- বইয়ের নামঃ চলচ্চিন্তা
- লেখকের নামঃ রাজশেখর বসু
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭৮/১৯৫৬)
আজ* যাঁকে আমরা স্মরণ করছি, সাধারণে তাঁকে জানে তিনি চিত্রকলায় নূতন পদ্ধতির প্রবর্তন করেছেন, নূতন ধরনের রূপকথা আর রূপনাট্য লিখেছেন। কেউ কেউ আরও জানে–তিনি গাছের আঁকাবাঁকা ডাল কেটে কাটুম কুটুম নাম দিয়ে অদ্ভুত মূর্তি গড়তেন এবং চমৎকার গল্প বলতে পারতেন। অবনীন্দ্রনাথ প্রধানত নূতন চিত্রকলা আর নূতন সাহিত্যের স্রষ্টা, সুতরাং আজকের এই সভায় কোনও বিখ্যাত চিত্ররসজ্ঞ বা সাহিত্যিককে সভাপতি করাই উচিত ছিল। চিত্র সম্বন্ধে আমার কিছুমাত্র জ্ঞান নেই, সাহিত্যের জ্ঞানও নগণ্য। সভার আহ্বায়করা হয়তো স্থবির বলেই আমাকে ধরে এনেছেন। অতএব একজন সাধারণ অতিবৃদ্ধের অভিজ্ঞতা সম্বল করেই কিছু বলছি।
আমার ছেলেবেলায় অর্থাৎ প্রায় ষাট বৎসর আগে যখন অবনীন্দ্রনাথ খ্যাত হন নি তখন শিক্ষিত লোকদের বলতে শুনেছি–এদেশের আর্ট অতি কাঁচা, ভারতীয় দেবদেবীর মূর্তিতে বিস্তর গলদ। আমাদের উচিত ইটালি থেকে ভাল sculptor আনিয়ে শিব দুর্গা রাধাকৃষ্ণ ইত্যাদি দেবদেবীর মূর্তি গড়ানো এবং তার আদর্শে এদেশের মূর্তিকার আর চিত্রকারদের শিক্ষিত করা। সে সময়ে বউবাজারের আর্ট স্টুডিওর ছবি ঘরে ঘরে দেখা যেত, কিছুকাল পরে রবি বর্মার ছবি আরও জনপ্রিয় হল। সাধারণে মনে করত, যে ছবি বা বিগ্রহ ফোটোগ্রাফের মতন যথাযথ বা ইওরোপীয় পদ্ধতির অনুযায়ী তাই উৎকৃষ্ট। সেই প্রচলিত ধারণা অগ্রাহ্য করে অবনীন্দ্রনাথ চিত্ররচনায় প্রবৃত্ত হলেন। তিনি এদেশের প্রাচীন কলাশাস্ত্র অধ্যয়ন করলেন, ভারত পারস্য চীন জাপান প্রভৃতি প্রাচ্য দেশের চিরাগত পদ্ধতির বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করলেন, এবং নিজের উদ্ভাবিত নূতন পদ্ধতিতে আঁকতে লাগলেন। অসাধারণ কিছু করতে গেলেই গঞ্জনা সইতে হয়। অবনীন্দ্রনাথও নিন্দিত হলেন, তার আগে রবীন্দ্রনাথ যেমন হয়েছিলেন। ভাগ্যক্রমে কয়েকজন প্রভাবশালী গুণজ্ঞ ছিলেন, যেমন প্রবাসী-সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। তাদের চেষ্টায় অবনীন্দ্র-চিত্রাবলী ক্রমশ বহু-প্রচারিত হল। আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ হাভেল সাহেবের গ্রন্থ পড়েও শিক্ষিত সমাজ নবদৃষ্টি লাভ করলেন।
এখন আমাদের শিক্ষিত জন বুঝেছেন যে আর্টের সীমা সংকীর্ণ নয়, চিত্র আর বিগ্রহ বাস্তবের অনুযায়ী না হলেও সার্থক হতে পারে। মানুষ শুধু প্রকৃতিসৃষ্ট বাস্তব রূপে তৃপ্ত হয় না, নিজেও রূপ সৃষ্টি করতে চায়, গুণী শিল্পী প্রাকৃতিক রীতি লঙ্ঘন করেও নব নব মনোজ্ঞ রূপ উদ্ভাবন করতে পারেন। দেবমূর্তির অনেক হাত অনেক মাথা, কান পর্যন্ত টানা চোখ, ঝোলা কান, লতানে আঙুল প্রভৃতি অসভ্যতার লক্ষণ নাও হতে পারে। অশোকস্তম্ভের সিংহ, দক্ষিণ ভারতের গজবিড়াল মূর্তি প্রভৃতি অস্বাভাবিক হলেও সার্থক সৃষ্টি, যেমন মিসর দেশের স্ফিংক্স আর বিলাতের ইউনিকর্ন কল্পিত প্রাণী হলেও চিত্তাকর্ষক। এই প্রকার উদার বুদ্ধি এখন আমাদের হয়েছে।
অবনীন্দ্রনাথের শিষ্যভাগ্য অসাধারণ। নন্দলাল প্রমুখ প্রতিভাবান শিল্পীবৃন্দের চেষ্টার ফলে ভারতীয় নবচিত্রকলা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং ক্রমশ বৃদ্ধিলাভ করেছে। যেমন পাশ্চাত্ত্য দেশের তেমনি এদেশের শিল্পীরাও নব নব পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা করছেন। অবনীন্দ্রনাথ যে মার্গের সূচনা করেছিলেন তা ক্রমশ বহু শাখাপ্রশাখায় বিস্তার লাভ করছে।
অবনীন্দ্রনাথের সাহিত্যরচনা সম্বন্ধে কিছু বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি। যেমন তার চিত্রপদ্ধতি তেমনি তার রূপকথা আর রূপনাট্য বা যাত্রা পালার রচনা-পদ্ধতি একেবারে নূতন। সম্প্রতি বিখ্যাত লেখক Gerald Bulletএর একটি প্রবন্ধ পড়েছি-Facts and Fairy-Tales। তাতে তিনি বাইবেল-পাঠক সম্বন্ধে লিখেছেন–He need not believe that the stories really happened. He is free to regard them as allego ries, fables or fairy-tales, items in a sublime mythology,…just as very young children accept and enjoy fairy-tales without either believing or disbelieving them to be fact। বাইবেল-পাঠক আর very young children সম্বন্ধে বুলেট যা বলেছেন, ছোট বড় নির্বিশেষে রূপকথার সকল পাঠক সম্বন্ধেই তা খাটে। ছেলেমানুষ না হলেও রূপকথা উপভোগ করা যায়। সত্যাসত্য বিচারের দরকার হয় না, আমাদের স্বভাব-নিহিত কোনও গূঢ় কারণে সুরচিত রূপকথা তথা পুরাণকথা শুনে আমরা মুগ্ধ হই। এই মোহিনী শক্তির প্রধান সহায় বিশেষ প্রকার বর্ণনাভঙ্গী। আমাদের দেশের গল্প বলার গ্রাম্য পদ্ধতিতে সেই ভঙ্গী পাওয়া যায়। অবনীন্দ্রনাথ তার রূপকথার জন্য নূতনতর বর্ণনাভঙ্গী সৃষ্টি করেছেন, তার ফলে তার ক্ষীরের পুতুল, বুড়ো আংলা, মাসী-পিসীর গল্প, স্টীমার ভ্রমণ কথা, যাত্রার পালা প্রভৃতি অসামান্য মনোহারিতা পেয়েছে। তার মৌখিক আলাপেও এই মনোহারিতার পরিচয় পাওয়া যেত। আমাদের সৌভাগ্যক্রমে শ্ৰীযুক্তা রানী চন্দ সেই আলাপ লিপিবদ্ধ করে স্থায়ী করেছেন।
অবনীন্দ্রনাথ তার চিত্রকলার জন্য যেমন অক্ষয় কীর্তি স্থাপন করেছেন, তেমনি তার সাহিত্যরচনায় নিজের চারিত্রিক স্পর্শ এমন করে রেখে গেছেন যে পড়লেই তাঁর সান্নিধ্য অনুভব করা যায়।
[* রবীন্দ্রভারতী-ভবনে জন্মোৎসব সভায় পঠিত। ১৩ই ভাদ্র, ১৩৬৩।]
আচার্য উপাচার্য
আচার্য উপাচার্য (১৮৭৯/১৯৫৭)
কালক্রমে অনেক শব্দের মানে বদলায়। সংস্কৃত অভিধানে যেসব অর্থ পাওয়া যায় আধুনিক বাঙলা প্রয়োগে বহু ক্ষেত্রে তার অল্পাধিক পরিবর্তন হয়েছে। পাঠশালা আর বিদ্যালয় এই দুইএর মূল অর্থ একই, কিন্তু আজকাল মানে বদলে গেছে। সেই রকম–বৈদ্য ও চিকিৎসক, ঘটনা ও যোজনা, অভ্যর্থনা ও প্রার্থনা, প্রণাম ও নমস্কার। অনেক শব্দের অর্থব্যাপ্তি (connotation) পূর্ববৎ নেই, যেমন, সাহিত্যএর অর্থ প্রসারিত হয়েছে, কাব্যএর অর্থ সংকুচিত হয়েছে। ধাতু বললে সাধারণ শিক্ষিত লোকে বোঝে metal, কিন্তু কবিরাজরা প্রাচীন অর্থ অনুসারে অধিকন্তু বোঝেন হরিতাল হিঙগুল প্রভৃতি যৌগিক পদার্থ এবং রক্ত মাংস প্রভৃতি দৈহিক উপাদান।
একালের রাষ্ট্রিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থা সেকালের মতন নয়, সেজন্য অনেক শব্দের প্রাচীন অর্থ কিছু না বদলালে আমাদের আধুনিক প্রয়োজন মেটে না। কিন্তু মূল অর্থের সঙ্গে নূতন অর্থের ভাবগত বিরোধ যাতে না হয় তা দেখা দরকার। স্নাতকএর একটি প্রাচীন অর্থ– বিদ্যাশিক্ষান্তে যে ব্রহ্মচর্যসমাপ্তিসূচক স্নান করেছে। সমাবর্তন-এর অর্থ ব্রহ্মচর্যের অন্তে গৃহস্থাশ্রমে প্রবেশ। আজকাল এই দুই শব্দ গ্র্যাজুএট ও কনভোকেশন অর্থে চলছে। এতে আপত্তির কারণ কিছু নেই। কিন্তু নাচ গানের স্কুলকে বিদ্যালয় বলা গেলেও পাঠশালা বলা চলবে না, সেখানকার শিক্ষককেও গুরুমহাশয় বা অধ্যাপক বলা চলবে না।
কুলপতি শব্দের আভিধানিক অর্থ–যে বিপ্রর্ষি দশসহস্র মুনিকে প্রতিপালন ও শিক্ষাদান করেন। যেমন অক্ষৌহিণী শব্দের বিবৃতিতে ৬৫,৬১০ অশ্ব, ২১,৮৭০ গজ ইত্যাদির উল্লেখ আছে তেমনি কুলপতির বিবৃতিতে ১০,০০০ শিক্ষার্থী মুনির উল্লেখও পৌরাণিক সংখ্যান ধরা যেতে পারে। দশ সহস্র শিষ্যের মানে অনেক শিষ্য, দু-এক হাজার বা দু-পাঁচ শও হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন ও বিশ্বভারতীর কুলপতি ছিলেন– একথা বললে প্রাচীন অর্থের অপলাপ হবে মনে করি না।
মনুর বচন অনুসারে আচার্য শব্দের অর্থ–যে দ্বিজ শিষ্যকে উপনীত করে বেদাঙ্গ ও উপনিষৎ সমেত বেদ শিক্ষা দেন। আপ্তের অভিধানে আচার্যএর একটি অর্থ দেওয়া আছে–(when affixed to proper names) learned, venerable (somewhat like the Eng. Dr.) 143 সব অর্থের কালোচিত পরিবর্তন করলে রবীন্দ্রনাথের আচার্য উপাধিও সার্থক। গুরু আর আচার্য প্রায় সমার্থক, সেজন্য তাঁর গুরুদেব উপাধিও সার্থক।
রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আর বিশ্বভারতীর শুধু প্রতিষ্ঠাতা নন, বহুকাল স্বয়ং অধ্যাপনা করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত সমগ্র শিক্ষার বিধায়ক ছিলেন। এ কারণে আচার্য উপাধি সর্বতোভাবেই তার উপযুক্ত। বিশ্বভারতী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে, তার চানসেলর নেহরুজী দিল্লিতে থাকেন, কালেভদ্রে বিশেষ উপলক্ষে শান্তিনিকেতনে আসেন, প্রশাসন বা adminis tration সংক্রান্ত কয়েকটি বিষয়ে তার সম্মতি নিতে হয়। কোনও স্কুল বা কলেজের গভর্নিং বডির প্রেসিডেন্টকে আচার্য বা অধ্যাপক বললে যে দোষ হয়, বিশ্বভারতীর চানসেলরকে আচার্য বললেও সেই দোষ হয়। বিশ্বভারতী বা কলিকাতা বা অন্য কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের চানসেলরের পদে যিনি অধিষ্ঠান করেন তিনি রাষ্ট্রপতি প্রধান মন্ত্রী বা রাজ্যপাল যাই হন, তাকে আচার্য বলা নিতান্ত অসংগত। চানসেলর আর আচার্য এই দুই শব্দের অর্থগত বা ভাবগত সাদৃশ্য কিছুমাত্র নেই।
কলেজের প্রিনসিপাল অধ্যাপনাও করতে পারেন কিন্তু অধ্যাপনার উপর গুরুত্ব না দিয়ে তাকে শুধু প্রাধান্যসূচক পদবী দেওয়া হয়েছে, কারণ, তিনি অধ্যাপকবর্গের প্রধান এবং পরিচালক। প্রিনসিপালএর প্রতিশব্দ অধ্যক্ষও প্রাধান্য ও কর্তৃত্বসূচক। Concise Oxford Dictionaryতে University Chancellorএর অর্থ–titular head with Vice-c. acting, অর্থাৎ চানসেলর পদবীতে প্রধান হলেও ভাইস-চানসেলরই প্রকৃত কর্তা। চানসেলরের যা অধিকার তা প্রশাসন বা ব্যয়-অনুমোদন সংক্রান্ত, তাঁকে আচার্য বলার পক্ষে কিছুমাত্র যুক্তি নেই।
ভাইস-চানসেলরকে উপাচার্য বলা আরও আপত্তিজনক। ইংরেজী ভাইস-এর অন্ধ অনুকরণে বাঙলায় উপ-উপসর্গের প্রয়োগ একেবারে নিরর্থক। ভাইস-চানসেলর ইচ্ছা করলে অধ্যাপনা করতে পারেন, কিন্তু তার প্রকৃত কর্ম প্রশাসন বা পরিচালন। ইংরেজী নামে ভাইস উপসর্গ সত্ত্বেও তিনি কারও স্থলাভিষিক্ত বা সহকারী নন। উপাচার্য শুনলে মনে আসে assistant professor। এই উপাধি তার শুধু অযোগ্য নয়, মর্যাদাহানিকরও। বটে।
সরকারী কার্যের পরিভাষা সংকলনের জন্য কয়েক বৎসর পূর্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি সমিতি নিযুক্ত করেছিলেন।* এই সমিতির সংকলিত তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত কয়েকটি পরিভাষা আছে, যেমন–Senate অধিষদ, Syndicate নিষদ, Registrar নিবন্ধক, Vice Chancellor অধিপাল, Chancellor মহাধিপাল। (এই সংজ্ঞাগুলির রচয়িতা অধ্যাপক শ্রীযুক্ত দুর্গামোহন ভট্টাচার্য এম এ, কাব্যসাংখ্যপুরাণ তীর্থ)। কলেজের প্রধান যেমন অধ্যক্ষ, সরকারী বিভাগের ডিরেক্টর যেমন অধিকর্তা, কোনও সংঘের প্রধান নেতা বা নিয়ন্তা যেমন অধিনায়ক, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের যিনি প্রধান নিয়ন্তা তিনি অধিপাল।
একালের ভাইস-চানসেলর (বিশেষত বিশ্বভারতীর তুল্য আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের) সেকালের কুলপতিরই সমপর্যায়ের। অধিপাল উপাধিতে তার অধিনায়কত্ব ও পদোচিত গৌরব সূচিত হয়। চানসেলরকে আচার্য আখ্যা না দিয়ে মহাধিপাল বললে তারও যথোচিত মর্যাদা বজায় থাকে।
[* কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নিযুক্ত সমিতির মতন এটিরও সভাপতি ছিলেন–রাজশেখর বসু।–স:।]
আমাদের পরিচ্ছদ
আমাদের পরিচ্ছদ (১৮৭৮/১৯৫৬)
সম্প্রতি জওহরলাল নেহরু এক বক্তৃতায় বলেছেন, ইওরোপীয় পোশাকের উপর এ দেশের লোকের অত্যন্ত ঝোঁক তিনি পছন্দ করেন না। কি রকম সাজ ভারতবাসীর উপযুক্ত তা তিনি খোলসা করে বলেন নি। কয়েক বৎসর পূর্বে যখন তিনি ইংলান্ডে গিয়েছিলেন তখন কাগজে তার হ্যাট কোট টাই ট্রাউজার পরা ছবি বেরিয়েছিল। সম্প্রতি আমেরিকা ভ্রমণের ছবিতে তাঁর পরনে লংকোট টাই আর গান্ধীটুপি দেখা গেছে। ভারতবর্ষে তিনি চুড়িদার পাজামা আচকান আর গান্ধীটুপি পরে থাকেন। অতএব ধরে নিতে পারি সর্বাবস্থায় সাহেব সেজে থাকাই তার অপছন্দ; ক্ষেত্র বিশেষে বিলাতী বা দেশী-বিলাতীর মিশ্র পোশাকে তার সম্মতি আছে।
হিন্দীতে একটা প্রবাদ আছে যার মানে নিজের রুচিতে খাবে আর পরের রুচিতে পরবে। নিজের রুচিতে সাজতে গেলে বাধা পাওয়া যায় তা আমি দেখেছি। একবার দরজীকে ফরমাশ করেছিলাম–আমার যে পঞ্জাবি করবে তার বুকের উপর বাঁ দিকে একটা মামুলী পকেট হবে, আর ভিতরে ডান দিকে আর একটা পকেট হবে; বাঁ দিকের পকেট বাইরে, আর ডান দিকেরটা ভিতরে। বুঝেছ? দরজী বলল, আজ্ঞে ঠিক বুঝেছি। যখন জামা তৈরি হয়ে এল তখন দেখলাম দুটো পকেটই বাঁ দিকে, একটা বাইরে আর একটা ঠিক তার পিছনে ভিতর দিকে। বললাম, এ কি করেছ মিয়া? মিয়া উত্তর দিল, দুটো দু দিকে থাকলে যে বেপ্যাটান হবে বাবু, তা তো দস্তুর নয়। দরজী নিষ্ঠাবান লোক, দস্তুর ভঙ্গের পাতক থেকে আমাকে রক্ষার জন্য নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছিল। আর একবার পঞ্জাবির ফরমাশ দিয়েছিলাম যার বুক কোটের মতন সবটা খোলা যায়। দরজী এবারে আমার অনুরোধ রেখেছিল। কিন্তু শুভানুধ্যায়ী বন্ধুরা বলল, এ কি রকম বেয়াড়া জামা! এ যে কোটজাবি, না কোট না পঞ্জাবি, ফেলে দাও এটা। আমি ফেলি নি, দু-তিন জন আমার দেখাদেখি কোটজাবি বানিয়েছিল।
.
