ে নাচতে লাগলেন। হোজ—পাইপ থেকে জলধারার মতন তাঁর মুখ থেকে যে ভর্ৎসনা নির্গত হতে লাগল তা যেমন তীব্র তেমনি মর্মস্পর্শী। তার সকল বাক্য ভদ্রজনের শ্রোতব্য নয়, ভদ্র—নারীর উচ্চার্যও নয়, কিন্তু আনন্দীবাঈ—এর তখন হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। তিনি উত্তরোত্তর উত্তেজিত হচ্ছেন দেখে শেঠজী হাত জোড় করে আবার বললেন, আনন্দী, মাফ করো, সব ঠিক হো জাগা।
আনন্দী গর্জন করে বললেন, চোপ রহো শড়ক কা কুত্তা, ডিরেন কা ছুছুন্দর! এই বলেই বাঘিনীর মতন লাফিয়ে গিয়ে শেঠজীর দুই গালে খামচে দিলেন। তারপর পিছু হটে তাঁর বাঁ হাত থেকে দশগাছা মোটা মোটা চুড়ি খুলে নিয়ে স্বামীর মস্তক লক্ষ্য করে ঝনঝন শব্দে নিক্ষেপ করলেন। শেঠজীর কপাল ফেটে রক্ত পড়তে লাগল, তিনি চিৎকার করে ধরাশায়ী হলেন। ততোধিক চিৎকার করে আনন্দীবাঈ তাঁর পূজোর ঘরে চলে গেলেন এবং মেঝেয় শুয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
বাড়িতে মহা শোরগোল পড়ে গেল। আত্মীয়া যাঁরা ছিলেন তাঁরা আনন্দীকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন। শেঠজীর জন্যে খজনচাঁদ তখনই ডাক্তার ডেকে আনালেন।
সাত দিন পরে শেঠজী অনেকটা সুস্থ হয়েছেন এবং দোতলার বারান্দায় আরাম কেদারায় বসে গুড়গুড়ি টানছেন। তাঁর মাথায় এখনও ব্যাণ্ডেজ আছে, মুখে স্থানে স্থানে স্টিকিং প্লাসটারও আছে।
খজনচাঁদ এসে বললেন, কহিএ শেঠজী, তবিঅত কৈসী হৈ।
শেঠজী বললেন, অনেক ভাল। শোন খজন—ভাই রাজহংসী আর বলাকার সঙ্গে আমি সম্পর্ক রাখতে চাই না। তুমি তুরন্ত বোম্বাই আর কলকাতায় গিয়ে একটা মিটমাট করে ফেল, যত টাকা লাগে আমি দেব। ওই মুম্বইবালী আর কলকাত্তাবালী শুধু আমার টাকা চায়, আমাকে চায় না, কিন্তু আনন্দী আমাকেই চায়। খুশবু পাচ্ছ? আনন্দী নিজে আমার জন্যে অড়হর ডালের খিচড়ি বানাচ্ছে। আর এই দেখ, গলাবন্ধ বুনে দিয়েছে।
খজনচাঁদ বললেন, বহুত খুশী কি বাত। শেঠজী , ভাববেন না, আমি সব ঠিক করে দেব। আপনি আনন্দীবাঈকে মথুরা বৃন্দাবন দ্বারকায় ঘুরিয়ে আনুন, তাঁর মেজাজ ভাল হয়ে যাবে।
পত্নীর সেবায় ত্রিক্রমদাস শীঘ্র সেরে উঠলেন। খজনচাঁদের চেষ্টায় রাজহংসী আর বলাকার সঙ্গে মিটমাট হয়ে গেছে, জুলফিকার খাঁও পান খাবার জন্যে মোটা টাকা পেয়েছেন। কলকাতার সব চেয়ে বড় জ্যোতিষসম্রাট জ্যোতিষচন্দ্র জ্যোতিষার্ণবের কাছ থেকে আনন্দীবাঈ হাজার টাকা দামের একটি বশীকরণ কবচ আনিয়ে স্বামীর গলায় বেঁধে দিয়েছেন। এই পুরশ্চরণসিদ্ধ কবচের ফলও আশ্চর্য। শেঠজী আজকাল তাঁর বিশ্বস্ত বন্ধুদের কাছে বলে থাকেন, সিবায় আনন্দী সব আওরত চুড়ৈল হৈ—অর্থাৎ আনন্দী ছাড়া সব স্ত্রীলোকই পেতনী।*
১৮৭৮ শক (১৯৫৬)
* এই ইংরেজী গল্পের প্লটের অনুসরণে। লেখকের নাম মনে নেই।
আমের পরিণাম
ছেলেবেলায় শোনা একটি গল্প বলছি।
খলিফা হারুন—অল—রসিদ একদিন তাঁর মন্ত্রী জাফরকে বললেন, ‘উজির তুমি দিন দিন অকর্মণ্য হচ্ছে, তোমার দ্বারা রাজকার্য চলবে না। তোমাকে আস্তাবলের ঘেসেড়া করব স্থির করেছি।’
জাফর হাত জোড় করে বললেন, ‘কেন প্রভু, আমি তো প্রাণপণে রাজকার্য চালাচ্ছি।’
‘ছাই চালাচ্ছ। আমার রাজ্যে ভাল মেওয়া মেলে না কেন?’
‘বলেন কি হুজুর, আপনার রাজ্য হ’ল বাদাম পেস্তা আজির খোবানি কিশমিশ মনাক্কা খেজুরের অক্ষয় ভাণ্ডার। এত ফল আর কোন মুলুকে পাওয়া যায়?’
খলিফা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি দিন দিন বেকুফ হচ্ছ। ওসব শুঁটকি ফল, রস কিচ্ছু নেই।’
জাফর বললেন, ‘কেন বেদনাতে তো রস আছে।’
‘চার ভাগ বিচি, এক ভাগ রস। রস গিলব না বিচি ফেলব? আমের নাম শুনেছ।’
জাফর সভয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আম? সে কি চিজ?’
‘তুমি কোনও খবরই রাখ না। আম হচ্ছে হিন্দুস্থানের ফল, কেতাবে পড়েছি তার তুল্য মেওয়া দুনিয়ায় নেই। আমার রাজধানী এই বোগদাদে তার আমদানি নেই কেন?’
‘প্রভু যদি হুকুম দেন তবে আমি নিজে হিন্দুস্থানে গিয়ে আনতে পারি।’
‘তবে এখনই রওনা হও। এক বছরের মধ্যে ফিরে আসা চাই। খরচ যা লাগবে খাজানা থেকে নাও।’
জাফর ভাবলেন, শাপে বর হ’ল। পথখরচের টাকা থেকে কিছু মোটা রকম লাভ হবে, নূতন মুলুক দেখা হবে, কিছুকাল খলিফার ধমক থেকেও রেহাই পাওয়া যাবে। তিনি পাঁচ শ উট, এক হাজার অনুচর, দশজন সুয়ো বেগম, চল্লিশজন দুয়ো বেগম আর বিস্তর টাকা নিয়ে রওনা হলেন। কুর্দিস্থান, ইরান, আফগানিস্থান পার হয়ে অবশেষে পেশোআরে পৌঁছলেন। সেখান থেকে আমের সন্ধান নিয়ে বেনারস গেলেন, তারপর ত্রিহুত, মালদহ, মুরশিদাবাদ।
নানারকম আম বিস্তর কেনা হ’ল। নিজেরা ঢের খেলেন আর খলিফার জন্য দু হাজার ঝুড়ি উটে বোঝাই করে বোগদাদের দিকে ফিরলেন।
দুদিন পরেই দেখা গেল যে আম মেওয়া নয়, বেশী দিন টিকবে না। জাফর ভাবলেন, এমন উত্তম জিনিস নষ্ট করে কি হবে, খেয়ে ফেলা যাক। তার পর তিনি সদলে আম সাবাড় করতে শুরু করলেন। নিজে আর সুয়ো বেগমরা খান আমের চাকা, দুয়োরা আঁটি চোষেন, আর পচা আম খায় লোক—লশকর। বোগদাদ পৌঁছবার ঢের আগেই আম নিঃশেষ হয়ে গেল।
শেষ আমটি খেয়ে জাফর মাথা চাপড়ে বললেন, ‘ইয়া আল্লা, খলিফাকে আমি কি বলব? হায় হায়, আমাকে তিনি নিশ্চয় কতল করবেন।’
বেগম আর অনুচরদের ভিতর কান্নাকাটি প’ড়ে গেল। তখন দুয়ো বেগমদের ভিতর যিনি সবচেয়ে দুয়ো, তিনি একটু ভেবে বললেন, ‘প্রভু, কোনও চিন্তা নেই, বোগদাদে চলুন, সেখানে আমি নিস্তারের উপায় বাতলে দেব।’
জাফর বললেন, ‘যদি আমার প্রাণ রক্ষা করতে পার তবে তোমাকেই এক নম্বর সুয়ো করব।’
খলিফা হারুন—অল—রসিদ রাজসভায় বসেছেন। বিস্তর পাত্র মিত্র সভাসদ হাজির হয়েছে। আজ আম এসে পৌঁছবে, সকলেই তার আস্বাদনের জন্য লোলুপ হয়ে আছেন।
খলিফা হাঁক দিলেন, ‘জাফরটা এখনও হাজির হ’ল না কেন? তার গর্দানের ওপর কটা মুণ্ড আছে?’
জাফর আস্তে আস্তে রাজসভায় প্রবেশ করলেন। তাঁর হাতে একটা বোঁচকা। তিনবার কুর্নিশ ক’রে খলিফাকে বললেন, ‘খোদাবন্দ, গোলাম হাজির। আপনি কেতাবে আমের যে সুনাম পড়েছেন তা একেবারে মিথ্যা।’
খলিফা বললেন, ‘ওসব শুনতে চাই না, নিকালো আম।’
জাফর বললেন, ‘এই যে হুজুর, এখনই আপনাকে আম চাখিয়ে দেখাচ্ছি।’ এই ব’লে তিনি বোঁচকা খুলে দুটো মালসা বার করলেন, তার একটাতে তেঁতুলের মাড়ি, আর একটাতে গুড়। দুটো একসঙ্গে চটকে নিয়ে নিজের লম্বা দাড়িতে জুবড়ে মাখালেন। তার পর খলিফার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে ব’সে দাড়িটি এগিয়ে দিয়ে বললেন, ‘প্রভু চুষতে আজ্ঞা হ’ক।’
খলিফা বললেন, ‘বিসমিল্লাহ, এ কিরকম বেয়াদবি!’
জাফর বললেন, ‘হে দীনদুনিয়ার মালিক, আম অতি ওয়াহিয়াত অপবিত্র ফল, কাফেররা খায়, আপনাকে কি তা দিতে পারি? তাই আমার এই বৃদ্ধ বয়সের ফসল, আমার মান—ইজ্জতের নিশান, এই দাড়িতে আমের স্বাদ গন্ধ স্পর্শ মিশিয়ে আপনাকে নিবেদন করছি। এতে আমের অপবিত্রতা নেই, কিন্তু মিষ্টতা অম্লতা ছিবড়ে আর গন্ধ এই চার লক্ষণই হুবহু বর্তমান। একবারটি চুষে দেখুন।’
খলিফা মুখ ফিরিয়ে বললেন, ‘তোঁবা তোঁবা।’
জাফর তখন সভাসদবর্গের দিকে দাঁড়িটি নেড়ে বললেন, ‘আপনারা একটু ইচ্ছে করেন কি? চেটে দেখতে পারেন।’
তাঁরাও বললেন, ‘তোঁবা তোঁবা।’
খলিফা বললেন, ‘খবরদার, আর আমের নামও কেউ ক’রো না। যাও জাফর, তোমার দাড়ি ধুয়ে ফেল।’
সেই অবধি খলিফার হুকুমে আরব দেশে আমের আমদানি নিষিদ্ধ হ’ল। তবে জাফরের সেই দুয়ো বেগম, যিনি বুদ্ধিবলে সুয়োতমা হলেন, তিনি লুকিয়ে লুকিয়ে আমসত্ত্ব আনিয়ে খেতেন।
১৯—৭—৪২
______
* ‘হনুমানের স্বপ্ন’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত নয়।
উপেক্ষিত
শহর ফতেহাবাদ, সময় অপরাহ্ন। শাহজাদী জবরউন্নিসা দিলতোড়বাগ উদ্যানে একাকিনী বসিয়া আছেন। সমান্তরাল তরুশ্রেণীর শীর্ষে অস্তরাগ ঝিকমিক করিতেছে, ডালে ডালে হাজার বুলবুলের কাকলি, গোলাবের ফোয়ারায় রামধনুর রংবাহার, ফুলে ফুলে চারিদিক ছয়লাপ। শাহজাদীর হাতে রবাব, তাহাতে তিনি কোমল গুঞ্জন তুলিয়া আপন মনে মৃদুস্বরে গাহিতেছেন। তাঁহার প্রিয় ব্যাঘ্র হেমকান্তি ফারুকশিয়র পদ—প্রান্তে বসিয়া থাবা দিয়া তাল দিতেছে এবং মাঝে মাঝে স্বামিনীর বিজাপুরী জরিদার লাল চটিজুতা চাটিতেছে।
সহসা একটি পুরুষ মূর্তির আবির্ভাব। গৌরবর্ণ বলিষ্ঠ দেহ, বক্রাগ্র দাড়ি, বহুমূল্য পরিচ্ছদ, কটিবন্ধে রত্নখচিত পিধানে নিহিত দামস্কসীয় তলবার। ইনিই সুবিখ্যাত কোফতা খাঁ, বাদশাহের সেনাপতি ও দক্ষিণহস্ত।
জবরউন্নিসা চমকিত হইয়া বলিলেন—’একি, কোফতা খাঁ, তুমি এখানে?’
সেনাপতি কহিলেন—’হাঁ সুন্দরী। আজ আমি একটা হেস্ত—নেস্ত করিতে চাই। তুমি বহুকাল আমাকে ছলনা করিয়াছ, আজ জবান খুলিয়া বল আমাকে বিবাহ করিবে কি না।’
জবরউন্নিসা কন্দর্পচাপতুল্য তাঁহার ভ্রূযুগল কুঞ্চিত করিয়া বলিলেন—’বেওকুফ, তুমি কাহার সঙ্গে কথা কহিতেছ? ছিলে নগণ্য কিজিলবশ ক্রীতদাস, আজ বাদশাহের দয়ায় সেনাপতি হইয়াছ। বস, ঐখানেই ক্ষান্ত হও, অধিক ঊর্ধ্বে নজর দিও না।’
কোফতা খাঁ যথোচিত ভীষণতা সহকারে একটি অট্টহাস্য হাসিলেন। বলিলেন,—’শাহজাদী, কে তোমার পিতাকে তখতে চড়াইয়াছে? মারহাট্টার আক্রমণ কে বার বার রোধ করিয়াছে? কাহার অনুগ্রহে তোমার এই ভোগৈশ্বর্য, এই হীরাজহরৎ, এই লীলা—উদ্যান, এই হাজার—বুলবুল—মুখরিত বুস্তাঁ? ঈনশাল্লাহ! জান, একটি অঙ্গুলির হেলনে সমস্ত ভূমিসাৎ করিতে পারি? আজ হিন্দুস্তানের প্রকৃত মালিক কে? তোমার অক্ষম পিতা, না এই মহাবীর রুস্তম—ই—হিন্দ কোফতা খান ফতে জঙ্গ?’
জবরউন্নিসা বলিলেন—’কুত্তার গর্দানে লোম গজাইলেই সে সিংহ হয় না।’
সেনাপতি কহিলেন—’বিসমিল্লাহ! এই কথা আর কেহ বলিলে এই মুহূর্তে তাহাকে কোতল করিতাম। কিন্তু তুমি আমার দিল গিরিফতার করিয়াছ, এবারকার মত মাফ করিলাম। যাহা হউক, এখনও বল তুমি আমার হৃদয়েশ্বরী হইবে কি না।’
জবরউন্নিসা মধুর হাস্য করিয়া বলিলেন—’কোফতা খাঁ, তুমি কি কবি হাফেজের সেই বয়েতটি জান না?—কুকুর বার বার ঘেউ ঘেউ করে, কিন্তু সিংহী একবারই গর্জায়।’
ইহার পর কোনও পুরুষই স্থির থাকিতে পারে না, বিশেষত সেই দারুণ মুঘল যুগে। কোফতা খাঁ হুংকার করিয়া কহিলেন—’ইলহমদলিল্লাহ! শাহজাদী, তবে আল্লার নাম স্মরণ করিয়া মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও।’ কোষ হইতে সড়াক করিয়া অসি নির্গত হইল।
‘কোফতা খাঁ তুমি আমাকে নিতান্তই হাসাইলে!’ এই বলিয়া শাহজাদী অন্যমনস্কভাবে গুনগুন করিয়া গহিতে লাগিলেন—’চল চল চম্বেলীবাগ পর মেরা বাঘকো খিলাউংগি।’
অসহ্য। কোফতা খাঁর নিষ্ঠুর হস্তে তলবার ঝলকিয়া উঠিল। সহসা শূন্যে যেন সৌদামিনী খেলিল, একটি হিল্লোলিত কাঞ্চনাকায়া নিমেষের তরে উৎক্ষিপ্ত হইয়া আবার ভূতলে পড়িল। একটু অস্ফুট আর্তনাদ, একটু ছটফটানি, তাহার পর সব শেষ।
সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনীভূত হইতেছে। জবরউন্নিসা তখন যন্ত্রে ঝংকার তুলিয়া গাহিতেছেন—’আয়সে বেদরদীকে পালে পড়ী হু।’ তাঁহার পোষা বাঘটি ভোজন সমাপ্ত করিয়া পরম তৃপ্তির সহিত সৃক্কণী পরিলেহন করিতেছে। তাহার বাঁয়ে কোফতা খাঁর পাগড়ি, ডাহিনে ছিন্ন ইজার কাবা জোব্বা, সম্মুখে কিঞ্চিৎ হাড়।
১৩৩৬ (১৯২৯)
উপেক্ষিতা
তিন নম্বর রোডোডেনড্রন রোড, বালিগঞ্জ। বাহিরে মুষলধারে বৃষ্টি পড়িতেছে। ড্রইংরুমে পিয়ানোর কাছে উপবিষ্ট গরিমা গাঙ্গুলী, তাহার সম্মুখে ইজিচেয়ারে চটক রায়। ঘরে আসবাব বেশী নাই, কারণ গরিমার বাবার ঢাকায় বদলির হুকুম আসিয়াছে, অধিকাংশ জিনিস প্যাক হইয়া আগেই রওনা হইয়া গিয়াছে।
এই চটক ছেলেটি যেমন ধনী তেমনই মিষ্টভাষী বিনয়ী বাধ্য, চিমটি কাটিলেও টুঁ শব্দ করে না—যাহাকে বলে নারীর মনুষ্য অর্থাৎ লেডিজম্যান। না হইবে কেন, সে যে পাঁচ বৎসর বিলাতে থাকিয়া সেরেফ এটিকেট অধ্যয়ন করিয়াছে। এমন সুপাত্র আজকালকার বাজারে দুর্লভ। গরিমার পিতামাতা কলিকাতা ত্যাগের পূর্বেই কন্যাকে বাগদত্তা দেখিতে চান, তাই তাঁহারা যাত্রার পূর্বসন্ধ্যায় ভাবী দম্পতীকে বিশ্রম্ভালাপের সুযোগ দিয়া দোতলায় বসিয়া সুসংবাদের প্রতীক্ষা করিতেছেন।
কিন্তু আলাপ তেমন জমে নাই। গোটা—পনের গান শেষ করিয়া গরিমা তৃতীয়বার জানাইল—’কাল আমরা যাচ্ছি।’
চটক বলিল—’ও।’
হায় রে, বিদায়বার্তার এই কি উত্তর! গরিমার কথা যোগাইতেছে না। বলিল—’সেই ভুটানী গজলটা গাইব কি?’
‘নাঃ, এইবার ওঠা যাক।’
‘সেকি হয়, আগে বৃষ্টি থামুক।’
চটক চেয়ারে বসিয়া নীরবে উশখুশ করিতে লাগিল। মিনিট—দুই পরে আবার বলিল—’এইবার উঠি।’
গরিমা ভাবিতেছিল, কবি বৃথাই লিখিয়াছেন—’এমন দিনে তারে বলা যায়।’ এই বাদল সন্ধ্যা কি নিষ্ফল হইবে? চটকের কি হইল? কেন সে পালাইতে চায়? তাহার কিসের অস্বস্তি, কিসের অস্থিরতা? গরিমার মোহিনী শক্তি আজ তাহাকে ধরিয়া রাখিতে পারিতেছে না। সেই ভেটকি—মুখী বেহায়া মেনী মিত্তিরটা চটককে হাত করে নাই তো? হবেও বা, যা গায়ে পড়া মেয়ে! গরিমা তাহার কণ্ঠাগত ক্রন্দন গিলিয়া ফেলিয়া বলিল—’আর একটু বসুন।’
কিন্তু চটক বসিল না। চেয়ারে হইতে লাফাইয়া উঠিয়া বলিল—’নাঃ, চললুম, গুড নাইট।’
বৃষ্টির নিরবচ্ছিন্ন ঝমঝমানি ভেদ করিয়া চটকের মোটর গুঞ্জরিয়া উঠিল। গেল, যাহা বলিবার তাহা না বলিয়াই চলিয়া গেল—ভোঁপ, ভোঁপ,—দূরে, বহু দূরে।
গরিমা কাঁদিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া চটকের পরিত্যক্ত চেয়ারে দেহলতা এলাইয়া দিল। তাহার পরেই এক লাফ। ভীষণ সত্য সহসা প্রকট হইল। বেচারা চটক!
চেয়ারে অগনতি ছারপোকা।
১৩৩৬(১৯২৯)
উলট-পুরাণ
রিচমণ্ড বঙ্গ-ইঙ্গীয় পাঠশালা। মিস্টার ক্র্যাম (পণ্ডিত মহাশয়)
এবং ডিক টম হ্যারি প্রভৃতি বালকগণ
ক্র্যাম। চটপট নাও, চারটে বাজে। ডিক, ইতিহাসের শেষটুকু প’ড়ে ফেল।
ডিক। ‘ইওরোপের দুঃখের দিন অবসান হইয়াছে। জাতিতে জাতিতে দ্বেষ হিংসা বিবাদ দূর হইয়াছে। প্রবলপরাক্রান্ত ভারত—সরকারের দোর্দণ্ডশাসনের সুশীতল ছায়ায়’—দোর্দণ্ড মানে কি পণ্ডিত মশায়?
ক্র্যাম। দোর্দণ্ড জান না? The big rod. under the soothing influence of the big rod.
ডিক। ‘সুশীতল ছায়ায় আশ্রয়লাভ করিয়া সমস্ত ইওরোপ ধন্য হইয়াছে। আয়ারল্যাণ্ড হইতে রাশিয়া, ল্যাপল্যাণ্ড হইতে সিসিলি, সর্বত্র শান্তি বিরাজ করিতেছে। ফ্রান্স এখন আর জার্মানির গলা কাটিতে চায় না, ইংলণ্ড আর জাতিতে জাতিতে বিবাদ বাধাইতে পারে না, অস্ট্রিয়া ও ইটালিতে আর মেতিপুকুরের দখল লইয়া মারামারি করে না।’ মেতিপুকুর কোনটা পণ্ডিতমশায়?
ক্র্যাম। ঐ সামনে মানচিত্র রয়েছে দেখ না। ইটালির কাছে যে সমুদ্র সেইটে। সেকালে নাম ছিল মেডিটেরেনিয়ান। ইণ্ডিয়ানরা উচ্চারণ ক’রতে পারে না ব’লে নাম দিয়েছে মেতিপুকুর। সেইরকম আলস্টারকে বলে বেলেস্তারা, সুইটসারল্যাণ্ডকে বলে ছছুরাবাদ, বোর্দোকে বলে ভাঁটিখানা, ম্যাঞ্চেস্টারকে বলে নিমতে। তারপর প’ড়ে যাও।
ডিক। ‘ইওরোপীয়গণের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি হইতেছে। তাহাদের লোভ কমিয়াছে, অসভ্য বিলাসিতা দূর হইতেছে, ইহকালের উপর আস্থা কমিয়া গিয়াছে, পরকালের উপর নির্ভরতা বাড়িতেছে। ভারত—সন্তানগণ সাত—সমুদ্র তের নদী পার হইয়া এই পাণ্ডববর্জিত দেশে আসিয়া নিঃস্বার্থভাবে শান্তি শৃঙ্খলা ও সভ্যতার প্রতিষ্ঠা করিতেছেন।’ আচ্ছা পণ্ডিতমশায়, এসব কি সত্যি?
ক্র্যাম। ছাপার অক্ষরে যখন লিখেছে আর সরকারের হুকুমে যখন পড়তে হচ্ছে তখন সত্যি বইকি।
ডিক। কিন্তু বাবা বলেন সব bosh।
ক্র্যাম। তোমার বাবার আর বলতে বাধা কি। তিনি হলেন উকিল, আমার মতন তো আর সরকারের মাইনেয় নির্ভর করতে হয় না।
ডিক। ‘হে সুবোধ ইংরেজশিশুগণ, তোমরা সর্বদা মনে রাখিও যে ভারত সরকার তোমাদের দেশের অশেষ উপকার করিয়াছেন। তোমরা বড় হইয়া যাহাতে শান্ত বাধ্য রাজভক্ত প্রজা হইতে পার তাহার জন্য এখন হইতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া যাও।’
টম। বু—হু—হু—হু—
ক্র্যাম। ও কি রে, শীত করছে বুঝি? আবার তুই ধুতি—পাঞ্জাবি প’রে এসেছিস! বাঙালীর নকল করতে গিয়ে শেষে দেখছি নিউমোনিয়ায় মরবি।
টম। বাবার হুকুম পণ্ডিতমশায়। আজ পাঠশালের ফেরত খাঁসাহেবের গবসন টোডির পার্টিতে যেতে হবে। তিনি নতুন খেতাব পেয়েছেন কিনা। সেখানে বিস্তর ইণ্ডিয়ান ভদ্রলোক আসবেন, তাই বাবা বললেন, দেশী পোশাক পরা চলবে না।
ক্র্যাম। তা বাঙালী সাজতে গেলি কেন? ইজের—চাপকান পরলেই তো পারতিস।
টম। আজ্ঞে, বাবা বললেন, বাঙালীই সবচেয়ে সভ্য তাই—ব্রর র র—
ক্র্যাম। যা যা শীগগির বাড়ি যা, অন্তত একটা শাল মুড়ি দিগে যা। ও কি, হোঁচট খেলি নাকি?
হ্যারি। দেখুন দেখুন, টম কি রকম কাছা দিয়েছে, যেন স্কিপিং রোপ!
ধর্মযাজকগণের মুখপত্র ‘দি কিংডম কাম’
হইতে উদ্ধৃত।
সর্বনাশের আয়োজন হইতেছে। ভারতসরকার আমাদের ধনপ্রাণ হস্তগত করিয়াছেন—আমরা নিরীহ ধর্মযাজক—সম্প্রদায় তাহাতে কোনও উচ্চবাচ্য করি নাই, কারণ ইহলোকের পাঁউরুটি ও মাছের উপর আমাদের লোভ নাই এবং সীজারের প্রাপ্য সীজারকে দেওয়াই শাস্ত্রসম্মত। কিন্তু আজ এ কি শুনিতেছি? আমাদের ধর্মের উপর হস্তারোপ! ঘোড়দৌড় বন্ধ করার জন্য আইন হইতেছে। অ্যাসকট, এপসম প্রভৃতি মহাতীর্থ কি শেষে শ্মশানে পরিণত হইবে? বিশপ স্টোনিব্রোক নাকি গর্ভনমেণ্টকে জানাইয়াছেন যে ধর্মশাস্ত্রে ঘোড়দৌডের উল্লেখ নাই, অতএব রেস বন্ধ করিলে খ্রীষ্ট্রিয় ধর্মের হানি হইবে না। হা, একজন ধর্মযাজকের মুখে এই কথা শুনিতে হইল! বিশপ কি জানেন না যে, রেস খেলা ব্রিটিশ জাতির সনাতন ধর্ম এবং লোকাচার বাইবেলেরও উপর? আরও ভয়ানক সংবাদ—শীঘ্রই নাকি মদ্যপান রোধ করার উদ্দেশ্যে আইন হইবে। আমাদের শাস্ত্রসম্মত সনাতন পানীয় বন্ধ করিয়া ভারত সরকার কি ভারতীয় চায়ের কাটতি বাড়াতে চান?
‘রাষ্ট্রবিৎ’—যাহার সঙ্গে সংযুক্ত আছে ‘ইঙ্গবন্ধু’
হইতে উদ্ধৃত।
আমরা খাঁসাহেব গবসন টোডিকে সাদরে অভিনন্দন করিতেছি। তিনি অতি উপযুক্ত ব্যক্তি, তাহাকে উচ্চ সম্মানে ভূষিত দেখিয়া আমরা প্রকৃতই আনন্দিত হইয়াছি। দেশী লোকের ভাগ্যে এত বড় উপাধি এই প্রথম মিলিল। আমরা কিন্তু সরকারকে সাবধান করিতেছি—এই সকল উচ্চ উপাধি যেন বেশী সস্তা করা না হয়, তাহা হইলে ভারতীয় রায়সাহেব খাঁবাহাদুর প্রভৃতি ক্ষুণ্ণ হইবেন এবং তাহাতে ইওরোপের উন্নতি পিছাইয়া যাইবে। নাইট, ব্যারন, মার্কুইস, ডিউক প্রভৃতি দেশী উপাধিই সাহেবদের পক্ষে যথেষ্ট। যাহা হউক, মিস্টার টোডি যখন নিতান্তই খাঁসাহেব টোডি হইয়া গিয়াছেন, তখন তাঁহার অতি সন্তর্পণে সম্ভ্রম বজায় রাখিয়া চলা উচিত। আশা করি, তিনি রাজদ্রোহী লিবার্টি—লীগের ছায়া মাড়াইবেন না।
গবসন টোডির অন্দরমহল। মিসেস টোডি, তাঁহার দুই কন্যা
ফ্লফি ও ফ্ল্যাপি এবং তাহাদের শিক্ষয়িত্রী জোছনা—দি
জোছনা। ফ্ল্যাপি, তোমায় নিয়ে আর পেরে উঠি নে বাছা। ওই রকম ক’রে বুঝি চুল বাঁধে? আহা কি ছিরিই হয়েছে! কান দুটো যে সবটাই বেরিয়ে রয়েছে। এতখানি বয়স হ’ল কিছুই শিখলে না। দেখ দিকি, তোমার দিদি কি সুন্দর খোঁপা বেঁধেছে!
ফ্ল্যাপি। Let her। কানের ওপর চুল পড়লে আমি কিচ্ছু শুনতে পাই না। আমি ঘাড় ছাঁটবো, ও—বাড়ির মিস ল্যাংকি গসলিং—এর মতন।
জোছনা। হ্যাঁ ঘাড় ছাঁটবে, নাড়া হবে, ভুরু কামাবে, রূপ একেবারে উথলে উঠবে। দেখাবে যেন হাড়গিলেটি। পড়তে শাশুড়ীর পাল্লায়—
ফ্ল্যাপি।
Little pussy Friskers
Shaved off her whiskers;
And sharpening her paw
Scratched her mum-in-law.
জোছনা। কি বেহায়া মেয়ে। মিসেস টোডি, আপনার ছোট মেয়েকে দুরস্ত করা আমার সাধ্য নয়।
মিসেস টোডি। ছি ফ্ল্যাপি, তুমি দিন দিন ভারী বেয়াড়া হচ্ছ। জোছনা—দি তোমাদের শিক্ষার জন্য কত মেহনত করেন তা বোঝ?
ফ্ল্যাপি। আমি শিখতে চাই না। উনি ফ্লফিকে শেখান না।
জোছনা। আবার ‘ফ্লফি’! দিদি বলতে কি হয়? অ্যাঁ ও কি—ফের তুমি পেনসিল চুষছ! ছি ছি, কি নোংরা! আচ্ছা, এখন তুমি ও ঘরে গিয়ে সেই উর্দু গজলটা অভ্যাস কর।
মিসেস টোডি। জোছনা—দি, আপনার ডিবে থেকে একটা পান নেব? থ্যাংক ইউ।
জোছনা। দেখুন মিসেস টোডি, কথায় কথায় থ্যাংক ইউ—প্লীজ—সরি এগুলো বলবেন না। ভারী বদ অভ্যাস এর জন্যেই আপনাদের জাতের উন্নতি হচ্ছে না। ওরকম তুচ্ছ কারণে কৃতজ্ঞতা বা দুঃখ জানানো আমরা ভন্ডামি ব’লে মনে করি। নিন একটু দোক্তা খান।
মিসেস টোডি। নো, থ্যাংকস,—থুড়ি। দোক্তা খেলেই আমার মাথা ঘোরে। বরং একটা সিগারেট খাই।
জোছনা। মেয়েদের সিগারেট খাওয়া অত্যন্ত খারাপ। আপনি একটু চেষ্টা ক’রে দোক্তা ধরুন।
মিসেস টোডি। কিন্তু দু—ই তো হল তামাক?
জোছনা। তা বললে কি হয়। একটা হ’ল ধোঁয়া আর একটা হ’ল ছিবড়ে। ধোঁয়া পুরুষের জন্য, আর ছিবড়ে মেয়েদের জন্য। ফ্লফি, তোমার সেই বাংলা উপন্যাসখানা শেষ হয়েছে?
ফ্লফি। বড় শক্ত, মোটেই বুঝতে পারছি না।
জোছনা। বোঝবার বিশেষ দরকার নেই, কেবল বাছা বাছা জায়গা মুখস্থ ক’রে ফেলবে। লোককে জানানো চাই যে বাংলা ভাল ভাল বইয়ের সঙ্গে তোমার পরিচয় আছে। কিন্তু তোমার উচ্চারণটা বড় খারাপ। সভ্যসমাজে মিশতে গেলে চোস্ত বাংলা উচ্চারণ আগে দরকার, আর গোটাকতক উর্দু গান। আচ্ছা, তুমি বাংলায় এক দুই তিন চার ব’লে যাও দিকি।
ফ্লফি। এক দুই তিন শাড়—
জোছনা। শাড় নয়, চার।
ফ্লফি। চার পাইচ—
জোছনা। পাইচ নয়, পাঁচ।
ফ্লফি। পাঁইশ—
জোছনা। পাঁ—চ।
ফ্লফি। ফ্যাঁচ—
জোছনা। মাটি করলে। মিসেস টোডি, ফ্লফিকে বেশী চকোলেট খেতে দেবেন না, ছোলাভাজার ব্যবস্থা করুন, নইলে জিবের জড়তা ভাঙবে না। দেখ ফ্লফি, আর এক কাজ কর। বার বার আওড়াও দিকি—রিশড়ের আড়পার খড়দার ডান ধার—ছাঁদনাতলায় হোঁতকা হোঁদল।
নেপথ্যে গবসন টোডি। ডিয়ারি—
মিসেস টোডি। কূ! কোথায় তুমি?
গবসন টোডি। বাথরুমে। আরও গোটাকতক আম দিয়ে যাও।
জোছনা। বাথরুমে আম?
মিসেস টোডি। তা ভিন্ন আর উপায় কি। গবি বলে, আম যদি খেতে হয় তবে ভারতীয় পদ্ধতিতেই খাওয়া উচিত। অথচ আপনাদের মতন হাত দুরস্ত নয়,—পোশাক কার্পেট টেবিল—ক্লথে রস ফেলে একাকার করে। তাই গবিকে বলেছি বাথরুমে গিয়ে আম খাওয়া অভ্যাস করতে। সেখানে দু—হাতে আঁটি ধ’রে চুষছে আর চোয়াল ব’য়ে রস গড়াচ্ছে। Horrid!
জোছনা। ঠিক ব্যবস্থাই করেছেন। দেখুন মিসেস টোডি, আপনি যে স্বামীকে ‘গবি’ বলছেন, ওটা সভ্যতার বিরুদ্ধে। আড়ালে গবি হাবি যা খুশি বলুন, কিন্তু অপরের কাছে নাম করবেন না। দরকার হ’লে বলবেন—’উনি’। আর যদি অতটা খাতির না করতে চান তবে বলবেন—’ও’।
মিসেস টোডি। তাই নাকি? আচ্ছা, আপনি বসুন একটু। আমি ওকে আম দিয়ে আসছি।
‘রাষ্ট্রবিৎ’—এর বিজ্ঞাপনস্তম্ভ হইতে।
বিশুদ্ধ আনন্দনাড়ু। চর্বিমিশ্রিত ইংরেজী বিস্কুট খাইয়া স্বাস্থ্য নষ্ট করিবেন না। আমাদের আনন্দনাড়ু খান। দাঁত শক্ত হইবে। কেবল চালের গুঁড়ো ও গুড়। যন্ত্রদ্বারা স্পর্শিত নহে। বাঙালী মেয়ের নিজ হাতে গড়া। এক ঠোঙা পাঁচ শিলিং। সর্বত্র পাওয়া যায়। নির্মাতা—রসময় দাস, টিকটিকি বাজার, কলিকাতা।
অম্বুরী বরুণ। মেমগণের দুঃখ এইবার দূর হইল। এই আশ্চর্য গুঁড়া মুখে মাখিলে ফ্যাকাশে রং দুর হইয়া ঠিক বাঙালী মেয়ের মতন রং হইবে। যদি আর একটু বেশী ঘোর করিতে চান, তবে ইহার সঙ্গে একটি বের্দিগ্রীন মিশাইয়া লইবেন। রামচন্দ্রজী উহা মাখিতেন। দাম প্রতি পুরিয়া পাঁচ শিলিং। বিক্রেতা—শেখ অজহর লেডেনহল স্ট্রীট, ইন্ডিয়া হাউস, লণ্ডন।
‘দি লণ্ডন ফগ’ হইতে উদ্ধৃত
আগামী আশ্বিন মাসে এই লণ্ডন নগরে বিরাট রাজসূয় যজ্ঞ বসিবে। স্বয়ং মহাক্ষত্রপ ভারত সরকারের প্রতিনিধিরূপে এই যজ্ঞের যজমান হইবেন। হোতা, ঋত্বিক মোল্লা, মওলানা প্রভৃতি ভারত হইতে আসিবেন। দুই মাস ব্যাপিয়া দীয়তাং ভূজ্যত্যাং চলিবে, খরচ জোগাইবে অবশ্য এই গরীব ইওরোপবাসী।
সমস্ত ইওরোপের শোষণকার্য অবিরাম গতিতে চলিতেছে, কিন্তু তাহাতেও তৃপ্তি নাই। ভারতমাতা তাঁহার খরজিহ্বা লকলক করিয়া বলিতেছেন—হে সপত্নীপুত্রগণ, আনন্দ কর, আর একবার ভাল করিয়া তোমাদের হাড় চাটিব।
ঠিক ঐ সময়েই হাগ—নগরে প্যান—ইওরোপিয়ান লিবার্টি—লীগের অধিবেশন হইবে। হে ব্রিটন, জন—অ—গ্রোটস হইতে ল্যাণ্ডস—এণ্ড পর্যন্ত যে যেখানে আছ, দলে দলে সর্বরাষ্ট্রীয় মহাসম্মেলনে যোগ দাও। যদি তোমার বিন্দুমাত্র আত্মসম্মান থাকে তবে রাজসূয় যজ্ঞের ত্রিসীমায় যাইও না। একবার ভাবিয়া দেখ তোমার এই মেরি ইংল্যাণ্ড—যেখানে একদা দুগ্ধ ও মধুর স্রোত বহিত—তাহার কি দশা হইয়াছে। অন্ন নাই, বস্ত্র নাই, বীফ নাই, মাখন নাই, পনির নাই—এইবার বিয়ারও বন্ধ হইবে। বিদেশ হইতে গম আসে তবে তোমার রুটি প্রস্তুত হয়। তোমার ভেড়ার লোম ছাঁটামাত্রই পাঞ্জাবে যাইতেছে এবং তথা হইতে বনাত কম্বলরূপে ফিরিয়া আসিয়া তোমার অঙ্গে উঠিতেছে। ভারতের কার্পাসবস্ত্র তোমার বিখ্যাত লিনেন শিল্প নষ্ট করিয়াছে। হায়, তুমি কাহার বসন পরিয়াছ? তোমার নগ্নতা ঘুচিয়াছে কিন্তু লজ্জা ঢাকে নাই, শীত নিবারিত হইয়াছে কিন্তু তুমি অন্তরে অন্তরে কাঁপিতেছ। তোমার ভাল ভাল গো—বংশ ভারতে নির্বাসিত হইয়াছে, সেখানকার হিন্দু—মুসলমান ক্ষীর—ছানা ঘি খাইয়া নির্দ্বন্ধে মোটা হইতেছে। বিয়ার হুইস্কির আস্বাদ তুমি ভুলিয়া যাইতেছ, ভারতের গাঁজা আফিম তোমার মস্তিষ্কে শনৈঃ শনৈঃ প্রভাব বিস্তার করিতেছে। তোমার সর্বনাশের উপরে ভারত তাহার ভোগবিলাসের বিরাট মন্দির খাড়া করিয়াছে। তুমি ডিসেম্বরের শীতে পর্যাপ্ত কয়লার অভাবে হিহি করিয়া শিহরিতেছ, ওদিকে তোমারই অর্থে শেভিয়ট হিলে লক্ষ লক্ষ টন কয়লা পুড়াইয়া কৃত্রিম আগ্নেয়গিরি সৃষ্টি করা হইয়াছে; কারণ, ভারতীয় আমলাগণ শীতকালে সেখানে অপিস করবেন —লণ্ডনের শীত তাঁহাদের বরদাস্ত হয় না।
হে বহুধাবিভক্ত আত্মকলহপরায়ণ ইওরোপীয়গণ, এখনও কি তোমরা তুচ্ছ সাম্প্রদায়িক স্বার্থ ত্যাগ করিবে না? এখনও কি অ্যাংলো—সেল্টিক দ্বন্দ্ব, ফ্রাঙ্কো জার্মান দ্বন্দ্ব, ধনিক—শ্রমিকের দ্বন্দ্ব, স্ত্রী—পুরুষের দ্বন্দ্ব বন্ধ হইবে না?
হাইড পার্ক। বক্তা—সার ট্রিকসি টার্নকোট।
শ্রোতা—তিন চার হাজার লোক।
টার্নকোট। মাই কান্ট্রিমেন, তোমরা আজ আমাকে যে দু—চার কথা বলবার সুযোগ দিয়েছ তার জন্য বহু ধন্যবাদ। তোমাদের কি বলে সম্বোধন করব খুঁজে পাচ্ছি না, কারণ আমার হৃদয় পূর্ণ হয়েছে। হে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠদেশবাসী ভগবানের নির্বাচিত মানবগণ, হে ব্রিটন—সাকসন—ডেন—নর্মান বংশোদ্ভব ইংরেজ জাতি—।
ম্যাকডুডল। ইংরেজ নয়, বলুন ব্রিটিশ জাতি। স্কচরা কি ভেসে এসেছে নাকি?
টার্নকোট। আচ্ছা, আচ্ছা। হে ব্রিটিশ জাতি, একবার তোমাদের সেই প্রাচীন ইতিহাস স্মরণ কর। হে হেস্টিংস—ক্রেসি—এজিনকোর্টের বীরগণ, যাদের বিজয়পতাকা একদিন ইংল্যাণ্ড, স্কটল্যাণ্ড, আয়ারল্যাণ্ড, ফ্রান্সে—
ম্যাকডুডল। মিথ্যে কথা। স্কটল্যাণ্ডে তোমাদের বিজয়পতাকা কোনও কালে ওড়ে নি।
টার্নকোট। আচ্ছা, আচ্ছা, স্কটলাণ্ড বাদ দিলুম। যাদের বিজয়পতাকা একদিন আয়ারলাণ্ড ফ্রান্সে—
ও’ হুলিগান। Oirsland! Say it again!
টার্নকোট। আচ্ছা, আচ্ছা। বিজয়পতাকা কোথাও ওড়ে নি। হে ইংলিশ—স্কচ— আইরিশ—মিশ্রিত—ব্রিটিশ জাতি—
ও’ হুলিগান। Begorrah! আমরা ব্রিটিশ নই, — সেলটিক। টার্নকোট। আচ্ছা, আচ্ছা। হে ব্রিটিশ ও সেলটিক ভাইসকল আজ তোমরা কেন সমবেত হয়েছ?
ও’ হুলিগান। Sure, Oi don’t know।
টার্নকোট। কেন এখানে সমবেত হয়েছ তাও কি ব’লে দিতে হবে? হে হতভাগ্যগণ, তোমাদের এই পৈতৃক দেশের বুকের ওপর কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে তার খবর রাখ? রাজসুয় যজ্ঞ। ভারত সরকার মহা আড়ম্বর ক’রে তাঁর ঐশ্বর্য এবং পরাক্রমের পসরা খুলে বসবেন, আর সমস্ত ইওরোপের গণ্যমান্য ব্যক্তি এসে মহাক্ষত্রপকে কুর্নিশ করে বলবেন— ভারতসরকার কি জয়! এই আউট লাণ্ডিশ কাণ্ড এই স্যাক্রিলেজ—
(লর্ড ব্লার্নির বেগে প্রবেশ)
লর্ড ব্লার্নি জনান্তিকে। আরে তুমি কি বলছ সার ট্রিকসি। নিজের সর্বনাশ করছ? আমি কত ক’রে ক্ষত্রপকে ব’লে ক’য়ে এসেছি যেন Chiltren Hundreds-এর দেওয়ানিটা তোমাকেই দেওয়া হয়। কি আরামের চাকরি, একেবারে sine cure। ক্ষত্রপের ইচ্ছে চাকরিটা টোডিকে দেন, কিন্তু আমার একান্ত মিনতি শুনে বলেছেন বিবেচনা করে দেখবেন। এখনই খবর আসবে, আর এদিকে তুমি রাজদ্রোহ প্রচার করছ!
টার্নকোট। বটে বটে? আচ্ছা, আমি সামলে নিচ্ছি।
জনতা হইতে। Go on Tricksy, go on।
টার্নকোট। হ্যাঁ, তারপর কি বলছিলুম—হে আমার দেশবাসিগণ, এই ঘোর দুর্দিনে তোমাদের কর্তব্য কি? তোমরা কি এই যজ্ঞে এই বিরাট তামাশায় যোগ দেবে?
জনতা হইতে। Never, never।
বিল স্নুকস। Say guv’nor will they stand treat? মদ ক পিপে আসবে?
টার্নকোট। এক ফোঁটাও নয়। কেবল বাতাসা বিলি হবে। হে বন্ধুগণ! এই মহাযজ্ঞে তোমাদের স্থান কোথায়?
লর্ড ব্লার্নি। আঃ, কি বলছ টার্নকোট।
টার্নকোট। ঘাবড়ান কেন, শুনুন না। হে বন্ধুগণ! এই বিরাট যজ্ঞে কি তোমরা যাবে?
জনতা হইতে। বরং শয়তানের কাছে যাব।
টার্নকোট। না না, সেটা ভালো দেখাবে না। তোমাদের যেতেই হবে— না গিয়ে উপায় নেই, কারণ ভারত সরকার স্বয়ং তোমাদের আহ্বান করেছেন।
লর্ড ব্লার্নি। হিয়ার, হিয়ার।
জনতা হইতে। মিয়াও, মিয়াও।
টার্নকোট। দোহাই তোমরা আমাকে ভুল বুঝো না। মনে রেখো ভারতের সহানুভুতি না পেলে আমাদের গতি নেই—আমাদের ভবিষৎ নির্ভর করছে সরকারের দয়ার উপর—(পচা ডিম) —এঃ, চোখটা খুব বেঁচে গেছে। হে বন্ধুগণ! আমি কর্তব্য পালনে ভয় খাই না, যা সত্য ব’লে বিশ্বাস করি তাই অকপটে বলব।
লর্ড ব্লার্নি। বাঃ, ঠিক হচ্ছে। ঐ যে টেলিগ্রাম নিয়ে আসছে। ব্রেভো সার ট্রিকসি, নিশ্চয় ক্ষত্রপ তোমাকেই মনোনীত করেছেন। আমি পড়ে দেখছি, তুমি থেমো না, বক্তৃতা চলুক।
টার্নকোট। হে ভাই—সকল! আমি যা বলছি তা তোমাদেরই মঙ্গলের জন্য। এতে আমার নিজের কোনো স্বার্থ নেই। ব্লার্নি খবর কি হে? হে প্রিয় বন্ধুগণ, দেশের মঙ্গলের জন্য আমি সকল রকম লাঞ্ছনা ভোগ করতে প্রস্তুত। তোমাদের ঐ বেড়ালডাক আমারই জয়ধ্বনি। তোমাদের এই পচা ডিম আমি মাথা পেতে নিলুম। যদি তোমাদের তুণীরে আরও কিছু নিগ্রহের অস্ত্র থাকে —(বাঁধাকপি) —নাঃ, আর পারা যায় না। ব্লার্নি বল না হে, কি লিখেছে?
ব্লার্নি। পুওর ট্রিকসি! শেষটায় টোডি ব্যাটাই চাকরি পেলে। নেভার মাইন্ড, তুমি হতাশ হয়ো না। আবার একটা সুবিধা পেলেই তোমার জন্য চেষ্টা করব। ক্ষত্রপটা অতি গাধা। এটা বুঝলে না যে টোডি তো পোষ মেনেই আছে। আর তুমি হ’লে এত বড় একটা ডিমাগ—তোমাকে হাত করবার এমন সুযোগটা ছেড়ে দিলে! ছি ছি!
টার্নকোট। ড্যাম টোডি অ্যান্ড ড্যাম ক্ষত্রপ। হে আমার স্বদেশবাসীগণ—
জনতা হইতে। Shut up! Kick him—lynch the traitor!
টার্নকোট। না, না, আগে আমাকে বলতেই দাও। এই রাজসূয় যজ্ঞে তোমাদের যেতেই হবে। কেন যেতে হবে? বাতাসা খেতে? সেলাম করতে? ভারতসরকারের জয়জয়কার করতে? নেভার। সেখানে যাবে যজ্ঞ পন্ড করতে, লন্ডভন্ড করতে—ভারতসরকার যেন বুঝতে পারে যে তামাশা দেখিয়ে আর বাতাসা খাইয়ে তোমাদের আর ভুলিয়ে রাখা যাবে না।
জনতা হইতে। Long live Tricksy! Turncoat for ever!
নারীজাতির মুখপত্র ‘দি শিম্যান’ হইতে উদ্ধৃত।
কাল বৈকালে ঠিক তিনটার সময় নিখিল—ব্রিটিশ—নারী—বাহিনীর শোভাযাত্রা বাহির হইবে। রিজেণ্ট পার্ক হইতে আরম্ভ করিয়া পোর্টল্যাণ্ড প্লেস, রিজেন্ট স্ট্রীট, পিকাডিলি সার্কাস, ট্রাফালগার স্কোয়ার হইয়া এই বিরাট প্রসেশন পার্লিমেণ্ট হাউসে পৌঁছিবে।
হাজার হাজার বৎসর হইতে পুরুষজাতি নারীর উপর কর্তৃত্ব করিয়া আসিতেছে, কিন্তু আর তাহাদের চালাকি চলিবে না। আমরা সবলে নিজের প্রাপ্য আদায় করিয়া লইব। আমরা ভোটের অধিকার যাহা পাইয়াছি তাহা একেবারে ভুয়া। জুয়াচোর পুরুষগণ ছলে বলে কৌশলে ভোট যোগাড় করিয়া রাষ্ট্রীয়—পরিষদ প্রায় একচেটে করিয়াছে। এ ব্যবস্থা চলিবে না। ব্রিটেনের লোকসংখ্যার শতকরা ষাটজন নারী। আমরা এই অনুপাতেই নারীসদস্য চাই। সরকারী চাকরিতেও আমরা শতকরা ষাটজন নারী চাই। পুরুষের চেয়ে কিসে আমরা কম? আমরা ডিভাইডেড স্কার্ট পরি, ঘাড় ছাঁটি, সিগারেট খাই, ককটেল টানি। এর পর দরকার হয় তো মুখে কবিরাজি কেশ—তৈল মাখিয়া গোঁফ—দাড়ি গজাইব। পুরুষের সহিত কোনও কারবার রাখিব না, কারণ ওরূপ কুটিল স্বার্থপর জাতি পৃথিবীতে আর নাই। তারা মনে করে এই জগতটা পুরুষের জন্যই সৃষ্টি হইয়াছে। তাদের ভগবান পর্যন্ত পুংলিঙ্গ। আমরা হি—গড মানিব না। আইসিস, ডায়না, কালী অথবা শূর্পণখা—এঁদের দ্বারাই আমাদের কাজ চলিবে।
হে নারী, তুমি আর অবলা সরলা miminy piminy গৃহিণী নও। তুমি দাঁত নখ শানাইয়া এস, ভয়ংকর মূর্তিতে এই মহাবাহিনীতে যোগ দিয়া পার্লামেণ্ট আক্রমণ কর। অকর্মণ্য পুরুষদের তাড়াইয়া দিয়া সরকারের নিকট হইতে আপন অধিকার আদায় করিয়া লও।
পুরুষজাতির মুখপাত্র ‘দি মিয়্যার ম্যান’ হইতে উদ্ধৃত।
সরকার কি নাকে সরিষার তেল দিয়া ঘুমাইতেছেন? কাল এই লণ্ডন শহরের উপর যে পৈশাচিক কাণ্ড হইয়া গেল তাহাতে বোধ হয় যেন দেশে অরাজকতা উপস্থিত। দুর্বৃত্তা নারীগণ প্রকাশ্য দিবালোকে বিষম অত্যাচার করিয়াছে, দোকান—পাট ভাঙিয়া তছনছ করিয়াছে, নিরীহ পুরুষগণকে খামচাইয়া কামড়াইয়া জর্জরিত করিয়াছে, কিন্তু সরকারের পেয়ারের উড়িয়া—পুলিস তখন কি করিতেছিল? তারা একগাল পান মুখে পুরিয়া দন্ত বিকাশ করিয়া হাসিতেছিল এবং নারীগুন্ডাগণকে, অধিকতর ক্ষিপ্ত করিবার জন্য হাততালি দিয়া বলিতেছিল—’হী—হ—হ—হ—হ—হ—।’ খাঁসাহেব গবসন টোডি, সার ট্রিকসি টার্নকোট প্রভৃতি মাননীয় দেশনেতৃগণ দাঙ্গানিবারণের উদ্দেশ্যে গিয়াছিলেন, কিন্তু উড়িয়া সার্জেণ্টরা তাদের অপমান করিয়া, বলিয়াছে—’এ সাহেবঅ, ওপাকে যিব তো ডণ্ডা খিব।’
সরকার নিশ্চয় এই ব্যাপারে মনে মনে খুশী হইয়াছেন, কারণ দেশে আত্মকলহ যত হয় ততই সরকারের বলিবার ছুতা হয় যে আমরা স্বায়ত্তশাসনের অযোগ্য।
‘রাষ্ট্রবিৎ’ হইতে উদ্ধৃত।
ইংরেজগণের মধ্যে যদি কেহ বুদ্ধিমান থাকেন তবে এইবার বুঝিবেন যে তাঁহাদের স্বাধীনতার আশা সুদূরপরাহত। লিবার্টি লীগ, অ্যাংলো—সেল্টিক ইউনিয়ন, হেটোরো—সেক্সুয়াল প্যাক্ট—এ সব শুনিতে বেশ। কিন্তু এই ঠাণ্ডা দেশের রক্ত যখন দ্বেষ—হিংসায় গরম হইয়া উঠে তখন আর তত্ত্বকথায় চলে না। যখন দাঙ্গা বাধে তখন একমাত্র ভরসা ভারত সরকারের দণ্ডনীতি আর দুর্দান্ত উড়িয়া—পুলিস।
কেবলই শুনিতে পাই—স্বায়ত্তশাসনে ব্রিটিশ জাতির জন্মগত অধিকার। কিন্তু হে ব্রিটন, তোমাদের ইতিহাসে কি সাক্ষ্য দেয়? স্বাধীনতা কাকে বলে তোমরা কখনই জানিতে না। প্রথমে রোমানগণের, তারপর অ্যাঙ্গল, স্যাক্সন, ডেন, নরম্যান প্রভৃতি দস্যুজাতির অধীনতায় তোমাদের দিন কাটিয়াছে। যাহারা বিজেতারূপে তোমাদের দেশে আসিয়াছে, পরে তাহারাই আবার অন্য জাতি কর্তৃক বিজিত হইয়াছে। আজ কে বিজেতা কে বিজিত বুঝিবার উপায় নাই—তোমরা কেহই নিজের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিতে পার নাই। তোমাদের জাতির স্থিরতা নাই, দেশ নিজের নয়, ধর্ম পর্যন্ত নিজের নয়। একতা তোমাদের মধ্যে কোনও কালেই নাই। সামাজিক আর্থিক কতরকম দলাদলি তোমাদের আছে তার ইয়ত্তা নাই। ক্ষুদ্র ব্রিটেনের যখন এই অবস্থা, তখন সমস্ত ইউরোপের কথা না তোলাই ভাল! নানা জাতি, নানা ভাষা, নানা ধর্ম ইওরোপকে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন করিয়া রাখিয়াছে। একমাত্র ভারতসরকারের শাসনেই এই মহাদেশ ঠাণ্ডা হইয়াছে। তোমরা আগে একটু সভ্য হও, তার পর স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিও। তোমরা মদে ও জুয়ায় ডুবিয়া আছ, বর্বরের মত তোমরা এখনও নাচিয়া থাক, স্নান করিতে ভয় খাও, আহারের পর কুলকুচা কর না। এখন কিছুকাল শান্ত শিষ্ট হইয়া সর্ব বিষয়ে ভারতের অনুগত হইয়া চল, তারপর যথাসময়ে তোমাদের অধিকার দেওয়া—না—দেওয়া সম্বন্ধে বিবেচনা করা হইবে।
ভোমস্টাট প্রাসাদ। প্রিন্স ভোম, চৈনিক পর্যটক ল্যাং প্যাং
এবং প্রিন্সের খানসামা কোবল্ট
প্রিন্স ভোম। আচ্ছা হের প্যাং, আপনি তো নানা দেশ বেড়িয়েছেন— আমাদের এই রাজ্যটা আপনার কেমন লাগছে?
ল্যাং প্যাং। মন্দ নয়। মাঠ আছে, জল আছে, রুটি আছে, ঘাস আছে, শুওর—ভেড়া আছে। কিন্তু দেশের লোক যেন সব ঝিমিয়ে রয়েছে। কেন বলুন তো?
প্রিন্স। ঐ তো মজা। সমস্ত ইওরোপে যে অসন্তাোষ আর চাঞ্চল্য দেখেছেন, এখানে তার কিছুই পাবেন না। ভারত সরকার বলেন—আমাদের খাস রাজ্যে আমরা ইচ্ছামত প্রজাদের একটু আশকারা দেব, আবার রাশ টেনে ধরব। কিন্তু তুমি নাবালক, ওরকম করতে যেও না, মারা যাবে। তোমার রাজ্যে গোলযোগ দেখলেই তোমায় কান ধরে বার ক’রে দেব। তাই রাজ্যসুদ্ধ মৌতাতের ব্যবস্থা ক’রে দিয়েছি—সব ভোম হয়ে আছে। কোবল্ট, এক গুলি দে বাবা, তিনটে বাজে, হাই উঠছে। আহা, কি জিনিসই আপনাদের পূর্বপুরুষেরা আবিষ্কার করেছিলেন হের প্যাং!
ল্যাং প্যাং। কিন্তু এখন আর আমাদের দেশে জন্মায় না। যা খাচ্ছেন তা ভারতের, আপনাদের জন্যই উৎপন্ন হয়।
(প্রিন্সের মন্ত্রী ব্যারন ফন বিবলারের প্রবেশ)
বিবলার। মহারাজ, ইংল্যাণ্ড থেকে সার ট্রিকসি টার্নকোট দেখা করতে এসেছেন।
প্রিন্স। আঃ জ্বালালে! একটু যে শুয়ে শুয়ে আরাম করব তার জো নেই। নিয়ে এসো ডেকে। বাবা কোবল্ট, আমায় বাঁ পাশে ফিরিয়ে দে তো।
ল্যাং প্যাং। আমি তা হ’লে এখন উঠি—
প্রিন্স। না, না, বসুন। আমি ভারতীয় কায়দায় লোকজনের সঙ্গে মোলাকাত করি, একে একে অডিয়েন্স দেওয়া আমার পোষায় না, একসঙ্গেই পাঁচ—সাত জনের দরবার শুনি। তাতে মেহনত কম হয়, গল্প—গুজবও ভাল জমে।
(টার্নকোটের প্রবেশ)
প্রিন্স। হা—ডু—ডু সার ট্রিকসি?—বসুন ঐ চেয়ারটায়। তারপর খবর কি বলুন।
টার্নকোট। প্রিন্স, আপনাকে হাগ যেতে হবে, প্যান ইওরোপিয়ান লিবার্টি লীগের সভাপতিরূপে।
প্রিন্স। মাইন গট! এ বলে কি? কোবল্ট, আর এক গুলি দে বাবা।
টার্নকোট। আচ্ছা সভাপতি হ’তে আপত্তি থাকে, না হয় অমনিই যবেন। না গেলে আমরা ছাড়ছি না।
প্রিন্স। হাগ যাব? খেপেছেন নাকি?
টার্নকোট। কেন, তাতে বাধা কি? এই তো ভাইকাডণ্ট প্যাফ, কাউণ্টেস গ্রিমালকিন, গ্র্যাণ্ডডিউক প্যাঞ্জানড্রাম—এঁরা সব যাবেন।
প্রিন্স। আরে তাদের সঙ্গে আমার তুলনা! তারা হ’ল নগণ্য ভারতীয় প্রজা, ইচ্ছা করলে জাহান্নামে যেতে পারে। আর আমি হলুম একজন স্বাধীন সামন্ত নরপতি, যাব বললেই কি যাওয়া যায়? যদি মহাক্ষত্রপের হুকুম নিতে যাই তো বলবেন—ব্যাটা এক্ষুনি রাজ্য ছেড়ে বনবাসে যাও।
টার্নকোট। তবে কথা দিন রাজসূয় যজ্ঞেও যাবেন না।
প্রিন্স। গট ইন হিম্মেল! আপনার দেখছি মাথা বিগড়ে গেছে। রাজসূয় যজ্ঞে যাবার জন্যে ছ—মাস ধ’রে আয়োজন করছি, কোটিখানেক টাকা খরচ হবে—আর আপনাদের আবদার শুনে সব এখন ভেস্তে দিই! হাঁ—ভাল কথা—ব্যারন, জগঝম্প সব কটা ঠিক আছে তো? সতরটা গুণে দেখেছ?
বিবলার। আজ্ঞে হাঁ। আমি সব—কটা রদ্দুরে দিয়ে টনটনে ক’রে রেখেছি।
প্রিন্স। ঠিক সতরটা?
বিবলার। ঠিক সতর।
ল্যাং প্যাং। জগঝম্প কি হবে প্রিন্স?
প্রিন্স। বাজবে। যখন আমি যাত্রা করব, সঙ্গে সঙ্গে সতরটা জগঝম্পই বাজবে। প্রিন্স ড্রুংকেনডর্ফের মোটে তেরটা। আমার সতর।
ল্যাং প্যাং। আপনার অভাব কি, আপনি মনে করলে তো সতরর জায়গায় সাত—শ জগঝম্প, জয়ঢাক, চড়বড়ে, কাঁসি, ভেঁপু, রামশিঙে যা খুশী বাজাতে পারেন।
প্রিন্স। হেঁ হেঁ, জগঝম্প হ’লেই হয় না। সরকার যে—কটি বরাদ্দ ক’রে দিয়েছেন ঠিক সেই কটি বাজানো চাই। বেশী যদি বাজাই তবে বিলকুল বাতিল হবে। বাবা কোবল্ট, আমার নাকের ডগায় একটু সুড়সুড়ি দিয়ে দে তো।
টার্নকোট। তা হ’লে আপনি আমার কোনও অনুরোধই রাখলেন না?
