কনকবর্মা বললেন, এই বারে বুঝেছি, সখা, তুমি সম্মত আছ?
বিশাখসেন বললেন, অন্য উপায় তো দেখছি না। বেশ, তাই হোক।
সেকালের রথ কতকটা একালের এক্কার মতন। দুটি মাত্র চাকা, হালকা গড়ন, বেশী জায়গা নিত না। সারথি সামনে বসত, তার পাশে বা পিছনে রথী বসতেন। দুই রাজার আদেশে রথের ঘোড়া খুলে ফেলা হল। বোম খাড়া করে তুলে সেই সংকীর্ণ স্থানে সহজেই রথ ঘোরানো গেল। তারপর আবার ঘোড়া জোতা হল। একটু পিছনে হটাতেই দুই রথের পিছন দিক ঠেকে গেল, তখন রাজারা না থেমেই এক রথ থেকে অন্য রথে উঠলেন। দুই রাজবয়স্যও নিজ নিজ প্রভুর পশ্চাতে বসলেন।
অনন্তর কনকবর্মা পিছনে ফিরে বললেন, হে কলিঞ্জর সৈন্যগণ, ব্যাবর্তধ্বম (অর্থাৎ right about turn)। এখন থেকে তোমরা মহারাজ বিশাখসেনের অধীন, উনি তোমাদের সঙ্গে গিয়ে কলিঞ্জর রাজ্য অধিকার করবেন। আমিও বিদর্ভসেনার সঙ্গে গিয়ে বিদর্ভ রাজ্য অধিকার করব।
বিশাখসেনও অনুরূপ ঘোষণা করলেন।
সৈন্যরা অতি সুবোধ, সমস্বরে বললে, রাজাদেশ শিরোধার্য। তারপর কনকবর্মা আর বিশাখসেন একযোগে আজ্ঞা দিলেন, গম্যতাম (অর্থাৎ march)। বিদর্ভসেনা বিদর্ভের দিকে চলল, কনকবর্মার রথ তাদের পিছনে গেল। কলিঞ্জরসেনা কলিঞ্জরে ফিরে চলল, বিশাখসেনের রথ তাদের পিছনে গেল।
যেতে যেতে কনকবর্মা তাঁর বয়স্যকে বললেন, কাজটা কি ভাল হল? রাজ্য বদলের ফলে বিশাখসেনের লাভ আর আমার ক্ষতি হবে। আমার মহিষী তার মহিষীর চাইতে ঢের বেশী সুন্দরী।
কহোড় বললেন, মহারাজ, আপনি যে লোকবাহ্য কথা বলছেন, পরস্ত্রীকেই লোকে বেশী সুন্দরী মনে করে। সর্ব বিষয়ে আপনারই লাভ অধিক হবে। বিদর্ভমহিষী পুত্রবতী, কিন্তু আপনার মহিষী এখনও অনপত্যা। বিদর্ভরাজ্যের ধনভাণ্ডারও অতি বিশাল। ওখানকার অধিপতি হয়ে আপনি ধনে পুত্রে লক্ষ্মীলাভ করবেন।
কনকবর্মা যখন বিদর্ভরাজ্যে পৌঁছলেন তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। তাঁর আদেশে কয়েক জন অশ্বারোহী আগেই রাজধানীতে গিয়ে সংবাদ দিয়েছিল যে রাজ্য বদল হয়ে গেছে, নূতন রাজা আসছেন। কনকবর্মা দেখলেন, তাঁর সংবর্ধনার কোনও আয়োজন হয় নি, পথে আলোকসজ্জা নেই, শাঁখ বাজছে না, হুলুধ্বনি হচ্ছে না, কেউ লাজবর্ষণও করছে না। তিনি অপ্রসন্ন মনে রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হয়ে রথ থেকে নামলেন। কয়েকজন রাজপুরুষ নীরবে নমস্কার করে তাঁকে সভাগৃহে নিয়ে গেল, কহোড়ভট্টও সঙ্গে সঙ্গে গেলেন।