সমস্ত ভারতের স্ত্রীপুরুষের পরিচ্ছদের আলোচনা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য চলচ্চিন্তা নয়, কেবল বাঙালী হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কথাই বলব, প্রথমে পুরুষের, শেষে মেয়ের। পরিচ্ছদ সম্বন্ধে আমাদের রুচি তিন কারণে প্রভাবিত হয়– (১) গতানুগতিক রীতি, (২) সাময়িক ফ্যাশন হুজুক বা বিখ্যাত লোকের আদর্শ এবং (৩) স্বাস্থ্য স্বাচ্ছন্দ্য বা সুবিধার জ্ঞান। তা ছাড়া আর্থিক কারণ বা সুলভতা দুর্লভতা তো আছেই।
গতানুগতিক রীতি কালক্রমে বদলায়। আমার শৈশবে অর্থাৎ প্রায় সত্তর বৎসর আগে সাধারণ ভদ্র বাঙালীর পরিচ্ছদ ছিল ধুতি পিরান চাদর আর বিলাতী গড়নের জুতো (শু বা পম্প)। পিরানের আকার আধুনিক পঞ্জাবির মতন, কিন্তু ঝুল কম। ব্রাহ্মণ-পণ্ডিতরা পরতেন ধুতি, কোরতা বা খাটো আঙরাখা, চাদর আর চটি, অনেক সময় শুধু ধুতি চাদর চটি। কোরতায় বোতামের বদলে ফিতা থাকত, ঝুল কোমর পর্যন্ত। খাটো আঙরাখার গড়ন চাপকানের মতন কিন্তু ঝুল নিতম্ব পর্যন্ত। কীর্তন-গায়করা এখনও কোরতা পরে থাকেন। গেঞ্জির চলন ৬০৭০ বৎসর আগে হয়। সেকালে নাম ছিল। গেঞ্জিফ্রক। ইংলান্ড আর ফ্রান্সের মাঝে যেসব দ্বীপ আছে তার একটার নাম। Guernsey আর একটার Jersey। তা থেকেই জামার নাম গেঞ্জি আর জার্সি হয়েছে।
বিলাতফেরতরা তখন সর্বদা সাহেবী পোশাক পরতেন, সুরেন বাড়জ্যে এবং আরও দু-চার জন ছাড়া। উকিল ডেপুটি সবজজ আর বড় কর্মচারীরা ইজার চাপকানের উপর চোগা বা পাকানো চাদর পরতেন, মাথায় শামলা বা পিরালী পাগড়ি দিতেন। রবীন্দ্রনাথের চোখের বালিতে আছে, মহেন্দ্র চাপকান পরে মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়তে যেত। শীতকালে অবশ্য সকলেরই পোশাকের পরিবর্তন হত, মধ্যবিত্তরা ধুতির উপর গরম কোট এবং র্যাপার বা শাল পরতেন। অল্প কয়েক জন অতি সেকেলে লোক পারসী কোট (ঝুল প্রায় হাঁটু পর্যন্ত) আর চায়না কোট (গলায় কলার নেই, ঢিলা গড়ন) পরতেন।
প্রায় ষাট বৎসর আগে অল্পবয়স্কদের মধ্যে পিরানের বদলে শার্টের প্রচলন হল। শার্টের উপর চাদর বা উড়নি ইচ্ছাধীন, কিন্তু কলকাতার যুবসমাজে কোটের উপর চাদর পরা বাঙাল বা খোট্টা-বাঙালীর লক্ষণ গণ্য হত। ক্রমশ শিক্ষিত লোকের অনেকের হুঁশ হল, শার্ট হচ্ছে সাহেবদের অন্তরীয়, কোটের নীচে পরবার। তখন তার বদলে এল পঞ্জাবি, অর্থাৎ বেশী ঝুলওয়ালা পিরান। সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালীর সাজ নিরূপিত হয়ে গেল– ধুতি আর পঞ্জাবি, তার উপর চাদর ইচ্ছাধীন। ধুতি-চাদর আমাদের বহু প্রাচীন পরিধেয়, কিন্তু পঞ্জাবি নামেই বোঝা যায় এটি খাঁটি বাঙলা দেশের জিনিস নয়। পিরান শার্ট আর পঞ্জাব অঞ্চলের আজানুলম্বিত কমীজ-এর মিশ্রণে পঞ্জাবি নামক জামার উৎপত্তি হয়েছে। ১৯২০-৩০ নাগাদ চাপকান চোগা শামলা পাগড়ি লোপ পেতে লাগল এবং সাহেবী সাজই সম্ভ্রান্ত পোশাক গণ্য হল, কিন্তু হ্যাট বহুপ্রচলিত হয় নি।
কাপড়ের দাম ক্রমশ বেড়ে যাওয়ার ফলে বালক আর কিশোরদের মধ্যে হাফপ্যান্টের ব্যাপক প্রচলন হয়েছে। ধুতি পরা ছোট ছেলে এখন আর প্রায় দেখা যায় না, মেয়েরাও কিশোর বয়স পর্যন্ত ফ্রক পরে। যুবা আর প্রৌঢ়দের মধ্যে ধুতির বদলে পাজামা ইজার বা প্যান্টের প্রচলন ক্রমশ বাড়ছে। স্বাধীনতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের স্বদেশী রুচি লুপ্তপ্রায় হয়েছে, এখন হরেক রকম ইজার প্যান্ট শার্ট আর শার্ট-কোটের খিচুড়ি চলছে, অদূর ভবিষ্যতে বাঙালীর জাতীয় পরিচ্ছদ কি দাঁড়াবে বলা অসম্ভব।
.
গত সত্তর বৎসরে আমাদের পরিচ্ছদের যে ক্রমিক পরিবর্তন হয়েছে তার একটি কারণ নকল, ফ্যাশন বা হুজুক, অন্য কারণ ধুতির মূল্যবৃদ্ধি। কি রকম পরিচ্ছদ আমাদের উপযুক্ত তা নূতন করে বিচারের পূর্বে কতকগুলি বিষয় মেনে নেওয়া যেতে পারে। যথা
(১) সর্বাবস্থায় একই রকম পরিচ্ছদ চলতে পারে না, কর্মভেদে এবং ঋতুভেদে বেশের পরিবর্তন হবেই।
(২) ভারতের সকল প্রদেশের আবহাওয়া সমান নয়, সে কারণে পরিচ্ছদও সমান হতে পারে না। তথাপি সর্বভারতীয় মিলনের ক্ষেত্রে কিছু সাম্য থাকা বাঞ্ছনীয়।
(৩) ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন জাতির পরিচ্ছদে খুব মিল আছে। ইংরেজী যেমন বিশ্বরাজনীতির ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইওরোপীয় পোশাকও তেমনি সর্বজাতির ভব্য পরিচ্ছদ হয়ে পড়েছে। ভারতবাসী যদি ইওরোপীয় পোশাক অল্পাধিক গ্রহণ করে তবে আপত্তির কারণ নেই। অবশ্য ইওরোপীয় পোশাকের সবটাই স্বাস্থ্যের অনুকূল আর সুবিধাজনক নয়, অনাবশ্যক উপকরণও তাতে আছে (যেমন নেকটাই), সে কারণে কিছু কিছু সংস্কার হওয়া উচিত।
ফ্যাশন অগ্রাহ্য করে শুধু স্বাস্থ্য আর সুবিধার প্রতি দৃষ্টি রেখে যদি বাঙালীর পরিধেয় নির্ধারণ করা যায় তবে তা কি রকম হবে? অনেক কাল আগে একজন মান্যগণ্য ইংরেজ (নাম মনে নেই) কয়েক বৎসর বাঙলা দেশে বাস করে বিলাতে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন–We are baked for four months, boiled for four months and allowed to cool for four months। এই বিবরণে অত্যুক্তি আছে, কিন্তু এ কথা ঠিক যে আমাদের মাতৃভূমি গ্রীষ্মকালে সর্বদা মলয়জশীতলা থাকে না, গুমট আর ভেপসা গরম দুইই আমাদের ভোগ করতে হয়। এ দেশের বাতাস পশ্চিম ভারতের মতন শুখনো নয়, সেজন্য তাপ প্রবল না হলেও ঘাম বেশী হয়। এখানে বসন্ত থেকে শরৎ পর্যন্ত প্রায় সাত মাস অল্পাধিক গরম, শীত ঋতুও মৃদু ও অল্পস্থায়ী। অতএব আমাদের পরিধেয় প্রধানত আর্দোষ্ণ (humid and hot) বায়ুর উপযুক্ত হওয়া উচিত। অবশ্য শীতকালে পরিবর্তন করতে হবে।
আরব দেশের লোক গ্রীষ্মের তাপ রোধের জন্য সাদা কাপড়ের চোগা পরে, পুরুষরাও সাদা ঘোমটা দিয়ে মাথা আর মুখের দু পাশ ঢাকে। আমাদের দেশে গ্রীষ্মের দু-এক মাস খালি গায়ে আর খালি মাথায় বাইরে গেলে তাতের জন্য কষ্ট হয়, ছাতা বা আর কিছু দিয়ে মাথা ঢাকতে হয়। কিন্তু পূর্বোক্ত সাত মাসের বাকী সময় বাতাস আদ্রোষ্ণ থাকে, তখন অল্প পরিচ্ছদই স্বাস্থ্যকর। ইওরোপীয় পুরুষ খালি গায়ে মোটরে চলেছে এই দৃশ্য এখন কলকাতায় বিরল নয়। আমাদের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের অনেকে সেকালে যা পরতেন এবং এখনও যা পরেন–ধুতি চাদর আর চটি–এই হলেই যথেষ্ট। তাত অথবা অল্প ঠাণ্ডার সময় চাদর দিয়ে গা ঢাকা যেতে পারে, ভেপসা গরমে চাদর কাঁধে রেখে গায়ে হাওয়া লাগানো যেতে পারে। কিন্তু মানুষের রুচি সকল ক্ষেত্রে যুক্তির বশে চলে না। ভারত সরকার আমাদের জীবনযাত্রার মান বাড়াবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন, আমাদের ভব্যতার ধারণাও বদলাচ্ছে, আগে যা বিলাস গণ্য হত এখন তা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। শুধু ধুতি চাদর চটি এখন অচল, আমাদের গলা থেকে পা পর্যন্ত সবই ঢাকতে হবে।
ধুতির অনেক গুণ। সেলাই করতে হয় না, সহজে পরা যায়, সহজে খোলা যায়, গায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে না, হাওয়া লাগতে দেয়, নিত্য কাঁচা যায়, ইস্তিরি না করলেও চলে। ধুতি শব্দের মূল রূপ ধৌতি, অর্থাৎ যা নিত্য ধৌত করতে হয়। আধুনিক ভদ্র বাঙালী যেভাবে ধুতি পরে তা নির্দোষ নয়। সামনে এক গোছা কোঁচা নিরর্থক, তাতে শুধু বোঝা বাড়ায় আর হাওয়া আটকায়। প্রমাণ ধুতি যদি দশ হাতের বদলে আট হাত করা হয় তবে লজ্জা নিবারণে কিছুমাত্র বাধা হয় না, শরীরে বেশী হাওয়া লাগে, কাপড়ের ওজন ১/৫ ভাগ কমে, দামও কমে।
বাঙালীর কোঁচা একটা সমস্যা, পথে চলবার সময় অনেকেই বাঁ হাতে কোঁচার নিম্নভাগ ধরে থাকে। সেকালের ভারতীয় সুন্দরীদের হাতে লীলাকমল থাকত, মধ্যযুগের রাজাবাদশাদের হাতে গোলাপ ফুল বা শিকারী বাজপাখী থাকত, ভিকটোরীয় যুগের বিলাসিনীদের হাতে flirting fan থাকত। মানবজাতির কাণ্ডজ্ঞান বৃদ্ধি পাওয়ায় ওসব অনাবশ্যক প্রথা লোপ পেয়েছে। বর্তমান কর্মময় যুগে পথচারী বাঙালী কোঁচার দায়ে এক হাত পঙ্গু করেছে এই দৃশ্য অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। কেঁচার নীচের অংশটা কোমরে খুঁজলে ক্ষতি কি?
শৌখিন ধনী বাঙালী যাঁরা সাধারণত ইওরোপীয় পরিচ্ছদ ধারণ করেন তাঁরাও বিবাহ শ্ৰাদ্ধ ইত্যাদির সভায় ধুতি পরে আসেন। অনেকের পরনে আভিজাত্যসূচক ৫২ ইঞ্চি বা আরও বেশী বহরের সূক্ষ্ম ধুতি থাকে, হাঁটবার সময় কেঁচার স্তবকতুল্য নিম্নভাগ মাটিতে লুটয়। চণ্ডীদাসের নায়িকা যেমন নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি চলত, শৌখিন বাঙালী নাগরিক তেমনি কেঁচাটি লুটিয়ে ঝেটিয়ে ঝেটিয়ে চলে। একজন সুপরিচিত ভদ্রলোককে বলেছিলাম –মাটিতে যত ময়লা আছে সবই যে কেঁচায় লাগছে! উত্তর দিলেন, লাগুক গে, কালই তো লনড্রিতে যাবে।
আজকাল অনেকের পরনে যে পাতলা কাপড়ের পায়জামা বা ইজার দেখা যায় তা নানা বিষয়ে ধুতির চাইতে শ্রেষ্ঠ। ওজন কম, দামও ধুতির কাছাকাছি, কোঁচার বালাই নেই। যাদের দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়–যেমন ডাক্তার বিজ্ঞানী যন্ত্রী ইত্যাদি–তাদের পক্ষে ধুতির চাইতে পাজামা বা ইজার সুবিধাজনক।
সম্প্রতি মোটা কাপড়ের প্যান্ট বা ট্রাউজারের খুব চলন হয়েছে। শুনতে পাই, স্মার্টনেসের লক্ষণ হচ্ছে ঘোর রঙের প্যান্টের উপর সাদা বা ফিকা রঙের শার্ট। শার্ট পুরো হাতা হওয়া চাই, কিন্তু কনুই পর্যন্ত আস্তিন গোটানো থাকবে। গরিব গৃহস্থকেও ছেলের শখ মেটাবার জন্য দামী কাপড়ের প্যান্ট শার্ট যোগাতে হয়।
অনেককে বলতে শুনেছি–ড্রিল কর্ডরয় প্রভৃতি মোটা রঙিন কাপড়ের প্যান্ট মোটের উপর ধুতির চাইতে সস্তা। কারণ, ময়লা হলে সহজে ধরা যায় না, কাচতে হয় না, বার বার ধোবার বাড়ি দিতে হয় না, সহজে ছেড়ে না, বহু কাল পরা চলে। এই যুক্তিতে ফাঁকি আছে। ধুতি যদি সাদা না হয়ে বাদামী খাকী বা ছাই রঙের হত, এবং রোজ কাঁচা না হত, তবে তাও দীর্ঘস্থায়ী হত। দোষ আমাদের প্রথার বা ফ্যাশনের, ধুতির নয়। ধুতি সাদা হওয়া চাই, রোজ কেচে শুদ্ধ করা চাই, কিন্তু মোটা রঙিন প্যান্ট কাঁচা হয় না, যত দিন তার মলিনতা চোখে দেখা না যায় তত দিন তার বাহ্যাভ্যন্তর শুচি।
পরিধেয় বস্ত্রে দুরকম ময়লা লাগে–দেহের ক্লেদ (ঘাম, তেল ইত্যাদি), এবং বাইরের বিশেষত বাতাসের ধুলো আর ধোঁয়া। শুকনো কাপড়ের চাইতে ভিজে কাপড়ে বাতাসের ময়লা বেশী লাগে। কাচা কাপড় যখন ভিজে অবস্থায় শুখখাতে দেওয়া হয় তখন বাতাসের ধুলো আর ধোঁয়া তাতে আটকে যায়। এই কারণে প্রতিবার কাচার পর কাপড়ের মলিনতা বাড়ে, গাত্রজ মল দূর হলেও বায়ুস্থিত মল ক্রমশ জমা হতে থাকে। শহরের বাইরে কাপড় শীঘ্র ময়লা হয় না, কারণ সেখানে ধুলো ধোঁয়া কম। আমাদের চিরাগত প্রথা–ধুতি শাড়ি প্রত্যহ কেচে শুদ্ধ করে নিতে হবে। বার বার কাচার ফলে কাপড় জীর্ণ হয়, ধুলো-ধোঁয়ায় ময়লা হয়–এই অসুবিধা আমরা মেনে নিয়েছি। কিন্তু মোটা প্যান্টের বেলায় আমাদের ধারণা অন্য রকম। দেহের ময়লা প্যান্টেও লাগে, প্রতিবার প্রস্রাবের সময় তাও দু-চার ফোঁটা লাগে, কিন্তু এ সব গ্রাহ্য করা হয় না।
অতএব দেহজ মল আর বায়ুজ মল দুয়ের মধ্যে একটাকে আমাদের মেনে নিতে হবে কিংবা রফা করতে হবে। মোটা প্যান্ট নিত্য কাচা অসম্ভব, কিন্তু পাতলা পাজামা বা ইজার যদি মাঝে মাঝে কাচা হয় তবে কতকটা ধুতির তুল্য শুদ্ধ হতে পারে। মোটা প্যান্ট পরা ফ্যাশন-সম্মত হলেও যুক্তিসংগত নয়, অন্তত গরমের সময় নয়। সব দিক দিয়ে বিচার করলে আমাদের নিত্য পরিধানের জন্য পাতলা কাপড়ের পাজামা বা ইজার বা আট-হাতি ধুতি প্রশস্ত।
ধুতি আর পাজামার যে গুণ, পঞ্জাবিরও তা আছে, গায়ে লেপটে থাকে না, হাওয়া লাগতে দেয়। ভিতরে গেঞ্জি বা ফতুয়া পরলে পঞ্জাবি নিত্য কাচতে হয় না, ভিতরের জামা কাচলেই চলে। পঞ্জাবির ঝুল নিতম্ব পর্যন্ত হওয়াই ভাল, বেশী হলে অনর্থক বায়ুরোধ আর তাপবৃদ্ধি করে। পাতলা কাপড়ের কোট (বা কোট তুল্য পঞ্জাবি) আরও ভাল, কারণ সহজেই পরা আর খোলা যায়, বেশী ঢিলা করবার দরকার হয় না।
ব্রিটিশ রাজত্বে আমাদের দরবারী পোশাক ছিল ইজার চাপকান চোগা আর শামলা বা পাগড়ি, সাহেব আর ইঙ্গ-বঙ্গের পক্ষে ড্রেস সুট। বর্তমান ভারত সরকার কর্তৃক বিহিত দরবারী পোশাক সাদা চুড়িদার পাজামা আর আচকান। দুটোই আপত্তিজনক। চুড়িদার পাজামা পায়ের সঙ্গে লেপটে থাকে, পরতে আর খুলতে মেহনত হয়। আজানুলম্বিত আচকান পরলে অনর্থক কাপড়ের বোঝা বইতে হয়। ঠাণ্ডায় অসুবিধা না হতে পারে, কিন্তু গরমের সময় বায়ুরোধ করে। শ্রীরাজাগোপালাচারীর মতন ধুতি পঞ্জাবি অথবা বিভিন্ন প্রদেশে যে ভব্য পরিচ্ছদ প্রচলিত আছে তাই দরবারী পোশাক গণ্য হবে না কেন?
কনভোকেশনের সময় গ্রাজুয়েটদের যে পোশাক পরতে বাধ্য করা হয়–কালো বা রঙিন কাপড়ের জোব্বা আর মাথায় থোপনা দেওয়া স্লেট–তা সার্বজাতিক হতে পারে, কিন্তু যেমন বিশ্রী তেমনি জবড়জঙ্গ। কয়েক বৎসর আগে শান্তিনিকেতনে উৎসবাদি উপলক্ষে অধ্যাপকদের বিহিত পরিচ্ছদ ছিল ধুতি-পঞ্জাবির উপর বাসন্তী রঙের উত্তরীয়। এখনও সেই প্রথা আছে কিনা জানি না। সেই রকম সুলভ শোভন পরিচ্ছদ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রবর্তন করতে পারে।
সাধারণত বাঙালী মাথা ঢাকে না। প্রায় চল্লিশ বৎসর আগে কলকাতার একটি বিলাতী কম্পানি বাঙালীর জন্য বিশেষ এক রকম টুপি চালাবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু একটাও বেচতে পারে নি। মহাত্মা গান্ধী যেসব বস্তু উদ্ভাবন করেছেন তার মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ বস্তু গান্ধীটুপি। সস্তা, হালকা, সহজে কাঁচা যায়, ঠাণ্ডা আর রোদ থেকে কতকটা মাথা বাঁচায়, টাক ঢাকে। গৈরিকধারীকে দেখলে যেমন মনে হয় লোকটি সাধু ধর্মাত্মা তেমনি গান্ধীটুপিধারীকে মনে হয় কংগ্রেসকর্মী বা দেশসেবক। যেসব রাজনীতিক সভায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোক একত্র হয় সেখানে বাঙালী গান্ধীটুপির প্রভাবে সহজেই দলে মিশে যেতে পারে, তাকে হংস মধ্যে বক মনে হয় না। কিন্তু যেখানে রোদ থেকে মাথা বাঁচানোই উদ্দেশ্য সেখানে হ্যাটই শ্রেষ্ঠ শিরস্ত্রাণ। বহুকাল পূর্বে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় মহাশয় প্রবাসীতে লিখেছিলেন, রোদের সময় ধুতির সঙ্গে হ্যাট পরা যেতে পারে। পুলিসের শিরস্ত্রাণ যদি লাল পাগড়ির বদলে সোলা-হ্যাট করা হয় তবে ওজন কমবে, দামও বাড়বে না, মাথা গরম হবে না, অন্তত বাঙালী কনস্টেবলরা খুশী হবে। এ দেশের সোলা-হ্যাট-শিল্প লোপ পেতে বসেছে, কারণ বিলাতে এখন তার আদর নেই। পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি পুলিসের জন্য সোলা-হ্যাটের প্রবর্তন করেন তবে অনেকের উপকার হবে।
.