প্রিন্স। অত্যন্ত দুঃখিত। কিন্তু আপনাদের উদ্যমে আমার সম্পূর্ণ সহানুভুতি আছে জানবেন। ব্যারন বিবলার, আপনি একটু ও—ঘরে যান তো। হ্যাঁ— দেখুন সার ট্রিকসি, আপনাদের সঙ্গে দেশ উদ্ধার করতে গিয়ে আমার এই পৈতৃক রাজ্য আর পৈতৃক প্রাণটি খোয়াতে পারব না। তবে যদি বেঁচে থাকি, আর আপনাদের কার্যসিদ্ধি হয়, আর ইওরোপের জন্য একজন জবরদস্ত এম্পারার কি কাইজার কি ডিকটেটার দরকার হয়, তখন আমার কাছে আসবেন। ঐ কাজটা আমাদের বংশগত কিনা, বেশ সড়গড় আছে। তার পর সার ট্রিকসি, এগুলি খেয়ে দেখবেন নাকি? মাথা ঠাণ্ডা হবে। অভ্যাস নেই? আচ্ছা, তবে এক গ্লাস শ্ন্যাপ্স খান।
‘দি লণ্ডন ফগ’ হইতে উদ্ধৃত
দুইমাসব্যাপী হরতালের মধ্যে রাজসূয় যজ্ঞ সমাপ্ত হইল। ইওরোপের জনসাধারণ এই অনুষ্ঠান বর্জন করিয়া আত্মসম্মান রক্ষা করিয়াছে—অবশ্য জনকতক ধামা—ধরা ছাড়া। আমরা যজ্ঞক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলাম না, সুতরাং আর কোনও খবর জানি না।
‘রাষ্ট্রবিৎ’ হইতে উদ্ধৃত
রাজসূয় যজ্ঞ নির্বিঘ্নে সমাপ্ত হইল। তথাকথিত দেশনায়কগণকে রম্ভা প্রদর্শন করিয়া ইওরোপের জনসাধারণ এই বিরাট উৎসবে যোগ দিয়া অশেষ আনন্দ লাভ করিয়াছে।
যজ্ঞ উপলক্ষে যাঁহারা সরকারকে নানাপ্রকার সাহায্য করিয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে সার ট্রিকসি টার্নকোর্টের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। শুনিতেছি ব্রিটিশ মেষবংশের উৎকর্ষ সাধনের জন্য সরকার যে কমিশন বসাইয়াছেন, সার ট্রিকসি তার প্রেসিডেণ্টরূপে শীঘ্রই কামরূপ যাত্রা করিবেন।
উৎকণ্ঠা স্তম্ভ
বিলিতী খবরের কাগজে যাকে অ্যাগনি কলম বলা হয় তাতে এক শ্রেণীর ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন বহুকাল থেকে ছাপা হয়ে আসছে। ত্রিশ চল্লিশ বৎসর আগে বাঙলা কাগজে সে রকম বিজ্ঞাপন কদাচিৎ দেখা যেত, কিন্তু আজকাল ক্রমেই বাড়ছে। হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ’ শীর্ষক স্তম্ভে তার অনেক উদাহরণ পাবেন। ইংরেজীতে যা আগনি কলম, বাঙলায় তারই নাম উৎকণ্ঠা স্তম্ভ।
কয়েক মাস আগে দৈনিক যুগানন্দ পত্রের উৎকণ্ঠা স্তম্ভে উপরি উপরি দ; দিন এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গিয়েছিল।
বাবা পানু, যেখানেই থাক এখনই চলে এস, টাকার দরকার হয় তো জানিও। তোমার মা নেই, বড়ো বাপ আর পিসীমাকে এমন কষ্ট দেওয়া কি উচিত? তুমি যাকে চাও তার সঙ্গেই যাতে তোমার। বিয়ে হয় তার ব্যবস্থা আমি করব। কিচ্ছু ভেবো না, শীঘ্র ফিরে। এস। তোমার পিসীমা।
চার দিন পরে উক্ত কাগজে এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গেল–
এই পেনে, পাজী হতভাগা শওর, যদি ফিরে আসিস তবে জতিয়ে লাট করে দেব। আমার দেরাজ থেকে তুই সাত শ টাকা চুরি করে পালিয়েছিস, শুনতে পাই বিপিন নন্দীর ধিঙ্গী মেয়ে লেত্তি তোর সঙ্গে গেছে। তুই ভেবেছিস কি? তোকে ফেরাবার জন্যে সাধাসাধি করব? তেমন বাপই আমি নই। তোকে ত্যাজ্যপত্র করলুম, তোর চাইতে ঢের ভাল ভাল ছেলের আমি জন্ম দেব, তার জন্যে ঘটক লাগিয়েছি।–তোর আগেকার বাপ।
সাত দিন পরে এই বিজ্ঞাপন দেখা গেল
পানু-দা, চিঠিতে লিখে গেছ তিন দিন পরেই ফিরবে, কিন্তু আজও দেখা নেই। গেছ বেশ করেছ, কিন্তু আমার মফ চেন আর রোচ নিয়ে গেছ কেন? তুমি যে চোর তা ভাবতেই পারি নি। এখন তোমাকে চিনেছি, চেহারাটাই চটকদার, তা ছাড়া অন্য গুণ কিছুই নেই। অল্প দিনের মধ্যে বিদায় হয়েছ ভালই, কিন্তু আর ফিরে এসো না। ভেবেছ আমার বুক ভেঙে যাবে, তোমাকে ফেরাবার জন্য সাধাসাধি করব? সে রকম ছিঁচকাঁদুনে মেয়ে আমি নই, নিজের পথ বেছে নিতে পারব।–লেত্তি।
উৎকণ্ঠা স্তম্ভের এই সব বিজ্ঞাপন পড়ে পাঠকবর্গ বিশেষত যাদের ফুরসত আছে, মহা উৎকণ্ঠায় পড়ল। অনেকে আহরি নিদ্রা ত্যাগ করে গবেষণা করতে লাগল, ব্যাপারটা কি। একজন বিচক্ষণ সিনেমার ঘণ বললেন, বুঝেছ না, এ হচ্ছে একটা ফিল্মের বিজ্ঞাপন, প্রথমটা শুধু পবলিকের মনে সুড়সুড়ি দিচ্ছে, তার পর খোলসা করে জানাবে আর বড় বড় পোস্টার সাঁটবে। আর একজন প্রবীণ সিনেমা রসিক বললেন, হুকু চৌধুরী যে নতুন ছবিটা বানাচ্ছে—মুঠো মুঠো প্রেম, নিশ্চয় তারই বিজ্ঞাপন। আর একজন বললেন, তোমরা কিছুই বোেঝ না, এ হচ্ছে চা-এর বিজ্ঞাপন, দু দিন পরেই লিখবে–আমার নাম চা, আমাকে নিয়মিত পান করুন, তা হলেই সংসারে শান্তি বিরাজ করবে। আর একজন বললেন, চা নয়, এ হচ্ছে বনস্পতির বিজ্ঞাপন। বুড়োর দল কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত মানলেন না। তাঁদের মতে এ হচ্ছে মামলী পারিবারিক কেলেঙ্কারির ব্যাপার, সিনেমা দেখে আর উপন্যাস পড়ে সমাজের যে অধঃপতন হয়েছে তারই লক্ষণ।
কয়েক দিন পরেই উৎকণ্ঠা স্তম্ভে এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গেল—
লেত্তি দেবী, আপনার মনের বল দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আপনার ভাল নাম লতিকা কি ললিতা তা জানি না, আমাকেও আপনি চিনবেন না, তব, সাহস করে অনুরোধ করছি, আপনার ব্যর্থ অতীতকে পদাঘাতে দরে নিক্ষেপ করুন, প্রেমের বীর্ষে অশঙ্কিনী হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ান, আমরা দুজনে স্বর্ণময় উজ্জ্বল ভবিষ্যতে অগ্রসর হব। আমি আপনার অযোগ্য সাথী নই, এই গ্যারান্টি দিতে পারি। আরও অনেক কিছু লিখতুম, কিন্তু কাগজওয়ালারা ডাকাত, এক লাইনের রেট পাঁচ সিকে নেয়, সেজন্যে এখানেই থামতে হল। উত্তরের আশায় উৎকণ্ঠিত হয়ে রইলুম, আপনার ঠিকানা পেলে মনের কথা সবিস্তারে লিখব। কৃষ্ণধন কুণ্ডু (বয়স ২৬), এঞ্জিনিয়ার, গণেশ কটন মিল, পারেল, বম্বে।
দু দিন পরে এই বিজ্ঞাপনটি দেখা গেল–
শ্রীমান পানুর পিতা মহাশয়, আপনার বিজ্ঞাপন দৃষ্টে জানিলাম আপনি আবার বিবাহ করিবেন, সে কারণে ঘটক লাগাইয়াছেন। যদি ইতিমধ্যে অন্য কাহারও সঙ্গে পাকা কথা না হইয়া থাকে তবে আমার প্রস্তাবটি বিবেচনা করিবেন। আমি এখানকার ফিমেল জেলের সুপারইনটেনডেন্ট, বয়স চল্লিশের কম, হাজার দশেক টাকা পজি আছে। চাকরি আর ভাল লাগে না, বড়ই অপ্রীতিকর, সেজন্য সংসার ধম করিতে চাই। যদি আমার পাণিগ্রহণে সম্মত থাকেন তবে সত্বর জানাইবেন, কারণ আরও দুই ব্যক্তির সঙ্গে কথাবার্ত চলিতেছে। ডকটর মিস সত্যভামা ব্যানার্জি, পি-এইচ-ডি, ফিমেল জেল, চুন্দ্রিগড়।
এর পর উৎকণ্ঠা স্তম্ভে আর কোনও বিজ্ঞাপন দেখা গেল না, কিন্তু ব্যাপারটি অনেক দূর গড়িয়েছিল। বিশ্বস্ত সূত্রে যা জানা গেছে তাই সংক্ষেপে বলছি।
বিপিন নন্দীর মেয়ে লেত্তি (ভাল নাম লজ্জাবতী) কৃষ্ণধন কুণ্ডুকে বিয়ে করেছে। পানু অর্থাৎ প্রাণতোষের বড়ো বাপ মনোতোষ ভটচাজ ডকটর সত্যভামাকে বিয়ে করেছেন। অগত্যা পানুর পিসীমা কাশী চলে গেছেন।
বোম্বাই থেকে পানু তার বাপকে চিঠি লিখেছে–
পুজনীয় বাবা, তোমার টাকার জন্যে ভেবো না, যা নিয়েছিলাম সুদ সুদ্ধ ফেরত দেব। আমি মোটেই কুপুত্তুর নই, ফেলনা বংশধর নই, তোমার বংশ আমি উজ্জ্বল করেছি। আমার নাম এখন প্রাণতোষ নয়, সুন্দরকুমার। নয়নসমুখ ফিল্ম কম্পানিতে জয়েন করেছি, বেশ ভাল রোজগার। এখানে আমার খুব নাম, সবাই বলে সুন্দরকুমারের মতন খসরত অ্যাক্টর দেখা যায় না। শুনলে অবাক হবে, বিখ্যাত স্টার মিস গুলাবা ভেরেন্দী আমাকে বিবাহ করেছেন। তাঁর কত টাকা আছে জান? পাঁচ লাখ বাহান্ন হাজার, তা ছাড়া তিনটে মোটর কার। আগামী রবিবার বন্ধে মেলে আমি সস্ত্রীক কলকাতায় পৌঁছবে। আমাদের জন্যে দোতলার বড় ঘরটা সাহেবী স্টাইলে সাজিয়ে রেখো, ফুলদানিতে এক গোছা রজনীগন্ধা যেন থাকে। ভয় নেই, বেশী দিন থাকব না, হপ্তা খানেক পরেই বোম্বাই ফিরে আসব।
মনোতোষ ভটচাজের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ডকটর সত্যভামা বললেন, তা ছেলেটা আসছে আসুক না, তুমি গালাগাল মন্দ দিও না বাপ। পনি, আমাদের বাহাদুর ছেলে।
কৃষ্ণধন কুণ্ডু ছুটি নিয়ে তার বউ লেত্তির সঙ্গে কলকাতায় এসেছিল। পানু সস্ত্রীক বাড়ি আসছে শুনে লেত্তি চুপ করে থাকতে পারল না, মনোতোষ ভটচাজের বাড়িতে উপস্থিত হল। পাড়ার আরও অনেকে এল, সিনেমা স্টার গুলাবাকে দেখবার জন্যে। কিন্তু পানকে একলা দেখে সবাই নিরাশ হয়ে গেল।
মনোতোষ বললেন, একা এলি যে? তোর বউ কোন চুলোয় গেল?
মাথা চুলকে পান বলল, সে আসতে পারল না বাবা। হঠাৎ মস্কো থেকে একটা তার এল, তাই এক মাসের জন্যে সোবিএত রাষ্ট্রে কলচরাল টুর করতে গেছে।
লেত্তি বলল, সব মিছে কথা। আমরা সদ্য বোম্বাই থেকে এসেছি, সেখানকার সব খবর জানি। গোবা ভেরেন্দী তোমাকে বিয়ে করবে কোন দুঃখে? দু বছর আগে নবাবজাদা সোভানুল্লার সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। তাঁকে তালাক দিয়ে গলাবা সম্প্রতি লগনচাঁদ বজাজকে বিয়ে করেছে। তুমি তো গ্রান্ট রোডে একটা ইরানী হোটেলে বয়-এর কাজ করতে, চুরি করেছিলে তাই তোমাকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
মনোতোষ গর্জন করে বললেন, দূর হ জোচ্চোর ভ্যাগাবন্ড, নয়তো জুতিয়ে লাট করে দেব।
সত্যভামা বললেন, আহা, ছেলেটাকে এখনি তাড়াচ্ছ কেন, আগে একটু জিরক। বাবা পানু ভেবো না, তোমার একটা হিল্লে আমিই লাগিয়ে দিচ্ছি। আমার ফ্রেণ্ড মিষ্টার হায়দর মুস্তাফা কলকাতায় এসেছেন। দক্ষিণ বর্মীয় মৌলমিন শহরে তাঁর বিরাট পোলট্রি ফার্ম আছে, আমি তাঁকে বললেই তোমাকে তার ম্যানেজার করে দেবেন। তুমি তৈরী হয়ে নাও, পরশু তিনি রওনা হবেন, তাঁর সঙ্গেই তুমি যাবে। টাকার জন্যে ভেবো না, আমি তোমার জাহাজ ভাড়া আর কিছু, হাত খরচ দেব।
অতঃপর সকলের উৎকণ্ঠার অবসান হল। তবে পানুর হিল্লে এখনও পাকাপাকি লাগে নি। সাত দিন পরেই সে মুস্তাফা সাহেবের কিছু টাকা চুরি করে সিংগাপুরে পালিয়ে গেল। সেখানে পিপলস চায়না হোটেলে একটা কাজ যোগাড় করেছে, খদ্দেরদের খাবার পরিবেশন করতে হয়। হোটেলের মালিক মিস ফুক-সান তাকে সুনজরে দেখেন। পানুর আশা আছে, ভাল করে খোশামোদ করতে পারলে মিস ফুক-সান তাকে পোষ্য পতির পদে প্রমোশন দেবেন।
উৎকোচ তত্ত্ব
লোকনাথ পাল জেলা জজ, অতি ধর্মভীরু, খুঁতখুঁতে লোক। তিনি সর্বদা ভয়ে ভয়ে থাকেন পাছে ধূর্ত লোকে তাঁকে দিয়ে কোনও অন্যায় কাজ করিয়ে নেয়। ছ মাস পরেই তাঁকে অবসর নিতে হবে, জজিয়তির শেষ পর্যন্ত যাতে দুর্নীতির লেশমাত্র তাঁকে স্পর্শ না করে সে সম্বন্ধে তিনি খুব সতক। উৎকোচ তত্ত্ব বিষয়ক একটি গ্রন্থ রচনার ইচ্ছা তাঁর আছে, সময় পেলেই তার জন্যে তিনি একটি খাতায় নোট লিখে রাখেন। আজ রবিবার, অবসর আছে। সকালবেলা একতলায় তাঁর অফিসঘরে বসে লোকনাথ নোট লিখছেন।–
কৌটিল্য বলেছেন, মাছ কখন জল খায় আর রাজপুরুষ কখন ঘুষ নেয়, তা জানা যায় না। কিন্তু একটি কথা তিনি বলেন নি–ঘুষগ্রাহী অনেক ক্ষেত্রে নিজেই বুঝতে পারে না যে সে ঘুষ নিচ্ছে। পাপ সব সময় স্বলরপে দৃষ্টিগোচর হয় না, অনেক সময় সক্ষম বা সক্ষমাতিসক্ষেরপে দেখা দেয়, তখন তার স্বরূপ চেনা বড়ই কঠিন। স্পষ্ট ঘুষ, প্রচ্ছন্ন ঘুষ আর নিষ্কাম উপহার—এদের প্রভেদ নির্ণয় সকল ক্ষেত্রে করা যায় না। মনে করুন, রামবাবু একজন উচ্চপদস্থ লোক, তাঁর অফিসে একটি ভাল চাকরি খালি আছে। যোগ্যতম প্রার্থীকেই মনোনীত করা তাঁর কর্তব্য। শ্যামবাবুর জামাই একজন প্রার্থী, যথানিয়মে দরখাস্ত করেছে। শ্যামবাবু রামবাবুকে বললেন, আপনার হাতেই তো সব, দয়া করে আমার জামাইকেই সিলেক্ট করবেন, হাজার টাকা দিচ্ছি, বাহাল হয়ে গেলে আরও হাজার দেব। এ হল অতি স্থূল ঘুষ, নির্লজ্জ পাকা ঘুষখোর কিংবা দুর্বলচিত্ত লোভী ভিন্ন কেউ নিতে রাজী হয় না। অথবা মনে করুন, রামবাবুর সঙ্গে শ্যামবাবুর ঘনিষ্ঠ পরিচয় আছে। এক হাঁড়ি সন্দেশ এনে শ্যামবাবু বললেন, কাশী থেকে আমার মা এনেছেন, খেয়ো। আমার জামাইকে তো তুমি দেখেছ, অতি ভাল ছোকরা। তার দরখাস্তটা একটু বিবেচনা করে দেখো ভাই, তোমাকে আর বেশী কি বলব। এও স্থূল ঘুষ, যদিও পরিমাণে তুচ্ছ। কিন্তু ধরুন, কোনও অনুরোধ না করে শ্যামবাবু এক গোছা গোলাপফুল দিয়ে বললেন, আমাদের মধুপুরের বাগানে হয়েছে। এ হল সক্ষম ঘুষ, এর ফল নিতান্ত অনিশ্চিত, তবে নিরাপদ জেনেই শ্যামবাবু দিতে সাহস করেছেন। আশা করেন এতেই রামবাবুর মন ভিজবে। আবার মনে করুন, রামবাবুর মেয়ের অসুখ, শ্যামবাবুর স্ত্রী এসে দিন রাত সেবা করলেন, অসুখও সারল এক্ষেত্রে তাঁর স্ত্রীর সেবা অনুচ্চারিত অনুরোধ অর্থাৎ অতি সক্ষম ঘুষ হতে পারে, অথবা নিঃস্বার্থ পরোপকারও হতে পারে, স্থির করা সোজা নয়। রামবাবু যদি দৃঢ়চিত্ত সাধুপুরুষ হন তবে শ্যামের জামাইএর প্রতি কিছুমাত্র পক্ষপাত করবেন না, তবে অন্যভাবে অবশ্যই কৃতজ্ঞতা জানাবেন। কিন্তু রামবাবু যদি বন্ধুবৎসল কোমলপ্রকৃতির লোক হন তবে শ্যাম-গৃহিণীর সেবা হয়তো জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তাঁকে প্রভাবিত করবে। এ ছাড়া বাঙ্ময় ঘুষ আছে যার আর্থিক মূল্য নেই, অর্থাৎ খোশামোদ বা প্রশংসা। নিপুণভাবে প্রয়োগ করলে বুদ্ধিমান সাধুলোকও এর দ্বারা প্রভাবিত হয়–
লোকনাথের নোট লেখায় বাধা পড়ল। দরজা ঠেলে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক ঘরে এসে বললেন, কেমন আছ লোকনাথ বাবাজী, অনেক কাল তোমাদের দেখি নি। সেকি, চিনতে পারছ না? আরে আমি হলাম তোমাদের মোহিত পিসেমশাই, বেহালার মোহিত সমাজদার। কই রে, পারলে কোথা আছিস, এদিকে আয় না মা।
হাঁকডাক শুনে লোকনাথ-গৃহিণী পারুলবালা এলেন। আগন্তুক লোকটিকে চিনতে তাঁরও কিছু দেরি হল। তার পর মনে পড়লে প্রণাম করে বললেন, মোহিত পিসেমশাই এসেছেন! উঃ কি ভাগ্যি!
অগত্যা লোকনাথও একটা নমস্কার করলেন।
মোহিত সমজদার হাঁক দিলেন, রামবচন, জিনিসগুলো এখানে নিয়ে আয় বাবা। মোহিতবাবর অনুচর বাইরে অপেক্ষা করছিল, এখন ঘরে এসে মনিবের সামনে চারটে বাণ্ডিল রাখল।
একটা কার্ডবোর্ড বাক্স পারুলবালার হাতে দিয়ে মোহিতবাবু বললেন, আসল কাশ্মীরী শাল, তোর জন্যে এনেছি, দেখ তোর পছন্দ হয় কিনা।
শাল দেখে পারুলবালা আহ্লাদে গদগদ হয়ে বললেন, চমৎকার, অতি সুন্দর।
মোহিতবাবু বললেন, লোকনাথ বাবাজী, তোমার তো কোনও শখই নেই, শুধু বই আর বই। তাই একটা ওআলনট কাঠের কিতাব দান মানে বুকে ব্ল্যাক এনেছি। আর এই বাক্সটায় কয়েক গজ কাশ্মীরী তাফতা আছে, একটা শাড়ি আর গোটা দুই ব্লাউজ হতে পারবে। আর এই চুবড়িটায় কিছু মেওয়া আছে, পেস্তা বাদাম আখরোট কিশমিশ মনাক্কা এই সব।
কুণ্ঠিত হয়ে লোকনাথ বললেন, আহা কেন এত সব এনেছেন, এ যে বিস্তর টাকার জিনিস। না না, এসব দেবেন না।
মোহিতবাবু বললেন, আরে খরচ করলেই তো টাকা সার্থক হয়। তোমরা আমার স্নেহপাত্র, তোমাদের দিয়ে যদি আমার তৃপ্তি হয় তবে দেব না কেন, তোমরাই বা নেবে না কেন?
পারুলবালা বললেন, নেব বই কি পিসেমশাই, আপনার স্নেহের দান মাথায় করে নেব। তার পর, এখন কোথা থেকে আসা হল? দিল্লি থেকে? পিসিমাকে আনলেন না কেন? তিনি আর ছেলেমেয়েরা সব ভাল আছেন তো?
–সব ভাল। তাদের একদিন নিশচয় আনব। অনেক কাল পরে কলকাতায় এলুম, বেহালার বাড়িখানা যাচ্ছেতাই নোঙরা করে রেখেছে। একটু গোছানো হয়ে যাক তার পর তোর পিসীকে নিয়ে একদিন আসব। মানানানান, চা-টা কিছু নয়, আমার এখন মরবার ফুরসত নেই, নানা জায়গায় ঘুরতে হবে। আজ চললুম। ঝড়ের মতন এলম আর গেলম, তাই না? কিছ, মনে করো না। তোমরা, সুবিধে মতন আবার একদিন আসব।
পারুলবালাকে প্রশ্ন করে লোকনাথ জানলেন, মোহিতবাবু তাঁর আসল পিসে নয়, পিসের ভাই। ছেলেবেলায় তাঁর বাপের বাড়িতে আসল পিসের সঙ্গে তাঁর এই ভাইও মাঝে মাঝে আসতেন, সেই সূত্রে পরিচয়। তার পর কালে ভদ্রে তাঁর দেখা পাওয়া যেত। মোহিতবাবু নানা রকম কারবার ফেদেছিলেন। কোনওটারই এখন অস্তিত্ব নেই, কিন্তু সেজন্যে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মনে হয় না। তাঁর অবস্থা ভালই, বড় বড় লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে। এখন তিনি কি করেন জানা নেই।
লোকনাথ তাঁর অফিসঘরে বসে ভাবতে লাগলেন। মামার শালা পিসের ভাই, তার সঙ্গে সম্পর্ক নাই। মোহিতবাবুর স্নেহ হঠাৎ উথলে উঠল কেন? বহুকাল আগে লোকনাথ তাঁর শ্বশুরবাড়িতে এই কৃত্রিম পিসেমশাইটিকে দেখে থাকবেন, কিন্তু এখন মনে পড়ে না। আপাতত মোহিতবার কোনও দোষও ধরা যায় না, তিনি বহুমূল্য উপহার দিয়েছেন কিন্তু কিছুই চান নি। হয়তো দিন দুই পরেই একটা অন্যায় অনুরোধ করে বসবেন।
লোকনাথ তাঁর পত্নীকে বললেন, দেখ, তোমার পিসেমশাইএর জিনিসগুলো এখন তুলে রাখ, হয়তো ফেরত দিতে হবে। ওই সব দামী দামী উপহারের জন্যে অস্বস্তি বোধ করছি, তাঁর মতলব বুঝতে পারছি না।
পারুলবালা বললেন, মতলব আবার কি, আমাদের ভালবাসেন তাই দিয়েছেন।
-উনি তোমার আপন আত্মীয় নন, ওঁর নিজের ছেলেমেয়েও আছে, তবে হঠাৎ আমাদের ওপর এত স্নেহ হল কেন?
–খুঁত ধরা তোমার স্বভাব। থাকলই বা নিজের ছেলেমেয়ে, পরের ওপর কি টান হতে নেই? পিসেমশাই বড়লোক, উঁচু নন, তিনি দামী জিনিস উপহার দেবেন তাতে ভাববার কি আছে? তোমাকে তো ঘুষ দেন নি।
যাই হক, তুমি এখন ওগুলো ব্যবহার করো না।
পারুলবালা গরম হয়ে বললেন, কেন করব না? এমন জিনিস তুমি কোনও দিন আমাকে দিয়েছ, না তুমি তার কদর জান? পিসেমশাই যদি ভালবেসে দিয়ে থাকেন তবে তুমি বাদ সাধবে কেন? আর, দামী জিনিস তোমাকে তো দেন নি, আমাকে দিয়েছেন। তুমি যে কাঠের র্যাকটা পেয়েছ সেটা না হয় ফেরত দিও।
লোকনাথ চুপ করে গেলেন।
দুদিন পরে মোহিতবাবু আবার এলেন। সঙ্গে তাঁর পত্নী আসেন নি, একজন অচেনা ভদ্রলোক এসেছেন।
মোহিতবাবু বললেন, বাড়ির সব ভাল তো লোকনাথ? ইনি হচ্ছেন শ্রীগিরধারীলাল পাচাড়ী, মস্ত কারবারী লোক, আমার বিশিষ্ট বন্ধ। ইনি একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন।
লোকনাথ ভাবলেন, এইবারে পিসের গোপন কথাটি প্রকাশ পাবে। জিজ্ঞাসা করলেন, কি প্রস্তাব?
–আচ্ছা বাবাজী, তোমার সার্ভিস শেষ হতে আর কত দেরি?
-এখন এক্সটেনশনে আছি, ছ মাস পরেই শেষ হবে।
–তার পর কি করবে স্থির করেছ?
–কিছুই করব না, লেখাপড়া নিয়ে থাকব।
হাত নেড়ে মোহিতবাবু বললেন, নানানানানা, বসে থাকা ঠিক নয়। তোমার শরীর ভালই আছে, মোটেই বুড়ো হও নি, তবে রোজগার করবে না কেন? শাস্ত্রে বলে, অজরামরবং প্রাজ্ঞো বিদ্যামর্থ চিয়েৎ। তুমি হচ্ছ প্রাজ্ঞ লোক, অর্থ উপার্জনের সঙ্গেই বিদ্যাচর্চা করবে। যা বলছি বেশ করে বিবেচনা করে দেখ বাবাজী।
মোহিতবাবু তাঁর মাথাটি এগিয়ে দিয়ে বিশ্বস্তভাবে নিম্নকণ্ঠে বললেন, এই গিরধারীলাল পাচাড়ীজী হচ্ছেন সিকিম স্টেটের মত বড় কন্ট্রাক্টার। পশম কম্বল কাঠ মগনাভি বড়-এলাচ চিরেতা মাখন ঘি এই সব জিনিস ওখান থেকে এদিকে চালান দেন, আবার সতী কাপড় চাল গম তেল চিনি নন কেরোসিন প্রভৃতি এখানে সপ্লাই করেন। সিকিমের আমদানি রপ্তানি এরই হাতে, মহারাজও একে খুব খাতির করেন, নানা বিষয়ে পরামর্শ নেন। মহারাজ একে বলেছেন, বলন নং গিরধারীবাবু, নিজেই বলুন না।
গিরধারী বললেন, শুনেন হুজুর। মহারাজ তাঁর বড় আদালতের জন্যে একজন চীফ জজ চান। ওখানকার লোকদের ওপর তাঁর বিশ্বাস নেই, মনে করেন সবাই ঘুষখোর। ভাল লোকের খোঁজ নেবার ভার আমাকেই দিয়েছেন, তাই আমি মোহিতবাবুকে ধরেছিলাম। এর কাছে শুনেছি আপনিই উপযুক্ত লোক, যেমন বিদ্বান বুদ্ধিমান তেমনি ইমানদার সাধপুরুষ।
লোকনাথ বললেন, জজের দরকার থাকে তো সিকিম সরকার ভারত সরকারকে লিখলেন না কেন?
মোহিতবাবু বললেন, লিখবেন লিখবেন। মহারাজ নিজে লোক স্থির করবেন তার পর ইণ্ডিয়া গভরমেন্টকে লিখবেন, অমককে আমার পছন্দ, তাঁকেই পাঠানো হক। কোনও বাজে লোক দিল্লি থেকে আসে তা তিনি চান না। খুব ভাল পোস্ট, দশ বছরের জন্যে পাকা। এখানকার হাইকোর্ট জজের চাইতে বেশী মাইনে, চমৎকার ফ্রী কোআর্টস, ফ্রী মোটরকার, আরও নানা সুবিধে। তুমি যদি রাজী হও তবে গিরধারীজী নিজে গিয়ে মহারাজকে বলবেন।
লোকনাথ বললেন, আমি না ভেবে বলতে পারি না।
–ঠিক কথা, ভাববে বইকি। বেশ করে বিবেচনা করে দেখ, পারলের সঙ্গেও পরামর্শ কর, অতি বুদ্ধিমতী মেয়ে। কিন্তু বেশী দেরি করো না, মহারাজ তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা সেটল করতে চান, ইনি আবার চায়না জাপান বেড়াতে যাবেন কিনা। দিন কতক পরে আবার দেখা করব।
লোকনাথের অস্বস্তি বেড়ে উঠল, তিনি আবার ভাবতে লাগলেন। এই পিসেমশাইটি অদ্ভুত লোক, কেবল অনগ্রহই করছেন, এখন পর্যন্ত প্রতিদান কিছুই চাইলেন না। দেখা যাক, আবার যেদিন আসবেন সেদিন তাঁর ঝুলি থেকে বেরাল বার হয় কিনা।
দু সপ্তাহ পরে মোহিতবাবু একাই এলেন। এসেই প্লান মুখে বললেন, গিরধারীলালজী আসতে পারলেন না, তাঁর মনটা বড়ই খারাপ হয়ে আছে।
–কি হয়েছে?
আর বল কেন, ভদ্রলোক মহা ফেসাদে পড়েছেন। তাঁর মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হয়ে আছে, রামশরণ পোন্দারের ছেলে শিবশরণের সঙ্গে। কিন্তু শিবশরণের মাথার ওপর খাঁড়া ঝুলছে, এখন বেলে খালাস আছে। ছোকর। এদিকে ভালই, তবে বড়লোকের ছেলে, কুসঙ্গে পড়ে একটু চরিত্রদোষ ঘটেছিল। ব্যাপারটা কাগজে পড়ে থাকবে, প্রায় আট মাস আগেকার ঘটনা। তবলাওয়ালা লেনে তিতলীবাঈ নাচওআলী থাকত, তার কাছে শিবশরণ যেত, তার দু চারজন বন্ধও যেত। দুপুর রাতে তিতলী যখন বেহশ হয়ে ঘুমচ্ছিল তখন কোনও লোক তার পিঠে ছোরা মেরে পালিয়ে যায়। তিতলী বেচে আছে, কিন্তু খুবই জখম হয়েছে। পুলিস শিবশরণকেই সন্দেহ করে চালান দেয়। আমাদের সকলেরই আশা ছিল যে শিবশরণ খালাস পাবে, কিন্তু সম্প্রতি ম্যাজিস্ট্রেট তাকে দায়রা সোপর্দ করেছেন। ভাবী জামাইএর এই বিপদে গিরধারীলাল পাচাড়ী অত্যন্ত দমে গেছেন, তাঁর মেয়েও কান্নাকাটি করছে। তবে আমি বেশ ভালই জানি যে ছোকরা একবারে নির্দোষ, তার কোনও বন্ধুই এই কাজ করে সরে পড়েছে।
লোকনাথের মুখ লাল হল। বললেন, দেখুন, এ সম্বন্ধে আমাকে আর কোনও কথা বলবেন না। সেসনসে আমার কোটেই কেসটা আসবে।
প্রকাণ্ড জিব কেটে মোহিতবাবু বললেন, অ্যা, তাই নাকি? নানানানানা, তা হলে তোমাকে আর কিছুই বলা চলবে না। তবে গিরধারীর জন্যে আমারও মনটা বড় খারাপ হয়ে আছে। আচ্ছা, মকদ্দমাটা ভালয় ভালয় চুকে যাক, শিবশরণ খালাস পেলেই গিরধারী বাবু নিশ্চিন্ত হয়ে সিকিম রওনা হবেন। বসসা বাবাজী, চললম।
পাঁচ দিন পরে লোকনাথ তাঁর অফিস ঘরে বসে কাগজ পড়ছেন,। হঠাৎ গিরধারীলাল পাচাড়ী স্মিতমুখে এসে বললেন, নমস্কার
লোকনাথ বিরক্ত হয়ে বললেন, দেখুন পাচাড়ীজী, সেদিন মোহিতবাবুর কাছে যা শুনেছি তার পর আপনার সঙ্গে আমি আর কোনও কথা বলতে চাই না। আপনি এখন যান।
গিরধারীলাল হাত নেড়ে বললেন, আরে রাম রাম, সেসব কথা আপনি একদম ভুলে যান। রামশরণ আমার কেউ নয়, তার বেটা শিবশরণও কেউ নয়। সে খালাস পাবে কি না পাবে, তাতে আমার কি।
–কেন, সে তো আপনার ভাবী জামাই।
–থুঃ। আমার বেটী বলেছে, ওই লুচ্চা খুনী আসামীকে সে কিছুতেই বিয়া করবে না। এখন হুজুর যদি তাকে ফাঁসিতে লটকে দেন তাতে আমার কোনও ওজর নেই।
লোকনাথ বললেন, ওই কেস আমার কোর্টে আসবে না, অন্য জজের এজলাসে যাবে। আপনাদের প্রস্তাবের পর আমি আর এই মামলার বিচার করতে পারি না।
–বড় আফসোসের কথা। বদমাশটাকে হুজুর যদি কড়া সাজা দিতেন তো বড় ভাল হত। আচ্ছা, ভগবান সব কুছ মঙ্গলের জন্যেই করেন। তবে আমার বড়ই নকসান হল, শিউশরণকে সোনার ঘড়ি, হীরা বসানো কোটের বোতম, আঙটি এই সব দিয়েছিলাম, তা আর ফেরত দেবে না বলেছে। হুজুর যদি ওকে দশ বছর কয়েদ দিতেন তো ঠিক সাজা হত। ওই মোহিতবাবুর মারফত আরও কিছ, খরচ হয়ে গেল।
–আমাকে যে সব উপহার দিয়েছিলেন তারই জনন তো?
–হেঁ হেঁ, যেতে দিন, যেতে দিন।
–বলুন না, আপনার কত খরচ পড়েছিল।
গিরধারীলাল তাঁর নোটবুক দেখে বললেন, দুটো শাল এগার শ টাকা, তাফতা দেড় শ টাকা, কিতাবদান পঁয়তাল্লিশ টাকা, মেওয়া ছত্রিশ টাকা, ট্যাক্সি ওগয়রহ ষোল টাকা, মোট তেরো শ সাতচল্লিশ টাকা।
আশ্চর্য হয়ে লোকনাথ বললেন, শাল তো একখানা ছিল।
-বলেন কি! একটা আপনার আর একটা শ্ৰীমতীজীর জন্যে কিনবার কথা। ওই শালা মোহিতবাবু একটা শালের দাম চুরি করেছে। দেখে নেবেন, আমি ওর গলায় পা দিয়ে সাড়ে পাঁচ শ টাকা আদায় করে নেব। আমার সঙ্গে বেইমানি চলবে না, জরর আদায় করব।
—তা করবেন। বাকী সাত শ সাতানব্বই টাকার একটা চেক আমি আপনাকে দিচ্ছি, আমার জন্যে আপনার লোকসান হবে না। একটা রসিদ লিখে দিন।
গিরধারীলাল যুক্ত কর কপালে ঠেকিয়ে বললেন, ও হোহোহো, হুজুর একদম সচ্চা সাধু মহাত্মা আছেন, খুদ ভগবান আছেন, আপনার দয়া ভুলব না।
–সিকিমের চাকরিটাও চাই না।
গিরধারীলাল পাচাড়ী সলজ্জ প্রসন্ন মুখে দন্তবিকাশ করে বললেন, হেহেহে।
চেক নিয়ে পাচাড়ীজী প্রস্থান করলেন। লোকনাথের গ্লানি দূর হল, তিনি সোৎসাহে উৎকোচ তত্ত্ব রচনায় মনোনিবেশ করলেন।
একগুঁয়ে বার্থা
মোগলসরাই—এর দু স্টেশন আগে সাকলদিহা। সকাল আটটায় পঞ্জাব মেল সেখানে এসে থামল। একটা সেকেণ্ডক্লাস কামরায় দশ জন বাঙালী আর অবাঙালী যাত্রী আছেন, গাড়ি চলতে দেরি হচ্ছে দেখে তাঁরা অধীর হয়ে উঠলেন। প্ল্যাটফর্মে কলরব হতে লাগল।
ক্যা হুআ গার্ডসাহেব? গার্ড জানালেন, এঞ্জিন বিগড়ে গেছে, ট্রেন এখন সাইডিং—এ ফেলে রাখা হবে, মোগলসরাই থেকে অন্য এঞ্জিন এলে গাড়ি চলবে। অন্তত দেড় ঘণ্টা দেরি হবে।
অতুল রক্ষিত বিরক্ত হয়ে বললেন, বিগড়ে যাবার আর সময় পেলেন না ইঞ্জিন, সেরেফ বজ্জাতি। ই.আই.আর নাম বদলে গিয়েই এইসব যাচ্ছেতাই কাণ্ড শুরু হয়েছে। কাশী পৌঁছুতে দুপুর পেরিয়ে যাবে দেখছি। ওহে নরেশ, তোমাদের প্লে যদি ভাল না ওতরায় তো আমি দায়ী হব না তা বলে দিচ্ছি। আনাড়ী অ্যাক্টরদের তামিল দিতে অন্ততঃ দশ ঘণ্টা লাগবে। সিরাজুদ্দৌলা নাটকটি সোজা নয়।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, আপনি ভাববেন না রক্ষিত মশায়। ওরা অনেক দিন ধরে রিহার্সাল দিয়ে তৈরী হয়ে আছে, আপনি শুধু একটু পালিশ চড়িয়ে দেবেন। তিন—চার ঘণ্টার বেশী লাগবে না।
অতুল রক্ষিত বললেন, তাতে কিছুই হবে না, তোমাদের খোট্টাই উচ্চারণ দুরস্ত করতেই দিন কেটে যাবে। দেখ নরেশ, আমার মনে হচ্ছে আমরা অশ্লেষা কি মঘায় যাত্রা করেছি, সকলেই আমাদের পিছনে লেগেছে। হাওড়া আসতে ট্যাকসির টায়ার ফাটল, সিগারেটের দুটো টিন বাড়িতেই পড়ে রইল, ট্রেনে উঠতে হোঁচট খেলুম, এই দেখ গোড়ালি জখম হয়েছে। এখন আবার ইঞ্জিন নড়বেন না বলে গোঁ ধরেছেন।
অধ্যাপক ধীরেন দত্তর শ্বশুরবাড়ি কাশীতে, পূজোর বন্ধে সেখানে চলেছেন। সহাস্যে বললেন, অচেতন পদার্থের একগুঁয়েমি সম্বন্ধে একটা ইংরাজী প্রবাদ আছে বটে।
দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ কৈলাস গাঙুলী বললেন, জগদীশ বোস তো বলেই দিয়েছেন যে এক টুকরো লোহাও সাড়া দেয়। তার মানে, লোহার চেতনা আছে। রেলের ইঞ্জিন আর মোটর গাড়ি আরও সচেতন।
ধীরেন দত্ত বললেন, তাদের চাইতে একটা পিঁপড়ে ঢের বেশী সচেতন। এঞ্জিন বা মোটর গাড়ির জীবন নেই।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, নেই কেন? ইঞ্জিন কয়লা খায়, জল খায়, ধোঁয়া ছাড়ে, ছাই ফেলে, অর্থাৎ কোষ্ঠ সাফ করে। মোটর গাড়িও পেট্রল খায়, তেল খায়, ধোঁয়া ছাড়ে, চার পায়ে দাপিয়ে বেড়ায়। জীবনের সব লক্ষণই তো বর্তমান, গোঁ ধরবে তা আর বিচিত্র কি!
—হল না গাঙুলী মশায়! মোটর গাড়ি যদি লোহা—পেতল—চুর খেয়ে দেহের ক্ষয় মেরামত করতে পারত, আর মাঝে মাঝে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পিছনের খোপ থেকে একটি বাচ্চা মোটর প্রসব করত তবেই জীবিত বলা চলত। জীবনের লক্ষণ হচ্ছে—আহার গ্রহণ, শরীর পোষণ, মল বর্জন, আর বংশবৃদ্ধি।
—ওহে প্রফেসার, নিজের ফাঁদে নিজে পড়ে গেছ। তুমি যে সব লক্ষণ বললে তাতে আগুনকেও সজীব পদার্থ বলা চলে। আশপাশ থেকে দাহ্য উপাদান আত্মসাৎ করে পুষ্ট হয়, ধোঁয়া আর ছাই ত্যাগ করে সুবিধে পেলেই ব্যাপ্ত হয়ে বংশবৃদ্ধি করে।
ধীরেন দত্ত হেসে বললেন, হার মানলুম, গাঙুলী মশায়! কিন্তু এঞ্জিনের বা আগুনের গোঁ আছে এ কথা মানি না।
—জোর করে কিছুই বলা যায় না, জগৎটাই যে প্রাণময়।
একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক এক কোণে হেলান দিয়ে চোখ বুজে সব কথা শুনছিলেন। মাথায় টাক, বড় গোঁফ, কপালে একটা কাটা দাগ, চোখে পুরু চশমা। ইনি খাড়া হয়ে বসে বললেন, মশায়রা যদি অনুমতি দেন তো একটা কথা নিবেদন করি। আমি একটা মোটর গাড়ি জানি যার অতি ভয়ানক গোঁ ছিল। আমার নিজেরই গাড়ি, জার্মন বার্থা কার।
অতুল রক্ষিত বললেন, ব্যাপারটা খুলে বলুন সার।
দু হাতের আস্তিন গুটিয়ে ভদ্রলোক বললেন, এই দেখুন কি রকম চোট লেগেছিল। কপালের কাটা দাগতো দেখতেই পাচ্ছেন শুধু জখম হইনি মশায়, বিনা অপরাধে কোর্টে হাজারটি টাকা জরিমানা দিয়েছি। সবই সেই বার্থা গাড়ির একগুঁয়েমির ফল।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, আপনারই তো গাড়ি, তবে আপনার ওপর তার অত আক্রোশ হল কেন? বেদম চাবুক লাগিয়েছিলেন বুঝি?
—তামাশা করবেন না মশায়। আক্রোশ আমার ওপর নয়, মকদুমপুরের কুমার সাহেবের উপর। তিনি খুন হলেন, আমি জখম হলুম, আর অসাবধানে গাড়ি চালিয়ে মানুষ মেরেছি এই মিথ্যে অপবাদে মোটা টাকা দণ্ড দিলুম। আমি হচ্ছি মাখনলাল মল্লিক, আমার কেসটা কাগজে পড়ে থাকবেন।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, মনে পড়ছে না কি হয়েছিল। ঘটনাটা সবিস্তারে বলুন মল্লিক মশাই। ইঞ্জিন এসে পৌঁছুতে তো ঢের দেরি, ততক্ষণ আপনার আশ্চর্য কাহিনীটি শোনা যাক।
মাখন মল্লিক বলতে লাগলেন।—
আমি শেয়ারের দালালি করি, শহরে হরদম ঘুরে বেড়াতে হয়। পনর বছর আগেকার কথা। জগুমল সেথিয়া পুরনো মোটর গাড়ির ব্যবসা করে। একদিন আমাকে বললে, বাবুজী, একটা ভাল গাড়ি নেবেন? জার্মন বার্থা কার, রোলস রয়েস তার কাছে লাগে না, সস্তায় দেব। গাড়িটি দেখে আমার খুব পছন্দ হল। বেশী দিন ব্যবহার হয় নি, কিন্তু দেখেই বোঝা যায় যে, বেশ জখম হয়েছিল, সর্বাঙ্গে চোট লাগার চিহ্ন আছে। তা হলেও গাড়িটি অতি চমৎকার, মেরামতও ভাল করে হয়েছে। জগুমল খুব কম দামেই বেচলে, সাড়ে তিন হাজারে পেয়ে গেলুম।
একদিন স্টক এক্সচেঞ্জে যাচ্ছি, ড্রাইভার নেই, নিজেই চালাচ্ছি। যাব দক্ষিণ দিকে, কিন্তু স্টিয়ারিং এর ওপর হাতটা যেন কেউ জোর করে ঘুরিয়ে দিলে, গাড়ি উত্তর দিকে চলল। সামনে একটা প্রকাণ্ড গাড়ি আস্তে আস্তে চলছিল, আমার বার্থা গাড়ি পিছন থেকে তাকে প্রচণ্ড ধাক্কা দিলে, প্রাণপণে ব্রেক কষেও সামলাতে পারলুম না।
যখন জ্ঞান হল, দেখলুম আমি রক্ত মেখে শুয়ে আছি, মাথা আর হাতে যন্ত্রণা, চারিদিকে পুলিস। আমাকে মেডিক্যাল কলেজে ড্রেস করিয়ে থানায় নিয়ে গেল। শুনলাম ব্যাপারটা এই।—আমার গাড়ি যাকে ধাক্কা মেরেছিল সেটা হচ্ছে মকদুমপুরের কুমার সাহেবের গাড়ি। গাড়িখানা একেবারে চুরমার হয়েছে, একটা গ্যাস পোস্টে ঠুকে গিয়ে কুমার সাহেবের মাথা ফেটে গেছে, বাঁচবার কোনও আশা নেই। আমি বেহুঁশ হয়ে গাড়ি চালিয়ে মানুষ খুন করেছি এই অপরাধে পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করেছে। অনেক কষ্টে বেল দিয়ে খালাস পেলুম।
তার পর তিন মাস ধরে মকদ্দমা চলল। সরকারী উকিল বললেন, আসামী মদ খেয়ে চুর হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিল। আমার ব্যারিস্টার বললে, মাখন মল্লিক অতি সচ্চরিত্র লোক, মোটেই নেশা করে না, হঠাৎ মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়ে অসামাল হয়েছিল।
কৈলাস গাঙুলী প্রশ্ন করলেন, আপনার মৃগীর ব্যারাম আছে নাকি?
—না মশায়, মৃগী কস্মিন কালে হয় নি, মদ গাঁজা গুলিও খাই নি। আমাকে ফাঁসাবার জন্য সরকারী উকিল আর বাঁচাবার জন্যে আমার ব্যারিস্টার দুজনেই ডাহা মিথ্যে কথা বলেছিল। প্রকৃত ব্যাপার— বার্থা গাড়ি নিজেই চড়াও হয়েছিল, আমার তাতে কিছুমাত্র হাত ছিল না। কিন্তু সে কথা কে বিশ্বাস করবে? আমি নিস্তার পেলুম না, হাজার টাকা জরিমানা হল, আমার ড্রাইভিং লাইসেন্সও বাতিল হয়ে গেল।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, কুমার সাহেবের গাড়িটা কোন মেক ছিল?
—খুব দামী ব্রিটিশ গাড়ি, সোআংক—টুটলার।
—তাই বলুন। আপনার জার্মন গাড়ি তো ব্রিটিশ গাড়িকে ঢুঁ মারবেই, শত্রুর তৈরি যে। মজা মন্দ নয়, দুই চ্যাম্পিয়ান গাড়ির লড়াই হল, মাঝে থেকে বেচারা কুমার বাহাদুর মরলেন, আপনি জখম হলেন, আবার জরিমানাও দিলেন।
মাখন মল্লিক বললেন, যা ভাবছেন তা নয় মশায়, এতে ইণ্টারন্যাশনাল ক্ল্যাশের নাম গন্ধ নেই। আসল কথা, বার্থা গাড়ি প্রতিশোধ নিয়েছে, কুমার সাহেবকে ডেলিবারেটলি খুন করেছে।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, বড় অলৌকিক কথা, কলিযুগেও কি এমন হয়? অবশ্য জগতে অসম্ভব কিছু নেই। আপনার এই বিশ্বাসের কারণ কি?
এই সময় কামরায় একটা ধাক্কা লাগল, তারপরেই হেঁচকা টান। অতুল রক্ষিত বললেন, যাক বাঁচা গেল, ইঞ্জিন খুব চটপট এসে গেছে, সাড়ে দশটার মধ্যে কাশী পৌঁছে যাব।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, কাশী বিশ্বনাথ এখন মাথায় থাকুন। মল্লিক মশায়, আপনার গল্পটি শেষ করে ফেলুন, নইলে গাড়ি থেকে নামতে পারব না।
মাখন মল্লিক বললেন, তারপর শুনুন। আমার মাথার আর হাতের ঘা সেরে গেল, মকদ্দমাও চুকে গেল। তখন আমার মনে একটা জেদ চাপল। বার্থা গাড়ির আচরণটি বড়ই অদ্ভুত, তার রহস্য ভেদ না করলে স্বস্তি পাব না। প্রথমেই খোঁজ নিলুম জগুমল সেথিয়ার কাছে। সে বললে, এই গাড়ির মালিক ছিলেন সলিসিটার জলদ রায়, রায় অ্যান্ড দস্তিদার ফার্মের পার্টনার। রাঁচি যেতে চাণ্ডিলের কাছে তাঁর গাড়ি উলটে যায়। তাঁর বন্ধু কুমার বাহাদুর নিজের গাড়িতে আগে আগে যাচ্ছিলেন। তিনিই অতি কষ্টে জলদ রায় আর তাঁর স্ত্রীকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনেন। জলদ রায় সাত দিন পরে মারা গেলেন, তাঁর স্ত্রী ভাঙা বার্থা গাড়ি জগুমলকে বেচলেন। মেরামতের পর সে আবার আমাকে বেচলে।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, মানুষ মারাই দেখছি বার্থা গাড়িটার স্বভাব।
না মশায়, জলদ রায়কে বার্থা মারে নি। জগুমল আর কোনও খবর দিতে পারলেন না, তখন আমি জলদ রায়ের স্ত্রীর কাছে গেলুম। তিনি বাপের বাড়িতে ছিলেন, একেবারে উন্মাদ হয়ে গেছেন, তার সঙ্গে দেখা করা বৃথা। তার পর গেলুম জলদের পার্টনার রমেশ দস্তিদারের কাছে। শেয়ার কেনা বেচা উপলক্ষ্যে তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। প্রথমটা তিনি কিছুই বলতে চাইলেন না। যখন শুনলেন বার্থা গাড়িই কুমার সাহেবকে মেরেছে তখন অবাক হয়ে গেলেন এবং নিজে যা জানতেন তা প্রকাশ করলেন। মারা যাবার আগে জলদ রায় তাঁকে সবই জানিয়েছেন। সংক্ষেপে বলছি। শুনুন।
জলদ রায় বিস্তর পৈতৃক সম্পত্তি পেয়েছিলেন। সলিসিটার ফার্মের কাজ দস্তিদারই দেখতেন, জলদ রায় ফুর্তি করে বেড়াতেন আর নিয়মরক্ষার জন্য মাঝে মাঝে অফিসে যেতেন। তাঁর স্ত্রী হেলেনা রায় ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী আর বিখ্যাত সোসাইটি লেডি।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, ও, তাই বলুন, এর মধ্যে একজন সুন্দরী নারী আছেন, নইলে অনর্থ ঘটবে কেন।
—জলদ রায়ের সঙ্গে মকদুমপুরের কুমার ইন্দ্রপ্রতাপ সিং—এর খুব বন্ধুত্ব ছিল। ইন্দ্রপ্রতাপ বিলিতী সোআংক টুটলার গাড়ি কিনলেন দেখে জলদ রায় বললেন, আমি লেটেস্ট মডেল জার্মান বার্থা কার কিনেছি। তোমার গাড়ি বড়, কিন্তু স্পীডে বার্থার কাছে হেরে যাবে।
কুমার সাহেব বললেন, তবে এস, একদিন রেস লাগানো যাক, পাঁচ হাজার টাকা বাজি। জলদ রায় বললেন, রাজী আছি। আমার বাড়ী থেকে স্টার্ট করা যাবে। বেলা একটার সময় তুমি রওনা হবে, তার ঠিক পনর মিনিট পরে আমি হেলেনাকে নিয়ে বেরুব। চাণ্ডিলের আগেই তোমাকে ধরে ফেলব। কুমার সাহেব বললেন, খুব ভাল কথা। চাণ্ডিল ডাকবাংলায় আমরা রাত কাটাব, পরদিন সকালে একসঙ্গে রাঁচি যাব, সেখানে আমার বাড়িতে পিকনিক করা যাবে।
নির্দিষ্ট দিনে, জলদ রায় তাঁর অফিস থেকে বেলা পৌনে একটায় ফিরে এলেন। স্ত্রীকে দেখতে পেলেন না, দারোয়ান বললেন, বাহাদুর এসেছিলেন, তাঁর গাড়িতে মেমসাহেবকে তুলে নিয়ে এইমাত্র রওনা হয়েছেন। এই চিঠি রেখে গেছেন।
চিঠিটা জলদ রায়ের স্ত্রী লিখেছিলেন। তার মর্ম এই।—কুমারের সঙ্গে চললুম, জীবনটা পরিপূর্ণ করতে চাই। লক্ষ্মীটি, তুমি আর শুধু শুধু পিছনে ধাওয়া করো না। ডিভোর্সের দরখাস্ত কর, ইন্দ্রপ্রতাপ কৃপণ নয়, উপযুক্ত খেসারত দেবে। হেলেনা।
জলদ রায়ের মাথায় খুন চাপল। স্ত্রীর জন্যে একটা চাবুক, কুমারের জন্যে একটা মাউজার পিস্তল, নিজের জন্য এক বোতল ব্রাণ্ডি, আর বার্থার জন্যে তিন বোতল সাজাহানপুর রম নিয়ে তখনই বেরিয়ে পড়লেন। গাড়ি কেনার পরেই তিনি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন যে, বার্থাকে রম খাওয়ালে (অর্থাৎ পেট্রল ট্যাংকে ঢাললে) তার বেশ ফুর্তি হয়, হর্সপাওয়ার বেড়ে যায়।
প্রচণ্ড বেগে গাড়ি চালিয়ে জলদ রায় যখন চাণ্ডিলের কাছে পৌঁছুলেন তখন দেখতে পেলেন প্রায় দেড় মাইল দূরে কুমারের গাড়ি চলেছে। সন্ধ্যে হয়ে এসেছে কিন্তু দূর থেকে সোআংক—টুটলারের রূপলী রং স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
ওদিকে কুমার ইন্দ্রপ্রতাপও দেখলেন পিছনে একটা গাড়ি ছুটে আসছে। তিনটে হেড লাইট দেখেই বুঝলেন যে জলদ রায়ের বার্থা কার। কুমারের সামনেই একটা পাহাড়, রাস্তা তার পাশ দিয়ে বেঁকে গেছে। তিনি জোরে গাড়ি চালিয়ে পাহাড়ের আড়ালে এলেন, এবং গাড়ি থেকে নেমে তাড়াতাড়ি গোটাকতক বড় বড় পাথরের চাঙড় রাস্তায় রাখলেন। তারপর আবার গাড়িতে উঠে চললেন।
সঙ্গে সঙ্গে বার্থা গাড়ি এসে পড়ল। জলদ রায় বিস্তর মদ খেয়েছিলেন, বার্থাকেও খাইয়েছিলেন, তার ফলে দুজনেই একটু টলছিলেন। রাস্তার বাধা জলদ দেখতে পেলেন না, পাথরের ওপর দিয়েই পুরো জোরে চালালেন। ধাক্কা খেয়ে বার্থা গাড়ি কাত হয়ে পড়ে গেল। ইন্দ্রপ্রতাপের ইচ্ছে ছিল তাড়াতাড়ি অকুস্থল থেকে দূরে সরে পড়বেন। কিন্তু তাঁর সঙ্গিনী হেলেনা চিৎকার করতে লাগলেন, দৈবক্রমে একটা মোটর গাড়িও বিপরীত দিক থেকে এসে পড়ল। তাতে ছিলেন ফরেস্ট অফিসার বনবিহারী দুবে আর তাঁর চাপরাসী।
অগত্যা ইন্দ্রপ্রতাপকে থামতে হল; তিনি দুবের সাহায্যে জলদ রায়কে তুলে নিয়ে চাণ্ডিল হাসপাতালে এলেন। ডাক্তার বললেন, সাংঘাতিক জখম, আমি মরফীন ইঞ্জেকশন দিচ্ছি, এখনই কলকাতায় নিয়ে যান। দুবেজী বললেন, কুমার সাহেব, আপনি আর দেরি করবেন না, এঁদের নিয়ে এখনই বেরিয়ে পড়ুন। আপনার বন্ধুর গাড়িটা আমি পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। চেক বই সঙ্গে আছে তো? একখানা সাড়ে সাত হাজার টাকার বেয়ারার চেক লিখে দিন, পুলিসকে ঠাণ্ডা করতে হবে।
কলকাতায় ফেরবার সাত দিন পরেই জলদ রায় মারা পড়লেন, তাঁর স্ত্রী হেলেনা উন্মাদ অবস্থায় বাপের বাড়ি চলে গেলেন। তোবড়ানো বার্থা গাড়িটা জগুমল কিনে নিলে।
এখন ব্যাপারটা আপনাদের পরিষ্কার হল তো? ইন্দ্রপ্রতাপ বার্থাকে জখম করেছে, তার প্রিয় মনিবকে খুন করেছে, বার্থা এরই প্রতিশোধ খুঁজছিল। অবশেষে আমার হাতে এসে মনষ্কামনা পূর্ণ হল, স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে সোআংক—টুটলারকে ধাক্কা দিয়ে চুরমার করে দিলে, ইন্দ্রপ্রতাপকেও মারলে।
নরেন দত্ত বলিলেন, বার্থা খুব পতিব্রতা গাড়ি, তার আগেকার মনিবের হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছে, কিন্তু আপনার ওপর তার টান ছিল না, দেখছি। শত্রু মারতে গিয়ে আপনাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বার্থার গতি কি হল?
—জগুমলকেই বেচে দিয়েছি, চার শ টাকায়।
নরেশ মুখুজ্যে বললেন, খাসা গল্পটি মাখনবাবু, কিন্তু বড্ড তড়বড় করে বলেছেন। যদি বেশ ফেনিয়ে আর রসিয়ে পাঁচ শ পাতার একটি উপন্যাস লিখতে পারেন তবে আপনার রবীন্দ্র পুরস্কার মারে কে। যাই হোক, বেশ আনন্দে সময়টা কাটল।
—আনন্দে কাটল কি রকম? দুজন নামজাদা লোক খুন হল, এক জন মহিলা উন্মাদ হয়ে গেল, দুটো দামী গাড়ি ভেঙে গেল, আমি জখম হলুম আবার জরিমানাও দিলুম, এতে আনন্দের কি পেলেন?
—রাগ করবেন না মাখনবাবু। আপনি জখম হয়েছেন, জরিমানা দিয়েছেন, তার জন্যে আমরা সকলেই খুব দুঃখিত— কি বলেন গাঙুলী মশায়? কুমার সাহেবকে বধ করে আপনি ভালই করেছেন, কিন্তু জলদ রায়কে মরতে দিলেন কেন? সে কলকাতায় ফিরে এল, হেলেনা আহার নিদ্রা ত্যাগ করে সেবা করলে, জলদ সেরে উঠল, তার পর ক্ষমাঘেন্না করে দুজনে মিলে মিশে সুখে ঘরকান্না করতে লাগল—এইরকম হলে আরও ভাল হত না কি?