বিদর্ভরাজমহিষী বিংশতিকলা গম্ভীরমুখে সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁকে অভিবাদন করে কনকবর্মা বললেন, পট্টমহিষী, ভাল আছেন তো? পাঁচ বৎসর পূর্বে আপনার বিবাহসভায় আপনাকে তন্বী দেখেছিলাম। এখন আপনি একটু স্থূলাঙ্গী হয়ে পড়েছেন, তাতে আপনার রূপ ষোল কলা পেরিয়ে কুড়ি কলায় পৌঁছে গেছে। সকল সমাচার শুনেছেন বোধ হয়। এখন আমিই এই বিদর্ভরাজ্যের অধিপতি, অভিষেকের ব্যবস্থা কাল হবে। আমি আর আমার বয়স্য এই কহোড়ভট্ট অত্যন্ত শ্রান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়েছি, আজ ক্ষমা করুন, কাল আপনার সঙ্গে বিশ্রম্ভালাপ করব। এখন আমাদের বিশ্রামাগার দেখিয়ে দিন এবং সত্বর আহারের ব্যবস্থা করুন।
একজন সশস্ত্র রাজপুরুষকে সম্বোধন করে মহিষী বিংশতিকলা বললেন, ওহে কোষ্ঠপাল, এই ধৃষ্ট নির্বোধ রাজা আর তার সহচরকে কারাগারে নিক্ষেপ কর। এদের শয়নের জন্য কিছু খড় আর ভোজনের জন্য প্রত্যেককে এক সরা ছাতু আর এক ভাঁড় জল দিও।
কহোড়ভট্ট করজোড়ে বললেন, সে কি রানী—মা, আমাদের এই পরমভট্টারক শ্রীশ্রীমহারাজ আপনার ভগ্নীপতি তো বটেনই, এখন বিদর্ভপতি হয়ে অধিকন্তু আপনার পতিও হয়েছেন। একে ছাতু খাওয়াবেন কি করে? ইনি নিত্য নানা প্রকার চর্ব্য চূষ্য লেহ্য পেয় আহার করে থাকেন।
বিংশতিকলা বললেন, তাই হবে। ওহে কোষ্ঠপাল, এই রাজমূর্খকে দু মুটো ছোলা, এক ছড়া তেঁতুল, একটু গুড়, আর এক ভাঁড় ঘোল দিও। ছোলা চিবুবে, তেঁতুল চুষবে, গুড় চাটবে, আর ঘোলের ভাঁড়ে চুমুক দেবে।
কোষ্ঠপাল বললেন, যথা আজ্ঞা মহাদেবী। আরক্ষিগণ, এদের কারাগারে নিয়ে চল।
কনকবর্মা হতভম্ব হয়ে নীরবে কারাগৃহে গেলেন এবং ক্লান্তদেহে বিষণ্ণ মনে রাত্রিযাপন করলেন। পরদিন প্রাতঃকালে তিনি বললেন, ওহে পণ্ডিতমূর্খ কহোড়, তোমাদের মন্ত্রণা শুনেই আমার এই দুর্দশা হল। এই শত্রুপুরী থেকে উদ্ধার পাব কি করে?
কহোড় বললেন, মহারাজ, ভাববেন না। আমি সারা রাত চিন্তা করে উপায় নির্ধারণ করেছি।
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কনকবর্মা বললেন, তোমার উপর আর ভরসা নেই। বিশাখসেন কেমন আছেন কে জানে, তিনি হয়তো কলিঞ্জর রাজ্যে খুব সুখে আছেন।
কহোড় বললেন, মনেও ভাববেন না তা। আমাদের মহাদেবী কম্বুকঙ্গণাও বড় কম যান না।
এই সময় একজন প্রহরী কারাকক্ষে এসে বললেন, আপনারা শৌচস্থানাদির জন্য ওই প্রাচীরবেষ্টিত উপবনে যেতে পারেন।
কহোড় বললেন, বৎস প্রহরী, শৌচাদি এখন মাথায় থাকুক, একবার রানীমার সঙ্গে আমার দেখা করিয়ে দাও, মহারাজ তোমাকে পুরস্কার দেবেন।
প্রহরী বললে, আসুন আমার সঙ্গে।
রাজমহিষী বিংশতিকলার কাছে এসে কহোড় কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, মহাদেবী, ঢের হয়েছে, আমাদের মুক্তি দিন, ফিরে গিয়েই বিদর্ভরাজ বিশাখসেনকে পাঠিয়ে দেব।
মহিষী বললেন, আগে তিনি আসুন, তার পর তোমাদের মুক্তির বিষয় বিবেচনা করা যাবে।