কালিদাস নারীর অশিক্ষিতপটুত্বের উল্লেখ করেছেন। তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন বঙ্গনারীর পরিচ্ছদ। বাঙালী পুরুষ অনুকরণে পটু, এককালে মোগলাই সাজের নকল করেছিল, তার পর ইওরোপীয় পোশাকও নিয়েছে। কিন্তু বাঙালী মেয়ে তার স্বাতন্ত্র্য হারায় নি। কবিকঙ্কণ চণ্ডীর যুগে সে কাছা দিয়ে শাড়ি পরত, কবি হেমচন্দ্রের আমলে লাজে অবনতমুখী তনুখানি আবরি জুজুবুড়ী সেজে থাকত। কিন্তু আধুনিকা বাঙালিনী সুপর্ণা বিহঙ্গীর ন্যায় শোভনচ্ছদা হয়েছে, চিরন্তন পরিচ্ছদ বজায় রেখেও স্বাস্থ্যের অনুকূল সুরুচিসম্মত সুদৃশ্য সজ্জা উদ্ভাবন করেছে। দেশে বিদেশে শাড়ি অজস্র প্রশংসা পেয়েছে। যেসব ভারত-ললনা আঠারো-হাতি শাড়ি কাছা দিয়ে পরে এবং যারা সালোআর-কমীজ-দোপাট্টায় অভ্যস্ত তারাও ক্রমশ বাঙালিনীর অনুসরণ করছে।
কিন্তু একটা কথা ভাববার আছে। শাড়ি-ব্লাউজ ঘরে বাইরে সুশোভন পরিচ্ছদ, কিন্তু আজকাল অনেক মেয়ে শিক্ষা বা জীবিকার জন্য যে ধরনের কাজ করে তার পক্ষে শাড়ি সকল ক্ষেত্রে উপযুক্ত নাও হতে পারে। যান্ত্রিক বৈজ্ঞানিক আর চিকিৎসা সংক্রান্ত কাজে শাড়ির আঁচল একটা বাধা, বিপদের কারণও হতে পারে। সুবিধা আর নিরাপত্তার জন্য বোধ হয় ক্ষেত্র বিশেষে শাড়ির বদলে স্কার্ট বা স্ন্যাস জাতীয় পরিধেয়ই বেশী উপযুক্ত।
আমিষ নিরামিষ
আমিষ নিরামিষ (১৮৭৯/১৯৫৭)
মথুর মুখুজ্যে সকালবেলা পার্কে বেড়াচ্ছিলেন, হঠাৎ তাঁর বাল্যবন্ধু অঘোর দত্তর সঙ্গে অনেক দিন পরে দেখা হয়ে গেল। দুজনে একটা বেঞ্চিতে বসলেন। মথুরবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, তার পর, আছ কেমন? বয়স কত হল?
অঘোর দত্ত বললেন, ভাল মন্দ মিশিয়ে আছি, নালিশ করবার কিছু নেই। বয়স প্রায় আটাত্তর হল।
মথুর। আমার পঁচাত্তর, কিন্তু ভাল নই দাদা। বাত হাঁপানি ডিসপেপসিয়া, নানানখানা। আচ্ছা তুমি তো নিরামিষ খাও। কত দিন খাচ্ছ?
অঘোর। তা ষাট-পঁয়ষট্টি বৎসর, ছেলেবেলা থেকেই।
মথুর। বল কি হে! সেই জন্যই এখন পর্যন্ত বেশ আছ। আমিও ভাবছি মাছ মাংস ছেড়ে দেব। আর কেন, ঢের খেয়েছি, শেষ বয়সে সাত্ত্বিক আহারই ভাল। নিরামিষভোজীরা দীর্ঘজীবী হয়, আনি বেসান্ট, বার্নার্ড শ, গান্ধীজী
অঘোর। ভুল করলে ভাই। আমিষ খেয়েও বিস্তর লোক আশি পেরিয়ে বেঁচে আছেন, যেমন চার্চিল, ফজলুল হক, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ। যোগেশ বিদ্যানিধি মশাই তো ছেয়ানব্বই পার হয়ে বার্নার্ড শকেও হারিয়ে দিয়েছেন।
এমন সময় ফণী মল্লিক এসে পড়লেন। এঁর বয়স প্রায় ষাট, বহু কাল আগে একবার বিলাত গিয়েছিলেন, তার লক্ষণ সাজে আর চালচলনে এখনও কিছু দেখা যায়। মথুরবাবু বললেন, আসতে আজ্ঞা হক মল্লিক সায়েব, বসুন এইখানে। এই অঘোর দত্তকে চেনেন তো? অদ্ভুত মানুষ, পঁয়ষট্টি বৎসর নিরামিষ খেয়ে বেঁচে আছেন। আচ্ছা মল্লিক মশাই, আপনি তো বিচক্ষণ জ্ঞানী লোক, আমিষ নিরামিষ আহার সম্বন্ধে আপনার মত কি?
ফণী মল্লিক বললেন, প্রচুর আমিষ খাওয়া উচিত, আমিষের অভাবেই হিন্দু জাতির অধঃপতন হয়েছে।
মথুর। আচ্ছা অঘোর, তোমার তো কোনও কালেই ধর্মে তেমন মতি দেখি নি। তবে মাছ মাংস খাও না কি কারণে?
অঘোর। যে কারণে তুমি সাপ ব্যাঙ খাও না।
মথুর। ও একটা বাজে কথা। যদি বলতে অহিংসার জন্য বা স্বাস্থ্যের জন্য খাও না, কিংবা শাস্ত্রমতে প্রশস্ত নয় তাই খাও না তা হলে বুঝতাম।
অঘোর। আমরা যা করি সব কিছুরই কি কারণ বলা যায়? যা বলেছি। তার সোজা অর্থ–তোমার যেমন সাপ ব্যাঙে রুচি হয় না আমার তেমনি মাছ মাংসে হয় না। যদি জেরা কর কেন রুচি হয় না, তবে ঠিক উত্তর দিতে পারব না। হয়তো পাকযন্ত্রের গড়ন এমন যে আমিষ সয় না কিংবা পুষ্টির জন্য দরকার হয় না। হয়তো ছেলেবেলায় এমন পরিবেশে ছিলাম বা এমন কিছু দেখেছিলাম শুনেছিলাম বা পড়েছিলাম যার প্রভাব স্থায়ী হয়ে আছে। যদি নিরামিষ সহ্য না হত তবে নিশ্চয় আমিষ ধরতাম, যেমন অক্ষয়কুমার দত্ত শেষ বয়সে রোগে পড়ে ধরেছিলেন। আমি কিন্তু পুরোপুরি ভেজিটেরিয়ন নই। দুধ খাই, যা হচ্ছে খাঁটী গোরস, আর মাঝে মাঝে চিকিৎসার জন্য জান্তব ঔষধও খেতে বা ইনজেকশন নিতে হয়েছে।*
ফণী মল্লিক সহাস্যে বললেন, হ্, এইবার পথে আসুন। এক মার্কিন ভদ্রলোক এচ জি ওয়েল্সকে বলেছিলেন, আপনাদের বার্নার্ড শ একজন ক্ষণজন্মা জ্ঞানী সাধুপুরুষ, নিরামিষ খেয়েই এই বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত মস্তিষ্ক চালনা করছেন। ওয়েল্স হেসে বললেন, নিরামিষ না ছাই। দুধ খাচ্ছেন, চীজ খাচ্ছেন, ডিম খাচ্ছেন, আবার প্রতিদিন লিভার এক্সট্রাক্ট ইনজেকশন নিচ্ছেন, যা হল রক্তমাংসের সারাৎসার। শুনুন মথুরবাবু, মাছ মাংস ডিম খেলে যত সহজে পুষ্টি আর শক্তিলাভ হয়, তেমন আর কিছুতে হয় না। জনকতক ভাত ডাল শাগ তরকারি খেয়ে দীর্ঘজীবী হতে পারে, কিন্তু অ্যাভারেজ লোকের পক্ষে আমিষ বর্জন অনিষ্টকর। যার প্রচুর দুধ ক্ষীর ছানা খাবার সামর্থ্য আছে তার হয়তো চলে যেতে পারে, কিন্তু সকলের পক্ষে আর সকল জায়গায় তা সুলভ নয়।
মথুর। কিন্তু শুনেছি মাংস খেলে হিংসাবৃত্তি প্রবল হয়। এই দেখুন না, এদেশে যারা মাংসখোর তারাই দাঙ্গাবাজ আর একটুতে ছোরা মারে।
ফণী। মারবেই তো, অন্য পক্ষ যে নিস্তেজ ভীরু। মুখুজ্যে মশাই, আমাদের যে মাইল্ড হিন্দু বলে খ্যাতি আছে তা মোটেই গৌরবের নয়। আমাদের একটু উগ্র হওয়া দরকার। ভারতীয় আর্যজাতির ইতিহাস দেখুন। রাম লক্ষ্মণ সীতা বনে গিয়ে মাংস খেয়েই জীবনধারণ করতেন। চিত্রকূট আর দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে চাল ডাল আটা পাবেন কোথা? পেলে অবশ্য ফলমূলও খেতেন, কিন্তু সেটা তাদের প্রধান খাদ্য ছিল না, শুধু ভাইটামিন-সিএর জন্য খেতেন। বনবাসী পাণ্ডবরাও তাই করতেন। তারা এত হরিণ মারতেন যে সেখানকার ঋষিরা তাদের অন্যত্র চলে যেতে বলেছিলেন। আমাদের মাংসাশী পূর্বপুরুষরা তেজস্বী মহাবীর যুদ্ধবিশারদ ছিলেন, আবার বেদ-বেদান্তও রচনা করেছেন। তাদের বংশধররা বৌদ্ধ আর জৈনদের নকলে নিরামিষভোজী হয়েই অধঃপাতে গেছে।
মথুর। অঘোর, তুমি কি বল? মাংসাহার আসুরিক নয় কি? তাতে কাম ক্রোধ লোভাদি রিপু আর হিংস্রতা প্রবল হয় না কি?
অঘোর। ঠিক বলতে পারি না। নিরামিষাশী গণ্ডার মোষ আর ষাঁড়ের ক্রোধ নেহাত কম নয়। বাঁদর আর ছাগলের প্রথম রিপু বাঘ সিংগির চাইতে প্রবল। শুনেছি হিটলার নিরামিষ খেতেন, কিন্তু অহিংস হতে পারেন নি। আমিষাশী লোকের তুলনায় নিরামিষাশীর সংযম হয়তো মোটের উপর কিছু বেশী, কিন্তু তার কোনও নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। চুরি জুয়াচুরি ভেজাল কালোবাজার লাম্পট্য ইত্যাদি নানারকম দুষ্কর্ম আমাদের দেশের নিরামিষ খোরদের মধ্যে কিছুমাত্র কম নয়। এদেশের অনেক লোক গরুকে মাতৃজ্ঞান করে, বাঁদরকে ভ্রাতৃজ্ঞান করে, কিন্তু গোখাদক শিকারপ্রিয় পাশ্চাত্ত্য জাতিদের তুলনায় আমাদের জন্তুপ্রীতি মোটের উপর কম। নিরামিষ ভোজন বেশী হিতকর কি না তার পরীক্ষা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে এ পর্যন্ত হয় নি। যদি শ-খানিক শিশুকে একই পরিবেশে প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত রাখা হয় এবং তাদের পঞ্চাশ জনকে আমিষ আর পঞ্চাশ জনকে নিরামিষ খাওয়ানো হয় তবে তাদের স্বাস্থ্য আর চরিত্রের গড়পড়তা প্রভেদ দেখে খাদ্যের গুণাগুণ বিচার করা যেতে পারে। তবে এ কথা ঠিক যে আধুনিক খাদ্য-বিজ্ঞানীরা বেশী মাংস খাওয়ার নিন্দা করেন, আমিষ-নিরামিষ মিশ্রিত খাদ্যই ভাল মনে করেন।
ফণী। আমিও মানি যে মিশ্রিত আহারই ভাল। কিন্তু খাদ্যবিজ্ঞানীরা শুধু বেশী মাংস খাওয়ার নিন্দা করেন না, অতিরিক্ত স্টার্চ মিষ্টান্ন আর তেল ঘিও অনিষ্টকর বলেন। আমরা বাঙালীরা যা খাই তাতে মাছ মাংসের মাত্রা নিতান্তই কম। এদেশে নদীবহুল অঞ্চল আর সমুদ্রের উপকূলে বিস্তর মাছ পাওয়া যায়, সেই বিধিদত্ত খাদ্য না খাওয়া ঘোরতর বোকামি। মাছ পাঠা মটন ডিম আমাদের নিষিদ্ধ খাদ্য নয়, মুরগিও জাতে উঠেছে, আজকাল পোর্ক আর বীফেও অনেকের আপত্তি নেই। এখন দরকার যেমন করে হক আহারে আমিষের মাত্রা বাড়ানো। আমরা যদি আহার বিষয়ে পাশ্চাত্ত্য জাতিদের সমান না হই তবে জীবনযুদ্ধে পিছিয়ে যাব। কূপমণ্ডুক হয়ে সনাতন বিধিনিষেধের মধ্যে আবদ্ধ থাকার দিন চলে গেছে। আমাদের এখন নানা উপলক্ষে দেশবিদেশে যেতে হয়, এ খাব না ও খাব না বলে আবদার করলে চলবে না। সভ্য মানুষের পোশাক যেমন প্রায় এক ধরনের হয়ে পড়ছে, সভ্য মানুষের খাদ্যও তেমনি ইউনিভর্সাল হওয়া দরকার। অঘোরবাবু যে সাপ ব্যাঙের সঙ্গে তুলনা দিয়েছেন তা অত্যন্ত কুযুক্তি। সাপ ব্যাঙে রুচি না হবারই কথা, কিন্তু সভ্য লোকে সর্ব দেশে যা খায় তার উপর ঘৃণা থাকা সুরুচির পরিচয় নয়।
অঘোর। সাপ ব্যাঙ শুওর গরু ছাগল ভেড়া কোনওটার উপর আমার ঘৃণা নেই, সবাই কৃষ্ণের জীব। সায়েবদের যেমন কাঁঠাল কয়েতবেল আর টোপাকুলের গন্ধ সয় না, আমারও তেমনি আমিষের গন্ধ সয় না। নিজে খাই না, কিন্তু যারা খায় তাদের রুচির নিন্দা করি না। মল্লিক মশাই, আপনি রামায়ণ মহাভারত থেকে উদাহরণ দিয়েছেন। দয়া করে আর একটু পশ্চাতে দৃষ্টিনিক্ষেপ করুন। আমাদের পূর্বপুরুষ অতি প্রাচীন মানবজাতি কি খেয়ে জীবনধারণ করত? যখন পশুপালন আর কৃষিকর্ম জানা ছিল না তখন মানুষ শুধু শিকার করা জন্তু নয়, সাপ ব্যাঙ ইঁদুর টিকটিকি শামুক গুগলি ফড়িং পোকা, মায় নরমাংস, যা জুটত তাই খেত। পাওয়া গেলে ফলমূলও খেত, কিন্তু এই বৈজ্ঞানিক সত্য মানতে হবে যে প্রায় সকল প্রাণীই মানুষের ভক্ষ্য হতে পারে, কিন্তু সকল উদ্ভিদ নয়। পশুপক্ষিপালন শেখার পর মানুষ পালিত জন্তুর মাংস দুধ ডিম খেতে শুরু করল। তার পর কৃষির প্রচলন হলে নানারকম শস্য উৎপন্ন হতে লাগল, খাদ্যের বৈচিত্র্য বেড়ে গেল। মানুষের রুচি কালে কালে বদলায়, এক শ বছর আগে আমরা যা খেতাম এখন ঠিক তা খাই না। মোট কথা, আমাদের অতি প্রাচীন পূর্বপুরুষদের সাপ ব্যাঙ পোকামাকড়ে বিলক্ষণ রুচি ছিল, তার পর ক্রমশ রুচি বদলেছে, আধুনিক সভ্য মানুষ নানা রকম আমিষ নিরামিষ খেতে শিখেছে, সেকালের অনেক খাদ্যের উপর বিতৃষ্ণাও জন্মেছে। কিন্তু এখনও অসভ্য আর অর্ধসভ্য জাতি আছে যাদের সাপ ব্যাঙ ইঁদুর পোকায় আপত্তি নেই।
ফণী। আদিম মানুষ কি খেত আর একালের অসভ্য মানুষ কি খায় তা আমাদের দেখবার দরকার নেই। আমার বক্তব্য আধুনিক সভ্য সমাজে যা খুব চলে তাই আমাদের খেতে হবে।
অঘোর। অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ কতকগুলি প্রাণীর মাংস ডিম দুধ আর বাছা বাছা শস্য তরকারি ফল মূল। হিন্দুর লোকাঁচার অনুসারে মাছ ছাগল ভেড়া হরিণ হাঁস ইত্যাদি কয়েকটি প্রাণীর মাংস শুদ্ধ। শাস্ত্রে পাঁচটি পঞ্চনখ জন্তু খাবার বিধানও আছে–খরগোশ শজারু গোসাপ গণ্ডার আর কচ্ছপ। এখন নতুন ফর্দ করতে হবে, সায়েবরা যা খায় অর্থাৎ গরু শুওর ইত্যাদিও খেতে হবে। পোর্ক আর বীফ দুর্মূল্য হওয়ায় পাশ্চাত্ত্য দেশে আজকাল ঘোড়া আর তিমি অর্থাৎ হোয়েলের মাংসও চলছে। সায়েবরা ব্যাঙের ঠ্যাং আর ঝিনুকের কাঁচা শাঁসও অতি সুস্বাদু মনে করে। অতএব এসবেও আপত্তি করা চলবে না। মল্লিক মশাই, এই তো আপনার মত?
ফণী। হাঁ, তবে সায়েব বললে ঠিক হবে না, বলুন আধুনিক সুসভ্য জাতিরা।
অঘোর। সুসভ্য জাতিদের মধ্যে যাঁরা বিজ্ঞতম আর দূরদর্শী তারা বুঝেছেন যে অভ্যস্ত বাছাবাছা খাদ্যের উপর একান্ত নির্ভর ভাল নয়। দরকার হলে অনভ্যস্ত খাদ্যও খেতে হবে, যাতে পুষ্টি হয় আর স্বাস্থ্যহানি হয় না। পুরাণে আছে, দুর্ভিক্ষের সময় বিশ্বামিত্র সপরিবারে কুকুরের মাংস খেতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। আধুনিক যুগে যুদ্ধ বা আবিষ্কার ইত্যাদির অভিযানে অবস্থা বিশেষে অনভ্যস্ত খাদ্যও খাবার দরকার হতে পারে। সম্প্রতি বিলাতে আর ফ্রান্সে জনকতক ভলনটিয়ারকে কিছুদিনের জন্য এমন জায়গায় নির্বাসিত করা হয়েছিল যেখানে মামুলী খাদ্য মোটেই মেলে না। তাদের প্রতি। নির্দেশ ছিল, ফল মূল পাতা পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ মাছ ব্যাঙ শামুক গুগলি যা জোটে তাই কাঁচা খেয়ে জীবনধারণ করতে হবে। তারা ফিরে এলে দেখা গেল যে তাদের কিছুমাত্র স্বাস্থ্যহানি হয় নি। আমাদের দেশেও ওই রকম আপৎকালীন আহারের অভ্যাস হওয়া দরকার।
মথুর। দেখ অঘোর, তুমি একটি ভণ্ড। নিজে নিরামিষ খাও অথচ মল্লিক মশাইকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছ। তুমি কি বলতে চাও, সাপ ব্যাঙ পোকা মাকড় খেতে না শিখলে আমাদের নিস্তার নেই?
ফণী। অঘোরবাবু আমার লেগ পুল করছেন।
অঘোর। আজ্ঞে না। আপনি অনেক সারগর্ভ কথা বলেছেন, আমি শুধু আপনার যুক্তি আর একটু ফালাও করবার চেষ্টা করছি।
মথুর। আচ্ছা মল্লিক মশাই, আমিষ খাদ্য খুব পুষ্টিকর তা তো বুঝলাম। কিন্তু অহিংসা হচ্ছে পরম ধর্ম, অতএব কিঞ্চিৎ স্বাস্থ্যহানি মেনে নিয়েও নিরামিষাশী হওয়া উচিত নয় কি? প্রাচীন যুগের অবস্থা যাই হক, ঈশ্বরকৃপায় এখন যখন চাল ডাল গম তরকারি আর কিছু কিছু দুধও জুটছে, আর মাছ মাংসের বাজারও আগুন, তখন নিরামিষ খাওয়াই আমাদের উচিত, এই কি ঈশ্বরের অভিপ্রায় নয়?
ফণী। ঈশ্বরের অভিপ্রায় কি তা জানবেন কি করে? সকলেই অহিংস হবে আর নিরামিষ খাবে এই যদি সৃষ্টিকর্তার মতলব হত, তবে তিনি বাঘ সিংগি বেরাল প্রভৃতি জানোয়ার সৃষ্টি করতেন না, সব জন্তুকেই গরু ছাগলের মতন নিরামিষাশী করতেন। পৃথিবীতে বিস্তর প্রাণী আছে যারা বিধাতার বিধানেই আমিষাশী হয়েছে, হিংসার পাপ তাদের স্পর্শ করে না। মানুষকেও সেই দলে ফেলবেন না কেন?