—আপনি কি বলতে চান আমি একটা গল্প বানিয়ে বলেছি? আপনারা দেখছি অতি নিষ্ঠুর বেদরদী লোক।
মোগলসরাই এসে পড়ল। মাখন মল্লিক তাঁর বিছানার বাণ্ডিলটা ধপ করে প্লাটফর্মে ফেললেন এবং সুটকেসটি হাতে নিয়ে নেমে পড়ে বললেন, অন্য কামরায় যাচ্ছি, নমস্কার।
কৈলাস গাঙুলী বললেন, ভদ্রলোককে তোমরা শুধু শুধু চটিয়ে দিলে। আহা, চোট খেয়ে বেচারার মাথা গুলিয়ে গেছে।
১৩৬০ (১৯৫৩)
কচি-সংসদ
আলিপুরের সংবাদ—সাগর আইল্যাণ্ডে বায়ুমণ্ডলে যে গর্ত হইয়াছিল সেটা সম্প্রতি পাকারকম ভরাট হইয়া গিয়াছে, সুতরাং আর বৃষ্টি হইবে না। চৌরঙ্গিতে তিনটা সবুজ পোকার অগ্রদূত ধরা পড়িয়াছে। ঘোলা আকাশ ছিঁড়িয়া ক্রমশঃ নীল রং বাহির হইতেছে। রৌদ্রে কাঁসার রং ধরিয়াছে, গৃহিণী নির্ভয়ে লেপ—কাঁথা শুকাইতেছেন। শেষরাত্রে একটু ঘনীভূত হইয়া শুইতে হয়। টাকায় এক গণ্ডা রোগা—রোগা ফুলকপির বাচ্ছা বিকাইতেছে। পটোল চড়িতেছে, আলু নামিতেছে। স্থলে জলে মরুৎ—ব্যোমে দেহে মনে শরৎ আত্মপ্রকাশ করিতেছে। সেকালে রাজারা এই সময়ে দিগবিজয়ে যাইতেন।
আদালত বন্ধ, আমার গৃহ মক্কেলহীন। সার্কুলার রোডে ধাপা—মেলের বাঁশি পোঁ করিয়া বাজিল—চমকিত হইয়া দেখিলাম বড় ছেলেটা জিওমেটরি ত্যাগ করিয়া রেলের টাইম—টেবল অধ্যয়ন করিতেছে। ছোট ছেলেটার ঘাড়ে এঞ্জিনের ভূত চাপিয়াছে, সে ক্রমাগত দু—হাতের কনুই ঘুরাইয়া ছুঁচার মতন মুখ করিয়া বলিতেছে—ঝুক ঝুক ঝুক ঝুক। মন চঞ্চল হইয়া উঠিল।
এবার কোথা যাওয়া যায়? দু—একজন মহাপ্রাণ বন্ধু বলিলেন—পূজার ছুটিতে দেশে যাও, পল্লীসংঙ্কার কর। কিন্তু অতীব লজ্জার সহিত স্বীকার করিতেছি যে বহু বহু সৎকার্যের ন্যায় এটিও আমার দ্বারা হইবার নয়। জানামি ধর্মং—অন্ততঃ মোটামুটি জানি, কিন্তু ন চ মে প্রবৃত্তিঃ। ভ্রমণের নেশা আমার মাথা খাইয়াছে।
পদব্রজ, গোযান, মোটর, নৌকা, জাহাজ—এসব মাঝে মাঝে মুখ বদলাইবার জন্য মন্দ নয়। কিন্তু যানের রাজা রেলগাড়ি, রেলগাড়ির রাজা ই. আই. আর। বন্ধু বলেন—ইংরেজের জিনিসে তোমার অত উৎসাহ ভাল দেখায় না। আচ্ছা, রেল না—হয় ইংরেজ করিয়াছে কিন্তু খরচটা কে যোগাইতেছে? আজ না—হয় আমরা ইংরেজকে সহিংস বাহবা দিতেছি, কিন্তু এমন দিন ছিল যখন সেও আমাদের কীর্তি অবাক হইয়া দেখিত। আবার পাশা উলটাইবে, দু—শ বৎসর সবুর কর। তখন তারায় তারায় মেল চালাইব, ইংরেজ ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া দেখিবে, সঙ্গে লইব না,— পয়সা দিলেও না।
বাংলার নদ—নদী, ঝোপ—ঝাড়, পল্লীকুটীরের ঘুঁটের সুমিষ্ট ধোঁয়া, পানাপুকুর হইতে উত্থিত জুঁই ফুলের গন্ধ—এসব অতি স্নিগ্ধ জিনিস। কিন্তু এই দারুণ শরৎকালে মন চায় ধরিত্রীর বুক বিদীর্ণ করিয়া সগর্জনে ছুটিয়া যাইতে। পঞ্জাবমেল সন সন ছুটিতেছে, বড় বড় মাঠ, সারি সারি তালগাছ, ছোট ছোট পাহাড় নিমেষে নিমেষে পট—পরিবর্তন। মাঝে মাঝে বিরাম, পান—বিড়ি—সিগ্রেট, চা—গ্রাম, পুরী—কচৌড়ি, রোটি—কাবাব, dinner sir at shikohabad? তারপর আবার প্রবল বেগ, টেলিগ্রাফের খুঁটি ছুটিয়া পলাইতেছে। দু—পাশে আখের খেত স্রোতের মত বহিয়া যাইতেছে, ছোট ছোট নদী কুণ্ডলী পাকাইয়া অদৃশ্য হইতেছে, দূরে প্রকাণ্ড প্রান্তর অতিদূরের শ্যামায়মান অরণ্যানীকে ধীরে প্রদক্ষিণ করিতেছে। কয়লার ধোঁয়ার গন্ধ, হঠাৎ জানালা দিয়া এক ঝলক উগ্রমধুর ছাতিম ফুলের গন্ধ। তারপর সন্ধ্যা—পশ্চিম আকাশে ওই বড় তারাটা গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিয়া চলিয়াছে। ওদিকের বেঞ্চে স্থূলোদর লালাজী এর মধ্যেই নাক ডাকাইতেছেন। মাথার উপর ফিরিঙ্গীটা বোতল হইতে কি খাইতেছে। এদিকের বেঞ্চে দুই কম্বল পাতা, তার উপর আরও দুই কম্বল, তার মধ্যে আমি, আমার মধ্যে ভর—পেট ভাল ভাল খাদ্যসামগ্রী—তা ছাড়া বেতের বাক্সে আরও অনেক আছে। গাড়ির অঙ্গে অঙ্গে লোহালক্কড়ে চাকার ঠোক্করে জিঞ্জিরডাণ্ডার ঝঞ্ঝনায় মৃদঙ্গ—মন্দিরা বাজিতেছে—আমি চিতপাত হইয়া তাণ্ডব নাচিতেছি। হমীন অস্ত, ওআ হমীন অস্ত!
এই পাশবিক পরিকল্পনা—এই অহেতুকী রেলওয়েপ্রীতি—ইহার পশ্চাতে মনস্তত্ত্বের কোন দুষ্ট সর্প লুক্কায়িত আছে? গিরীন বোসকে জিজ্ঞাসা করিতে সাহস হয় না। চট করিয়া স্থির করিয়া ফেলিলাম—ডালহাউসি যাইব, আমার এক পাঞ্জাবী বন্ধুর নিমন্ত্রণে। একাই যাইব, গৃহিণীকে একটা মোটা রকম ঘুষ এবং অজস্র থিয়েটার দেখার অনুমতি দিয়া ঠাণ্ডা করিয়া রাখিব। কিন্তু man proposes woman disposes।
আমার বড় সুটকেসটা ঝাড়িতেছি, হঠাৎ বিদ্যুল্লতার মত ছুটিয়া আসিয়া গৃহিণী বলিলেন—’হোআট—হোআট—হোআট?’
এইখানে একটা কথা চুপি চুপি বলিয়া রাখি। গৃহিণীর ইংরেজী বিদ্যা ফার্স্ট বুক পর্যন্ত। কিন্তু তিনি আমার ফাজিল শ্যালকবৃন্দের কল্যাণে গুটিকতক মুখরোচক ইংরেজী শব্দ শিখিয়াছেন এবং সুযোগ পাইলেই সেগুলি প্রয়োগ করিয়া থাকেন।
আমি আমতা আমতা করিয়া বলিলাম—’এই মনে করছি, ছুটির ক—দিন একটু পাহাড়ে কাটিয়ে আসি, শরীরটা একটু ইয়ে কিনা।’
গৃহিণী বলিলেন—’হোআট ইয়ে? হুঁ, একাই যাবার মতলব দেখছি—আমি বুঝি একটা মস্ত ভারী বোঝা হয়ে পড়েছি? পাহাড়ে গিয়ে তপস্যা হবে নাকি?’
সভয়ে দেখিলাম শ্রীমুখ ধূমায়মান, বুঝিলাম পর্বতো বহ্ণিমান। ধাঁ করিয়া মতলব বদলাইয়া ফেলিয়া বলিলাম—’রাম বল, একা কখনও তপস্যা হয়? আমি হব না হব না হব না তাপস যদি না মিলে তপস্বিনী।’
মন্ত্রবলে স্মোক নুইসান্স কাটিয়া গেল, গৃহিণী সহাস্যে বলিলেন—’হোআট পাহাড়?’
আমি। ডালহাউসি। অনেক দূর।
গৃহিণী। হ্যাং ডালহাউসি। দার্জিলিং চল। আমার ত্রিশ ছড়া পাথরের মালা না কিনলেই নয়, আর চার ডজন ঝাঁটা। আর অত দাম দিয়ে গলায় দেবার শুঁয়োপোকা কেনা হ’ল—সেই যে বোআ না কি বলে—আর হীরে—বসানো চরকা—ব্রোচ—তা তো এ পর্যন্ত পরতেই পেলুম না। তোমার সেই ডালকুত্তো পাহাড়ে সেসব দেখবে কে? দার্জিলিং—এ বরঞ্চ কত চেনাশোনা লোকের সঙ্গে দেখা হবে। টুনি—দিদি, তার ননদ, এরা সব সেখানে আছে। সরোজিনীরা, সুকু—মাসী, এরাও গেছে। মংকি মিত্তিরের বউ তার তেরোটা এঁড়িগেঁড়ি ছানাপোনা নিয়ে গেছে।
যুক্তি অকাট্য, সুতরাং দার্জিলিং যাওয়াই স্থির হইল।
দার্জিলিং—এ গিয়া দেখিলাম, মেঘে বৃষ্টিতে দশদিক আচ্ছন্ন। ঘরের বাহির হইতে ইচ্ছা হয় না, ঘরের মধ্যে থাকিতে আরও অনিচ্ছা জন্মে। প্রাতঃকালের আহার সমাধা করিয়া পায়ে মোটা বুট এবং আপাদমস্তক ম্যাকিনটশ পরিয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছি।….জনশূন্য ক্যালকাটা রোডে একাকী পদচারণ করিতে করিতে ভাবিতেছিলাম—অবলম্বনহীন মেঘরাজ্যে আর তো ভাল লাগে না…এমন সময় অনতিদূরে—
এই পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথে সহিত আশ্চর্য রকম মিল আছে। কিন্তু আমার অদৃষ্ট অন্যপ্রকার—বদ্রাওনের নবাব গোলাম কাদের খাঁর পুত্রীর সাক্ষাৎ পাইলাম না। দেখা হইল ডুমরাওনের মোক্তার নকুড় চৌধুরীর সঙ্গে, যিনি সম্পর্কনির্বিশেষে আত্মীয়—অনাত্মীয় সকলেরই সরকারী মামা।
নকুড়—মামা পথের পার্শ্বস্থিত খাদের ধারে একটা বেঞ্চে বসিয়া আছেন। তাঁর মাথায় ছাতা, গলায় কম্ফর্টার, গায়ে ওভারকোট, চক্ষুতে ভ্রূকুটি, মুখে বিরক্তি। আমাকে দেখিয়া কহিলেন—’ব্রজেন নাকি?’
বলিলাম—’আজ্ঞে হ্যাঁ। তারপর, আপনি হঠাৎ দার্জিলিং—এ? বাড়ির সব ভাল তো? কেষ্টার খবর কি—বেনারসেই আছে নাকি? কি করছে সে আজকাল?’—কেষ্ট নকুড়—মামার আপন ভাগিনেয়, বেনারসের বিখ্যাত যাদব ডাক্তারের একমাত্র পুত্র, পিতৃমাতৃহীন, বয়স চব্বিশ—পঁচিশ। সে একটু পাগলাটে লোক, নকুড়—মামাকে বড় একটা গ্রাহ্যই করে না, তবে আমাকে কিছু খাতির করে।
নকুড়—মামা কহিলেন—’সব বলছি। তুমি আগে একটা কথার জবাব দাও দিকি। এই দার্জিলিং—এ লোকে আসে কি করতে হ্যাঁ? ঠাণ্ডা চাই? কলকাতায় তো আজকাল টাকায় এক মন বরফ মেলে, তারই গোটাকতক টালির ওপর অয়েলক্লথ পেতে শুলেই চুকে যায়, সস্তায় শীতভোগ হয়। উঁচু চাই—তা না হ’লে শৌখিন বাবুদের বেড়ানো হয় না? কেন রে বাপু, দু—বেলা তালগাছে চড়লেই তো হয়। যত—সব হতভাগা—।’
এই পৃথিবীটা যখন কাঁচা ছিল তখন বিশ্বকর্মা তাহাকে লইয়া একবার আচ্ছা করিয়া ময়দা—ঠাসা করিয়াছিলেন। তাঁর দশ আঙুলের গাঁট্টার ছাপ এখনও রহিয়া গিয়া স্থানে স্থানে পর্বত উপত্যকা নদী জলধি সৃষ্টি করিয়াছে। বিশ্বকর্মার একটি বিরাট চিমটির ফল এই হিমালয় পর্বত। নাই দিলে কুকুর মাথায় ওঠে,—ভগবানের আশকারা পাইয়া মানুষ হিমালয়ের বুকে চড়িয়া দার্জিলিং—এ বাসা বাঁধিয়াছে। নকুড়—মামা ধর্মভীরু লোক, অতটা বাড়াবাড়ি পছন্দ করেন না।
আমি বলিলাম—’কি জানেন নকুড়—মামা, কষ্ট পাবার যে আনন্দ, তাই লোকে আজকাল পয়সা খরচ করে কেনে। অমৃত বোস লিখেছে—
ভাগ্যিস আছিল নদী জগৎ সংসারে
তাই লোকে যেতে পারে পয়সা দিয়ে ওপারে।
দার্জিলিং আছে তাই লোকের পয়সা খরচ ক’রে পাহাড় ডিঙোবার বদখেয়াল হয়েছে। তবে এইটুকু আশার কথা—’এখানে মাঝে মাঝে ধস নাবে।’
মামা ত্রস্ত হইয়া খাদের কিনারা হইতে সরিয়া রাস্তার অপেক্ষাকৃত নিরাপদ প্রান্তে আসিয়া বলিলেন—’উচ্ছন্ন যাবে। এটা কি ভদ্দর লোকের থাকবার দেশ? যখন—তখন বৃষ্টি, বাসা থেকে বেরুলে তো দশ তলার ধাক্কা, দু—পা হাঁটো আর দম নাও। তাও সিঁড়ি নেই, হোঁচট খেলে তো হাড়গোড় চূর্ণ। চললে হাঁপানি, থামলে কাঁপুনি—কেন রে বাপু?’
নকুড়—মামা চারিদিকে একবার ভীষণ দৃষ্টিতে চাহিলেন। সময়টা যদি সত্য ত্রেতা অথবা দ্বাপর যুগ হইত এবং মামা যদি মুনি ঋষি বা ভস্মলোচন হইতেন, তবে এতক্ষণে সমস্ত দার্জিলিং শহর সাহারা মরুভূমি অথবা ছাইগাদা হইয়া যাইত। আমি বলিলাম—’তবে এলেন কেন?’
নকুড়। আরে এসেছি কি সাধে। কেষ্টার স্বভাব জানো তো? লেখাপড়া শিখলি, বে—থা কর, বিষয় আশয় দেখ—রোজগার তো আর করতে হবে না। সে সব নয়। দিনকতক খেয়াল হ’ল, ছবি আঁকলে। তার পর আমসত্ত্বর কল ক’রে কিছু টাকা ওড়ালে। তার পর কলকাতায় গিয়ে কতকগুলো ছোঁড়ার সর্দার হ’য়ে একটা সমিতি করলে। তারপর বম্বে গেল, সেখান থেকে আমাকে এক আর্জেন্ট টেলিগ্রাম। কি হুকুম? না এক্ষুনি দার্জিলিং যাও, মুন—শাইন ভিলায় ওঠ, আমিও যাচ্ছি, বিবাহ করতে চাই। কি করি, বড়লোক ভাগনে, সকল আবদার শুনতে হয়। এসে দেখি—মুন—শাইন ভিলায় নরক গুলজার। বরযাত্রীর দল আগে থেকে এসে ব’সে আছে। সেই কচি—সংসদ,—কেষ্টা যার প্রেসিডেণ্ট।
আমি। পাত্রী ঠিক হয়েছে?
নকুড়। আরে কোথায় পাত্রী! এখানে এসে হয়তো একটা লেপচানী কি ভুটানী বিয়ে করবে।
আমি। কচি—সংসদের সদস্যরা কিছু জানে না?
নকুড়। কিচ্ছু না। আর জানলেই বা কি, তাদের কথাবার্তা আমি মোটেই বুঝতে পারি না, সব যেন হেঁয়ালি। তবে তারা খায়—দায় ভাল, আমার সঙ্গে তাদের ঐটুকুই সম্বন্ধ। কেষ্টবাবাজী আজ বিকেলে পৌঁছবেন। সন্ধ্যেবেলা যদি এস, তবে সবটা টের পাবে, সংসদের সঙেদের সঙ্গেও আলাপ পরিচয় হবে।
কচি—সংসদের কথা পূর্বে শুনিয়াছি। এদের সেক্রেটারি পেলব রায় আমাদের পাড়ার ছেলে, তার পিতৃদত্ত নাম পেলারাম। বি.এ. পাস করিয়া ছোকরার কচি এবং মোলায়েম হইবার বাসনা হইল। সে গোঁফ কামাইল, চুল বাড়াইল এবং লেডি—টাইপিস্টের খোঁপার মতন মাথার দু—পাশ ফাঁপাইয়া দিল। তারপর মুগার পাঞ্জাবি গরদের চাদর, সবুজ নাগরা ও লাল ফাউণ্টেন পেন পরিয়া মধুপুরে গিয়া আশু মুখুজ্যেকে ধরিল—ইউনিভার্সিটির খাতাপত্রে পেলারাম রায় কাটিয়া যেন পেলব রায় করা হয়। স্যার আশুতোষ এক ভলুম এনসাইক্লোপিডিয়া লইয়া তাড়া করিলেন। পেলারাম পলাইয়া আসিল এবং বি.এ ডিপ্লোমা বাক্সে বন্ধ করিয়া নিরুপাধিক পেলব রায় হইল। তারই উদ্যমে কচি—সংসদ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে তবে যতদূর জানি কেষ্টই সমস্ত খরচপত্র যোগায়। এই কচি—সংসদের উদ্দেশ্য কি আমার ঠিক জানা নাই। শুনিয়াছি এরা যাকে তাকে মেম্বার করে না এবং নূতন মেম্বারের দীক্ষাপ্রণালীও এক ভয়াবহ ব্যাপার। গভীর পূর্ণিমা নিশীথে সমবেত সদস্যমণ্ডলীর করস্পর্শ করিয়া দীক্ষার্থী ষোলটি ভীষণ শপথ গ্রহণ করে। সঙ্গে সঙ্গে ষোল টিন সিগারেট পোড়ে এবং এনতার চা খরচ হয়।
অনেক বেলা হইয়াছে, মেঘও কাটিয়া গিয়াছে। সন্ধ্যার সময় নিশ্চয়ই মুন—শাইন ভিলায় যাইব বলিয়া নকুড়—মামার নিকট বিদায় গ্রহণ করিলাম।
গৃহিণী তিন ছড়া পাঁচ সিকা দামের চুনি—পান্নার মালা উপর্যুপরি গলায় পরিয়া বলিলেন— ‘দেখ তো, কেমন মানাচ্ছে।’
আমি বলিলাম—’চমৎকার। যেন পরস্ত্রী।’
গৃহিণী। তুমি একটি ক্যাড। পরস্ত্রী না হ’লে বুঝি মনে ধরে না?’
আমি। আরে চট কেন। পরকীয়াতত্ত্ব অতি উঁচুদরের জিনিস। তার মহিমা বোঝা যার তার কম্ম নয়, তবে যে নিজের স্ত্রীকে পরস্ত্রীর মতন নিত্য—নূতন ধরি ধরি ধরিতে না পারি— দেখে, সে অনেকটা এগিয়েছে। রাধাকৃষ্ণই হচ্ছেন মডেল প্রেমিক। ফ্রয়েড বলেছেন—
গৃহিণী। ড্যাম ফ্রয়েড—অ্যাণ্ড রাধাকৃষ্ণ মাথায় থাকুন। আমাদের মতন মুখখু লোকের সীতারামই ভাল।
আমি। কিন্তু রাম যে সীতাকে দু—দুবার পোড়াতে চাইলেন তার কি?
গৃহিণী। সে ত লোকনিন্দেয় বাধ্য হ’য়ে। ত্রেতাযুগের লোকগুলো ছিল কুচুণ্ডে রাসকেল।
আমি। তা—তিনি ভরতকে রাজ্য দিয়ে সীতাকে নিয়ে আবার বনে গেলেই পারতেন।
গৃহিণী। সেই আহ্লাদে প্রজারা যে রামকে ছাড়তে চাইলে না।
আমি। বাঃ, তুমি আমার চাইতে ঢের বড় উকিল। আমি তোমাকে রামচন্দ্রের তরফ থেকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। কিন্তু ভাগ্যিস তিনি সীতার মতন বউ পেয়েছিলেন তাই নিস্তার পেয়ে গেলেন। তোমার পাল্লায় পড়লে অযোধ্যা শহরটাকেই ফাঁসি দিতে হ’ত।
গৃহিণী। কেন, আমি কি শূর্পনখা না তাড়কা রাক্ষসী?
আমি। সীতা ছিলেন গোবেচারী লক্ষ্মীমেয়ে। তোমার মতন আবদেরে নয়।
গৃহিণী। সোনার হরিণ কে চেয়েছিল মশায়? কত ওজন তার খোঁজ রাখ? যদি ফাঁপা হয়, তবু পাঁচ হাজার ভরি।
আমি। আচ্ছা, আচ্ছা, তোমারই জিত। আর শুনেছ, কেষ্ট যে এখানে বিয়ে করতে আসছে। সেই কাশীর কেষ্ট।
গৃহিণী। হুরে! ভাগ্যিস খানকতক গহনা এনেছি। কিন্তু আশ্বিন মাসে লগ্ন কই?
আমি। প্রেমের তেজ থাকলে লগ্নে কি আসে যায়। তবে পাত্রীটি কে তা কেউ জানে না। হয়তো এখনও পাত্রীই স্থির হয় নি, যদিও বরযাত্রীর দল হাজির।
গৃহিণী। গ্যাড! শুনেছিলুম কেষ্টর বাপের ইচ্ছে ছিল টুনি—দিদির ননদের সঙ্গে কেষ্টর বিয়ে দিতে। সে মেয়ে তো এখানেই আছে বড়—সড়ও হয়েছে। তারও বাপ—মা নেই, তার দাদা—টুনি—দির বর ভুবনবাবু—তিনিই এখন অভিভাবক।
আমি। তা বলতে পারি না। কেষ্টর মতিগতি বোঝা শিবের অসাধ্য। যাই হ’ক, সন্ধ্যার সময় একবার কেষ্টর বাসায় যাব।
মনোহারিণী সন্ধ্যা। জনবিরল পথ দিয়া চলিয়াছি। শহরের সর্বত্র—উপরে, আরও উপরে, নীচে, আরও নীচে— স্তরে স্তরে অগণিত দীপমালা ফুটিয়া উঠিয়াছে। রাস্তার দু—ধারে ঝোপে জঙ্গলে পাহাড়ী ঝিঁঝির অলৌকিক মূর্ছনা ষড়জ হইতে নিষাদে লাফাইয়া উঠিতেছে। পরিষ্কার আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে, কুয়াশার চিহ্নমাত্র নাই। ঐ মুন—সাইন ভিলা।
কিসের শব্দ? দার্জিলিং শহরে পূর্বে শিয়াল ছিল না। বর্ধমানের মহারাজা যে কটা আনিয়া ছাড়িয়া দিয়াছিলেন তারা কি মুন—সাইন ভিলায় উপনিবেশ স্থাপন করিয়াছে? না, শিয়াল নয়, কচি—সংসদ গান গাহিতেছে। গানের কথা ঠিক বোঝা যাইতেছে না, তবে আন্দাজে উপলব্ধি করলাম, এক অচেনা অজানা অচিন্ত্যনীয় অরক্ষণীয়া বিশ্ব—তরুণীর উদ্দেশ্যে কচি—গণ হৃদয়ের ব্যথা নিবেদন করিতেছে। হা নকুড়—মামা, তোমার কপালে এই ছিল?
আমাকে দেখিয়া সংসদ গান বন্ধ করিল। মামা ও কেষ্টকে দেখিলাম না। কেষ্ট আজ বিকালে পৌঁছিয়াছে, কিন্তু কোথায় উঠিয়াছে কেহ জানে না। শীঘ্রই সে মুন—শাইন ভিলায় আসিবে এরূপ সংবাদ পাওয়া গিয়াছে।
পেলব রায় আমাকে খাতির করিয়া বসাইল এবং সংসদের অন্যান্য সভ্যগণের সহিত পরিচয় করাইয়া দিল, যথা—
শিহরণ সেন
বিগলিত ব্যানার্জি
অকিঞ্চিৎ কর
হুতাশ হালদার
দোদুল দে
লালিমা পাল (পুং)
এদের নাম কি অন্নপ্রাশনলব্ধ না সজ্ঞানে স্বনির্বাচিত? ভাবিলাম জিজ্ঞাসা করি; কিন্তু চক্ষুলজ্জা বাধা দিল। লালিমা পাল মেয়ে নয়। নাম শুনিয়া অনেকে ভুল করে, সেজন্য সে আজকাল নামের পর ‘পুং’ লিখিয়া থাকে।
হঠাৎ দরজা ঠেলিয়া নকুড়—মামা ঘরে প্রবেশ করিলেন। তাঁর পিছনে ও কে? এই কি কেষ্ট? আমি একাই চমকিত হই নাই, সমগ্র কচি—সংসদ অবাক হইয়া দেখিতে লাগিল। হুতাশ বেচারা নিতান্ত ছেলেমানুষ, সবে সিগারেট খাইতে শিখিয়াছে,—সে আঁতকাইয়া উঠিল।
কেষ্টর আপাদমস্তক বাঙালীর আধুনিক বেশবিন্যাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করিতেছে। তার মাথার চুল কদম্বকেশরের মতন ছাঁটা, গোঁফ নাই কিন্তু ঠোঁটের নীচে ছোট একগোছা দাড়ি আছে, গায়ে সবুজ রঙের খাটো জামা—তাতে বড় বড় সাদা ছিট, কোমরে বেল্ট, মালকোঁচা—মারা বেগনী রঙের ধুতি, পায়ে পট্টি ও বুট, হাতে একটি মোটা লাঠি বা কোঁতকা, পিঠে ক্যাম্বিসের ন্যাপস্যাক স্ট্রাপ দিয়া বাঁধা।
আমিই প্রথমে কথা কহিলাম—’কেষ্ট, একি বিভীষিকা?’
কেষ্ট বলিল—’প্রথমটা তাই মনে হবে, কিন্তু যখন বুঝিয়ে দেব তখন বলবেন হ্যাঁ কেষ্ট ঠিক করেছে। ব্রজেন—দা, জীবনটা ছেলেখেলা নয়, আর্ট অ্যাণ্ড এফিশেন্সি।’
আমি। কিন্তু চেহারাটা অমন ধরলে কেন?
কেষ্ট। শুনুন! মানুষের চুলটা অনাবশ্যক, শীততাপ নিবারণের জন্য যেটুকু দরকার ঠিক ততটুকু রেখেছি। এই যে দেখছেন দাড়ি, একে বলে ইম্পিরিয়াল, এর উদ্দেশ্য নাকটা ব্যালান্স করা। আপনারা সাদা ধুতির ওপর ঘোর রঙের জামা পরেন—অ—ফুল। তাতে চেহারাটা টপ—হেভি দেখায়। আমার পোশাক দেখুন—প্লাম ভায়োলেট অ্যাণ্ড সেজ গ্রীন, হোয়াইট স্পটস—কলার কনট্রাস্ট অ্যাণ্ড হারমনি। এইবার পাছাপাড় হাফপ্যাণ্ট ফরমাশ দিয়েছি, তাতে ওয়েস্ট—লাইন আরও ইমপ্রুভ করবে। এই যে দেখছেন লাঠি, এতে বাঘ মারা যায়। এই যে দেখছেন পিঠের ওপর বোঁচকা, এতে পাবেন না এমন জিনিস নেই। আমি স্বাবলম্বী, স্বয়ংসিদ্ধ, বেপরোয়া।
এই পর্যন্ত বলিয়া কেষ্ট দুই পকেট হইতে দুই প্রকার সিগারেট বাহির করিল এবং যুগপৎ টানিতে টানিতে বলিল—’পারেন এ রকম? একটা ভার্জিনিয়া একটা টার্কিশ। মুখে গিয়ে ব্লেণ্ড হচ্ছে।’
নকুড়—মামা চক্ষু মুদিয়া অগ্নিগর্ভ শমীবৃক্ষবৎ বসিয়া রহিলেন। তাঁহার অভ্যন্তরে বিস্ময় ও ক্রোধ ধিকিধিকি জ্বলিতেছে।
পেলব রায় বলিল—’কেষ্টবাবু, আপনি না কচি—সংসদের সভাপতি? আপনি শেষটায় এমন হলেন?’
কেষ্ট। কচি ছিলুম বটে, কিন্তু এখন পাকবার সময় হয়েছে।
আমি। নিশ্চয়ই, নইলে দরকচা মেরে যাবে। যাক ওসব কথা,—কেষ্ট, তুমি নাকি বে করবে?’
কেষ্ট। সেই পরামর্শ করতেই তো আসা। আপনিও এসেছেন, খুব ভালই হয়েছে। প্রথমে আমি প্রেম সম্বন্ধে দু—চার কথা বলতে চাই।
আমি। নকুড়—মামা, আপনি ওপরে গিয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ুন—আর ঠাণ্ডা লাগাবেন না। যা স্থির হয় পরে জানাব এখন। তার পর কেষ্ট, প্রেম কি প্রকার?—একটু চা হ’লে যে হ’ত।
পেলব হাঁকিল—’বোদা—বোদা—।’ বোদা বলিল—’জু।’
বোদা কেষ্টর চাকর, নেপালী ক্ষত্রিয়। তাহার মুখ দেখিলেই বোঝা যায় যে সে চন্দ্রবংশাবতংস। পেলব তাহাকে দশ পেয়ালা চা আনিতে বলিল।
কেষ্ট বলিতে লাগিল—’প্রেম সম্বন্ধে লোকের অনেক বড় বড় ধারণা আছে। চণ্ডীদাস বলেছেন—নিমে দুধ দিয়া একত্র করিয়া ঐছন কানুর প্রেম। রাশিয়ান কবি ভডকাউইস্কি বলেন—প্রেম একটা নিকৃষ্ট নেশা। মেটস্নিকফ বলেন—প্রেমে পরমায়ু বৃদ্ধি হয়, কিন্তু ঘোল আরও উপকারী। মাদাম দে সেইয়াঁ বলেন—প্রেমই নারীর একমাত্র অস্ত্র যার দ্বারা পুরুষের যথাসর্বস্ব কেড়ে নেওয়া যায়। ওমর খায়য়াম লিখেছেন—প্রেম চাঁদের শরবত, কিন্তু তাতে একটু শিরাজী মিশুতে হয়। হেনরি—দি—এইটথ বলেছিলেন—প্রেম অবিনশ্বর, একটি প্রেমপাত্রী বধ করলে পর পর আর দশটি এসে জোটে। ফ্রয়েড বলেন—প্রেম হচ্ছে পশু—ধর্মের ওপর সভ্যতার পলেস্তারা। হ্যাভেলক এলিস বলেন—’
আমি। ঢের হয়েছে। তুমি নিজে কি বল তাই শুনতে চাই।
কেষ্ট। আমি বলি—প্রেম একটা ধাপ্পাবাজি, যার দ্বারা স্ত্রী পুরুষ পরস্পরকে ঠকায়।
কচি—সংসদ একটা অস্ফুট আর্তনাদ করিল। হুতাশ বুকে হাত দিয়া ক্ষীণ স্বরে বলিল—’ব্যথা, ব্যথা।’
কেষ্ট বলিল—’হুতো, অমন করছিস কেন রে? বেশী সিগারেট খেয়েছিস বুঝি? আর খাস নি?’
লালিমা পালের গলা হইতে একটা ঘড়ঘড়ে আওয়াজ নির্গত হইল—জাপানী ঘড়ি বাজিবার পূর্বে যে—রকম করে সেই প্রকার। তার গলাটা স্বভাবতঃ একটু শ্লেষ্মাজড়িত। কলিকাতায় থাকিতে সে কোকিলের ডিমের সঙ্গে মকরধ্বজ মাড়িয়া খাইত, কিন্তু এখানে অনুপান অভাবে ঔষধ বন্ধ আছে। কেষ্ট তাহাকে উৎসাহিত করিয়া বলিল—’নেলো, তোর যদি প্রেম সম্বন্ধে কিছু বলবার থাকে তো বল না।’
লালিমা বলিল—’আমার মতে প্রেম হচ্ছে একটা—একটা—একটা—’
আমি সজেস্ট করিলাম—’ভূমিকম্প।’
কেষ্ট। এগস্যাক্টলি। প্রেম একটা ভূমিকম্প, ঝঞ্ঝাবাত, নায়াগ্রা—প্রপাত, আকস্মিক বিপদ—যাতে বুদ্ধিশুদ্ধি লোপ পায়।
লালিমা আর একবার বাজিবার উপক্রম করিল, কিন্তু তার প্রতিবাদ নিষ্ফল জানিয়া অবশেষে নিরস্ত হইল।
আমি বলিলাম—’তবে তুমি বিয়ে করতে চাও কেন? কত টাকা পাবে হে?’
কেষ্ট। এক পয়সাও নেব না। আমি বিবাহ করতে চাই জগতকে একটা আদর্শ দেখাবার জন্য। জগতে দু—রকম বিবাহ চলিত আছে। এক হচ্ছে—আগে বিবাহ, তার পরে প্রেম, যেমন সেকেলে হিঁদুর। আর এক রকম হচ্ছে—আগে প্রেম, তার পর বিবাহ, অর্থাৎ কোর্টশিপের পর বিবাহ। আমি বলি—দু—ইভুল। আগে বিবাহ হ’লে যদি বনিবনা না হয়, তখন কোথা থেকে প্রেম আসবে? আর—আগে প্রেম, পরে বিবাহ, এও সমান খারাপ; কারণ কোর্টশিপের সময় দু—পক্ষই প্রেমের লোভে নিজের দোষ ঢেকে রাখে। তার পর বিবাহ হয়ে গেলে যখন গলদ বেরিয়ে পড়ে তখন টু—লেট।
আমি। ওসব তো পুরনো কথা বলছ। তুমি কি ব্যবস্থা করতে চাও তাই বল!
কেষ্ট। আমার সিস্টেম হচ্ছে—প্রেমকে একদম বাদ দিয়ে কোর্টশিপ চালাতে হবে, কারণ প্রেমের গন্ধ থাকলেই লুকোচুরি আসবে। চাই—দু’জন নির্লিপ্ত সুশিক্ষিত নরনারী, আর একজন বিচক্ষণ ভুক্তভোগী মধ্যস্থ ব্যক্তি—যিনি নানা বিষয়ে উভয় পক্ষের মতামত বেশ করে মিলিয়ে দেখবেন। আমি একটা লিস্ট করেছি। এতে আছে—বেশভূষা, আহার্য, শয্যা, পাঠ্য, কলাচর্চা, বন্ধু—নির্বাচন, আমোদ—প্রমোদ, ইত্যাদি তিরানব্বইটি অত্যন্ত দরকারী বিষয়, যা নিয়ে স্বামী—স্ত্রীর হরদম মতভেদ হয়ে থাকে। প্রথমেই যদি এইসব মোকাবিলা হ’য়ে যায় এবং অধিকাংশ বিষয়ে দু—পক্ষের এক মত হয়, আর বাকী অল্পস্বল্প বিষয়ে একটা রফা করা চলে, তা হ’লে পরে গোলযোগের ভয় থাকবে না। কিন্তু খবরদার, গোড়াতেই প্রেম এসে না জোটে, তা হ’লেই সব ভণ্ডল হবে। শেষে যত খুশি প্রেম হ’ক তাতে আপত্তি নেই। এতদিন চলছিল—কোর্টশিপ, আর আমার সিস্টেম হচ্ছে—হাইকোর্টশিপ।
আমি। কোর্ট—মার্শাল বললে আরও ঠিক হয়। সিস্টেম তো বুঝলুম, কিন্তু এমন পাত্রী কে আছে যে তোমার এই এক্সপেরিমেন্টে রাজী হবে? তবে তুমি যে প্রেমের ভয় করছ সেটা মিথ্যে। তোমার ঐ মূর্তি দেখলে প্রেম বাপ বাপ ক’রে পালাবে।
কেষ্ট। পাত্রী আমি আজ ঠিক ক’রে এসেছি।
আমি। কে সেই হতভাগিনী?
কেষ্ট। ভুবন বোসের ভগ্নী, পদ্মমধু বোস।
আমি। আরে! আমাদের টুনি—দিদির ননদ? তাই বল। গিন্নী তা হ’লে ঠিক আন্দাজ করেছিলেন। কিন্তু শুনলুম তোমাদের বিয়ের কথা নাকি আগেই একবার হয়েছিল। এতে কেস প্রেজুডিসড হবে না?
কেষ্ট। মোটেই না। আমরা দু—পক্ষই নির্বিকার। ব্রজেন—দা, আপনাকেই মধ্যস্থ হ’তে হবে কিন্তু। আপনার লিগাল ম্যাট্রিমনিয়াল দু—রকম অভিজ্ঞতাই আছে, ভাল ক’রে জেরা করতে পারবেন।
আমি। রাজী আছি, কিন্তু মেয়েটা আমার ওপর না চটে।
কেষ্ট। কোন ভয় নেই, পদ্ম অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক।
আমি। লোকটি তো বুদ্ধিমান, কিন্তু মেয়েটি কেমন?
কেষ্ট। মজবুত ব’লেই তো বোধহয়। সাত মাইল হাঁটতে পারে, দু—ঘণ্টা টেনিস খেলতে পারে, মাস্কুলার ইনডেক্স খুব হাই, ফেটিগ—কোয়েফিশেণ্ট বেশ লো। সেলাই জানে, রান্না জানে, লজিক জানে, বাজে তর্ক করে না, ইকনমিক্স জানে, গান গাইবার সময় বেশী চেঁচায় না। তা হ’লে কাল সন্ধ্যেবেলা ভুবনবাবুর বাড়ি ঠিক যাবেন—লাভলক রোড, মডলিন কটেজ।
আমি প্রতিশ্রুতি দিয়া গৃহাভিমুখ হইলাম। মুন—শাইন ভিলার গেট পার হইতেই একটা কোলাহল কানে আসিল। আন্দাজে বুঝিলাম কচি—সংসদের রুদ্ধ বেদনা মুখরিত হইয়া কেষ্টকে গঞ্জনা দিতেছে। আমি আর দাঁড়াইলাম না।
সমস্ত শুনিয়া গৃহিণী মত প্রকাশ করিলেন—’রিপিং! পারসী থিয়েটারের চাইতেও ভাল। আমি কিন্তু তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। যদি পাঁচ টাকা দিয়ে টিকিট কিনতে হয় তাতেও রাজী আছি।’
আমি বলিলাম—’কিন্তু তোমাকে তো শুনতে দেবে না। হাইকোর্টশিপ গোপনে হয়, ওইটুকুই সাধারণ কোর্টশিপের সঙ্গে মেলে। ঘরে থাকব শুধু আমি, কেষ্ট আর পদ্ম।’
গৃহিণী। আড়ি পাতব।
আমি। তার দরকার হবে না। সব কথাই প’রে শুনতে পাবে। আমার যে কান তাহা তোমার হউক।
গৃহিণী। যাই হ’ক আমিও যাব।
আমি। কিন্তু পরের ব্যাপারে তোমার ওরকম কৌতূহল তো ভাল নয়। ফ্রয়েড এর কি ব্যাখা করেন জান?
গৃহিণী। খবরদার, ও মুখপোড়ার নাম ক’রো না বলছি।
অগত্যা দুজনেই টুনি—দিদির বাসায় চলিলাম।
ভুবনবাবু ও টুনি—দিদি—এঁরা যেন সাংখ্যদর্শনের পুরুষ—প্রকৃতি। কর্তাটি কুঁড়ের সম্রাট, সমস্তক্ষণ ড্রেসিং গাউন পরিয়া ইজিচেয়ারে বসিয়া বই পড়েন ও চুরুট ফোঁকেন। গিন্নীটি ঠিক উলটো অসীম শক্তিময়ী, অঘটনঘটনপটিয়সী, মাছকোটা হইতে গাড়ি রিজার্ভ করা পর্যন্ত সব কাজ নিজেই করিয়া থাকেন, কথা কহিবার ফুরসত নাই। তাড়াতাড়ি অভ্যর্থনা শেষ করিয়াই অতিথিসৎকারের বিপুল আয়োজন করিতে রান্নাঘরে ছুটিলেন। পদ্ম আসিয়া প্রণাম করিল।
খাসা মেয়ে। কেষ্টা হতভাগা বলে কিনা মজবুত! একি হাতুড়ি না হামানদিস্তা? কচি—সংসদের মধ্যে বাস্তবিক যদি কেউ নিরেট কচি থাকে, তবে সে কেষ্ট—যতই প্রেমের বক্তৃতা দিক। ঋষ্যশৃঙ্গের একটা শিং ছিল, কেষ্টর দুটো শিং। কিন্তু এই সুশ্রী বুদ্ধিমতী সপ্রতিভ মেয়েটি কেন এই গর্দভের খেয়ালে রাজী হইল? স্ত্রীজাতি বাঁদর—নাচ দেখিতে ভালবাসে। পদ্মর উদ্দেশ্য কি শুধু তাই? স্ত্রীচরিত্র বোঝা শক্ত। না, মনস্তত্ত্বের বইগুলো ভাল করিয়া পড়িতে হইবে।
হাইকোর্টশিপ আরম্ভ হইল। ঘরের পর্দা ভেদ করিয়া সুদূর রান্নাঘর হইতে টুনি—দিদি ও আমার গৃহিণীর উচ্চ হাসি এবং কাটলেট ভাজার গন্ধ আসিতেছে। আমি যথাসাধ্য গাম্ভীর্য সঞ্চয় করিয়া শুভকার্য আরম্ভ করিলাম—
‘এই মকদ্দমায় বাদী, প্রতিবাদী, অনুবাদী, সংবাদী, বিসংবাদী কে কে তা এখনও স্থির হয় নি। কিন্তু সেজন্য বিচার আটকাবে না, কারণ দুই সাক্ষী হাজির,—শ্রীমান কেষ্ট ও শ্রীমতী পদ্ম।—’
কেষ্ট বলিল—’ব্রজেন—দা, আপনি এই গুরু বিষয় নিয়ে আর তামাশা করবেন না—কাজ শুরু করুন।’
আমি। ব্যস্ত হও কেন—, আগে যথারীতি সত্যপাঠ করাই।—শ্রীমান কেষ্ট, তুমি শপথ ক’রে বল যে তোমার মধ্যে পূর্বরাগের কোন কমপ্লেক্স নেই। যদি থাকে তবে মকদ্দমা এখনই ডিসমিস হবে।
কেষ্ট। একদম নেই। পদ্ম যখন পাঁচ বছরের আর আমি যখন দশ বছরের, তখন ওকে যে—রকম দেখতুম এখনও ঠিক তাই দেখি। তবে আগে ওকে ঠেঙাতুম, এখন আর ঠেঙাই না।
আমি। শ্রীমতী পদ্ম, কেষ্টর প্রতি তোমার মনোভাব কি রকম তা জিজ্ঞেস ক’রে তোমায় অপমান করতে চাই না। কেষ্টর মূর্তিই হচ্ছে পূর্বরাগের অ্যাণ্টি—ডোট। কেষ্ট, এইবার তোমার সেই ফিরিস্তিটা দাও। বাপ! তিরানব্বইটা আইটেম! বেশভূষা— আহার্য—শয্যা—পাঠ্য—এ তো দেখছি পাক্কা পনেরো দিন লাগবে। দেখ, আজ বরঞ্চ আমি গোটাকতক বাছা বাছা প্রশ্ন করি, যদি অবস্থা আশাজনক বোধ হয় তবে কাল থেকে সিস্টেম্যাটিক টেস্ট শুরু হবে। আচ্ছা, প্রথমে আহার্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি—কারণ ওইটেই সবচেয়ে দরকারী, ফ্রয়েড যা—ই বলুন। কেষ্ট তুমি লঙ্কা খাও?
কেষ্ট। ঝাল আমার মোটেই সহ্য হয় না।
আমি। পদ্ম কি বল?
পদ্ম। লঙ্কা না হ’লে আমি খেতেই পারি না।
আমি। ব্যাড। প্রথমেই ঢেরা পড়ল। স্বামী—স্ত্রীর তো ভিন্ন হেঁশেল হ’তে পারে না। রফা করা চলে কিনা পরে স্থির করা যাবে। জলে লঙ্কা সেদ্ধ ক’রে দুজনকে খাইয়ে দেখে এমন একটা পার্সেণ্টেজ ঠিক করতে হবে যা দু—পক্ষেরই বরদাস্ত হয়। আচ্ছা—তোমরা চায়ে কে ক চামচ চিনি খাও?
কেষ্ট। এক।
পদ্ম। সাত।
আমি। ভেরি ব্যাড। আবার ঢেরা পড়ল।
কেষ্ট। আমি মেরে কেটে তিন চামচ অবধি উঠতে পারি। পদ্ম, তুমি একটু নাবো না।
আমি। খবরদার, সাক্ষী ভাঙাবার চেষ্টা ক’রো না। যা জিজ্ঞাসা করবার আমিই করব। আচ্ছা—কেষ্ট, তুমি কি—রকম বিছানা পছন্দ কর? নরম না শক্ত?
কেষ্ট। একটু শক্ত রকম, ধরুন দু—ইঞ্চি গদি। বেশী নরম হ’লে আমার ঘুমই হয় না।
পদ্ম। আমি চাই তুলতুলে।
আমি। ভেরি ভেরি ব্যাড। এই ফের ঢেরা দিলুম। আচ্ছা—কেষ্ট, পদ্মর চেহারাটা তোমার কি—রকম পছন্দ হয়?
কেষ্ট। তা মন্দ কি।
আমি সাক্ষীবিহ্বলকারী ধমক দিয়া বলিলাম—’ওসব ভাসা ভাসা জবাব চলবে না, ভাল ক’রে দেখ তারপর বল।’
পদ্ম লাল হইল। কেষ্ট অনেকক্ষণ ধরিয়া তাহাকে নিরীক্ষণ করিয়া একটু বোকা—হাসি হাসিয়া বলিল—’খাখ—খাসা চেহারা। এঃ, পদ্ম আর সে পদ্ম নেই, একেবারে—’
আমি। বস বস—বাজে কথা ব’লো না। পদ্ম, এবারে তুমি কেষ্টকে দেখে বল।
পদ্ম ভ্রূকুঞ্চিত করিয়া কেষ্টর প্রতি চকিত দৃষ্টি হানিয়া বলিল—’যেন একটি সঙ!’
কেষ্ট। তা—তা আমিই না—হয় মাথার চুলটা এক ইঞ্চি বাড়িয়ে ফেলব, আর দাড়িটাও না—হয় ফেলে দেব। আচ্ছা, এই হাত দিয়ে দাড়িটা চেপে রাখলাম—এইবার দেখ তো পদ্ম।
পদ্ম হাসিয়া লুটাইয়া পড়িল।
আমি বলিলাম—’হোপলেস। আপত্তির প্রতিকার হ’তে পারে, কিন্তু বিদ্রূপের ওষুধ নেই।’
কেষ্ট একটু নরম হইয়া বলিল—’আপনিই তো যা—তা রিমার্ক ক’রে সব গুলিয়ে দিচ্ছেন।’
আমি। আচ্ছা বাপু, তুমি নিজেই না—হয় জেরা কর।
কেষ্ট প্রত্যালীঢ়পদে বসিয়া আস্তিন গুটাইয়া বলিল—’পদ্ম, এই দেখ আমার হাত। একে বলে বাইসেপ্স—এই দেখ ট্রাইসেপ্স। এইরকম জবরদস্ত গড়ন তোমার পছন্দ হয়, না ব্রজেন—দার মতন গোলগাল নাদুস—নুদুস চাও? তোমার মতামত জানতে পারলে আমি না—হয় আমার আদর্শ সম্বন্ধে ফের বিবেচনা করব।’
পদ্ম। তোমার চেহারা তুমি বুঝবে—আমার তাতে কি। আমি তো আর তোমায় দারোয়ান রাখছি না।
কেষ্ট। আচ্ছা, তোমার হাতটা দেখি একবার—কি রকম পাঞ্জার জোর—
কেষ্ট খপ করিয়া পদ্মার পদ্মহস্ত ধরিল। আমি বলিলাম—’হাঁ হাঁ—ও কি! সাক্ষীর ওপর হামলা! ওসব চলবে না—আমার ওপর যখন বিচারের ভার তখন যা করবার আমিই করব। তুমি ওই ওখানে গিয়ে বস।’
কেষ্ট অপ্রতিভ হইয়া বলিল—’বেশ তো, আপনিই ফের কোশচেন করুন।’
আমি। আর দরকার নেই। তোমাদের মোটেই মতে মিলবে না, রফা করাও চলবে না। আমি এই হুকুম লিখলুম—napoo, nothing doing। কেস এখন মুলতবী রইল। এক বৎসর নিজের নিজের মতামত বেশ ক’রে রিভাইজ কর, তারপর আবার অত্র আদালতে হাজির হইবা।
কেষ্ট এবার চটিয়া উঠিল। বলিল—’আপনি আমার সিস্টেম কিচ্ছু বুঝতে পারেন নি। আপনি যা করলেন সে কি একটা টেস্ট হ’ল?—শুধু ইয়ারকি। আপনাকে মধ্যস্থ মানাই ঝকমারি হয়েছে।’
আমিও খাপপা হইয়া বলিলাম—’দেখ কেষ্ট, বেশী চালাকি ক’রো না। আমি একজন উকিল, বার বৎসর প্র্যাকটিস করেছি, পনর বৎসর হ’ল বিবাহ করেছি, ঝাড়া একটি মাস সাইকলজি পড়েছি। কার সঙ্গে কার মতে মেলে তা আমার বিলক্ষণ জানা আছে। আর—তুমি তো নির্বিকার, তোমার অত রাগ কেন? দেখ দিকি, পদ্ম কেমন লক্ষ্মীমেয়ে, চুপটি ক’রে বসে আছে।’
কেষ্ট গজগজ করিতে লাগিল। এই সময় হঠাৎ ঘরের পর্দা ঠেলিয়া টুনি—দিদির ছোট খুকী প্রবেশ করিল।
আমি গম্ভীর স্বরে বলিলাম—’নারী তুমি কি চাও?’
খুকীর নারীত্বের দাবি অতি মহৎ এবং সমস্ত নারীসমাজের অনুধাবনযোগ্য। বলিল—’খাবেন চলুন, লুচি জুড়িয়ে যাচ্ছে।’
কেষ্ট কাহারও সহিত আর বাক্যালাপ করিল না, ভাল করিয়া খাইলও না। আহারান্তে আমি একাই নিজের বাসায় ফিরিলাম। গৃহিণী আজ এখানেই রাত্রি যাপন করিবেন।
পরদিন বেলা দশটার সময় গৃহিণী ফিরিয়া আসিয়া আপাদমস্তক মুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িলেন। সভয়ে দেখিলাম তিনি কম্বলের ভিতর ক্ষণে ক্ষণে নড়িয়া উঠিতেছেন এবং অস্ফুট শব্দ করিতেছেন।
বলিলাম—’ফিক ব্যথাটা আবার ধরেছে বুঝি? ডাক্তার দাসকে ডাকব?’
গৃহিণী অতি কষ্টে বলিলেন—’না, কিছু দরকার নেই, ও আপনিই সেরে যাবে। হুঃ হুঃ হিঃ।’
হিস্টিরিয়া নাকি? ও উৎপাত তো ছিল না, নিশ্চয় বেচারা কল্যকার ব্যাপারে মনঃক্ষুণ্ণ হইয়াছে। আমার মতলব তো জানে না। মেয়েরা চায় রাতারাতি বিবাহটা স্থির হইয়া যাক। আরে অত ব্যস্ত হইলে কি চলে! কেষ্ট সবে বঁড়শি গিলিয়াছে, এখন তাকে আরও দিনকতক খেলাইতে হইবে।
বৈকালে মুন—শাইন ভিলায় যাইলাম—উদ্দেশ্য কেষ্টকে একটু ঠাণ্ডা করা। কিন্তু কেষ্টর দেখা পাইলাম না, মামাও নাই। কচি—সংসদের সভ্যগণ নিজ নিজ খাটে শুইয়া আছে, ডাকিলে সাড়া দিল না। তাহাদের দৃষ্টি উদাস,—নিশ্চয় একটা বড়—রকম ব্যথা পাইয়াছে।
বোদাকে জিজ্ঞাসা করিলাম—’বাবু কাঁহা?’
বোদার বদনচক্রে দর্শন, নিঃশ্বাস ও বাক্যনিঃসরণের জন্য যে কয়টি ছোট ছোট ছিদ্র আছে তাহা বিস্ফারিত হইল। বলিল—’বাবু বাগা।’
আঁ? কেষ্টবাবু ভাগা! কাঁহা ভাগা? নিশ্চয় ভুবনবাবুর বাড়িতে গিয়া হোগা।
‘বুবনবাবু, বাগ গিয়া! উনকি বিবি বাগ গিয়া। উনকি কোকী বাগ গিয়া। কোকীকা গোড়া বাগ গিয়া। গোরে—সি মিসিবাবা যো থি সো বি বাগ গিয়া।’ কেষ্ট পালাইয়াছে। ভুবনবাবু, তাঁহার বিবি, তাঁহার খুকী, খুকীর ঘোড়া এবং ফরসা—মতন মিসিবাবা—অর্থাৎ পদ্ম—সকলেই পালাইয়াছে। নকুড় মামা বোধ হয় খোঁজে বাহির হইয়াছেন। কচি সংসদ কিছুই জানে না, জিজ্ঞাসা করা বৃথা।
গৃহিণীর কাণ্ড মনে পড়িল। ফিক ব্যথাও নয়, হিস্টিরিয়াও নয়—শুধু হাসি চাপিবার চেষ্টা। তৎক্ষণাৎ বাসায় ফিরিলাম।
বলিলাম—’তুমিই যত নষ্টের গোড়া।’
গৃহিণী। আহা, কি আমার কাজের লোক! নিজে কিছুই করতে পারলেন না, এখন আমার দোষ।
আমি। তারপর ব্যাপারটা কি বল দিকি?
গৃহিণী প্রথমে একচোট হাসিয়া গড়াইয়া লইলেন। শেষে বলিলেন—’তুমি তো রাত সাড়ে দশটায় ফিরে গেলে। টুনি—দিদি আর আমি গল্প করতে লাগলুম— সে কত সুখ—দুঃখের কথা। রাত বারটার সময় দেখি— কেষ্ট টিপিটিপি আসছে। তার মুখ কাঁদো—কাঁদো, চাউনি পাগলের মতন। টুনিদি বললে—কেষ্ট, কি হয়েছে? কেষ্ট বললে, পদ্মর সঙ্গে বে না হ’লে সে আর এ প্রাণ রাখবে না, তার আর তর সইছে না। হয় পদ্ম—নয় কি একটা অ্যাসিড। আমি বললুম—তার আর চিন্তা কি, অ্যাসিড ডাক্তারখানায় পাওয়া যায়, আর পদ্ম তো মজুতই আছে। আগে সকাল হ’ক তারপর যা—হয় একটা ব্যবস্থা করা যাবে। কেষ্ট বলল—সে এক্ষুনি তার সঙের সাজ ফেলে দিয়ে ভদ্দর লোক সাজবে, কিন্তু অত লাফালাফির পর পাঁচ জনের কাছে মুখ দেখাবে কেমন করে? টুনি—দি বললে—কুছ পরোয়া নেই, কালকের মেলেই কলকাতায় পালিয়ে চল, গিয়েই বে দেব। পদ্ম বিগড়ে বসল। টুনি—দি বললে নে, নেঃ—নেকী। টুনি—দিকে জান তো, তার অসাধ্য কাজ নেই। সেই রাত্রেই মশাই মোট বাঁধা হয়ে গেল—এক—শ তেষট্টিটা লাগেজ। তারপর আজ সকালে তাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে এখানে চ’লে এলুম।’
বিবাহের পর দেড় মাস কেষ্ট আমার সঙ্গে লজ্জায় দেখা করে নাই—সবে কাল আসিয়া ক্ষমা চাহিয়া গিয়াছে। আমি তাহাকে সর্বান্তঃকরণে মার্জনা করিয়াছি এবং মনস্তত্ত্ব হইতে নজির দেখাইয়া বুঝাইয়া দিয়াছি যে তাহার লজ্জিত হইবার কোনও কারণ নাই। কেষ্টর মনের আড়ালে যে আর একটা উপমন এতদিন ছাই—চাপা ছিল তাহারই ভূমিকম্পের ফলে সে বাঁদর নাচিয়াছে।
কচি—সংসদ ছত্রভঙ্গ হইয়া গিয়াছে। কেষ্ট আবার একটা নূতন ক্লাব স্থাপন করিয়াছে—হৈহয় সংঘ। ইতিহাস—প্রসিদ্ধ হৈহয় ক্ষত্রিয়গণের সঙ্গে ইহার কোনও সম্বন্ধ নাই। ইহার মেম্বার—সস্ত্রীক আমি ও কেষ্ট। এই বড়দিনের বন্ধে আমরা হাওড়া হইতে পেশাওআর পর্যন্ত হইহই করিতে যাইব।
কর্দম মেখলা
পুষ্কর সরোবরের তীরে বিশ্বামিত্র আর মেনকা কাছাকাছি বসে এ আছেন। মেনকা তাঁর কেশপাশ আলুলায়িত করে কাঁকুই দিয়ে আঁচড়াচ্ছেন, বিশ্বামিত্র মুখ ফিরিয়ে আত্মচিন্তা করছেন।
অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর বিশ্বামিত্র কপাল কুঁচকে নাক ফুলিয়ে বললেন, মেনকা, তুমি সরে যাও, তোমার চুলের তেলচিটে গন্ধ আমি সইতে পারছি না।
ভ্রূভঙ্গী করে মেনকা বললেন, তা এখন পারবে কেন। অথচ এই সেদিন পর্যন্ত আমার চুলের মধ্যে মুখ গুঁজড়ে পড়ে থাকতে। চুলে কি মাখি জান? মলয়গিরিজাত নারিকেল তৈলে পঞ্চাশ রকম গন্ধদ্রব্য ভিজিয়ে ধন্বন্তরী আমার জন্যে এই কেশতৈল প্রস্তুত করেছেন। এর সৌরভে দেব দানব গন্ধব মানব মুগ্ধ হয়, আর তোমার তা সহ্য হচ্ছে না! মুখে হাঁড়ি করে রয়েছ কেন, মনের কথা খুলেই বল না।
বিশ্বামিত্র বললেন, তুমি মুখ অপ্সরা, দ্রব্যগুণ কিছুই জানি না। উত্তম গতৈলও আবায়ুর সংস্পর্শে বিকৃত হয়। প্রজাতির নাকের সাড় নেই, কিন্তু অন্য লোকে দুর্গন্ধ পায়।
—এতদিন তুমি দুর্গন্ধ পাও নি কেন?
–আমার বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছিল, লুব্ধ কুক্কুরের ন্যায় পূতিগন্ধকে দিব্য সৌরভ মনে করতাম, তোমার কুটিল কালসর্প সম বেণী কুসুমদাম বলে ভ্রম হত, তোমার ক্লিন্ন অশুচি দেহের স্পর্শে আমার আপাদমস্তক হর্ষিত হত। সেই কদর্য মোহ এখন অপসত হয়েছে। মেনকা, তোমাকে আমার আর প্রয়োজন নেই, তুমি চলে যাও।
মেনকা বললেন, ছ মাসেই প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল। আমি যখন প্রথমে তোমার এই আশ্রমে এসেছিলাম তখন আমাকে দেখেই তুমি সংযম হারিয়ে তপস্যায় জলাঞ্জলি দিয়ে লোলুপ হয়েছিলে। আমি কিন্তু নিষ্কামভাবে নির্বিকার চিত্তে অপ্সরার কর্তব্য পালন করেছি, তোমার কুৎসিত জটাশ্মশ্র, আর লোমশ বক্ষের স্পর্শ, তোমার দেহের উৎকট শার্দূলগন্ধ সবই ঘৃণা দমন করে সয়েছি। ওহে ভূতপূর্ব কান্যকুব্জরাজ মহাবল বিশ্বমিত্র, বশিষ্ঠের গরু চুরি করতে গিয়ে তুমি সসৈন্যে মার খেয়েছিলে। তখন তুমি বিলাপ করেছিলে–ধিগ বলং ক্ষত্রিয়বলং ব্ৰহয়তেজো বলং বলম্। তার পর তুমি ব্ৰহ্মর্ষি হবার জন্য কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন হলে। কিন্তু ইন্দ্রের আদেশে যেমনি আমি তোমার কাছে এলাম তখনই তোমার মুণ্ড ঘরে গেল, তপস্যা চুলোয় গেল, একটা অবলা অপ্সরার কাছেও আত্মরক্ষা করতে পারলে না। এখন হয়তো বুঝেছ যে, ব্রহ্মতেজের বলও অপ্সরার বলের কাছে তুচ্ছ, অনেক রাজর্ষি মহর্ষি ব্রহ্মর্ষি আমাদের পদানত হয়েছেন। যা বলি শোন-ব্রহ্মর্ষি হবার সঙ্কল্প ত্যাগ করে অপ্সরা হবার জন্যে তপস্যা কর।
বিশ্বামিত্র বললেন, কটুভাষিণী, তুমি দূর হও।
—ত হচ্ছি। আমার গড়ে তোমার যে সন্তান আছে তার ব্যবস্থা কি করবে?
স্বৰ্গবেশ্যার সন্তানের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে। যা করবার তুমি করবে।
–তুমি তো মহা বেদজ্ঞ আর পুরাণজ্ঞ। এ কথা কি জান না যে অপ্সরা কদাপি সন্তান পালন করে না? আমরা প্রসব করেই সরে পড়ি, এই হল সনাতন রীতি। অপত্যপালন জন্মদাতারই কর্তব্য, গর্ভধারিণী অপ্সরার নয়।
অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে বিশ্বামিত্র বললেন, তুমি আমার তপস্যা পণ্ড করেছ, বুদ্ধি মোহগ্রস্ত করেছ, চরিত্র কলুষিত করেছ। পাপিষ্ঠা, দূর হও এখান থেকে, তোমার গর্ভস্থ পাপও তোমার সঙ্গে দূর হয়ে যাক।
পুষ্কর সরোবরের ধার থেকে খানিকটা কাদা তুলে নিয়ে মেনকা দুই হাতে তাল পাকাতে লাগলেন।
বিশ্বামিত্র প্রশ্ন করলেন, ও আবার কি হচ্ছে?
