হনুমান কহিলেন,—’তুমি এই পত্নীপুঞ্জ শাসনে রাখ কি করিয়া? তাহারা কলহ করে না? তোমাকে বাক্যবাণে প্রপীড়িত করে না?’
সুগ্রীব সহাস্যে কহিলেন—’সাধ্য কি। আমি কদলীবল্কল দ্বারা তাহাদের ওষ্ঠাধর বাঁধিয়া রাখি, কেবল প্রেমালাপকালে খুলিয়া দিই। যাহা হউক, তোমার ভয় নাই। আপাতত তুমি একটিমাত্র পত্নী গ্রহণ কর, পরে ক্রমে ক্রমে সংখ্যা বৃদ্ধি করিও। আমি বলি কি—তুমি অন্যত্র চেষ্টা না করিয়া শ্রীমতী তারাকে বিবাহ কর, আমার আর তাঁহাকে প্রয়োজন নাই। তিনি প্রবীণা এবং পতিসেবায় পরিপক্বা। তাঁহাকে লাভ করিয়া তুমি নিশ্চয়ই সুখী হইবে।’
হনুমান কহিলেন—’তুমি তারাদেবীর নাম করিও না, তিনি আমার নমস্যা।’
সুগ্রীব কহিলেন—’বটে! অযোধ্যায় থাকিয়া তোমার মতি—গতি বিগড়াইয়াছে দেখিতেছি। আচ্ছা, তুমি আর এক চেষ্টা করিতে পার। এই কিষ্কিন্ধ্যার দক্ষিণে কিচ্চট দেশ আছে। তাহার অধিপতি প্লবংগম অপুত্রক অবস্থায় লোকান্তর গমন করিয়াছেন। এখন তাঁহার দুহিতা চিলিম্পা রাজ্যশাসন করিতেছেন। এই বানরী অতিশয় লাবণ্যবতী বিদূষী ও চতুরা। আমি বিবাহের প্রস্তাবসহ দূত পাঠাইয়াছিলাম, কিন্তু লাঙ্গুল কর্তন করিয়া চিলিম্পা তাহাকে বিদায় দিয়াছে। নল—নীল—গয়—গবাক্ষ ইঁহারাও প্রেমনিবেদন করিতে তাহার কাছে একে একে গিয়াছিলেন, কিন্তু সকলেই ছিন্নলাঙ্গুল লইয়া ফিরিয়া আসিয়াছেন। এই দুর্বিনীতা বানরীর উপর আমার লোভ আক্রোশ উভয়ই আছে, কিন্তু আমার অবসর নাই, নতুবা স্বয়ং অভিযান করিয়া তাহাকে ধরিয়া আনিতাম। এখন তুমি যদি তাহাকে জয় কর তবে আমার ক্ষোভ দূর হইবে, তোমারও পত্নী লাভ হইবে।’
হনুমান কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া কহিলেন—’তাহাই হউক। আমি এখনই কিচ্চট দেশে যাত্রা করিতেছি।’
হনুমান কিচ্চট রাজ্যে উপস্থিত হইলেন। তাঁহার বিশাল বপু দেখিয়া প্রজাগণ সভয়ে পথ ছাড়িয়া দিল এবং চিলিম্পাকে সংবাদ দিল—’হে রাজনন্দিনী, আর রক্ষা নাই, এক পর্বতাকার বীর বানর তোমার রাজ্য আক্রমণ করিয়াছে।’
চিলিম্পা কহিলেন—’ভয় নাই, অমন অনেক বীর দেখিয়াছি। তাহাকে ডাকিয়া আন।’
হনুমান এক মনোরম কুঞ্জবনে আনীত হইলেন। চিলিম্পা তথায় সখীগণে পরিবৃতা হইয়া বসিয়া আছেন, তাঁহার কর্ণে রক্ত—প্রবাল, কণ্ঠে কপর্দমালা, হস্তে লীলাকদলী। হনুমান মুগ্ধ হইয়া ভাবিতে লাগিলেন—’অহো, সুগ্রীব যথার্থই বলিয়াছেন। এই তরুণী বানরী পরমা সুন্দরী, ইহাকে দেখিবামাত্র আমার চিত্ত চঞ্চল হইয়া উঠিল, সংশয় দূর হইল। ইহাকে যদি লাভ করিতে না পারি তবে জীবনই বৃথা।’
ঈষৎ হাস্যে কুন্দদন্ত বিকশিত করিয়া চিলিম্পা কহিলেন—’হে বীরবর, তুমি কি—হেতু বিনা অনুমতিতে আমার রাজ্যে প্রবেশ করিয়াছ? তুমি কে, কোথা হইতে আসিয়াছ, কি চাও, সমস্ত প্রকাশ করিয়া বল, আমি তোমাকে অভয় দিলাম।’
হনুমান উত্তর দিলেন—’হে প্লবংগম—নন্দিনী, আমি রামদাস হনুমান, অযোধ্যা হইতে আসিয়াছি তোমার পাণিগ্রহণ করিয়া আবার অযোধ্যায় ফিরিতে চাই। আমিও তোমাকে অভয় দিতেছি।’
হনুমানের বাক্য শুনিয়া সখীগণ কিলকিলা রবে হাসিয়া উঠিল। চিলিম্পা কহিলেন—’হনুমান, তেমার ধৃষ্টতা তো কম নয়। তোমার কী এমন গুণ আছে যাহার জন্য আমার পাণিপ্রার্থী হইতে সাহসী হইয়াছ?’