অঘোর। কিন্তু মানুষ শুধু আমিষ খায় না, লাউ কুমড়ো আম কাঁঠালও খায়। বিধাতা আমাদের বাঘ সিংগির দলে ফেলেন নি, বরং বলতে পারেন, ভালুক শেয়াল ইঁদুর কাগ প্রভৃতি সর্বভুক জানোয়ারের দলে ফেলেছেন।
ফণী। এ কথায় আমার আপত্তি নেই।
অঘোর। আরও একটা কথা। বিধাতা আমাদের এমন বুদ্ধি দিয়েছেন, যাতে চিরাভ্যস্ত খাদ্য বদলাতে পারি।
মথুর। তাইতো, বিষয়টা বড়ই গোলমেলে ঠেকছে। তোমরা দুই তার্কিকে মিলে আমার মাথা গুলিয়ে দিলে।
অঘোর। শোন মথুর, এ নিয়ে বেশী মাথা ঘামিও না, কূল কিনারা পাবে না। শাস্ত্রে আছে, যাতে জীবের অত্যন্ত হিত হয়, তাই ধর্ম। কিন্তু মুশকিল এই, বেরালের যা হিত ইঁদুরের তা নয়, মশা মাছি ছারপোকার যা হিত মানুষের তা নয়। অহিংসা পরম ধর্ম, কিন্তু তা পুরোপুরি মেনে চলা আমাদের অসাধ্য। আমিষাহার না হয় বর্জন করা গেল, কিন্তু আরও অনেক নিষ্ঠুর কর্ম আমরা চোখ বুজে করে থাকি। ষাঁড়কে নপুংসক করে বলদ বানিয়ে নাকে দড়ি দিয়ে খাটাই। কোটি কোটি পোকা মেরে পবিত্র আর শৌখিন এণ্ডি গরদ তসর তৈরি করি, তুচ্ছ শখের জন্য পাখিকে খাঁচায় পুরি, নানা জন্তুর স্বাধীনতা হরণ করে জুএ বন্দী করি, পোলিও-ভ্যাকসিন তৈরির জন্য হাজার হাজার বাঁদর চালান দিই, তাদের বধ করা হবে জেনেও। এসব কি জীবহিংসা নয়? আমাদের স্বভাব হঠাৎ বদলানো যাবে না। আমিহার অতি প্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে, শাস্ত্রে তার নিন্দা থাকলেও বারণ নেই। মনুর সেই বচনটি জান তো? ন মাংস ভক্ষণে দোষো ইত্যাদি। প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং–লোকের প্রবৃত্তিই এই রকম, নিবৃত্তিস্তু মহাফলা–তবে ছাড়তে পারলে মহা ফললাভ। আমাদের দেশের অনেক মহাপুরুষ মাংসাহার সমর্থন করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র তার গৌরদাস বাবাজীকে দিয়ে বলিয়েছেন, বাপু, ভগবান কোথায় বলেছেন যে পাঁঠা খাইও না?…পদ্মপুরাণ খোল, দেখাইব যে মাংস দিয়া বিষ্ণুর ভোগ দিবার ব্যবস্থা আছে। বিবেকানন্দ মাংসভোজন আবশ্যক বলেছেন। এ দেশের যেসব সম্প্রদায় বংশানুক্রমে নিরামিষাশী ছিল, তাদেরও অনেকে আজকাল আমিষ খাচ্ছে, আধুনিক ভারতে নিরামিষভোজী কমছে, আমিষভোজী বাড়ছে।
মথুর। তবে কি তোমরা বলতে চাও আমিষ না খাওয়াই দোষের?
ফণী। তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
অঘোর। আমি তা বলি না। এ যুগের ঋষি হচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। খাদ্য বিজ্ঞানী যে ব্যবস্থা দেবেন, তাই মেনে নেওয়া ভাল। অবশ্য সেকালের ঋষিদের মতন আধুনিক ঋষিদেরও মতভেদ আছে। যার ব্যবস্থা আমাদের মনের মতন হয়, তাই মেনে নেওয়া যেতে পারে।
ফণী। অঘোরবাবু, আপনাদের শাস্ত্রে আছে না–মহাজনো যেন গতঃ স পন্থাঃ? মহাজন অর্থাৎ বেশীর ভাগ লোকে যা করে, তাই হচ্ছে ধর্মের পথ। অতএব আমিষাহারই ধর্ম। আপনি ধর্ম থেকে ভ্রষ্ট হয়েছেন।
অঘোর। মহাজনের পথ ছেড়ে অন্য পথে চললেই লোকে ধর্মভ্রষ্ট হয় না। গৈরিকধারী সন্ন্যাসী, আজীবন ব্রহ্মচারী, ছাতু-মা-ভোজী নির্বাক মৌনী বাবা, বিবস্ত্র নেংটা বাবা–এরা খাপছাড়া, কিন্তু অধার্মিক নয়। নিরামিষ ভোজীকেও যদি এইসব ক্ল্যাংকের দলে ফেলেন, তবে আপত্তি করব না। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না। কালক্রমে নিরামিষ ভোজনই সভ্যজনের প্রিয় হওয়া অসম্ভব নয়। অহিংসা প্রবৃত্তির প্রসারের ফলে আমাদের রুচি বদলাতে পারে। নিরামিষের তুলনায় আমিষ খাদ্যে টোমেইন আর নানা রকম ক্রিমি কীট (যেমন trichina, fluke ইত্যাদি) জন্মাবার সম্ভাবনা বেশী, এই কারণেও আমিষের আকর্ষণ কমতে পারে। হয়তো ভবিষ্যতে সভ্য মানবের বিচারে আমিষ খাদ্য অসুন্দর অহূদ্য অনাবশ্যক গণ্য হবে। অনেক পাশ্চাত্ত্য শিকারী লিখেছেন, মানুষের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে বলে বাঁদরের মাংস তারা খেতে পারেন না। সর্বজীবে সমজ্ঞান বৃদ্ধি পেলে হয়তো কোনও মাংসেই রুচি হবে না।
মথুর। বাঁদর তো আমাদের পূর্বপুরুষ?
অঘোর। ঠিক পূর্বপুরুষ নয়, নিকট জ্ঞাতি বলা যেতে পারে। সম্প্রতি প্রফেসর হলডেন দিল্লিতে বক্তৃতায় বলেছেন, মাছই আমাদের অতি প্রাচীন আদিম পূর্বপুরুষ।
মথুর। কি ভয়ানক কথা! তাহলে মাছ খাওয়া মানে পিতৃমাংস ভক্ষণ? আচ্ছা দেড় টাকা সেরের চুনো পুঁটিও কি আমাদের পূর্বপুরুষ?
অঘোর। চুনো পুঁটি কই মাগুর ইলিশ রুই কাতলা সবাই। তবে চিংড়ির কথা আলাদা, ওরা হল মাকড়সা আর কাকড়াবিছার সগোত্র।
মথুর। মহাভারত! তা হলে খাব কি?
অঘোর। বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি বলছে, হাতি ঘোড়া থেকে পোকা মাকড় পর্যন্ত সব প্রাণীই মানুষের ভক্ষ্য। প্রবৃত্তি বলছে, বাছা বাছা গুটিকতক প্রাণীই খেতে ইচ্ছা করে। অন্তরাত্মা বলছে, নিরামিষেই যখন কাজ চলে তখন জীব-হিংসার দরকার কি।
ফণী। সব গাঁজা। আমিষ ত্যাগ করলে মানুষের অধঃপতন হবে, নিরামিষ খাদ্যে এসেনশ্যাল আমিনো-অ্যাসিডের অভাব আছে।
অঘোর। খাদ্যবিজ্ঞানী আর রসায়নী হয়তো সে অভাব পূরণ করতে পারবেন। সয়াবীন, চীনাবাদাম, তিল, ঈস্ট, খুদে পানা ইত্যাদি নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট চলছে।
মথুর। তা হলে এখন করা যায় কি?
অঘোর। দেখ মথুর, প্রবৃত্তিই বলবতী। যাতে তোমার রুচি হয়, যা তোমার পেটে সয়, তাই খাবে। ভবিষ্যতে হয়তো মাছ মাংসের অনুকল্প উপাদেয় সুষম নিরামিষ খাদ্য আবিষ্কৃত হবে, কিন্তু তা তোমার আমার ভোগে লাগবে না। মল্লিক মশায়ের বয়স কম, উনি হয়তো চেখে দেখবার সুযোগ পাবেন। এখন ওঠা যাক, অনেক বেলা হয়েছে।
[* প্রায় কোনও প্রচ্ছন্নতা না রেখে নিজেকে এতটা project বোধহয় আর কখনও করেন নি। বয়স আটাত্তর, ৬০/৬৫ বৎসর অর্থাৎ ১২/১৩ বৎসর বয়স থেকে নিরামিষাশী ও সব বিষয় চরম বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর rational মতবাদ। ফোটোগ্রাফ না হলেও অঘোর দত্ত নিখুঁত আত্মপ্রতিকৃতি। আর হয়তো ছেলেবেলায় এমন কিছু পড়েছিলাম…–আমার শৈশবে একবার বলেছিলেন–রাজর্ষি; ওটাও আমার নিরামিষ খাওয়ার একটা কারণ। আবার–মোটেই ভেজিটেরিয়ন নই, রোজ খাঁটী গোরস খাচ্ছি–এও বলেছেন। স:।]
গল্পের বাজার
গল্পের বাজার (১৮৭৯/১৯৫৭)
অন্য জন্তুর সঙ্গে মানুষের অনেক তফাত আছে। আমরা খাড়া হয়ে হাঁটি, আঙুল দিয়ে কলম ধরি, দাড়ি কামাই, নেশা করি। নেশা মানে শুধু মদ গাঁজা আফিম নয়, পান তামাক চা-ও নয়, জীবনধারণের জন্য যা অনাবশ্যক অথচ অভ্যাস করলে যাতে সহজেই প্রবল আসক্তি আসে, তারই নাম নেশা। ব্যসন শব্দেরও এই অর্থ। মৃগয়া দূত দিবানিদ্রা পরনিন্দা নৃত্য গীত ক্রীড়া বৃথাভ্রমণ বেশ্যা মদ, এই দশটি শাস্ত্রোক্ত কামজ ব্যসন। সদর্থেও ব্যসন শব্দের প্রয়োগ আছে। মহাত্মাদের একটি লক্ষণ বলা হয়েছে–ব্যসনং শুতৌ, অর্থাৎ বেদবিদ্যায় আসক্তি। শখ আসক্তি ব্যসন আর নেশা, নির্দোষ বা সদোষ যাই হক, মোটামুটি একই শ্রেণীতে পড়ে।
আগের তুলনায় এখন আমাদের নেশার সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। সেকালের তরজা, কবিগান, মেড়ার লড়াই, বাচখেলা, বাইনাচ ইত্যাদির চাইতে এখনকার রেডিও সিনেমা থিয়েটার জলসা ফুটবল-ক্রিকেট ম্যাচ ইত্যাদির বৈচিত্র্য আর আকর্ষণ বেশী। এ সবের চাইতেও ব্যাপক নেশার জিনিস গল্পের বই। আজকাল সাহিত্য বললে অধিকাংশ লোক কথাসাহিত্যই বোঝে। অনেক লোক আছে যারা কোনও রকম নেশা না করে অর্থাৎ পান তামাক সিগারেট চা পর্যন্ত না খেয়ে স্বচ্ছন্দে জীবনযাপন করে। তেমনি এমন লোকও আছে যাদের গল্প পড়বার আগ্রহ কিছুমাত্র নেই। তবু বলা যেতে পারে, শিক্ষিত আর অল্পশিক্ষিত আবালবৃদ্ধবনিতা অসংখ্য লোকে গল্পের বই পড়ে এবং অনেকের পক্ষে তা প্রবল আসক্তি বা নেশার বস্তু।
বঙ্কিমচন্দ্র লেখকদের উপদেশ দিয়েছেন–টাকার জন্য লিখিবে না। কিন্তু ছাপাখানার মালিককে তিনি বলেন নি টাকার জন্য ছাপিবে না। তার আমলে লেখক আর পাঠক দুইই কম ছিল, সুতরাং লেখককে নিঃস্বার্থ জনশিক্ষক মনে করা চলত। কিন্তু একালে চা আর সিগারেটের মতন গল্পের বই অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে, পাঠকরাও দাম দিতে প্রস্তুত, সুতরাং মুদ্রাকর দপ্তরী আর প্রকাশকের দাবি মেনে নিয়ে শুধু লেখককে বঞ্চিত করার কারণ নেই। জনসাধারণের গল্পপ্রীতি বেড়ে যাওয়ার ফলে বাঙালী একটি সম্মানিত নূতন জীবিকার সন্ধান পেয়েছে। গল্পকার শুধু লেখক নন, কবি আর চিত্রকরের তুল্য কলাবিৎ, ইন্দ্রজালিকের সঙ্গেও তার সাদৃশ্য আছে। কাল্পনিক ঘটনার বিবৃতির দ্বারা তিনি পাঠককে সম্মোহিত ও রসাবিষ্ট করেন। গল্পগ্রন্থের আদর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থের চাইতে ঢের বেশী, টেক্সটবুকের নীচেই তার কাটতি।
ষাট-সত্তর বৎসর আগে যখন বাঙলা গল্পের খুব অভাব ছিল, তখন লোকে অবসরকালে কি পড়ত, তাদের রুচি কিরকম ছিল, এই সব খবর আধুনিক লেখক আর পাঠকদের অনেকেই জানেন না। বাঙলা বা ইংরেজী গল্পগ্রন্থের জ্ঞান আমার অতি অল্প, সেকালের সাহিত্যসেবীদের সঙ্গেও আমার যোগ ছিল না। তথাপি তখনকার পাঠকদের অবস্থা সম্বন্ধে আমার যতটুকু জানা আছে তা বলছি।
তখন গল্পখোর বাঙালীর প্রধান সম্বল ছিল বঙ্কিমচন্দ্রের এগারোটি উপন্যাস, রমেশচন্দ্রের ছটি, তারকনাথের স্বর্ণলতা, স্বর্ণকুমারী দেবীর কয়েকটি গল্প, রবীন্দ্রনাথের রাজর্ষি আর বউঠাকুরাণীর হাট, এবং আরব্য উপন্যাস। আরও কতকগুলি ভাল মাঝারি মন্দ গল্পের বই প্রচলিত ছিল, কিন্তু তার অধিকাংশই এখন লোপ পেয়েছে, নাম পর্যন্ত লোকে ভুলে গেছে। রবীন্দ্রনাথ তখন সবে ছোটগল্প লিখতে আরম্ভ করেছেন, কিন্তু অল্প পাঠকই তার খবর রাখত। শরৎচন্দ্র আর প্রভাতকুমার তখনও কলম ধরেন নি। সেই গল্পাল্পতার যুগে পাঠকের স্পৃহা কি করে মিটত? তখন কৃত্তিবাস কাশীরাম আর ভারতচন্দ্রের রচনা লোকে সাগ্রহে পড়ত, দীনবন্ধু, গিরিশচন্দ্র আর রাজকৃষ্ণ রায়ের নাটক খুব জনপ্রিয় ছিল, মধুসূদন হেমচন্দ্ৰ নবীনচন্দ্র এবং অনেক নিকৃষ্ট কবির রচনাও লোকে পড়ত, কিন্তু রবীন্দ্রকাব্য বহুপ্রচারিত হয় নি, সাধারণ পাঠকের পক্ষে তা একটু দুরূহ ছিল। এখনকার মতন তখনও অধিকাংশ পাঠক কবিতার চাইতে গল্পেরই বেশী ভক্ত ছিল, কিন্তু যথেষ্ট গল্পের বই না থাকায় কবিতার পাঠক এখনকার তুলনায় সেকালে বেশী ছিল।
তখন শুধু বাঙলা বই পড়ে পাঠকের বুভুক্ষা মিটত না, প্রচুর ইংরেজী গল্পও লোকে পড়ত। আশ্চর্য এই, সেকালে সদ্য এনট্রান্স পাস করা ছাত্র এবং অনেকে যারা পাস করে নি তারাও ইংরেজী নভেল পড়ত, অথচ শুনতে পাই এখনকার অধিকাংশ গ্রাজুয়েট ইংরেজি নভেল বুঝতে পারে না। নব্য বাঙালীর শক্তি বা রুচির এই পরিবর্তন উন্নতি কি অবনতির লক্ষণ তা শিক্ষাবিশারদগণ বলতে পারেন।
আজকাল পাশ্চাত্ত্য দেশে কোনও শক্তিমান লেখকের আবির্ভাব হলে এদেশে অবিলম্বে তার খবর আসে। সেকালে এমন হত না। অল্প কয়েকজন উচ্চশিক্ষিত লোক নূতন বইএর সন্ধান রাখতেন কিন্তু আর সকলের পাঠ্য ছিল প্রাচীন লেখকের রচনা। তখন কলেজ স্ট্রীটের বইএর দোকানে ক্লাসিক ভিন্ন অন্য ইংরেজী নভেল পাওয়া যেত না, পাঠকরা হগ মার্কেট, রেলওয়ে বুকস্টল প্রভৃতি থেকে তাদের প্রিয় গল্পের বই যোগাড় করতেন। শিক্ষকরা মনে করতেন ছাত্রদের পক্ষে অবাধ নভেল পাঠ ভাল নয়, তাঁরা বলতেন, রবিনসন ক্রুসো, গলিভার্স ট্রাস, রাসেলাস, ভিকার অভ ওয়েকফিল্ড পড়তে পার, স্কটের বইও দু-চারখানা পড়তে পার, কিন্তু তার বেশী নয়। তখন কোনান ডয়েল সবে লিখতে আরম্ভ করেছেন, কিন্তু তার খবর অল্প বাঙালীই জানত।
সেকালে নভেলখোর বাঙালীর প্রধান পাঠ্য ছিল স্কট, ডিকেন্স, লিটন, থ্যাকারে, ভিকটর হিউগো, রাইডার হ্যাগার্ড, মারি করেলি, ডুমা ইত্যাদি। হার্ডি, গল্সওয়ার্দি আর টলস্টয়ের নাম সাধারণ পাঠকের অজ্ঞাত ছিল। রাশি রাশি অতি সস্তা মার্কিন ডিটেকটিভ আর ওআইল্ড ওয়েস্টের গল্প আমদানি হত, কিন্তু অনভিজ্ঞ পাঠকের পক্ষে তার স্ল্যাং-বহুল ভাষা একটু দুর্বোধ ছিল। লোকে সব চেয়ে বেশী পড়ত রেনল্ডসের রোমাঞ্চকর গল্পাবলী, ডিস এডিশন, ছ আনায় একখানা বেশ বড় বই, বিস্তর ছবি। অতি ছোট হরফে ছাপা, কিন্তু যারা পড়ত তাদের চোখের তেজ ছিল, মিটমিটে প্রদীপ বা হারিকেনের আলোয় অনায়াসে পড়া চলত। আমার এক মাস্টারমশাই গোগ্রাসে রেনল্ডস গিলতেন। আমাকে বলেছিলেন, খবরদার, ত্রিশ বছর বয়সের আগে রেনল্ডস ছোঁবে না। কিন্তু আমার দাদা* বললেন, শুনিস না মাস্টারের কথা, রেনল্ডসের রবার্ট ম্যাকেয়ার পড়ে দেখিস, চমৎকার ডাকাতের গল্প; তার পর রাইহাউস প্লট, নেক্রোমান্সার ব্রঞ্জ স্ট্যাচু এই সব পড়বি। আমি দাদার উপদেশই পালন করেছিলাম। অল্প বয়সেই একগাদা রেনল্ডস পড়া হয়ে গেল, অরুচিও ধরল।
ডিক্স এডিশনের মতন সস্তা বই এখন স্বপ্নের অগোচর। শেকস্পীয়র মিলটন শেলী বাইরন প্রভৃতির সম্পূর্ণ গ্রন্থাবলীর দাম ছিল বারো আনা। ডিকেন্স স্কট লিটন ইত্যাদির উপন্যাস ছ আনা মাত্র। অতি গরিব পাঠকও অল্প খরচে অনেক বই সংগ্রহ করতে পারত।
এককালে যাঁর বইএ এ দেশের বাজার ছেয়ে গিয়েছিল সেই রেনল্ডসের কোনও চিহ্নই এখন পাওয়া যায় না। বিলাতেও তার বই প্রথম প্রথম খুব চলত। দু-একটি বইএ তিনি ব্রিটিশ রাজবংশের কুৎসা করেছিলেন সেজন্য কালক্রমে তার জনপ্রিয়তা লোপ পায়। তাঁর গ্রন্থাবলীর কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ আমার মনে আছে। দেদার রহস্য আর রোমাঞ্চ, কিছু ব্যভিচার, কিছু চুরি ডাকাতি নরহত্যা, এবং লর্ড-লেডিদের বিলাসময় জীবনযাত্রা। নায়ক নায়িকারা রূপে গুণে অতুলনীয়, বিস্তর বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে বহু কষ্টভোগের পর তাদের মিলন হয়। অনেক বইএর শেষে থাকত–And they were happy, oh, supremely happy I went-At last they were united in holy wedlock and lived happily ever after 1