কাদার পিণ্ড পাকিয়ে সাপের মতন লম্বা করে মেনকা বললেন, রাজর্ষি বিশ্বামিত্র, তোমার সন্তান আমি চার মাস গর্ভে বহন করেছি, আরও প্রায় পাঁচ মাস বইতে হবে। তোমার কৃতকর্মের ফল শুধু আমিই বয়ে বেড়াব আর তুমি লঘুদেহে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করবে তা হতে পারে না। তোমাকেও ভার সইতে হবে। এই নাও।
মেনকা তাঁর হাতের লম্বা কাদার পিণ্ড সবেগে নিক্ষেপ করলেন। বিশ্বামিত্রের কটিদেশে তা মেখলার ন্যায় জড়িয়ে গেল।
চমকে উঠে মুখ বিকৃত করে বিশ্বামিত্র বললেন, আঃ! সেই কর্দম মেথলা টেনে খুলে ফেলবার জন্যে তিনি অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। তখন পুষ্করের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধুয়ে ফেলবার জন্যে দুই হাত দিয়ে ঘুষতে লাগলেন, কিন্তু সেই কালসর্প তুল্য মেখলার ক্ষয় হল না, নাগপাশের ন্যায় বেষ্টন করে রইল।
হতাশ হয়ে বিশ্রাম জল থেকে তীরে উঠে এলেন। মেনকাকে আর দেখতে পেলেন না।
বিশ্বামিত্র পুনর্বার তপস্যায় নিরত হবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু মনোনিবেশ করতে পারলেন না, কর্দম মেখলার নিরন্তর সংস্পর্শে তাঁর ধৈর্য নষ্ট হল, চিত্ত বিক্ষোভিত হল। তিনি আশ্রম ত্যাগ করে আকুল হয়ে পর্যটন করতে লাগলেন, হিমাচল থেকে দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত ভ্রমণ করলেন, নানা তীর্থসলিলে অবগাহন করলেন, কিন্তু মেখলা বিগলিত হল না। এই ভাবে সাড়ে পাঁচ বৎসর কেটে গেল।
ঘুরতে ঘুরতে একদিন তিনি মালিনী নদীর তীরে উপস্থিত হলেন। নদীর কাকচক্ষু, তুল্য নির্মল জল দেখে তাঁর মনে একটু আশার উদয় হল। উত্তরীয় তীরে রেখে বিশ্বামিত্র জলে নামলেন এবং অনেকক্ষণ প্রক্ষালন করলেন, কিন্তু তাঁর মেখলা পূর্ববৎ অক্ষয় হয়ে রইল। অবশেষে তিনি বিষণ্ণ মনে জল থেকে তীরে উঠতে গেলেন, কিন্তু পারলেন না, পাঁকের মধ্যে তাঁর দুই পা প্রায় হাঁটু পর্যন্ত ডুবে গেল।
প্রাণভয়ে বিশ্বামিত্র চিৎকার করলেন। মালিনীর তটবর্তী বন ভূমিতে তিনটি মেয়ে খেলা করছিল, একটির বয়স পাঁচ, আর দুটির সাত-আট। বিশ্বামিত্রের আর্তনাদ শুনে তারা ছুটে এল এবং নিজেরাও চিৎকার করে ডাকতে লাগল—ও পিসীমা দৌড়ে এস, কে একজন ডুবে যাচ্ছে।
পিসীমা অর্থাৎ গৌতমী লম্বা আঁকশি দিয়ে একটি প্রকাণ্ড অম্রাতক বৃক্ষ থেকে পাকা আমড়া পাড়ছিলেন। মেয়েদের ডাক শুনে ছুটে এলেন। নদীর ধারে এসে বিশ্বামিত্রকে বললেন, নড়বেন না, তা হলে আরও ডুবে যাবেন। এই আঁকশিটা বেশ শক্ত, পাঁকের তলা পর্যন্ত পতে দিচ্ছি, এইটেতে ভর দিয়ে স্থির হয়ে থাকুন। এই অনু আর প্রিয়, তোরা দুজনে দৌড়ে যা, আমি যে চাঁচাড়ির চাটাই শই সেইটে নিয়ে আয়।
অনু আর প্রিয় অল্পক্ষণের মধ্যে ধরাধরি করে একটা চাটাই নিয়ে এল। গৌতমী সেটা পাঁকের উপর বিছিয়ে দিয়ে বললেন, এইবারে আস্তে আস্তে পা তুলে চাটাইএর উপর দিন, তাড়াতাড়ি করবেন না! আঁকশিটা পাঁক থেকে টেনে নিচ্ছি। এই এগিয়ে দিলাম, দু হাত দিয়ে ধরুন।
আঁকশির এক দিক বিশ্বামিত্র ধরলেন, অন্য দিক গৌতমী ধরে টানতে লাগলেন, মেয়েরা তার কোমর ধরে রইল। বিশ্বামিত্র ধীরে ধীরে তীরে উঠে এসে বললেন, ভদ্রে, আপনি আমার প্রাণরক্ষা করেছেন। কে আপনি দয়াময়ী? এই দেবকন্যার ন্যায় বালিকারা কারা?
গৌতমী বললেন, আমি মহর্ষি কণ্বের ভগিনী গৌতমী। এই অনু আর প্রিয় — অনসূয়া আর প্রিয়ংবদা, এরা এই আশ্রমবাসী পিপ্পল আর শাল্মল ঋষির কন্যা। আর এই ছোটটি শকু–মহর্ষি কণ্বের পালিতা দুহিতা শকুন্তলা। আমার ভ্রাতার আশ্রম এই মালিনী নদীর তীরেই। সৌম্য, আপনি কে?
–আমি হতভাগ্য বিশ্বামিত্র।
–বলেন কি, রাজর্ষি বিশ্বামিত্র! আপনার এমন দুর্দশা হল কেন?
অনু আর প্রিয় নাচতে নাচতে বলল, ওরে বিশ্বামিত্র মুনি এসেছে, শকুর বাবা এসেছে রে, এক্ষুনি শকুকে নিয়ে যাবে রে!
শকুন্তলা ভ্যাঁ করে কেঁদে গৌতমীকে জড়িয়ে ধরল।
অনুসয়া আর প্রিয়ংবদাকে ধমক দিয়ে গৌতমী বললেন, চুপ কর দষ্ট মেয়েরা, কেন ছেলেমানুষকে ভয় দেখাচ্ছিস!
বিশ্বামিত্র বললেন, খুকী, তোমার বাবা কে তা জান?
শকুন্তলা বলল, আমার বাবা ক মনি, আর মা এই পিসীমা।
অনসূয়া আর প্রিয়ংবদা আবার নাচতে নাচতে বলল, দূর বোকা, সব্বাই জানে আর তুই কিচ্ছু জানিস না। তোর বাবা এই বিশ্বামিত্র মনি, আর মা–
গৌতমী দুই মেয়ের পিঠে কিল মেরে বললেন, দূর হ এখান থেকে। এই রাজর্ষির পরিধেয় ভিজে গেছে, তোদের বাবার কাছ থেকে শুখনো কাপড় চেয়ে নিয়ে আয়। আর তোদের মাকে বল, অতিথি এসেছেন, আমাদের আশ্রমেই আহার করবেন।
বিশ্বামিত্র বললেন, বস্ত্রের প্রয়োজন নেই, আমার অধোবাস আপনিই শুখিয়ে যাবে, আর আমার উত্তরীয় শঙ্কই আছে। আপনি আহারের আয়োজন করবেন না, আমার ক্ষুধা নেই। দেবী গৌতমী, এই বালিকাকে কোথায় পেলেন?
গৌতমী নিম্নকণ্ঠে জনান্তিকে বললেন, মেনকা প্রসব করেই মালিনী নদীর তটে একে ফেলে চলে যায়। মহর্ষি কশ্ব মান করতে গিয়ে দেখেন, এক ঝাঁক হংস সারস চকুবাকাদি শকুত পক্ষ বিস্তার করে চারদিকে ঘিরে সদ্যোজাত এই বালিকাকে রক্ষা করছে। দয়া হয়ে তিনি একে আশ্রমে নিয়ে আসেন। শকুন্ত কতৃক আরক্ষিতা, সেজন্য আমরা নাম দিয়েছি শকুন্তলা।
বিশ্বামিত্র বললেন, কন্যা, একবারটি আমার কোলে এস।
শকুন্তলা আবার কেঁদে উঠে বলল, না, যাব না, তুমি আমার বাবা নও, কণ্ব মুনি আমার বাবা।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিশ্বামিত্র বললেন, ঠিক কথা। আমি তোমার পিতা নই, মেনকাও তোমার মাতা নয়, যারা তোমাকে ত্যাগ করেছিল তাদের সঙ্গে তোমার সম্পর্ক নেই। যাঁরা তোমাকে আজন্ম পালন করেছেন তাঁদেরই তুমি কন্যা। খুকী, তুমি কি খেলনা চাও বল, রুপোর রাজহাঁস, সোনার হরিণ, পান্না-নীলার ময়ূর–
অনসূয়া ঠোঁট বেঁকিয়ে বলল, ভারী তো। আমাদের আসল হাঁস হরিণ ময়ুর আছে।
প্রিয়ংবদা বলল, আমাদের হাঁস প্যাঁক প্যাঁক করে, হরিণ লাফায়, ময়ূর নাচে। তোমার হাঁস হরিণ ময়ূর তা পারে?
বিশ্বামিত্র বললেন, না, শুধু ঝকমক করে। শকুন্তলা, তুমি আমার সঙ্গে চল। শত রাজকন্যা তোমার সখী হবে, সহস্র দাসী তোমার সেবা করবে, স্বর্ণমণ্ডিত গজদন্তের পর্যঙ্কে তুমি শোবে, দেবদুর্লভ অন্ন ব্যঞ্জন মিষ্টান্ন পায়স তুমি খাবে, মণিময় চত্বরে সখীদের সঙ্গে খেলা করবে। তোমাকে আমি সুবিশাল রাজ্যের অধীশ্বরী করে দেব।
গৌতমী বললেন, কি করে করবেন? আপনার কান্যকুঞ্জ রাজ্য তো পুত্রদের দান করে তপস্বী হয়েছেন।
–তুচ্ছ কান্যকুঞ্জ রাজা আমার পুত্ররাই ভোগ করক, তা কেড়ে নিতে চাই না। বাহুবলে আর তপোবলে আমি সসাগরা ধরা জয় করে আমার কন্যাকে রাজরাজেশ্বরী করব। যত দিন কুমারী থাকে তত দিন আমিই এর প্রতিভূ হয়ে রাজ্যশাসন করব। তার পর অতুলনীয় রুপবান গণবান বলবান বিদ্যাবান কোনও রাজা বা রাজপুত্রের হাতে একে সম্প্রদান করে পনবার তপস্যায় নিরত হব।
গৌতমী বললেন, কি বলিস শকু, যাবি এই রাজর্ষির সঙ্গে? শকুন্তলা আবার কেঁদে উঠে বলল, না না যাব না।
গৌতমী বললেন, রাজর্ষি বিশ্বামিত্র, জন্মের পূর্বেই যাকে বর্জন করেছিলেন তার প্রতি আবার আসক্তি কেন? আপনার সংযম কিছুমাত্র নেই। বশিষ্ঠের কামধেনুর লোভে আপনার ধর্মজ্ঞান লোপ পেয়েছিল, মেনকাকে দেখে আপনি উন্মত্ত হয়েছিলেন, এখন আবার তার কন্যাকে দেখে স্নেহে অভিভূত হয়েছেন। এই বালিকার কল্যাণই যদি আপনার অভীষ্ট হয় তবে একে আর উদ্বিগ্ন করছেন কেন, অব্যাহতি দিন, এর মায়া ত্যাগ করে প্রস্থান করুন।
বিশ্বামিত্র বললেন, শকুন্তলা, তোমার এই পিসীমাকে যদি সঙ্গে নিয়ে যাই তা হলে তুমি যাবে তো?
গৌতমী বললেন, কি যা তা বলছেন, আমি কেন আপনার সঙ্গে
–দেবী গৌতমী, আমি আপনার পাণিপ্রার্থী। আমাকে বিবাহ করে আপনি আমার কন্যার জননীর স্থান অধিকার করুন।
অনসূয়া আর প্রিয়ংবদা আবার নাচতে নাচতে বলল, পিসীমার বর এসেছে রে!
গৌতমী সরোষে বললেন, বিশ্বামিত্র, আপনি উন্মাদ হয়েছেন, আপনার হিতাহিত জ্ঞান লোপ পেয়েছে। আর প্রলাপ বকবেন না, চলে যান এখান থেকে।
বিশ্বামিত্র কাতর স্বরে বললেন, শকুন্তলা, একবার আমার কোলে এস, তার পরেই আমি চলে যাব।
গৌতমী বললেন, যা না শকু, একবারটি ওঁর কোলে গিয়ে বস। ভয় কি, দেখছিস তো, তোকে কত ভালবাসেন।
শকুন্তলা ভয়ে ভয়ে বিশ্বামিত্রের কোলে বসল। তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, কন্যা, সরাসরি যক্ষ রক্ষ তোমাকে রক্ষা করুন, বসুগণ তোমাকে বসুমতীর ন্যায় বিত্তবতী করুন, ধী শ্রী কীর্তি ধৃতি ক্ষমা তোমাতে অধিষ্ঠান করুন্রর–
হঠাৎ শকুলা লাফিয়ে উঠে বলল, ওরে পিসীমা রে!
ব্যাকুল হয়ে গৌতমী বললেন, কি হল রে?
বিশ্বামিত্র উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর কর্দম মেখলা খসে গিয়ে মাটিতে পড়ে কিলবিল করতে লাগল।
প্রিয়ংবদা চিৎকার করে বলল, সাপ সাপ!
অনসূয়া বলল, ঢোঁড়া সাপ!
গৌতমী বললেন, জলডুণ্ডুভ। এই দেখ, সড়সড় করে নদীতে নেমে যাচ্ছে।
বিশ্বামিত্র বললেন সাপ নয়, মেনকার অভিশাপ, এতকাল পরে আমাকে নিষ্কৃতি দিয়েছে। কন্যা, তোমার পবিত্র স্পর্শে আমি শাপমুক্ত পাপমুক্ত সন্তাপমুক্ত হয়েছি। আশীর্বাদ করি, রাজেন্দ্রের রাজ্ঞী হও, রাজচক্রবতী সম্রাটের জননী হও। দেবী গৌতমী, আমি যাচ্ছি, আপনাদের মঙ্গল হক, আমার আগমনের স্মৃতি আপনাদের মন থেকে লুপ্ত হয়ে যাক।
কামরূপিণী
শীতকাল, বিকাল বেলা। শিবপুর বটানিক্যাল গার্ডেনে একটি দল গঙ্গার কাছে মাঠের উপর শতরঞ্জি পেতে বসেছেন। দলে আছেন—
প্রবীণ অধ্যাপক নিকুঞ্জ ঘোষ, তাঁর স্ত্রী ঊর্মিলা, মেয়ে ইলা, বয়স পনরো।
নিকুঞ্জর শালা নবীন অধ্যাপক বীরেন দত্তর স্ত্রী সুরুচি, আর তার ছেলে নুটু, বয়স ছয়।
বৃদ্ধ শীতল চৌধুরী। বীরেন দত্তের সঙ্গে এঁর কি একটা দূর সম্পর্ক আছে। ছোট বড় নির্বিশেষে সকলেই এঁকে শীতুমামা বলে ডাকে।
বীরেন দত্তর আসতে একটু দেরি হবে। তাঁর নববিবাহিত বন্ধু মেজর সুকোমল গুপ্ত সম্প্রতি তাঁর স্ত্রী আর শাশুড়ীর সঙ্গে আসাম থেকে কলকাতায় এসেছেন। বীরেন তাঁদের নিয়ে আসবে।
শীতল চৌধুরী বললেন, তোমাদের এ কি রকম পিকনিক? খাবার জিনিস কিছুই সঙ্গে আন নি, শুধু হাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরতে হবে নাকি?
সুরুচি বলল, ভয় নেই শীতুমামা। ওঁর সঙ্গে সবই এসে পড়বে, সস্ত্রীক সশাশুড়ীক মেজর সুকোমল গুপ্ত আর দেদার খাবার। গুপ্তর বউ আর শাশুড়ী নিজের হাতে সব খাবার তৈরী করে আনবেন। বউভাতের ভোজটা আমাদের পাওনা আছে, এখানেই খাওয়াবেন।
নুটু বলল, ও শীতুমামা, কাল যে গল্পটা বলছিলে তা তো শেষ হয় নি। খেতে অনেক দেরি হবে, ততক্ষণ গল্পটা বল না।
শীতুমামা বললেন, আচ্ছা বলছি শোন।—তার পর রাজা তো খুব সানাই ভেঁপু রামশিঙা ঢাক ঢোল জগঝম্প বাজিয়ে শোভাযাত্রা করে সুয়োরানীকে বিয়ে করে রাজবাড়িতে নিয়ে এলেন। পঞ্চাশটা শাঁখ বেজে উঠল, রাজার মাসী পিসী মামীরা খুব জিব নেড়ে হুলুলুলু করলেন। বেচারী দুয়োরানী মনের দুঃখে তাঁর খোকাকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেলেন। এখন, সেই সুয়োরানীটা ছিল রাক্কুসী। সাত দিন যেতে না যেতে রাজার কাছে খবর এল—হাতিশালায় হাতি মরছে, ঘোড়াশালায় ঘোড়া মরছে, শুধু তাদের হাড় দাঁত আর ন্যাজ পড়ে আছে।
নুটু বলল, সুয়োরানী ওসব চিবুতে পারে না বুঝি?
নুটুর মা সুরুচি ধমক দিয়ে বলল, চুপ কর খোকা, ও ছাই গল্প শুনতে হবে না। শীতুমামা, আপনি এইসব বিদকুটে গল্প কেন বলেন? এতে ছোট ছেলেদের মনে একটা খারাপ ছাপ পড়ে।
নিকুঞ্জ ঘোষ হেসে বললেন, আরে না না। সব দেশেরই রূপকথায় একটু উৎকট ব্যাপার থাকে, তাতে ছোট ছেলেমেয়ের কোনও অনিষ্ট হয় না। তারা বেশ বোঝে যে সবই বানিয়ে বলা হচ্ছে। নয় রে নুটু?
নুটু বলল, হুঁ। আমিও গল্প বানাতে পারি।
সুরুচি বলল, যাই হ’ক, শীতুমামা, আপনি ওসব বেয়াড়া মিথ্যে গল্প বলবেন না।
শীতুমামা বললেন, বেশ, মা—লক্ষ্মীর যখন আপত্তি আছে তখন বলব না। নুটু তুই বরং তোর মায়ের কাছে রামায়ণের গল্প শুনিস, শূর্পনখা রাক্কুসীর কথা, খুব ভাল সত্যি গল্প। কিন্তু একটা কথা তোমাদের জানা দরকার। রূপকথার সবটাই মিথ্যে এমন বলা যায় না। যা ঘটে তাই কতক কতক রটে।
নিকুঞ্জ—পত্নী ঊর্মিলা বললেন, আচ্ছা, শীতুমামা, রাক্কুসী সুয়োরানী, পাতালপুরীর রাজকন্যা, সোনার কাঠি রুপোর কাঠি, কামরূপ—কামিখ্যের মায়াবিনী যারা ভেড়া বানিয়ে দেয়—এ সবে আপনি বিশ্বাস করেন?
—কিছু কিছু করি বইকি, বিশেষ করে ওই ভেড়া বানাবার কথা যা বললে।
নিকুঞ্জ—কন্যা ইলা বলল, ভেড়ার কথাটা খুলে বলুন না শীতুমামা।
—নাঃ থাক। নুটুর মায়ের যখন আপত্তি।
নিকুঞ্জ ঘোষ বললেন, লোকের কৌতূহলে খোঁচা দিয়ে চুপ করে থাকা ঠিক নয়, খোলসা করে বলে ফেলাই ভাল।
সুরুচি বলল, বেশ তো, শীতুমামা, ভেড়ার গল্পটা খোলসা করেই বলুন, কিন্তু বেশী বেয়াড়া কথাগুলো বাদ দেবেন।
শীতুমামা বললেন, নাঃ থাক গে। বরং একটু ভগবৎপ্রসঙ্গ হ’ক। ইলা ভাই, তুমি একটু রবীন্দ্রসংগীত গাও, সেই ‘মাথা নত করে দাও’ গানটি।
সুরুচি বলল, অত মান ভাল নয় শীতুমামা। আমি মাপ চাচ্ছি, আপনি ভেড়ার গল্প বলুন।
নুটু বলল, না, আগে সেই রাক্কুসী সুয়োরানীর গল্প হবে।
সুরুচি বলল, তুই থাম খোকা। রাক্কুসীর চাইতে ভেড়াওয়ালী ভাল। বলুন শীতুমামা।
শীতল চৌধুরী বলতে লাগলেন—
পঁচিশ বৎসর আগেকার কথা। বলভদ্র মর্দরাজকে তোমরা চিনবে না, তার বাপ রামভদ্র মর্দরাজ বালেশ্বর জেলার একজন বড় জমিদার ছিলেন, রাজা বললেই হয়। তাঁর এস্টেটে আমি তখন কাজ করতুম। বলভদ্রর বয়স ত্রিশের নীচে, সুপুরুষ, মেজাজ ভাল, শিকারের খুব শখ। একদিন সে আমাকে বলল, ও শীতলবাবু, কেবলই সেরেস্তার কাজ নিয়ে থাকলে তোমার মাথা বিগড়ে যাবে। বাবাকে বলে তোমার বিশ দিনের ছুটি মঞ্জুর করিয়ে দিচ্ছি, আমার সঙ্গে কিমাপুর চল, উত্তর—পূর্ব আসামে, খাস জায়গা, দেদার শিকার। সেখানে আঠারো—শিঙা হরিণ পাওয়া যায়, আকারে খুব বড় নয়, কিন্তু শিঙ দুটো অতি অদ্ভুত, প্রত্যেকটার নটা ফেঁকড়া।
সব খরচ বলভদ্র যোগাবে, আমার কাজ হবে শুধু মোসাহেবি, সুতরাং রাজী হলুম। কিমাপুর জায়গাটা একটু দুর্গম, ব্রহ্মপুত্রের ওপারে ভুটান রাজ্যের লাগোয়া, তবে কামরূপ জেলাতেই পড়ে। পথ ভাল নয়, কোনও রকমে মোটর চলে। শিকারী বলে বলভদ্রর খুব খ্যাতি ছিল, সহজেই আসাম গভর্নমেন্টের কাছ থেকে সব রকম দরকারী পারমিট পেয়ে গেল। একটা বড় হডসন মোটর গাড়ি অনেক খাবার জিনিস, ড্রাইভার, আর একজন চাকর নিয়ে আমরা কিমাপুর ডাকবাংলায় উঠলুম। রোজই শিকারের চেষ্টা হত, নানা রকম জানোয়ারও পাওয়া যেত কিন্তু আঠারো—শিঙা হরিণের দেখা নেই। ওখানকার লোকরা বলল, আরও উত্তরে জঙ্গলের মধ্যে পাওয়া যাবে। খানিক দূর পর্যন্ত কোনও রকমে মোটর চলবে, তার পর হেঁটে যেতে হবে।
সকাল আটটার সময় আমরা যাত্রা করলুম। গাড়িতে বলভদ্র, আমি, ড্রাইভার কিরপান সিং, আর তার পাশে একজন ভুটিয়া, সে পথ দেখাবে। রাস্তা অতি খারাপ, দু বার টায়ার পাংচার হল, তিন মাইল যেতেই বেলা এগারোটা বাজল। গরম বেশ, খিদেও পেয়েছে খুব, আমরা বিশ্রামের উপযুক্ত জায়গা খুঁজছি, এমন সময় দেখতে পেলুম গাছের আড়ালে একটি সুন্দর ছোট বাংলা। আমরা একটু এগিয়ে যেতেই সেই বাংলা থেকে একটি অপূর্ব সুন্দরী বেরিয়ে এলেন। নিখুঁত গড়ন, খুব ফরসা, তবে নাক একটু খাঁদা আর চোখ পটল—চেরা নয়, লংকা—চেরা বলা যেতে পারে। আমরা নমস্কার করে নিজেদের পরিচয় দিলুম। সুন্দরী জানালেন, তাঁর নাম মায়াবতী কুরুঞ্জি, এখন একলাই আছেন, তাঁর সঙ্গিনী মাসীমা চাকরকে নিয়ে কিমাপুরের হাটে গেছেন। মায়াবতী খাঁটী বাংলাতেই কথা বললেন, তবে উচ্চারণে একটু আসামী টান টের পাওয়া গেল তাঁর সাদর আহ্বানে কৃতার্থ হয়ে আমরা আতিথ্য স্বীকার করলাম।
বলভদ্র মর্দরাজের ভঙ্গী দেখে বোঝা গেল সে প্রথম দর্শনেই প্রচণ্ড প্রেমে পড়েছে, তার কথার সুরে গদগদ ভাব ফুটে উঠেছে। আমাদের ভুটিয়া গাইড লাদেন গাম্পা চুপি চুপি আমাকে বলল, ওই মেমসাহেবটা ভাল নয়, পালিয়ে চলুন এখান থেকে। কিন্তু তার কথা কে গ্রাহ্য করে। বলভদ্র প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আর আমিও মুগ্ধ হয়ে গেছি।
মায়াবতী আমাদের খুব সৎকার করলেন। বললেন, আঠারো—শিঙা হরিণের সীজন এখন নয়, তারা শীতকালে পাহাড় থেকে নেমে আসে। মিস্টার মর্দরাজ আর মিস্টার চৌধুরী যদি দু মাস পরে আসেন তখন নিশ্চয় শিকার মিলবে। আমরা বহু ধন্যবাদ এবং আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদায় নিলুম।
পথে গোটাকতক পাখি মেরে আমরা কিমাপুরে ডাকবাংলায় ফিরে এলুম। তার পর দিন বলভদ্র আবার মায়াবতীর কাছে গেল, শরীরটা একটু খারাপ হওয়ায় আমি বাংলাতেই রইলুম। অনেক বেলায় ফিরে এসে বলভদ্র বলল, শোন শীতলবাবু, আমি ওই মিস মায়াবতীকে বিয়ে করব, পনেরো দিন পরে ওকে নিয়ে কলকাতায় যাব। তুমি কালই চলে যাও, বালিগঞ্জে একটা ভাল বাড়ি ঠিক করে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করবে। আমি অনেক বোঝালুম, অজ্ঞাতকুলশীলাকে হঠাৎ বিয়ে করা উচিত নয়, তার বাবাও তা পছন্দ করবেন না। কিন্তু বলভদ্র কোনও কথা শুনল না, অগত্যা আমি পরদিনই কলকাতায় রওনা হলুম।
পনরো দিন পরে বলভদ্রের ড্রাইভার কিরপান সিং আমার কাছে এসে খবর দিল—বলভদ্র হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়েছে, কোথায় গেছে কেউ জানে না, মেমসাহেব মায়াবতীও বলতে পারলেন না। জেরা করে জানলুম, চার দিন আগে গাড়িটা বিগড়ে যাওয়ায় বলভদ্র সকালবেলা মায়াবতীর কাছে হেঁটে গিয়েছিল। মনিব ফিরে এলেন না দেখে পরদিন কিরপান সিং খোঁজ নিতে গেল। গিয়ে দেখল, সেখানে শুধু মায়াবতী আর তাঁর বুড়ী মাসী আছেন। তাঁরা বললেন, বলভদ্র গতকাল সকালে এসেছিলেন বটে, কিন্তু এখান থেকে কোথায় গেছেন তা তাঁরা জানে না। কিরপান সিং আরও দেখল, একটি বাদামী রঙের নধর ভেড়া বারান্দার খুঁটির সঙ্গে বাঁধা আছে, একটা ধামা থেকে ভিজে ছোলা খাচ্ছে।
সুরুচি বলল, শীতুমামা, আপনি কি বলতে চান, সেই ভেড়াটাই বলভদ্র মর্দরাজ?
—আমি কিছুই বলতে চাই না। যা শুনেছি তাই হুবহু জানালাম, বিশ্বাস করা না করা তোমাদের মর্জি।
নুটু বলল, শীতুমামা, ভেড়াটা ছোলা খাচ্ছিল কেন? সেখানে বুঝি ঘাস নেই?
ইলা বলল, বুঝলি না খোকা, গ্রাম—ফেড মটন তৈরি হচ্ছিল। উঃ আপনি খুব বেঁচে গেছেন শীতুমামা।
এই সময়ে সুরুচির স্বামী বীরেন দত্ত এবং তার সঙ্গে দুটি মহিলা এসে পৌঁছুলেন। খাবারের ঝুড়ি নিয়ে দুজন অনুচরও এল। মহিলাদের একজনের বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি, আর একজনের বাইশ—তেইশ। দুজনেই অসাধারণ সুন্দরী, যদিও চোখ আর নাক একটু মঙ্গোলীয় ছাঁদের।
বীরেন দত্ত পরিচয় করিয়ে দিল— ইনি হচ্ছেন সুকোমল গুপ্তর শাশুড়ী ঠাকরুন মিসিস মায়াবতী মর্দরাজ, আর ইনি সুকোমলের স্ত্রী মিসিস মোহিনী গুপ্ত। আমাদের আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে, এঁরা অনেক রকম খাবার তৈরি করলেন কিনা।
ইলা ফিসফিস করে বলল, শীতুমামা, এই মায়াবতীই আপনার সেই তিনি নাকি?
শীতুমামা বললেন চুপ চুপ।
নিকুঞ্জ ঘোষ জিজ্ঞাসা করলেন, কই, মেজর গুপ্ত এলেন না?
মধুর কণ্ঠে মোহিনী গুপ্ত বললেন, সুকোমল? তার কথা আর বলবেন না, পুওর ফেলো। কোথায় উধাও হয়েছে কিছুই জানি না।
আঁতকে উঠে ইলা ফিসফিস করে বলল, কি সর্বনাশ!
মায়াবতী বললেন, মিলিটারী সার্ভিসের মতন ওঁচা চাকরি আর নেই, হঠাৎ একটা টেলিগ্রাম পেয়ে কিছু না জানিয়েই চলে গেছে। আপনারা খেতে বসে যান, নয়তো সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। মোহিনী আর আমি পরিবেশন করছি।
বীরেন দত্ত বলল, শীতুমামা, সব জিনিস নির্ভয়ে খেতে পারেন। আপনি মন্ত্র নিয়েছেন, নিষিদ্ধ মাংস এখন আর খান না, তাই এঁরা চিকেন বাদ দিয়েছেন। কাটলেট ফ্রাই পাই চপ শিককাবাব সবই পবিত্র ভেড়ার মাংসে তৈরি, এঁদের স্পেশালিটিই হল ভেড়া। হেঁ হেঁ হেঁ, এঁরা কামরূপ—কামিখ্যের মহিলা কিনা।
ইলা বলল, ওরে মা রে!
নিকুঞ্জ ঘোষ বললেন, কই আপনারা কিছু নিলেন না?
মায়াবতী স্মিতমুখে বললেন, আমরা একটু আগেই খেয়েছি।
শিউরে উঠে ইলা বলল, ইঁ হিঁ হিঁ, ওরে বাবা রে!
হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে সুরুচি বলল, আমার গা গুলুচ্ছে, গঙ্গার ধারে বসি গিয়ে।
ঊর্মিলা বললেন, আমারও কেমন কেমন বোধ হচ্ছে, আমিও যাই।
ইলাও তার মায়ের সঙ্গে গেল।
বীরেন ব্যস্ত হয়ে পিছনে পিছনে গিয়ে বলল, এঁরা ছ বোতল সোডাও এনেছেন, একটু খাও, নশিয়া কেটে যাবে।
সুরুচি বলল, ওআক থু! রাক্কুসীদের জলস্পর্শ করব না।
বাড়ি ফিরে এসে সব কথা শুনে বীরেন বলল, ছি ছি, কি কেলেঙ্কারি করলে তোমরা! এই জন্যেই শাস্ত্রে বলেছে স্ত্রীবুদ্ধি প্রলয়ংকরী। শীতুমামার গাঁজাখুরী গল্পটা বিশ্বাস করলে। উনি নিজে তো গাণ্ডেপিণ্ডে খেয়েছেন।
১৮৭৮ শক (১৯৫৬)
কাশীনাথের জন্মান্তর
প্রায় দেড় শ বৎসর আগেকার কথা। তখন কলকাতার বাঙালী হিন্দুসমাজের নানারকম পরিবর্তন আরম্ভ হয়েছে কিন্তু তার কোনও লক্ষণ রাঘবপুর গ্রামে দেখা দেয় নি, কাশীনাথ সার্বভৌম সেই গ্রামের সমাজপতি, দিগগজ পণ্ডিত, যেমন তাঁর শাস্ত্রজ্ঞান তেমনি বিষয়বুদ্ধি। তাঁর সন্তানরা কলকাতা হুগলি বর্ধমান কৃষ্ণনগর মুরশিদাবাদ প্রভৃতি নানা স্থানে ছড়িয়ে আছে, কিন্তু তিনি নিজে তাঁর গ্রামেই থাকেন, জমিদারি দেখেন, তেজারতি আর দেবসেবা করেন, একটি চতুষ্পাঠীরও ব্যয় নির্বাহ করেন।
একদিন শেষরাত্রে তিনি স্বপ্ন দেখলেন, তাঁর ইষ্টদেবী কালীমাতা আবির্ভূত হয়ে বলছেন, বৎস কাশীনাথ, তোমার বয়স শত বর্ষ অতিক্রম করেছে, তুমি সুদীর্ঘকাল ইহলোকের সুখদুঃখ ভোগ করেছ। আর কেন, এখন দেহরক্ষা কর।
কাশীনাথ বললেন, মা কৈবল্যদায়িনী, এখন তো মরতে পারব না। আমার জাজ্বল্যমান সংসার, চতুর্থ পক্ষের স্ত্রী এখনও বেঁচে আছেন। আঠারোটি পুত্রকন্যা, এক শ পঁচিশটি পৌত্র পৌত্রী দৌহিত্র দৌহিত্রী। প্রপৌত্র প্রদৌহিত্র প্রভৃতি বোধ হয় হাজার খানিক জন্মেছিল, তাদের অনেকে মরেছে কিন্তু এখনও প্রচুর জীবিত আছে। তাছাড়া বিস্তর শিষ্য আমার চতুষ্পাঠীতে পড়ে, আমি তাদের পালন ও অধ্যাপনা করি। এই সব স্নেহভাজনদের ত্যাগ করা অতীব কষ্টকর। তোমার জন্য একটি বৃহৎ মন্দির নির্মাণের সংকল্প করেছি, তাও উদযাপন করতে হবে। কলকাতার কিরিস্তানী অনাচার যদি এই গ্রামে প্রবেশ করে তবে আমাকেই তা রোধ করতে হবে। আমার ছেলেদের দিয়ে কিছু হবে না, তারা স্বার্থপর, নিজেদের ধান্দা নিয়েই ব্যস্ত। বয়স বেশী হলেও আমার শরীর এখনও শক্ত আছে। অতএব কৃপা করে আরও দশটি বৎসর আমাকে বাঁচতে দাও।
কালীমাতা, ভ্রূকুটি করে অন্তর্হিত হলেন।
পরদিন প্রাতঃকালে কাশীনাথ সার্বভৌমের চতুর্থ পক্ষের পত্নী রাসেশ্বরী বললেন, আজ যে তোমার তিনটি প্রপৌত্রপুত্র আর পাঁচটি প্রদৌহিত্রপুত্রের অন্নপ্রাশন, তার হুঁশ আছে? তুমি চট করে স্নান আহ্নিক সেরে এস, তোমাকেই তো হোমযাগ করতে হবে।
গঙ্গায় স্নান করে এসে কাতরকণ্ঠে কাশীনাথ বললেন, সর্বনাশ হয়েছে গিন্নী, কালসর্প আমাকে দংশন করেছে, আমার মৃত্যু আসন্ন। মা করালবদনী, এ কি করলে, হায় হায়, সংকল্পিত কর্ম সমাপ্ত না হতেই আমাকে পরলোকে পাঠাচ্ছ!
শাস্ত্রে বলে, যার যেমন ভাবনা তার তেমনি সিদ্ধিলাভ হয়। কাশীনাথ যদি শ্রীরামপুরের পাদরীদের কবলে পড়ে খ্রীষ্টান হতেন তবে মৃত্যুর পর শেষ বিচারের প্রতীক্ষায় তাঁকে সুদীর্ঘকাল জড়ীভূত হয়ে থাকতে হত, সরীসৃপাদি যেমন শীতকালে থাকে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে তিনি অতি নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন, সেজন্য তাঁর পারলৌকিক পরিণাম অবিলম্বে সংঘটিত হল।
মৃত্যুর পরেই কাশীনাথ উপলব্ধি করলেন, তিনি সূক্ষ্ম শরীর ধারণ করে শূন্যে অবস্থান করছেন, তাঁর প্রাণহীন দেহ অঙ্গনে তুলসীমঞ্চের সম্মুখে পড়ে আছে। তাঁর পত্নী আর আত্মীয়বর্গ চারিদিকে বিলাপ করছেন, প্রতিবেশীরা বলছেন, ওঃ, একটা ইন্দ্রপাত হল! ক্ষণকাল পরেই তিনি প্রচণ্ড বেগে ব্যোমমার্গে দক্ষিণ দিকে বাহিত হয়ে যমলোকে উপনীত হলেন।
যম বললেন, এস হে কাশীনাথ। তোমার সুকৃতি—দুষ্কৃতির বিচার এবং তদুপযুক্ত ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি, সংক্ষেপে বলছি শোন। পুণ্যকর্মের তুলনায় তোমার পাপকর্ম অল্প। রামগতি ভট্টাচার্যের জমির কিয়দংশ তুমি অন্যায় ভাবে দখল করেছিলে, তিন বার আদালতে মিথ্যা হলফ করেছিলে, প্রথম ও মধ্য বয়সে বন্ধুপত্নী ও বধুস্থানীয় কয়েক জনের প্রতি কুদৃষ্টিপাত করেছিলে, মুষিকের ন্যায় অজস্র সন্তান উৎপাদন করেছিলে, অন্তিম কাল পর্যন্ত বিষয়চিন্তায় মগ্ন ছিলে। এ ছাড়া আর যা করেছ সবই সৎকার্য। নিয়মিত দুর্গোৎসবাদি করেছ, গঙ্গাস্নান তীর্থভ্রমণ বারব্রতাদি এবং ব্রাহ্মণের যাবতীয় কর্তব্য পালন করেছ, কদাপি অখাদ্য ভোজন করনি। দুষ্কৃতির জন্য তুমি পঞ্চাশ বৎসর নরকবাস করবে, তারপর পুণ্যকর্মের ফল স্বরূপ এক শত বৎসর স্বর্গাবাস করবে। আচ্ছা, এখন যাও, কর্মফল ভোগ কর গিয়ে।
নির্দিষ্ট কাল নরকভোগ আর স্বর্গভোগের অন্তে কাশীনাথ পুনর্বার যমসকাশে আহুত হলেন। যম বললেন, ওহে কাশীনাথ, তোমার প্রাক্তন কর্মের ফলভোগ সমাপ্ত হয়েছে, এখন তোমাকে পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে। বিধাতা তোমার উপর প্রসন্ন, তুমি অভীষ্ট কুলে জন্মগ্রহণ করতে পারবে। বল, কি প্রকার জন্ম চাও, ধনী বণিকের বংশধর হয়ে, না দরিদ্র জ্ঞানী ধর্মাত্মার পুত্র রূপে, না শুচীনাং শ্রীমতাং গেহে?
কাশীনাথ উত্তর দিলেন, ধর্মরাজ, মৃত্যুকালে আমার অনেক কামনা অতৃপ্ত ছিল। দয়া করে এই ব্যবস্থা করুন যাতে আমার বর্তমান বংশধরের গৃহেই প্রত্যাবর্তন করতে পারি। আমার প্রপৌত্রের পুত্র শ্রীমান ভবানীচরণ আমার অতিশয় স্নেহভাজন ছিল, তারই সন্তান করে আমাকে ধরাধামে পাঠান।
যম বললেন, কি বলছ হে কাশীনাথ! জীবিত কালেই তুমি অধস্তন পাঁচ পুরুষ পর্যন্ত দেখেছিলে। তোমার মৃত্যুর পর দেড় শ বৎসর কেটে গেছে, তাতে আরও ছ পুরুষ হয়েছে। এখন যে বংশধর সে তোমার সপিণ্ডও নয়, তার সঙ্গে তোমার কতটুকু সম্পর্ক? তার পুত্র হয়ে জন্মালে তোমার কি লাভ হবে? আরও তো ভাল ভাল বংশ আছে।
কাশীনাথ বললেন, প্রভু, দয়া করে সেই অধস্তন একাদশসংখ্যক বংশধরের গৃহেই আমাকে পাঠিয়ে দিন। ব্যবধান যতই থাকুক, সে আমার তথা শ্রীমান ভবানীচরণের সন্তান, অতীব স্নেহের পাত্র। তাকে দেখবার জন্য আমি উৎকণ্ঠ হয়ে আছি।
—তুমি তাকে চিনবে কী করে? তোমার বর্তমান স্মৃতি তো থাকবে না, জ্ঞানহীন ক্ষুদ্র শিশু রূপে প্রসূত হয়ে তুমি ক্রমে ক্রমে বড় হবে, জ্ঞানার্জনও করবে, কিন্তু বিগত কালের সঙ্গে তোমার নবজীবনের যোগ থাকবে না।
—প্রভু, আমার প্রার্থনাটি অবধান করুন। নারীগর্ভে ন মাস দশ দিন বাস করার পর শিশু রূপে ভূমিষ্ঠ হতে আমি চাই না। জ্ঞানবান জাতিস্মর করেই আমাকে পাঠিয়ে দিন।
—মরবার সময় তোমার বয়স এক শ বৎসরের কিঞ্চিৎ অধিক হয়েছিল। সেই বয়স নিয়েই জন্মাতে চাও নাকি?
—আজ্ঞে না। জরাজীর্ণ স্থবির হয়ে যদি পৃথিবীতে যাই তবে নবজন্ম কদিন ভোগ করব? আমাকে পঁচিশ—ত্রিশ বৎসরের যুবা করে পাঠিয়ে দিন।
—তোমার আকাঙ্ক্ষা অতি অদ্ভুত। গর্ভবাস করবে না, যুবা রূপে নবজন্ম লাভ করবে, পূর্বস্মৃতি বিদ্যমান থাকবে, বর্তমান বংশধরের গৃহে অকস্মাৎ অবতীর্ণ হবে। এই তো তুমি চাও?
—আজ্ঞে হ্যাঁ।
—আচ্ছা, তাই হবে। দেখাই যাক না এর ফল কি হয়। তোমার গোত্র কি?
—ভরদ্বাজ।
যমরাজ মুহূর্তকাল ধ্যানমগ্ন হয়ে রইলেন, তারপর বললেন, ধরাধামে অনেক সামাজিক পরিবর্তন হয়েছে। তুমি যদি স্বাভাবিক নিয়মে শিশু রূপে ভূমিষ্ট হতে তবে ক্রমে ক্রমে বর্তমান অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যেতে। কিন্তু অদৃষ্টপূর্ব সমাজে হঠাৎ অবতরণের ফলে সংকটে পড়বে। তোমার অসুবিধা যাতে অত্যাধিক না হয় তার জন্য আমি যথাসম্ভব ব্যবস্থা করছি।
যম তাঁর এক অনুচরকে বললেন, আজ দ্বিপ্রহর রাত্রিতে এই জীবাত্মা ত্রিশ বৎসরের যুবা রূপে ধরাধামে ফিরে যাবে। একে পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক ভাষা শিখিয়ে দাও, সেই সঙ্গে কিঞ্চিৎ অপভ্রষ্ট ইংরেজী আর হিন্দীও। বর্তমান কালের উপযুক্ত পরিচ্ছদ, নিতান্ত প্রয়োজনীয় অন্যান্য বস্তু, এবং প্রচুর অর্থও একে দেবে। একটি নিষ্ক্রান্তি বটিকাও দেবে। তারপর কলিকাতা নগরীতে নিয়ে গিয়ে শ্রীমধুসূদন রোডে তিন নম্বর বাড়ির ফটকের সামনে একে সুপ্ত অবস্থায় রেখে দেবে। ওহে কাশীনাথ, তোমার বংশধর চক্রধর মুখুজ্যের কাছে তোমাকে পাঠাচ্ছি। তোমার পূর্বনামই বজায় থাকবে। যদি দেখ যে বর্তমান সমাজব্যবস্থা তোমার পক্ষে কষ্টকর, কিছুতেই তুমি সইতে পারছ না, তবে নিষ্ক্রান্তি বটিকাটি খেয়ো। তা হলে তৎক্ষণ যমলোকে ফিরে আসবে এবং অবিলম্বে পুনর্বার সনাতন রীতিতে জন্মগ্রহণ করবে।
চক্রধর মুখুজ্যে ধনী লোক, বাস্তুবিবর্ধন করপোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, তিন নম্বর শ্রী মধুসূদন রোডে তাঁর প্রকাণ্ড বাড়ি। সকালে আটটার আগে তিনি বিছানা ছেড়ে ওঠেন না, কিন্তু আজ ভোর বেলায় তাঁর স্ত্রী সরূপা ঠেলা দিয়ে তাঁর ঘুম ভাঙিয়ে দিলেন। চক্রধর জিজ্ঞাসা করলেন, কি হয়েছে?
—নীচে গোলমাল হচ্ছে শুনতে পাচ্ছ না? বারান্দায় দাঁড়িয়ে খোঁজ নাও কি হয়েছে। আমার বাপু ভয় করছে।
চক্রধর বারান্দা থেকে দেখলেন গেটের সামনে অনেক লোক জমা হয়ে কলরব করছে। প্রশ্ন করলেন, কি হয়েছে লালবাহাদুর?
দারোয়ান লালবাহাদুর বলল, কে একজন বাবু ফটকের সামনে রাস্তার উপর পড়ে আছে, বেঁচে আছে কি মরে গেছে বোঝা যাচ্ছে না।
নেমে এসে চক্রধর দেখলেন, তাঁর বাড়ির ফটকের ঠিক বাইরে একটা চামড়ার ব্যাগ মাথায় দিয়ে আগন্তুক বেহুঁশ হয়ে শুয়ে আছে। বার কতক জোর ঠেলা দিতেই লোকটি মিটমিট করে তাকাল তারপর আস্তে আস্তে উঠে হাই তুলে তুড়ি দিয়ে বলল, তারা ব্রহ্মময়ী করালবদনী, কোথায় আনলে মা?
চক্রধর বললেন,কে হে তুমি? এখন নেশা ছুটেছে? কি খেয়েছিলে, মদ না চণ্ডু?
—আমি শ্রীকাশীনাথ মুখোপাধ্যায় সার্বভৌম, আবার এসে পৌঁছেছি। তুমিই চক্রধর? শ্রীমান ভবানীচরণের বংশধর? আহা, কত বড়টি হয়েছ! ঘরে চল বাবাজী, সব কথা বলছি।
কাশীনাথের আত্মকথা শুনে চক্রধর স্থির করলেন, লোকটা নেশাখোর নয়, মিথ্যাবাদী জুয়াচোরও নয়, কিন্তু এর মাথা খারাপ। প্রশ্ন করলেন, তোমার ওই ব্যাগে কি আছে?
—তা তো জানি না, তুমিই খুলে দেখ। এই যে, আমার পইতেতে চাবি বাঁধা রয়েছে, খুলে নাও।
চক্রধর ব্যাগ খুললেন। গোটাকতক ধুতি গেঞ্জি পাঞ্জাবি, একটা এণ্ডির চাদর, একজোড়া চটি, একটা গামছা, আরশি চিরুনি ইত্যাদি। নীচে একটা পোর্টফোলিও। সেটা খুলে চক্রধর আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, প্রায় পাঁচ লাখ টাকার গভর্নমেণ্ট কাগজ এবং ভাল ভাল শেয়ার, নগদ দু হাজার টাকার নোট আর দশ টাকার আঁধুলি সিকি আনি ইত্যাদি।
—সব তোমারই নামে দেখছি। কি করে পেলে।
—কিছুই জানি না বাবাজী, সবই জগদম্বার লীলা আর যমরাজের ব্যবস্থা।
চক্রধর অনেকক্ষণ ভাবলেন। লোকটি পাগল হলেও গুছিয়ে কথা বলে। একে হাতছাড়া করা চলবে না, বাড়িতেই রাখতে হবে, চিকিৎসাও করাতে হবে। বয়স তো বেশী নয়, বড় জোর ত্রিশ। তাঁর একমাত্র মেয়ের বিবাহ হয়ে গেছে, কিন্তু তাঁর ভাইঝি তো রয়েছে! এই কাশীনাথের সঙ্গে বিয়ে দিলে সেই বাপ—মা—মরা মেয়েটার একটা চমৎকার গতি হয়ে যায়। পাঁচ লাখ টাকার ইনভেস্টমেণ্ট কি সোজা কথা! লোকটা যদি তিন বৎসর আগে আসত তবে চক্রধর নিজের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিতেন।
চক্রধর বললেন, শোন হে কাশীনাথ। তুমি আমার পূর্বপুরুষ হলেও আপাতত আমার চাইতে অনেক ছোট, তোমার বয়স বোধ হয় ত্রিশ হবে, আর আমার হল গিয়ে ষাট। তোমার ইতিহাস আমি জানলুম, কিন্তু আর কাকেও ব’লো না, লোকে তোমাকে পাগল ভাববে। তুমি আমার জ্ঞাতি, ছেলেবেলায় তোমাদের পাড়াগাঁ থেকে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে পালিয়েছিলে, এখন সন্ন্যাসে অরুচি হওয়ায় আমার আশ্রয়ে এসেছ, এই তোমার পরিচয়! তুমি আমাকে বলবে কাকাবাবু, আমি তোমাকে বলব কাশী বাবাজী। তোমার সম্পত্তির কথা খবরদার কাকেও বলবে না, বুঝলে?
কাশীনাথ বললেন, হাঁ বুঝেছি। কিন্তু তোমার বাড়ীতে আমি থাকব কি করে? তুমি তো দেখছি স্লেচ্ছ হয়ে গেছ। পেঁয়াজের গন্ধ পাচ্ছি, পাশের জমিতে মুরগী চরছে। একটি প্রৌঢ়াকে দেখলুম, চটি জুতো পরে চটাং চটাং করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল, ঘোমটা নেই, প্যাঁটপ্যাঁট করে আমার দিকে চাইল।
—উনি তোমার কাকীমা।
—ও তা বেশ। কিন্তু স্ত্রীলোক জুতো পরে কেন? ঘোর কলি।
—ঠিক বলেছ বাবাজী, ঘোর কলি। এই কলিযুগের সঙ্গেই তোমাকে মানিয়ে চলতে হবে।
—তুমি বোধ হয় মুসলমান বাবুর্চীর রান্না খাও? তা আমি মরে গেলেও খেতে পারব না।
—না, না, বাবুর্চী আছে বটে, কিন্তু মুসলমান নয়, হরিজন, জাতে চামার।
—রাধামাধব! আমি স্বপাকে খাব, আজ শুধু ফলার। আমার থাকবার আলাদা ব্যবস্থা করে দাও।
—বেশ তো, আমার বাড়ির নীচের তলায় পূর্ব দিকের অংশে তুমি থাকবে, এক বারে আলাদা আর নিরিবিলি।
চক্রধর ডাকলেন, চন্দনা, ও চন্দনা।
একটি মেয়ে ঘরে এল। চক্রধর বললেন, এটি আমার ভাইঝি। প্রণাম কর রে, ইনি তোর কাশী দাদা, দূর সম্পর্কে আমার ভাইপো!
চন্দনা প্রণাম করে চলে গেল। কাশীনাথ বললেন, তোমাদের কাণ্ড কিছুই বুঝতে পারছি না। মেয়েটার মাথায় সিঁদুর নেই কেন? কপাল পুড়েছে নাকি।
চক্রধর বললেন, না, না, ওর বিয়েই হয়নি। খুব ভাল মেয়ে, বি.এ. পাস করেছে।
—দুর্গা দুর্গা! এত বড় ধাড়ী মেয়ের বিবাহ হয় নি? বিবি বানাচ্ছ দেখছি।
—আচ্ছা কাশীনাথ, তোমার বিবাহের মতলব আছে তো?
—আছে বইকি। একজন ভাল ঘটক লাগাও।
—আমার ভাইঝি এই চন্দনাকে বিয়ে কর না?
—তুমি উন্মাদ হলে নাকি চক্রধর? এক গোত্রে বিবাহ হবে কি করে? তা ছাড়া ও রকম বেয়াড়া স্ত্রী আমার পোষাবে না। সদবংশের লজ্জাবতী নিষ্ঠাবতী মেয়ে চাই। বিদ্যার দরকার নেই, রান্না আর ঘরকন্নার সব কাজ জানবে, বারব্রত পালন করবে, তোমার গিন্নী আর ভাইঝির মতন ধিঙ্গী হলে চলবে না।
—মুশকিলে ফেললে কাশীনাথ। তুমি যেরকম পাত্রী চাও তেমন মেয়ে ভদ্র ঘরে আজকাল লোপ পেয়েছে। আচ্ছা, যতটা সম্ভব তোমার পছন্দসই পাত্রীর জন্যে আমি চেষ্টা করব। এখন তুমি স্নান আর সন্ধ্যা—আহ্নিক সেরে আহারাদি কর।
চক্রধর মুখুজ্যে ভাবতে লাগলেন। লোকটা পাগল, কিন্তু কথাবার্তা অসংলগ্ন নয়, সেকেলে মতিগতি হলেও বুদ্ধিমান বলা চলে। আশ্চর্য ব্যাপার, কাশীনাথ অত টাকা পেল কোথা থেকে? যাই হক, ওকে আটকে রাখতে হবে, সম্পত্তি যাতে আমার কাছেই গচ্ছিত রাখে তার ব্যবস্থা করতে হবে। চন্দনার সঙ্গে বিয়ে হলে খাসা হত, একেবারে আমার হাতের মুঠোয় এসে পড়ত। ওর পছন্দমত পাত্রীই বা পাই কোথায়? সেকেলে নিষ্ঠাবতী মেয়ে হবে, পাগল স্বামীকে সামলাবে, আবার আমার বশে চলবে। হঠাৎ চক্রধরের মাথায় একটা বুদ্ধি এল? আচ্ছা, গয়েশ্বরীর সঙ্গে বিয়ে দিলে হয় না? তার তো খুব নিষ্ঠা আর আচার—বিচার, বুদ্ধি খুব, আমাকেও খাতির করে, সব বিষয়ে আমার মত নেয়। টাকার লোভে কাশীনাথকে বিয়ে করতে হয়তো রাজী হবে। কিন্তু বয়সের তফাতটা যে বড্ড বেশী।
গয়েশ্বরী সম্পর্কে চক্রধরের ভাগনী, জেঠতুতো বোনের মেয়ে। বয়স প্রায় পঞ্চাশ হলেও এখনও তিনি কুমারী। বাপ মা অল্প বয়সে মারা গেলে চক্রধরই অভিভাবক হয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে ভাগনীর তত্ত্বাবধান বেশী দিন করতে হয় নি। গয়েশ্বরী অসাধারণ মহিলা, অল্প লেখাপড়া আর নানা রকম শিল্পকর্ম শিখেই তিনি স্বাবলম্বিনী হলেন। তাঁর নারীবস্ত্রশালা খুব লাভের ব্যবসা। পাঁচজন উদবাস্তু মেয়ে আর দুজন দরজী গয়েশ্বরীর দোকানে কাজ করে, তিনটে সেলাই—এর কল চলে, খদ্দেরের খুব ভিড়। চক্রধর অনেক বার ভাগনীর বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু গয়েশ্বরী বলেছেন, ও সব হবে না, আমি কত কষ্ট করে ব্যবসাটি খাড়া করেছি, আর এখন একটা উটকো মিনসে এসে কর্তামি করবে তা আমি সইব না। চক্রধর স্থির করলেন, খুব সাবধানে কথাটা পাত্র আর পাত্রীর কাছে পাড়তে হবে।
দৈবক্রমে চার দিন পরেই কাশীনাথ আর গয়েশ্বরীর একটা সংঘর্ষ হয়ে গেল।
চক্রধরের বাড়ির একতলায় পূর্বদিকের অংশে কাশীনাথ স্বতন্ত্র হয়ে বাস করতে লাগলেন। তিনি স্বপাকে খান, চক্রধরের একজন পুরনো চাকর তাঁর ফরমাশ খাটে। একদিন সকালবেলা প্রাতঃকৃত্য সেরে কাশীনাথ গড়িয়াহাট মার্কেটে বাজার করতে গেছেন। জামাইষষ্ঠীর জন্যে সেদিন বাজারে খুব ভিড়। কাশীনাথ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ভাবছিলেন, এ যে ঘোর কলি, বারো আনা সের বেগুন! সব জিনিসই অগ্নিমূল্য, দেশে মন্বন্তর হয়েছে নাকি? কাশীনাথ দুটি কাঁচকলা কিনবেন বলে ভিড়ের মধ্যে সাবধানে অগ্রসর হচ্ছিলেন এমন সময় অকস্মাৎ থপাস করে গয়েশ্বরীর সঙ্গে তাঁর কলিশন হল।
কাশীনাথের অপরাধ নেই। তিনি রোগা বেঁটে মানুষ, পিছনের ভিড়ের ঠেলা সামলাতে না পেরে সামনের দিকে পড়ে যাচ্ছিলেন। ঠিক সেই সময় গয়েশ্বরী উল্টোদিক থেকে আসছিলেন। তিনি স্থূলকায়া, সুতরাং তাঁর দেহেই পতনোন্মুখ কাশীনাথের ধাক্কা প্রতিহত হল। গয়েশ্বরী পড়ে গেলেন না, অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, আ মরণ ছোঁড়া, নেশা করেছিস নাকি? ভদ্রলোকের মেয়ের গায়ে ঢলে পড়িস এতদূর আস্পর্ধা!
কাশীনাথ বললেন, ক্ষমা করবেন ঠাকরুন, ভিড়ের চাপে এমন হল, আমি ইচ্ছে করে অপরাধ করি নি।
গয়েশ্বরী বললেন, একশ বার অপরাধ করেছিস, হতভাগা বেহায়া বজ্জাত!
এক দল লোক গয়েশ্বরীর পক্ষ নিয়ে এবং আর এক দল কাশীনাথের হয়ে তুমুল ঝগড়া আরম্ভ করল। গয়েশ্বরীকে অনেকেই চেনে। একজন টিকিধারী পুরুত ঠাকুর বললেন, ও গয়া দিদি, ব্যাপারটি তো সোজা নয়, তোমাকে প্রায়শ্চিত্তির করতে হবে।
চার—পাঁচ জন চিৎকার করে বলতে লাগল, নিশ্চয় নিশ্চয়। তুমি লোকটা কে হে, পাড়াগাঁ থেকে এসেছ বুঝি! ধাক্কা লাগাবার আর মানুষ পেলে—না, গয়েশ্বরী দেবীর গায়ে ঢলে পড়লে কোন আক্কেলে? এক্ষুনি বার কর পঞ্চাশটি টাকা, প্রায়শ্চিত্তের খরচ, নইলে তোমার নিস্তার নাই।
এইসময়ে চক্রধরের চাকর এসে পড়ায় কাশীনাথ বেঁচে গেলেন। পুরুত ঠাকুরটি বললেন, তা বেশ তো, গয়া দিদি আর এই কাশীনাথ ছোকরা দুজনেই যখন চক্রধরবাবুর আপনার লোক তখন তিনিই একটা মীমাংসা করবেন।
চক্রধর মুখুজ্যে বোঝেন যে তপ্ত অবস্থায় ঘা দিলেই লোহার সঙ্গে লোহা জুড়ে যায়। তিনি কালবিলম্ব না করে প্রথমে তাঁর ভগিনীকে প্রস্তাবটি জানালেন। গয়েশ্বরী আশ্চর্য হয়ে বললেন, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে নাকি মামা? চক্রধর সবিস্তারে জানালেন, লোকটা বাতিকগ্রস্ত হলেও ভালমানুষ, সহজেই পোষ মানবে, আর তার বিস্তর টাকাও আছে। বয়স কম তাতে হয়েছে কি? আজকাল ও সব কেউ ধরে না। গয়েশ্বরী অতি বুদ্ধিমতী মহিলা, মামার প্রস্তাবটি সহজেই তাঁর হৃদয়ংগম হল। পরিশেষে বললেন, তা ও ছোঁড়া যদি রাজী হয় তো আমার আর আপত্তি কি, লোকে কি বলবে তা আমি গ্রাহ্য করি না।
কাশীনাথ অত সহজে বাগ মানলেন না। বললেন, কি পাগলের মতন বলছ চক্রধর কাকা! গয়েশ্বরীর বয়স যে আমার প্রায় ডবল। সেকালে কুলীন কন্যার অমন বিবাহ হত বটে, কিন্তু আমি তো পেশাদার পাণিগ্রাহী নই।
চক্রধর বললেন, বেশ করে সব দিক ভেবে দেখ কাশী বাবাজী। মেয়েটি অতি নিষ্ঠাবতী, সব রকম বারব্রত পালন করে, মায় আমড়া—ষষ্ঠী পর্যন্ত। দরজীর দোকান চালায় বটে, কিন্তু ওর চালচলন তোমারই মতন সেকেলে। দোকানটা তোমারই হাতে আসবে, তোমার আয় বেড়ে যাবে!
—কিন্তু বয়সের যে আকাশ—পাতাল তফাত।
—খুব ঠিক কথা। তোমার ইতিহাস যা বলেছ তাতে তোমার আসল বয়েস এখন দু শ পঞ্চাশের বেশী, আর গয়েশ্বরীর মোটে উনপঞ্চাশ। তোমার তুলনায় ও তো খুকী। আরও বুঝে দেখ, তোমার শরীরটাই জোয়ান, কিন্তু মনটা দু সেঞ্চুরি পিছিয়ে আছে। গয়েশ্বরীর সঙ্গে তোমার মনের মিল সহজেই হবে। আরও একটা কথা, আধুনিক পণ্ডিতরা বলেন, মেয়েদের পূর্ণযৌবন হয় পঞ্চাশের পরে। মর্তমান কলা খেয়েছ তো? পাকলেই সুতার হয় না। যার খোসাটি কালচিটে হয়ে কুঁচকে গেছে, শাঁসটি মজে গিয়ে একটু নরম হয়েছে, সেই পরিপক্ক কলাই অমৃত। মেয়েরাও সেই রকম। এখনকার পঞ্চাশীর কাছে তোমাদের সেকেলে ষোড়শী—টোড়শী দাঁড়াতেই পারে না।
চক্রধরের যুক্তি শুনে কাশীনাথ ধীরে ধীরে বশে এলেন। একটু চিন্তা করে বললেন, আমি যখন মারা গিয়েছিলাম তখন আমার চতুর্থ পক্ষের স্ত্রী রাসেশ্বরীর বয়েস ছিল তোমার ভাগনী গয়েশ্বরীর মতন। এখন মনে হচ্ছে রাসেশ্বরী গয়েশ্বরী হয়ে ফিরে এসেছে। আচ্ছা, তুমি ঘটক লাগাতে পার।
—আমিই তো ঘটক। গয়েশ্বরীর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, সে রাজী আছে। এখন পাকা দেখাটা হয়ে গেলেই বিবাহ হতে পারবে। আজ বিকেল বেলা তুমি তার বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে আলাপ ক’রো।
—তোমারও উপস্থিত থাকা চাই চক্রকাকা।
—না, না, তা দস্তুর নয়, তোমরা দুজনে আলাপ করবে।
কাশীনাথকে দেখে গয়েশ্বরী একটু হেসে বললেন, কি হে ছোকরা, আমাকে মনে ধরেছে তো?
