এই ধরনের কিন্তু অতি গুরুতর একটা বিভ্রাট পুরাকালে ঘটেছিল। তারই ইতিহাস এখন বলছি।
একদা সত্যযুগে বিন্ধ্য গিরির অহংকার হয়েছিল, চন্দ্র—সূর্যের পথরোধ করবার জন্য সে ক্রমশ উঁচু হতে লাগল। তখন অগস্ত্য মুনি এসে তাকে বললেন, আমি দক্ষিণে যাত্রা করব, আমাকে পথ দাও। বিন্ধ্য বিদীর্ণ হয়ে একটি সংকীর্ণ পথ করে দিলে, যার নাম অগস্ত্যদ্বার। সেই গিরিসংকটের ওপারে গিয়ে বিন্ধ্যের আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে অগস্ত্য বললেন, বৎস বিন্ধ্য, এ হচ্ছে কি, তুমি যে বাঁকা হয়ে বাড়ছ, ওলন ঠিক নেই, কোন দিন হুড়মুড় করে পড়ে যাবে। আমি ফিরে এসে শিখিয়ে দেব কি করে খাড়া হয়ে বাড়তে হয়, ততদিন তুমি উঁচু হয়ো না। বিন্ধ্য বললে, যে আজ্ঞে। তারপর অনেক কাল কেটে গেল কিন্তু অগস্ত্য ফিরলেন না। তখন বিন্ধ্য রেগে গিয়ে শাপ দিলে, এই অগস্ত্যদ্বারে যারা দু দিক থেকে মুখোমুখি প্রবেশ করবে তাদের বুদ্ধিভ্রংশ হবে। শাপের কথা একজন শিষ্যের মুখে শুনে অগস্ত্য বললেন, ভয় নেই, কিছুদিন পরেই বুদ্ধি ফিরে আসবে।
উক্ত পৌরাণিক ঘটনার বহু কাল পরের কথা বলছি। তখনও বিন্ধ্য পর্বতের নিকটবর্তী স্থান নিবিড় অরণ্যে আচ্ছন্ন, সেখানে লোকালয় ছিল না, কোনও রাজার শাসনও ছিল না। এই বিশাল নো ম্যানস ল্যাণ্ডের উত্তরে কলিঞ্জর রাজ্য। কলিঞ্জরের দক্ষিণে অরণ্য, তারপর দুর্লঙ্ঘ বিন্ধ্য গিরি, তারপর আবার অরণ্য, তারপর বিদর্ভ রাজ্য। কলিঞ্জরের রাজা কনকবর্মা আর বিদর্ভের রাজা বিশাখসেন দুজনেই তেজস্বী যুবক। তাঁদের মহিষীরা মামাতো—পিসতুতো ভগ্নী।
কলিঞ্জরপতি কনকবর্মা তাঁর রাজ্যের দক্ষিণস্থ বনে মাঝে মাঝে মৃগয়া করতে যেতেন। একদিন তাঁর ইচ্ছা হল বিন্ধ্য গিরি অতিক্রম করে আরও দক্ষিণে গিয়ে শম্বর হরিণ শিকার করবেন। তিনি তাঁর প্রিয় বয়স্য কহোড়ভট্টের সঙ্গে রথে চড়ে যাত্রা করলেন, পিছনে রথী পদাতিক গজারোহী অশ্বারোহী সৈন্যদল চলল।
দৈবক্রমে ঠিক এই সময়ে বিদর্ভরাজ বিশাখসেনেরও ইচ্ছা হল বিন্ধ্য পর্বত্যের উত্তরবর্তী অরণ্যে গিয়ে ব্যাঘ্রভল্লুকাদি বধ করবেন। তিনি তাঁর প্রিয় বয়স্য বিড়ঙ্গদেবের সঙ্গে রথারূঢ় হয়ে যাত্রা করলেন, চতুরঙ্গসেনা পিছনে পিছনে গেল।
বিন্ধ্যপর্বতমালা ভেদ করে একটি পথ উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে গেছে। এই পথটি বেশ প্রশস্ত, কিন্তু মাঝামাঝি এক স্থানে পূর্বোক্ত অগস্ত্যদ্বার নামক গিরিসংকট আছে, তা এত সংকীর্ণ যে দুটি রথ পাশাপাশি যেতে পারে না।
কলিঞ্জরপতি কনকবর্মা অগস্ত্যদ্বারের উত্তর প্রান্তে এসে দেখলেন রাজা বিশাখসেন সদলবলে দক্ষিণ প্রান্তে উপস্থিত হয়েছেন। দুই রাজরথ নিকটবর্তী হলে কনকবর্মা বললেন নমস্কার সখা বিশাখসেন, স্বাগতম। বিদর্ভ রাজ্যের সর্বত্র কুশল তো? চতুর্বর্গের প্রজা ও গবাদি পশু বৃদ্ধি পাচ্ছে তো? ধনধান্যের ভাণ্ডার পূর্ণ আছে তো? তোমার মহিষী আমার শ্যালিকা বিংশতিকলা ভাল আছেন তো?