Yellow Back নামে খ্যাত জনপ্রিয় ইংরেজী নভেলসমূহ এবং যেসব বাঙলা বইএর কাটতি সব চেয়ে বেশী তাদের রচনা পদ্ধতি অনেকটা রেনল্ডসের মতন। রূপকথা আর অধিকাংশ ডিটেকটিভ গল্পের পদ্ধতিও এই রকম। আমার মনে হয় সব রকম গল্পই মোটামুটি দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম শ্রেণীর গল্প রূপকথা জাতীয়, প্লটে যতই জটিলতা আর রোমহর্ষণ থাকুক, পরিশেষে পূর্ণ শান্তি, নায়ক-নায়িকার শারীরিক মানসিক আর্থিক সর্বাঙ্গীণ কুশল। পড়া শেষ হলে পাঠক হয়তো মনে মনে কিছুক্ষণ রোমন্থন করেন, কিন্তু তার পরে নিশ্চিন্ত হন, কারণ নায়ক-নায়িকার ভবিষ্যৎ একেবারে নিষ্কণ্টক। দ্বিতীয় শ্রেণীর গল্পের নায়ক-নায়িকা অম্লাধিক আঘাত পায়, তার ক্ষত সম্পূর্ণভাবে সারে না। লেখক মিলনান্ত করে গল্প সমাপ্ত করলেও কিছু কণ্টক রেখে দেন, তার ফলে পাঠকের মনে গল্পের জের চলতে থাকে। এই শ্রেণীর সকণ্টক গল্পকেই বোধ হয় মনস্তত্ত্বমূলক বলা হয়।
মহাভারতের অন্তর্গত সাবিত্রী-সত্যবান আর নল-দময়ন্তীর উপাখ্যান প্রথম শ্রেণীর নিষ্কণ্টক গল্প। কিন্তু মহাভারতের মূল আখ্যান সকণ্টক দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। যুদ্ধজয়ের পর যুধিষ্ঠির ছত্রিশ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। গ্রন্থ সমাপ্তির পরেও আমাদের ভাবনা হয়–যুধিষ্ঠিরের মন হয়তো শেষ পর্যন্ত অশান্ত ছিল, তবে ভীম বোধ হয় বেশ ফুর্তিতেই ছিলেন। দ্রৌপদী তাঁর পিতা ভ্রাতা আর পঞ্চ পুত্রের শোক নিশ্চয় ভুলতে পারেন নি, গান্ধারী আর তাঁর বিধবা পুত্রবধূদের সঙ্গে রাজপুরীতে বাসও বোধ হয় তার পক্ষে সুখকর ছিল না। বঙ্কিমচন্দ্রের রাধারানী আর যুগলাঙ্গুরীয় নিষ্কন্টক গল্প, বিষবৃক্ষ সকণ্টক। নগেন্দ্র-সূর্যমুখীর পুনর্মিলন হলেও তাদের সম্পর্ক আগের মতন হবার নয়। রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবিকে নিষ্কণ্টক গল্প বলা যেতে পারে, কারণ পাত্রপাত্রীদের সমস্ত দুঃখ শেষকালে মিটে গেছে। কিন্তু তবু সন্দেহ থেকে যায়, জীবনের অত বড় বিপর্যয়ের পর কমলা তার অজ্ঞাত স্বামীকে আবিষ্কার করে কি পূর্ণ তৃপ্তি পেয়েছিল? শেষের কবিতা নিশ্চয় সকণ্টক গল্প। কেটিকে বিবাহ করে অমিত রায় কর্তব্য পালন করেছে, সেই সঙ্গে আত্মবিসর্জনও দিয়েছে। লাবণ্যর কাছে সে যেরকম উচ্ছ্বাসময় বক্তৃতা দিত, কেটির কাছে তার কোনও কদর হবে মনে হয় না। অগত্যা সে হয়তো পলিটিক্স নিয়ে মেতে উঠে একজন দেশনেতা হয়ে যাবে। শরৎচন্দ্রের দত্তা নিষ্কণ্টক গল্প, কিন্তু বামুনের মেয়েতে কণ্টক আছে। প্রিয়নাথ ডাক্তার হয়তো সামলে উঠে আবার রোগী দেখা শুরু করবেন, কিন্তু তার গর্বিতা কন্যার মনস্তাপ সহজে দূর হবে না।
এ দেশের এবং বোধ হয় সকল দেশেরই বেশীর ভাগ পাঠক প্রথম শ্রেণীর অর্থাৎ নিষ্কণ্টক গল্প চায় যার শেষে নায়ক-নায়িকা সুখে ঘরকন্না করে and live happily ever after। মামুলী ডিটেকটিভ কাহিনী এবং রোমাঞ্চ সিরিজের রূপসী বোম্বেটে জাতীয় গল্পও এই শ্রেণীতে পড়ে। ছোট ছেলেমেয়ের জন্য যেমন রূপকথা তেমনি অসংখ্য সাধারণ পাঠকের জন্য এমন গল্প দরকার যাতে প্রচুর আতঙ্ক আর উত্তেজনা আছে, প্রেমের লড়াইও আছে, কিন্তু যার পরিণাম নিষ্কণ্টক। যে পাঠকরা অপেক্ষাকৃত বিদগ্ধ এবং মানবচিত্তের রহস্য সম্বন্ধে কুতূহলী, অর্থাৎ যাঁরা সমস্যাময় বাস্তব জীবনের চিত্র চান, তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর সকণ্টক গল্পই বেশী উপভোগ করেন।
[* শশিশেখর বসু।—স:।]
গ্রহণীয় শব্দ
গ্রহণীয় শব্দ (১৮৮০/১৯৫৮)
ভাবের বাহন ভাষা, ভাষার উপাদান শব্দ। শব্দের অর্থ যদি সর্বগ্রাহ্য হয় তবেই তা সার্থক, অর্থাৎ প্রয়োগের উপযুক্ত এবং সাহিত্যে গ্রহণীয়।
বাঙলা ভাষা ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। তার এক কারণ, বাঙালীর জীবনযাত্রার পরিবর্তন, অর্থাৎ নূতন বস্তু নূতন ভাব নূতন রুচি নূতন আচারের প্রচলন। অন্য কারণ, অজ্ঞাতসারে বা ইচ্ছাপূর্বক ইংরেজী ভাষার অনুকরণ। মৃত ভাষা ব্যাকরণের বন্ধনে মমির মতন অবিকৃত থাকতে পারে, কিন্তু সজীব চলন্ত ভাষায় বিকার বা পরিবর্তন ঘটবেই। আমাদের আহার পরিচ্ছদ আবাস সমাজব্যবস্থা আর শাসনপ্রণালী যেমন বদলাচ্ছে, তেমনি শব্দ শব্দার্থ আর শব্দবিন্যাসও বদলাচ্ছে।
যাঁরা গোঁড়া প্রাচীনপন্থী তারা কোনও পরিবর্তন প্রসন্ন মনে মেনে নিতে পারেন না। আধুনিক ছেলেমেয়েদের চালচলন যেমন অনেক লোকের পক্ষে দৃষ্টিকটু, আধুনিক বাঙলা ভাষার রীতিও সেই রকম। অন্ধ গোঁড়ামি সকল ক্ষেত্রেই অন্যায়, কিন্তু শুধু হুজুক বা ফ্যাশনের বশে কোনও নূতন বস্তু বা রীতি মেনে নেওয়া বুদ্ধিমানের লক্ষণ নয়। ভাষার রীতির তুলনায় সামাজিক রীতির গুরুত্ব অবশ্য অনেক বেশী, তথাপি কোনও শিক্ষিত লোকই চান না যে মাতৃভাষায় জঞ্জাল আসুক। সহসাগত কোনও শব্দ শব্দার্থ বা প্রয়োগরীতিকে সাহিত্যে স্থান দেবার আগে একটু যাচাই করে দেখা ভাল।
ভাষার সমৃদ্ধি হয় কৃতী লেখকের প্রভাবে, কিন্তু তার ক্রমিক মন্থর পরিবর্তনে জনসাধারণের হাতই বেশী। সাধারণ মানুষ ব্যাকরণ অভিধানের বশে চলে না। কয়েকজন শব্দের উচ্চারণে বা প্রয়োগে ভুল করে, তার পর অনেকে সেই ভুলের অনুসরণ করে, তার ফলে কালক্রমে নূতন শব্দ নূতন অর্থ আর নূতন ভাষার উৎপত্তি হয়। ভাষা মাত্রেই পূর্ববর্তী কোনও ভাষার বিকার বা অপভ্রংশ এবং একাধিক ভাষার মিশ্রণ। শব্দ অর্থ আর ভাষার এই স্বাভাবিক অভিব্যক্তি বা evolution বারণ করা যায় না। কিন্তু অভিব্যক্তিতেও মানুষের কিছু হাত আছে। মানুষ অন্ধভাবে সবরকম প্রাকৃতিক পরিবর্তন মেনে নেয় না, স্বচ্ছন্দাগত সব কিছুকে সাদরে বরণ করে না। অভিব্যক্তির বহু ক্ষেত্রে মানুষ সজ্ঞানে হস্তক্ষেপ করেছে, যে পরিবর্তন তার পক্ষে অনুকূল তাই ঘটাবার চেষ্টা করেছে। বন্য প্রাণী আর উভিদ থেকে গৃহপালিত পশুপক্ষী আর ভক্ষ্য শস্য ফলাদির উৎপত্তি মানুষেরই যত্নের ফল। ভাষার ক্ষেত্রেও আমাদের সতর্ক হস্তক্ষেপ শুভজনক হতে পারে।
বিষয়টি সহজ নয়। ভাষার সৌষ্ঠব রক্ষা আর প্রকাশ-শক্তি বর্ধনের প্রকৃষ্ট উপায় কি সে সম্বন্ধে মতভেদ থাকতে পারে, কোন্ শব্দ গ্রহণীয় বা বর্জনীয় তা নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। সবিস্তার আলোচনা না করে শুধু কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি। তা থেকে হয়তো সতর্কতার প্রয়োজন বোঝা যাবে।
এমন অনেক বস্তু এদেশে আছে যার সম্বন্ধে আমাদের সাধারণ শিক্ষিত জন এতকাল উদাসীন ছিলেন। সম্প্রতি এই প্রকার কয়েকটি বস্তুর গুরুত্ব বেড়েছে, সংবাদপত্র এবং সাধারণের পাঠ্যগ্রন্থে তাদের উল্লেখ না করলে চলে না। কিন্তু নামকরণে অসাবধানতা দেখা যাচ্ছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বৎসর যাবৎ এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে লোহা তৈরি হচ্ছে, নূতন পরিকল্পনায় উৎপাদন বহুগুণ বেড়ে যাবে। যে কাঁচা মাল বা খনিজ বস্তু থেকে লোহা তৈরি হয় তার বাঙলা নাম কি? রাশি রাশি এই বস্তু রেলগাড়িতে বোঝাই হয়ে লোহার কারখানায় যায়, কলকাতার বন্দর থেকে জাহাজে জাপান রাশিয়া ইত্যাদি দেশে রপ্তানি হয়। অতি প্রয়োজনীয় এই ভারতীয় সম্পদের একটা সর্বগ্রাহ্য নাম অবশ্যই চাই। ইংরেজী নাম iron ore, বৈজ্ঞানিক নাম hematite। যে অশিক্ষিত জন এই বস্তু পাহাড় কেটে বার করে বা খনি থেকে তোলে তারা বলে লোহা-পাথর। এই অতি সরল উত্তম নামটি কিন্তু বাঙলা কাগজে স্থান পায় না, লেখা হয়–লৌহপিণ্ড বা খনিজ লৌহ বা আকরিক লৌহ। তিনটে নামই ভুল। লৌহপিণ্ড মানে লোহার তাল, lump of iron। খনিজ বা আকরিক লৌহ বলতে বোঝায়, যে লৌহ খনি বা আকরে থাকে। কিন্তু খনি বা আকরে কুত্রাপি লৌহ থাকে না, থাকে একরকম পাথর যাতে লোহা যৌগিক অবস্থায় আছে। মাটিতে আখ হয়, আখে চিনি আছে, কিন্তু আখকে ভমিজ শর্করা বলা চলে না। খনি আর আকর শব্দের মানে একই, কিন্তু পারিভাষিক প্রয়োগে mineralএর বাঙলা খনিজ, oreএর বাঙলা আকরিক। অতএব iron oreএর শুদ্ধ প্রতিশব্দ লৌহ আকরিক। কিন্তু লোহা-পাথর নাম আরও ভাল।
লোহার কথা আর একটু বলছি। লোহা-পাথর থেকে প্রথমে যে লোহা অশুদ্ধ অবস্থায় নিষ্কাশিত হয় তার মোটা মোটা বাটের নাম pig-iron। শূকর-দেহের সঙ্গে সাদৃশ্য কল্পনা করে এই নাম দেওয়া হয়েছে। এই বস্তু ভারতের বাইরে প্রচুর চালান যায়। Iron foundry বা লোহা ঢালাইখানায় এই লোহা গলিয়ে ছাঁচে ঢেলে রেলিং, রাঁধবার কড়াই, বাটখারা ইত্যাদি নানা জিনিস তৈরি হয়। এই জাতীয় লোহার নাম cast-iron বা ঢালাই লোহা। সংস্কৃতে অনেক রকম লোহার নাম আছে, কিন্তু কোটিতে cast-iron বোঝায় তা স্থির করা যায় না। Pig-iron-এর বাঙলা নাম চাই। শূকর-লৌহ চলবে না, বাজার চলিত নাম পিগ-লোহা বাঙলা ভাষায় মেনে নেওয়া ভাল।
Atom bomb অর্থে অনেকে আণবিক বোমা লেখেন। এই অনুবাদ ভুল। Atomicএর বাঙলা পারমাণবিক। পরমাণু বোমা লিখলে ঠিক হয়। এ সম্বন্ধে পরিমল গোস্বামী মহাশয় অনেকবার আলোচনা করেছেন।
যুদ্ধের সময় blackout অর্থে নিষ্প্রদীপ খুব শোনা যেত, এখনও বিজলীর অভাবে শহর অন্ধকার হলে বলা হয় নিষ্প্রদীপ। কিন্তু blackoutএর উদ্দিষ্ট অর্থ আলোকহীনতা। নিষ্প্রদীপ মানে আলোকহীন। ভারতচন্দ্র বহুকাল আগে শুদ্ধ নাম রচনা করে গেছেন–অপ্রদীপ, অর্থাৎ আলোকের অভাব। শব্দটি বিশেষ্য বিশেষণ দুই রূপেই চলতে পারে। Blackoutএর প্রতিশব্দ রূপে অপ্রদীপই গ্রহণীয়।
সাত-আট বৎসর আগে civil supply অর্থে লেখা হত অসামরিক সরবরাহ। Civil শব্দের বাঙলা ছিল না, তাই নঞর্থক অসামরিক শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল। যেন সামরিক প্রয়োজনই মুখ্য, জনসাধারণের প্রয়োজন নিতান্তই গৌণ। এই রকম মনোভাবের ফলে এককালে non-Mohamedan নামটির সৃষ্টি হয়েছিল। আজকাল সরকারী নাম জনসংভরণ চলছে, কিন্তু প্রথম প্রথম খুব আপত্তি শোনা গিয়েছিল।
Subcontinentএর বাঙলা উপমহাদেশ। ইংরেজী কাগজে অবিভক্ত সমগ্র ভারত সম্বন্ধে কিছু বক্তব্য থাকলে লেখা হয়–in this Subconti nent। এর উদ্দেশ্য বোধ হয় পাকিস্তানকে কোনও রকমে ক্ষুণ্ণ না করা। বাঙলায় এই উপমহাদেশে যেমন শ্ৰতিকটু তেমনি অনর্থক। বিষ্ণুপুরাণে পরাশরের বচন আছে–
উত্তরং যৎ সমুদ্রস্য হিমাদ্রেশ্চৈব দক্ষিণম্।
বর্ষং তদ্ ভারতং নাম ভারতী যস্য সন্ততিঃ।
এই বর্ণনা অনুসারে ভারতবর্ষ মানেই this Subcontinent, যেমন স্কান্ডিনেভিয়া মানে নরওয়ে সুইডেন ডেনমার্ক আর আইসলান্ড। প্রাচীনকালে এই দেশে বহু স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ছিল, ব্রিটিশ আমলেও ফ্রেঞ্চ পোর্তুগীজ অঞ্চল আর নেপাল ছিল, তথাপি সমগ্র দেশকে বলা হত India বা ভারতবর্ষ। পাকিস্তান হয়েছে বলেই ভারতবর্ষ নামের ভৌগোলিক অর্থ বদলাতে পারে না। আমাদের খণ্ডিত দেশকে শুধু ভারত বা ভারত রাষ্ট্র বলা যেতে পারে।
Chancellor ও Vice-chancellor অর্থে আচার্য ও উপাচার্য চলছে। এই দুই প্রতিশব্দ অত্যন্ত অযৌক্তিক মনে করি। উপাচার্যের মানে assistant professor/ Vice-chancellorকে এই নাম দিলে তার মর্যাদার হানি হয়। এ সম্বন্ধে পূর্বে কিছু আলোচনা করেছি।*
কথায় কথায় thanks, please, kindly ইত্যাদি বলা ইংরেজী শিষ্টাচার। আমরা তা মেনে নিয়েছি। একবার একটি মেয়ের অটোগ্রাফ খাতায় আমি নাম সহি করলে সে বলেছিল, ধন্যবাদ। আমি প্রশ্ন করলাম, কে ধন্য, তুমি না আমি? মেয়েটি প্রথমে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, তার পর উত্তর দিল আমি, আমি ধন্য শব্দের এক অর্থ কৃতার্থ, আর এক অর্থ খুব বাহাদুর, যেমন ধন্য তোমারে হে রাজমন্ত্রী। মেয়েটি প্রথম অর্থে নিজেকেই ধন্যবাদ দিয়েছিল, দ্বিতীয় অর্থে আমাকে দেয় নি। Thanksএর বাঙলা চাই, ঠিক সমার্থক না হলেও ধন্যবাদ মেনে নেওয়া যেতে পারে। Please, kindly স্থানে অনুগ্রহপূর্বক, দয়া করে ইত্যাদি বলা হয়। হিন্দীতে কৃপয়া এই ছোট সংস্কৃত পদটি চলছে, বাঙলাতেও মেনে নেওয়া যেতে পারে।
ইংরেজীতে অনেক লোকের নাম একত্র লিখতে হলে আগে Messrs বসানো হয়, অর্থাৎ এঁরা সকলেই Mister। হিন্দীতে তার নকল চলছে সর্বশ্রী, বাঙলাতেও মাঝে মাঝে দেখতে পাই। সর্বশ্রী শুনলেই মানে আসে হাওড়াশ্রী বাঁটরাশ্রী। লোকে যদি এতই শ্রীর কাঙাল হয় তবে উৎকট সর্বশ্রী না লিখে শ্রীর পর কোলন বা ড্যাশ দিয়ে সমস্ত নাম লেখা যেতে পারে।
স্ত্রীলিঙ্গ শব্দের প্রতি আমাদের কিছু পক্ষপাত দেখা যায়। জীবনচরিত বা চরিত স্থানে জীবনী, জন্মবার্ষিক বা জন্মদিন স্থানে জন্মবার্ষিকী, পরিক্রম বা পরিক্রমণ স্থানে পরিক্রমা, শতাব্দ স্থানে শতাব্দী, প্রকাশ স্থানে প্রকাশনা ইত্যাদি চলছে। এতে আপত্তির কারণ নেই, কিন্তু স্থানে অস্থানে কার্যকরী শব্দটির এত চলন হল কেন? শুধু খবরের কাগজে নয়, অনেক জনপ্রিয় লেখক আর অধ্যাপকের লেখাতেও দেখতে পাই–কার্যকরী উপায়, কার্যকরী সমাধান, প্রস্তাব কার্যকরী করা ইত্যাদি। কার্যকর বা কার্যকারী লিখতে বাধে কেন?
আর একটি অদ্ভুত ফ্যাশন সম্প্রতি দেখা দিয়েছে ক্লীবলিঙ্গ প্রীতি। পত্রিকা বা পুস্তকের নাম রূপ, সুন্দর, অবনীন্দ্রচরিতম্ ইত্যাদি রাখলে আপত্তি করা যায় না। বোধ হয় গৌরব বৃদ্ধির জন্যই সংস্কৃত বিভক্তিযুক্ত নাম দেওয়া হয়। ভরতনাট্যও এই রকম হতে পারে। অনেক দ্রাবিড়ী নামের শেষে ম্ আছে, যেমন–পায়সম্ রসম্ পপডম্ শ্রীরঙ্গম্ চিদম্বরম্। ভরতনাট্যও হয়তো সেই রকম। সেদিন রাস্তায় একটি কবিরাজী দোকানে সাইন বোর্ড দেখেছি–শ্রীআয়ুর্বেদম্। সংস্কৃত ভাল করে না শিখলে কবিরাজ হওয়া যায় না। আয়ুর্বেদ পুংলিঙ্গ শব্দ। দোকানের মালিক শেষে ম্যােগ করে আয়ুর্বেদকে নপুংসক করলেন কেন? আর একটি শোচনীয় নাম মাঝে মাঝে চোখে পড়ে। একজন লেখক তাঁর রচনার শেষে নাম লেখেন– ভারতপুত্র। এই ভারতসন্তান ক্লীবত্ব বরণ করলেন কোন্ দুঃখে?