কাশীনাথ নীরবে উপরে নীচে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।
—তোমার নাকি পাঁচ লাখ টাকা আছে? শোন কত্তা, বিয়েটা চুকে গেলেই সব টাকা আমার হাতে দেবে। তুমি যে রকম ন্যালাখ্যাপা মানুষ তোমার হাতে টাকা থাকলে গেছি আর কি, লোকে সব ঠকিয়ে নেবে। আমার মামাবাবুটিকেও বিশ্বাস করি না।
কাশীনাথ বললেন, ভয় নেই গয়েশ্বরী ঠাকরুন, আমাকে ঠকাতে পারে এমন মানুষ ভূভারতে নেই। যা মতলব করেছি বলি শোন। মেয়েছেলের দোকানদারি ভাল নয়, বিয়ের পর তোমার দোকানটা বেচে দেব। তার টাকা আর আমার যা আছে তা দিয়ে তেজারতি করব। চক্রকাকা বলেন আজকাল জমিদারি কেনা যায় না। তোমার কোনও অভাব রাখব না, এক গা গহনা গড়িয়ে দেব। এই কলকাতা হচ্ছে অসুরের শহর, ভয়ংকর জায়গা, আমরা রাঘবপুর গ্রামে গিয়ে বাস করব। বাড়ি বাগান পুকুর গোয়াল সব হবে, একটি দেবমন্দির আর চতুষ্পাঠীও হবে।
গয়েশ্বরী হাত নেড়ে ঝংকার করে বললেন, আ মরিমরি, কি মতলবই ঠাউরেছ ঠাকুর মশাই! পাগল কি আর গাছে ফলে, তুমি একটি আস্ত উন্মাদ পাগল। শোন হে ছোকরা, তোমার স্ত্রী হলেও আমি বয়সে বড়, গুরুজন তুল্যি। আমার হেপাজতে তুমি থাকবে, আমার বশেই তোমাকে চলতে হবে।
কাশীনাথ কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলেন, তারপর ‘তারা ব্রহ্মময়ী’ রক্ষা কর মা’ বলেই চলে গেলেন।
সন্ধ্যাহ্নিকের পর কাশীনাথ ইষ্টদেবীকে নিজের অবস্থা নিবেদন করলেন।— এ কি বিপদে ফেললে মা! তোমারই বা দোষ কি, নিজের কুবুদ্ধিরই ফল ভোগ করছি। পৃথিবীতে কলি যে এত প্রবল হয়েছে তা তো ভাবতে পারি নি। ব্রাহ্মণের বাড়ি বাবুর্চী রাঁধছে, মুরগী চরছে, বুড়ী মাগীরা জুতো পরে খটমটিয়ে চলছে, ধাড়ী মেয়েরা ইস্কুলে যাচ্ছে। ছোট লোকের আস্পর্ধা বেড়ে গেছে, ব্রাহ্মণকে গ্রাহ্য করে না, সামনেই বিড়ি খায়। এখানে জাত ধর্ম কিছুই রক্ষা পাবে না। ওই গয়েশ্বরী একটা ভয়ংকরী খাণ্ডার মাগী, ওকে বিয়ে করলে আমার নরকভোগের আর বাকী থাকবে না। চক্রধর একটা পাষণ্ড কুলাঙ্গার, আমার বংশধর হতেই পারে না, যমরাজ নিশ্চয় ভুল করে ওর কাছে আমাকে পাঠিয়েছেন। কালী কৈবল্যদায়িনী, উপায় বাতলাও মা।
শেষরাত্রে কাশীনাথ স্বপ্ন দেখলেন, তাঁর ইষ্টদেবী আবির্ভূত হয়ে হাত নেড়ে বলছেন, সরে পড় কাশীনাথ। তখনই কাশীনাথের ঘুম ভেঙে গেল। তিনি বুঝলেন, এই পাপ সংসারে ফিরে আসা তাঁর মস্ত বোকামি হয়েছে। মন স্থির করে কাশীনাথ তখনই যমদত্ত সেই নিষ্ক্রান্তি বটিকাটি গিলে ফেললেন এবং অবিলম্বে যমলোকে প্রয়াণ করলেন।
সকালবেলা কাশীনাথকে পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, থ্রম্বোসিস। এত কম বয়সে বড় একটা দেখা যায় না, তবে পাগলদের এরকম হয়ে থাকে।
চক্রধর তখনই কাশীনাথের পইতে থেকে চাবি নিতে গেলেন, কিন্তু পেলেন না। তাড়াতাড়ি ব্যাগটা দখল করতে গেলেন, কিন্তু তাও খুঁজে পেলেন না। নিশ্চয় গয়েশ্বরী ভোগা দিয়ে সেটা হাতিয়েছে, এই ভেবে তিনি ভাগনীর বাড়ি ছুটলেন। দুজনের তুমুল ঝগড়া হল কিন্তু ব্যাগ পাওয়া গেল না। কাশীনাথের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর যমদত্ত সম্পত্তি যম—সরকারে বাজেয়াপ্ত হয়েছে।
১৮৭৮ শক (১৯৫৬)
কৃষ্ণকলি
সকাল বেলা বেড়াতে বেরিয়েছি। রাস্তার ধারে একটা ফুলুরির দোকানের দাওয়ায় তিন—চার বছরের দুটি মেয়ে বসে আছে। একটি মেয়ে কুচকুচে কালো, কিন্তু সুশ্রী। আর একটি শ্যামবর্ণ, মুখশ্রী মাঝারি রকম। দুজনে আমসত্ত্ব চুষছে।
আমি তাকাচ্ছি দেখে তারা মুখ থেকে আমসত্ত্ব বার করে আমার দিকে এগিয়ে ধরলো। বোধ হয় লোভ দেখাবার জন্য। বললুম, কি চুষছ খুকী?
কালো মেয়েটি উত্তর দিলো, বল দিকি নি কি?
—চটি জুতোর সুকতলা।
—হি হি হি, এ বাবুটা কিছু জানে না, আমসত্ত্বকে বলছে সুকতলা!
অন্য মেয়েটি বললে, হি হি হি, বোকা বাবু রে!
তার পর প্রায় চার বৎসর কেটে গেছে। সকাল বেলা বাড়ি থেকে বেরুবার উপক্রম করছি, একটি মেয়ে এসে বললে, একটু দুব্বো দেবে গা দাদু? বিশ্বকম্মা পুজো হবে।
দেখেই চিনেছি এ সেই আমসত্ত্ব—চোষা কালো মেয়ে, এখন এর বয়স বোধ হয় আট বছর। বললুম, যত খুশি দুব্বো নাও না।
মেয়েটির সাজ দেখবার মতন। সদ্য স্নান করে এসেছে, এলো চুল পিঠের ওপর ছড়ানো। একটি ফরসা লালপেড়ে শাড়ি কোমরে জড়িয়েছে। গা খোলা, কিন্তু আঁচলের এক দিক মাথায় দেবার চেষ্টা করছে আর বার বার তা খসে পড়ছে। গোল গোল দুই হাত যেন কষ্টি পাথরে কোঁদা, তাতে ঝকঝকে রুপোর চুড়ি আর অনন্ত, কোমরে রুপোর গোট, গলায় লাল পলার মালা, পায়ে আলতা, হাতে আলতা, সিঁথিতে সিঁদুর। জিজ্ঞাসা করলুম একি খুকী, বিয়ে করলে কবে?
মাথার ওপর কাপড় টেনে খুকী বললে, খুকী ব’লো নি বাবু, এখন আমি বড় হইছি। আমার নাম কেলিন্দী।
আমি বললুম, কেলিন্দী নয়, কালিন্দী। কিন্তু তোমার আরও ভাল নাম আছে, কৃষ্ণকলি। রবি ঠাকুর তোমাকে দেখে লিখেছেন—কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি, কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।…কালো? তা সে যতই কালো হ’ক, দেখেছি তার কালো হরিণ—চোখ। কৃষ্ণকলি নাম তোমার পছন্দ হয়?
কালিন্দী ঘাড় দুলিয়ে জানালে যে খুব পছন্দ হয়।
—তোমার বিয়ে হল কবে?
—সেই অঘ্রান মাসে।
—শ্বশুরবাড়ি কোথায়? বরের নাম কি?
—ধেৎ, বরের নাম বুঝি বলতে আছে! শ্বশুরঘর হুই হোথাকে, ছুতোর বউ মুড়িউলীর দোকানে। দাদু ওই রাঙা ফুল দুটো দাও না, মা পুজো করবে।
চাকরকে বললুম, নিতাই গোটাকতক রঙ্গন ফুল পেড়ে দাও।
মুখ বেঁকিয়ে সাদা দাঁত বার করে কৃষ্ণকলি বললে, এ ম্যা গে, ও তো নোংরা পেণ্টু পরে আছে, সাত জন্ম কাচে নি। তুমি ফুল পেড়ে দাও।
—আমিও তো নোংরা, এখনও স্নান করি নি, কাপড় ছাড়ি নি। আচ্ছা এক কাজ করা যাক, নিতাই তোমাকে আলগোছে তুলে ধরুক, ও ফুল ছোঁবে না, তুমি নিজের হাতে পেড়ে নাও।
—কি বলচ গা দাদু, আমার যে বে হয়ে গেছে।
বুঝলুম, পরপুরুষের স্পর্শে কৃষ্ণকলির আপত্তি আছে। বললুম, তবে তোমার বরকে ডেকে আন, সেই তোমাকে তুলে ধরুক।
—সে তুলতে লারবেক। তুমিই আমাকে তুলে ধর না, আমি ফুল পেড়ে নেব।
—সেকি কৃষ্ণকলি, তোমার যে বিয়ে হয়ে গেছে। আমি তোমাকে তুলে ধরব কি করে?
—তুমি তো বুড়ো থুবড়ো।
ঠিক কথা, এতক্ষণ আমার হুঁশ ছিল না যে আমি বুড়ো থুবড়ো, সমস্ত অবলা জাতি আমার কাছে অভয় পেয়েছে। বললুম, আমার হাতে যে বাতের ব্যথা, তোমাকে তোলবার তো শক্তি নেই।
—বাড়িতে আঁকশি নেই?
আমার লাঠির ডগায় একটা ছুরি বেঁধে আঁকশি করা হল। নিতাই তাই দিয়ে গোটাকতক ফুল পাড়লে, কৃষ্ণকলি মাটি থেকে কুড়িয়ে নিলে।
ফুল—দুব্বো নিয়ে সে চলে যাবার উপক্রম করছে, আমি তাকে বললুম, কৃষ্ণকলি, বিস্কুট খাবে?
—উঁহু।
—মাখন দেওয়া পাঁউরুটি আর মিষ্টি কুলের আচার?
কৃষ্ণকলির মুখ দেখে মনে হল তার রুচি আছে, কিন্তু সংস্কারে বাধছে। বললে, আজ খেতে নেই, বিশ্বকম্মা পূজো। সোঁসা আছে?
—আছে বোধ হয়। নিতাই, দেখ তো বাড়িতে শসা আছে কিনা।
শসা পবিত্র ফল, তাতে কৃষ্ণকলির আপত্তি নেই। নিতাই দুটো শসা এনে আলগোছে তার আঁচলে দিলে। আমি বললুম, কৃষ্ণকলি, তুমি এই অল্প বয়সে বিয়ে করে ফেলেছ, টের পেলে পুলিসে যে তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে।
—ইশ, নিয়ে গেলেই হল কিনা! আমি তো বে করি নি, বে করেছে রেমো। সেই তো মন্তর পড়লে, আমি চুপটি করে বসেছিনু। রেমোর বাবার গায়ে খুব জোর, বলেছে পুলিস এলে ভোমর ঘুরিয়ে তাদের পেট ছেঁদা করে দেবে।
—রেমো বুঝি তোমার বর?
কৃষ্ণকলি ওপর নীচে মাথা নাড়লে।
—এই যাঃ, কৃষ্ণকলি, বরের নাম করে ফেললে!
কৃষ্ণকলি লজ্জায় মা—কালীর মতন জিব বার করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, বলে ফেলেছ তা হয়েছে কি, আজকাল সব্বাই বরকে নাম ধরে ডাকে।
—সক্কলের সামনে ডাকে?
—আড়ালে ডাকে! নির্মলচন্দ্রের বউ ডাকে—ওরে নিমে, জগদানন্দর বউ ডাকে— এই জগা। দিন কতক পরে মেমদের মতন সক্কলের সামনেই ডাকবে।
—আমি যে তোমার সামনে বলে ফেলনু!
—তাতে দোষ হয় নি, আমি বুড়ো লোক কিনা।
এমন সময় একটি ফ্রক—পরা মেয়ে এসে বললে, এই কেলিন্দী, কি করছিস এখেনে, এক্ষুনি আয়, মামী ডাকছে।
এই মেয়েটিই বোধ হয় সেই চার বছর আগে দেখা আমসত্ত্ব—চোষা দ্বিতীয় মেয়ে। কৃষ্ণকলি তাকে বললে, খবদ্দার বিমলি আর কেলিন্দী কইবি নি, রবি ঠাকুর আমার ভাল নাম দিয়েছে কেষ্টকলি। এই দাদু বললে।
মুখভঙ্গী করে দু—হাত নেড়ে বিমলি বললে, মরি মরি, কেলেকিষ্টি কেলিন্দীর নাম আবার কেষ্টকলি! রূপ দেখে আর বাঁচ্চি নে!
কৃষ্ণকলি বললে, দেখ না দাদু, বিমলি আমায় ভেংচি কাটছে।
প্রশ্ন করলুম, বিমলি তোমার কে হয়, বোন নাকি?
—বোন না ঢেঁকি, ও তো আমার পিসতুতো ননদ। বিমলি, তুই যা, আমি একটু পরে যাব।
চলে যেতে যেতে বিমলি বললে, দেখিস এখন, আজ মামী তোকে ছেঁচবে। ওরে আমার কেষ্টকলি, শ্যাওড়া গাছের পেতনী!
কৃষ্ণকলি বললে, দাদু, ও আমায় পেতনী বলবে কেন?
—বলুক গে, ননদরা অমন বলে থাকে, শ্রীরাধার ননদও বলত। এক মেয়ের রূপ আর এক মেয়ে দেখতে পারে না। তোমার বর রেমো তো তোমাকে পেতনী বলে না?
—সেও বলে।
—তুমি রাগ কর না?
—উঁহু, সে হাসতে হাসতে বলে কিনা। আমি তাকে বলি ভূত পিচেশ হনুমান।
—তোমরা ঝগড়া কর নাকি?
—আমি খুব ঝগড়া করি, চিমটিও কাটি, কিন্তু রেমো রাগে না, শুধু মুখ ভেংচায় আর হাসে।
এমন সময় রামের মা এল। সে অনেকদিন থেকে এ বাড়িতে মুড়ি চিঁড়েভাজা দিয়ে আসছে। তার স্বামী মুরারী ছুতোর মিস্ত্রী, ভাল কারিগর, কাঠের ওপর নকসা তোলে। রামের মা কৃষ্ণকলিকে দেখে বললে, ওমা, তুই এখেনে রইছিস, বিমলি যে বললে কেলিন্দী ধিঙ্গী হয়ে হেথা হোথা সেথা চান্দিক ঘুরে বেড়াচ্ছে!
কৃষ্ণকলি বললে, সব মিছে কথা। জান গা মা, এই দাদু বললে রবি ঠাকুর আমার নাম দিয়েছে কেষ্টকলি।
আমি রামের মাকে জিজ্ঞাসা করলুম, এ মেয়েটি তোমার বউ নাকি?
—হেঁ গা বাবা, গেল অঘ্রানে রেমোর সঙ্গে বে দিয়েছি। রেমোর বয়স দশ আর এর আট।
—এত কম বয়সে বিয়ে দিলে? কাজটা যে বেআইনী হয়েছে।
—আইন ফাইন জানি নে বাবা। মেয়েটা হতভাগী, এর মা পাঁচ বছর রোগে ভুগে গেল সন জষ্টি মাসে ম’ল। বাপটা নক্ষীছাড়া, গাজা ভাং খেয়ে গেরুয়া পরে কোথা তারকেশ্বর কোথা ভদ্রেশ্বর টোটো করে ঘুরে বেড়ায়। তাই অনাথা মেয়েটাকে নিজের ঘরে এনে ছেলের সঙ্গে বে দিনু। ওদের ফুলুরির দোকানটাও আমি চালাচ্ছি। আমার তিন মেয়েই তো শ্বশুরঘর করছে, একটা বউ না আনলে কি আমার চলে বাবা? তা কেলিন্দী এখেনে এসে আপনাকে জ্বালাতন করছে বুঝি?
—না না, জ্বালাতন করে নি, একটু গল্প করছিল। তুমি আর একে কেলিন্দী ব’লো না রামের মা, এখন থেকে কৃষ্ণকলি ব’লো।
—হা রে কপাল, আমার খুড়শাশুড়ীর নাম যে ফেষ্টদাসী। ঠাকুর দেবতার নাম কি মুখে আনবার জো আছে বাবা, শ্বশুরবাড়ির গুষ্টি সব নাম দখল করে বসে আছে। দাদাশ্বশুর ছিলেন ফরিদাস, শ্বশুরের নাম ফালিদাস, খুড়শ্বশুর ফ্রীধর, শ্বাশুড়ী ফরস্বতী।
কৃষ্ণকলি বললে, আর তোমার নামটা বলে দিই মা? হি হি হি, ফুগগা ফুগগতিনাশিনী!
আমি বললুম, রামের মা, আদর দিয়ে তুমি বউটির মাথা খেয়েছ, মুখের ওপর তোমাকে ঠাট্টা করে।
রামের মা হেসে বললে, কি করি বাবা, ওর ধরনই ওইরকম। নিজের মায়ের যত্ন আর ক দিন পেয়েছে, জন্ম ইস্তক আমাকেই দেখছে কিনা। যে নতুন নামটি বললেন তার পুরোটি তো বলতে পারব নি, এখন থেকে একে কলি বলব। দেখুন বাবা, এর বন্নটা কালো বটে, কিন্তু খুব ছিরি আছে, ছাঁদটি পরিষ্কার যেন বাটালি দিয়ে গড়া, আর ভারী সতীনক্ষী মেয়ে। বিমলিটা হচ্ছে কুঁদুলি। এখন আসি বাবা। ঘরকে চলরে কলি।
আমি বললুম, কৃষ্ণকলি, তোমার বরকে নিয়ে এক দিন এখানে এসো।
রামের মা বললে, হা আমার কপাল, রেমোর যে বড্ড নজ্জা, বউ—এর সঙ্গে কোথাও যেতে চায় না। আজকালকার ছোঁড়াদের মতন তো নয় যে সোমত্ত বউকে নিয়ে চাদ্দিকে ধেই ধেই নেত্য করে বেড়াবে। রেমোর পরীক্ষেটা চুকে যাক, আমিই একদিন দুটিকে নিয়ে আসব।
কৃষ্ণকলি হাত নেড়ে বললে, সে তোমাকে কিছু করতে হবে নি মা, আমি একাই একাই তাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে আসব।
আমি বললুম, রামের মা, তোমার ছেলে তো সেকেলে, কিন্তু বউটি যে অত্যন্ত একেলে।
—ওটুকু সেরে যাবে বাবা, একটু বড় হলেই নজ্জা শরম আসবে।
রামের মা তার পুত্রবধূকে নিয়ে চলে গেল। কৃষ্ণকলির কপাল ভাল, আট বছর বয়সেই সে শাশুড়ীর থেকে সতীলক্ষ্মী সার্টিফিকেট আদায় করেছে, এক মা হারিয়ে আর এক মা পেয়েছে, এমন বর পেয়েছে যাকে নির্বিবাদে চিমটি কাটা চলে আর হিড়হিড় করে টেনে আনা যায়।
১৩৫৯ (১৯৫২)
গগন-চটি
হাতিবাগানের দরজী আবুবকর মিঞা আর তার বউ রমজানী বিবি সন্ধ্যার সময় পশ্চিম আকাশে ঈদের চাঁদ দেখছিল। হঠাৎ একটা অদ্ভুত জিনিস রমজানীর নজরে পড়ল। সে তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করল, ও মিঞা, আসমানের মধ্যিখানে ছোট্ট কাটারির মতন জ্বলজ্বল করছে ওটা কি গো? আবুবকর অনেকক্ষণ ঠাহর করে বলল, কাটারি নয় রে, ওটা পয়জার, দেখছিস না তালতলার চটির মতন গড়ন। বোধ হয় মল্লিকবাবুরা ফানুস উড়িয়েছে।
আবুবকরের অনুমান ঠিক নয়, কারণ পরদিন এবং তারপর রোজই সন্ধ্যার পর আকাশে দেখা গেল। এই অদ্ভুত বস্তু ফানুসের মতন এদিক ওদিক ভেসে বেড়ায় না, আকাশে স্থির হয়েও থাকে না, চাঁদ আর গ্রহ—নক্ষত্রর মতন এর উদয় অস্ত হয়। উদীয়মান জ্যোতিঃসম্রাট তারক সান্যালকে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, ওটা রাহু, বলেই মনে হচ্ছে, মহাবিপদের পূর্বলক্ষণ। এই কথা শুনে প্রবীণ জ্যোতিঃসম্রাট শশধর আচার্য বললেন, তারকটা গোমূর্খ, রাহু হলে মুণ্ডুর মতন গড়ন হত না? ওটা কেতু, ল্যাজের মতন দেখাচ্ছে। অতি ভীষণ দুর্নিমিত্ত সূচনা করছে। তোমাদের উচিত গ্রহশান্তির জন্য যাগ করা আর অষ্টপ্রহরব্যাপী হরিসংকীর্তন।
একটা আতঙ্ক সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল। খবরের কাগজে নানা রকম মন্তব্য প্রকাশিত হতে লাগল। একজন লিখলেন, বোধহয় উড়ন চাকতি, ধাক্কালেগে তুবড়ে গিয়ে চটিজুতোর মতন দেখাচ্ছে। আর একজন লিখলেন, নিশ্চয় ল্যাজকাটা ধূমকেতু, সূর্যের আর একটু কাছে এলেই নূতন ল্যাজ গজাবে, তার ঝাপটায় পৃথিবী চুরমার হতে পারে।
প্রবীণ হেডপণ্ডিত কুঞ্জবিহারী তলাপাত্র কাগজে লিখলেন, এই আকাশচারী ভয়ংকর পাদুকা কোন মহাপুরুষের? দেখিয়া মনে হয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের। মধ্য—শিক্ষাপর্ষদের খামখেয়াল দেখিয়া সেই স্বর্গস্থ তেজস্বী মহাত্মার ধৈর্যচ্যুতি হইয়াছে, তাই তাঁহার এক পাটি বিনামা গগনতলে নিক্ষেপ করিয়াছেন। এই উড়ুক্কু গগন—চটি শীঘ্রই শিক্ষাপর্ষদের মস্তকে নিপতিত হইবে।
সরকার—বিরোধী দলের অন্যতম মুখপাত্র বিরুপাক্ষ মণ্ডল লিখলেন, না, বিদ্যাসাগরের চটি নয়, তার শুঁড় এত বড় ছিল না। এই আসমানী পয়জার হচ্ছে স্বর্গস্থ মনীষী ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের। যত সব মেডিক্যাল কলেজ আর হাসপাতালের কেলেঙ্কারি দেখে তিনি খেপে উঠেছেন, হাতের কাছে অন্য হাতিয়ার না পেয়ে এক পাটি চটি ছেড়েছেন। কর্তারা হুঁশিয়ার।
ভক্তকবি হেমন্ত চট্টরাজ লিখলেন, এই গগন চটি মানুষের নয়, এ হচ্ছে মূর্তিমান ঐশ রোষ। চুরি ঘুষ ভেজাল মিথ্যাচার ব্যভিচার ভণ্ডামি ইত্যাদি পাপের বৃদ্ধি, রাজ্যসরকারের অকর্মণ্যতা, ধনীদের বিলাসবাহুল্য, ছেলেমেয়েদের সিনেমোন্মাদ, এই সব দেখে নটরাজ চঞ্চল হয়েছেন, প্রলয়নাচন নাচবার জন্য ডান পা বাড়িয়েছেন, তা থেকেই এই রুদ্র—চটি গগনতলে খসে পড়েছে। প্রলয়ংকর রুদ্রতাণ্ডব শুরু হতে আর দেরি নেই, জগতের ধ্বংস একেবারে আসন্ন। দেশের ধনী দরিদ্র উচ্চ নীচ আবালবৃদ্ধ স্ত্রীপুরুষ যদি শীঘ্র ধর্মপথে ফিরে না আসে তবে এই রুদ্ররোষ সকলকেই ব্যাপাদিত করবে।
কিন্তু আনাড়ী লোকদের এই সব জল্পনা শিক্ষিত জনের মনে লাগল না। বিশেষজ্ঞরা কি বলেন? বিশ্বম্ভর কটন মিল, বিশ্বম্ভর ব্যাংক, বিশ্বম্ভরী পত্রিকা ইত্যাদির মালিক শ্রীবিশ্বম্ভর চক্রবর্তী একজন সর্ববিদ্যাবিশারদ লোক, কোনও প্রশ্নের উত্তরে তিনি ‘জানি না’ বলেন না। কিন্তু গগন—চটির কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি শুধু গম্ভীরভাবে উপর নীচে ডাইনে বাঁয়ে ঘাড় নাড়লেন। কয়েকজন অধ্যাপককে জিজ্ঞাসা করায় তাঁরা বললেন, এখন কিছু বলা যায় না, তবে নক্ষত্র নয় তা নিশ্চিত, কারণ এর গতিপথ বিষুববৃত্তের ঠিক সমান্তরাল নয়। এই আগন্তুক জ্যোতিষ্কটি গ্রহের মতন বিপথগামী। পুচ্ছহীন ধূমকেতু হতে পারে। তা ভয়ের কারণ আছে বইকি। সাদা চোখে যতই ছোট দেখাক বস্তুটি নিশ্চয় প্রকাণ্ড। দেখা যাক, আমাদের কোদাইক্যানাল মানমন্দির আর গ্রীনিচ প্যালোমার ইত্যাদি থেকে কি রিপোর্ট আসে।
রিপোর্ট শীঘ্রই এল, দেশ—বিদেশের সমস্ত বিখ্যাত মানমন্দির থেকে একই সংবাদ প্রচারিত হল। দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বাদ দিয়ে যা দাঁড়ায় তা এই। —সূর্যের নিকটতম গ্রহ হচ্ছে বুধ (মার্করি), তার পরে আছে শুক্র (ভিনস), তারপর আমাদের পৃথিবী, তার পর মঙ্গল (মার্স), তার পর বহু দূরে বৃহস্পতি (জুপিটার)। আরও দূরদূরান্তরে শনি (সাটার্ন), ইউরেনাস, নেপচুন আর প্লুটো। মঙ্গল আর বৃহস্পতির কক্ষের মাঝামাঝি পথে প্রকাণ্ড এক ঝাঁক অ্যাস্টারয়েড যা ছোট ছোট খণ্ডগ্রহ সূর্যকে পরিক্রমা করে। তারই একটা হঠাৎ কক্ষভ্রষ্ট হয়ে পৃথিবীর নিকটে এসে পড়েছে। এই খণ্ডগ্রহটি গোলাকার নয়। ভারতীয় জ্যোতিষীরা এর নাম দিয়েছেন গগন—চটি অর্থাৎ হেভেনলি স্লিপার। আপাতত আমরাও সেই নাম মেনে নিলাম। এই গগন—চটির কিঞ্চিৎ স্বকীয় দীপ্তি আছে, তার উপর সূর্যকিরণ পড়ায় আরও দীপ্তিমান হয়েছে। পৃথিবী থেকে এর বর্তমান দূরত্ব পৌনে দু কোটি মাইল, প্রায় দু বৎসরে সূর্যকে পরিক্রমণ করছে। এর আয়তন আর ওজন চন্দ্রের প্রায় দ্বিগুণ। এত বড় অ্যাস্টারয়েডের অস্তিত্ব জানা ছিল না। অনুমান হয়, গোটা কতক খণ্ডগ্রহের সংঘর্ষ আর মিলনের ফলে উৎপন্ন হয়ে এই গগন—চটি ছিটকে বেরিয়ে এসেছে। এর উত্তাপ আর স্বকীয় দীপ্তিও সংঘর্ষ—জনিত। এই বৃহৎ অ্যাস্টারয়েড নিকটে আসায় মঙ্গল গ্রহ আর চন্দ্রের কক্ষ একটু বেঁকে গেছে, আমাদের জোয়ার ভাটার সময়ও কিছু বদলেছে। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব এখন পর্যন্ত যা আছে তাতে বিশেষ ভয়ের কারণ নেই, তবে সন্দেহ হচ্ছে গগন—চটি ক্রমেই কাছে আসছে। যদি বেশী কাছে আসে তবে আমাদের এই পৃথিবীর পরিমাণ কি হবে তা ভাবতেও হৃৎকম্প হয়।
এই বিবৃতির ফলে অনেকে ভয়ে আঁতকে উঠল, কয়েকজন স্থূলকায় ধনী হার্টফেল হয়ে মারা গেল। অনেকে পেটের অসুখ, মাথা ঘোরা, বুক ধড়ফড়ানি আর হাঁপানিতে ভুগতে লাগল। হিন্দুধর্মের নেতৃস্থানীয় স্বামী—মহারাজগণ, মুসলমান মোল্লা—মাওলানাগণ এবং খ্রীষ্টীয় পাদরীগণ নিজের নিজের শাস্ত্র অনুসারে হিতোপদেশ দিতে লাগলেন। সাহিত্যিকরা উপন্যাস কবিতা রম্যরচনা প্রভৃতি বর্জন করে পরলোকের কথা লিখতে লাগলেন। কিন্তু বেশির ভাগ লোকের দুশ্চিন্তা দেখা গেল না, বরং গগন—চটির হুজুগে পাড়ায় পাড়ায় আড্ডা জমে উঠল। শেয়ারবাজারে বিশেষ কোনও তেজিমন্দি দেখা গেল না, সিনেমার ভিড়ও কমল না।
কিছুদিন পরেই দফায় দফায় যে জ্যোতিষিক সংবাদ আসতে লাগল তাতে লোকের পিলে চমকে উঠল, রক্ত জল হয়ে গেল। গগন—চটি নামক এই দুষ্টগ্রহ ক্রমশ পৃথিবীর নিকটবর্তী হচ্ছে এবং মহাকর্ষের নিয়ম অনুসারে পরস্পর টানাটানি চলছে। চন্দ্রসমেত পৃথিবী আর গগন—চটি যেন মিলে মিশে তালগোল পাকাবার চেষ্টায় আছে। হিসাব করে দেখা গেছে, পাঁচ মাসের মধ্যেই চন্দ্র আর গগন—চটির সংঘর্ষ হবে, তারপর দুটোই হুড়মুড় করে পৃথিবীর উপর পড়বে। তার ফল যা দাঁড়াবে তার তুলনায় লক্ষ হাইড্রোজেন বোমা তুচ্ছ। সংঘাতের কিছু পূর্বেই বায়ুমণ্ডল লুপ্ত হবে, সমুদ্র উৎক্ষিপ্ত হবে, সমস্ত প্রাণী রুদ্ধশ্বাস হয়ে মরবে। চরম ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছু করণীয় নেই।
বিভিন্ন খ্রীষ্টীয় সম্প্রদায়ের মুখপাত্রগণ একটি যুক্ত বিবৃতি প্রচার করলেন—আমাদের করণীয় অবশ্যই আছে। সেকালে বৃদ্ধরা একটি ছড়া বলতেন—If cold air reach you through a hole, Go make your will and mend your soul। কিন্তু এই আগন্তুক গগন—চটি ছিদ্রাগত শীতল বায়ু নয়, মানবজাতির পাপের জন্য ঈশ্বরপ্রেরিত মৃত্যুদণ্ড, আমাদের সকলকেই ধ্বংস করবে। উইল করা বৃথা, কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে আমাদের আত্মার ত্রুটি অবশ্যই শোধন করতে হবে। অতএব সরল অতঃকরণে সমস্ত পাপ স্বীকার কর, নিরন্তর প্রার্থনা কর, ঈশ্বরের করুণা ভিক্ষা কর, সকল শত্রুকে ক্ষমা কর, যে কদিন বেঁচে আছ যথাসাধ্য অপরের দুঃখ দূর কর।
ইহুদী মুসলমান আর বৌদ্ধ ধর্মনেতারাও অনুরূপ উপদেশ দিতে লাগলেন। আদি—শংকরাচার্যের একমাত্র ভাগিনেয়ের বশংধর ১০০৮ শ্রী ব্যোমশংকর মহারাজ একটি হিন্দী পুস্তিকা ছাপিয়ে পঞ্চাশ লক্ষ কপি বিলি করলেন। তার সারমর্ম এই।—অয় মেরে বচ্চেচ, হে আমার বৎসগণ, মৃত্যুভয় ত্যাগ কর। আমার বয়স নব্বই পেরিয়েছে, আর তোমরা প্রায় সকলেই আমার চাইতে ছোট, কিন্তু তাতে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, কারণ ভবযন্ত্রণার ভোগ বালক—বৃদ্ধ সকলের পক্ষেই সমান। আমাদের আত্মা শীঘ্রই দেহপিঞ্জর থেকে মুক্তি পেয়ে পরামাত্মায় লীন হবে, এ তো পরম আনন্দের কথা, এতে ভয়ের কি আছে? কিন্তু অশুচি অবস্থায় দেহত্যাগ করা চলবে না, তাতে নরকগতি হবে। তোমরা হয়তো জান, কোনও বড় অপারেশনের আগে রোগীকে উপবাসী রাখা হয় এবং জোলাপ আর এনিমা দিয়ে তাঁর কোষ্ঠ সাফ করা হয়। যখন রোগীর পাকস্থলী শূন্য, মলভাণ্ড শূন্য, মূত্রাশয়ও শূন্য, সর্ব শরীর পরিষ্কৃত, তখনই ডাক্তার অস্ত্রপ্রয়োগ করেন। শুচিতার জন্য এত সতর্ককার কারণ—পাছে সেপটিক হয়। এখন ভেবে দেখ, অ্যাপেনডিক্স বা হার্নিয়া বা প্রস্টেট ছেদনের তুলনায় প্রাণ বিসর্জন কত গুরুতর ব্যাপার। মৃত্যুকালে যদি মনে কিছুমাত্র কালুষ্য বা কল্মষ বা কিল্বিষ থাকে তবে আত্মার সেপসিস অনিবার্য। পাপক্ষালন না করেই যদি তোমরা প্রাণত্যাগ কর তবে নিঃসন্দেহে সোজা নরকে যাবে। অতএব আর বিলম্ব না করে সরল মনে লজ্জা ভয় ত্যাগ করে সমস্ত পাপ স্বীকার কর, তাতেই তোমার শুচি হবে। চুপি চুপি বললে চলবে না, জনতার সমক্ষে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করতে হবে, কিংবা ছাপিয়ে প্রচার করতে হবে, যেমন আমি করছি। এই পুস্তিকায় শেষে তফসিল ক আর খ—এ মৎকৃত যাবতীয় দুষ্কর্মের তালিকা পাবে—কতগুলো ছারপোকা মেরেছি, কতবার লুকিয়ে মুরগি খেয়েছি, কতবার মিথ্যা বলেছি, কতজন ভক্তিমতী শিষ্যার প্রতি কুদৃষ্টিপাত করেছি—সবই খোলাস করে বলা হয়েছে। তোমরাও আর কালবিলম্ব না করে এখনই পাপক্ষালনে রত হও।
বিলাতে অক্সফোর্ড গ্রুপের উদ্যোগে দলে দলে নরনারী দুষ্কৃতি স্বীকার করতে লাগল, অন্যান্য পাশ্চাত্ত্য দেশেও অনুরূপ শুদ্ধির আয়োজন হল। ভারতবাসীর লজ্জা একটু বেশী, সেজন্য ব্যোমশংকরজীর উপদেশে প্রথম প্রথম বিশেষ ফল হল না। কিন্তু সম্প্রতি প্যালোমার মানমন্দির থেকে যে রিপোর্ট এসেছে তারপরে কেউ আর চুপ করে থাকতে পারে না। গগন—চটি আরও কাছে এসে পড়েছে, তার ফলে পৃথিবীর অভিকর্ষ বা গ্রাভিটি কমে গেছে, আমরা সকলেই একটু হালকা হয়ে পড়েছি। আর দেরি নেই, শেষের সেই ভয়ংকর দিনের জন্য প্রস্তুত হও।
মনুমেণ্টের নীচে আর শহরের সমস্ত পার্কে দলে দলে মেয়ে—পুরুষ চিৎকার করে পাপ স্বীকার করতে লাগল। বড়বাজার থেকে একটি বিরাট প্রসেশন ব্যাণ্ড বাজাতে বাজাতে বেরুল এবং নেতাজী সুভাষ রোড হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করতে লাগল। বিস্তর মান্যগণ্য লোক তাতে যোগ দিয়ে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে করুণ কণ্ঠে নিজের নিজের দুষ্কর্ম ঘোষণা করতে লাগলেন, কিন্তু ব্যাণ্ডের আওয়াজে তাঁদের কথা ঠিক বোঝা গেল না।
বিলাতী রেডিওতে নিরন্তর বাজতে লাগল—Nearer my God to Thee। দিল্লীর রেডিওতে ‘রঘুপতি রাঘব’ এবং লখনউ আর পাটনায় ‘রাম নাম সচ হৈ’ অহোরাত্র নিনাদিত হল। কলকাতায় ধ্বনিত হল—’সমুখে শান্তিপারাবার’। মস্কো রেডিও নীরব রইল, কারণ ভগবানের সঙ্গে কমিউনিস্টদের সদভাব নেই। অবশেষে সোভিএট রাষ্ট্রদূতের সনির্বন্ধ অনুরোধে আমাদের রাষ্ট্রপতি কমিউনিস্ট প্রজাবৃন্দের আত্মার সদগতির নিমিত্ত গয়াধামে অগ্রিম পিণ্ডদানের ব্যবস্থা করলেন।
বৃহৎ চতুঃশক্তি অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের শাসকবর্গ গত পঞ্চাশ বৎসরে যত কুকর্ম করেছেন তার ফিরিস্তি দিয়ে White Book প্রকাশ করলেন এবং একযোগে ঘোষণা করলেন—সব মানুষ ভাই ভাই, কিছুমাত্র বিবাদ নাই। পাকিস্তানের কর্তারা বললেন, য়হ বাত তো ঠিক হৈ, হিন্দী পাকী ভাই ভাই, লেকিন আগে কাশ্মীর চাই।
জগদব্যাপী এই প্রচণ্ড বিক্ষোভের মধ্যে শুধু একজনের কোনও রকম চিত্তচাঞ্চল্য দেখা গেল না। ইনি হচ্ছেন হাঠখোলার ভুবনেশ্বরী দেবী। বয়স আশি পার হলেও ইনি বেশ সবলা, সম্প্রতি দ্বিতীয় বার কেদার—বদরী ঘুরে এসেছেন। প্রচুর সম্পত্তি, স্বামী পুত্র কন্যার ঝঞ্ঝাট নেই, শুধু একপাল আশ্রিত কুপোষ্য আছে, তাদের ইনি কড়া শাসনে রাখেন। ভুবনেশ্বরী খুব ভক্তিমতী মহিলা, গীতগোবিন্দ গীতা আর গীতাঞ্জলি কণ্ঠস্থ করেছেন। কিন্তু পাড়ার লোকে তাঁকে ঘোর নাস্তিক মনে করে, কারণ তিনি কোনও রকম হুজুগে মাতেন না। তাঁর ভয়ার্ত পোষ্যবর্গ ব্যাকুল হয়ে অনুরোধ করল, কর্তা—মা, গগন—চটি উদয় হয়েছেন, প্রলয়ের আর দেরি নাই। জগন্নাথ ঘাটে সভা হচ্ছে, সবাই পাপ কবুল করছে, আপনিও করে ফেলুন। মন খোলসা হলে শান্তিতে মরতে পারবেন।
ভুবনেশ্বরী ধমক দিয়ে বললেন, পাপ যা করেছি তা করেছি, ঢাক পিটিয়ে সবাইকে তা বলতে যাব কেন রে হতভাগারা? গগন—চটি না ঢে�কি, আকাশে লাখ লাখ তারা আছে, আর একটা না হয় এল, তাতে হয়েছে কি? তোরা বললেই প্রলয় হবে? মরতে এখন ঢের দেরি রে, এখনই হা—হুতোশ করছিস কেন? ভগবান আছেন কি করতে? ‘আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হ’ত যে মিছে’—রবি ঠাকুরের এই গান শুনিস নি? মানুষকেই যদি ঝাড়ে বংশ লোপাট করে ফেলেন তবে ভগবানের আর বেঁচে সুখ কি? লীলা খেলা করবেন কাকে নিয়ে? যা যা, নিশ্চিন্তি হয়ে ঘুমো গে।
কিসে কি হয় কিছুই বলা যায় না। হয়তো ভুবনেশ্বরীর কথায় ত্রিভুবনেশ্বরের একটু চক্ষুলজ্জা হল। হয়তো কার্যকারণ পরম্পরায় প্রাকৃতিক নিয়মেই যা ঘটবার তা ঘটল। হঠাৎ একদিন খবরের কাগজে তিন ইঞ্চি হরফে ছাপা হল—ভয় নেই, দুষ্ট গ্রহ দূর হচ্ছে। বড় বড় জ্যোতিষীরা একযোগে জানিয়েছেন, বৃহস্পতি শনি ইউরেনাস আর নেপচুন এই চারটে প্রকাণ্ড গ্রহের সঙ্গে এক রেখায় আসার ফলে গগন—চটির পিছনে টান পড়েছে, সে দ্রুতবেগে পুরাতন কক্ষে নিজের সঙ্গীদের মধ্যে ফিরে যাচ্ছে। অতি অল্পের জন্য আমাদের পৃথিবী বেঁচে গেল।
বিপদ কেটে যাওয়ায় জনসাধারণ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, কিন্তু যাঁরা অসাধারণ তাঁরা নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। দেশের হোমরাচোমরা মান্যগণ্যদের প্রতিনিধিস্থানীয় একটি দল দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে নিবেদন করলেন, হুজুর, আমরা যে বিস্তর কসুর কবুল করে ফেলেছি এখন সামলাব কি করে? প্রধানমন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের চীফ জস্টিসের মত চাইলেন। তিনি রায় দিলেন, পুলিসের পীড়নের ফলে কেউ যদি অপরাধ স্বীকার করে তবে তা আদালতে গ্রাহ্য হয় না। গগন—চটির আতঙ্কে লোকে যা বলে ফেলেছে তারও আইনসম্মত কোনও মূল্য নেই, বিশেষতঃ যেমন স্ট্যাম্প কাগজে কেউ অ্যাফিডাভিট করে নি।
বৃহৎ চতুঃশক্তি এবং ইউ—এন—ও গোষ্ঠীভুক্ত ছোট বড় সকল রাষ্ট্র একটি প্রোটোকলে স্বাক্ষর করে ঘোষণা করলেন, গগন—চটির আবির্ভাবে বিকারগ্রস্ত হয়ে আমরা যেসব প্রলাপোক্তি করেছিলাম তা এতদ্বারা প্রত্যাহৃত হল। এখন আবার পূর্বাবস্থা চলবে।
গগন—চটি সুদূর গগনে বিলীন হয়েছে কিন্তু যাবার আগে সকলকেই বিলক্ষণ ঘা কতক দিয়ে গেছে। আমাদের মান ইজ্জত ধূলিসাৎ হয়েছে মাথা উঁচু করে বুক ফুলিয়ে আর দাঁড়াবার জো নেই।
১৮৭৯ শক (১৯৫৭)
গন্ধমাদন-বৈঠক
পুরাণে সাত জন চিরজীবীর নাম পাওয়া যায়—অশ্বত্থামা বলির্ব্যাসো হনুমাংশ্চ বিভীষণঃ কৃপঃ পরশুরামশ্চ সপ্তৈতে চিরজীবিনঃ। এঁরা একবার একত্র হয়েছিলেন।
বদরিকাশ্রমের উত্তর—পূর্বে গন্ধমাদন পর্বত। বনবাসে ভীম যখন দ্রৌপদীর উপরোধে সহস্রদল পদ্ম আনতে যান তখন গন্ধমাদনে হনুমানের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল। রামচন্দ্রের স্বর্গারোহণের পর থেকে হনুমান সেখানে বাস করছেন।
একটি প্রকাণ্ড অক্ষোট অর্থাৎ আখরোট গাছের নীচে প্রতিদিন অপরাহ্নে হনুমান বার দিয়ে বসেন। সেই সময় নিকটবর্তী অরণ্যের অধিবাসী বহুজাতীয় বানর ভল্লুক প্রভৃতি বুদ্ধিমান প্রাণী তাঁকে দর্শন করতে আসে। হনুমান নানাপ্রকার বিচিত্র কথা বলেন, তাঁর ভক্তেরা পরম আগ্রহে তা শোনে।
একদিন হনুমান অক্ষোটতরুতলে সমাসীন হয়ে ভক্তবৃন্দের বিবিধ প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন এমন সময় জাম্ববানের বংশধর একটি বৃদ্ধ ভল্লুক করজোড়ে বললে, প্রভু আপনার লঙ্কাদহনের ইতিহাসটি আর একবার আমরা শুনতে ইচ্ছা করি।
হনুমান বললেন, সাগরলঙ্ঘন করে লঙ্কায় গিয়ে দেবী জানকীর সঙ্গে দেখা করার পর আমি বিস্তর রাক্ষস বধ করেছিলাম। তার পর ইন্দ্রজিৎ ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে আমাকে কাবু করে ফেললেন। তখন রাক্ষসরা শণ আর বল্কলের রজ্জু দিয়ে আমাকে বেঁধে রাবণের কাছে নিয়ে চলল। আমি ভাবলাম, এ তো মজা মন্দ নয়, বিনা চেষ্টায় রাবণের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যাবে—
এই পর্যন্ত বলার পর হনুমান দেখলেন, একজন নিবিড়শ্যামবর্ণ দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ পুরুষ লম্বা লম্বা পা ফেলে তাঁর কাছে আসছেন। সভায় যারা উপস্থিত ছিল সকলেই নিমেষের মধ্যে নিকটস্থ অরণ্যে অন্তর্হিত হল। আগন্তুক হনুমানের কাছে এসে নমস্কার করে বললেন, মহাবীর, আমাকে চিনতে পার?
হনুমান উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আরে, এ যে দেখছি লঙ্কেশ্বর বিভীষণ! বহু বৎসর পরে দেখা হল। মহারাজ, সমস্ত কুশল তো? লঙ্কা থেকে কবে এসেছ? এখানে আছ কোথায়?
বিভীষণ বললেন, কাল এসেছি। বদরিকাশ্রমে আমার পত্নীকে রেখে তোমাকে দেখতে এলাম। সমস্ত কুশল, তবে আমার লঙ্কারাজ্য আর নেই।
—সেকি? সিংহল তো রয়েছে।
—সিংহল লঙ্কা নয়, লোকে ভুল করে। লঙ্কা সাগরগর্ভে বিলীন হয়েছে। আমি এখন নিষ্কর্মা রাজ্যহীন হয়ে ছদ্মবেশে নানা স্থানে ঘুরে বেড়াই, কোনও স্থায়ী আবাস নেই, মহেশ্বর আর রামচন্দ্রের কৃপায় কোনও অভাব নেই। রাজ্য গেছে তাতে ভালই হয়েছে, আজকাল রাজাদের বড় দুর্দিন চলছে।
—বটে! পৃথিবীর আর সব খবর কি বল। লোকে রামচন্দ্রের কীর্তিকথা ভুলে যায় নি তো?
—ভুলে যায় নি, তোমার খ্যাতিও রামচন্দ্রের চাইতে কম নয়, কিন্তু বাংলাদেশে অন্য রকম দেখেছি।
—কি রকম?
—সেখানকার লোকে রামের প্রতি মৌখিক ভক্তি দেখায়, ভূত তাড়াবার জন্য রাম রাম বলে, কিন্তু তাঁর পূজা করে না, কেউ কেউ তাঁর নিন্দাও করে। সবচেয়ে দুঃখের কথা, তোমাকে তারা বিদ্রূপ করে। একনিষ্ঠ প্রভুভক্তি আর অলৌকিক বীরত্বের মহিমা বোঝবার শক্তি বাঙালীর নেই।
—তোমার কথা কি বলে?
—সে অতি কুৎসিত কথা। আমাকে বলে—ঘরভেদী বিভীষণ। জয়চাঁদ, মীরজাফর, লাভাল আর কুইসলিংএর দলে আমাকে ফেলেছে। ন্যায় আর ধর্মের জন্যই আমি ভ্রাতাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি তা কেউ বোঝে না।
এই সময় আর একজন সেখানে উপস্থিত হলেন। দীর্ঘ শীর্ণ মলিন দেহ, মাথায় জটা, এক মুখ দাড়ি—গোঁফ, পরনে চীরবাস, গায়ে কর্কশ কম্বল। এককালে বলিষ্ঠ ও সুপুরুষ ছিলেন তা বোঝা যায়। আগন্তুক বললেন, মহাবীর হনুমান আর রাক্ষসরাজ বিভীষণের জয় হোক।
হনুমান বললেন, কে আপনি সৌম্য? ব্রাহ্মণ মনে হচ্ছে, প্রণাম করি।
—না না প্রণাম করতে হবে না। আমি ভরদ্বাজের বংশধর দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা, কিন্তু ভাগ্যদোষে পতিত হয়েছি।
হনুমান বললেন, অশ্বত্থামা নাম শুনেছি বটে। দাঁড়িয়ে রইলে কেন, বস এখানে। কোন পাপে তোমার পতন হল?
—সে অনেক কথা। পাণ্ডবরা জঘন্য কপট উপায়ে আমার পিতাকে বধ করেছিল, তারই প্রতিশোধে আমি দ্রৌপদীর পঞ্চমপুত্র আর ধৃষ্টদ্যুম্নকে সুপ্ত অবস্থায় হত্যা করেছিলাম, পাণ্ডববধূ উত্তরার গর্ভে দারুণ ব্রহ্মশিরঅস্ত্র নিক্ষেপ করেছিলাম। তাই কৃষ্ণ আমাকে শাপ দিয়েছিলেন—নরাধম, তুমি তিন সহস্র বৎসর জনহীন দেশে অসহায় ব্যাধিগ্রস্ত ও পূষশোণিতগন্ধী হয়ে বিচরণ করবে। সেই শাপের কাল অতিক্রান্ত হয়েছে, এখন আমি ব্যাধিমুক্ত, ইচ্ছানুসারে সর্ব জগৎ পরিভ্রমণ করি। কিন্তু আমার শান্তি নেই, মন ব্যাকুল হয়ে আছে। এখন আমার বার্তা শুনুন। ভগবান পরশুরাম আমাকে আজ্ঞা করেছেন, বৎস সপ্ত চিরজীবী যাতে গন্ধমাদন পর্বতে সমবেত হন তার আয়োজন কর। দৈবক্রমে বিভীষণ এখানে এসে পড়েছেন, আমরা তিন জন একত্র হয়েছি, অবশিষ্ট চার জনকে আমি আহ্বান করেছি। ওই যে ওঁরাও এসে গেছেন।
জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম, মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস, বিরোচনপুত্র দৈত্যরাজ বলি, এবং অশ্বথামার মাতুল কৃপ উপস্থিত হলেন। হনুমান সসম্ভ্রমে নমস্কার করে বললেন, আজ আমার জন্ম সফল হল, বিষ্ণুর ষষ্ঠ অবতার ভগবান পরশুরাম আমার আশ্রমে পদার্পণ করেছেন, তাঁর সঙ্গে মহাজ্ঞানী মহর্ষি ব্যাস, দানশৌণ্ড মহাকীর্তিমান বলি, এবং সর্বাস্ত্র বিশারদ কৃপাচার্যও এসেছেন। আরও সৌভাগ্য এই যে বহুকাল পরে আমার মিত্র বিভীষণের দর্শন পেয়েছি এবং দ্রোণপুত্র মহারথ অশ্বথামাও উপস্থিত হয়েছেন। আমরা সপ্ত চিরজীবী সমবেত হয়েছি, এখন শ্রীপরশুরাম আজ্ঞা করুন আমাদের কি করতে হবে।
পরশুরাম বললেন, তোমরা বোধ হয় জান যে বসুন্ধরার অবস্থা বড়ই সংকটময়। ধর্ম লুপ্ত হয়েছে, সমস্ত প্রজা যুদ্ধের ভয়ে উদবিগ্ন হয়ে আছে। শুনেছি দু—চার জন নীতিশাস্ত্রজ্ঞ ধর্মযুদ্ধের নিয়ম বন্ধনের চেষ্টা করছেন কিন্তু পেরে উঠছেন না। আমরা এই সপ্ত চিরজীবী অনেক দেখেছি, অনেক শুনেছি, অনেক কীর্তি করেছি। মহর্ষি ব্যাসের রসনাগ্রে সমস্ত পুরাণ আর ইতিহাস অবস্থান করছে। দৈত্যরাজ বলি ইন্দ্রকে পরাস্ত করেছিলেন, অসংখ্য সৈন্য পরিচালনার অভিজ্ঞতা এঁর আছে। কৃপাচার্য কুরুক্ষেত্রসমরে অশেষ পরাক্রম দেখিয়েছেন কিন্তু কদাচ ধর্মবিরুদ্ধ কর্ম করেন নি। বিভীষণ আর অশ্বত্থামা দুজনেই মহারথ, অধিকন্তু সমস্ত পৃথিবীর সংবাদ রাখেন। পবননন্দন হনুমান চরিত্রগুণে এবং প্রভুভক্তিতে অদ্বিতীয়। আর আমার কীর্তি তোমরা জানো, নিজের মুখে আর বলতে চাই না। এখন আমাদের কর্তব্য, সাত জনে মন্ত্রণা করে এই দারুণ কলিযুগের উপযুক্ত ধর্মযুদ্ধের নিয়ম বেঁধে দেওয়া।
দৈত্যরাজ বলি বললেন, আপনারা কিছু মনে করবেন না, আমি কিঞ্চিৎ অপ্রিয় সত্য নিবেদন করছি। এই ব্যাসদেব ছাড়া আমরা সকলেই এক কালে অসংখ্য বিপক্ষ বধ করেছি। আমরা কেউ ধর্মযুদ্ধ করি নি, অপরাধীর সঙ্গে বিস্তর নিরপরাধ লোককেও বিনষ্ট করেছি। ধর্মযুদ্ধের আমরা কি জানি? ব্যাসদেবও কুরুপাণ্ডবের যুদ্ধ নিবারণ করতে পারেন নি। আসল কথা, ধর্মযুদ্ধ হতেই পারে না, যুদ্ধ মাত্রেই পাপযুদ্ধ। যে বীর যত শত্রু মারেন তিনি তত পাপী।
পরশুরাম প্রশ্ন করলেন, তুমি কি বলতে চাও আমরা সকলেই পাপী?
—আজ্ঞে হাঁ, ব্যাসদেব ছাড়া। আমাদের মধ্যে শ্রীহনুমান সব চেয়ে কম পাপী, কারণ উনি শুধু হাত পা আর দাঁত দিয়ে লড়েছেন, বড় জোর গাছ আর পাথর ছুড়েছেন। উনি ধনুর্বিদ্যা জানতেন না, দূর থেকে বহু প্রাণী বধ করা ওঁর পক্ষে অসম্ভব ছিল।
হনুমান বুক ফুলিয়ে বললেন, দৈত্যরাজ, তুমি কিছুই জান না। ধনুর্বাণের কোনও প্রয়োজনই আমার হয় নি, শুধু হাত পা দিয়েই আমি সহস্র কোটি রাক্ষস বধ করেছি।
বিভীষণ বললেন, ওহে মহাবীর, পৌরাণিক ভাষা তুমি তো বেশ আয়ত্ত করেছ! পৃথিবীর লোকসংখ্যা এখন মোটে দু শ কোটি, ত্রেতাযুগে ঢের কম ছিল।
পরশুরাম বললেন, বেশ, মেনে নিচ্ছি হনুমান সব চাইতে কম পাপী। সব চাইতে বড় পাপী কে?
বলি বললেন, আজ্ঞে, সে হচ্ছেন আপনি। একুশ বার পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় করেছিলেন, শিশুকেও বাদ দেন নি।
পরশুরাম বললেন, দেখ বলি, পিতামহ প্রহ্লাদের প্রশ্রয় আর বিষ্ণুর অনুগ্রহ পেয়ে তোমার বড়ই স্পর্ধা হয়েছে। আমি বহু দিন অস্ত্র ত্যাগ করেছি, নতুবা তোমার ধৃষ্টতার সমুচিত শাস্তি দিতাম। ধর্মাধর্মের তুমি কতটুকু জান হে দৈত্য? বিষ্ণুক্রান্তা ধরণী থেকে তুমি নির্বাসিত হয়েছ, পাতালে অবরুদ্ধ হয়ে আছ, আজ শুধু আমার অনুরোধে বিষ্ণু তোমাকে দু দণ্ডের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন।
বলি বললেন, প্রভু পরশুরাম, আপনি অবতার হতে পারেন, কিন্তু আপনার ধর্মাধর্মের ধারণা অত্যন্ত সেকেলে। ওহে অশ্বত্থামা, তুমি তো সমস্ত পৃথিবী পর্যটন করেছ, অনেক খবর রাখ, যুদ্ধ সম্বন্ধে এখনকার মনীষীদের মতামত কি শুনিয়ে দাও না।
অশ্বত্থামা বললেন, বড় বড় রাষ্ট্রের কর্তারা বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, কিন্তু সর্বদাই প্রস্তুত আছি; যদি বিপক্ষ রাষ্ট্র আমাদের কোনও ক্ষতি করে তবে অবশ্যই লড়ব। পক্ষান্তরে কয়েকজন ধর্মপ্রাণ মহাত্মা বলেন, অহিংসাই পরম ধর্ম, যুদ্ধ মাত্রেই অধর্ম। অন্যায় সইবে না অন্যায়কারীকে প্রাণপণে বাধা দেবে, কিন্তু কদাপি হিংসার আশ্রয় নেবে না। অহিংস প্রতিরোধের ফলেই কালক্রমে বিপক্ষের ধর্মবুদ্ধি জাগ্রত হবে।
পরশুরাম বললেন, কলিযুগের বুদ্ধি আর কতই হবে! ঘরে মশা ইঁদুর বা সাপের উপদ্রব হলে যে গৃহস্থ অহিংস হয়ে থাকে তাকে ঘর ছেড়ে পালাতে হয়। যারা স্বভাবত দুরাত্মা অহিংস উপায়ে তাদের জয় করা যায় না। অক্রোধেন জয়েৎ ক্রোধং এই উপদেশ সদাশয় বিপক্ষের বেলাতেই খাটে। দুর্যোধনকে তুষ্ট করবার জন্য যুধিষ্ঠির বহু চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তাতে ফল হয়েছিল কি? যাঁরা এখন অহিংসার প্রচার করছেন তাঁরা যুদ্ধ থামাতে পেরেছেন কি?
অশ্বত্থামা বললেন, আজ্ঞে না। আমি যে অধর্মযুদ্ধ করেছিলাম তার জন্য কৃষ্ণ আমাকে ত্রিসহস্রবর্ষভোগ্য দারুণ শাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু আধুনিক মারণাস্ত্রের তুলনায় আমার ব্রহ্মশির অস্ত্র অতি তুচ্ছ। এখন যাঁরা আকাশ থেকে বজ্রময় প্রলয়াগ্নি ক্ষেপণ করে জনপদ ধ্বংস করেন, নির্বিচারে আবালবৃদ্ধবনিতা সহস্র নিরপরাধ প্রজা হত্যা করেন, তাঁদের কেউ শাপ দেয় না। আধুনিক বীরগণের তুল্য উৎকট পাপী সত্য ত্রেতা দ্বাপরে ছিল না।
বলি মৃদুস্বরে বললেন, ছিল। আমাদের এই জামদগ্ন্য পরশুরাম যে একুশ বার ক্ষত্রিয়সংহার করেছিলেন, নৃশংসতায় তার তুলনা হয় না।
পরশুরামের শ্রবণশক্তি একটু ক্ষীণ, বলির কথা শুনতে পেলেন না। বললেন, বীরের পাপপুণ্য বিচার করা অত সহজ নয়। দুষ্ক্রিয়া যখন দেশব্যাপী হয়, অথবা শ্রেণীবিশেষের মধ্যে অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়, যখন উপদেশে বা অনুরোধে কোন ফল হয় না, তখন ঝাড়ে বংশে নির্মল করাই একমাত্র নীতি, কে দোষী কে নির্দোষ তার বিচারের প্রয়োজন নেই।
বিভীষণ বললেন, একজন পাশ্চাত্ত্য পণ্ডিত (T.H. Huxley) বলেছেন, নীতি হচ্ছে দু রকম, নিসর্গনীতি (cosmic law) আর ধর্মনীতি (moral law)। প্রথমটি বলে, আত্মরক্ষা আর স্বার্থসিদ্ধির জন্য পরের সর্বনাশ করা যেতে পারে। এই নীতি অনুসারেই লোকে মশা ইঁদুর সাপ বাঘ ইত্যাদি মারে, খাদ্যের জন্য জীবহত্যা করে, লক্ষ লক্ষ কীট বধ করে কৌষেয় বস্ত্র প্রস্তুত করে, সভ্য সবল জাতি অসভ্য দুর্বল জাতিকে পীড়ন বা সংহার করে, যুদ্ধকালে কোনও উপায়ে বিপক্ষকে ধ্বংস করবার চেষ্টা করে। পক্ষান্তর ধর্মনীতি বলে, স্বার্থসিদ্ধির জন্য কদাপি পরের অনিষ্ট করবে না, সকলকেই আত্মীয় মনে করবে। কিন্তু কেবল ধর্মনীতি অবলম্বন করে কি করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করা যায়, স্বার্থ আর পরার্থ বজায় রাখা যায়, তার পদ্ধতি এখনও আবিষ্কৃত হয় নি। রাজনীতিক পণ্ডিতগণ অবস্থা বুঝে প্রথম বা দ্বিতীয় নীতির ব্যবস্থা করেন, সাধারণ মানুষও তাই করে। তবে ভবিষ্যদদর্শী মহাত্মারা আশা করেন যে মানবজাতি ক্রমশ নিসর্গনীতি বর্জন করে ধর্মনীতি আশ্রয় করবে। আমাদের এই ভগবান ভার্গব নিসর্গনীতি অনুসারেই একুশ বার ক্ষত্রিয় সংহার করেছিলেন।
পরশুরাম বললেন, ঠিক করেছিলাম। সাধুদের পরিত্রাণ আর দুষ্কৃতদের বিনাশের জন্যই অবতাররা আসেন। তাঁরা চটপট ধর্ম—সংস্থাপন করতে চান, অগণিত দুর্বুদ্ধি পাপীকে উপদেশ দিয়ে সৎপথে আনবার সময় তাঁদের নেই। এখনকার লোকহিতৈষী যোদ্ধারা যদি অনুরূপ উদ্দেশ্যে নির্মম হয়ে যুদ্ধ করেন তাতে আমি দোষ দেখি না।
অশ্বত্থামা বললেন, কিন্তু একাধিক প্রবল পক্ষ থাকলে নিসর্গনীতিও জটিল হয়ে পড়ে। সকলেই বলে, অন্যায় উপায়ে যুদ্ধ করা চলবে না, অথচ ন্যায়—অন্যায়ের প্রভেদ সম্বন্ধে তারা একমত হতে পারে না। প্রত্যেক পক্ষই বলতে চায়, তাদের যে অস্ত্র আছে তার প্রয়োগ ন্যায় সম্মত, কিন্তু আরও নিদারুণ নূতন অস্ত্রের প্রয়োগ ঘোর অন্যায়।
পরশুরাম বললেন আমাদের মধ্যে আলোচনা তো অনেক হল, এখন তোমরা নিজের নিজের মত প্রকাশ করে বল—ধর্মযুদ্ধের লক্ষণ কি? কি প্রকার যুদ্ধ এই কলিযুগের উপযোগী? বলি, তুমিই, আগে বল।
বলি বললেন, যুদ্ধচিন্তা ত্যাগ করে নিরন্তর শ্রীহরির নাম কীর্তন করতে হবে, কলিতে অন্য গতি নেই।
পরশুরাম বললেন, তোমার বুদ্ধিভ্রংশ হয়েছে, বামনদেবের তৃতীয় পদের নিপীড়নে তোমার মস্তিষ্ক ঘুলিয়ে গেছে। বিভীষণ কি বল?
বিভীষণ বললেন, যেমন চলছে চলুক না, ধর্মযুদ্ধের নিয়ম রচনায় প্রয়োজন কি। তাতে কোনও ফল হবে না, আমাদের বিধান মানবে কে? অশ্বত্থামা, তোমার মত কি?
অশ্বত্থামা বললেন, তিন হাজার বৎসর শাপ ভোগ করে আমার বুদ্ধি ক্ষীণ হয়ে গেছে, বিচারের শক্তি নেই। আমার পূজ্যপাদ মাতুলকে জিজ্ঞাসা করুন।
কৃপাচার্য বললেন, যুদ্ধের কোন কথায় আমি থাকতে চাই না, আমি আজকাল সাধনা করছি।
হনুমান বললেন, আপনারা ভাববেন না, ধর্মযুদ্ধের নিয়ম বন্ধন অতি সোজা। সেনায় সেনায় যুদ্ধ এবং সর্ববিধ অস্ত্রের প্রয়োগ একেবারে নিষিদ্ধ করতে হবে। দুই পক্ষের যাঁরা প্রধান তাঁরা মল্লযুদ্ধ করবেন, যেমন বালী আর সুগ্রীব, ভীম আর কীচক করেছিলেন। কিন্তু চড় লাথি দাঁত নখ প্রভৃতি স্বাভাবিক অস্ত্রের প্রয়োগ আপত্তির কারণ নেই।
বিভীষণ বললেন, মহাবীর, তোমার ব্যবস্থায় একটু ত্রুটি আছে। দুই বীর সমান বলবান না হলে ধর্মযুদ্ধ হতে পারে না। মনে কর, চার্চিল আর স্তালিন, কিংবা ট্রুমান আর মাও—সে—তুং, এঁরা মল্লযুদ্ধ করবেন। এঁদের দৈহিক বলের পাল্লা সমান করবে কি করে?