প্রতিনমস্কার করে বিশাখসেন বললেন, অহো কি সৌভাগ্য যে এই দুর্গম পথে প্রিয়সখার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! মহারাজ, তোমার শুভেচ্ছার প্রভাবে আমার রাজ্যের সর্বত্র কুশল। কলিঞ্জর রাজ্যের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল তো? তোমার মহিষী আমার শ্যালিকা কম্বুকঙ্কণা ভাল আছেন? সখা, এখন দয়া করে পথ ছেড়ে দাও, তোমার রথটি এই গিরিসংকটের একটু উত্তরে সরিয়ে রাখ। আমি সসৈন্যে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাই, তারপর তুমি তোমার সেনা নিয়ে অভীষ্ট স্থানে যাত্রা ক’রো।
কনকবর্মা মাথা নেড়ে বললেন, তা হতেই পারে না, আমি তোমার চাইতে বয়সে বড়, আমার অশ্ব—রথ—গজাদিও বেশী, অতএব পথের অগ্রাধিকার আমারই। তুমিই একটু দক্ষিণে হটে গিয়ে আমাকে পথ ছেড়ে দাও।
বিশাখসেন বললেন, অন্যায় বলছ সখা। তুমি বয়সে একটু বড় হতে পার, তোমার অশ্ব—গজাদিও প্রচুর থাকতে পারে, কিন্তু আমার বিদর্ভ রাজ্য অতি সমৃদ্ধ ও বিশাল, তার মধ্যে চারটে কলিঞ্জরের স্থান হয়। অতএব তুমিই আমাকে পথ দাও।
অনেকক্ষণ এই রকম তর্কবিতর্ক চলল। তারপর কনকবর্মা বললেন, ওহে বিশাখসেন তোমার বড়ই স্পর্ধা হয়েছে। এই শরাসন স্পর্শ করে শপথ করছি, কিছুতেই তোমাকে আগে যেতে দেব না, তোমার পূর্বেই আমি দক্ষিণে অগ্রসর হব। যখন মিষ্টবাক্যে বিবাদের মীমাংসা হল না তখন যুদ্ধই করা যাক। এই বলে তিনি তাঁর ধনুতে শরসন্ধান করলেন।
বিশাখসেন বললেন, ওহে কনকবর্মা, আমিও শপথ করছি, বাহুবলে আমার পথ করে নেব, তোমার পূর্বেই আমি উত্তর দিকে যাত্রা করব। এই বলে তিনি ধনুতে শরযোজনা করে জ্যাকর্ষণ করলেন।
তখন দুই রাজবয়স্য কহোড়ভট্ট আর বিড়ঙ্গদেব একযোগে হাত তুলে উচ্চ কণ্ঠে বললেন, ভো নৃপতিযুগল, থামুন থামুন। মনে নেই, গত বৎসর মকরসংক্রান্তির দিনে আপনারা নর্মদায় স্নানের পর অগ্নিসাক্ষী করে মৈত্রীবন্ধন করেছিলেন? অপি চ, তখন উষ্ণীষ বিনিময় করে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে কিছুতেই আপনাদের সৌহার্দ ক্ষুণ্ণ হতে দেবেন না।
কনকবর্মা গালে হাত দিয়ে বললেন, হুঁ, ওই রকম একটা প্রতিজ্ঞা করা গিয়েছিল বটে!
বিশাখসেন বললেন, হুঁ, আমারও সে কথা মনে পড়েছে। তাই তো! এখন কি করা যায়? এক দিকে সৌহার্দরক্ষার প্রতিজ্ঞা, আর এক দিকে অগ্রযাত্রার শপথ। দুটোই বজায় থাকে কি করে? মহারাজ কনকবর্মা, তোমার মুখ্যমন্ত্রীকে সংবাদ পাঠাও, তিনি এখনই এখানে চলে আসুন। আমিও আমার মহামন্ত্রীকে আনাচ্ছি। দুই মন্ত্রী যুক্তি করে এমন একটা উপায় স্থির করুন যাতে আমাদের প্রতিজ্ঞা আর শপথ রক্ষিত হয়, মর্যাদারও হানি না হয়।