[* আচার্য উপাচার্য দ্রষ্টব্য।–স:।
শতাব্দ স্থানে সর্বদা অকারণ স্ত্রীলিঙ্গ শতাব্দী চলছে। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর আরম্ভে পাশাপাশি লেখা হতে লাগল–নতুন সহস্রাব্দ। অব্দ–শত হলে স্ত্রী, আর সহস্র হলে পুং (লালিমা পাল)-কোন্ যুক্তিতে লিঙ্গভেদ?–স:।]
বানানের সমতা ও সরলতা
বানানের সমতা ও সরলতা (১৮৭৯/১৯৫৭)
কয়েক বৎসর পূর্বে একজন উত্তরপ্রদেশীয় লেখক আমার কাছে এসেছিলেন। একজন বাঙালী অধ্যাপকও তখন উপস্থিত ছিলেন। দুজনের পরিচয়ের পর অধ্যাপক প্রশ্ন করলেন, পণ্ডিতজী, আমাদের জাতীয় সংগীত জন-গণ-মন হিন্দীতে অমন উৎকট বানানে লেখা হয় কেন–দ্রাবিড় উৎকল-বঙ্গা, উচ্ছল-জলধিতরঙ্গা? শেষে অনর্থক আ-কার যোগ করেন কেন? পণ্ডিতজী উত্তর দিলেন, বাবুজী, হিন্দী আর বাঙলা জবান এক নয়। আপনাদের অ-কার যেন awe, কিন্তু হিন্দীতে তেমন নয়, upএর আদ্যক্ষর তুল্য হ্রস্ব। জন-গণ-মন গাইবার সময় সেই হ্রস্ব অ-কার আমরা টেনে দীর্ঘ করি, তার ফলে অ-কারান্ত বঙ্গ আমাদের উচ্চারণে বঙ্গা হয়ে যায়। শেষে আ-কার না দিলে লোকে পড়বে–দ্রাবিড় উৎকল্ বঙ্গ উচ্ছল্ জলধিতরঙ্গ। তুলসীদাসজীও তার রামায়ণে ছন্দের প্রয়োজনে অনেক জায়গায় অ স্থানে আ করেছেন, যেমন, সুনি প্রভু বচন হরস হনুমানা, শরণাগত বচ্ছল ভগবানা। আপনাদের বানানেও গলদ আছে। অ-কার হচ্ছে হ্রস্ব স্বর, তার আসল উচ্চারণ ভুলে গিয়ে তাকে awful করেছেন কেন? হ্রস্ব অ-কার বোঝাবার জন্য আপনারা দীর্ঘ আ-কার দেন কোন হিসাবে? bus club Punjab (পঞ্জাব) স্থানে বাস ক্লাব পাঞ্জাব লেখেন কেন?
.
বাঙলা বানান নিয়ে বহু বিতর্ক হয়ে গেছে, এখন আর সেসব পুরনো কথার আলোচনা করব না। কতকগুলি শব্দের বানানে যে বৈষম্য, বাহুল্য বা জটিলতা দেখা দেয় তার সম্বন্ধে কিছু বলছি।
বাঙলা আসামী ওড়িয়া হিন্দী মরাঠী গুজরাটী প্রভৃতি আর্যভাষার মধ্যে অনেক মিল আছে। এই মিল যত বজায় রাখা যায় ততই মঙ্গল। বাঙলা বইএর গুণগ্রাহীঅবাঙালী পাঠকবিঘ্নআছেন। আমরা যদি বাঙলা বানানে অনর্থকবৈষম্য আনি তবে অবাঙালী পাঠকের পক্ষে তা দুর্বোধ হবে, তার ফল বাঙলা সাহিত্যের পক্ষে লাভজনকহবেনা।
সংস্কৃতে অ কণ্ঠ্য বর্ণ, তার মূল উচ্চারণ upএর আদ্যক্ষর তুল্য। এই হ্রস্ব অ টেনে উচ্চারণ করলেই আ হয়। ই ঈ যেমন মূলত একই ধ্বনি, শুধু প্রথমটি হ্রস্ব আর দ্বিতীয়টি দীর্ঘ তেমনি অ আ মূলত একই, শুধু প্রথমটি হ্রস্ব আর দ্বিতীয়টি দীর্ঘ। ইংরেজী fur যদি টেনে দীর্ঘ করা হয় তবে far হয়ে যায়। পঞ্চাশ-ষাট বৎসর আগে কলেক্টর পায়োনিয়র সর (Sir) ক্লব ইত্যাদি বানান প্রচলিত ছিল। তখন অ-কারের মৌলিক অর্থাৎ upএর আদ্যক্ষর তুল্য উচ্চারণ আমাদের অভ্যস্ত ছিল, তার ফলে বাঙলা হিন্দী প্রভৃতি ভাষায় বহু শব্দে একই বানান চলত। বাঙালী তখন স্থানভেদে অ-কারের চার রকম উচ্চারণ করত, যেমন কটা, কটু, একটু, টি-কপ। কটা শব্দে অ-কারের উচ্চারণ সংবৃত, অর্থাৎ ইংরেজী awe শব্দের তুল্য। এই উচ্চারণ হিন্দীতে নেই। কটু শব্দের অ-কার ও-কারের তুল্য। এও হিন্দীতে নেই। একটু শব্দে অ-কার গ্রস্ত, অর্থাৎ ক-অক্ষর হসন্ত তুল্য। টি-কপ শব্দে ক-এর উচ্চারণ বিবৃত, অর্থাৎ ইংরেজী cupএর তুল্য, কিন্তু আধুনিক বাঙালী অ-কারের শেষোক্ত হ্রস্ব উচ্চারণ ভুলে গেছে, তার ফলে অ-কার স্থানে আ-কার চলছে, যেমন ক্লাব, বাস, সার্কাস, কাটলেট। মাঝে মাঝে নাম্বারও দেখতে পাই, কিন্তু জজ এখনও জাজ হন নি।
হিন্দী মরাঠী গুজরাটীতে অ-কারের শুধু বিবৃত বা হ্রস্ব, এবং গ্রস্ত বা হসন্তবৎ উচ্চারণ আছে। কল বন বট-এর হিন্দী উচ্চারণ cull, bun, butএর তুল্য। গ্রস্ত অ-কার হিন্দীতে খুব বেশী, আমাদের জনতা বিমলা কামনা হিন্দী উচ্চারণে জন্তা, বিম্লা, কান্না। কিন্তু হিন্দীতে সংবৃত অর্থাৎ awe-তুল্য অ-কার নেই, তা বোঝাবার জন্য আ-কার লেখা হয়, যেমন royal-রায়ল, talky-টাকি। সেকালে বাঙালীও এই রকম বানান করত, তার কয়েকটি নিদর্শন এখনও রয়ে গেছে, যেমন কালেজ, আগস্ট, লাট (lord বা lot)। ষাট-সত্তর বৎসর আগে law স্থানে লা লেখা হত।
এককালে আমাদের অ-কারের যে শক্তি ছিল তা ফিরিয়ে আনা উচিত মনে করি। হ্রস্ব অ-কার স্থানে আ-কারের প্রয়োগ খুব বেশীদিনের নয়। ১৮৬৫ সালে প্রকাশিত দুর্গেশনন্দিনীর আখ্যাপত্রে আছে–অপর সরকিউলর রোড। রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থের পুরনো মুদ্রণে কটলেট, থর্ড ইত্যাদি বানান দেখা যায়। আমাদের লেখকরা একটু চেষ্টা করলেই আকারের অপপ্রয়োগ বন্ধ করে অ-কারের মৌলিক বিবৃত হ্রস্ব উচ্চারণ ফিরিয়ে আনতে পারেন। Bus স্থানে বাস না লিখে বস লিখলে কোনও ক্ষতি হবে না, সাধারণ লোকে এখন যতটা বিকৃত উচ্চারণ করে তার চাইতে বেশী বিকৃত করবে না। স্থানভেদে অ-কারের চার রকম উচ্চারণই বাঙলায় চলতে পারে, তাতে অবাঙালী পাঠকের উচ্চারণ ভুল হলেও অর্থবোধে বাধা হবে না। জন-গণ-মন গানে সংবৃত অ-কার বোঝাবার জন্য যদি বঙ্গা-তরঙ্গা লেখা হয় তাতে আমাদের আপত্তির কারণ নেই। আমরাও তো হিন্দী হৈ স্থানে হ্যায় লিখি।
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-নিযুক্ত বানান-সমিতির নিয়মে অসংস্কৃত শব্দে ণ বাদ দিয়ে শুধু ন লেখার বিধান আছে। হিন্দী প্রভৃতিতেও অসংস্কৃত শব্দে ণ নেই, রানী, বরন (বর্ণ), মন (চল্লিশ সের) লেখা হয়। বাঙলায় গিণি সোণা মূর্ধন্য ণ দিয়ে কেন লেখা হয় জানি না, হয়তো সোনার গৌরব-বৃদ্ধির জন্য।
বানান-সমিতির আর একটি নিয়ম–কয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে বিদেশী শব্দে মূল উচ্চারণ অনুসারে s স্থানে স এবং sh স্থানে শ হবে, যেমন, ইশারা তামাশা শয়তান শেমিজ-এ তালব্য শ, কিন্তু আসমান জিনিস সাদা নোটিস পুলিস-এ দন্ত্য স। হিন্দী প্রভৃতিতে এই রীতি মানা হয়, বাঙালী মুসলমান লেখকরাও তা মানেন। সকলেই এই নিয়মে বানান করলে সামঞ্জস্য আসবে।
আর একটি বিষয় বিচারের যোগ্য। অনেক শব্দে অনর্থক apostrophe বা ঊর্ধ্ব কমা দেখতে পাই। বার্নার্ড শ, পাঁচ শ ইত্যাদিতে ঊর্ধ্ব কমার সার্থকতা কি? না দিলেও লোকে শএর ঠিক উচ্চারণ করবে, কেউ শ বলবে না। দুদিন, নটাকা ইত্যাদি বানানে ঊর্ধ্ব কমার কিছুমাত্র প্রয়োজন দেখি না। দুই থেকে দু, নয় থেকে ন হয়েছে তা জানাবার কি দরকার? দু ছ ন শ ইত্যাদি স্বপ্রতিষ্ঠ শব্দ, এদের ব্যুৎপত্তি না জানালে কোনও ক্ষতি হয় না। সাধু রূপ তাহা তাহাকে তাহাতে তাহার থেকে চলিত রূপ তা তাকে তাতে তার হয়েছে, কিন্তু ঊধ্ব কমা দেওয়া হয় না।
লখনউএর যারা বাসিন্দা তারা সরল বানান লেখে ল খ ন উ, কিন্তু বাঙালী অনর্থক লক্ষ্ণৌ লেখে কেন? দরভঙ্গায় দ্বার নেই, বঙ্গের সঙ্গেও সম্পর্ক নেই, তবু দ্বারবঙ্গ লেখা হয় কেন? আর একটা উৎকট বানান sir স্থানে স্যার। যেমন ক্যাট হ্যাট ব্যাট, তেমনি স্যার। শুধু সার লিখলেই চলে, সেকেলে বানান সর আরও ভাল মনে করি।
অনেকে মনে করেন বিদেশী শব্দের হসন্ত উচ্চারণ বোঝাবার জন্য শেষে হচিহ্ন দিতেই হবে। এঁরা লেখেন–কাটলেট, টি-পট, প্লেট, ডিশ। হসচিহ্ন না দিয়ে যদি শুধু ডিশ লেখা হয় তবে লোকে ডিশঅ পড়বে এমন ভয় আছে কি? অনর্থক হসচিহ্ন দিয়ে লেখা কণ্টকিত করায় লাভ নেই। অনেকে মেইন, চেইন, টেইল লেখেন। এঁদের যুক্তি ইংরেজী শব্দে । অক্ষর আছে, উচ্চারণেও তার প্রভাব পড়ে। এই যুক্তি মিথ্যা। এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষায় যথাযথ প্রকাশ করা যায় না, কাছাকাছি বানানে হলেই যথেষ্ট। মেইন, চেইন ইত্যাদি লিখলে লোকে ই-কারের উপর অতিরিক্ত জোর দেয়। আর একটি ভয়ংকর বানান মাঝে মাঝে দেখি–কেইক অর্থাৎ কেক। ই-কার না দিলে কি ক্যাক পড়বার ভয় আছে?
শিক্ষার আদর্শ
শিক্ষার আদর্শ (১৮৮০/১৯৫৮)
আমার শোবার ঘরের পাশে একটা বকুল গাছ আছে, এক জোড়া বুলবুলি আর গোটাকতক শালিক চড়াই তাতে রাত্রিযাপন করে। চৈত্র মাসে নূতন পাতা গজাবার পর তারা প্রায় সকলেই বিতাড়িত হয়, দুটো কাগ এসে গাছে বাসা বাঁধে। নিশ্চয় একটা পুরুষ আর একটা স্ত্রী। কিছুদিন পরে দেখি, বাসার খড়কুটোর মধ্যে একটা কদাকার বাচ্চা প্রকাণ্ড হাঁ করছে, তার মা নিজের ঠোঁট দিয়ে সন্তানের লাল মুখের ভিতর খাবার পুরে দিচ্ছে। শিশু কাগ ক্রমশ বড় হয়ে ওঠে, তার মুখের ব্যাদান আর রক্তিমা কমে আসে, সে নিজের ঠোঁট দিয়ে মায়ের মুখ থেকে খাবার তুলে নেয়। আরও কিছুদিন পরে দেখি, কিশোর কাগ বাসা ছেড়ে ডালের উপর বসেছে, তার মা তাকে ঠেলা দিচ্ছে, বাচ্চা ভয়ে কা কা করছে, পাখা নাড়ছে, আর দু পায়ের আঙুল দিয়ে ডাল আঁকড়ে আছে। তার পর তরুণ কাগ হঠাৎ শাখাচ্যুত হয়ে ঝটপট করছে, তার মা নিজের দেহ দিয়ে তাকে সামলাচ্ছে। একজন সাঁতারপটু লোক ছোট ছেলেকে যেমন করে সাঁতার শেখায়, কাগের মা তেমনি করে নিজের বাচ্চাকে উড়তে শেখাচ্ছে।
পাখির যা প্রাথমিক শিক্ষা, ওড়া আর আহার সংগ্রহ, তা সে নিজের মায়ের কাছ থেকেই পায়। বাকী যা কিছু সবই তার সহজ প্রবৃত্তি (instinct) আর অভিজ্ঞতার ফল। মাছ ব্যাঙ সাপ ইত্যাদি নিম্নতর প্রাণী পিতামাতার উপর আরও কম নির্ভর করে, তাদের জীবিকার্জনের সামর্থ্য জন্মগত।
আদিম মানুষ পিতা মাতা আর গোষ্ঠীবর্গের কাছ থেকে জীবনযাপনের উপযোগী সকল প্রকার শিক্ষা পায়। সভ্যতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজন বেড়েছে, শিক্ষার ব্যবস্থা ক্রমশ জটিল হয়েছে। আত্মীয়স্বজনের কাছে যা শেখা যায় তা এখন পর্যাপ্ত নয়, সমাজ আর রাষ্ট্রই নানাপ্রকার শিক্ষার ব্যবস্থা করে। ইতর প্রাণী আর আদিম মানুষ পিতামাতা ইত্যাদির কাছে যা শেখে তা যতই সামান্য হক, তাদের জীবনযাত্রার পক্ষে পর্যাপ্ত বা যথেষ্ট। আধুনিক সভ্য মানুষের জন্য যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত আছে তাও কি পর্যাপ্ত? অন্য দেশ সম্বন্ধে আলোচনা না করে আমাদের দেশের কথাই বলছি।
.
প্রচলিত শিক্ষাকে মোটামুটি তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যেতে পারে। (১) সামান্য শিক্ষা, যা সকলের পক্ষেই আবশ্যক এবং পরবর্তী শিক্ষার ভিত্তিস্বরূপ গণ্য হয়। (২) বিশেষ শিক্ষা, যা শিক্ষার্থীর রুচি ও সামর্থ্য অনুসারে নির্ধারিত হয়। (৩) বৃত্তিমুখী শিক্ষা, যার উদ্দেশ্য জীবিকার্জনের উপযোগী কোনও কর্মে জ্ঞান ও পটুতা লাভ।
(১) সামান্য শিক্ষা।– আমাদের দেশে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষার জন্য যেসব বিষয় নির্দিষ্ট আছে সেগুলিকেই সামান্য শিক্ষার অঙ্গ বলা যেতে পারে। মহাত্মা গান্ধীর প্রবর্তিত বুনিয়াদী তালিমও সামান্য শিক্ষা, যদিও তার অঙ্গগুলি কিছু অন্যরকম। নিরক্ষর লোকেও জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, কেউ কেউ কোটিপতি ধনী বা সাধু মহাত্মাও হতে পারে, তথাপি বিদ্যার প্রয়োজন চিরকালই স্বীকৃত হয়েছে। এককালে লেখাপড়া বললে বোঝাত ন্যূনতম বিদ্যা অর্থাৎ নামমাত্র লেখা আর পড়া, আর একটু অঙ্ক করা। ইংরেজীতে এরই নাম three Rs-reading, riting and rithmetic। এই লেখাপড়া কখনই যথেষ্ট গণ্য হয় নি, শাস্ত্র (অর্থাৎ সুশৃঙ্খল কেতাবী বিদ্যা) না পড়লে মানুষ অন্ধবৎ হয়, একথা বিষ্ণুশর্মা হিতোপদেশ গ্রন্থে বলেছেন
অনেকসংশয়চ্ছেদি পরোক্ষার্থস্য দর্শক।
সর্বস্য লোচনং শাস্ত্রং যস্য নাস্ত্যন্ধ এব সঃ।
অনেক সংশয়ের উচ্ছেদক এবং অপ্রত্যক্ষ বিষয়ের প্রদর্শক সকলের লোচনস্বরূপ শাস্ত্রজ্ঞান যার নেই সে অন্ধই।
এদেশে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত যেসব বিষয় পড়ানো হয় তার বার বার পরিবর্তন হয়েছে, তথাপি এইগুলিকে প্রধান অঙ্গ বলা যেতে পারে।
–মাতৃভাষা, ইংরেজী, সংস্কৃত, ভারতের ইতিহাস ও শাসনতন্ত্র, ভূগোল, গণিত, প্রাথমিক বিজ্ঞান ইত্যাদি। এইসব বিদ্যার অল্পমাত্র জ্ঞানও যার নেই সে অন্ধ এব, অর্থাৎ তাকে অশিক্ষিত বলা যেতে পারে।
(২) বিশেষ শিক্ষা। –উল্লিখিত সামান্য শিক্ষায় সকলে তৃপ্ত হয় না, অনেকে কয়েকটি বিদ্যা ভাল করে আয়ত্ত করতে চায়। এই বিশেষ শিক্ষার উদ্দেশ্য অর্থোপার্জন নাও হতে পারে। অনেকে কেবল শখ বা জ্ঞানলাভের জন্যই বিদ্যাবিশেষের চর্চা করেন। হাইকোর্টের জজ ব্যারিস্টার ইত্যাদির মধ্যে গণিত বিজ্ঞান আর সংস্কৃতে উচ্চ উপাধিধারী লোক বিরল নন। এঁরা যে বিশেষ বিদ্যা আয়ত্ত করেছেন তা বিচার সংক্রান্ত কাজের পক্ষে অনাবশ্যক।
এক শ্রেণীর বিদ্যাকে ইংরেজীতে বলা হয় humanities। এই সংজ্ঞাটির অর্থ সুনির্দিষ্ট নয়। মোটামুটি বলা যেতে পারে, লাটিন গ্রীক প্রভৃতি প্রাচীন সাহিত্য এর একটি প্রধান অঙ্গ। কয়েকটি আধুনিক বিদ্যাও এর অন্তর্গত, কিন্তু পরীক্ষা ও প্রযুক্তিমূলক বিজ্ঞান (experimental and applied science) নয়। কলেজের পাঠ্য বিষয়কে সাধারণত দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়, আর্টস্ ও সায়েন্স। সায়েন্সের প্রতিশব্দ আছে–বিজ্ঞান। খবরের কাগজে আর্টস্ স্থানে কলা দেখতে পাই, কিন্তু এই অনুবাদ অন্ধ নকল। আর্টস্ বললে যেসব কলেজী বিদ্যা বোঝায় তাদের কলা নাম দিলে উপহাস করা হয়। আর্টস্ আর হিউম্যানিটিজকে যুক্তভাবে সাহিত্যাদিবর্গ বলা যেতে পারে। প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য এবং ইতিহাস জীবনচরিত দর্শন সমাজ সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয় সাহিত্যাদির অন্তর্গত।
ষাট-সত্তর বৎসর পূর্বে কলেজের উচ্চতর শ্রেণীতে বিজ্ঞানের চাইতে সাহিত্যাদিবর্গের ছাত্র বেশী দেখা যেত। তখন বিজ্ঞ লোকেরা বলতেন, সায়েন্স তো ছেলেখেলা, আসল বিদ্যা হচ্ছে ইংরেজী সাহিত্য, তার পরে ফিলসফি। এখন রুচির পরিবর্তন হয়েছে, বিজ্ঞানের ছাত্রই আজকাল বেশী। এই পরিবর্তনের কারণ, সাহিত্যাদি শিখলে জীবিকার্জনের যত সম্ভাবনা, বিজ্ঞান শিখলে তার চাইতে বেশী। ভারত সরকার শিল্পবর্ধনের ব্যাপক পরিকল্পনা করেছেন, তার ফলে বিজ্ঞানীর চাকরি পাবার সম্ভাবনা বেড়ে গেছে। অর্থবিদ্যা (economics), বাণিজ্য (commerce) প্রভৃতি বিশেষ বিদ্যাও আজকাল জনপ্রিয় হয়েছে, শিখলে জীবিকার ক্ষেত্র প্রসারিত হয়।
(৩) বৃত্তিমুখী শিক্ষা। –এই শ্রেণীর শিক্ষা হাতেকলমে না শিখলে সম্পূর্ণ হয় না। আইন আর এঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা বৃত্তিমুখী, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ নয়। ডাক্তারি শিক্ষার পদ্ধতিকেই প্রকৃতপক্ষে বৃত্তিমুখী বলা চলে। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র রোগীর সাক্ষাৎ সম্পর্কে আসেন, চিকিৎসা কার্যেও সাহায্য করেন, সেজন্য তার বৃত্তির উপযোগী প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ হয়। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টান্ট পদের শিক্ষার্থীও ভবিষ্যৎ মক্কেল শ্রেণীর সম্পর্কে আসেন, সেজন্য তাঁর শিক্ষাও যথার্থ বৃত্তিমুখী। আইন শিক্ষার্থীকে যদি বাদী প্রতিবাদীর সম্পর্কে আনা হত এবং মকদ্দমা চালাবার কিছু ভার দেওয়া হত, এঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার্থীকে দিয়ে যদি নূতন ব্রিজ বাঁধ বা কারখানার প্ল্যান এস্টিমেট আর তদারকের কাজ কিছু কিছু করানো হত, তবেই তাদের শিক্ষা যথার্থ বৃত্তিমুখী হত।
.