হনুমান বললেন, খুব সোজা। একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্থ থাকবেন, যে বেশী বলবান তাকে তিনি প্রথমেই যথোচিত প্রহার দেবেন, যাতে তার বল প্রতিপক্ষের সমান হয়ে যায়।
বিভীষণ বললেন, যেমন ঘোড়দৌড়ের হ্যাণ্ডিক্যাপ।
পরশুরাম বললেন, বৎস হনুমান, কোনও মানুষ তোমার এই বানরিক বিধান মেনে নেবে না। ব্যাসদেব নীরব রয়েছেন কেন, ঘুমিয়ে পড়লেন নাকি? ওহে ব্যাস, ওঠ ওঠ।
পরশুরামের ঠেলায় মহর্ষি ব্যাসের ধ্যানভঙ্গ হল। তিনি বললেন, আমি আপনাদের সব কথাই শুনেছি। এখন একটু সৃষ্টিতত্ত্ব বলছি শুনুন। ভগবান স্বয়ম্ভু কারণবারি সৃষ্টি করে সপ্ত সমুদ্র পূর্ণ করলেন। কালক্রমে সেই বারিতে সর্বজীবের মূলীভূত প্রাণপঙ্ক উৎপন্ন হল, যার পাশ্চাত্ত্য নাম প্রোটোপ্লাজম। কোটি বৎসর পরে তা সংহত হয়ে প্রাণকণায় পরিণত হল, এখন যাকে বলা হয় কোষ বা সেল। এই প্রাণকণাই সকল উদভিদ আর প্রাণীর আদিরূপ। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নেই কিন্তু চেষ্টা আছে, অন্তর্লীন আত্মাও আছে। আরও কোটি বৎসর পরে বহু কণার সংযোগের ফলে বিভিন্ন জীবের উদভব হল, যেমন ইষ্টকের সমবায়ে অট্টালিকা। প্রাণকণার যে পৃথক প্রাণ আর আত্মা ছিল, জীবশরীরে তা সংযুক্ত হয়ে গেল। ক্রমশ জীবের নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ইন্দ্রিয়াদি উদভূত হল কিন্তু বিভিন্ন অবয়বের মধ্যে বিরোধের সম্ভাবনা রইল না, কারণ সর্বশরীরব্যাপী একই প্রাণ আর আত্মা তাদের নিয়ন্তা।
পরশুরাম বললেন, ওহে ব্যাস, তোমার ব্যাখ্যান থামাও বাপু, আমি তোমার শিষ্য নই।
ব্যাস বললেন, দয়া করে আর একটু শুনুন। কালক্রমে জীবশ্রেষ্ঠ মানুষের উৎপত্তি হল তারা সমাজ গঠন করলে। ইতর প্রাণীরও সমাজ আছে, কিন্তু মানবসমাজ এক অত্যাশ্চর্য ক্রমবর্ধমান পদার্থ। বিভিন্ন মানুষ কামনা করছে—আমরা সকলে যেন এক হই। এই কামনার ফলে সামাজিক প্রাণ আর সামাজিক আত্মা ধীরে ধীরে অভিব্যক্ত হচ্ছে, ব্যষ্টিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের স্থানে সমষ্টিগত বৃহৎ স্বার্থের উপলব্ধি আসছে। কিন্তু সৃষ্টির ক্রিয়া অতি মন্থর, একত্ববোধ সম্পূর্ণ হতে বহু কাল লাগবে। তারপর আরও বহু কাল অতীত হলে বিভিন্ন মানব সমাজও একপ্রাণ একাত্মা হবে। তখন বিশ্বমানবাত্মক বিরাট পুরুষই সমস্ত সমাজ আর মানুষকে চালিত করবেন, অঙ্গে অঙ্গে যেমন যুদ্ধ হয় না সেইরূপ মানুষে মানুষেও যুদ্ধ হবে না।
পরশুরাম প্রশ্ন করলেন, তোমার এই সত্যযুগ কত কাল পরে আসবে?
—বহু বহু কাল পরে। তত দিন মানবজাতির বিরোধ নিবৃত্ত হবে না। কিন্তু লোকহিতৈষী মহাত্মারা যদি অহিংসা আর মৈত্রী প্রচার করতে থাকেন তবে তাঁদের চেষ্টার ফলে ভাবী সত্যযুগ তিল তিল করে এগিয়ে আসবে। এখন আপনারা নিজ নিজ স্থানে ফিরে যান, দশ বিশ হাজার বৎসর ধৈর্য ধরে থাকুন, তারপর আবার এখানে সমবেত হয়ে তৎকালীন অবস্থা পর্যালোচনা করবেন।
পরশুরাম বললেন, হুঁ, খুব ধূমপান করেছ দেখছি, দশ—বিশ হাজার বৎসর বলতে মুখে বাধে না। ও সব চলবে না বাপু, আমি এখন বিষ্ণুর কাছে যাচ্ছি। তাঁকে বলব, আর বিলম্ব কেন, কল্কিরূপে অবতীর্ণ হও, ভূভার হরণ কর, পাপীদের নির্মূল করে দাও, অলস অকর্মণ্য দুর্বলদেরও ধ্বংস করে ফেল, তবেই বসুন্ধরা শান্ত হবেন। আর, তোমার যদি অবসর না থাকে তো আমাকে বল, আমিই না হয় আর একবার অবতীর্ণ হই।
১৩৫৯(১৯৫২)
গনৎকার
লোকটির নাম হয়তো আপনাদের মনে আছে। কয়েক বৎসর আগে খবরের কাগজে তাঁর বড় বড় বিজ্ঞাপন ছাপা হত–ডক্টর মিনাল্ডার দ মাইটি, জগদবিখ্যাত গ্রীক অ্যাস্ট্রোপামিস্ট, ত্রিকালজ্ঞ জ্যোতিষী, হস্তরেখাবিশারদ, ললাটলিপিপাঠক, গ্রহরত্ন বিধায়ক, হিপনটিস্ট, টেলিপ্যাথিস্ট, ক্লেয়ারভয়ান্ট ইত্যাদি। ইনি ইজিপ্টে বহু দিন গবেষণা করে হামেটিক গুপ্তবিদ্যা আয়ত্ত করেছেন, দামস্কসে কালডীয় জ্যোতিষের রহস্য ভেদ করেছেন, কামরূপ কামাখ্যায় তমলু শিখেছেন, কাশীতে ভূগসংহিতার হাড়হন্দ জেনে নিয়েছেন। কিছুই জানতে এর বাকী নেই।
আমার ভাগনে বঙ্কার মুখে তাঁর উচ্ছসিত প্রশংসা শুনলুম–। ওঃ, এমন মহাপরষে দেখা যায় না, কলকাতার সমস্ত রাজজ্যোতিষীর অন্ন মেরে দিয়েছেন। বড় বড় ব্যারিস্টার উকিল ডাক্তার মন্ত্রী দেশনেত প্রফেসর সাহিত্যিক সবাই দলে দলে তাঁর কাছে যাচ্ছেন আর থ হয়ে ফিরে আসছেন। মামা, তোমার তো সময়টা ভাল যাচ্ছে না, একবার এই গ্রীক গনকার ডক্টর মিনাল্ডারের কাছে যাও না। ফী মোটে কুড়ি টাকা। আট নম্বর পিটারকিন লেন, দেখা করবার সময় সকাল আটটা থেকে দশটা, বিকেলে তিনটে থেকে সন্ধ্যে সাতটা।
গনৎকারের কাছে যাবার কিছুমাত্র আগ্রহ আমার ছিল না। একদিন কাগজে মিনাল্ডার দ মাইটির ছবি দেখলুম। মাথায় মুকুটের মতন টুপি, উজ্জ্বল তীক্ষ দৃষ্টি, দু ইঞ্চি ঝোলা গোঁফ, ছ ইঞ্চি লম্বা দাড়ি, গায়ে একটা নকশাদার উত্তরীয়, সেকালের গ্রীকদের মতন ডান হাতের নীচ দিয়ে কাঁধের উপরে পড়েছে। গলায় কোমর পর্যন্ত ঝোলা রাশীচ মাকা হার। মুখখানা যেন চেনা চেনা মনে হল। টুপি আর গোঁফদাড়ি চাপা দিয়ে খুব ঠাউরে দেখলাম। আরে! এ যে আমাদের ও ফ্লেণ্ড মীনেন্দু মাইতি, ভোল ফিরিয়ে মিনাড়ীর দ মাইটি হয়েছে। তিন বছর আগেও আমার কাছে মাঝে মাঝে আসত, তার কিছু, উপকারও আমি করেছিলাম। কিন্তু তার পরেই সে গা ঢাকা দিল। আমাকে এড়িয়ে চলত, চিঠি লিখলে উত্তর দিত না। স্থির করলম, এনগেজমেন্ট না করেই দেখা করব।
ভাগ্যজিজ্ঞাসুর ভিড় এড়াবার জন্যে আটটার দু-চার মিনিট আগেই গেলুম। চৌরঙ্গী রোড থেকে একটি গলি বেরিয়েছে পিটারকিন লেন। আট নম্বরের দরজায় একটি বড় নেমপ্লেট আঁটা–ডক্টর মিনাল্ডার দ মাইটি, নীচে ইংরেজী বাঙলা হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় লেখা আছে—সোজা দোতলায় চলে আসন। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠলম। সামনের দরজায় নোটিস আছে—ওয়েলকম, ভিতরে এসে বসুন।
ঘরটিতে আলো কম। একটা টেবিলের চার দিকে কতকগুলো চেয়ার আছে, আর কেউ সেখানে নেই। পাশের ঘরের পর্দা ভেদ করে মদ, কণ্ঠস্বর আসছে। বুঝলাম, আমার আগেই অন্য মক্কেল এসে গেছে। হঠাৎ দেওয়ালে একটা ফ্রেমের ভিতর আলোকিত অক্ষর ফটে উঠল—ওয়েট প্লীজ, একটু পরেই আপনার পালা আসবে। টেবিলে গোটাকতক পুরনো সচিত্র মার্কিন পত্রিকা ছিল, তারই পাতা ওলটাতে লাগলুম।
কিছুক্ষণ পরে আরও দুজন এসে আমার পাশের চেয়ারে বসলেন। একজনের বয়স ত্রিশ-বত্রিশ, অন্য জনের পঁচিশ-ছাব্বিশ। প্রথম লোকটি আমাকে প্রশ্ন করলেন, অনেকক্ষণ বসে আছেন নাকি মশাই?
উত্তর দিলাম, তা প্রায় দশ মিনিট হবে।
-তবেই সেরেছে, আমাকে হয়তো ঘণ্টা খানিক ওয়েট করতে হবে। এই রতন, তুই শুধু শুধু এখানে থেকে কি করবি, বাড়ি যা।
রতন বলল, কেন, আমি তো বাগড়া দিচ্ছি না গোঠ-দী। গনৎকার সায়েব তোমাকে কি বলে না জেনে আমি নড়ছি না।
গোষ্ঠ-দা আমার দিকে চেয়ে বললেন, দেখুন তো মশাই রতনার আক্কেল। আমি এসেছি নিজের ভাগ্যি জানতে, তুই কি করতে থাকবি?
আমি বললাম, আপনার ভাগফল উনিও জানতে চান। আপনার আত্মীয় তো?
–আত্মীয় না হাতি। এ শালা আমার জোঁক, কেবল চুষে খাবার মতলব।
রতন বলল, আগে থাকতে শালা শালা ব’লো না মাইরি। আগে বিজির সঙ্গে তোমার বে হয়ে যাক তার পর যত খুশি বলো।
-আরে গেল যা। বিজিকেই যে বে করব তার ঠিক কি? গুলরাণীও তো নিন্দের সম্বন্ধ নয়। কি বলেন সার?
টআমি বললাম, আপনাদের তকের বিষয়টা আমি তো কিছুই জানি না।
–তা হলে ব্যাপারটা খুলে বলি শুনুন। আমি হলাম শ্রীগো বিহারী সাঁতরা, শ্যামবাজারের মোড়ে সেই যে ইম্পিরিয়াল টি-শপ আছে তারই সোল প্রোপাইটার। তা আপনার আশীর্বাদে দোকানটি ভালই চলছে। এখন আমার বয়স হল গে ত্রিশ পেরিয়ে একত্রিশ, এখনও যদি সংসার ধর্ম না করি তবে কবে করব? বড়ো বয়সে বে করে লাভ কি? কি বলেন আপনি, আ? এখন সমিস্যে হয়েছে পাত্রী নিয়ে, দুটি আমার হাতে আছে। এক নম্বর হল, নফর দাসের মেয়ে গুলরানী, ভাল নাম গোলাপসুন্দরী। দেখতে তেমন সুবিধের নয়, একটু কুলীও বটে। কিন্তু বাপের টাকা আছে, বিয়ে করলে কিছু, পাওয়া যাবে। তার পর ধরুন, যদি কারবারটি বাড়াতে চাই তবে শ্বশুরের কাছ থেকে কোন না আরও হাজার খানিক টাকা বাগাতে পারব। দু নম্বর পাত্রী হচ্ছে বিজনবালা, ডাক নাম বিজি, এই রতন শালার বোন। বাপ নেই, শুধু বুড়ী মা আর এই ভাগাবশও ভাইটা আছে, অবস্থা খারাপ, বরপণ নবডঙ্কা। কিন্তু মেয়েটা দেখতে অতি খাসা, নানা রকম রান্না জানে, এক পো মাংসের সঙ্গে দেদার মোচা এচড় ডুমুরের কিমা মিশিয়ে শ-খানিক এমন চপ বানাবে যে আপনি ধরতেই পারবেন না যে তার চোদ্দ আনা নিরিমিষ। বিজিকে বে করলে সে আমার সত্যিকার পার্টনার হবে। শ্বশুরের টাকা নাই বা পেলুম, আপনার আশীর্বাদে আমার পজি নেহাত মন্দ নেই। ইচ্ছে আছে টি-শপটির বোম্বাই প্যাটান নাম দেব, নিখিল ভারত বিশ্রান্তি গহ। চপ কাটলেট ডেভিল মামলেট এই সব তৈরি করব, খদ্দেরের অভাব হবে না মশাই। আমার খুব ঝোঁক বিজির ওপর, কিন্তু মুশকিল হয়েছে তার মা আর বাউণ্ডুলে ভাইটা আমার ঘাড়ে পড়বে। বড়ী শ্বাশুড়ীকে পুষতে আপত্তি নেই, কিন্তু এই রতনা আমার কাঁধে চাপবে আর বোনের কাছ থেকে হরদম টাকা আদায় করবে তা আমি চাই না।
রতন বলল, আমি কথা দিচ্ছি তোমার কাঁধে চাপব না। আমার ভাবনা কি, ইলেকট্রিকের সব কাজ জানি, আর্মেচারের তার পর্যন্ত জড়াতে পারি। একটা ভাল চাকরি যোগাড় করতে পারি না মনে কর?
–যোগাড় করতে পারিস তো করিস না কেন রে হতভাগা। এ পর্যন্ত অনেক কাজ তো পেয়েছিলি, একটাতেও লেগে থাকতে পারলি নি কেন? ওই কিরণ চক্কোত্তি তোর মাথা খেয়েছে, দিনরাত তার তরণে অপেরা পার্টিতে আড্ডা দিস, হয়তো নেশা-ভাঙও করিস।
–মাইরি বলছি গোষ্ঠ-দা, খারাপ নেশা আমি করি না। মাঝে মাঝে একটু সিদ্ধির শরবত খাই বটে, কিন্তু খুব মাইন্ড।
আমি বললাম, গোষ্ঠবাবু আপনার সমস্যাটি তো তেমন কঠিন নয়। যখন শ্রীমতী বিজনবালাকে মনে ধরেছে তখন তাঁকে বিয়ে করাই তো ভাল। একটু রিস্ক না হয় নিলেন।
–আপনি জানেন না মশাই, এই রতনা সোজা রিস্ক নয়। সেই জন্যেই তো এই সায়েব জ্যোতিষীর কাছে এসেছি, আমার ঠিকুজিটাও এনেছি। ইনি সব কথা শুনে আমার হাত দেখে আর আঁক কষে যার নাম বলবেন, বিজনবালা কি গোলাপসুন্দরী, তাকেই প্রজাপতির নিবন্ধ মনে করে বে করব। কুড়ি টাকা লাগে লাগুক, একটা তো হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।
–আচ্ছা, এই রতন যদি কলকাতার বাইরে একটা ভাল কাজ পায়, তা হলে তো আপনার সুরাহা হতে পারে?
–সুরাহা নিশ্চয় হয়, আমি তা হলে নিশ্চিন্দি হয়ে বিজিকে বে করতে পারি। কিন্তু তেমন চাকরি ওকে দিচ্ছে কে?
-রতনবাবু তোমার লাইসেন্স আছে?
রতন বলল, আছে বইকি, ভাল ভাল সার্টিফিকিটও আছে। দয়া করে একটি কাজ যোগাড় করে দিন না সার, গোঠ-দার গঞ্জনা আর সইতে পারি না।
আমি বললাম, শোন রতন। একটি এঞ্জিনিয়ারিং ফার্মের সঙ্গে আমার যোগ আছে, শিলিগুড়ি ব্লঞ্চের জন্যে একজন ফিটার মিস্ত্রী দরকার। তোমাকে কাজটি দিতে পারি, প্রথমে এক শ টাকা মাইনে পাবে, তিন মাস প্রোবেশনের পর দেড় শ। কিন্তু শত এই, একটি বৎসর শিলিগুড়ি থেকে নড়বে না, তবে বোনের বিয়ের সময় চার-পাঁচ দিন ছুটি পেতে পার। রাজী আছ?
—এক্ষুনি। দিন, পায়ের ধুলো দিন সার। অপেরা পার্টি ছেড়ে দেব, কিরণ চক্কোত্তির সঙ্গে আমার বনছে না, আজ পর্যন্ত আমাকে একটি টাকাও দেয় নি।
—তা হলে তুমি আজই বেলা তিনটের সময় আমাদের অফিসে গিয়ে দেখা ক’রো। ঠিকানাটা লিখে নাও।
ঠিকানা লিখে নিয়ে রতন বলল, গো-দা, তোমার সমিসো তো মিটে গেল, মিছিমিছি গনৎকার সায়েবকে কুড়ি টাকা দেবে কেন। চল, বাড়ি ফেরা যাক।
গোষ্ঠ সাঁতরা বললেন, কোথাকার নিমকহারম তুই! এই ভদ্র লোকের হাত দেখে জ্যোতিষী কি বলেন তা না জেনেই যাবি?
লজ্জায় জিব কেটে রতন নিজের কান মলল। এমন সময় জ্যোতিষীর খাস কামরার পর্দা ঠেলে দুজন গুজরাটী ভদ্রলোক হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন, নিশ্চয় সফল পেয়েছেন। এরা চলে গেলে জ্যোতিষীর কামরায় একটা ঘণ্টা বেজে উঠল। একটু পরে একজন মহিলা এলেন, কালো শাড়ি, নীল ব্লাউজ, কাঁধে রাশিচকু মাকা লাল ব্যাজ। ইনি বোধ হয় ডক্টর মিনাল্ডারের সেক্রেটারি। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি আগে এসেছেন?
উত্তর দিলুম, আজ্ঞে হাঁ।
–আপনার নাম আর ঠিকানা? জন্মস্থান আর জন্মদিন?
সব বললম, উনি নোট করে নিলেন।
–কুড়ি টাকা ফী দিতে হবে জানেন তো?
–জানি, টাকা সঙ্গে এনেছি।
–কি জানবার জন্যে এসেছেন?
—আসন্ন ভবিষ্যতে আমার অর্থপ্রাপ্তিযোগ আছে কিনা।
–বুঝলম না, সোজা বাঙলায় বলুন।
—জানতে চাই, ইমিডিয়েট ফিউচারে কিছু টাকা পাওয়া যাবে কিনা।
সেক্রেটারি নোট করে নিলেন। তার পর গোষ্ঠ সাঁতরাকে বললেন, আপনার কি প্রশ্ন?
গোষ্ঠবাবু সহাস্যে বললেন, কিছু, না, আমি আর রতন এই এনার সঙ্গে এসেছি।
তিন মিনিট পরেই সেক্রেটারি ফিরে এসে আমাকে বললেন, ডক্টর মিনাল্ডার আপনাকে জানাচ্ছেন, এখন আপনার বরাতে টাকার ঘরে শন। বছর খানিক পরে আর একবার আসতে পারেন।
গোষ্ঠবাবু আশ্চর্য হয়ে বললেন, বা রে, এ কি রকম গোনা হল? আপনাকে না দেখেই ভাগ্যফল বললেন!
আমি বললাম, বুঝলেন না গোষ্ঠবাবু, এই মিনাণ্ডার সায়েবের দিব্যদৃষ্টি আছে, না দেখেই ভাগ্য বলে দিতে পারেন। চলুন, ফেরা যাক।
নেমে এসে গোঠবাবু বললেন, ব্যাপারটা কি মশাই? জ্যোতিষী আপনার সঙ্গে দেখা করলেন না, ফীও নিলেন না, এ তো ভারি তাজব!
বললুম, ব্যাপার অতি সোজা। এই জ্যোতিষীটি হচ্ছেন আমার পুরনো বন্ধু মীনেন্দু মাইতি, ভোল ফিরিয়ে মিনাণ্ডার দ মাইটি হয়েছেন। তিন বছর আগে আমার কাছ থেকে কিছু মোটা রকম ধার নিয়েছিলেন, বার বার তাগিদ দিয়েও আদায় করতে পারি নি। অনেক দিন নিখোঁজ ছিলেন, এখন গ্রীক গনৎকার সেজে আসরে নেমেছেন। তাই আমার পাওনা টাকাটা সম্বন্ধে ওঁকে প্রশ্ন করেছিলাম।
রতন বলল, আপনি ভাববেন না সার, জোচ্চোরটাকে নির্ঘাত শায়েস্তা করে দেব। দয়া করে আমাকে তিনটি দিন ছুটি দিন, আমি দলবল নিয়ে এর দরজার সামনে পিকেটিং করব, আর গরম গরম দোগান আওড়াব। বাছাধন টাকা শোধ না করে রেহাই পাবেন না।
রতনের পিকেটিংএ সফল হয়েছিল। ডক্টর মিনাণ্ডার দ মাইটি আমার প্রাপ্য টাকার অর্ধেক দিয়ে জানালেন, পশার একটু বাড়লে বাকীটা শোধ করবেন। কিন্তু কলকাতায় তিনি টিকতে পারলেন না, এখানকার পাট তুলে দিয়ে ভাগ্যপরীক্ষার জন্যে দিল্লি চলে গেলেন।
গামানুষ জাতির কথা
যেসময়ের কথা বলছি তার প্রায় ত্রিশ বৎসর আগে পৃথিবী থেকে মানবজাতি লুপ্ত হয়ে গেছে। তর্ক উঠতে পারে, আমরা সকলেই যখন পঞ্চত্ব পেয়েছি তখন এই গল্প লিখছে কে, পড়ছেই বা কে। দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। লেখক আর পাঠকরা দেশ—কালের অতীত, তাঁরা ত্রিলোকদর্শী ত্রিকালজ্ঞ। এখন যা হয়েছিল শুনুন।
বড় বড় রাষ্ট্রের যাঁরা প্রভু তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য অনেক দিন থেকেই চলছিল। ক্রমশঃ তা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা দাঁড়াল যে মিটমাটের আর আশা রইল না। সকলেই নিজের নিজের ভাষায় দ্বিজেন্দ্রলালের এই গানটি ন্যাশনাল অ্যানথেম রূপে গাইতে লাগলেন—’আমরা ইরান দেশের কাজী, যে বেটা বলিবে তা না না না সে বেটা বড়ই পাজী।’ অবশেষে যখন কর্তারা স্বপক্ষের জ্ঞানী—গুণীদের সঙ্গে মন্ত্রণা করে নিঃসন্দেহ হলেন যে বজ্জাত বিপক্ষ গোষ্ঠীকে একেবারে নির্মূল করতে না পারলে বেঁচে সুখ নাই তখন তাঁরা পরস্পরের প্রতি অ্যানাইহিলিয়ম বোমা ছাড়লেন। বিজ্ঞানের এই নবতম অবদানের তুলনায় সেকেলে ইউরেনিয়ম বোমা তুলো—ভরা বালিশ মাত্র।
প্রত্যেক রাষ্ট্রের বোমা—বিশারদগণ আশা করেছিলেন যে অপরাপর পক্ষের যোগাড় শেষ হবার আগেই তাঁরা কাজ সাবাড় করবেন। কিন্তু দুর্দৈবক্রমে সকলেরই আয়োজন শেষ হয়েছিল এবং তাঁরা গুপ্তচরের মারফত পরস্পরের মতলব টের পেয়ে একই দিনে একই শুভলগ্নে ব্রহ্মাস্ত্র মোচন করলেন।
সভ্য অর্ধসভ্য অসভ্য কোনও দেশ নিস্তার পেলে না। সমগ্র মানবজাতি, তার সমস্ত কীর্তি, পশু—পক্ষী, কীট—পতঙ্গ, গাছপালা, মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস হল। কিন্তু প্রাণ বড় কঠিন পদার্থ, তার জের মেটে না। সাগরগর্ভে পবর্তকন্দরে জনহীন দ্বীপে এবং অন্যান্য কয়েকটি দুষ্প্রবেশ্য—স্থানে কিছু উদ্ভিদ আর ইতর প্রাণী বেঁচে রইল। তাদের বিস্তারিত বিবরণে আমাদের দরকার নেই, যাদের নিয়ে এই ইতিহাস তাদের কথাই বলছি।
লণ্ডন প্যারিস নিউইয়র্ক পিকিং কলকাতা প্রভৃতি বড় বড় শহরে রাস্তার নীচে যে গভীর ড্রেন ছিল তাতে লক্ষ লক্ষ ইঁদুর বাস করত। তাদের বেশীর ভাগই বোমার তেজে বিলীন হল, কিন্তু কতকগুলি তরুণ আর তরুণী ইঁদুর দৈবক্রমে বেঁচে গেল। শুধু বাঁচা নয়, বোমা থেকে নির্গত গামা—রশ্মির প্রভাবে তাদের জাতিগত লক্ষণের আশ্চর্য পরিবর্তন হল, জীববিজ্ঞানীরা যাকে বলেন মিউটেশন। কয়েক পুরুষের মধ্যেই তাদের লোম আর ল্যাজ খসে গেল, সামনের দুই পা হাতের মতন হল, পিছনের পা এত মজবুত হল যে তারা খাড়া হয়ে দাঁড়াতে আর চলতে শিখল, মস্তিষ্ক মস্ত হল, কণ্ঠে তীক্ষ্ন কিচকিচ ধ্বনির পরিবর্তে সুস্পষ্ট ভাষা ফুটে উঠল, এক কথায় তারা মানুষের সমস্ত লক্ষণ পেলো। কর্ণ যেমন সূর্যের বরে সহজাত কুণ্ডল আর কবচ নিয়ে জন্মেছিলেন, এরা তেমনি গামা—রশ্মির প্রভাবে সহজাত প্রখর বুদ্ধি এবং ত্বরিত উন্নতির সম্ভাবনা নিয়ে ধরাতলে আবির্ভূত হল। এক বিষয়ে ইঁদুর জাতি আগে থেকেই মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল—তাদের বংশবৃদ্ধি অতি দ্রুত। এখন এই শক্তি আরও বেড়ে গেল।
এই নবাগত অলাঙ্গুলে দ্বিপাদচারী প্রতিভাবান প্রাণীদের ইঁদুর বলে অপমান করতে চাই না, তা ছাড়া বার বার চন্দ্রবিন্দু দিলে ছাপাখানার উপর জুলুম হবে। এদের মানুষ বলেই গণ্য করা উচিত মনে করি। আমাদের মতন প্রাচীন মানুষের সঙ্গে প্রভেদ বোঝাবার জন্য এই গামা—রশ্মির বরপুত্রগণকে ‘গামানুষ’ বলব।
এখন কিঞ্চিৎ জটিল তত্ত্বের অবতারণা করতে হচ্ছে। যাঁরা ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেন তাঁরা মোটামুটি পঁচিশ বৎসর মানুষের এক পুরুষ এই হিসাবে বংশ—পর্যায় গণনা করেন। অতএব ১৮০০০ বৎসরে ৭২০ পুরুষ। আমাদের ঊর্ধ্বতন ৭২০ নম্বর পুরুষ কেমন ছিলেন? নৃবিদ্যাবিশারদগণ বলেন, এঁরা পুরোপলীয় অর্থাৎ প্রাচীন উপল যুগের লোক, চাষ করতে শেখেন নি, কাপড় পরতেন না, রাঁধতেন না, কাঁচা মাংস খেতেন, গুহায় বাস করতেন। ভেবে দেখুন, মোটে ৭২০ পুরুষে আমাদের কি আশ্চর্য উন্নতি হয়েছে। আমাদের যেমন পঁচিশ বৎসরে, ইন্দুরোদভব গামানুষদের তেমনি পনেরো দিনে এক পুরুষ, কারণ তারা জন্মাবার পনেরো দিন পরেই বংশরক্ষা করতে পারে। মানবজাতি ধ্বংস হবার পর যে ত্রিশ বৎসর অতিক্রান্ত হয়েছে সেই সময়ে গামানুষ জাতির ৭২০ পুরুষ জন্মেছে। অর্থাৎ গা—মানুষের ত্রিশ বৎসর আমাদের ১৮০০০ বৎসরের সমান। যদি সন্দেহ থাকে তবে অঙ্ক কষে মিলিয়ে দেখতে পারেন।
এই সুদীর্ঘ ত্রিশ বৎসরে গামানুষ অতি দ্রুত গতিতে সভ্যতার শীর্ষদেশে উপস্থিত হয়েছে। পূর্বমানব যে বিদ্যা কলা আর ঐশ্বর্যের অহংকার করত গামানুষ তার সমস্তই পেয়েছে। অবশ্য তাদের সকল শাখাই সমান সভ্য আর পরাক্রান্ত হয়নি, তাদের মধ্যেও জাতিভেদ, সাদা—কালার ভেদ, রাজনীতির ভেদ, ছোট বড় রাষ্ট্র, সাম্রাজ্য, পরাধীন প্রজা, দ্বেষ—হিংসা এবং বাণিজ্যিক প্রতিযোগ আছে, যুদ্ধবিগ্রহও বিস্তর ঘটেছে। বার বার মারাত্মক সংঘর্ষের পর বিভিন্ন দেশের দূরদর্শী গামানুষদের মাথায় এই সুবুদ্ধি এল—ঝগড়ার দরকার কি, আমরা সকলে একমত হয়ে কি শান্তিতে থাকতে পারি না? আমাদের বর্তমান সভ্যতার তুলনা নেই, আমরা বিশ্বের বহু রহস্য ভেদ করেছি, প্রচণ্ড প্রাকৃতিক শক্তিকে আয়ত্ত করে কাজে লাগিয়েছি, শারীরিক ও সামাজিক বহু ব্যাধির উচ্ছেদ করেছি, দর্শন ও নীতিশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান লাভ করেছি। আমাদের রাষ্ট্রনেতা ও মহা মহা জ্ঞানীরা যদি একযোগে চেষ্টা করেন তবে বিভিন্ন জাতির স্বার্থবুদ্ধির সমন্বয় অবশ্যই হবে।
জনহিতৈষী পণ্ডিতগণের নির্বন্ধে রাষ্ট্রপতিগণ এক মহতী বিশ্বসভা আহ্বান করলেন। বিভিন্ন দেশ থেকে বড় বড় রাজনীতিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক প্রভৃতি মহা উৎসাহে সেই সভায় উপস্থিত হলেন, অনেক রবাহূত ব্যক্তিও তামাশা দেখতে এলেন। যাঁরা বক্তৃতা দিলেন, তাঁদের আসল নাম যদি গামানুষ ভাষায় ব্যক্ত করি তবে পাঠকদের অসুবিধা হতে পারে সেজন্য কৃত্রিম নাম দিচ্ছি যা শুনতে ভালো এবং অনায়াসে উচ্চারণ করা যায়।
আমাদের দেশে হরেক রকম সভায় কার্যারম্ভের আগে সংগীতের এবং কার্যাবলীর মধ্যে মধ্যে কুমারী অমুক অমুকের নৃত্যের দস্তুর আছে। পরাক্রান্ত গামানুষ জাতির রসবোধ কম, তারা বলে, আগে ষোল আনা কাজ তারপর ফুর্তি। তাদের জীবনকালও কম সেজন্য বক্তৃতাদি অতি সংক্ষেপে চটপট শেষ করে। প্রথমেই সভাপতি মনস্বী চং লিং সকলকে বুঝিয়ে দিলেন যে এই সভায় যে কোনও উপায়ে বিশ্বশান্তির ব্যবস্থা করতেই হবে, নতুবা গামানুষ জাতির নিস্তার নেই।
সভাপতির অভিভাষণের পর একটি অনতিসমৃদ্ধ রাষ্ট্রের প্রতিনিধি কাউণ্ট নটেনফ বললেন, জগতের সম্পদ মোটেই ন্যায়সম্মত পদ্ধতিতে ভাগ করা হয় নি সেই কারণেই বিশ্বশান্তি হচ্ছে না। দু—চারটি রাষ্ট্র অসৎ উপায়ে বড় বড় সাম্রাজ্য লাভ ক’রে দেদার কাঁচা মাল আর আজ্ঞাবহ নিস্তেজ প্রজা হস্তগত করেছে, উপনিবেশও বিস্তর পেয়েছে। কিন্তু আমরা বঞ্চিত হয়েছি, আমাদের বাড়তে দেওয়া হচ্ছে না। যদি যুদ্ধবিগ্রহ বন্ধ করতে হয় তবে বিশ্বসম্পত্তির আধাআধি বখরা আমাদের দিতে হবে।
বৃহত্তম সাম্রাজ্যের প্রতিনিধি লর্ড গ্র্যাবার্থ বললেন, জগতের শান্তিরক্ষার জন্যই আমাদের জিম্মায় বিশাল সাম্রাজ্য থাকা প্রয়োজন, সাম্রাজ্য চালনার অভিজ্ঞতা আমাদের যত আছে তেমন আর কারও নেই। আমরা শক্তিমান হলে তোমরা সকলেই নিরাপদে থাকবে। কাঁচা মাল চাও তো উপযুক্ত শর্তে কিছু দিতে পারি। আমাদের হেফাজতে যেসব অসভ্য অর্ধসভ্য দেশ আছে তার উপর লোভ করো না, আমরা তো সেসব দেশবাসীর অছি মাত্র, তারা লায়েক হলেই ছেড়ে দিয়ে ভারমুক্ত হব। আমরা কারও অনিষ্ট করি না, বিপদ যদি ঘটে আমার বন্ধু কীপফ—এর প্রকাণ্ড দেশই তার জন্য দায়ী হবে। এঁর দেশে স্বাধীন শিল্প আর কারবার নেই, সবই রাষ্ট্রের অঙ্গ। যাঁরা সমাজে মস্তকস্বরূপ সেই অভিজাত আর ধনিক শ্রেণীই ওখানে নেই। এদের কুদৃষ্টান্তে আমাদের শ্রমজীবীরা বিগড়ে যাচ্ছে। দিনকতক পরেই দেখতে পাবেন এঁদের কদর্য নীতি আর সস্তা মালে জগৎ ছেয়ে যাবে, আমাদের সকলের সমাজ ধর্ম আর ব্যবসার সর্বনাশ হবে। যদি শান্তি চান তো আগে এঁদের শায়েস্তা করুন।
জেনারেল কীপফ তাঁর মোটা গোঁফে পাক দিয়ে বললেন, বন্ধুবর লর্ড গ্র্যাবার্থ প্রচণ্ড মিছে কথা বলেছেন তা আপনারা সকলেই বোঝেন। ওঁর রাষ্ট্রই আমাদের সকলকে দাবিয়ে রেখেছে, ওঁরা ঘুষ দিয়ে আমাদের দেশে বারবার বিপ্লব আনবার চেষ্টা করেছেন। এর শোধ একদিন তুলব, এখন বেশী কিছু বলতে চাই না।
পরাধীন দেশের জননেতা অবলদাসজী বললেন, লর্ড গ্র্যাবার্থ যে অছিগিরির দোহাই দিলেন তা নিছক ভণ্ডামি। আমরা লায়েক কি নালায়েক তার বিচারের ভার যদি ওঁরা নিজের হাতে রাখেন তবে কোনও কালেই আমাদের দাসত্ব ঘুচবে না। এই সভার একমাত্র কর্তব্য—সমস্ত সাম্রাজ্যের লোপ সাধন এবং সর্বজাতির স্বাধীনতা স্বীকার। অধীন দেশই দ্বেষ—হিংসার কারণ।
মহাতপস্বী নিশ্চিন্ত মহারাজ চোখ বুজে বসে ছিলেন। এখন মৌন ভঙ্গ করে অবলদাসের পিঠে সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন, কোনও চিন্তা নেই বৎস, আমি আছি। আমার তপস্যার প্রভাবে তোমরা সকলেই যথাকালে শ্রেয়োলাভ করবে। গৌরীশঙ্কর—শিখরবাসী মহর্ষিদের সঙ্গে আমার হরদম চিন্তাবিনিময় হয়, তাঁরা সকলেই আমার সঙ্গে একমত।
কর্মযোগী ধর্মদাসজী বললেন, এসব বাজে কথায় কিছুই হবে না। আগে সকলের চরিত্র শোধন করতে হবে তবে রাষ্ট্রীয় সদবুদ্ধি আসবে। আমার ব্যবস্থা অতি সোজা—সকলে নিরামিষ খাও, সর্বপ্রকার বিলাসিতা বর্জন কর, এক মাস (মানুষের হিসাবে পঞ্চাশ বৎসর) নিরবচ্ছিন্ন ব্রহ্মচর্য পালন কর, এই সময়ের মধ্যে বুড়োরা আপনিই মরে যাবে, নূতন প্রজাও জন্মাবে না, তার ফলে জগতের জনসংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে, খাদ্যাদি প্রয়োজনীয় বস্তুর অভাব থাকবে না। যুদ্ধ দুর্ভিক্ষ মহামারী কিছুই দরকার হবে না, বিশুদ্ধ ধর্মসংগত উপায়ে সকলেরই প্রয়োজন মিটবে।
পণ্ডিত সত্যকামজী বললেন, আমি অনেক চিন্তা করে দেখেছি যুক্তিতর্কে বা অলৌকিক উপায়ে কিছুই হবে না। নিরামিষ ভোজন, বিলাসিতা বর্জন আর ব্রহ্মচর্যও বৃথা, এসব উৎকট ব্যবস্থা আমাদের প্রকৃতিবিরুদ্ধ, আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা জোর করে চালানো যাবে না। আমাদের দরকার সত্যভাষণ। এই সভার সদস্যগণ যদি মনের কপাট খুলে অকপটচিত্তে নিজেদের মতলব প্রকাশ করেন তবে বিশ্বশান্তির উপায় সহজেই নির্ধারণ করা যেতে পারে। আমরা বিজ্ঞানে অশেষ উন্নতি লাভ করেছি কিন্তু গামানুষ চরিত্রের কিছুই করতে পারি নি। তার কারণ, বিজ্ঞানী যে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা করেন তাতে প্রতারণা নেই, জড়প্রকৃতি ঠকায় না, সেজন্য তথ্যনির্ণয় সুসাধ্য হয়। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রভুরা মিথ্যা ভিন্ন এক পা চলতে পারেন না। এঁদের গূঢ় অভিপ্রায় কি তা প্রকাশ করে না বললে শান্তির উপায় বেরুবে না। রোগের সব লক্ষণ না জানলে চিকিৎসার ব্যবস্থা হবে কি করে?
লর্ড গ্র্যাবার্থ ওষ্ঠ কুঞ্চিত করে বললেন, কেউ যদি মনের কথা বলতে না চায় তবে কার সাধ্য তা টেনে বার করে। সত্য কথা বলাবেন কোন উপায়ে?
জেনারেল কীপফ বললেন, ওষুধ খাইয়ে। সোডিয়াম পেণ্টোথাল শুনেছেন? এর প্রভাবে সকলেই অবশ হয়ে সত্য কথা বলে ফেলে। আমাদের দেশে রাষ্ট্রদ্রোহীদের এই জিনিসটি খাইয়ে দোষ কবুল করানো হয়, তার পর পটাপট গুলি। আমরা মকদ্দমায় সময় নষ্ট করি না, উকিলকেও অনর্থক টাকা দিই না।
বিশ্ববিখ্যাত বিচক্ষণ বৃদ্ধ ডাক্তার ভৃঙ্গরাজ নন্দী বললেন, বোকা, বোকা, সব বোকা। পেণ্টোথালে লোকে জড়বুদ্ধি হয়। সত্য কথা বলে বটে, কিন্তু বিচারের ক্ষমতা লোপ পায়। আমরা এখানে নেশা করে আড্ডা দিতে আসি নি, জটিল বিশ্বরাজনীতিক সমস্যার সমাধান করতে এসেছি। পেণ্টোথালের কাজ নয়, আমার সদ্য আবিষ্কৃত ভেরাসিটিন ইনজেকশন দিতে হবে। গাঁজা থেকে উৎপন্ন, অতি নিরীহ বস্তু, কিন্তু অব্যর্থ। যতই ঝানু কূটবুদ্ধি হন না কেন, ঘাড় ধরে আপনাকে সত্য বলাবে, অথচ বুদ্ধির কিছুমাত্র হানি করবে না। স্থায়ী অনিষ্টেরও ভয় নেই, এক ঘণ্টা পরে প্রভাব কেটে যাবে, তার পর যত খুশি মিথ্যা বলতে পারবেন। ওষুধটি আমার সঙ্গেই আছে, সভাপতি মশায় যদি আদেশ দেন তবে সকলকেই এক মুহূর্তে সত্যবাদী করে দিতে পারি।
কাউণ্ট নটেনফ প্রশ্ন করলেন, পরীক্ষা হয়েছে?
ভৃঙ্গরাজ উত্তর দিলেন, হয়েছে বইকি। বিস্তর ইঁদুর আর গিনিপিগের উপর পরীক্ষা করেছি।
জেনারেল কীপফ অট্টহাস্য করে বললেন, ইঁদুরের আবার সত্য মিথ্যা আছে নাকি? আপনি তাদের ভাষা জানেন?
নন্দী বললেন, নিশ্চয় জানি, তাদের ভঙ্গী দেখে বুঝতে পারি। যদি বাঁয়ে ল্যাজ নাড়ে তবে জানবেন মতলব ভালো নয়, উদ্দেশ্য গোপন করছে। যদি ডাইনে নাড়ে তবে বুঝবেন তার মনে কোনো ছল নেই। তা ছাড়া আমার এক শিষ্যের উপর পরীক্ষা করেছি, তার ফলে বেচারার পত্নী বিবাহভঙ্গের মামলা এনেছে।
সভাপতি চং লিং বললেন, সন্দেহ রাখবার দরকার কি, এইখানেই পরীক্ষা হ’ক না। কে ভলণ্টিয়ার হতে চান—বিজ্ঞানপ্রেমী কে আছেন—এগিয়ে আসুন।
ধর্মদাসজী ডাক্তার নন্দীর কাছে এসে হাত বাড়িয়ে বললেন, আমি রাজী আছি, দিন ইনজেকশন।
নন্দী তখনই পকেট থেকে প্রকাণ্ড একটি ম্যাগাজিন—সিরিঞ্জ বার করে ধর্মদাসের হাতে ফুঁড়ে পনেরো ফোঁটা আন্দাজ চালিয়ে দিলেন। ওষুধের ক্রিয়ার জন্য দু’মিনিট সময় দিয়ে সভাপতি বললেন, ধর্মদাসজী, এইবারে আপনার মনের কথা খুলে বলুন।
ধর্মদাস বললেন, নিরামিষ ভোজন, খাদ্যে মসলা বর্জন, সর্ব বিষয়ে অবিলাসিতা আর নিরবচ্ছিন্ন ব্রহ্মচর্য। তবে আমিও মাঝে মাঝে আদর্শচ্যুত হয়েছি।
জেনারেল কীপফ সহাস্যে বললেন, এসব পাগলদের উপর পরীক্ষা করা বৃথা, এরা স্বাভাবিক অবস্থাতেও বেশী মিথ্যে বলে না, যা বিশ্বাস করে তাই প্রচার করে। আসুন, আমাকেই ইনজেকশন দিন, সত্য মিথ্যা কিছুতেই আমার আপত্তি নেই।
লর্ড গ্র্যাবার্থ অত্যন্ত চঞ্চল হয়ে কীপফের হাত ধরে বললেন, করেন কি, ক্ষান্ত হন, এসব বিশ্রী ব্যাপারে থাকবেন না। যার আত্মসম্মানবোধ আছে সে কখনও এতে রাজী হতে পারে? অভিপ্রায় গোপনে আমাদের বিধিদত্ত অধিকার, একটা হাতুড়ে ডাক্তারের পাল্লায় পড়ে তা ছেড়ে দিতে পারি না। স্থূল মিথ্যা অতি বর্বর জিনিস তা স্বীকার করি, কিন্তু সূক্ষ্ম মিথ্যা অতি মহামূল্য অস্ত্র, ত্যাগ করে লাগাতে পারলে জগৎ জয় করা যায়, তা আমরা কিছুতেই ছাড়তে পারি না। পরিমার্জিত মিথ্যাই সভ্যসমাজের আশ্রয় আর আচ্ছাদন, সমস্ত লোকাচার আর রাজনীতি তার উপর প্রতিষ্ঠিত। আপনার লজ্জা নেই? এই সভার মধ্যে উলঙ্গ হওয়া যা, মনের কথা প্রকাশ করাও তা।
জেনারেল কীপফ নিরস্ত হলেন না, গ্র্যাবার্থের মুঠো থেকে নিজের হাত সজোরে টেনে বাড়িয়ে দিলেন, ডাক্তার নন্দীও তৎক্ষণাৎ সূচীপ্রয়োগ করলেন। তারপর কীপফ দুই হাতে গ্র্যাবার্থকে জাপটে ধরে বললেন, শীগগির, এঁকেও ফুঁড়ে দিন, একটু বেশী করে দেবেন। ডাক্তার ভৃঙ্গরাজ নন্দী ডবল মাত্রা ভেরাসিটিন চালিয়ে দিলেন। কীপফের স্থূল লোমশ বাহুর বন্ধনে ছটফট করতে করতে গ্র্যাবার্থ বললেন, একি অত্যাচার! আপনারা সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছেন। সভাপতি মশায়, আপনি একেবারে অকর্মণ্য। উঠুন, এখনই আমার রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর কাছে টেলিফোন করুন।
কীপফ বললেন, বড় বেয়াড়া পেশেন্ট, হাড়ে হাড়ে রোগ ঢুকেছে, লাগান আরও দুই ডোজ। ডাক্তার নন্দী বিনা বাক্যবায়ে আর একবার ফুঁড়ে দিলেন। তারপর গ্র্যাবার্থ ক্রমশ শান্ত হয় মৃদুস্বরে বললেন, শুধু আমাদের দুজনকে কেন? ওই বজ্জাত গুণ্ডা নটেনফটাকেও দিন।
নটেনফ ঘুঁষি তুলে গ্র্যাবার্থকে আক্রমণ করতে এলেন। কীপফ তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললেন, থামুন থামুন, সত্য বলতে এত ভয় কিসের? আমরা সকলেই তো পরস্পরের অভিসন্ধি বুঝি, খোলসা করে বললে কি এমন ক্ষতি হবে?
নটেনফ চুপি চুপি বললেন, আরে, তোমাদের আমি গ্রাহ্য করি নাকি? আমার আপত্তির কারণ আলাদা। আন্তর্জাতিক অশান্তির চেয়ে পারিবারিক অশান্তি আরও ভয়ানক।
এমন সময় দর্শকদের গ্যালারি থেকে কাউণ্টেস নটেনফ তারস্বরে বললেন, দিন জোর করে ফুঁড়ে, কাউণ্ট অতি মিথ্যাবাদী, চিরকাল আমাকে ঠকিয়েছে।
এই হট্টগোলের সুযোগে ডাক্তার নন্দী হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এসে নটেনফের নিতম্বে ভেরাসিটিন প্রয়োগ করলেন। নটেনফপত্নী চিৎকার করে বললেন, এইবার কবুল কর তোমার প্রণয়িনী কে কে।
সভাপতি চং লিং বললেন, ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, প্রণয়িনীরা পালিয়ে যাবে না, এখন আমাদের কাজ করতে দিন। লর্ড গ্র্যাবার্থ, কাউণ্ট নটেনফ, জেনারেল কীপফ, এখন একে একে খুলে বলুন আপনাদের রাজনীতিক উদ্দেশ্য কি।
গ্র্যাবার্থ বললেন, আমাদের উদ্দেশ্য অতি সোজা, জোর যার মুলুক তার এই হচ্ছে একমাত্র রাজনীতি। পরহিতৈষিতা আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বেশ, কিন্তু আন্তর্জাতিক ব্যাপারে তার স্থান নেই। আমরা সভ্য অসভ্য শক্তিমান দুর্বল সকল জাতির কাছ থেকে যথাসাধ্য আদায় করতে চাই, এতে ন্যায়—অন্যায়ের কথা আসে না। দুধ খাবার সময় বাছুরের দুঃখ কে ভাবে? যখন মাংসের জন্য বা অন্য প্রয়োজনে গরু ভেড়া বাঘ সাপ ইঁদুর মশা মারেন তখন, জীবের স্বার্থ গ্রাহ্য করেন কি? উদভিদেরও প্রাণ আছে, অহিংস হয়ে পাথর খেয়ে বাঁচতে পারেন কি? আমরা সর্বপ্রকার সুখভোগ করতে চাই, তার জন্য সর্বপ্রকার দুষ্কর্ম করতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু আমাদের নিরঙ্কুশ হবার উপায় নেই, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী আছে, নিজের স্বভাবগত কোমলতা আছে—যাকে মূর্খরা বলে বিবেক বা ধর্মজ্ঞান। তা ছাড়া স্বজাতি আর মিত্রস্থানীয় বিজাতির মধ্যে জনকতক দুর্বলচিত্ত ধর্মিষ্ঠ আছে, তাদের সব সময় ধাপ্পা দেওয়া চলে না, ঠাণ্ডা রাখবার জন্য মাঝে মাঝে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। এই সভার যা উদ্দেশ্য তা কোনও কালে সিদ্ধ হবে না। প্রতিপক্ষের ভয়ে বাধ্য হয়ে মাঝে মাঝে যৎকিঞ্চিৎ স্বার্থত্যাগ করতে পারি, কিন্তু পাকা ব্যবস্থায় রাজী নই, আজ যা ছাড়ব সুবিধা পেলেই কাল আবার দখল করব। অভিব্যক্তিবাদ তো আপনারা জানেন, বেশী কিছু বলবার দরকার নেই।
নটেনফ বললেন, আমাদের নীতিও ঠিক ওই রকম। কর্মপদ্ধতির অল্প অল্প ভেদ আছে, কিন্তু মতলব একই। আমরা জাত্যাংশে সর্বশ্রেষ্ঠ, জগতের একাধিপত্য একদিন আমাদের হাতে আসবেই, ছলে বলে কৌশলে যেমন করে হ’ক আমরা মনস্কামনা সিদ্ধ করব।
কীপফ বললেন, আমরাও তাই বলি, তবে আপনাদের আর আমাদের পদ্ধতিতে বিলক্ষণ প্রভেদ আছে। ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশটি প্রকাণ্ড, এখনও অন্য দেশকে শোষণ করবার বিশেষ দরকার হয় নি, তবে ভবিষ্যৎ ভেবে আমরা এখন থেকেই হাত পাকাচ্ছি।
অবলদাসজী মাথাচাপড়ে বললেন, হায় হায়, এর চেয়ে মিথ্যা কথাই যে ভাল ছিল! তবু একটা আশা ছিল যে এরা এখন ক্ষমতার দম্ভে বুঝতে পারছে না, পরে হয়তো এদের ন্যায়বুদ্ধি জাগ্রত হবে। আচ্ছা লর্ড গ্র্যাবার্থ, একটা প্রশ্নের উত্তর দিন। আমরা অধীন জাতিরা একটু একটু করে শক্তিমান হচ্ছি। আপনারা যাই বলুন, জগতে সকল দেশে এখনও সাধু লোক আছেন, তাঁরা আমাদের সহায়। আমরা একদিন বন্ধনমুক্ত হবই। আমাদের মনে যে বিদ্বেষ জমছে তার ফলে ভবিষ্যতে আপনাদের কি সর্বনাশ হবে তা বুঝছেন? আমাদের সঙ্গে যদি এখনই একটা ন্যায়সংগত চুক্তি করেন এবং তার জন্য অনেকটা ত্যাগ স্বীকার করেন তবে ভবিষ্যতে আমরা আপনাদের একেবারে বঞ্চিত করব না। এই সহজ সত্যটা আপনাদের মাথায় ঢোকে না কেন?
গ্র্যাবার্থ বললেন, অবশ্যই ঢোকে। কিন্তু সুদূর ভবিষ্যতে এক আনা পাব সেই আশায় উপস্থিত ষোল আনা কেন ছাড়ব? আমাদের অতিবৃদ্ধ প্রপৌত্রের জন্য মাথাব্যথা নেই।
অবলদাস দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বসে পড়লেন। নিশ্চিন্ত মহারাজ আর একবার তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, ভয় কি, আমি আছি।
ধর্মদাস বললেন, ইনজেকশান দিয়ে কি ভাল হল? সবই তো আমাদের জানা কথা। আমাদের শাস্ত্রে অসুরপ্রকৃতির লক্ষণ দেওয়া আছে—
ইদমদ্য ময়া লব্ধমিদং প্রাপস্যে মনোরথম।
ইদমস্তীদমপি মে ভবিষ্যতি পুনর্ধনম।।
অসৌ ময়া হতঃ শত্রুর্হনিষ্যে চাপরানপি।
ঈশ্বরোহোমহং ভোগী সিদ্ধোহোং বলবান সুখী।।
আঢ্যোহোভিজনবানস্মি কোন্যোস্তি সদৃশো ম।
—আজ আমার এই লাভ হল, এই অভীষ্ট বিষয় পাব, এই আমার আছে, আবার এই ধনও আমার হবে। ওই শত্রু আমি হত্যা করেছি, অপর শত্রুদেরও হত্যা করব। আমি ঈশ্বর, আমি ভোগী, আমি যা করি তাই সফল হয়, আমি বলবান, আমি সুখী। আমি অভিজাত, আমার সদৃশ আর কে আছে।
সভাপতি সকলের দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন, বড় বড় রাষ্ট্রনেতাদের মতলব তো জানা গেল, এখন শান্তির উপায় আলোচনা করুন।
গ্র্যাবার্থ, নটেনফ, কীপফ সমস্বরে বললেন, আমরা বেশ আছি, শান্তি টান্তি বাজে কথা, আমরা নখদন্তহীন ভালমানুষ হতে চাই না, পরস্পর কাড়াকাড়ি মারামারি করে মহানন্দে জীবনযাপন করতে চাই।
এই সভার একজন সদস্য এতক্ষণ পিছন দিকে চুপচাপ বসে ছিলেন, ইনি আচার্য ব্যোমবজ্র দর্শন—বিজ্ঞানশাস্ত্রী, এক দিস্তা ফুলস্ক্যাপে এর সমস্ত উপাধি কুলয় না। এখন ইনি দাঁড়িয়ে উঠে বললেন, বিশ্বশান্তির উপায় আমি আবিষ্কার করেছি।
ডাক্তার ভৃঙ্গরাজ নন্দী বললেন, আপনারও একটা ইনজেকশন আছে নাকি?
ব্যোমবজ্র উত্তর দিলেন, পৃথিবীর কোটি কোটি লোককে ইনজেকশন দেওয়া অসম্ভব। প্রকৃষ্ট উপায় হচ্ছে আমার আবিষ্কৃত বিশ্বব্যাপক শান্তিস্থাপক বোমা, তার প্রভাবে সর্বত্র শান্তি বিরাজ করবে। এই বোমা থেকে যে আকস্মিক রশ্মি নির্গত হয় তা কস্মিক রশ্মির চেয়ে হাজার গুণ সূক্ষ্ম। তার স্পর্শে চিত্তশুদ্ধি, কাম ক্রোধ লোভাদির উচ্ছেদ এবং আত্মার বন্ধনমুক্তি হয়।
গ্র্যাবার্থ ধমক দিয়ে বললেন, খবরদার এখানে কোনও রহস্য প্রকাশ করবেন না। আমাদের টাকায় আপনি গবেষণা করেছেন। আপনার যা বলবার আমাদের প্রধান মন্ত্রীকে গোপনে বলবেন।
নটেনফ লাফিয়ে উঠে বললেন, বাঃ, আমরাই তো ওঁর সমস্ত খরচ জুগিয়েছি! বোমা আমাদের।
কীপফ বললেন, আপনারা ড্যাম মিথ্যাবাদী। আমাদের রাষ্ট্র বহুদিন থেকে ওঁকে সাহায্য করে আসছে, ওঁর আবিষ্কার একমাত্র আমাদের সম্পত্তি।
ব্যোমবজ্র দুই হাতে বরাভয় দেখিয়ে বললেন, আপনারা ব্যস্ত হবেন না, আমার বোমায় আপনাদের সকলেরই স্বত্ব আছে, আপনারা সকলেই উপকৃত হবেন। অবলদাসজী, আপনাদেরও দলাদলি আর সকল দুর্দশা দূর হবে। এই বলে তিনি একটি ছোটো বোঁচকা খুলতে লাগলেন।
সভায় তুমুল গোলযোগ শুরু হল, গ্র্যাবার্থ নটেনফ কীপফ এবং অন্যান্য সমস্ত রাষ্ট্র প্রতিনিধি বোঁচকাটি দখল করবার জন্য পরস্পরের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করতে লাগলেন।
ধর্মদাস বললেন, ব্যোমবজ্রজী, আর দেরি করছেন কেন, ছাড়ুন না আপনার বোমা।
ব্যোমবজ্রকে কিছু করতে হল না, সদস্যদের টানাটানিতে বোমাটি তাঁর হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভুঁইপটকার মতন ফেটে গেল। কোনও আওয়াজ কানে এল না, কোনও ঝলকানি চোখে লাগল না, শব্দ আর আলোকের তরঙ্গ ইন্দ্রিয়দ্বারে পৌঁছবার আগেই সমগ্র গামানুষ জাতির ইন্দ্রিয়ানুভূতি লুপ্ত হয়ে গেল।
কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে থাকবার পর গ্র্যাবার্থ বললেন, শাস্ত্রীর বোমাটি ভাল, মনে হচ্ছে আমরা সবাই সাম্য মৈত্রী আর স্বাধীনতা পেয়ে গেছি। নটেনফ, কীপফ তোমাদের আমি বড্ড ভালবাসি হে। অবলদাস, তোমরাও আমার পরমাত্মীয়। একটা নতুন ইণ্টারন্যাশনাল অ্যানথেম রচনা করেছি শোন—ভাই ভাই এক ঠাঁই, ভেদ নাই ভেদ নাই। এস, এখন একটু কোলাকুলি করা যাক।
নিশ্চিন্ত মহারাজ অবলদাসের পিঠ চাপড়ে সগর্বে বললেন, হুঁ হুঁ, আমি বলেছিলাম কিনা?
সভায় বিজয়াদশমী আর ঈদ মুবারকের ভ্রাতৃভাব উথলে উঠল। খানিক পরে নটেনফ বললেন, আসুন দাদা, এখন বিশ্বের কয়লা তেল গম গরু ভেড়া শুয়োর তুলো চিনি রবার লোহা সোনা ইউরেনিয়াম প্রভৃতির একটা বাটোয়ারা হক। জন—পিছু সমান হিসসা, কি বলেন?
ব্যোমবজ্র সহাস্যে বললেন, কোনও দরকার হবে না, আপনারা সকলেই নশ্বর দেহ থেকে মুক্তি পেয়ে নিরালম্ব বায়ুভূত হয়ে গেছেন। এখন নরকে যেতে পারেন, বা আবার জন্মাতে পারেন বা একদম উবে যেতে পারেন, যার যেমন অভিরুচি।
কীপফ বললেন, আপনি কি বলতে চান আমরা মরে ভূত হয়ে গেছি? আমি ভূত মানি না।
ব্যোমবজ্র বললেন, নাই বা মানলেন, তাতে অন্য ভূতদের কিছুমাত্র ক্ষতি হবে না।
ম,তবৎসা বসুন্ধরা একটু জিরিয়ে নেবেন তারপর আবার সসত্ত্বা হবেন। দুরাত্মা আর অকর্মণ্য সন্তানের বিলোপে তাঁর দুঃখ নাই। কাল নিরবধি, পৃথিবীও বিপুলা। তিনি অলসগমনা, দশ—বিশ লক্ষ বৎসরে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি হবে না, সুপ্রজাবতী হবার আশায় তিনি বার বার গর্ভধারণ করবেন।
১৩৫২ (১৯৪৫)
গুপী সায়েব
এই লোকটির নাম আপনাদের হয়তো জানা নেই। আমিও তাকে ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু সেদিন হঠাৎ মনে পড়ে গেল। তার যে ইতিহাস নয়নচাঁদ পাইন আর দাশু মল্লিককে বলেছিলাম তাই আজ আপনাদের বলছি। নয়নচাঁদ আর দাশ, তা মন দিয়ে শোনেন নি, কারণ তাঁদের তখন অন্য ভাবনা ছিল। আমার বিশ্বাস, গুপী সায়েব অখ্যাত হলেও একজন অসাধারণ গুণী লোক। আশা করি আপনারা যথোচিত শ্রদ্ধাসহকারে তার এই ইতিহাস শুনবেন।
নয়নচাঁদ পাইনের ঘড়ির ব্যবসা আছে। দাশু মল্লিক তাঁর দূর সম্পর্কের শালা, নেশাখোর, কিন্তু খুব সরল লোক। নয়নচাঁদের ছেলের বিয়ের কথাবার্তা চলছে। কনের ঠাকুরদা হদয় দাসের সঙ্গে আমার আলাপ আছে, সেজন্যে নয়নচাঁদ আমাকে অনুরোধ করেছেন তাঁর দাবি সম্বন্ধে আমিই যেন হদয় দাসের সঙ্গে কথা বলি। দাবির দটি আইটেমর ওপর আমাকে বেশী জোর দিতে হবে। এক নম্বর-পাত্রের পিতার জন্যে একটি মোটর গাড়ি অগ্রিম চাই, উত্তম সেকেণ্ড হ্যাণ্ড হলেও চলবে। দু নম্বর—যেহেতু এদেশে পাত্রের তেমন লেখা পড়া হল না, সেকারণে দাদাশ্বশুরের খরচে তাকে জেনিভা পাঠাতে হবে, ঘড়ি তৈরি শেখবার জন্যে।
আমার দৌত্যের ফল কি হল তা জানবার জন্য দাশু মল্লিক আমার কাছে এসেছেন, নয়নচাঁদও একটু পরে আসবেন। আমি বললাম, দাশবাবু ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, পাইন মশাই এলেই সব খবর বলব ততক্ষণ একটা বম। চুরুট টানুন।
দাশু মল্লিক ধুমপান করতে করতে চুপিচুপি বললেন, দেখ হে, তুমি এই দেনাপাওনার ব্যাপারে বেশী জড়িয়ে পড়ো না, পরে হয়তো লজ্জায় পড়বে। আমার ভাগনে, মানে নয়নচাঁদের ছেলে একটি পাঁঠা।
এমন সময় নয়নচাঁদ এলেন, এসেই একটা তাকিয়া টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লেন।
আমি প্রশ্ন করলুম, কি হল পাইন মশাই, শরীরটা খারাপ নাকি?
