আমি বললুম, অমিত রায় হচ্ছে একটি কথার তুবড়ি। রবীন্দ্রনাথ পরিহাস করে তাকে দিয়ে যা বলিয়েছেন আপনি তা সত্য মনে করছেন কেন?
অক্রুরবাবু টেবিলে কিল মেরে বললেন, মোটেই পরিহাস নয়, একেবারে খাঁটি সত্য। তিনি সর্বদর্শী কবি ছিলেন, দাম্পত্যের যা পরাকাষ্ঠা সেই তিন নম্বরেরই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। তার ভাবার্থ হচ্ছে—স্বামী—স্ত্রী আলাদা বাড়িতে বাস করবে, কালেভদ্রে দেখা করবে, তবেই তাদের প্রীতি স্থায়ী হবে নববধূ চিরদিন নববধূ থাকবে।
—আপনি এরকম দাম্পত্যের চেষ্টা করেছিলেন?
একবার মাত্র চেষ্টা করেছিলুম, তা বিফল হয়েছে। কিন্তু বিফলতার কারণ এ নয় যে রবীন্দ্রনাথের থিওরি ভুল, আমার নির্বাচনেই গলদ ছিল। যাই হক, আর চেষ্টা করবার প্রবৃত্তি নেই।
—ঘটনাটা বলবেন কি?
—শুনুন। আমার বয়স তখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের ফরমূলাটি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে মনে হল, বাঃ, এই তো দাম্পত্যের শ্রেষ্ঠ মার্গ, চেষ্টা করে দেখা যাক না। আমার গোটাকতক বাড়ি আছে, ছোট—বড় ফ্ল্যাটে ভাগ করা, সেগুলো ভাড়া দিয়ে থাকি। একদিন একটি মহিলা আমার সঙ্গে দেখা করে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন। নাম বাগেশ্রী দত্ত, বয়স আন্দাজ চল্লিশ, কিন্নরবিদ্যাপীঠে গান বাজনা নাচ শেখান। দেখতে মন্দ নয়, আমার পছন্দ হল, ক্রমে ক্রমে আলাপও হল। ভাবলুম, এক নম্বর দাম্পত্যের আশা নেই, দু নম্বরেও রুচি নেই। এই বাগেশ্রীকে নিয়ে তিন নম্বরের চেষ্টা করা যাক। যখন আলাদা আলাদা বাস করব তখন তো আদর্শ আর মতামতের প্রশ্নই ওঠে না। তার সঙ্গে দেখা করে বললুম, শোন বাগেশ্রী, আমাকে বিয়ে করবে? আমি নিজের বসত বাড়িতে থাকব, তোমাকে আমার রসা রোডের বাড়িটা দেব, সেটাও বেশ ভাল বাড়ি। তোমাকে টাকাও প্রচুর দেব। তুমি নিজের বাড়িতে নিজের মত চলবে, আমার পছন্দ অপছন্দ মানতে হবে না। মাসে একদিন আমি তোমার অতিথি হব, আর একদিন তুমি আমার অতিথি হবে। এই শর্তে বিয়ে করতে রাজী আছ? বাগেশ্রী বললে, এক্ষুনি। খাসা হবে, আমার বাড়িতে আমার মা দিদিমা মাসী দুই ভাই আর চার বোনকে এনে রাখব, এই ফ্ল্যাটটায় তো মোটেই কুলয় না। আমি বললুম, তা তো চলবে না, তোমার বাড়িতে আমি গেলে ভিড়ের মধ্যে হাঁপিয়ে উঠব যে। বাগেশ্রী বললে তোমাকে সেখানে যেতে কে বলছে? নিজের বাড়িতেই তুমি থাকবে, আমিও তোমার কাছে থাকব। তুমি যা ন্যালাখ্যাপা মানুষ, আমি না দেখলে চাকর বাকর সর্বস্ব লোপাট করবে, বাপ রে, সে আমি সইতে পারব না। আমার পিশেমশায়ের ভাগনে প্রাণতোষ দাদাও আমার কাছে থাকবে, সেই সব দেখবে শুনবে, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। বাগেশ্রীর মতলবটি শুনে আমি তখনই সরে পড়লুম। তার পর সে তিন দিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আমি হাঁকিয়ে দিয়েছি।
আমি প্রশ্ন করলুম, উকিলের চিঠি পান নি।
অক্রুরবাবু বললেন, পেয়েছিলুম। উত্তরে জানালুম, ব্রীচ অভ প্রমিস হয় নি, আমি খেসারত এক পয়সাও দেব না। তবে বাগেশ্রী যদি দু মাসের মধ্যে তার প্রাণতোষ দাদা বা আর কাকেও বিবাহ করে তবে পাঁচ হাজার টাকা যৌতুক দিতে প্রস্তুত আছি। বাগেশ্রী তাতেই রাজী হয়েছিল।
—সকলকেই যৌতুক দিলেন, শুধু সত্যভামা বেচারী ফাঁকে পড়লেন।
—তিনিও একেবারে বঞ্চিত হন নি। পুরী থেকে চলে আসবার তিন মাস পরে একটা নিমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলুম—হুণ্ডাগড়ের খুড়া সাহেবের সঙ্গে সত্যভামার বিবাহ হচ্ছে। আমি একটি ছোট্ট পিকিনীজ কুকুর সত্যভামাকে উপহার পাঠিয়ে দিলুম, খুব খানদানী কুকুর, তার জন্য প্রায় আট শ টাকা খরচ হয়েছিল।
—এক দু তিন নম্বর সবই তো পরীক্ষা করেছেন, আপনার ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম কি?
