হনুমান ভাবিলেন—’এই বিদগ্ধা বানরী এইবার আমাকে সংকটে ফেলিল, ইহার প্রশ্নের কি উত্তর দিব? যাহা হউক আমি অপ্রতিভ হইব না। —হে সুন্দরী, তোমাকে দেখিয়া আমার চিত্ত চঞ্চল হইয়াছে, প্রেমতত্ত্বের ইহাই আমার প্রথম জ্ঞান। তুমি চিন্তা করিও না, কিষ্কিন্ধ্যাপতি সুগ্রীব আমার অগ্রজতুল্য, তিনি আমাকে সমস্ত শিখাইয়া দিবেন। তুম্বরাজ চঞ্চরীক আমার বন্ধু, তিনিও আমাকে জ্ঞানদান করিবেন। তুমি যদি মুক্তাহার কামনা কর তবে জানকীর নিকট চাহিয়া লইব, যদি আহার না কর তবে এই লৌহকঠোর অঙ্গুলি দ্বারা তোমাকে খাওয়াইব। হে প্রিয়ে, আর বিলম্ব করিও না, আমার সহিত চল। সীতা তোমার হনুমতী নাম দিয়াছেন, তিনি তোমাকে বরণ করিবার জন্য অযোধ্যায় প্রতীক্ষা করিতেছেন।’
চিলিম্পা তখন হনুমানর চিবুকে তর্জনীর মৃদু মৃদু আঘাত করিয়া মধুর স্বরে কহিলেন—’ওরে বর্বর, ওরে অবোধ, ওরে বৃদ্ধবালক, তুমি প্রেমের কিছুই জান না। যাও, কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়া সুগ্রীবকে পাঠাইয়া দাও।’
হনুমান আকুল হইয়া কহিলেন—’অয়ি নিষ্ঠুরে, আমাকে আশা দিয়া নিরাশ করিতেছ কেন? আমি তোমাকে কিছুতেই ছাড়িব না।’ এই বলিয়া তিনি চিলিম্পাকে ধরিবার জন্য বাহু প্রসারিত করিলেন।
চিলিম্পা করতালি দিয়া বিকট হাস্য করিলেন। সহসা বনান্তরাল হইতে কালান্তক যমের ন্যায় দুই মহাকায় নরকপি নিঃশব্দে আসিয়া হনুমানকে অতর্কিতে পাশবদ্ধ করিল। চিলিম্পা কহিলেন—’হে অরঙ্গ—অটঙ্ক, এই মর্কটের বড়ই স্পর্ধা হইয়াছে, দ্বাদশাঙ্গুল পরিমাণ ছাঁটিয়া দিয়া ইহাকে বিতাড়িত কর।
তখন প্রত্যুৎপন্নমতি হনুমান প্রভঞ্জনকে স্মরণ করিলেন। নিমেষে তাঁহার দেহ হিমাদ্রিতুল্য হইল, পাশ শতছিন্ন হইল, প্রচণ্ড পদাঘাতে নরকপিদ্ধয় সাগরগর্ভে নিক্ষিপ্ত হইল। স্বর্গ—মর্ত্য—পাতাল প্রকম্পিত করিয়া মহাবীর উপ উপ রবে তিন বার সিংহনাদ করিলেন, তাহার পর চিলিম্পার কেশ গ্রহণপূর্বক ‘জয় রাম’ বলিয়া উর্দ্ধে লম্ফ দিলেন।
ঝঞ্ঝাবাহিত মেঘের ন্যায় হনুমান শূন্যমার্গে ধাবিত হইতেছেন। আকাশবিহারী সিদ্ধ—গন্ধর্ব—বিদ্যাধরগণ বলিতে লাগিলেন—’হে পবনাত্মজ, এতদিনে তোমার কৌমারদশা ঘুচিল, আশীর্বাদ করি সুখী হও।’ দিগবধূগণ ছুটিয়া আসিয়া বলিল—’হে অঞ্জনানন্দন, মুহূর্তের তরে গতি সংবরণ কর, আমরা নববধূর মুখ দেখিব।’ হনুমান হুংকার করিলেন, গগনচারিগণ ভয়ে মেঘান্তরালে পলায়ন করিল, দিগবধূগণ দিগবিদিকে বিলীন হইল।
চিলিম্পা কাতর কণ্ঠে কহিলেন—’হে মহাবীর, আমার কেশ ছাড়িয়া দাও, বড়ই লাগিতেছে। বরং আমাকে পৃষ্ঠে নতুবা বক্ষে ধারণ কর।’
হনুমান বলিলেন—’চোপ!’
চিলিম্পা বলিলেন—’হে প্রাণবল্লভ, আমি একান্ত তোমারই হে অরসিক, তুমি কি পরিহাস বুঝিতে পার নাই? আমি যে তোমা—বই আর কাহাকেও জানি না।’
হনুমান পুনরুপি বলিলেন—’চোপ!’
নিম্নে কিষ্কিন্ধ্যা দেখা যাইতেছে। সুগ্রীব স্বল্পতোয়া তুঙ্গভদ্রার গর্ভে অষ্টাধিক সহস্র পত্নীসহ জলকেলি করিতেছেন।
হনুমান মুষ্টি উন্মুক্ত করিলেন। অব্যর্থ লক্ষ্য। বানরী ঘুরিতে ঘুরিতে সুগ্রীবের স্কন্ধে নিপতিত হইল।
ভারমুক্ত হইয়া হনুমান দ্বিগুণ বেগে ধাবিত হইলেন। পঞ্চবটী—জনস্থান—চিত্রকূট—প্রয়াগ— শৃঙ্গবের—অবশেষে অযোধ্যা।
সীতা সবিস্ময়ে বলিলেন, ‘একি বৎস! সংবাদ দাও নাই কেন? আমি নগরী সুসজ্জিত করিতাম, বাদ্যভান্ড প্রস্তুত রাখিতাম। হনুমতী কই?’
হনুমান অবনত মস্তকে বলিলেন—’মাতঃ, হনুমতীকে পাই নাই। আমি এক সামান্য বানরী হরণ করিয়া সুগ্রীবকে দান করিয়াছি। হে দেবি, বিধাতা আমার এই বিশাল বক্ষে যে ক্ষুদ্র হৃদয় দিয়াছেন তাহা তুমি ও রামচন্দ্র পরিপূর্ণ করিয়া বিরাজ করিতেছ, দারাপুত্রের স্থান নাই।’
সীতা বলিলেন—’বৎস, পিতৃ—ঋণ শোধের কি করিলে?’
হনুমান মস্তকে করাঘাত করিয়া বলিলেন—’আহো পাষণ্ড! আমি সে কথা ভুলিয়াই গিয়াছিলাম। জননী, তুমি এই বর দাও যেন অমর হইয়া চিরকাল পিতৃগণের পিণ্ডোদকের বিধান করিতে পারি।’
সীতা বলিলেন—’বৎস, তাহাই হউক।’
তখন হনুমান পরিতুষ্ট হইয়া বিশাল বক্ষ প্রসারিত করিয়া ভুজদ্বয় ঊর্ধ্বে তুলিয়া বজ্রনির্ঘোষে বলিলেন—’জয় সীতারাম!’
১৩৩৭(১৯৩০)