কনকবর্মা তাঁর এক অশ্বারোহী অনুচরকে বললে, খেটকসিংহ, তুমি এখনই দ্রুতবেগে গিয়ে আমার মুখ্যমন্ত্রীকে ডেকে নিয়ে এস। বিশাখসেন, তুমিও লোক পাঠাও।
কহোড়ভট্ট বললেন, তার কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই, অনর্থক বিলম্ব হবে। আমার পরম বন্ধু মহাপণ্ডিত বিড়ঙ্গদেব এখানে রয়েছেন, আমারও বিদ্যাবুদ্ধির প্রচুর খ্যাতি আছে। আমরা দুজনেই রাজবয়স্য। ঠিক মন্ত্রী না হই, উপমন্ত্রী তো বটেই। পত্নীর স্থান অন্তঃপুরে, পথে তিনি বিবর্জিতা, উপপত্নীই প্রবাসসঙ্গিনী হয়ে থাকে। তদ্রূপ মন্ত্রীর স্থান রাজধানীতে, কিন্তু পর্যটনে ও ব্যসনে উপমন্ত্রীই সহায়। আমরাই মন্ত্রণা করে কিংকর্তব্য স্থির করতে পারব।
দুই রাজা বললেন, উত্তম কথা, তাই কর। কিন্তু বিলম্ব না হয়, বেলা পড়ে আসছে।
কহোড় আর বিড়ঙ্গ রথ থেকে নেমে পরস্পরকে আলিঙ্গন করলেন, তার পর একটি শিলাপট্টে বসে মন্ত্রণা করতে লাগলেন। অনেকক্ষণ পরে কহোড় বললেন, হে নরপতিদ্বয়, শুনতে আজ্ঞা হোক। আমরা দুই বন্ধুতে মিলে আপনাদের সমস্যার একটি উত্তম সমাধান স্থির করেছি, তাতে সৌহার্দের প্রতিজ্ঞা, অগ্রযাত্রার শপথ, এবং উভয়ের মর্যাদা সমস্তই রক্ষা পাবে।
উদগ্রীব হয়ে দুই রাজা বললেন, কি প্রকার সমাধান?
কহোড় বললেন, মহারাজ কনকবর্মা! আপনি রাজধানী থেকে এক দল নিপুণ খনক আনান, তারা অগস্ত্যদ্বারের তলা দিয়ে একটি সুড়ঙ্গ খনন করুক। সেই সুড়ঙ্গপথে আপনি দক্ষিণ দিকে এবং উপরের পথে বিদর্ভরাজ বিশাখসেন উত্তরদিকে একই মুহূর্তে যাত্রা করবেন।
বিশাখসেন বললেন, যুক্তি মন্দ নয়। কিন্তু পবর্তের নীচে সুড়ঙ্গ করতে অন্তত এক বৎসর লাগবে। তত দিন আমরা কি করব? রথ থেকে আমি কিছুতেই নামব না তা বলে দিচ্ছি।
কহোড় বললেন, নামবেন কেন। রথে আরূঢ় থেকেই একটু কষ্ট করে এক বৎসর কাটিয়ে দেবেন, ওখানেই শৌচ—স্নানাদি পান—ভোজনাদি অক্ষক্রীড়াদি করবেন, ওখানেই নিদ্রা যাবেন। রাজধানী থেকে নর্তকীদের আনিয়ে নিন, তারা নৃত্যগীত করে আপনাদের চিত্তবিনোদন করবে।
কনকবর্মা বললেন, সুড়ঙ্গ টুড়ঙ্গ চলবে না। বিশাখসেন উপর দিয়ে যাবেন আর আমি মূষিকের ন্যায় তাঁর নীচে দিয়ে যাব এ হতে পারে না।
বিড়ঙ্গ বললেন, মহারাজ কনকবর্মা, আর এক উপায় আছে। আপনি কুবেরের আরাধনা করুন যাতে তিনি তুষ্ট হয়ে কিছুক্ষণের জন্য তার পুষ্পক বিমানটি পাঠিয়ে দেন। সেই বিমানে আপনি আকাশমার্গে দক্ষিণ দিকে যাবেন এবং বিদর্ভরাজ গিরিসংকট দিয়ে উত্তর দিকে যাবেন।
বিশাখসেন বললেন, উনি আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাবেন তা হতেই পারে না। তোমরা দুজনেই অত্যন্ত মূর্খ, সমস্যার সামাধান তোমাদের কর্ম নয়।
বিড়ঙ্গ বললেন, মহারাজ, ধৈর্য ধরুন আমরা আর এক বার মন্ত্রণা করছি।
দুই রাজবয়স্য আবার মন্ত্রণায় নিবিষ্ট হলেন, দুই রাজা অধীর হয়ে রথের উপর তাঁদের ধনুক ঠুকতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পরে কহোড় বললেন, হে নৃপতিযুগল, এবারে আমরা একটি অতি সাধু বিচিত্র ও যশস্কর সমাধান আবিষ্কার করেছি।
কনকবর্মা বললেন, বলে ফেল।
কহোড় বললেন, প্রথমে আপনাদের দুই রথের ঘোড়া খুলে ফেলা হবে, তা হলে সংকীর্ণ স্থানেও অনায়াসে রথ ঘোরানো যাবে। ঘোরাবার পর আবার ঘোড়া জোতা হবে, তখন দুই রথের মুখ বিপরীত দিকে থাকবে।
বিশাখসেন সক্রোধে বললেন, আমরা পরাঙমুখ হয়ে নিজ নিজ রাজ্যে ফিরে যাব এই তুমি বলতে চাও?