হনুমান কহিলেন—’আমি সেই রামচন্দ্রের সেবক যিনি পিতৃ—সত্য পালনের জন্য বনে যান, যিনি রাবণকে নিধন করিয়াছেন, যিনি দুর্বাদলশ্যাম পদ্মপলাশলোচন, যিনি সর্বাগুণাম্বিত লোকোত্তরচরিত।’
চিলিম্পা কহিলেন—’হে রামদাস, তুমি কি রামচন্দ্রের সম্বন্ধ করিতে আসিয়াছ?’
হনুমান জিহ্বাদংশন করিয়া কহিলেন—’আমার প্রভু একদারনিষ্ঠ। জনকতনয়া সীতা তাঁহার ভার্যা, যিনি মূর্তিমতী কমলা, যাঁহার তুলনা ত্রিজগতে নাই। আমি নিজের জন্যই তোমার কাছে আসিয়াছি।’
চিলিম্পা কহিলেন—’তবে নিজের কথাই বল।’
হনুমান কহিলেন—’নিজের কীর্তি নিজে বলা ধর্মবিরুদ্ধ, কিন্তু পণ্ডিতগণের মুখে শুনিয়াছি শত্রু ও প্রিয়ার নিকট আত্মগৌরব কথনে দোষ নাই। অতএব বলিতেছি শ্রবণ কর। আমি সাগর লঙ্ঘন করিয়াছি, গন্ধমাদন উৎপাটিত করিয়াছি, ভগবান ভানুকে কক্ষপুটে রুদ্ধ করিয়াছি, এই দেখ স্ফোটকের চিহ্ন। আমি সাত লক্ষ রাক্ষস বধ করিয়াছি, রাবণের মস্তকে চপেটাঘাত করিয়াছি, তাহার রথচূড়া চর্বণ করিয়াছি, এই দেখ একটি দন্ত ভাঙ্গিয়া গিয়াছে।’
চিলিম্পা কহিলেন—’হে মহাবীর, তোমার বচন শুনিয়া আমার পরম প্রীতি জন্মিয়াছে। কিন্তু স্ত্রীজাতি কেবল বীরত্ব চাহে না। তোমার কান্তগুণ কি কি আছে? তুমি নৃত্যগীত জান? কাব্য রচিতে পার?’
হনুমান কহিলেন—’অয়ি চিলিম্পে, রাবণবধের পর আমি অধীর হইয়া একবার নৃত্যগীতের উপক্রম করিয়াছিলাম, কিন্তু নল নীল প্রভৃতি বানরগণ আমাকে উপহাস করে, তাহাতে আমি নিরস্ত হই। সুমিত্রানন্দন তখন আমাকে বলেন—মারুতি, তুমি ক্ষুব্ধ হইও না। তুমি যাহা কর তাহাই নৃত্য, যাহা বল তাহাই গীত, যাহা না বল তাহাই কাব্য, ইতরজনের বুঝিবার শক্তি নাই।’
চিলিম্পা তাঁহার করধৃত কদলীগুচ্ছ লীলাসহকারে দংশন করিতে করিতে কহিলেন—’হে পবননন্দন তুমি প্রেমতত্ত্বের কতদূর জান? তুমি কোন জাতীয় নায়ক? ধীরোদাত্ত, ধীরোদ্ধত, প্রশান্ত না ললিত? তুমি কি করিয়া আমার মনোরঞ্জন করিবে, কি করিয়া আমার মানভঞ্জন করিবে? আমি যদি গজমুক্তার হার কামনা করি তবে তুমি কোথায় পাইবে? যদি রাগ করিয়া আহার না করি তবে কি করিবে?’