মানুষের শৈশবে যার আরম্ভ হয় এবং জীবিকানির্বাহের উপযোগী কর্মে নিয়োগ পর্যন্ত যা চলে, যাতে যথাসম্ভব শরীর আর মনের উৎকর্ষ এবং অর্থোপার্জনের যোগ্যতা লাভ হয়, সেই সমগ্র শিক্ষাই পর্যাপ্ত শিক্ষা। এরূপ শিক্ষার উদ্দেশ্য–সকল লোকেরই সামর্থ্য অনুযায়ী বিদ্যা আর জীবিকার বিধান। শুনতে পাই সোভিএট রাষ্ট্রে সমস্ত প্রজার জন্য এই ব্যবস্থা আছে, কিন্তু সেখানে কর্ম নির্বাচনে প্রজার ইচ্ছা-অনিচ্ছা কতটা গ্রাহ্য হয় জানি না। ভারতে এবং অন্যান্য সকল দেশে অল্পসংখ্যক প্ৰজাই সরকারী কাজ পায়, বাকী সকলকেই নিজের চেষ্টায় জীবিকার যোগাড় করতে হয়। আমাদের দেশে সকলে কাজ পায় না, সেজন্য বেকারের সংখ্যা ক্রমশ ভয়াবহ হয়ে উঠছে।
বন্দে মাতরম্ স্তোত্রে বঙ্কিমচন্দ্র স্বদেশকে ধরণীং ভরণীং বলেছেন, অর্থাৎ বঙ্গমাতা তার সন্তানগণকে ধারণ করেন, ভরণও করেন। এখন নানা কারণে আমাদের মাতৃভূমির ধারণ ও ভরণের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে। সকল প্রজার উপযুক্ত পর্যাপ্ত শিক্ষা আর জীবিকার সংস্থান শীঘ্র সম্ভাব্য না হলেও কল্যাণ রাষ্ট্র বা ওয়েলফেয়ার স্টেটের লক্ষ্য তাই হওয়া উচিত।
শিক্ষা যদি পর্যাপ্ত বা বৃত্তিমুখী নাও হয় তথাপি জীবিকার্জনের উপযোগী হতে পারে। যারা কেবল সাহিত্যাদি বিদ্যায় ব্যুৎপন্ন তাঁরাও রাষ্ট্রের অতি উচ্চ পদ পেতে পারেন, সরকারী বিভাগের অধিকর্তা, রাজনীতিক, অধ্যাপক, লেখক, সম্পাদক, ব্যবসায়ী ইত্যাদি হতে পারেন। যাঁরা বিজ্ঞানাদি বিশেষ বিদ্যা আয়ত্ত করেন অথবা বৃত্তিমুখী শিক্ষা লাভ করেন তাদের জীবিকার ক্ষেত্র অবশ্য আরও বিস্তৃত।
আমাদের শিক্ষালাভের তিনটি পর্যায় আছে- (১) পাঠশালা ও স্কুল, (২) কলেজ, (৩) বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া, প্রায়োগিক (technical) ও বৃত্তিমুখী শিক্ষার জন্য কতকগুলি পৃথক শিক্ষালয় আছে, যেমন মেডিক্যাল, এঞ্জিনিয়ারিং ও ল কলেজ, চারু ও কারু শিল্প বা arts and craftsএর শিক্ষালয়, সংগীত শিক্ষালয় ইত্যাদি। এইপ্রকার কয়েকটি প্রতিষ্ঠান কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্গত।
ইংরেজী ইউনিভার্সিটি শব্দের অনুকরণে বিশ্ববিদ্যালয় শব্দ রচিত হয়েছে। এই বৃহৎ শব্দটির বদলে একটি ছোট নাম চালাতে পারলে সকলেরই সুবিধা হয়। বিদ্যামণ্ডল, বিদ্যাচ, বিদ্যাকুল, এইরকম কিছু চালানো যায় না কি?
নামের আদিতে বিশ্ব থাকলেও তার মানে এই নয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবতীয় বিদ্যা শেখাবার ব্যবস্থা আছে। শিক্ষণীয় বিষয় আর শিক্ষার্থীর বাহুল্য হলে সকল ক্ষেত্রে ফল ভাল হয় না। প্রাচীনকালের কুলপতি বিপ্রর্ষিরা তাঁদের আশ্রমে নাকি দশ সহস্র মুনিকে পালন করতেন আর শিক্ষা দিতেন। নালন্দা প্রভৃতি, বিহারেও অসংখ্য বিদ্যার্থী থাকত। তিন-চার শ বৎসর আগেও বিদ্যার সংখ্যা কম ছিল, মেধাবী লোকে চেষ্টা করলে সর্ববিদ্যাবিশারদ হতে পারত। কিন্তু এখন বিদ্যার (বিশেষত বিজ্ঞানের) শাখা প্রশাখা অত্যন্ত বেড়ে গেছে, আজকাল সর্বজ্ঞ বা বহুজ্ঞের চাইতে বিশেষজ্ঞের আদর বেশী। ইংরেজীতে একটি পরিহাস আছে–বিশেষজ্ঞ তাকেই বলে যিনি অল্প বিষয় সম্বন্ধে বিস্তর জানেন। অতএব গণিতের পদ্ধতি অনুসারে বলা চলে–শূন্য বিষয় সম্বন্ধে যাঁর অনন্ত জ্ঞান আছে তিনিই চরম বিশেষজ্ঞ।
সেকালের অসংখ্য বিদ্যার্থী সমন্বিত ঋষিকুল বা বিহারের অনুরূপ ব্যবস্থা এখন অচল। যেখানে কয়েকটি বিদ্যার প্রকৃষ্ট চর্চার ব্যবস্থা আছে সেই বিদ্যামণ্ডলই প্রশস্ত। অতিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের যাঁরা প্রধান তারা যদি প্রশাসন বা পরিচালন নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তবে অধ্যাপনা উপেক্ষিত হবে।
পাশ্চাত্ত্য দেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিদ্যাচর্চার খ্যাতি আছে। প্রাচীন ভারতে তক্ষশিলা আয়ুর্বেদ চর্চার জন্য, উজ্জয়িনী জ্যোতিষের জন্য, মিথিলা জনক রাজার কালে অধ্যাত্ম বিদ্যার জন্য এবং পরবর্তীকালে ন্যায়শাস্ত্র চর্চার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। বর্তমান কালে আমাদের দেশেও বিভিন্ন বিদ্যামণ্ডলের বৈশিষ্ট্য থাকা বাঞ্ছনীয়। সকল বিশ্ববিদ্যালয় একই ছাঁচে গড়ে উঠলে ফল ভাল হবে না। |||||||||| বিশ্বভারতী এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে। শুনতে পাই সেখানকার শিক্ষার ব্যবস্থা কি রকম হওয়া উচিত তা নিয়ে প্রবল মতভেদ আছে। এক দল নাকি বলেন, সেকেলে আশ্রমিক ব্যবস্থা চলবে না, এখন আধুনিক পাশ্চাত্ত্য পদ্ধতি মেনে নিতে হবে। আর এক দল বলেন, গুরুদেবের যে আদর্শ ছিল, তিনি যে রীতি চালিয়ে গেছেন তা থেকে কিছুমাত্র স্খলন হলে বিশ্বভারতী পণ্ড হবে।
প্রতিষ্ঠাতার আদর্শ আর তাঁর প্রবর্তিত রীতির অনুসরণ করলে বিশ্বভারতীর অগ্রগতি ব্যাহত হবে–এই ধারণার কারণ দেখি না। কলিকাতা প্রভৃতি অতিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যা শেখানো হয়, উচ্চ বিজ্ঞানাদি শেখাবার যে রকম ব্যবস্থা আছে, বিশ্বভারতীতে ঠিক সে রকম না হলে ক্ষতি কি? কবিগুরুর জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে আর বিশ্বভারতীতে যা শিক্ষণীয় ছিল তা প্রধানত সাহিত্যাদি বিদ্যা হিউম্যানিটিজ ও আর্টস্, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাসাদি, তা ছাড়া চিত্র সংগীত ইত্যাদি চারুকলা আর কয়েকটি কারুকলা। শিক্ষার সেই বৈশিষ্ট্য আর পরিধি বজায় রেখেই বিশ্বভারতীর অগ্রগতি ও বিবৃদ্ধি হতে পারে। পূর্বে যে সামান্য শিক্ষার কথা বলেছি (যা সকলের পক্ষেই অপরিহার্য) তারই অঙ্গ হিসাবে বিজ্ঞান শিক্ষার সীমা যদি আই এস-সি শ্রেণী পর্যন্তই রাখা হয় এবং বহুবিধ বিজ্ঞান চর্চার আয়োজন যদি নাও হয় তাতেই বা ক্ষতি কি? যেসব ছাত্র উচ্চতর বিজ্ঞান অথবা চিকিৎসা বাস্তুবিদ্যা যন্ত্রবিদ্যা প্রভৃতি প্রায়োগিক বা বৃত্তিমুখী বিদ্যা শিখতে চায় তারা কলকাতায় বা অন্যত্র শিক্ষালাভ করতে পারে। Liberal education বা উদার শিক্ষা বা polite learning বা ভব্য শিক্ষা বললে যা বোঝায় তাই বিশ্বভারতীর বৈশিষ্ট্য হতে পারে। কবিগুরুর যা একান্ত কাম্য ছিল–বিভিন্ন দেশের মনীষীদের চিন্তার আদান-প্রদান, বিশ্বভারতী যদি সেই মিলনের ক্ষেত্র হয় তা হলেও তার প্রতিষ্ঠা সার্থক হবে।
গাছতলায় বা কঁকা জায়গায় বিনা চেয়ার টেবিলে পঠন-পাঠনের পদ্ধতি যথাসম্ভব বজায় রাখলে বিশ্বভারতীর মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে না। প্রাসাদের বদলে আটচালাতেও উচ্চ শিক্ষা চলতে পারে। বাহ্য আড়ম্বরের চাইতে বিদ্বান কুশলী ও সন্তুষ্ট অধ্যাপকবর্গের প্রয়োজন অনেক বেশী। পণ্ডিত নেহরু সম্প্রতি এ সম্বন্ধে যা বলেছেন তা সকল বিদ্যাস্থান সম্বন্ধেই প্রযোজ্য।
সাহিত্যের পরিধি
সাহিত্যের পরিধি (১৮৭৯/১৯৫৭)
রাম আর শ্যাম ঘোড়া নিয়ে তর্ক করছে। রাম সজোরে বলছে, ঘোড়ার মাপ অন্তত তিন হাত। ততোধিক জোরে শ্যাম বলছে, ঘোড়া দেড় ইঞ্চির বেশী হতেই পারে না। এরা কেউ দু রকম অর্থ স্বীকার করে না। ঘোড়া বললে রাম বোঝে যে ঘোড়া ঘাস খায়, আর শ্যাম বোঝে যা টিপলে বন্দুকের আওয়াজ হয়।
এই তর্কের হেতু–পৃথক বস্তু বোঝাবার জন্য একই শব্দের প্রয়োগ। এ রকম তর্ক বড় একটা শোনা যায় না, কিন্তু আর এক রকম তর্ক আছে যাতে শব্দের বাচ্যার্থ একই কিন্তু অর্থের ব্যাপ্তি সমান নয়। যেমন, যদু বলছে, ছানা আর চিনি একত্র পাক করলে যা হয় তারই নাম সন্দেশ। মধু বলছে, নাগ মশাই দে-মশাই সেন-মশাই আর গগুমশাই যা তৈরি করেন তাই হল সন্দেশ, আর সব সন্দেশই নয়। যারা আসল আর ভুয়ো গণতন্ত্র, সচ্চা আর ঝুটা আজাদি, খাঁটী আর ভেজাল হিন্দুধর্ম, ইত্যাদি নিয়ে বিতণ্ডা করে তারাও এই দলে পড়ে।
সাহিত্য সম্বন্ধে মাঝে মাঝে যে তর্ক শোনা যায় তা অনেকটা যদু-মধুর তর্কের তুল্য। তর্ককারীরা নিজের নিজের পছন্দসই গণ্ডির মধ্যে সাহিত্য শব্দের অর্থ আবদ্ধ রাখতে চান। কেউ বলেন, সাহিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য রসসৃষ্টি। কেউ বলেন শুধু রসে চলবে না, উচ্চ আদর্শ চাই। সংস্কৃতে কাব্য আর সাহিত্য প্রায় সমার্থক। কিন্তু আধুনিক প্রয়োগে সাহিত্যের পরিধি অনেক বেড়ে গেছে। Concise Oxford Dictionaryতে literatureএর fasho oncs–writings whose value lies in beauty of form or emotional effect; the books treating of a subject; (colloq.) printed matter। বাঙলায় সাহিত্য শব্দ আজকাল যেসব অর্থে চলে তা এই ইংরেজী বিবৃতির অনুরূপ।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর অন্তরঙ্গ জনকে অনেক চিঠি লিখেছেন। মথুর কুণ্ডুও পাটের দর জানাবার জন্য শিবু শাকে চিঠি লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথ যা লিখেছেন তাই প্রকৃত চিঠি, আর মথুর কুণ্ডু যা লিখেছেন তা কিছুই নয়–এ কথা বলা চলে না। তুচ্ছ মহৎ ভাল মন্দ যাই হক, কবি প্রেমিক উকিল বা পাওনাদার যিনিই লিখুন, সমস্ত চিঠির সামান্য লক্ষণ–একজন অপর জনকে কিছু জানাবার জন্য যা লেখে। সাহিত্যেরও সামান্য লক্ষণ বলা যেতে পারে–একজন (বা এক দল) বহু জনকে কিছু জানাবার জন্য যা লেখে। সাহিত্য অতি তুচ্ছ হতে পারে, পাগলের প্রলাপ, বিপক্ষকে গালাগালি, বিজ্ঞাপন, টেক্সটবুক, সংবাদপত্র, কবিতা, গল্প, জ্ঞানগর্ভ রচনা বা তত্ত্বকথা হতে পারে, তার পাঠকসংখ্যা নগণ্য বা অগণ্য হতে পারে। আপনার আমার যা ভাল লাগে কিংবা নামজাদা সমালোচক যাকে রসোত্তীর্ণ বলেন তাই সাহিত্য এবং আর সবই অসাহিত্য, এমন মনে করলে অর্থবিভ্রাট হবে। সাহিত্যের আধুনিক অর্থ অতি ব্যাপক। কাব্যসাহিত্য, কথাসাহিত্য, শিশুসাহিত্য, বৈষ্ণবসাহিত্য, রবীন্দ্রসাহিত্য তো আছেই, তা ছাড়া দর্শন বিজ্ঞান ইতিহাস জীবনী সমালোচনা বিজ্ঞাপন স্কুলপাঠ্য-সাহিত্য প্রভৃতি, এমন কি অশ্লীল সাহিত্যও শোনা যায়। এই সব প্রয়োগে সাহিত্যের অর্থ, the books treating of a subject, কোনও বিষয় সংক্রান্ত পুস্তকসমূহ।
আজকাল গাড়ি বললে বড়লোকরা বোঝেন মোটরকার। সেইরকম অনেক শিক্ষিত জন সাহিত্য শব্দে বোঝেন ললিত সাহিত্য, অর্থাৎ সর্বাগ্রে গল্প-উপন্যাস, তার পর কবিতা নাটক লঘুপ্রবন্ধ ও ভ্রমণকথা। Writings whose value lies in beauty of form or emotional effect, 715 রচনাপদ্ধতি বা ভাষা মনোহর অথবা যা ভাবের উদ্রেক করে–এই অর্থই এখন অনেকে সাহিত্যের একমাত্র অর্থ মনে করেন। সাহিত্যদর্পণকারও বলেছেন, রসাত্মক বাক্যই কাব্য (= সাহিত্য)।
আত্মব্যঞ্জনা বা self-expressionএর জন্য মানুষ নানা প্রকার চেষ্টা করে, তারই একটির ফল সাহিত্য। সাহিত্যের মধ্যে উচ্চ নীচ ভাল মন্দ সবই আছে। কিন্তু সকল পাঠকের রুচি সমান নয়, একই পাঠকেরও রুচির বৈচিত্র্য থাকতে পারে। রাম সন্দেশ ভালবাসে, কিন্তু জিলিপি ছোঁয় না। শ্যামও সন্দেশের ভক্ত, কিন্তু সময়ে সময়ে জিলিপিই বেশী পছন্দ করে। অধিকাংশ লোকের মতে সন্দেশই শ্রেষ্ঠ, কিন্তু কি রকম সন্দেশ? ভারত সরকার তেল ঘি ইত্যাদি অনেক জিনিসের standard বেঁধে দিয়েছেন, হয়তো ভবিষ্যতে এক-দুই-তিন নম্বর সন্দেশের উপাদানের অনুপাত নির্দেশ করে দেবেন। কিন্তু এক-দুই-তিন নম্বর সাহিত্যের মান বেঁধে দেবার শক্তি সাহিত্য আকাডেমিরও নেই। বহু লোকের মতে বা পুলিশের দৃষ্টিতে যা অনিষ্টকর তা বর্জিত বা দমিত হবে, কিন্তু বিভিন্ন পাঠকের রুচি বা প্রয়োজন অনুসারেই অন্যান্য সাহিত্য প্রচলিত থাকবে।
অধিকাংশ জনপ্রিয় রচনার উপজীব্য মানুষের আচরণ ও চিত্তবৃত্তি, এবং সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। কিন্তু এমন রচনাও উৎকৃষ্ট ও সমাদৃত হতে পারে যার পাত্র-পাত্রী আর ঘটনাবলী অপ্রাকৃত, যেমন Penguin Island, Animal Farm, রবীন্দ্রনাথের তাসের দেশ ইত্যাদি। ডিটেকটিভ এবং রহস্যমূলক রোমাঞ্চকর গল্পে emotional effect প্রচুর থাকে, তার পাঠকসংখ্যাও সকল দেশে সব চাইতে বেশী, তথাপি এই শ্রেণীর রচনা শ্রেষ্ঠ সাহিত্য গণ্য হয় না। দৈবাৎ ব্যতিক্রম দেখা যায়, যেমন Conan Doyleএর Sherlock Holmesএর গল্প ক্লাসিক সাহিত্যের সম্মান পেয়েছে। Lewis Carrollএর Alice in Wonderland ছোট ছেলে-মেয়েদের জন্য লিখিত হলেও সকল পাঠকের সমাদর পেয়ে চিরায়ত হয়েছে। সুকুমার রায়ের আবোলতাবোল আরও উচ্চ শ্রেণীর রচনা মনে করি। চিত্র আর তক্ষণ কলায় যেমন impressionistic style এবং অবাস্তব সংস্থান দ্বারা রসসৃষ্টি করা হয়, সুকুমার রায় তাঁর ছড়া রচনায় সেইরূপ পদ্ধতির সার্থক প্রয়োগ করেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের পাঠক আর সমালোচকদের মধ্যে রামগরুড়ের ছানার বাহুল্য আছে তাই সুকুমার রায়ের প্রতিভা যথোচিত মর্যাদা পায় নি।
ইংরেজী অভিধানে যে beauty of form or emotional effectএর উল্লেখ আছে, কবি নীলকণ্ঠ দীক্ষিতের একটি শ্লোকে তারই সমর্থন পাওয়া যায়
যানেব শব্দান্ বয়মালপামোঃ
যানেব চার্থান্ বয়মুন্নিখামঃ।
তৈরেব বিন্যাসবিশেষভব্যৈঃ
সম্মোহয়ন্তীহ কবয়ো জগন্তি।
–আমরা যেসব শব্দ বলি, যেসব অর্থ প্রয়োগ করি, তাদেরই বিশেষ প্রকার ভব্য বিন্যাস দ্বারা কবিগণ জগৎকে সম্মোহিত করেন।
কিন্তু form বা শব্দবিন্যাসের উপর যদি অতিরিক্ত নির্ভর করা হয় তবে emotion বা রসের চাইতে ভঙ্গীই বেশী প্রকট হয়। এরূপ রচনার বহু পাঠক হয় না। জেমস জয়েসের অদ্ভুত রচনায় যাঁরা রস পান তাদের সংখ্যা অল্প। আমাদের দেশের কয়েকজন আধুনিক কবির রচনা সাধারণের পক্ষে দুর্বোধ, কিন্তু এক শ্রেণীর সমানধর্মা পাঠকের সমাদর পেয়েছে। বাঙলা কবিতার যাঁরা চর্চা করেন তারা এখন দ্বিধা বিভক্ত। একদল প্রাচীনপন্থী কবিদের কৃপার চক্ষে দেখেন, আর একদল অত্যাধুনিক কবিদের অপ্রকৃতিস্থ মনে করেন। কোনও নূতন পদ্ধতির প্রবর্তনকালে প্রায় মতভেদ দেখা যায়। কালক্রমে সেই পদ্ধতি বর্জিত বা বহুসমাদৃত হতে পারে অথবা চিরদিনই বিতর্কের বিষয় হয়ে টিকে থাকতে পারে। শত বৎসর পূর্বে বাঙলা কবিতায় যমক অনুপ্রাস ইত্যাদি শব্দালংকারের বাহুল্য ছিল, এখন আর নেই। এককালে গদ্য কবিতা অনেকের দৃষ্টিতে উপহাসের বিষয় ছিল, এখন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। আদিরসাত্মক রচনা নিয়ে বোধ হয় চিরদিনই বিতর্ক চলবে।
.