—কিছুই স্থির করতে পারি নি। আপনি তো বোদ্ধা লোক একটা পরামর্শ দিন না।
—দেখুন অক্রুরবাবু, আপনার ওপর আমার অসীম শ্রদ্ধা হয়েছে। যা বলছি তাতে দোষ নেবেন না। আমি সামান্য লোক, শরীর বা মনের তত্ত্ব কিছুই জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি যে পুং—হরমোনের কথা বলছেন তা হরেক রকম আছে। একটাতে দাড়ি গজায়, আর একটাতে গুঁতিয়ে দেবার অর্থাৎ আক্রমণের শক্তি আসে, আর একটাতে সর্দারি করবার প্রবৃত্তি হয়। তা ছাড়া আরও একটা আছে যা থেকে প্রেমের উৎপত্তি হয়। বোধ হচ্ছে আপনার সেইটের কিঞ্চিৎ অভাব আছে। আপনি কোনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অক্রুরবাবু বললেন, তাই করা যাবে।
আমি নমস্কার করে বিদায় নিলুম। তার পরে আর অক্রুর নন্দীর সঙ্গে দেখা হয় নি। শুনেছি তিনি সমস্ত সম্পত্তি দান করে দ্বারাকাধামে তপস্বিনী জগদম্বা মাতাজীর আশ্রমে বাস করছেন। ভদ্রলোক শেষকালে আত্মসমর্পণই করলেন। আশা করি তিনি শান্তি পেয়েছেন।
১৩৫৯ (১৯৫২)
অগস্ত্যদ্বার
পঞ্চাশ—ষাট বছর আগে পাটনায় ঘোড়ায় টানা ট্রামগাড়ি ছিল। পুরনো শহরের গুলজারবাগ মহল্লা থেকে বাঁকিপুরের জজ—আদালত পর্যন্ত সিংগল লাইনে গাড়ি চলত। দুদিক থেকে যাতায়াতের বাধা যাতে না হয় তার জন্য এক মাইল অন্তর লুপ ছিল, অর্থাৎ লাইন থেকে একটা শাখা বেরিয়ে বিশ—পঁচিশ গজ দূরে আবার লাইনের সঙ্গে মিশত। প্রত্যেক গাড়ি লুপের কাছে এসে থামত এবং উলটো দিকের গাড়ি এলে লুপে গিয়ে পথ ছেড়ে দিত। কিন্তু সব সময় এই ব্যবস্থায় কাজ হত না। একটা গাড়ি লুপের কাছে এসে দাঁড়িয়ে আছে, আধ ঘণ্টা হয়ে গেল তবু ও দিকের গাড়ির দেখা নেই। যাত্রীরা অধীর হয়ে বললে, চালাও গাড়ি, আর আমরা সবুর করতে পারি না। গাড়ি অগ্রসর হল, কিন্তু আধ মাইল যেতে না যেতে ও দিকের গাড়ি এসে পথরোধ করলে। তখন দুই তরফের গালাগালি শুরু হল। আরে গাধা তুই লুপে সবুর করিস নি কেন? আরে উল্লু তুই এত দেরি করলি কেন? যাত্রীরাও ঝগড়ায় যোগ দিলে, দুই গাড়ির চারটে ঘোড়াও মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পা তুলে চিঁহিহি করতে লাগল। তামাশা দেখবার জন্য রাস্তায় লোক জমে গেল, ছোকরার দল হাততালি দিয়ে চেঁচাতে লাগল— হী লব লব লব। অবশেষে একজন যাত্রী বললে, ঝগড়া এখন থাক, গাড়ি চালাবার ব্যবস্থা কর। তখন দুই গাড়ির ঘোড়া খুলে পিছনে জোতা হল, এই গাড়ির যাত্রীরা ও গাড়িতে উঠল দুই গাড়িই যেখান থেকে এসেছিল সেখানে ফিরে চলল। গাড়ি বদলের ফলে যাত্রীরাও তাদের গন্তব্য স্থানে পৌঁছে গেল।