নয়নচাঁদ আঙুল নেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আমি তোমাদের এই বলে রাখলম, দেশ উচ্ছন্নে যেতে বসেছে, সর্বনাশের আর দেরি নেই।
দাশু মল্লিক আর আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম। নয়ন চাঁদ বলতে লাগলেন, গেল হস্তায় মানিকতলা বাজারে পকেট থেকে সাড়ে চোদ্দ টাকা উধাও হল। আবার আজ সকালে কলেজস্ট্রীট মার্কেটে উনিশ টাকা তেত্রিশ নয়াপয়সা মেরে নিয়েছে। তোমাদের মিনমিনে গণতন্ত্রী সরকারকে দিয়ে কিছুই হবে না, জবরদস্ত আয়ব শাহী গভরমেন্ট দরকার, পকেটমার চোর আর ভেজালওয়ালাদের সরাসরি ফাঁসিতে লটকাতে হবে।
দাশু মল্লিক বললেন, যা বলেছ দাদা। তোমাদের মনে আছে কিনা জানি না, তেরো-চোদ্দ বছর আগে লীগ মন্ত্রীদের আমলে পুরো একটি বছর পিকপকেটিং একবারে বন্ধ ছিল, নট এ সিংগল কেস। তার পর যেমন স্বাধীনতা এল, আবার যে কে সেই।
আমি বললাম, আপনারা প্রকৃত খবর জানেন না। লীগ মন্ত্রীদের বা পুলিসের কিছুমাত্র কেরামতি ছিল না, পকেটমারদের ঠাণ্ডা করেছিল আমাদের গুপী সায়েব।
নয়নচাঁদ বললেন, তিনি আবার কে?
–আমার এখানে দেখে থাকবেন, এখন ভুলে গেছেন। তেরো চোদ্দ বছর আগে প্রায়ই এখানে আসত, অতি অদ্ভুত লোক।
—ফিরিঙ্গী নাকি?
–না, খাঁটী বাঙালী। গুপী সায়েবের আসল নাম বোধ হয় গোপীবল্লভ ঘোষ, গোপীনাথ গোপেশ্বর কিংবা গোপেন্দ্রও হতে পারে, ঠিক জানি না। একটা বিস্কুটের কারখানায় কাজ করত। এখনকার ছোকরারা যেমন প্যান্ট-শার্ট পরে গলায় লম্বা টাই উড়িয়ে খালি মাথায় রোদে ঘুরে বেড়ায়, স্বাধীনতার আগের যুগে তেমন ফ্যাশন ছিল না। রামানন্দ চাটুজ্যে মশাই একবার লিখেছিলেন, রোদে বেরতে হলে মাথায় হ্যাট দেওয়া ভাল, দেশী সাজের সঙ্গেও তা চলতে পারে। গুপী এই উপদেশটি শিরোধার্য করেছিল, ধুতি পঞ্জাবি পরে মাথায় শোলা হ্যাট দিয়ে বাইসিকল চড়ে ঘুরে বেড়াত। একবার অধোদয় যোগের সময় তাকে দেখেছিলাম, একটা গামছা পরে আর একটা গামছা গায়ে জড়িয়ে মাথায় হ্যাট দিয়ে হাতে কমণ্ডল, ঝুলিয়ে গঙ্গা স্নানে যাচ্ছে। এই হ্যাটের জন্যেই সবাই তাকে গুপী সায়েব বলত।
নয়নচাঁদ বললেন, তোমার ভণিতা রেখে দাও, পকেটমার কিসে বন্ধ হল তাই চটপট বলে ফেল। আমাদের এখন অনেক কাজ আছে। একটা বিয়ের যোগাড় কি সোজা কথা!
একটু চটে গিয়ে আমি বললাম, গুপী সায়েব হেঁজিপেঁজি লোক নয়, তার ইতিহাস বলতে সময় লাগে, আর ধীরে-সুস্থে তা শুনতে হয়। আপনাদের যখন ফুরসত নেই তখন থাক।
নয়নচাঁদ বললেন, আরে না না, রাগ কর কেন। কি জান, মনটা একটু খিচড়ে আছে, তাই ব্যস্ত হয়েছিলাম। হাঁ, ভাল কথা, শুনলম হয় দাস নাকি একটা ভাল রোভার গাড়ির জন্যে বায়না করেছে। তা হলে কঞ্জুস বুড়োর সুবুদ্ধি হয়েছে?
–তা হয়েছে।
–বেশ বেশ, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। যাক, এখন তুমি গুপী সায়েবের ইতিহাস বল।
আমি বলতে লাগলুম—
গুপী সায়েব লেখাপড়া বেশী শেখে নি, কিন্তু ছোকরা খুব পরোপকারী ছিল আর হরেক রকম জানোয়ার সম্বন্ধে তার অগাধ জ্ঞান ছিল। তার মক্কেলও ছিল বিস্তর। পয়সার জন্যে নয়, শখের জন্যেই সে ফরমাশ খাটত, তবে কেউ কিছু দিলে খুশী হয়ে নিত। মনে করুন আপনি একটা ভাল কাবলী বেরাল চান। গুপী সায়েব ঠিক যোগাড় করে দেবে, এমন বৈরাল যার ন্যাজ খ্যাঁকশেয়ালকে হারিয়ে দেয়। আমাদের পাড়ার রাধাশ্যাম গোসাঁইএর নাতির শখ হল একটা বুলডগ পুষবে। কিন্তু বাড়িতে মাংস আনা বারণ। গুপী সায়েব এমন একটা কুত্তা এনে দিল যে ভাত ডাল ডাঁটা-চচ্চড়িতেই তুষ্ট, আর হাড়ের বদলে এক টুকরো কৃঞ্চি বা একটি পুরনো টুথব্রশ পেলেও তার চলে। কালীচরণ তবাগীশকে মনে আছে? লোকটা গোঁড়া শাক্ত, রাধাকৃষ্ণ কি সীতারাম শুনলে কানে আঙুল দিতেন। তাঁর শখ হল একটি ময়না পুষবেন, কিন্তু বৈষ্ণবী বলি কপচালে চলবে না। গুপী সায়েব তারাপীঠ না চন্দ্রনাথ কোথা থেকে একটা পাখি নিয়ে এল, সে গাঁজাখোরের মতন হেড়ে গলায় শুধু বলত, তারা তারা বল শালারা।
সেই সময় হ্যারিসন রোডে বিখ্যাত সিনেমা হাউস ছিল ঝমক মহল। করগেট লোহার ছাত, তার নীচে কাঠের সীলিং। বহুকালের পুরনো বাড়ি, সীলিংএ অনেক ফাঁক ছিল, তাই দিয়ে বিস্তর পায়রা ঢকে ভেতরের কার্নিসে রাত্রিযাপন করত। অডিটোরিয়ম এত নোংরা হত যে দর্শকরা হল্লা করতে শুরু করল। ম্যানেজার হরমসজী ছিপি ওয়ালা পায়রা তাড়াবার অনেক চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুই হল না। মেরে ফেলবার উপায় নেই, কারণ হিন্দুর চোখে গর, যেমন ভগবতী, তেমনি হিন্দু, মুসলমান আর পারসীর চোখে পায়রা লক্ষ্মীর প্রজা। ছিপিওয়ালা সায়েব লোকপরম্পরায় শুনলেন, পায়রা তাড়াতে পারে একমাত্র গুপী সায়েব। তাকে কল দেওয়া হল। সে বলল, খুব সোজা কজি। রাত বারোটার পর যখন শো বন্ধ হবে আর পায়রার দল বেহশ হয়ে ঘুমবে তখন দু-তিন জন লোক লাগিয়ে দেবেন। তারা মই দিয়ে উঠবে আর প্রত্যেকটি পায়রার পেট টিপে ছেড়ে দেবে। পায়রার স্মরণ শক্তি তীক্ষা নয়, সেজন্যে দিন কতক নিয়মিত ভাবে পেট টেপা দরকার। ক্রমশ তাদের হদয়ংগম হবে যে এই ঝমক মহল সিনেমা ভবন পায়রার পক্ষে মোটেই নিরাপদ আশ্রয় নয়। গুপী সায়েবের ব্যবস্থা অনুসারে হরমসজী ছিপিওয়ালা প্রাত্যহিক পেট টেপার অর্ডার দিলেন, দিন কতক পরেই পায়রার দল বিদায় হল। গুপী পঁচিশ টাকা দক্ষিণ পেল। তার কয়েক মাস পরে সিনেমা হাউসের ভাড়া নিয়ে ঝগড়া হওয়ায় ছিপিওয়ালা সায়েব নাগপুরে চলে গেলেন, ঝমক মহলের মালিক পুরনো বাড়ি ভেঙে ফেলে নতুন হাউস বানালেন।
একদিন গুপী সায়েব আমার এখানে এসেছে, তার ডান হাতে রবারের দস্তানা, বাঁ হাতে একটা দেশলাইএর বাক্স। আমরা প্রশ্ন করলুম, ব্যাপার কি? গুপী সায়েব জবাবু দিল না, ফরাসের ওপর দখানা খবরের কাগজ বিছিয়ে দেশলাইএর বাক্স খুলে তার ওপর ঢালল। ছোট ছোট জই ফলের কুড়ির মতন সাদা পদার্থ। গুপী বলল, ডেয়ো পিপড়ের ডিম, বারো টাকা ভরি, দু আনা দিয়ে এক রতি কিনেছি, খুব পোষ্টাই। তার পর দস্তানা পরা ডান হাত পকেটে পরে আবার বের করল, কাঁকড়াবিছেতে হাত ছেয়ে গেছে। আমরা এত হয়ে তক্তপোশ থেকে নেমে গেলুম। কাকড়াবিছের দল গুপীর হাত থেকে কাগজের ওপর পড়ল আর টপ টপ করে সমস্ত পিপড়ের ডিম খেয়ে ফেলল। তার পর গুপী সায়েব তার পোষা জানোয়ারদের আবার পকেটে পুরল।
আমরা সবাই বললুম, তোমার এ কিরকম ভয়ংকর শখ? কোন দিন বিছের কামড়ে মারা যাবে দেখছি।
গুপী সায়েব বলল, আপনারা জানেন না, কাঁকড়াবিছে অতি উপকারী প্রাণী। বিছানায় ছারপোকা হয়েছে? কীটিংস পাউডারে কিছু হচ্ছে না? (তখন ডিডিটি ইত্যাদি বেরোয় নি)। গুটিকতক কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দিন, তিন-চার দিন অন্য ঘরে রাত্রিযাপন করুন, তার পর দেখবেন ছারপোকা নিবংশ, আণ্ডা বাচ্চা ধাড়ী সমস্ত সাবাড়। আলমারি কি দরজা-জানালায় উই লেগেছে? ভাঁড়ার ঘরে পিপড়ে? তারও দাবাই কাঁকড়াবিছে।
জিতেন বোসের নাম শুনে থাকবেন। ভদ্রলোকের পুরনো বই সংগ্রহের বাতিক আছে। একদিন এখানে আড্ডা দিতে এসেছেন। কথায় কথায় বললেন, আর তো পারা যায় না, কলকাতার যত রিসার্চ কলার আর পি-এচ. ডি, আছেন সবাই আমার ওপর হামলা করছেন। কেবলই বলেন, এই বইটা দু দিনের জন্যে দাও, ওইখানা সাত দিনের জন্যে দাও। বই দিলে কিন্তু ফেরত আসে না। ওমর খাইয়ামের স্বহস্তে লেখা একটি মহামূল্য পথি আমার আছে। ডকটর সীতারাম নশকর সেই পুথিটি বাগাতে চান, একজন জুমন প্রোফেসরকে দেখাবেন। নশকর মশাইকে হাঁকিয়ে দিতে পারি না, এককালে তাঁর কাছে পড়েছিলাম। তানানানা করে এতদিন কাটিয়েছি, কিন্তু আসছে রবিবারে তিনি আবার আসবেন, কি ছুতো করব তাই ভাবছি।
দৈবক্রমে গুপী সায়েব উপস্থিত ছিল। সে বলল, আপনি ভাববেন না জিতেনাব। আপনার প্রত্যেক আলমারিতে আমি পাঁচটি করে কাঁকড়াবিছে ছেড়ে দেব আর গুটিদশেক ডিম। কেউ বই চাইলে বলবেন, আলমারি বিয়ে ভরতি, বই নিতে পারেন অ্যাট ইওর রিস্ক।
জিতেনবাবু রাজী হলেন, গুপী সায়েব যথোচিত ব্যবস্থা করল। তার পর ডকটর নশকর এসে ওমর খাইয়াম চাইলেন। জিতেনবাবু বললেন, মহা মুশকিল সার, সব আলমারি বিছেয় ভরে গেছে। এই সেদিন আমার ভাগনেকে কামড়েছে, বেচারা হাসপাতালে আছে। আমার তো হাত দেবার সাহস নেই। আপনি যদি নিরাপদ মনে করেন তবে বইটা খুঁজে বের করে নিতে পারেন। ডকটর নশকর সন্দিগ্ধ মনে আলমারিতে উঁকি মেরে দেখলেন, কাঁকড়াবিছে সঙিন খাড়া করে পাহারা দিচ্ছে। তিনি তখনই ওবাবা বলে প্রস্থান করলেন।
এইবার গুপী সায়েবের মহত্তম অবদানের কথা শুনেন। কিছুকাল তার দেখা পাই নি, হঠাৎ একদিন সন্ধ্যাবেলা টেলিফোন বেজে উঠল। কে আপনি? উত্তর এল, আমি গুপী, আপনাদের গুপী সায়েব, মুচীপাড়া থানা থেকে বলছি। আমাকে গ্রেপতার করেছে, শিগগির আসুন, বেল দিতে হবে।
থানায় গিয়ে দেখলাম, একটা সর কাঠের বেঞ্চে বসে গুপী সায়েব পা দোলাচ্ছে, দারোগা গুলজার হোসেন তাঁর চেয়ারে বসে কটমট করে তার দিকে চেয়ে আছেন। গুপীর পাশেই বেণে আর একটি লোক বসে আছে, রোগা, বেটে, অপ দাড়ি আছে, পরনে ময়লা ইজার ফরসা জামা, মাথায় টুপি। লোকটি কাতর স্বরে মাঝে মাঝে বাপ রে বাপ বলছে আর একটা গামলায় বরফ দেওয়া জলে হাত ডোবাচ্ছে। আশ্চর্য হয়ে আমি জিজ্ঞাসা করলুম, ব্যাপার কি ইনস্পেকটার সাহেব?
গুলজার হোসেন বললেন, এই গোপী ঘোষ আপনার ফ্রেণ্ড? অতি ভয়ানক লোক, এই বেচারা চোট্টু মিঞার জান লিয়েছেন।
ব্যাপার যা শুনলাম তা এই।গুপী সায়েব বউবাজারে কি কিনতে গিয়েছিল। চোট্টু মিঞা পকেট মারবার জন্যে গুপীর পকেটে হাত পোরে, সঙ্গে সঙ্গে দুটো কাঁকড়াবিছে তাকে কামড়ে দেয়। যন্ত্রণায় চোট্টু অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তখন দুজন পাহারাওয়ালা তাকে আর গুপী সায়েবকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে আসে।
আমি নিবেদন করলুম, চোট্টু মিঞা পকেট মারবার চেষ্টা করেছিল, তাকে আপনারা অবশ্যই প্রসিকিউট করবেন। কিন্তু গুপী সায়েবের কসর কি? ওঁকে তো আটকাতে পারেন না।
দারোগা সায়েব গর্জন করে বললেন, আমাকে আইন শিখলাবেন মশয়। এই গোপী একজন খুনী, ডেঞ্জার টু দি পবলিক। গরিব বেচারা চোট্টু মিঞা একটু আধটু পাকিট মারে, কিন্তু তার জন্যে আমরা আছি, সোরাবদি সাহেব আছেন, লাট সাহেব ভি আছেন। চোট্টুর জান নেবার কোনও ইখতিয়ার আপনার এই ফ্রেণ্ডের নেই।
আমার কথায় কোনও ফল হল না। এক শ টাকার বেল দিয়ে গুপীকে খালাস করে নিয়ে এলুম। পাঁচ দিন পরে ব্যাংকুশল স্ট্রীটের কোটে মকদ্দমা উঠল, শুধু গুপীর কেস। পকেটমার চোট্টুর বিচার পরে হবে, সে তখনও হাসপাতালে।
সরকারী উকিল বললেন, ইওর অনার, এই আসামী গোপী ঘোষকে কড়া সাজা দেওয়া দরকার। পিকপকেটকে বাধা দেবার অধিকার সকলেরই আছে, কিন্তু তাকে খুন বা নিমখন করা মারাত্মক অপরাধ। হুজুর সেই বহুকালের পুরনো কেস ক্রাউন ভার্সস ভিখন পাসীর নজিরটি দেখুন। ভিখুন পাসী তাড়ি তৈরি করত, তালগাছে ঝোলানো তার ভাঁড় থেকে রোজই তাড়ি চুরি যেত। চোরকে জব্দ করার মতলবে ভিখন ধুতরো ফলের রস ভাঁড়ের মধ্যে রাখল। পরদিন একটা তাড়িচোর মারা পড়ল, আর একটা কোনও গতিকে বেচে গেল। হাকিম রায় দিলেন, চোরের বিরুদ্ধে এমন মারাত্মক উপায় অবলম্বন করা গরতের অপরাধ। ভিখন পাসীর এক বছর জেল আর পঞ্চাশ টাকা জরিমানা হয়েছিল।
গুপী সায়েবের ‘উকিল বললেন, ইওর অনার, আমার মক্কেলের কেস একবারে আলাদা। কোনও লোককে জব্দ করবার মতলব বা ম্যালিস প্রিপেন্স এর ছিল না, পিকপকেটদের প্রতিও ইনি শত্রুভাবাপন্ন নন। ইনি শখ করে কাঁকড়াবিছে পোষেন, তাদের ট্রেনিং দেন, আদর করেন, ভালবাসেন, তাই সঙ্গে সঙ্গে রাখেন। কি করে ইনি জানবেন যে পুওর ফেলো চোটুর মতিচ্ছন্ন হবে? ইনি তার অনিষ্টচেষ্টা করেন নি, এর পালিত অবোধ প্রাণীরাই আত্মরক্ষার জন্যে চোটুকে কামড়ে দিয়েছিল। চোট্টু মিঞার প্রতি আমার ক্লায়েশের খুব সিমপাথি আছে, কিন্তু এর দায়িত্ব কিছুই নেই।
হাকিম ব্রজবিহারী অধিকারী ভুক্তভোগী লোক, বার দুই তাঁরও পকেট মারা গিয়েছিল। হাসি চেপে বললেন, পকেটে কাঁকড়াবিছে নিয়ে বাজারে যাওয়া অন্যায় কাজ। আসামী অপরাধী। ওঁকে সতর্ক করে দিচ্ছি, আর যেন এমন না করেন। আচ্ছা গোপীবাবু, আপনি যেতে পারেন।
গুপী সায়েব নমস্কার করে করজোড়ে বলল, হুজুর, একটা কোশ্চেন করতে পারি কি?
হাকিম বললেন, কি কোশ্চেন?
–আজ্ঞে, পঞ্জাবির পকেটে কাঁকড়াবিছে রাখা আমার ভুল হয়েছিল। কিন্তু যদি কোট পরি, তার পকেটের ওপর যদি বোতাম দেওয়া ফ্ল্যাপ থাকে, আর তার গায়ে যদি একটি নোটিস সেঁটে দিই–পাকিট মে বিচ্ছু হৈ, হাথ ঘসানা খতরনাক হৈ–তা হলে কি বেআইনী হবে?
হাকিম ব্রজবিহারী অধিকারী একটু চিন্তা করে বললেন, না, তা হলে বেআইনী হবে না। কিন্তু মাইণ্ড ইউ, আমি হাকিম হিসেবে মত প্রকাশ করছি না, একজন সাধারণ লোক হিসেবেই বলছি।
গুপী সায়েব খালাস হল, তার কিছু আক্কেলও হল। কিন্তু ব্যবসাবুদ্ধি তার কিছুমাত্র ছিল না। আমি বললাম, তোমার শ্বশুরবাড়ি কেষ্টনগরে না? কালই সেখানে যাও, হাজার খানিক মাটির কাঁকড়াবিছে অর্ডার দিয়ে এস, দাঁড়ার নীচে যেন ফাউন্টেন পেনের মতন ক্লিপ থাকে। বিজ্ঞাপন দেওয়া চলবে না, আমরা পাঁচজন মুখে মুখেই জিনিসটি চালু করে দেব। গুপী সায়েব হাজারটা নকল বিছে আনাল, বিশ দিনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে গেল। খুব ডিমাণ্ড, আরও আনাতে হল। চোট্টু মিঞার দুর্ভোগের খবর পিকপকেট সমাজে রটে গিয়েছিল, পথচারী ভদ্রলোকদের পকেট থেকে দুটি দাঁড়া উঁকি মারছে দেখে তারা আতঙ্কে কাঁপতে লাগল, তাদের পপশা একদম বন্ধ হয়ে গেল। তার পর ক্রমশ জানাজানি হল যে আসল বিচ্ছ, নয়, মাটির তৈরী। পকেটমারদের ভয় ভেঙে গেল, তারা আবার ব্যবসা শুরু করল।
ইতিহাস শুনে নয়নচাঁদ বললেন, হ, দিব্যি আষাঢ়ে গল্প বানিয়েছ। এখন কাজের কথা বলা হদয় দাস মোটর কিনছে ভাল কথা। আমার ছেলেকে বিলেত পাঠাতে রাজী আছে তো?
বিষণ্ণ মুখে আমি বললাম, আজ্ঞে না। মোটর কিনছেন নিজের জন্যে। নাতজামাইকে বিলেত পাঠাতে পারবেন না।
–বটে। আমার ছেলেকে জলের দরে পেতে চান?
–আজ্ঞে না, অন্য জায়গায় নাতনীর সম্বন্ধ স্থির করেছেন। কি জানেন পাইন মশাই, আপনি ধনী মানী লোক, কাজেই অনেকের চোখ টাটায়। হিংসুটে লোকে ছেলের নামে ভাংচি দিয়েছে।
–কি বলেছে?
–বলেছে, ষাঁড়ের গোবর।
গুরুবিদায়
বৈকালিক প্রসাধনের পর মানিনী দেবী একটি বড় আরশির সামনে দাঁড়াইয়া নিজের অঙ্গশোভা নিরীক্ষণ করিতেছেন, এমন সময় একজোড়া গোঁফের প্রতিবিম্ব তাঁহার কাঁধের উপর ফুটিয়া উঠিল।
উক্ত গোঁফের মালিক তাঁহার স্বামী রায় বংশলোচন ব্যানার্জি বাহাদুর জমিদার অ্যাণ্ড অনরারি ম্যাজিস্ট্রেট বেলিয়াঘাটা। মানিনী একটি ছোট দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া ঘাড় না ফিরাইয়াই বলিলেন—’কি সুখেই যে মোটা হচ্ছি!’
বংশলোচন রসিকতার চেষ্টা করিয়া বলিলেন—’কেন, সুখের কমটাই বা কি, অমন যার স্বামী!’
মানিনী যদি সামান্য পাড়াগেঁয়ে স্ত্রীলোক হইতেন তবে হয়তো বলিয়া ফেলিতেন—পোড়াকপাল অমন স্বামীর। কিন্তু তাঁহার বাকসংযম অভ্যাস আছে, সেজন্য বলিলেন—’স্বামী তো খুবই ভাল, আমিই যে মন্দ।’
কথার ধারা গহন অরণ্যের দিকে মোড় ফিরিতেছে দেখিয়া বংশলোচন নিপুণ সারথির ন্যায় বলিলেন—’কি যে বল তার ঠিক নেই। কিসের অভাব তোমার? হুকুম করলেই তো হয়।’
মানিনী এইবার স্বামীর দিকে চাহিয়া বলিলেন—’বয়েস তো বেড়েই চলেছে, ধম্মকম্ম কিছুই হল না।’
বংশলোচন বলিলেন—’কেন, এই যে আর বৎসর গয়া কাশী বৃন্দাবন আগ্রা দিল্লী করে এলে?’
‘ভারী তো, তার ফল আর কদিন টিকবে। ইচ্ছে হয় মন্তর—টন্তর নি।’
‘তা বেশ তো, সে তো খুব ভাল কথা। আমি চাটুজ্যে মশায়ের সঙ্গে এখনই পরামর্শ করছি।’
কিন্তু বংশলোচনের মন বলিতে লাগিল যে কথাটি মোটেই ভাল নয়। ইঁহাদের বাইশ বৎসর ব্যাপী দাম্পত্যজীবনে অসংখ্যবার প্রীতির শৃঙ্খল মেরামত করিতে হইয়াছে, কিন্তু বংশলোচনের প্রাধান্য এ পর্যন্ত মোটামুটি বজায় আছে। পত্নীর গুরুভক্তি যদি প্রবলা হইয়া ওঠে তবে স্বামীর আসন কোথায় থাকিবে? গুরু যদি কেবল অখণ্ডমণ্ডলাকারের পদটি দেখাইয়া দিয়া ক্ষান্ত হন তবে কোনও আপত্তির কারণ থাকে না। কিন্তু গুরু যদি নিজেই ঐ পদটি দখল করিয়া বসেন তবেই চিন্তার কথা। মুশকিল এই যে, ধর্মের ব্যাপারে ঈর্ষা অভিমান শোভা পায় না। তবে এক হিসাবে তাঁহার পত্নীর এই নূতন শখটি নিরাপদ। মানিনী দেবী অত্যন্ত একগুঁয়ে মহিলা। যদি দেশের বর্তমান হুজুগের বশে তাঁহার পিকেটিং করিবার বা প্রভাতফেরি গাহিবার ঝোঁক হইত তবে বংশলোচনের মান—ইজ্জত অনারারি হাকিমি কোথায় থাকিত? তাঁহার মুরুব্বী ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবই বা কি বলিতেন? মোটের উপর দেশভক্তির চেয়ে গুরুভক্তিতে ঝঞ্ঝাট ঢের কম।
বংশলোচন বৈঠকখানায় আসিয়া তাঁহার অন্তরঙ্গগণের নিকট পত্নীর অভিলাষ ব্যক্ত করিলেন। বৃদ্ধ কেদার চাটুজ্যে মহাশয় বলিলেন—’বউমার সংকল্প অত্যন্ত সাধু, তবে একটি সদ—গুরু দরকার। তোমাদের পৈতৃক গুরুর কুলে কেউ বেঁচে নেই?’
বংশলোচন বলিলেন—’শুনেছি একটি গুরুপুত্তুর আছেন, তিনি থিয়েটারে আবদালা সাজেন।’
‘রাধামাধব! আচ্ছা, আমাদের গুরুপুত্তুরটিকে একবার দেখলে পার। সেকেলে মানুষ, শাস্ত্রটাস্ত্র জানেন না বটে, কিন্তু পৈতৃক ব্যবসাটি বজায় রেখেছেন।’
উকিল বিনোদবাবু বলিলেন—’চাটুজ্যেমশায়, আপনি এখনও সত্যযুগে আছেন। আজকাল আর সেকেলে গুরুর চলন নেই যিনি বছরে বার—দুই শিষ্যবাড়ি পায়ের ধুলো দেন আর পাঁচ সের চাল, পাঁচ পো চিনি, গোটা দশেক টাকা, লাট্টু মার্কা থান ধুতিতে বেঁধে প্রস্থান করেন। এখন এমন গুরু চাই চেহারা দেখলে মন খুশী হয়, বচন শুনলে প্রাণ আনচান করে।’
বংশলোচনের ভাগনে উদয় বলিল—’মামাবাবু যদি মামীকে মুরগি ধরাতেন তবে আর এসব খেয়াল হত না। তাইজন্যেই তো আমার শাশুড়ী মন্তর নিতে পারছেন না।’
চাটুজ্যে বলিলেন—’ছাই জানিস উদো। উপেন পালের নাম শুনেছিস? সেবার মধুপুরে গিয়ে দেখলুম—প্রকাণ্ড বাড়ি, দশ বিঘে বাগান, দশটা গাই, এক পাল মুরগি। রাজর্ষির চালে থাকেন, ঘরের তরি—তরকারি, ঘরের দুধ, ঘরের মুরগি। সস্ত্রীক ধর্ম আচরণ করেন, সঙ্গে চার জন গুরু হামেহাল হাজির, নিজের দুজন, স্ত্রীর দুজন।’
উপযুক্ত গুরু কে আছেন এই লইয়া অনেকক্ষণ আলোচনা হইল। পর্বতবাসী সন্ন্যাসী, আশ্রমবাসী মহারাজ, স্বচ্ছন্দচারী লেংটাবাবা, বৈজ্ঞানিক মহাপুরুষ, উদারপন্থী আধুনিক সাধু—অনেকের নাম উঠিল। কিন্তু মুশকিল এই বংশলোচন যাঁহাকে উপযুক্ত অর্থাৎ নিরাপদ মনে করেন, গৃহিণীর হয়তো তাঁহাকে পছন্দ হইবে না।
এমন সময় বংশলোচনের শালা নগেন দোতলা হইতে নামিয়া আসিয়া বলিল—’আপনারা আর মাথা ঘামাবেন না, দিদি গুরু ঠিক করে ফেলেছেন।’
বংশলোচন ক্ষীণ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন—’কে?’
‘বালিগঞ্জের খল্বিদং স্বামী। অ্যাসা সুন্দর গাইতে পারেন! চেহারাটিও তেমনি, বয়সে এই জামাইবাবুর চেয়ে কিছু কম হবে। শুনেছি ছেলেবেলা থেকেই একটা উদাস উদাস ভাব ছিল, টেনিস খেলতে খেলতে কতবার অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। সংসারে যদ্দিন ছিলেন, নাম ছিল পরান সরকার। তারপর স্ত্রীবিয়োগ হতেই স্বামী হয়েছেন। এখন তার প্রায় দু—শ শিষ্য, চার—শ শিষ্যা।’
‘একবারে সব ঠিক হয়ে গেছে নাকি?’
‘উহুঁ, দিদি চালাক আছেন। কাল স্বামীজীকে নিয়ে আসছি, এখানে হপ্তা—খানেক জাঁকড়ে থাকবেন, যাকে বলে প্রোবেশন। তারপর দিদির যদি ভক্তিটক্তি হয় তবে মন্তর নেবেন।’
চাটুজ্যে মহাশয় বলিলেন—’অতি উত্তম ব্যবস্থা। গুরুটির সন্ধান দিলে কে?’
নগেন বলিল—’আমিই দিয়েছি। আমার বন্ধুদের মহলে ওর খুব খ্যাতি। আপনারাও দেখলে মোহিত হয়ে যাবেন।’
পরদিন খল্বিদং স্বামীর শুভাগমন হইল, সঙ্গে কেবল একটি কমণ্ড৯লু আর একটি বড় সুটকেশ। নগেন মিথ্যা বলে নাই, টকটকে গৌরবর্ণ, চাঁচর ঝাঁকড়া চুল, মধুর কণ্ঠস্বর, চোখে একটা অপূর্ব প্রতিভান্বিত ঢুলুঢুলু ভাব। ছ—শ শিষ্য হওয়া কিছুই বিচিত্র নয়।
মানিনী দেবী প্রত্যহ শুদ্ধাচারে ভাবী গুরুদেবের সেবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। স্বামীজীর নিত্যকর্মপদ্ধতি একেবারে ধরাবাঁধা। সকালবেলা অনুপানসহ তিন পাথরবাটি চা, দ্বিপ্রহরে পবিত্র অন্ন—ব্যঞ্জন, তাহার পর ঘন্টা তিন—চার যোগনিদ্রা, বিকালে নানাপ্রকার ফলমূল মিষ্টান্ন, পুনর্বার চা, সন্ধ্যায় মধুর কণ্ঠে ধর্মব্যাখ্যা, সঙ্গীত ও ঘুঙুর পরিয়া ভাবনৃত্য, রাত্রে সাত্ত্বিক লুচি পোলাও কালিয়া।
মানিনীর অন্তরে একটা সাড়া পড়িয়াছে। নভেল পড়া, লেস বোনা, ছাঁটা পশমের আসন তৈয়ারী প্রভৃতি সাংসারিক কার্যে আর তাঁহার মন পাই। প্রথম দিনেই তিনি নিজের হাতে স্বামীজীর উচ্ছ্বিষ্ট পরিষ্কার করিলেন। দ্বিতীয় দিনে পাতে প্রসাদ পাইলেন। তৃতীয় দিনে বংশলোচন রোমাঞ্চিত হইয়া দেখিলেন—খল্বিদং—এর চর্বিত আকের ছিবড়া মানিনী পরম ভক্তি সহকারে চুষিতেছেন। বংশলোচন বার বার স্বামীজীর বাণী স্মরণ করিতে লাগিলেন—সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম, এ সমস্তই ব্রহ্ম—কিন্তু মন প্রবোধ মানিল না। ব্রহ্ম নিখিল চরাচরে থাকিতে পারেন কিন্তু আকের ছিবড়ায় থাকিবেন কোন দুঃখে? একথা মনে করিতেই চিত্ত বিদ্রোহী হয়, পিত্ত চটিয়া ওঠে। ছি ছি বলিলে যথেষ্ট বলা হয় না, তোবা তোবা বলিতে ইচ্ছা করে।
চাটুজ্যে মহাশয় শুনিয়া বলিলেন—’তাইতো বেশী বাড়াবাড়ি হচ্ছে। এই নগেনটাই যত নষ্টের গোড়া। দেশী ঠাকুরমশায় তোর দিদির মনে না ধরে তো একটা জটাধারী গাঁজাখোর আনলেই তো পারতিস।’
নগেন বলিল—’বা রে, আমি কেমন ক’রে জানব যে দিদির অত ভক্তি হবে?’
বংশলোচন কাতরকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন—’এখন কি করা যায়?’
বিনোদ বলিলেন—’একটা ভৈরবী—টৈরবী ধ’রে এনে তুমিও সাধনা শুরু কর, বিষে বিষক্ষয় হয়ে যাক। আর যদি সাহস থাকে তবে গিন্নীকে মনের কথা খুলে বল, খল্বিদংকে অর্ধচন্দ্রং দাও।’
নগেন বলিল—’তা হলে দিদি ভয়ঙ্কর চটবে।’
কথাটা ভয়ঙ্কর সত্য, পত্নীর ধর্মাচরণে বাধা দেওয়া সহজ কথা নয়। বংশলোচন আকুল চিন্তাসাগরে হাবুডুবু খাইতে লাগিলেন। এমন যে বিচক্ষণ চাটুজ্যে মহাশয় আর তীক্ষ্নবুদ্ধি বিনোদ উকিল, ইঁহারাও প্রতিকারের কোনও সুসাধ্য উপায় খুঁজিয়া পাইতেছেন না। হায় হায়, কে তাঁহাকে রক্ষা করিবে? ভগবানের উপর নির্ভর করিয়া হাল ছাড়িয়া বসিয়া থাকা ভিন্ন গত্যন্তর নাই।
মানিনী মনস্থির করিয়া ফেলিয়াছেন, খল্বিদংকেই গুরুত্বে বরণ করিবেন। কাল সকালে দীক্ষা। বাড়ির পূর্বদিক সংলগ্ন যে মাঠটি আছে তাহাতে একটি বেদী রচনা করিয়া চারিদিকে ফুলের টব দিয়া সাজানো হইয়াছে। আজ বৈকালে খল্বিদং নিজে ঘুরিয়া ঘুরিয়া সমস্ত আয়োজন তদারক করিতেছেন। বংশলোচন, চাটুজ্যে, বিনোদ ইত্যাদি পিছনে পিছনে আছেন, মানিনীও একটু তফাতে থাকিয়া সমস্ত দেখিতেছেন।
খল্বিদং গুনগুন করিয়া গান করিতে করিতে পায়চারি করিতেছেন এমন সময় তাঁহার নজরে পড়িল—মাঠের শেষ দিকে একটি বৃহদাকার ছাগল তাঁহাকে সতৃষ্ণনয়নে নিরীক্ষণ করিতেছে। এই ছাগলটি লম্বকর্ণ নামে খ্যাত। সে যখন ছোট ছিল তখন বংশলোচন তাহাকে বেওয়ারিস অবস্থায় কুড়াইয়া পাইয়া বাড়িতে আনেন। সেই অবধি সে পরিবারভুক্ত হইয়া গিয়াছে এবং মানিনীর অত্যধিক আদর পাইয়া ফুলিয়া উঠিয়াছে। এখন তাহার নবীন যৌবন। লম্বকর্ণ যদি মনুষ্য হইত তবে এ বয়সে তাহাকে তরুণ বলা চলিত। কিন্তু সে অজত্বের অভিশাপ লইয়া জন্মিয়াছে, তাই লোকে তাহাকে বলে বোকাপাঁঠা।
খল্বিদং স্বামী লম্বকর্ণকে দেখিয়া প্রসন্নবদনে বলিলেন—’শ্রীভগবানের কি অপূর্ব সৃষ্টি এই জীবটি। বেঁচে থাকার যে আনন্দ, তা এতে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। প্রাণশক্তি যেন সর্বাঙ্গে উথলে উঠছে।’
স্বামীজী মাঠের নরম ঘাসের উপর বসিয়া পড়িলেন এবং এক মুঠা ঘাস ছিঁড়িয়া লইয়া ডাকিলেন—’আ—তু তু তু।’
লম্বকর্ণ আসিল না, স্বামীজীর দিকে চাহিয়া আস্তে আস্তে পিছু হাটিতে লাগিল।
স্বামীজী বলিলেন—’আহা অবোধ জীব, কিঞ্চিৎ ভীত হয়েছে, আমাকে এখনও চেনে না কিনা। তোমরা ওকে তাড়া দিও না, জীবকে আকর্ষণ করার উপায় হচ্ছে অসীম করুণা, অগাধ তিতিক্ষা। আ—তু তু তু তু।’
লম্বকর্ণ ভীত হইবার ছেলে নয়। আসল কথা প্রথম দর্শনেই খল্বিদং—এর উপর তাহার একটা অহৈতুকী অভক্তি জন্মিয়াছে। আজ তাঁহার মুখের মধুর হাসিটুকু দেখিয়া সেই অহৈতুকী অভক্তি অকস্মাৎ একটা বেয়াড়া বদখেয়ালে পরিণত হইল। লোকে যাহাই বলুক, লম্বকর্ণ মোটেই বোকা নয়। ছাগল হইলে কি হয়, তাহার একটা সহজাত বৈজ্ঞানিক প্রতিভা আছে। লম্বকর্ণ কলেজে পড়ে নাই, পাস করে নাই, তথাপি জানা আছে যে বেগ আহরণ করিতে হইলে যথাসম্ভব দূর হইতে ধাবমান হওয়াই যুক্তিসংগত। আরও জানা আছে যে তাহার দেহে দেড় মণ মাংসকে যদি তাহার বেগের অঙ্ক দিয়া গুণ করা হয় তবে যে বৈজ্ঞানিক রাশি উৎপন্ন হয় তাহার ধাককা সামলানো মানুষের অসাধ্য।
কিছুদূর পিছু হটিয়া লম্বকর্ণ এক মুহূর্তে স্থির হইয়া দাঁড়াইল। তাহার পর ঘাড় নীচু করিয়া শিং বাঁকাইয়া স্বামীজীর নধর উদর নিশানা করিয়া নক্ষত্রবেগে সম্মুখে ছুটিল।
স্বামীজীর মুখে প্রসন্ন হাসি তখনও লাগিয়া আছে, কিন্তু আর সকলে ব্যাপারটি বুঝিয়া লম্বকর্ণকে নিরস্ত করিবার জন্য ত্রস্ত চীৎকার করিয়া উঠিল। কিন্তু কার সাধ্য রোধে তার গতি। নিমেষের মধ্যে লম্বকর্ণের প্রচণ্ড গুঁতা ধাঁই করিয়া লক্ষ্য স্থানে পৌঁছিল, খল্বিদং একবার মাত্র বাবা গো বলিয়া ডিগবাজি খাইয়া ধরাশায়ী হইলেন।
ডাক্তারবাবু বলিলেন—’শুধু বোরিক কমপ্রেস। পেট ফুটো হয়নি, চোটও বেশী লাগেনি, তবে শক—টা খুব খেয়েছেন। একটু পরেই উঠে বসতে পারবেন, তখন আবার দু—ড্রাম ব্রান্ডি। ব্যথাটা সারতে দিন—পনর লাগবে।’
ডাক্তার অত্যুক্তি করেন নাই। কিছুক্ষণ পরেই খল্বিদং চাঙ্গা হইয়া উঠিয়া বসিলেন। বলিলেন—’ছাগলটা গেল কোথায়?’
বিনোদবাবু বলিলেন—’সেটাকে বেঁধে রাখা হয়েছে, আপনার কোনও ভয় নেই।’
স্বামীজী বলিলেন—’ভয় আমি কোনও শালায় করি না। কিন্তু ছাগলটাকে এক্ষুনি মেরে তাড়াতে হবে, ওঠা মূর্তিমান পাপ।’
বিনোদবাবু বলিলেন—’বলেন কি মশায়, আপনারা হলেন করুণার অবতার, পাপীকে যদি ক্ষমা না করেন তবে বেচারা দাঁড়ায় কোথা? আর লম্বকর্ণের স্বভাবটা তো হিংস্র নয়, আজ বোধ হয় হঠাৎ কিরকম ব্লাড—প্রেশার বেড়ে গিয়ে মাথা গরম হয়ে—কি বলেন ডাক্তারবাবু?’
উদয় বলিল—’বউ আজ ওকে একছড়া গাঁদাফুলের মালা খাইয়েছে, তাইতো বোধ হয়।’
খল্বিদং ভ্রূকুটি করিয়া বলিলেন—’ও—সব আমি শুনতে চাই না। এ বাড়িতে দুজনের স্থান নেই, হয় আমি নয় ঐ ব্যাটা।’
বংশলোচন দুরুদুরু বক্ষে পত্নীর দিকে চাহিয়া বলিলেন—’কি বল? ছাগলটাকে তা হলে বিদেয় করা যাক?’
মানিনী সবেগে ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন—’বাপরে, সে আমি পারব না।’ এই কথা বলিয়াই তিনি সটান দোতলায় গিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বংশলোচনের এক জোড়া ছেঁড়া মোজা মেরামত করিতে লাগিয়া গেলেন।
খল্বিদং বলিলেন—’তা হলে আমিই বিদায় হই।’
চাটুজ্যে মহাশয় স্বামীজীর পিঠে হাত বুলাইয়া বলিলেন—’যা বলেছ দাদা। এই নির্বান্ধব পুরে দুশমনের হাতে কেন প্রাণটা খোয়াবে, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যাও, বেঁচে থাকলে অনেক শিষ্য জুটবে। এস, আমি একটা ট্যাকসি ডেকে দিচ্ছি।’
বংশলোচন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলিয়া ভাবিতে লাগিলেন—স্ত্রীচরিত্র কি অদ্ভুত জিনিস।
১৩৩৭ (১৯৩০)
গুলবুলিস্তান
সম্প্রতি আরব্য উপন্যাসের একটি প্রাচীন পুথি উজবেকীস্তানে পাওয়া গেছে। তাতে যে আখ্যান আছে তা প্রচলিত গ্রন্থেরই অনুরূপ, কেবল শেষ অংশ একবারে অন্যরকম। বিচক্ষণ পণ্ডিতরা বলেন, এই নবাবিস্কৃত পথির কাহিনীই অধিকতর প্রামাণিক ও বিশ্বাসযোগ্য, নীতিসংগতও বটে। আপনাদের কৌতহলনিবৃত্তির জন্যে সেই উজবেকী উপসংহার বিবৃত করছি। কিন্তু তা পড়বার আগে প্রচলিত আখ্যানের আরমভ আর শেষ অংশ জানা দরকার। যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাই সংক্ষেপে মনে করিয়ে দিচ্ছি।
শাহরিয়ার ছিলেন পারস্য দেশের বাদশাহ, আর তাঁর ছোট ভাই শাহজমান ততির দেশের শাহ। দৈবযোগে তাঁরা প্রায় একই সময়ে আবিষ্কার করলেন, তাঁদের বেগমরা মায় সখী আর বাঁদীর দল সকলেই দ্রষ্টা। তখন দুই ভাই নিজ নিজ অন্তঃপুরের সমস্ত রমণীর মণ্ড চ্ছেদ করলেন এবং সংসারে বীতরাগ হয়ে একসঙ্গে পর্যটনে নির্গত হলেন।
স্ত্রীচরিত্রের আর একটি নিদর্শন তাঁরা পথে যেতে যেতেই পেলেন। এক ভীষণ দৈত্য তার সুন্দরী প্রণয়িনীকে সিন্দুকে পরে সাতটা তালা লাগিয়ে মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াত। মাঝে মাঝে সে সুন্দরীকে হাওয়া খাওয়াবার জন্যে সিন্দুক থেকে বার করত এবং তার কোলে মাথা রেখে ঘুমুত। সেই অবসরে সুন্দরী নব নব প্রেমিক সংগ্রহ করত। দুই ভ্রাতাও তার প্রেম থেকে নিষ্কৃতি পান নি।
শাহরিয়ার তাঁর কনিষ্ঠকে বললেন, ভাই, এই ভীষণ দৈত্য তার প্রণয়িনীকে সিন্দুকে বন্ধ করে সাতটা তালা লাগিয়েও তাকে আটকাতে পারে নি, আমরা তো কোন ছার। বিবাগী দরবেশ হয়ে লাভ নেই, আমরা আবার বিবাহ করব। কিন্তু স্ত্রীজাতিকে আর বিশ্বাস নেই, এক রাত্রি যাপনের পরেই পত্নীর মণ্ডচ্ছেদ করে পরদিন আবার একটা বিবাহ করব, তা হলে অসতী-সংসর্গের ভয় থাকবে না। দুই ভ্রাতা একমত হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে গেলেন এবং প্রাত্যহিক বিবাহ আর নিশাতে মণ্ডচ্ছেদের ব্যবস্থা করে অনাবিল দাম্পত্য সুখ উপভোগ করতে লাগলেন।
শাহরিয়ারের উজিরের দুই কন্যা, শহরজাদী ও দিনারজাদী। শহরজাদীর সনির্বন্ধ অনুরোধে উজির তাঁকে বাদশাহের হতে সমপণ করলেন। রাত্রিকালে শহরজাদী স্বামীকে জানালেন, ভগিনীর জন্যে তাঁর মন কেমন করছে। দিনারজাদীকে তখনই রাজপ্রাসাদে আনা হল। শাহরিয়ার আর শহরজাদীর শয়নগহেই দিনারজাদী রাত্রিযাপন করলেন। শেষ রাত্রে তিনি বললেন দিদি, আর তো দেখা হবে না, বাদশাহ যদি অনুমতি দেন তো একটা গল্প বল। শাহরিয়ার বললেন, বেশ তো, সকাল না হওয়া পর্যনত গল্প বলতে পার।
শহরজাদীর গল্প শুনে বাদশাহ মুগ্ধ হলেন, কিন্তু গল্প শেষ হল না। বাদশাহ বললেন, আচ্ছা, কাল রাত্রিতে বাকীটা শুনব, একদিনের জন্যে তোমার মণ্ডচ্ছেদ মূলতবী থাকুক। পরের রাত্রিতে শহরজাদী গল্প শেষ করলেন এবং আর একটি আরম্ভ করলেন। তারও শেষ অংশ শোনবার জন্যে বাদশাহের কৌতূহল হল, সুতরাং শহরজাদীর জীবনের মেয়াদ আর একদিন বেড়ে গেল। এইভাবে শহরজাদী এক হাজার একরাত্রি যাবৎ গল্প চালালেন এবং বেচেও রইলেন। পরিশেষে শাহরিয়ার খুশী হয়ে বললেন, শহরজাদী, তোমাকে কতল করব না, তুমি আমার মহিষী হয়েই বেচে থাক। তোমার ভগিনী দিনারজাদীর সঙ্গে আমার ভাই শাহজমানের বিবাহ দেব। অতঃপর শহরজাদীর সঙ্গে শাহরিয়ার এবং দিনারজাদীর সঙ্গে শাহজমান পরম সুখে নিজ নিজ রাজ্যে কালযাপন করতে লাগলেন।
এখন আরব্যরজনীর উজবেকী উপসংহার শুনেন।
হাজার-এক রাত্রি শেষ হলে শাহরিয়ার প্রসন্নমনে বললেন, শহরজাদী, তুমি যেসব অত্যাশ্চর্য গল্প বলেছ তা শুনে আমি অতিশয় তুষ্ট হয়েছি। তোমাকে মরতে হবে না।
শহরজাদী যথোচিত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলেন।
দিনারজাদী বললেন, জাহাঁপনা, এতদিন আপনি শুধু দিদির গল্পই শুনলেন, পুরস্কার স্বরূপ জীবনদানও করলেন। কিন্তু আমার কথা তো কিছুই শুনলেন না।
শাহরিয়ার বললেন, তুমিও গল্প জান নাকি? বেশ, শোনাও তোমার গল্প।
দিনারজাদী বললেন, আমি যা বলছি তা গল্প নয়, একবারে খাঁটী সত্য। জাহাঁপনা, আপনি তো বিস্তর স্ত্রীর সংসর্গে এসেছেন, এমন কাকেও জানেন কি যার তুলনা জগতে নেই?
-কেন, তোমার এই দিদি আর তুমি।
-আমাদের চাইতে শতগণ শ্রেষ্ঠ নারী আছে, তার বৃত্তান্ত আমার প্রিয়সখী গুলবদনের কাছে শুনেছি। তার দেশ বহ, দরে। ছ মাস আগে একদল হন দস্য, তাকে হরণ করে ইস্পাহানের হাটে নিয়ে এসেছিল, তখন আমার বাবা এক শ দিনার দাম দিয়ে তাকে কেনেন। গুলবদনের সঙ্গে একটু আলাপ করেই আমি বুঝলাম, সে সামান্য ক্রীতদাসী নয়, উচ্চ বংশের মেয়ে, গুলবুলিস্তানের শাহজাদীদের আত্মীয়।
—গুলবুলিস্তান কোন মুলুক? তার নাম তো শুনি নি।
–যে দেশে প্রচুর গোলাপ তার নাম গুলিস্তান। আর যে দেশে যত গোলাপ তত বলবল, তার নাম গুললিস্তান। এই দেশ হচ্ছে হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে বলখ উপত্যকায়। জানেন বোধ হয়, অনেক কাল আগে মহাবীর সেকেন্দর শাহ এই পারস্য সাম্রাজ্য আর পূবদিকের অনেক দেশ জয় করেছিলেন। দিনকতক তিনি সসৈন্যে গুলবুলিস্তানে বিশ্রাম করেছিলেন, সেই সময়ে তিনি নিজে আর তাঁর দু শ সেনাপতি ওখানকার অনেক মেয়েকে বিবাহ করেন। বর্তমান গুলবুলিস্তানীরা তাঁদেরই বংশধর। ওদেশের পুরুষরা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, আর মেয়েরা অত্যন্ত রুপবতী। তাদের গায়ের রঙ গোলাপী, গাল যেন পাকা আপেল, চোখের তারা নীল, চিবকের গড়ন গ্রীক দেবীমতির মতন সুগোল। স্বয়ং সেকেন্দর শাহ ওদেশের রাজার পূর্বপুরুষ। এখন রাজা জীবিত নেই, দুই শাহজাদী রাজ্য চালাচ্ছেন, উৎফুলন্নেসা আর লুৎফন্নেসা।
–ও আবার কিরকম নাম!
–আজ্ঞে, গ্রীক ভাষার প্রভাবে অমন হয়েছে। নিকটেই হিন্দু, মূলক, তার জন্যেও কিছু, বিগড়েছে। গুলবুলিস্তান অতি দুর্গম স্থান, অনেক পর্বত নদী মরুভূমি পার হয়ে যেতে হয়। পথে একটি গিরিসংকট আছে, বাব-এল-মৈমুন, অর্থাৎ বানর-তোরণ। দই খাড়া পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে অতি সরু পথ, একলক্ষ সুশিক্ষিত বানর সেখানে পাহারা দেয়, কেউ এলে পাথর ছুড়ে মেরে ফেলে। শোনা যায় বহুকাল আগে ওদেশের এক রাজা বংগাল মুলুক থেকে এই সব বানর আমদানি করেছিলেন। জাহাঁপনা, আমি বলি কি, আপনি আর আপনার ভাই শাহজমান সেই বলবলিস্তান রাজ্যে অভিযান করুন, শাহজাদী উৎফুল আর লুৎফুলকে বিবাহ করুন। আমার সখী গুলবদন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, আপনাদের সঙ্গে গেলে সেও নিরাপদে নিজের দেশে ফিরতে পারবে।
শাহরিয়ার বললেন, আমরা যাকে-তাকে বিবাহ করতে পারি না। সেই দই শাহজাদী দেখতে কেমন? তাদের চরিত্র কেমন?
—জাহাঁপনা, তাঁদের মতন রুপবতী দুনিয়ায় নেই, তেমন ভীষণ সতীও পাবেন না। তাঁদের যেমন রপে তেমনি ঐশ্বর্য। আপনারা দুই ভাই যদি সেই দই শাহজাদীকে বিবাহ করেন তবে স্বর্গের হরীর মতন স্ত্রীর সঙ্গে প্রচুর ধনরত্নও পাবেন।
–তোমার দিদি কি বলেন?
শহরজাদী বললেন, জাহাঁপনা, আমার জন্যে ভাববেন না, আপনাকে সুখী করবার জন্যে আমি জীবন দিতে পারি।
একটু চিন্তা করে শাহরিয়ার বললেন, বেশ, আমি আর শাহজমান শীঘ্রই গুলবুলিস্তান যাত্রা করব। সঙ্গে দশ হাজার তীরন্দাজ, দশ হাজার বশধারী ঘোড়সওয়ার আর ত্রিশ হাজার টাঙ্গিধারী পাইক সৈন্য নেব।
দিনারজাদী বললেন, অমন কাজ করবেন না জাহাঁপন, তা হলে গুলবুলিস্তানে পৌঁছবার আগেই সসৈন্যে মারা যাবেন। বাব-এল মৈমন গিরিসংকটে যে এক লক্ষ বানর আছে তারা পাথর ছুড়ে সবাইকে সাবাড় করবে। তা ছাড়া শাহজাদীদের পাঁচ হাজার হাতি আছে, আপনার সৈন্যদের তারা ছত্রভঙ্গ করে দেবে। আমি যা বলি শুনুন। সঙ্গে শুধু পঞ্চাশজন দেহরক্ষী নেবেন, আপনার পঁচিশ আর ছোট জাহাঁপনার পঁচিশ। আপনার যে দুজন জোয়ান সেনাপতি আছেন, শমশের জঙ্গ, আর নওশের জঙ্গ, তাদেরও নেবেন।
-কিন্তু সেই বাঁদরদের ঠেকাবে কি করে?
—শুনুন। এখন রমজান চলছে, কিছুদিন পরেই ঈদ-অল ফিতর। এই সময় দেশের আমির ফকির সকলেই জালা জালা শরবত খায়, তার জন্যে হিন্দুস্তান থেকে রাশি রাশি তখত-ই-খণ্ডেসরি অর্থাৎ খাঁড় গুড়ের পাটালি বসরা বন্দরে আমদানি হয়। আপনি সেই ‘পাটালি হাজার বস্তা বাজেয়াপ্ত করুন, সঙ্গে নিয়ে যাবেন। বাব-এল-মৈমনের কাছে এসে পথের দুই ধারে সেই পাটালি ছড়িয়ে দেবেন। বাঁদরের দল হমড়ি খেয়ে পড়বে আর কাড়াকড়ি করবে, তখন আপনারা অনায়াসে পার হয়ে যাবেন।
শাহরিয়ার বললেন, বাঃ তোমার খুব বুদ্ধি, যদি পুরুষ হতে তো উজির করে দিতাম। যেমন বললে সেই রকমই ব্যবস্থা করব। শাহজমানের কাছে আজই দূত পাঠাচ্ছি। তোমরা দুই বোন আর তোমাদের সখী গুলবদন যাবার জন্য তৈরী হও।
দিনারজাদীর পরামর্শ অনুসারে যাত্রার আয়োজন করা হল। কিছুদিন পরে শাহরিয়ার শাহজমান শহরজাদী দিনারজাদী, দুই সেনাপতি আর পঞ্চাশ জন অনুচর গুলবদনের প্রদর্শিত পথে নিরাপদে গুলবুলিস্তানে পৌঁছলেন।
চার জন রক্ষীর সঙ্গে গুলবদন এগিয়ে গিয়ে শাহরিয়ার ইত্যাদির আগমন-সংবাদ দুই শাহজাদীকে জানালেন। তাঁরা মহা সমাদরে অতিথিদের সংবর্ধনা করলেন। বিশ্রাম ও আহারাদির পর বড় শাহজাদী উত্যশ্নেসা বললেন, মহামহিম পারস্যরাজ ও তাতাররাজ কি উদ্দেশ্যে আপনারা এখানে এসেছেন তা প্রকাশ করে আমাদের কৃতার্থ করুন।
শাহরিয়ার উত্তর দিলেন, হে গুলবুলিস্তানের শ্রেষ্ঠ গোলাপী বলবল দই শাহজাদী, যা শুনেছিলাম তার চাইতে তোমরা ঢের বেশী সুন্দরী। আমরা একবারে বিমোহিত হয়ে গেছি, তোমরা দুই ভগিনী আমাদের দুজনের বেগম হও।
শাহজাদী উৎফল বললেন, তা বেশ তো, আমাদের আপত্তি নেই, বিবাহে আমরা সর্বদা প্রস্তুত। আপনাদের দলে এই যে দুজন সুন্দরী দেখছি এরা কে?
শাহরিয়ার বললেন, ইনি হচ্ছেন আমার এখনকার বেগম শহরজাদী, আর উনি আমার শালী দিনারজাদী, আমার ভাইএর বাগদত্তা। সপত্নীর সঙ্গে থাকতে এদের কোনও আপত্তি নেই।
মাথা নেড়ে উৎফল বললেন, তবে তো আমাদের সঙ্গে বিবাহ হতে পারে না। আমাদের নীতিশাস্ত্র কলীলা-ওঅ-দিমনা অনুসারে পুরুষের এককালে একাধিক স্ত্রী আর স্ত্রীর একাধিক স্বামী নিষিদ্ধ।
-তুমি যে ধর্মবিরদ্ধে খীষ্টানী কথা বলছ শাহজাদী। স্ত্রীর পক্ষেই একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ, পরষের পক্ষে নয়।
–আপনাদের রীতি এখানে চলবে না। আমাদের শরিয়ত অন্য রকম, তা যদি না মানেন তবে আপনাদের সঙ্গে আমাদের বিবাহ হবে না।
শাহরিয়ার তাঁর ভাই শাহজামানের সঙ্গে কিছুক্ষণ চুপি চুপি . পরামর্শ করলেন। তার পর বললেন, বেশ, তোমাদের রীতিই মেনে নিচ্ছি। শহরজাদী, তোমাকে তালাক দিলাম, তুমি আর আমার বেগম নও। তোমার জন্যে সত্যই আমি দুঃখিত। কি করা যায় বল, সবই আল্লার মর্জি। তোমার জন্যে আমি অন্য একটি ভাল স্বামী যোগাড় করে দেব।
শাহজমান বললেন, দুনিয়াজাদী, আমিও তোমাকে চাই না। তুমি অন্য কাকে বিবাহ করো।
অনন্তর সানাই ভেঁপু কাড়া-নাকাড়া আর দামামা বেজে উঠল, সখীর দল নাচতে লাগল, গুলবুলিস্তানের মোল্লারা শাহরিয়ারের সঙ্গে উৎফলের আর শাহজমানের সঙ্গে লঙ্কেলের বিবাহ যথারীতি সম্পাদন করলেন।
বিকাল বেলা প্রাসাদ-সংলগ্ন মনোরম উদ্যানে ফোয়ারার কাছে বসে শাহরিয়ার বললেন, প্রেয়সী উফল, তোমাদের সখীরা অতি খাসা, অনেকে তোমাদের দুই বোনের চাইতেও খুবসুরত। আমরা দুই ভাই ওদের ভাগাভাগি করে আমাদের হারেমে রাখব।
উৎফুল বললেন, খবরদার প্রাণনাথ, আমাদের সখী বাঁদী ঝাড়দারনী বা অন্য কোনও স্ত্রীলোকের দিকে যদি কুদষ্টি দাও তো তোমার গরদান যাবে।
অত্যন্ত রেগে গিয়ে শাহরিয়ার বললেন, ইনশাল্লাহ! মুখে সামলে কথা বল প্রিয়ে, গরদান নেওয়া আমারও ভাল রকম অভ্যাস আছে।
উৎফল বললেন, এস আমার সঙ্গে, বুঝিয়ে দিচ্ছি। এই বাঁদী, এখনই চারজন মশালী আর দশজন রক্ষীকে গরদানি মহলে যেতে বল।
দই শাহজাদী স্বামীদের নিয়ে সুবিশাল গরদানি মহলে প্রবেশ করলেন। মশালের আলোকে দুই ভ্রাতা সন্ত্রস্ত হয়ে দেখলেন, দেওয়ালের গায়ে বিস্তর গোঁজ পোঁতা আছে, তা থেকে সারি সারি নরমুণ্ড ঝুলছে। তাদের দাড়ি হরেক রকম, কাঁচা, কাঁচা-পাকা, গালপাট্টা, ছাগল দাড়ি, লম্বা দাড়ি, গোঁফহীন দাড়ি ইত্যাদি।
উৎফলন্নেসা বললেন, শোন বড় জাহাঁপনা আর ছোট জাহাঁপনা, এই সব মণ্ড হচ্ছে আমাদের ভুতপর স্বামীদের। উত্তরদিকের দেওয়ালে আমার স্বামীদের, আর দক্ষিণের দেওয়ালে লুৎফুলের। বিবাহের পর এরা প্রত্যেকেই আমাদের সখীদের প্রতি লোলুপ নয়নে চেয়েছিল, সেজন্যে আমাদের নিয়ম অনুসারে এদের কতল করা হয়েছে। তোমরা যেমন কুলটা স্ত্রীকে দণ্ড দাও, আমরা তেমনি লম্পট স্বামীকে দিই। ওহে শাহরিয়ার আর শাহজমান, যদি হশিয়ার না হও তবে তোমাদেরও এই দশা হবে। খবরদার, তলোয়ারে হাত দিও না, তা হলে আমাদের এই রক্ষীরা এখনই তোমার গরদান নেবে।
শাহরিয়ার বললেন, পিশাচী রাক্ষসী ঘলী ইবলিস-নন্দিনী, তোমাদের মনে কি দয়া মায়া নেই?
–তোমাদের চাইতে ঢের বেশী আছে। তোমরা প্রতিদিন নব নব বধু, ঘরে এনেছ, এক রাত্রির পরেই প্রত্যেককে হত্যা করেছ। তাদের চরিত্র ভাল কি মন্দ তা না জেনেই মেরে ফেলেছ। আমরা অত নির্দয় নই, বিনা দোষে পতিহত্যা করি না। যদি দেখি লোকটা অন্য নারীর উপর নজর দিচ্ছে তবেই তার গরদান নিই।
শাহজমান চুপি চুপি বললেন, দাদা, মুণ্ডুগুলো মাটির কি প্লাস্টিকের তৈরী নয় তো?