ব্যাপক প্রয়োগে সাহিত্যের আধুনিক অর্থ কোনও বিষয়সংক্রান্ত পুস্তকসমূহ এবং যা কিছু ছাপা হয় (printed_matter)। বিশিষ্ট প্রয়োগে–এমন গ্রন্থ যার রচনাপদ্ধতি বা ভাষা মনোহর, অথবা যা ভাবের উদ্রেক করে, অর্থাৎ যাতে রস আছে।
আর্ট-এর যেমন বাঙলা প্রতিশব্দ নেই, তেমনি রস-এর ইংরেজী নেই। মোটামুটি বলা যেতে পারে, রচনায় যে গুণ থাকলে পড়তে ভাল লাগে তারই নাম রস। অলংকারশাস্ত্রে নবরসের উল্লেখ আছে–আদি (বা শৃঙ্গার), হাস্য, করুণ, অদ্ভুত, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, শান্ত। কৌতূহলও একটা রস, বোধ হয় অদ্ভূতের অন্তর্গত। ডিটেকটিভ গল্পে এই রসই প্রধান। আমাদের আলংকারিকরা রস সম্বন্ধে বিস্তর লিখেছেন, করুণ রস পড়ে লোকে কেন সুখ পায় তাও বোঝাবার চেষ্টা করেছেন।
একশ্রেণীর সমালোচকরা বলেন, শুধু রসে চলবে না, উচ্চ আদর্শ থাকা চাই। সমাজের যা আদর্শ সাহিত্যেরও কি তাই? হিতোপদেশ, প্রবোধচন্দ্রোদয় নাটক, Pilgrims Progress, কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের সভাবশতক ইত্যাদি গ্রন্থে উচ্চ আদর্শ আছে। রাজনীতি থেকে অবসর নিয়ে মুকুন্দ দাস যেসব যাত্রার পালা রচনা করেছিলেন তা নীতিবাক্যে পরিপূর্ণ। ক্ষেত্রবিশেষে এই সব রচনার অবশ্যই প্রয়োজন আছে, কিন্তু সাহিত্যে যদি নীতিকথা বা সামাজিক আদর্শ প্রচারের বাহুল্য থাকে তবে তার রস শুখিয়ে যায়। হ্যামলেট, ম্যাকবেথ, ঘরে বাইরে, দেনাপাওনা, পথের পাঁচালি ইত্যাদিতে উচ্চ আদর্শ কতটুকু আছে? আমরা নিজের জীবনে রোগ শোক নিষ্ঠুরতা কৃতঘ্নতা প্রতারণা ব্যভিচার ইত্যাদি চাই না, ভয়ানক আর বীভৎস রসও পরিহার করি, কিন্তু সাহিত্যে এ সমস্তই রসসৃষ্টির সহায়। পুণ্যের জয় আর পাপের পরাজয়ও সাহিত্যে অত্যাবশ্যক নয়।
ব্যক্তিগত বা সামাজিক আকাঙ্ক্ষা আর সাহিত্যিক আকাক্ষা সমান নয়। মনোবিজ্ঞানীরা এই পার্থক্যের কারণ অনুসন্ধান করেছেন, কিন্তু কোনও বহুসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন নি। সাহিত্যের যে রস সুধীজনের কাম্য তা বহু জটিল উপাদানের সমন্বয়ে গঠিত। আমাদের রসতত্ত্বের জ্ঞান নিতান্ত অস্পষ্ট, art for arts sake, মানবকল্যাণের নিমিত্তই সাহিত্য, মানুষে মানুষে মিলনের জন্যই সাহিত্য, জীবনের আলেখ্যই সাহিত্য–এই ধরনের উক্তিতে রসতত্ত্বের নিদান পাওয়া যায় না। উত্তম সাহিত্য আমাদের আনন্দ দেয়, কিন্তু কোন্ কোন্ রস কি ভাবে যোজিত হলে উত্তম সাহিত্য উৎপন্ন হয় তা আমরা জানি না। অনেক বৎসর পূর্বে এ সম্বন্ধে যা লিখেছিলাম তা থেকে কিছু পুনরুক্তি করছি।*
সাহিত্যের অনেক উপাদান নীতিবিরোধী, অনেক উপাদান পরস্পর বিরোধী, কিন্তু কৃতী রচয়িতা কোনও উপাদান বাদ দেন না। নিপুণ পাঁচক কটু তিক্ত মিষ্ট সুগন্ধ দুর্গন্ধ নানা উপাদান মিশিয়ে সুখাদ্য প্রস্তুত করে। নিপুণ সাহিত্যিকের পদ্ধতিও অনুরূপ। খাদ্যে কতটা ঘি দিলে উপাদেয় হবে, কটা লংকা দিলে মুখ জ্বালা করবে না, কতটা পেঁয়াজ রসুন দিলে উৎকট গন্ধ হবে না,এবং সাহিত্যে শান্তরস আদিরস বা বীভৎসরস, সুনীতি বা দুর্নীতি, একনিষ্ঠ প্রেম বা ব্যভিচার, কত মাত্রায় থাকলে সুধীজনের উপভোগ্য হবে তার নিরূপণের সূত্র অজ্ঞাত। জনকতক ভোক্তার হয়তো কোনও বিশেষ রসে আসক্তি বা বিরক্তি থাকতে পারে, কিন্তু তাদের বিচারই চূড়ান্ত গণ্য হয় না। যিনি শুধু একশ্রেণীর ভোক্তার তৃপ্তিবিধান করেন অথবা জনসাধারণের অভ্যস্ত ভোজ্যই পরিবেশন করেন তিনি সামান্য পেশাদার বা hack writer মাত্র। যাঁর রুচি অভিনব এবং যিনি বহু ভোক্তার রুচিকে নিজের রুচির অনুগত করতে পারেন তিনিই উত্তম সাহিত্যস্রষ্টা। যিনি কোনও লেখকের রচনায় এই গুণ উপলব্ধি করে পাঠকগণকে তৎপ্রতি আকৃষ্ট করতে পারেন তিনিই উত্তম সমালোচক।
.
সকল দেশেই অল্প কয়েকজন বিচক্ষণ বোদ্ধা সাহিত্যের বিচারকরূপে গণ্য হয়ে থাকেন। এঁদের কেউ নির্বাচন করে না, নিজের প্রতিভাবলেই এঁরা বিচারকের পদ অধিকার করেন এবং পাঠকের রুচির উপর প্রভাব বিস্তার করেন। এঁরা কেবল রচনার রস বা উপভোগ্যতা দেখেন না, সমাজের উপর তার সম্ভাব্য প্রভাবও বিচার করেন। পাঠকের আনন্দ আর সামাজিক স্বাস্থ্য দুইএর প্রতিই তিনি দৃষ্টি রাখেন। তাঁর যাচাইএর পদ্ধতি কি রকম তা তিনি প্রকাশ করতে পারেন না, তাঁর নিজেরও বোধ হয় সে সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা নেই। সামাজিক আদর্শ চিরকাল একরকম থাকে না। সে কারণে রচনায় অল্পস্বল্প বিচ্যুতি থাকলে তিনি উপেক্ষা করেন, কিন্তু অধিক বিচ্যুতি মার্জনা করেন না। তার সিদ্ধান্তে মাঝে মাঝে ভুল হতে পারে, কিন্তু শিক্ষিত জন সাধারণত তাঁর অভিমতই প্রামাণিক মনে করেন।
[* সাহিত্যবিচার (লঘুগুরু) দ্রষ্টব্য।– স:।]
স্বাধীনতার স্বরূপ
স্বাধীনতার স্বরূপ (১৮৭৯/১৯৫৭)
স্বাধীন আর পরাধীন দেশের প্রভেদ কি? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলবেন, দেশের লোকেই যেখানে শাসন করে সে দেশ স্বাধীন, বিদেশী যেখানে শাসন করে তা পরাধীন। কিন্তু এত সহজে প্রশ্নটির মীমাংসা হয় না। দেশের কত জন স্বাধীন, কতটা স্বাধীন, কোন্ কোন্ ক্ষেত্রে স্বাধীন, ইত্যাদি নানা বিষয় বিচার করা দরকার।
স্বাধীনতার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ–নিজের ইচ্ছায় চলবার অর্থাৎ যা ইচ্ছা তাই করবার ক্ষমতা। এ রকম নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কোনও দেশের কোনও লোকের নেই, সর্বশক্তিমান ডিকটেটরেরও নেই। সকল রাষ্ট্রেই নাবালক, পাগল, জেলখানার কয়েদী ইত্যাদির স্বাধীনতা অল্প। প্রাচীন স্বাধীন ভারতে স্ত্রী আর শূদ্রের অনেক অধিকার ছিল না, ব্রাহ্মণ গুরু পাপে লঘু দণ্ড পেত, কিন্তু অব্রাহ্মণ নিষ্কৃতি পেত না। কমিউনিস্ট দেশের প্রজার স্বাধীনতা অতি সীমাবদ্ধ। দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যাগুরু অশ্বেতজাতির অনেক অধিকার নেই। বিলাতে ১৯২০ সালের আগে রোমান ক্যাথলিক প্রজার পূর্ণ অধিকার ছিল না, ১৯১৮ সালের আগে মেয়েদের ভোট ছিল না। ব্রিটিশ আমলে ভারতের প্রজা বিনা বাধায় প্রচুর স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির মালিক হতে পারত, কিন্তু সমাজতন্ত্রী স্বাধীন ভারতে সেই অধিকার সংকুচিত হয়েছে। বর্তমান ব্রিটিশ এবং আরও অনেক ইওরোপীয় রাষ্ট্রের অবস্থাও এই রকম। মোট কথা, প্রজার পক্ষে স্বাধীন আর পরাধীন দুই দশাই আপেক্ষিক বা relative
আমরা বলে থাকি, তুর্ক জাতি অর্থাৎ পাঠান-মোগল কর্তৃক ভারত বিজয়ের পর থেকে ১৯৪৭ সালের অগস্ট পর্যন্ত মোটামুটি ৭০০ বৎসর ভারত পরাধীন ছিল। কিন্তু কেউ কেউ বলেন, মুসলমান বিজেতারা ভারতে স্থায়ী ভাবে বসতি করেছিল এবং এদেশের বিস্তর লোক মুসলমান হয়ে বিজেতাদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল, এই কারণে বাদশা-নবাবদের বিদেশী বলা ঠিক নয়, তাদের রাজত্বকালে ভারত পরাধীন ছিল এ কথাও বলা চলে না। এঁদের যুক্তি অনুসারে কেবল ব্রিটিশ অধিকারেই ভারত পরাধীন ছিল। এ দেশের মুসলমানরাও মনে করে, বাদশাহী আর নবাবী আমলে তাদের স্বাধীনতার হানি হয় নি।
আলোচ্য বিষয়টি কি রকম জটিল তা আরও কয়েকটি দেশের ইতিহাস থেকে জানা যাবে। ১০৬৬ খ্রীষ্টাব্দে নরমান্ডির ডিউক উইলিয়ম যখন ইংলান্ড আক্রমণ করে জয়ী হন তখন ইংরেজ জাতি নিশ্চয় পরাধীন হয়েছিল। তার পর শতাধিক বৎসর নরমান অভিজাত বর্গের সর্বময় কর্তৃত্বের সময় দেশের অধিবাসী অ্যাংলোস্যাকসনরা অধীনতার দুঃখ ভাল করেই ভোগ করেছিল। কিন্তু সেই পরাধীন দশা ক্রমে ক্রমে আপনিই বিলীন হয়ে গেল। বিজেতা আর বিজিতদের মধ্যে ভাষাগত ভেদ ছিল, কিন্তু বর্ণগত ধর্মগত আর আচারগত ভেদ ছিল না, সেজন্য নরমান আর অ্যাংলোস্যাকসন শীঘ্রই সম্পূর্ণভাবে মিশে গেল। সুতরাং এ কথা বলা চলে যে নরমান বিজয়ের পর ইংলান্ড দু-এক শ বৎসর মাত্র পরাধীন ছিল।
সপ্তম শতাব্দে ইসলামের উৎপত্তির সময় মিসর পারস্য তাতার প্রভৃতি স্বাধীন ছিল, কিন্তু কয়েক শ বৎসরের মধ্যেই মুসলমান খলিফা এবং আরব যোদ্ধারা এই সব দেশ জয় করে করে নিজের ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করেন। দেশের লোক বিজিত হল, কিন্তু ধর্মান্তরিত হয়ে বিজেতাদের সঙ্গে মিশে গিয়ে সাযুজ্য লাভ করল, তাদের পরাধীনতার কলঙ্ক আর রইল না।
মুসলমান বিজয়ের এইপ্রকার পরিণাম অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঘটলেও কয়েকটি দেশে ব্যতিক্রম দেখা গেছে। স্পেন, সিসিলি, বলকান প্রদেশের কতক অংশ আর ভারতবর্ষ বিজিত হয়েও পুরোপুরি ধর্মান্তরিত হয় নি। স্পেন সিসিলি ইত্যাদি কয়েক শ বৎসরের মধ্যেই বিজেতার কবল থেকে মুক্ত হয়েছিল, কিন্তু ভারতবর্ষ তা পারে নি। কুবলাই খাঁ আর তার উত্তরাধিকারীরা অনেক বৎসর চীন দেশে রাজত্ব করেছিলেন এবং নিজেরাই বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
এ কালে ভারতে যে দেশাত্মবোধ আর সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছে সেকালে তা ছিল না। ভারতবাসী বহু সম্প্রদায়ে বিভক্ত, আপকালেও তাদের ঐক্য ঘটে নি, আক্রামক জাতিদের মতন তারা যুদ্ধনিপুণ ছিল না, তাদের নীতি যভবিষ্য তদৃভবিষ্য। এই সব কারণে ভারত পরাধীন হয়েছিল। ভারতীয় প্রজা চিরকাল ঝাট পরিহার করেছে, ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্যে থেকে চিরাগত ধর্ম আর সমাজবিধি পালন করতে পারলেই কৃতার্থ হয়েছে, রাজা যেই হক তাতে তার বিশেষ আপত্তি ছিল না।
নরমান বিজয়ের পর ইংলান্ডের এবং মুসলমান বিজয়ের পর মিসর। পারস্য প্রভৃতির সর্বাঙ্গীণ পরাধীনতা ঘটেছিল এবং মিশ্রণের ফলে কয়েক শ বৎসরের মধ্যে তা তিরোহিত হয়েছিল। কিন্তু ভারতের পরাধীনতা আংশিক, অর্থাৎ শুধু রাজনীতিক, অত্যাচারিত হয়েও দেশের অধিকাংশ লোক তাদের ধর্মগত আর সমাজগত স্বাতন্ত্র রক্ষা করেছিল। বহুবর্ষব্যাপী নিশ্চেষ্টতার মধ্যেও ভারতবাসীর একটি বিষয়ে দৃঢ়তা ছিল, সে তার সহজং কর্ম (বা ধর্ম) সদোষমপি ত্যাগ করে নি। সমগ্র ভারত যদি পরধর্ম গ্রহণ করত তবে আমাদের পরাধীন দশার স্থিতি সাত শ বৎসর না হয়ে দু শ বৎসর গণ্য হত, অর্থাৎ শুধু ব্রিটিশ অধিকার কাল। সে ক্ষেত্রে সমস্ত মুসলমানের সঙ্গে সাজাত্য অনুভব করে কবি ইকবালের মতন আমরাও হৃত রাজ্যের জন্য বিলাপ করতাম–চীন হমারা, স্পেন হমারা।
অন্য বিষয়ে উদ্যমহীন হয়েও ভারতবাসী তার দৃঢ় স্বধর্মনিষ্ঠা কোথা থেকে পেয়েছে? কেউ কেউ বলবেন, এর মূলে আছে বর্ণাশ্রম ধর্ম। কিন্তু যথার্থ বর্ণাশ্রম আর চাতুর্বর্ণ বহুকাল আগেই লোপ পেয়েছে, তার স্থানে যা এসেছে তা জাতিভেদ বা casteism। এই শতমুখী ভেদবুদ্ধির এমন শক্তি থাকতে পারে না যার দ্বারা বিজেতার ধর্মকে বাধা দেওয়া যায়। ভারতবাসীর প্রকৃতিতে এক প্রকার প্রবল জাড্য বা inertia আছে, সে অজ্ঞাতসারে অনেক পরিবর্তন মেনে নেয় কিন্তু সজ্ঞানে তার নিষ্ঠা ত্যাগ করতে চায় না। হয়তো এই বৈশিষ্ট্যের জন্যই বহিরাগত আঘাত প্রতিহত হয়েছিল। পেগান গ্রীস আর রোমের সংস্কৃতি প্রচুর ছিল, তথাপি সেখানকার লোকে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে খ্রীষ্টান হয়ে গিয়েছিল। ভারতের অসংখ্য ধর্মমত আর লোকাঁচারের মধ্যে এমন কিছু বলিষ্ঠ অবলম্বন আছে যার কাছে বিদেশীর প্রভাব হার মেনেছিল। ইতিহাসজ্ঞ সমাজবিজ্ঞানীরা হয়তো তার সন্ধান পেয়েছেন।
আর একটি বিষয় লক্ষণীয়। পাঁচ শ বৎসরের মুসলমান শাসনের ফলে ভারতবাসীর সংস্কৃতি অবশ্যই কিছু বদলেছে। কিন্তু তার চাইতে বহুগুণ বদলেছে দুশ বৎসরের ব্রিটিশ শাসনে। মুসলমান সংস্কৃতি থেকে গ্রহণযোগ্য বেশী কিছু আমরা পাই নি, কিন্তু ব্রিটিশ বা ইওরোপীয় সংস্কৃতি থেকে প্রচুর পেয়েছি। আমরা খ্রীষ্টীয় ধর্ম নেবার প্রয়োজন বোধ করি নি, কিন্তু ইওরোপীয় আচার কিছু কিছু আত্মসাৎ করেছি এবং সাগ্রহে পাশ্চাত্ত্য বিদ্যা বুদ্ধি ও ভাবধারা অজস্র পরিমাণে বরণ করে নিয়েছি।