—না না মহারাজ, ফিরবেন কেন? ঘোরাবার পর দুই রথ একটু পশ্চাতে সরে আসবে যাতে ঠেকাঠেকি হয়। তার পর মহারাজ কনকবর্মা পিছন দিক থেকে পা বাড়িয়ে টুপ করে বিদর্ভরাজের রথে উঠবেন এবং বিদর্ভরাজ কলিঞ্জরপতির রথে উঠবেন।
দুই রাজা সমস্বরে বললেন, তার পর, তার পর?
—রথ বদলের পর আর কোনও ভাবনা নেই। আপনারা যুগপৎ বিপরীত দিকে অর্থাৎ আপনাদের অভীষ্ট মার্গে যাত্রা করবেন।
কনকবর্মা প্রশ্ন করলেন, কিন্তু আমাদের চতুরঙ্গ সৈন্যদলের কি হবে?
—তাদেরও বদল হবে। আপনার আগে আগে বিদর্ভসেনা এবং মহারাজ বিশাখসেনের আগে আগে কলিঞ্জরসেনা যাবে। তারা মুখ ঘুরিয়ে নেবে।
কনকবর্মা বললেন, সখা, সম্মত আছ?
বিশাখসেন বললেন, আমার সেনা তোমার হবে এবং তোমার সেনা আমার হবে এতে আপত্তি করবার কিছু নেই। কিন্তু বেলা যে শেষ হয়ে এল, মৃগয়া কখন করব?
কহোড় বললেন, আজ মৃগয়া নাই করলেন মহারাজ। আজ আপনাদের প্রতিজ্ঞা আর শপথ রক্ষিত হক, মৃগয়া এর পরে এক দিন করবেন।
বিশাখসেন বললেন, কিন্তু আজ যেতে যেতেই তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে, আমাদের অভিযানের শেষ হবে কোথায়? ফিরব কখন?
কহোড় বললেন, ফিরবেন কেন? কিচ্ছু ভাববেন না, সবই আমরা স্থির করে ফেলেছি। আপনাদের রাজ্যেরও বিনিময় হবে। মহারাজ কনকবর্মা বিদর্ভসেনার সঙ্গে যাত্রা করে বিদর্ভরাজ্যে অধিষ্ঠিত হবেন, এবং মহারাজ বিশাখসেন কলিঞ্জরসেনার সঙ্গে গিয়ে কলিঞ্জর সিংহাসন অধিকার করবেন।
কিছু কাল স্তব্ধ হয়ে থাকার পর কনকবর্মা বললেন, অতি জটিল ব্যবস্থা। আমাদের পিতৃপিতামহের রাজ্য হস্তান্তরিত হবে এ যে বড় বিশ্রী কথা।
কহোড় বললেন, মহারাজ, ক্ষত্রিয় নৃপতির প্রধান কর্তব্য প্রতিজ্ঞা, শপথ আর আত্মমর্যাদা রক্ষা, তার জন্য যদি রাজ্য বা প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় তাও শ্রেয়। কিন্তু আমাদের ব্যবস্থায় আপনাদের রাজ্যনাশ বা প্রাণনাশ কিছুই হচ্ছে না, এক রাজ্যের পরিবর্তে আর এক রাজ্য পাচ্ছেন।