শাহরিয়ার বললেন, না, তা হলে মাছি বসত না। অবশ্য একটু গড় লাগালেও মাছি বসে। যাই হক, এই শয়তানীদের কবল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। আমাদের সঙ্গে যদি প্রচুর সৈন্য থাকত তবে সখীর দল সমেত এদের গ্রেপতার করে নিয়ে যেতাম।
তার পর শাহরিয়ার গুরুগম্ভীর স্বরে বললেন, শাহজাদী, তোমাদের আমরা তালাক দিলাম, এখনই দেশে ফিরে যাব।
উৎফল বললেন, তোমাদের তালাক-বাক্য গ্রাহ্য নয়, এখানকার আইন আলাদা। আমরা ছেড়ে না দিলে তোমাদের এখান থেকে মুক্তি নেই।
—তবে এই সখীদের সরিয়ে দাও, ওরা চোখের সামনে থাকলে আমাদের লোভ হবে।
-ওরা এখানেই থাকবে, নইলে তোমাদের চরিত্রের পরীক্ষা হবে, কি করে।
মাথা চাপড়ে শাহরিয়ার বললেন, হা, আমাদের পারস্য আর তার্তা রাজ্যের কি হবে?
উৎফুল বললেন, তার জন্যে ভেবো না। তোমার সেনাপতি শমশের জগ, শহরজাদীকে বেগম করে পারস্যের সিংহাসনে বসবে। আর নওশের জগ দিনারজাদীকে বেগম করে তাতার রাজ্যের মালিক হবে। তুমি আর শাহজমান এখনই ফরমান আর রাজীনামায় পাঞ্জা ছাপ লাগাও। দেরি করো না, তা হলে বিপদে পড়বে।
নিরুপায় হয়ে শাহরিয়ার আর শাহজমান দলিলে পাঞ্জার ছা: দিলেন। তার পর শাহরিয়ার করজোড়ে বললেন, শাহজাদী, দয়া কর। এখানে তোমাদের সখীদের দেখলে আমরা প্রলোভনে পড়ব, প্রা: হারাব। আমাদের অন্য কোথাও থাকতে দাও।
-তা থাকতে পার। এই গুলবুলিস্তানের উত্তরে পাহাড়ের গায়ে অনেক গুহা আছে, সেখানে তোমরা সুখে থাকতে পারবে। সাং দিন অন্তর এখান থেকে রসদ পাবে। দুজন মোল্লাও মাঝে মাহে গিয়ে ধর্মোপদেশ দেবেন। ওখানে তোমরা পাপমোচনের জনে; নিরন্তর তসবি জপ করবে এবং হরদম আল্লার নাম নেবে।
পাঁচ বৎসর পরে মোল্লারা জানালেন যে আল্লার কৃপায় দুই ভ্রাতার চরিত্র কিঞ্চিৎ দুরস্ত হয়েছে। তখন দই শাহজাদী নিজ নিজ স্বামীকে মুক্তি দিলেন, তালাকও দিলেন।
শাহরিয়ার ও শাহজমান দেশে ফিরে গিয়ে দেখলেন, প্রজা সৈন্য আর রাজকোষ সব বেহাত হয়ে গেছে, শমসের আর নওশের সিংহাসনে জেকে বসেছেন, রাজ্য ফিরে পাবার কোনও আশা নেই। অগত্যা তাঁরা বাগদাদে গেলেন এবং কাফিখানার জনতাকে আরব্য রজনীর বিচিত্র কাহিনী শুনিয়ে কোনও রকমে জীবিকানির্বাহ করতে লাগলেন।
চমৎকুমারী
বক্রেশ্বর দাস সরকারী গুণ্ডা দমন বিভাগের একজন বড় কর্মচারী। শীতের মাঝামাঝি এক মাসের ছুটি নিয়ে নববিবাহিত পত্নী মনোলোভার সঙ্গে সাঁওতাল পরগনায় বেড়াতে এসেছেন। সঙ্গে বুড়ো চাকর বৈকুণ্ঠ আছে। এঁরা গণেশমুণ্ডায় লালকুঠি নামক একটি ছোট বাড়িতে উঠেছেন। জায়গাটি নির্জন, প্রাকৃতিক দৃশ্য মনোহর।
বক্রেশ্বরের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, মনোলোভার পচিশের নীচে। বক্রেশ্বর বোঝেন যে তিনি সুদর্শন নন, শরীরে প্রচুর শক্তি থাকলেও তাঁর যৌবন শেষ হয়েছে। কিন্তু মনোলোভার রূপের খুব খ্যাতি আছে, বয়সও কম। এই কারণে বক্রেশ্বরের কিঞ্চিৎ হীনতাভাব অর্থাৎ ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে।
প্রভাত মুখুজ্যে মহাশয় একটি গল্পে একজন জবরদস্ত ডেপুটির কথা লিখেছেন। একদিন তিনি যখন বাড়িতে ছিলেন না তখন তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে এক পূর্বপরিচিত ভদ্রলোক দেখা করেন। ডেপুটিবাবু তা জানতে পেরে স্ত্রীকে যথোচিত ধমক দেন এবং আগন্তুক লোকটিকে আদালতী ভাষায় একটি কড়া নোটিস লিখে পাঠান। তার শেষ লাইনটি (ঠিক মনে নেই) এইরকম। বারদিগর এমত করিলে তোমাকে ফৌজদারি সোপর্দ করা হইবে। সেই ডেপুটির সঙ্গে বক্রেশ্বরের স্বভাবের কিছু মিল আছে। দরিদ্রের কন্যা অল্পশিক্ষিতা ভালমানুষ মনোলোভা তাঁর স্বামীকে চেনেন এবং সাবধানে চলেন।
জিনিসপত্র সব গোছানো হয়ে গেছে। বিকেল বেলা মনোলোভ বললেন, চল চম্পীদিদির সঙ্গে দেখা করে আসি। তিনি ওই তির সিংগা পাহাড়ের কাছে লছমনপুরায় আছেন, চিঠিতে লিখেছিলেন আমাদের এই বাসা থেকে বড় জোর সওয়া মাইল।
বক্রেশ্বর বললেন, আমার ফুরসত নেই। একটা স্কীম মাথায় এসেছে, গভরমেন্ট যদি সেটা নেয় তবে দেশের সমস্ত বদমাশ শায়েস্তা হয়ে যাবে। এই দুটির মধ্যেই স্কীমটা লিখে ফেলব। তুমি যেতে চাও যাও, কিন্তু বৈকুণ্ঠকে সঙ্গে নিও।
—বৈকুণ্ঠর ঢের কাজ। বাজার করবে, দুধের ব্যবস্খা করবে, রান্নার যোগাড় করবে। আর ও তে অথর্ব বুড়ো, ওকে সঙ্গে নেওয়া মিথ্যে। আমি একাই যেতে পারব, ওই তো তিরসিংগা পাহাড় সোজা দেখা যাচ্ছে।
–ফিরতে দেরি করো না, সন্ধ্যের আগেই আসা চাই।
লছমনপুরায় পৌঁছে মনোলোভা তাঁর চম্পীদিদির সঙ্গে অফুরন্ত গল্প করলেন। বেলা পড়ে এলে চম্পীদিদি ব্যস্ত হয়ে বললেন, যা যা শিগগির ফিরে যা, নয়তো অন্ধকার হয়ে যাবে, তোর বর ভেবে সারা হবে। আমাদের দুটো চাকরই বেরিয়েছে, নইলে একটাকে তোর সঙ্গে দিতুম। কাল সকালে আমরা তোর কাছে যাব।
মনোলোভ তাড়াতাড়ি চলতে লাগলেন। মাঝপথে একটা সর, নদী পড়ে, তার খাত গভীর, কিন্তু এখন জল কম। মাঝে মাঝে বড় বড় পাথর আছে, তাতে পা ফেলে অনায়াসে পার হওয়া যায়। নদীর কাছাকাছি এসে মনোলোভা দেখতে পেলেন, বাঁ দিকে কিছু দূরে চার-পাঁচটা মোষ চরছে, তার মধ্যে একটা প্রকাণ্ড শিংওয়ালা জানোয়ার কুটিল ভঙ্গীতে তাঁর দিকে তাকাচ্ছে। মোষের রাখাল একটি ন-দশ বছরের ছেলে। সে হাত নেড়ে চেঁচিয়ে কি বলল বোঝা গেল না। মনোলোভা ভয় পেয়ে দৌড়ে নদীর ধারে এলেন এবং কোনও রকমে পার হলেন, কিন্তু ওপারে উঠেই একটা পাথরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন, পারলেন না, পায়ের চেটোয় অত্যন্ত বেদনা।
চারিদিক জনশূন্য, সেই রাখাল ছেলেটাও অদশ্য হয়েছে। অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। আতঙ্কে মনোলোভার বুদ্ধিলোপ হল। হঠাৎ তাঁর কানে এল।
–একি, পড়ে গেলেন নাকি?
লম্বা লম্বা পা ফেলে যিনি এগিয়ে এলেন তিনি একজন ব্যুঢ়োরস্ক বৃষস্কন্ধ পুরুষ, পরনে ইজার, হাঁটু পর্যন্ত আচকান, তার উপর একটা নকশাদার শালের ফতুয়া, মাথায় লোমশ ভেড়ার চামড়ার আাকান টুপি।
মনোলোভার দুই হাত ধরে টানতে টানতে আগন্তুক বললেন, হেইও, উঠে পড়ুন। পারছেন না। খুব লেগেছে? দেখি কোথায় লাগল।
হাত পা গুটিয়ে নিয়ে মনোলোভা বললেন, ও আর দেখবেন কি, পা মচকে গেছে, দাঁড়াবার শক্তি নেই। আপনি দয়া করে যদি একটা পালকি টালকি যোগাড় করে দেন তো বড়ই উপকার হয়।
–খেপেছেন, এখানে পালকি তাঞ্জাম চতুর্দোলা কিছুই মিলবে না, স্ট্রেচারও নয়। আপনি কোথায় থাকেন? গণেশমুণ্ডায় লাল কুঠিতে? আপনারাই বুঝি আজ সকালে পৌঁছেছেন? আমি আপনার পায়ে একটু মাসাজ করে দিচ্ছি, তাতে ব্যথা কমবে। তার পর আমার হাতে ভর দিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বাড়ি ফিরতে পারবেন। যদি মচকে গিয়ে থাকে, চুনে-হলদে লাগালেই চট করে সেরে যাবে।
বিব্রত হয়ে মনোলোভা বললেন, না না আপনাকে মাসাজ করতে হবে না। হেঁটে যাবার শক্তি আমার নেই। আপনি দয়া করে আমাদের বাসায় গিয়ে মিস্টার বি দাসকে খবর দিন তিনি নিয়ে যাবার যা হয় ব্যবস্থা করবেন।
—পাগল হয়েছেন? এখান থেকে গিয়ে খবর দেব, তার পর দাস মশাই চেয়ারে বাঁশ বেধে লোকজন নিয়ে আসবেন, তার মানে অন্তত পঁয়তাল্লিশ মিনিট। ততক্ষণ আপনি অন্ধকারে এই শীতে একা পড়ে থাকবেন তা হতেই পারে না। বিপদের সময় সংকোচ করবেন না, আপনাকে আমি পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাচ্ছি।
-কি যা তা বলছেন!
–কেন, আমি পারব না ভেবেছেন? আমি কে তা জানেন? গগনচাঁদ চক্কর, গ্রেট মরাঠা সার্কসের স্ট্রং ম্যান। না না, আমি মরাঠী নই, বাঙালী বরেন্দ্র ব্রাহ্মণ, চক্রবর্তী পদবীটা ছেঁটে চক্কর করেছি। সম্প্রতি টাকার অভাবে সাকস বন্ধ ছিল, তাই এখানে আসবার ফরসত পেয়েছি। আজ সকালে আমাদের ম্যানেজার সাপুরজীর চিঠি পেয়েছি—সব ঠিক হয়ে গেছে, দু হপ্তার মধ্যে তোমরা পনায় চলে এস। জানেন, আমার বুকের ওপর দিয়ে হাতি চলে যায়, দু হন্দর বারবেল আমি বনবন করে ঘোরাতে পারি। আপনার এই শিঙি মাছের মতন একরত্তি শরীর আমি বইতে পারব না?
–খবরদার, ও সব হবে না।
—কেন বলুন তো? আপনি কি ভেবেছেন আমি রাবণ আর আপনি সীতা, আপনাকে হরণ করতে এসেছি। আপনাকে আমি বয়ে নিয়ে গেলে আপনার কলঙ্ক হবে, লোকে ছিছি করবে?
–আমার স্বামী পছন্দ করবেন না।
–কি অদ্ভুত কথা! অমন রামচন্দ্র স্বামী জোটালেন কোথা থেকে? বিপদের সময় নাচার হয়ে আপনাকে যদি বয়ে নিয়ে যাই তাতে আপত্তির কি আছে? আপনার কত বুঝি মনে করবেন আমার ওপর আপনার অনুরাগ জন্মেছে, আমার পশে আপনি পুলকিত হয়েছেন, এই তো? একবার ভাল করে আমার মুখখানা দেখুন তো, আকর্ষণের কিছু আছে কি?
পকেট থেকে একটা প্রকাণ্ড টর্চ বার করে গগনচাঁদ নিজের শ্রীহীন মুখের ওপর আলো ফেললেন, তার পর বললেন, দেখুন, লোকে আমার মুখ দেখতে সার্কসে আসে না, শুধু গায়ের জোরই দেখে। আমার এই চাঁদবদন দেখলে আপনার স্বামীর মনে কোনও সন্দেহই হবে না।
মনোলোভা বললেন, কেন কি করে সময় নষ্ট করছেন। আপনার চেহারা সুশ্রী না হলেও লোকে দোষ ধরতে পারে।
–ও, বুঝেছি। আপনার চিত্তবিকার না হলেও আমার তো আপনার ওপর লোভ হতে পারে—এই না? নিশ্চয় আপনি নিজেকে খুব সুন্দরী মনে করেন। একদম ভুল ধারণা, মিস চমৎকুমারী ঘাপার্দের কাছে আপনি দাঁড়াতেই পারেন না।
—তিনি আবার কে?
গগনচাঁদ চক্কর তাঁর ফতুয়ার বোতাম খুললেন, আচকানেরও খুললেন, তার নীচে যে জামা ছিল, তারও খুললেন। তার পর মুখে একটি বিহ্বল ভাব এনে নিজের উন্মুক্ত লোমশ বুকে তিনবার চাপড় মারলেন।
মনোলোভা প্রশ্ন করলেন, আপনার প্রণয়িনী নাকি?
—শুধু প্রণয়িনী নয় মশাই, দস্তুরমত সহধর্মিণী। তিন মাস হল দুজনে বিবাহবন্ধনে জড়িত হয়ে দম্পতি হয়ে গেছি।
–তবে মিস চমৎকুমারী বললেন কেন? এখন তো তিনি শ্রীমতী
-আঃ, আপনি কিছুই বোঝেন না। মিস চমৎকুমারী ঘাপার্দে হল তাঁর স্টেজ নেম, আমেরিকান ফিল্ম অ্যাকট্রেসরা যেমন পঞ্চাশবার বিয়ে করেও নিজের কুমারী নামটাই বজায় রাখে, সেইরকম আর কি। চমৎকুমারী হচ্ছেন গ্রেট মরাঠা সার্কসের লীডিং লেড়ি, বলবতী ললনা। যেমন রুপ, তেমনি বাহবল, তেমনি গলার জোর। একটা প্রমাণ সাইজ গর, কিংবা গাধাকে উপ করে কাঁধে তুলে নিয়ে ছুটতে পারেন। আবার ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে একটা হাত কানে চেপে অন্য হাতে তারা নিয়ে ধুপদ খেয়াল গাইতে পারেন। মহারাষ্ট্রী মহিলা, কিন্তু অনেক কাল কলকাতায় ছিলেন, চমৎকার বাঙলা বলেন। আপনার স্বামীর সঙ্গে তাঁর মোলাকাত করিয়ে দেব। চমৎকুমারীকে দেখলেই তিনি বুঝতে পারবেন যে আমার হদয় শক্ত খুটিতে বাঁধা আছে, তার আর নড়ন চড়ন নেই।
–আপনি আর দেরি করবেন না, দয়া করে মিস্টার দাসকে খবর দিন।
–কি কথাই বললেন! আমি চলে যাই, আপনি একলা পড়ে থাকুন, আর বাঘ কি হড়ার কি লক্কড় এসে আপনাকে ভক্ষণ করকে। শুনতে পাচ্ছেন? ওই শেয়াল ডাকছে। আপনার হিতাহিত জ্ঞান এখন লোপ পেয়েছে, কোনও আপত্তিই আমি শুনবো না। চুপ, আর কথাটি নয়।
নিমেষের মধ্যে মনোলোভাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গগন চাঁদ সবেগে চললেন। মনোলোভা ছটফট করতে লাগলেন। গগনচাঁদ বললেন, খবরদার হাত পা ছুড়বেন না, তা হলে পড়ে যাবেন, কোমর ভাঙবে, পাঁজরা ভাঙবে। এত আপত্তি কিসের? আমাকে কি অচ্ছুত হরিজন ভেবেছেন না সেকেলে বঠঠাকুর ঠাউরেছেন যে ছুঁলেই আপনার ধর্মনাশ হবে? মনে মনে ধ্যান করুন—আপনি একটা দুরন্ত খুকী, রাস্তায় খেলতে খেলতে আছাড় খেয়েছেন, আর আমি আপনার
স্নেহময়ী দিদিমা, কোলে করে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।
আপত্তি নিষ্ফল জেনে মনোলোভা চুপ করে আড়ষ্ট হয়ে রইলেন। গগনচাঁদ হাতের মুঠোয় টর্চ টিপে পথে আলো ফেলতে ফেলতে চললেন।
বক্রেশ্বর দাস দুজনকে দেখে আশ্চর্য হয়ে বললেন, একি ব্যাপার?
গগনচাঁদ বললেন, শোবার ঘর কোথায়? আগে আপনার স্ত্রীকে বিছানায় শুইয়ে দিই, তার পর সব বলছি। এই বুঝি আপনার চাকর? ওহে বাপ, শিগগির মালসা করে আগুন নিয়ে এস, তোমার মায়ের পায়ে সেক দিতে হবে।
মনোলোভাকে শুইয়ে গগনচাঁদ বললেন, মিস্টার দাস, আপনার স্ত্রী পড়ে গিয়েছিলেন, ডান পায়ের চেটো মচকে গেছে। চলবার শক্তি নেই, অথচ কিছুতেই আমার কথা শুনবেন না, কেবলই বলেন, লে আও পালকি, বোলাও দাস সাহেবকো। আমি জোর করে একে তুলে নিয়ে এসেছি। অতি অবুঝ বদরাগী মহিলা, সমস্ত পথটা আমাকে যাচ্ছেতাই গালাগাল দিতে দিতে এসেছেন।
মনোলোভ অস্ফুট স্বরে বললেন, বাঃ, কই আবার দিলুম!
বক্রেশ্বর একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। এখন গরম হয়ে বললেন, তুমি লোকটা কে হে? ভদ্রনারীর ওপর জলম কর এতদূর আস্পর্ধা?
-অবাক করলেন মশাই। কোথায় একটু চা খেতে বলবেন, অন্তত কিঞ্চিৎ থ্যাংকস দেবেন, তা নয়, শুধুই ধমক!
-হু আর ইউ? কেন তুমি ওঁর গায়ে হাত দিতে গেলে?
-আরে মশাই, ওঁকে যদি নিয়ে না আসতুম তা হলে যে এতক্ষণ বাঘের পেটে হজম হয়ে যেতেন, আপনাকে যে আবার একটা গিন্নীর যোগাড় দেখতে হত।
—চোপরও বদমাশ কোথাকার। জান, আমি হচ্ছি বক্রেশ্বর দাস আই.এ, এস, গণ্ডা কন্ট্রোল অফিসার, এখনি তোমাকে পুলিসে হ্যাণ্ড ওভার করতে পারি?
–তা করবেন বইকি। স্ত্রী যন্ত্রণায় ছটফট করছেন সেদিকে হুঁশ নেই, শুধু আমার ওপর তশি। মুখ সামলে কথা কইবেন মশাই, নইলে আমিও রেগে উঠব। এখন চললুম, নির্মল মুখুজ্যে ডাক্তারকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বক্রেশ্বর তেড়ে এসে গগনচাঁদের পিঠে হাত দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে বললেন, অভি নিকালো।
গগনচাঁদ বেগে চলতে লাগলেন, বক্রেশ্বের পিছু পিছ গেলেন। কিছুদূর গিয়ে গগনচাঁদ বললেন, লড়তে চান? আপনার স্ত্রী একটু সুস্থ হয়ে উঠুন তার পর লড়বেন। যদি সবর করতে না পারেন তো কাল সকালে আসতে পারি।
বক্রেশ্বর বললেন, কাল কেন, এখনই তোকে শায়েস্তা করে দিচ্ছি। জানিস, আমি একজন মিডলওয়েট চ্যাম্পিয়ন? এই নে, দেখি কেমন সামলাতে পারিস।
গগনচাঁদ ক্ষিপ্রগতিতে সরে গিয়ে ঘুষি থেকে আত্মরক্ষা করলেন এবং বক্রেশ্বরের পায়ের গুলিতে ছোট একটি লাথি মারলেন। সঙ্গে সঙ্গে বক্রেশ্বর ধরাশায়ী হলেন।
গগনচাঁদ বললেন, কি হল দাস মশাই, উঠতে পারছেন না? পা মচকে গেছে। বেশ যা হক, কাগিন্নীর এক হাল। ভাববেন না, আপনাকে তুলে নিয়ে গিন্নীর পাশে শুইয়ে দিচ্ছি, তার পর ডাক্তার এসে চিকিৎসার ব্যবস্থা করবে।
বক্রেশ্বর বললেন, ড্যাম ইউ, গেট আউট ইহাঁ সে।
-ও, আমার কোলে উঠবেন না? আচ্ছা চললম, আর কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
বক্রেশ্বর বেশ শক্তিমান পুরুষ, ভাবতেই পারেন নি যে ওই বদমাশ গুণ্ডাটা তাঁর প্রচণ্ড ঘুষি এড়িয়ে তাঁকেই কাবু করে দেবে। শুধু ডান পায়ের চেটো মচকায় নি, তাঁর কাঁধও একটু থেঁতলে গেছে। তিনি ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকতে লাগলেন, বৈকুণ্ঠ, ও বৈকুণ্ঠ।
প্রায় পনরো মিনিট বক্রেশ্বর অসহায় হয়ে পড়ে রইলেন। তার পর নারীকণ্ঠ কানে এল—অগ্গ বাঈ! হে কায়? কায় ঝালা তুমহালা?–ওমা, এ কি? কি হয়েছে আপনার?
বক্রেশ্বর দেখলেন, কাছা দেওয়া লাল শাড়ি পরা মহিষমর্দিনী তুল্য একটি বিরাট মহিলা টর্চ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। বক্রেশ্বর বললেন, উঃ বড় লেগেছে, ওঠবার শক্তি নেই। আপনি-আপনি কে?
—চিনবেন না। আমি হচ্ছি চমৎকুমারী ঘাপার্দে, গ্রেট মরাঠা সার্কসের বলবতী ললনা।
-আপনি যদি দয়া করে ওই লালকুঠিতে গিয়ে আমার চাকর বৈকুণ্ঠকে পাঠিয়ে দেন–
–আপনার চাকর তো রোগা পটকা বড়ো, আপনার এই দু-মনী লাশ সে বইতে পারবে কেন? ভাববেন না, আমিই আপনাকে পাঁজা কোলা করে তুলে নিয়ে যাচ্ছি।
-সেকি, আপনি?
-কেন, তাতে দোষ কি, বিপদের সময় সবই করতে হয়। ভাবছেন আমি অবলা নারী, পারব না? জানেন, আমি একটা পরষ্ট গাধাকে কাঁধে তুলে নিয়ে দৌড়াতে পারি?
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বক্রেশ্বর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। চমৎকুমারী খপ করে তাঁকে তুলে নিয়ে বললেন, ওকি, অমন কুকড়ে গেলেন কেন, লজ্জা কিসের? মনে করুন আমি আপনার মেলোমশাই, আপনি একটা পাজী ছোট ছেলে, আপনার চাইতেও পাজী আর একটা ছেলে লাথি মেরে আপনাকে ফেলে দিয়েছে, মেসোমশাই দেখতে পেয়ে কোলে তুলে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন।
চমৎকুমারী তাঁর বোঝা নিয়ে হনহন করে হেঁটে তিন মিনিটের মধ্যে লালকুঠিতে পৌঁছলেন এবং বিছানায় মনোলোভার পাশে ধপাস করে ফেলে বক্রেশ্বরকে শুইয়ে দিলেন। বক্রেশ্বর করণে স্বরে বললেন, উহহ, বড় ব্যথা। জান মনু, আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম, ইনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন, গ্রেট মরাঠা সার্কসের স্ট্রং লেডি মিস চমৎকুমারী ঘাপার্দে।
মনোলোভা অবাক হয়ে দু হাত তুলে নমস্কার করলেন।
নির্মল ডাক্তার তাঁর কম্পাউণ্ডারকে নিয়ে এসে পড়লেন। স্বামী শ্রীকে পরীক্ষা করে ডাক্তার বললেন, ও কিছু নয়, দুজনেরই পায়ে একটু স্পেন হয়েছে। একটা লোশন দিচ্ছি, তাতেই সেরে যাবে। তিন-চার দিন চলাফেরা করবেন না, মাঝে মাঝে ননের পুটলির সেক দেবেন। মিস্টার দাসের কাঁধে একটা ওষুধ লাগিয়ে ড্রেস করে দিচ্ছি।
যথাকর্তব্য করে ডাক্তার আর কম্পাউণ্ডার চলে গেলেন। চমৎকুমারী বললেন, আপনাদের চাকর একা সামলাতে পারবে না, আমি আপনাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে তার পর যাব।
বক্রেশ্বর করজোড়ে বললেন, আপনি করুণাময়ী, যে উপকার করলেন তা জীবনে ভুলব না।
মনোলোভা মনে মনে বললেন, তা ভুলবে কেন, ওই গোদা হাতের জাপটানি যে প্রাণে সুড়সুড়ি দিয়েছে। যত দোষ বেচারা গগনচাঁদের।
বক্রেশ্বর বললেন, ডাক্তারবাবুর কাছে শুনলাম, আপনার স্বামী মিস্টার চক্করও এখানে আছেন। কাল বিকেলে আপনারা দুজনে দয়া করে এখানে যদি চা খান তো কৃতার্থ হব। আমার এক শালী কাছেই থাকেন, তাঁকে কাল আনাব, তিনিই সব ব্যবস্থা করবেন। আমার তো চলবার শক্তি নেই, নয়তো নিজে গিয়ে আপনাদের আসবার জন্যে বলতুম।
চমৎকুমারী বললেন, কাল যে আমরা তিন দিনের জন্যে রাঁচি যাচ্ছি। শনিবারে ফিরব। রবিবার বিকেলে আমাদের বাসায় একটা সামান্য টি-পার্টির ব্যবস্থা করেছি। চক্করের বন্ধু হোম মিনিস্টার শ্ৰীমহাবীর প্রসাদ, দমকার ম্যাজিস্ট্রেট খাস্তগির সাহেব, গিরিডির মার্চেই সর্দার গুরমুখ সিং এরা সবাই আসবেন। আপনারা দুজনে দয়া করে এলে খুব খুশী হব। কোনও কষ্ট হবে না, একটা গাড়ি পাঠিবে দেব। আসবেন তো?
বক্রেশ্বের বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়।
মনোলোভা মনে মনে বললেন, হেই মা কালী, রক্ষা কর।
চাঙ্গায়নী সুধা
ক্যালকাটা টি ক্যাবিনের নাম নিশ্চয় আপনাদের জানা আছে, নূতন দিল্লির গোল মার্কেটের পিছনের গলিতে কালীবাবুর সেই বিখ্যাত চায়ের দোকান।
বিজয়াদশমী, সন্ধ্যা সাতটা। পেনশনভোগী বৃদ্ধ রামতারণ মুখুজ্যে, স্কুল মাস্টার কপিল গুপ্ত, ব্যাংকের কেরানী বীরেশ্বর সিংগি, কাগজের রিপোর্টার অতুল হালদার প্রভৃতি নিয়মিত আড্ডাধারীরা সকলেই সমবেত হয়েছেন। বিজয়ার নমস্কার আর আলিঙ্গন যথারীতি সম্পন্ন হয়েছে, এখন জলযোগ চলছে। কালীবাবু আজ বিশেষ ব্যবস্থা করেছেন—চায়ের সঙ্গে চিঁড়ে ভাজা ফুলুরি নিমকি আর গজা।
অতুল হালদার বললেন, আজকের ব্যবস্থা তো কালীবাবু ভালই করেছেন, কিন্তু একটি যে ত্রুটি রয়ে গেছে, কিঞ্চিৎ সিদ্ধির শরবত থাকলেই বিজয়ার অনুষ্ঠানটি সর্বাঙ্গসুন্দর হত।
রামতারণ মুখুজ্যে বললেন, তোমাদের যত সব বেয়াড়া আবদার। চায়ের দোকানে সিদ্ধির শরবত কি রকম? সিদ্ধি হল একটি পবিত্র বস্তু, যার শাস্ত্রীয় নাম ভঙ্গা বা বিজয়া। কালীবাবুর এই দোকান তো পাঁচ ভূতের হাট এখানে সিদ্ধি চলবে না। দেবীর বিসর্জনের পর মঙ্গলঘট আর গুরুজনদের প্রণাম করে শুদ্ধচিত্তে সিদ্ধি খেতে হয়। আমি তো বাড়িতেই একটু খেয়ে নিয়ম রক্ষা করে তবে এখানে এসেছি।
একজন সাধুবাবা টি ক্যাবিনে প্রবেশ করলেন। ছ ফুট লম্বা মজবুত গড়ন, কাঁধ পর্যন্ত ঝোলা চুল, মোটা—গোঁফ, কোদালের মতন কাঁচা—পাকা দাড়ি, কপালে ভস্মের ত্রিপুণ্ড্রক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, মাথায় কান—ঢাকা গেরুয়া টুপি, গায়ে গেরুয়া আলখাল্লা, পায়ে গেরুয়া ক্যামবিসের জুতো, হাতে একটি অ্যালুমিনিয়মের প্রকাণ্ড কমণ্ডলু বা হাতলযুক্ত বদনা। আগন্তুক ঘরে এসেই বাজখাঁই গলায় বললেন, নমস্তে মশাইরা, খবর সব ভাল তো?
কপিল গুপ্ত বললেন, আরে বকশী মশাই যে, আসতে আজ্ঞা হ’ক।* দু বছর দেখা নেই, এতদিন ছিলেন কোথায়? ভোল ফিরিয়েছেন দেখছি, সাধু মহারাজ হলেন কবে থেকে? বাঃ, দাড়িটিতে দিব্বি পার্মানেণ্ট ওয়েভ করিয়েছেন। কত খরচ পড়ল?
রামতারণ মুখুজ্যে বললেন, শোন হে জটাধর বকশী, দু’দুবার ঠকিয়ে গেছ, এবার আর তোমার নিস্তার নেই, পুলিশে দেব।
অতুল হালদার বললেন, হুঁ হুঁ বাবা দু—দুবার ঘুঘু তুমি খেয়ে গেছ ধান, এই বার ফাঁদে ফেলে বধিব পরান।
কপিল গুপ্ত বললেন, আহা ভদ্রলোককে একটু হাঁফ ছেড়ে জিরুতে দিন, এঁর সমাচার সব শুনুন, তারপর পুলিস ডাকবেন। ও কালীবাবু, বকশী মশাইকে চা আর খাবার দাও, আমার অ্যাকাউণ্টে।
রবি বর্মার ছবিতে যেমন আছে—মেনকার কোলে শিশু শকুন্তলাকে দেখে বিশ্বামিত্র মুখ ফিরিয়ে হাত নাড়ছেন—সেই রকম ভঙ্গী করে জটাধর বললেন, না না, আর লজ্জা দেবেন না। আপনাদের ঢের খেয়েছি, এখন আমাকেই সেই ঋণ শোধ করতে হবে।
রামতারণ বললেন, তোমার অচলার কি খবর, সেই যাকে বিধবা বিবাহ করেছিলে?
ফোঁস করে একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে জটাধর বললেন, তার কথা আর বলবেন না মুখুজ্যে মশাই, মনে বড় ব্যথা পাই। অচলা তার আগের স্বামী বলহরির সঙ্গেই চলে গেছে। বলহরি তাকে জোর করে নিয়ে গেছে, আমার পঞ্চাশটা টাকাও ছিনিয়ে নিয়েছে, অচলার জন্যে এখান থেকে যে খানকতক চপ নিয়ে গিয়েছিলুম তাও সেই রাক্ষসটা কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলেছে।
কপিল গুপ্ত বললেন, যাক, গতস্য অনুশোচনা নাস্তি, এখন আপনার সন্ন্যাসের ইতিহাস বলুন। আহা, লজ্জা করছেন কেন, চা আর খাবার খেতে খেতেই বলুন, আমরা শোনবার জন্যে সবাই উদগ্রীব হয়ে আছি। ওহে কালীবাবু বকশী মশাইকে আরও এক পেয়ালা চা আর এক প্লেট খাবার দাও, গোটা দুই বর্মা চুরুটও দাও, সব আমার খরচায়।
চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে জটাধর বললেন, নেহাতই যদি শুনতে চান তো বলছি শুনুন। অচলা চলে যাবার পর মনে একটা দারুণ বৈরাগ্য এল, সংসারে ঘেন্না ধরে গেল। দুত্তোর বলে একটি তীর্থযাত্রী দলের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লুম। ঘুরতে ঘুরতে মানস সরোবর কৈলাস পর্বতে এসে পৌঁছুলুম। সেখানে হঠাৎ কানহাইয়া বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁর পূর্বনাম কানাই বটব্যাল, খুব বড় সায়েণ্টিস্ট ছিলেন, অনেক রকম কারবারও একাকালে করেছেন। শেষ বয়সে বিবাগী হয়ে হিমালয়ের একটি গুহায় পাঁচটি বৎসর তপস্যা করে সিদ্ধ হয়েছেন। আমার সঙ্গে পূর্বে একটু পরিচয় ছিল, দেখা মাত্র চিনে ফেললেন। তাঁর পা ধরে আমার দুঃখের সব কথা তাঁকে নিবেদন করলুম। কানু ঠাকুর বললেন, ভেবো না জটাধর, নিষ্কাম হয়ে কর্মযোগ অবলম্বন কর, আমার শিষ্য হও। আমি সংকল্প করেছি এই মানস সরোবরের তীরে একটি বড় মঠ প্রতিষ্ঠা করব, তাতে যাত্রীরা আশ্রয় পাবে। তিব্বত সরকারের পারমিশন পেয়েছি, দালাই লামা তাসী লামা পঞ্চেন লামা সবাই শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। আমি চাঁদা সংগ্রহের জন্য পর্যটন করব, তুমি সঙ্গে থেকে আমাকে সাহায্য করবে। কানু মহারাজের কথায় আমি তখনই রাজী হলুম। তার পর প্রায় বছর খানিক তাঁর সঙ্গে ভ্রমণ করেছি, হিমালয় থেকে কুমারিকা পর্যন্ত। মঠের জন্য গরিব বড়লোক সবাই চাঁদা দিয়েছে, যার যেমন সামর্থ্য, এক আনা থেকে এক লাখ পর্যন্ত। তা টাকা মন্দ ওঠে নি, প্রায় পৌনে চার লাখ, সবই ইণ্ডো—টিবেটান যক্ষ ব্যাংকে জমা আছে। কানু মহারাজ সম্প্রতি দিল্লিতেই অবস্থান করছেন দরিয়াগঞ্জে শেঠ গজাননজীর কুঠীতে। তাঁর অনুমতি নিয়ে একবার আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে এলুম।
রামতরণ বললেন আমরা কেউ এক পয়সা চাঁদা দেব না তা আগেই বলে রাখছি। তোমাকে থোড়াই বিশ্বাস করি।
জটাধর বকশী প্রসন্ন বদনে বললেন, মুখুজ্যে মশাইএর কথাটি হুঁশিয়ার জ্ঞানযোগীরই উপযুক্ত। বিশ্বাস করবেন কেন, আমার ভালোর দিকটা তো দেখেন নি। অদৃষ্টের দোষে বিপাকে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছি, আপনাদের কাছে অপরাধী হয়ে পড়েছি, সে কথা আমিই কি ভুলতে পারি? সৎকার্যের জন্যে চাঁদা, বিশেষ করে মঠ নির্মাণের জন্যে চাঁদা শ্রদ্ধার সঙ্গে দিতে হয়। শ্রদ্ধয়া দেয়ম—এই হল শাস্ত্রবচন। শ্রদ্ধা না হলে দেবেন কেন, আমিই বা চাইব কেন!
অতুল হালদার বললেন, থ্যাংক ইউ জটাই মহারাজ, আপনার বাক্যে আশ্বস্ত হলুম। মঠ প্রতিষ্ঠার কথা শুনেই আতঙ্ক হয়েছিল এখনই বুঝি চাঁদা চেয়ে বসবেন, না দিলে কানহাইয়া বাবার শাপের ভয় দেখাবেন। যাক, শ্রদ্ধা যখন নাস্তি তখন চাঁদাও নবডঙ্কা। আপনার ওই বিরাট বদনাটায় কি আছে?
জটাধর বললেন, বদনা বলবেন না। এর নাম রুদ্র কমণ্ডলু, কানু মহারাজের ফরমাশে গজানন শেঠজী বানিয়ে দিয়েছেন। তাঁর অ্যালুমিনিয়মের কারখানা আছে কিনা।
রামতারণ প্রশ্ন করলেন, কি আছে ওটাতে? চলবল করছে যেন।
—আজ্ঞে এতে আছে চাঙ্গায়নী সুধা, আপনাদের জন্যেই এনেছি।
রামতারণ বললেন, মৃতসঞ্জীবনী সুধা জানি; চাঙ্গায়নী আবার কি?
—এ এক অপূর্ব বস্তু মুখুজ্যে মশাই, কানু মহারাজের মহৎ আবিষ্কার। খেলে মন প্রাণ চাঙ্গা হয় তাই চাঙ্গায়নী সুধা নাম।
—মদ নাকি?
—মহাভারত! কানু মহারাজ মাদক দ্রব্য স্পর্শ করেন না, চা পর্যন্ত খান না। চাঙ্গায়নীতে কি আছে শুনবেন? আপনাদের আর জানাতে বাধা কি, কিন্তু দয়া করে ফরমুলাটি গোপন রাখবেন।
কপিল গুপ্ত বললেন, ভয় নেই বকশী মশাই, আমরা এই ক—জন ছাড়া আর কেউ টের পাবে না।
—তবে শুনুন। এতে আছে কুড়িটি কবরেজী গাছ—গাছড়া, কুড়ি রকম ডাক্তারী আরক, কুড়ি রকম হোমিও গ্লোবিউল, কুড়ি দফা হেকিমী দাবাই, তা ছাড়া তান্ত্রিক স্বর্ণভস্ম হীরকভস্ম বায়ুভস্ম ব্যোমভস্ম রাজ্যের ভিটামিন, আর পোয়াটাক ইলেকট্রিসিটি। আর আছে হিমালয়জাত সামলাতো, যাকে আপনারা সিদ্ধি বলেন, আর কাশ্মীরী মকরকন্দ। এই সব মিশিয়ে বকযন্ত্রে চোলাই করে প্রস্তুত হয়েছে। কানু ঠাকুর বলেন, এই চাঙ্গায়নী সুধাই হচ্ছে প্রাচীন ঋষিদের সোমরস, উনি শুধু ফরমুলাটি যুগোপযোগী করেছেন।
অতুল হালদার ঊরুতে চাপড় মেরে বললেন, আরে মশাই, এইরকম জিনিসই তো আজ দরকার। একটু আগেই বলছিলুম কিঞ্চিৎ সিদ্ধির শরবত হলেই আমাদের এই বিজয়া সম্মিলনীটি নিখুঁত হয়।
রামতারণ বললেন, অত ব্যস্ত হয়ো না হে অতুল, জটাধরের চাঙ্গায়নী যে নেশার জিনিস নয় তা জানলে কি করে?
জটাধর বকশী তাঁর প্রকাণ্ড জিহ্বাটি দংশন করে বললেন, কি যে বলেন মুখুজ্যে মশাই! নেশার জিনিস কি আপনাদের জন্যে আনতে পারি, আমার কি ধর্মজ্ঞান নেই? এতে সিদ্ধি আছে বটে, কিন্তু তা মামুলী ভাঙ নয়, বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় শোধন করে তার মাদকত্য একেবারে নিউট্রালাইজ করা হয়েছে। আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে যাকে বলে হৃদ্য বৃষ্য বল্য মেধ্য, এই চাঙ্গায়নী হল তাই। খেলে শরীর চাঙ্গা হবে, ইন্দ্রিয় আর বুদ্ধি তীক্ষ্ন হবে, চিত্তে পুলক আসবে, সব গ্লানি আর অশান্তি দূর হবে। কপিলবাবু, একটু ট্রাই করে দেখুন না। চায়ের বাটিটা আগে ধুয়ে নিন, জিনিসটা খুব শুদ্ধভাবে খেতে হয়।
কপিল গুপ্ত তাঁর চায়ের বাটি ধুয়ে এগিয়ে ধরে বললেন, খুব একটুখানি দেবেন কিন্তু। এই সিকিটি দয়া করে গ্রহণ করুন, আপনার কানহাইয়া মঠের জন্যে যৎকিঞ্চিৎ সাহায্য।
সিকিটি নিয়ে জটাধর তাঁর দশসেরী রুদ্র কমণ্ডলুর ঢাকনি খুললেন। ভিতর থেকে একটি ছোট হাতা বার করে তারই এক হাতা কপিল গুপ্তর বাটিতে ঢেলে দিয়ে বললেন, শ্রদ্ধয়া পেয়ম।
অতুল হালদার বললেন, আমাকেও একটু দাও হে জটাধর মহারাজ। এই নাও দুটো দোয়ানি।
বীরেশ্বর সিংগিও চার আনা দক্ষিণা দিয়ে এক হাতা নিলেন। চেখে বললেন, চমৎকার বানিয়েছেন জটাধরজী, অনেকটা কোকা কোলার মতন।
অতুল হালদার বললেন, দূর মুখখু, কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! সেদিন হংগেরিয়ান এমবাসির পার্টিতে মিল্কপঞ্চ খেয়েছিলুম, তার আগে ফ্রেঞ্চ কনসলের ডিনারে শ্যাম্পেনও খেয়েছি, কিন্তু এই চাঙ্গায়নী সুধার কাছে সে সব লাগে না। ওঃ, কি চীজই বানিয়েছ জটাই বাবা! মিষ্টি টক নোনতা ঝাল, ঈষৎ তেতো, ঈষৎ কষা, সব রসই আছে, কিন্তু প্রত্যেকটি একেবারে লাগসই। ঝাঁজও বেশ, বোধ হয় ইলেকট্রিzসটির জন্যে, পেটে গিয়ে চিনচিন করে শক দিচ্ছে। দাও হে আর এক হাতা।
রামতারণ মুখুজ্যে বললেন, আমার আবার বাতের ব্যামো, ডায়াবিটিসও একটু আছে। চাঙ্গায়নী একটু খেলে বেড়ে যাবে না তো হে জটাধর?
জটাধর বললেন, বাড়বে কি মশাই, একেবারে নির্মূল হবে, শরীরের সমস্ত ব্যাধি, মনের সমস্ত গ্লানি, হৃদয়ের যাবতীয় জ্বালা বেমালুম ভ্যানিশ করবে। মুখ হাঁ করুন তো, এক হাতা ঢেলে দিচ্ছি, ভক্তিভরে সেবন করুন। শ্রদ্ধয়া পেয়ং, শ্রদ্ধয়া দেয়ম।
—নাঃ, তুমি দেখছি বেজায় নাছোড়বান্দা, কিছু আদায় না করে ছাড়বে না। নাও, পুরোপুরি একটা টাকাই নাও।
বৃদ্ধ রামতারণ মুখুজ্যের সদদৃষ্টান্তে সকলেই উৎসাহিত হয়ে চাঙ্গায়নী সেবন করলেন। তিন হাতা খাবার পর বীরেশ্বর সিংগি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন, জটাধরজী, আমার মনে সুখ নেই, বড় কষ্ট, বড় অপমান, বউটা হরদম বলে, বোকারাম হাঁদারাম ভ্যাবাগঙ্গারাম।
জটাধর বললেন, আর একটু চাঙ্গায়নী খান বীরেশ্বরবাবু, সব দুঃখ ঘুচে যাবে। আপনি হলেন বীরপুংগব পুরুষসিংহ কার সাধ্য আপনায় অপমান করে! বোকারাম বললেই হল! দেখবেন আজ থেকে আর বলবে না, সবাই আপনাকে ভয় করবে।
রামতারণ বললেন, ওহে জটায়ু পক্ষী, তোমার চাঙ্গায়নী সত্যিই খাসা জিনিস। এই নাও দু টাকা, একটু বেশী করে দাও তো। গিন্নী কেবলই বলে বাহাত্তুরে বেআক্কেলে বুড়ো, ভীমরতি ধরেছে। মাগী আমাকে ভালমানুষ পেয়ে গ্রাহ্যির মধ্যে আনে না, বড়লোকের বেটী বলে ভারী দেমাক। আরে বাপের কত টাকা আমার ঘরে এনেছিস? আজ বাড়ি গিয়ে দেখে নেব, বেশ একটু তেজ পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে।
জটাধর বললেন, এই চাঙ্গায়নীতে সৌরতেজ রুদ্রতেজ ব্রহ্মতেজ সব আছে মুখুজ্যে মশাই। আপনি নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ, ঋষিদের বংশধর, আপনার পূর্বপুরুষরা সোমযাগ করতেন, কলসী কলসী সোমরস খেতেন। আপনার আবার তেজের ভাবনা! নিন, চায়ের পেয়ালা ভরতি করে দিলাম, চোঁ করে গলাধঃকরণ করে ফেলুন। পাঁচ টাকা দক্ষিণা—শ্রদ্ধয়া দেয়ং, শ্রদ্ধয়া পেয়ম।
কালীবাবুর টি ক্যাবিনে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা সকলেই অল্পাধিক চাঙ্গায়নী সুধা পান করলেন। কিন্তু জিনিসটির প্রভাব সকলের উপর সমান হল না। কপিল গুপ্ত গম্ভীর হয়ে বিড়বিড় করে ম্যাকবেথ আবৃত্তি করতে লাগলেন। বীরেশ্বর সিংগি এবং আর দুজন কচি ছেলের মতন খুঁতখুঁত করে কাঁদতে লাগলেন। দু তিন জন মেজেতে শুয়ে পড়ে নিদ্রামগ্ন হলেন। অতুল হালদার দাঁড়িয়ে উঠে হাত নেড়ে থিয়েটারী সুরে বলতে লাগলেন, শাহজাদী সম্রাটনন্দিনী, মৃত্যুভয় দেখাও কাহারে? রামতারণ মুখুজ্যে বেঞ্চের উপর উবু হয়ে বসে তুড়ি দিয়ে রামপ্রসাদী গাইতে লাগলেন—
কালী, একবার খাঁড়াটা নেব;
তোমার লকলকে জিব কেটে নিয়ে মা,
ভক্তিভরে কেটে নিয়ে মা,
বাবা শিবের শ্রীচরণে দেব।
কালীবাবু তাঁর টেবিলের পিছনে বসে সমস্ত নিরীক্ষণ করছিলেন। এখন এগিয়ে এসে জটাধরকে প্রশ্ন করলেন,আজ কত টাকা হাতালে জটাধরবাবু?
জটাধর বললেন? চাঁদার কথা বলছেন? অতি সামান্য বড়জোর পঞ্চাশ টাকা। আপনার মক্কেলরা তো কেউ টাকার আণ্ডিল নয়, সকলেরই দেখছি অদ্যভক্ষ্য ধনুর্গুণ।
—আমার দোকানে ব্যবসা করলে আমাকে কমিশন দিতে হয় তা বোঝ তো?
—বিলক্ষণ বুঝি। এই নিন পাঁচটাকা, টেন পারসেণ্টের কিছু বেশী পোষাবে।
—তোমার ওই বদনাটায় আর কিছু আছে না কি?
—আছে বই কি, চায়ের কাপের দু কাপ হবে। খাবেন?
—দাম কিন্তু দেব না।
—আপনার কাছে আবার দাম কি। এই নিন, সবটাই খেয়ে ফেলুন।
কালীবাবু দু পেয়ালা চাঙ্গায়নী পান করলেন, একটু পরেই তাঁর চোখ ঢুলুঢুলু হল।
জটাধর বললেন, টেবিলের ওপর শুয়ে পড়ে একটু বিশ্রাম করুন কালীবাবু। ভাববেন না, দশ মিনিটের মধ্যেই আপনারা সবাই চাঙ্গা হয়ে উঠবেন। হাঁ, ভাল কথা—আমার টাকা একটু কম পড়েছে, কিছু হাওলাত চাই, শৃঙ্গেরী মঠে যাবার রাহাখরচ, টাকা পঁচিশ হলেই চলবে। আপনার ক্যাশ থেকে নিলুম। আপত্তি নেই তো? একটা হ্যাণ্ডনোট লিখে দিই?… তাও নয়? থ্যাঙ্ক ইউ কালীবাবু, আপনি মহাশয় ব্যক্তি, বন্ধুকে একটু সাহায্য করতে আপত্তি করবেন কেন। টাকাটা আমার নামে আপনার খাতায় ডেবিট করবেন, আবার যেদিন আসব সুদ সুদ্ধ শোধ করব।
শিবনেত্র হয়ে জড়িত কণ্ঠে কালীবাবু বললেন, আবার কবে দেখা পাব?
—সবই ঠাকুরের ইচ্ছে কালীবাবু। কানহাইয়া বাবা যখনই এখানে টানবেন তখনই এসে পড়ব। আচ্ছা, এখন আসি, দরজাটা ভেজিয়ে দিচ্ছি। একটু সজাগ থাকবেন, বড় চোরের উপদ্রব। নমস্কার।
১৮৭৮ শক (১৯৫৬)
* জটাধর বকশীর পূর্বকথা ‘কৃষ্ণকলি’ ও ‘নীলতারা’ গ্রন্থে আছে।
চিকিৎসা-সঙ্কট
সন্ধ্যা হব হব। নন্দবাবু হগ সাহেবের বাজার হইতে ট্রামে বাড়ি ফিরিতেছেন। বীডন স্ট্রীট পার হইয়া গাড়ি আস্তে আস্তে চলিতে লাগিল। সম্মুখে গরুর গাড়ি। আর একটু গেলেই নন্দবাবুর বাড়ির মোড়। এমন সময় দেখিলেন পাশের একটা গলি হইতে তার বন্ধু বঙ্কু বাহির হইতেছেন। নন্দবাবু উৎফুল্ল হইয়া ডাকিলেন—’দাঁড়াও হে বঙ্কু, আমি নাবছি।’ নন্দর দু—বগলে দুই বান্ডিল, ব্যস্ত হইয়া চলন্ত গাড়ি হইতে যেমন নামিবেন অমনি কোঁচায় পা বাধিয়া নীচে পড়িয়া গেলেন।
গাড়িতে একটা শোরগোল উঠিল এবং ঘ্যাচাং করিয়া গাড়ি থামিল। জনকতক যাত্রী নামিয়া নন্দকে ধরিয়া তুলিলেন। যাঁরা গাড়ির মধ্যে ছিলেন তাঁরা গলা বাড়াইয়া নানাপ্রকারের সমবেদনা জানাইতে লাগিলেন। ‘—আহা হা বড্ড লেগেছে —থোড়া গরম দুধ পিলা দোও— দুটো পা—ই কি কাটা গেছে?’ একজন সিদ্বান্ত করিল মৃগি। আর একজন বলিল ভির্মি। কেউ বলিল মাতাল, কেউ বলিল বাঙাল, কেউ বলিল পাড়াগেঁয়ে ভূত।
বাস্তবিক নন্দবাবুর মোটেই আঘাত লাগে নাই। কিন্তু কে তা শোনে। ‘লাগে নি কি মশায়, খুব লেগেছে—দু—মাসের ধাক্কা— বাড়ি গিয়ে টের পাবেন।’ নন্দ বার বার করজোড়ে নিবেদন করিলেন যে প্রকৃতই কিছুমাত্র চোট লাগে নাই। একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক বলিলেন— ‘আরে মোলো, ভাল করলে মন্দ হয়। স্পষ্ট দেখলুম লেগেছে তবু বলে লাগে নি।’
এমন সময় বঙ্কুবাবু আসিয়া পড়ায় নন্দবাবু পরিত্রাণ পাইলেন, মনঃক্ষুণ্ণ যাত্রীগণসহ ট্রাম গাড়িও ছাড়িয়া গেল।
বঙ্কু বলিলেন—মাথাটা হঠাৎ ঘুরে গিয়েছিল আর কি। যা হোক, বাড়ির পথটুকু আর হেঁটে গিয়ে কাজ নেই। এই রিকশ—’
রিকশ নন্দবাবুকে আস্তে আস্তে লইয়া গেল, বঙ্কু পিছনে হাঁটিয়া চলিলেন।
নন্দবাবুর বয়স চল্লিশ, শ্যামবর্ণ, বেঁটে গোলগাল চেহারা। তাঁহার পিতা পশ্চিমে কমিসারিয়টে চাকরি করিয়া বিস্তর টাকা উপার্জন করিয়াছিলেন এবং মৃত্যুকালে একমাত্র সন্তান নন্দর জন্য কলিকাতায় একটি বড় বাড়ি, বিস্তর আসবাব এবং মস্ত একগোছা কোম্পানির কাগজ রাখিয়া যান। নন্দর বিবাহ অল্পবয়সেই হইয়াছিল, কিন্তু এক বৎসর পরেই তিনি বিপত্নীক হন এবং তারপর আর বিবাহ করেন নাই। মাতা বহুদিন মৃতা, বাড়িতে একমাত্র স্ত্রীলোক এক বৃদ্ধা পিসী। তিনি ঠাকুরসেবা লইয়া বিব্রত, সংসারের কাজ ঝি চাকররাই দেখে। নন্দবাবুর দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে আপত্তি নাই, কিন্তু এ পর্যন্ত তাহা হইয়া উঠে নাই। প্রধান কারণ—আলস্য। থিয়েটার, সিনেমা, ফুটবল ম্যাচ, রেস এবং বন্ধু বর্গের সংসর্গ—ইহাতে নির্বিবাদে দিন কাটিয়া যায়, বিবাহের ফুরসত কোথা? তার পর ক্রমেই বয়স বাড়িয়া যাইতেছে, আর এখন না করাই ভাল। মোটের ওপর নন্দ নিরীহ গোবেচারা অল্পভাষী উদ্যমহীন আরামপ্রিয় লোক।
নন্দবাবুর বাড়ির নীচে সুবৃহৎ ঘরে সান্ধ্য আড্ডা বসিয়াছে। নন্দ আজ কিছু ক্লান্ত বোধ করিতেছেন, সেজন্য বালাপোশ গায়ে দিয়া লম্বা হইয়া শুইয়া আছেন। বন্ধুগণের চা ও পাঁপরভাজা শেষ হইয়াছে, এখন পান সিগারেট ও গল্প চলিতেছে।
গুপীবাবু বলিতেছিলেন—’উঁহু। শরীরের ওপর এত অযত্ন ক’রো না নন্দ। এই শীতকালে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ভাল লক্ষণ নয়।’
নন্দ। মাথা ঠিক ঘোরে নি, কেবল কোঁচার কাপড় বেধে—
গুপী। আরে, না না। ঘুরেছিল বই কি! শরীরটা কাহিল হয়েছে। এই তো কাছাকাছি ডাক্তার তফাদার রয়েছেন। অত বড় ফিজিশিয়ান আর শহরে পাবে কোথা? যাও না কাল সকালে একবার তাঁর কাছে।
বঙ্কু বলিলেন—’আমার মতে একবার নেপালবাবুকে দেখালেই ভাল হয়। অমন বিচক্ষণ হোমিওপ্যাথ আর দুটি নেই। মেজাজটা একটু তিরিক্ষি বটে, কিন্তু বুড়োর বিদ্যে অসাধারণ।’
ষষ্ঠীবাবু মুড়িশুড়ি দিয়া এক কোণে বসিয়াছিলেন। তাঁর মাথায় বালাক্লাভা টুপি, গলায় দাড়ি এবং তার উপর কম্ফর্টার। বলিলেন—’বাপ, এত শীতে অবেলায় কখনও ট্রামে চড়ে? শরীর অসাড় হলে আছাড় খেতেই হবে। নন্দর শরীর একটু গরম রাখা দরকার।’
নিধু বলিল—’নন—দা, মোটা চাল ছাড়। সেই এক বিরিঞ্চির আমলের ফরাস তাকিয়া, লক্কড় পালকি গাড়ি আর পক্ষীরাজ ঘোড়া, এতে গায়ে গত্তি লাগবে কিসে? তোমার পয়হার অভাব কি বাওআ? একটু ফুর্তি করতে শেখ।’
সাব্যস্ত হইল কাল সকালে নন্দবাবু ডাক্তার তফাদারের বাড়ি যাইবেন।
ডাক্তার তফাদার M.D M.R.A.S গ্রে স্ট্রীটে থাকেন। প্রকাণ্ড বাড়ি, দু—খানা মোটর, একটা ল্যাণ্ড। খুব পসার, রোগীরা ডাকিয়া সহজে পায় না। দেড় ঘণ্টা পাশের কামরায় অপেক্ষা করার পর নন্দবাবুর ডাক পড়িল। ডাক্তারসাহেবের ঘরে গিয়া দেখিলেন এখনও একটি রোগীর পরীক্ষা চলিতেছে। একজন স্থূলকায় মারোয়াড়ী নগ্নগাত্রে দাঁড়াইয়া আছে। ডাক্তার ফিতা দিয়া তাঁহার ভুঁড়ির পরিধি মাপিয়া বলিলেন—’বস, সওয়া ইঞ্চি বঢ় গিয়া।’ রোগী খুশি হইয়া বলিল—’নবজ তো দেখিয়ে।’ ডাক্তার রোগীর মণিবন্ধে নাড়ীর উপর একটি মোটর কারের স্পার্কিং প্লাগ ঠেকাইয়া বলিলেন—’বহুত মজেসে চল রহা।’ রোগী বলিল—’জবান তো দেখিয়ে। রোগী হাঁ করিল, ডাক্তার ঘরের অপর দিকে দাঁড়াইয়া অপেরা প্লাস দ্বারা তাহার জিব দেখিয়া বলিলেন—’থোড়েসি কসর হ্যায়। কল ফিন আনা।’
রোগী চলিয়া গেলে তফাদার নন্দর দিকে চাহিয়া বলিলেন—’ওয়েল?’
নন্দ বলিলেন—’আজ্ঞে বড় বিপদে পড়ে আপনার কাছে এসেছি। কাল হঠাৎ ট্রাম থেকে—
তফাদার। কম্পাউন্ড ফ্রাকচার? হাড় ভেঙেছে?
নন্দবাবু আনুপূর্বিক তাঁর অবস্থার বর্ণনা করিলেন। বেদনা নাই, জ্বর হয় না, পেটের অসুখ, সর্দি, হাঁপানি নাই। ক্ষুধা কাল হইতে একটু কমিয়াছে। রাত্রে দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছেন। মনে বড় আতঙ্ক।
ডাক্তার তাঁহার বুক পেট মাথা হাত পা নাড়ী পরীক্ষা করিয়া বলিলেন—’জিব দেখি।’
নন্দবাবু জিভ বাহির করিলেন।
ডাক্তার ক্ষণকাল মুখ বাঁকাইয়া কলম ধরিলেন। প্রেসক্রিপশন লেখা শেষ হইলে নন্দর দিকে চাহিয়া বলিলেন—’আপনি এখন জিব টেনে নিতে পারেন। এই ওষুধ রোজ তিনবার খাবেন।’
নন্দ। কি রকম বুঝলেন?
তফাদার। ভেরি ব্যাড।
নন্দ সভয়ে বলিলেন—’কি হয়েছে?’
তফাদার। আরও দিন কতক ওয়াচ না করলে ঠিক বলা যায় না। তবে সন্দেহ করছি cerebral tumour with strangulated ganglia। ট্রিফাইন ক’রে মাথার খুলি ফুটো করে অস্ত্র করতে হবে, আর ঘাড় চিরে নার্ভের জট ছাড়াতে হবে। শর্ট—সার্কিট হয়ে গেছে।
নন্দ। বাঁচব তো?
তফাদার। দ’মে যাবেন না, তা হ’লে সারাতে পারব না। সাত দিন পরে ফের আসবেন। মাই ফ্রেণ্ড মেজর গোঁসাই এর সঙ্গে একটা কনসলটেশনের ব্যবস্থা করা যাবে। ভাত—ডাল বড় একটা খাবেন না। এগ—ফ্লিপ, বোনম্যারো সুপ, চিকেন—স্টু, এইসব। বিকেলে একটু বার্গণ্ডি খেতে পারেন। বরফ—জল খুব খাবেন। হ্যাঁ, বত্রিশ টাকা। থ্যাঙ্ক ইউ।
নন্দবাবু কম্পিত পদে প্রস্থান করিলেন।
সন্ধ্যাবেলা বঙ্কুবাবু বলিলেন—’আরে তখনি আমি বারণ করেছিলুম ওর কাছে যেয়ো না। ব্যাটা মেড়োর পেটে হাত বুলিয়ে খায়। এঁঃ, খুলির ওপর তুরপুন চালাবেন!’
ষষ্ঠীবাবু। আমাদের পাড়ার তারিণী কবিরাজকে দেখালে হয় না?
গুপীবাবু। না না, যদি বাস্তবিক নন্দর মাথার ভেতর ওলট—পালট হয়ে গিয়ে থাকে তবে হাতুড়ে বদ্দির কম্ম নয়। হোমিওপ্যাথিই ভাল।
নিধু। আমার কথা তো শুনবে না বাওআ। ডাক্তারি তোমার ধাতে না সয় তো একটু কোবরেজি করতে শেখ। দরওয়ানজী দিব্বি একলোটা বানিয়েছে। বল তো একটু চেয়ে আনি।
হোমিওপ্যাথিই স্থির হইল।
পরদিন খুব ভোরে নন্দবাবু নেপাল ডাক্তারের বাড়ি আসিলেন। রোগীর ভিড় এখনও আরম্ভ হয় নাই, অল্পক্ষণ পরেই তাঁর ডাক পড়িল। একটি প্রকাণ্ড ঘরের মেঝেতে ফরাশ পাতা। চারিদিকে স্তূপাকারে বহি সাজানো। বহির দেওয়ালের মধ্যে গল্পবর্ণিত শেয়ালের মত বৃদ্ধ নেপালবাবু বসিয়া আছেন। মুখে গড়গড়ার নল, ঘরটি ধোঁয়ায় ঝাপসা হইয়া গিয়াছে।
নন্দবাবু নমস্কার করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন। নেপাল ডাক্তার কটমট দৃষ্টিতে চাহিয়া বলিলেন—’বসবার জায়গা আছে।’ নন্দ বসিলেন।
নেপাল। শ্বাস উঠেছে?
নন্দ। আজ্ঞে?
নেপাল। রুগীর শেষ অবস্থা না হ’লে তো আমায় ডাকা হয় না, তাই জিজ্ঞেস করছি।
নন্দ সবিনয়ে জানালেন তিনিই রোগী।
নেপাল। অ্যালোপ্যাথ ডাকাত ব্যাটারা ছেড়ে দিলে যে বড়? তোমার