তখন রাজ্ঞী সীতা হনুমানকে রাজান্তঃপুরে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—’বৎস, তোমার কি হইয়াছে প্রকাশ করিয়া বল, আমি তোমার মাতৃতুল্য, বলিতে সংকোচ করিও না।’
মহাবীর কিয়ৎক্ষণ তাঁহার বাম গ্রীবা কণ্ডূয়ন করিলেন, তাহার পর দক্ষিণ গ্রীবা কণ্ডূয়ন করিলেন। তদনন্তর মস্তক নত করিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন—’মাতঃ, আমার গোপন কথা যদি নিতান্তই শুনিতে চাও তবে না বলিয়া উপায় নাই। কিছুদিন পূর্বে আমি স্বপ্নে পিতৃগণকে দেখিয়াছি। তাঁহারা সুমেরুশিখরে সারি সারি পা ঝুলাইয়া বসিয়া আছেন এবং বিষণ্ণবদনে নিজ নিজ উদরে হাত বুলাইতেছেন। এই দুঃস্বপ্নের অর্থ আমি বশিষ্ঠপুত্র বামদেবকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম। তিনি বলিলেন, হে মহাবীর, ও কিছু নয়, তোমার পিতৃগণ ক্ষুধিত হইয়াছেন, তুমি কদলী দগ্ধ করিয়া শ্রাদ্ধ কর এবং ব্রাহ্মণগণকে ভূরিদক্ষিণা দাও। আমি বামদেবের উপদেশ পালন করিলাম, কিন্তু তাহার পর আবার পিতৃগণ আমাকে স্বপ্নে দর্শন দিলেন। তখন আমার জ্ঞান হইল যে তাঁহারা ক্ষণিক ব্যবস্থায় তৃপ্ত হইবেন না। আমার মৃত্যুর পর কে তাঁহাদিগকে পিণ্ড দিবে? লোকে যে—বয়সে বিবাহ করিয়া গার্হস্থ্যধর্ম পালন করে, আমি সেই বয়সে সুগ্রীবের অনুচর হইয়া বানপ্রস্থে কালহরণ করিয়াছি। এখন প্রভু রামচন্দ্রের কৃপায় সুগ্রীব রাজ্যলাভ করিয়াছেন, রাবণ বিনষ্ট হইয়াছে, আমারও অবসর মিলিয়াছে। কিন্তু আমি এখন বার্ধক্যের দ্বারদেশে উপস্থিত, এখন যদি দারপরিগ্রহ করিয়া গৃহী হইতে চাই, তবে লোকে আমাকে ধিককার দিবে। হা, আমার পিতৃঋণ শোধের কি উপায় হইবে? হে দেবী, এই দুশ্চিন্তা, আমাকে অহরহ দহন করিতেছে, আমি নিরন্তর পিতৃগণের ম্লানমুখ ও শূন্য উদর দেখিতে পাইতেছি, আমার ক্ষুধা নাই, নিদ্রা নাই, শান্তি নাই।’ এই বলিয়া হনুমান নীরবে অশ্রুমোচন করিতে লাগিলেন।
হনুমানের বচন শুনিয়া দেবী জানকী ঈষৎ হাস্যসহকারে বলিলেন—’হে বীরশ্রেষ্ঠ, এজন্য আর চিন্তা কি? তুমি লোকলজ্জায় অভিভূত হইও না, এই দণ্ডে বিবাহ করিয়া পিতৃগণকে নিশ্চিন্ত কর। তোমার কী এমন বয়স হইয়াছে? আমার পূজ্যপাদ শ্বশুর মহাশয় তোমার অপেক্ষাও অধিক বয়সে ভরতজননীকে গৃহে আনিয়া ছিলেন। আমি আমার সখীগণকে ডাকিয়া আনিতেছি, তাহারা সকলেই সুরূপা সুশীলা সদবংশীয়া। তোমার যাহাকে ইচ্ছা পত্নীত্বে বরণ কর। হে কপিপ্রবার, আমি নিশ্চয় কহিতেছি এই অযোধ্যায় এমন কন্যা নাই যে তোমাকে পতিরূপে পাইয়া ধন্য হইবে না। তুমি তোমার জাতির জন্য কিছুমাত্র কুণ্ঠিত হইও না। আমি অনুরোধ করিলে মহর্ষি বশিষ্ঠ উপনয়ন সংস্কার দ্বারা তোমাকে ক্ষত্রিয় বানাইয়া দিবেন। অথবা যদি মানবীতে তোমার অভিরুচি না থাকে, তবে কিষ্কিন্ধ্যায় গমন কর এবং একটি পরমা সুন্দরী বানরীর পাণিগ্রহণ করিয়া সত্বর অযোধ্যায় ফিরিয়া আইস তোমার পত্নীর নাম যাহাই হউক আমি তাহাকে হনুমতী বলিব এবং এই রাজপুরীর বধূগণমধ্যে সাদরে গ্রহণ করিব।’
তখন হনুমান প্রফুল্ল হইয়া কহিলেন—’জনকনন্দিনী, তোমার জয় হউক। আমি কৌলীন্য ভঙ্গ করিব না, বানরীই বিবাহ করিব এবং শ্রীরামচন্দ্রের অনুমতি লইয়া অদ্যই কিষ্কিন্ধ্যা যাত্রা করিব।’
হনুমান নানা গিরি নদী বনভূমি অতিক্রম করিয়া দণ্ডকারণ্যে উপস্থিত হইলেন। তখন অপরাহ্ণ, সূর্যাস্তের বিলম্ব নাই। মহাবীর এক বিশাল শাল্মলিতরুর শাখায় বসিয়া বিশ্রাম করিতে লাগিলেন এবং চতুর্দিকে চাহিয়া দেখিলেন নিকটে কোথাও রাত্রি বাসের উপযুক্ত আশ্রয় আছে কিনা। সহসা অদূরে একটি সুবৃহৎ পর্ণগৃহ নয়নগোচর হইল। হনুমান বৃক্ষ হইতে নামিয়া সেই গৃহে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন তাহার অভ্যন্তর পরিপাটীরূপে সজ্জিত। ভূমিতে কোমল তৃণরাশির উপর মসৃণ মৃগচর্মের আস্তরণ, এক কোণে স্তূপীকৃত সুপক্ব আম্র—পনস—রম্ভাদি ফল, অন্য কোণে চন্দনকাষ্ঠের মঞ্চের উপর রাজোচিত বসন, উত্তরীয়, উষ্ণীষ প্রভৃতি পরিচ্ছদ এবং বিবিধি প্রসাধনদ্রব্য, প্রাচীরগাত্রে লম্বিত একটি সুরম্য পরিবাদ্দিনী বীণা।
হনুমান সমস্ত নাড়িয়া চাড়িয়া দেখিয়া সহর্ষে কহিলেন—অহো, নিশ্চয়ই স্বর্গস্থ পিতৃগণ আমার প্রতি স্নেহবশে এই উপহারসামগ্রী প্রেরণ করিয়াছেন। তাঁহাদের প্রীতির নিমিত্ত আমি এখনই এই পরিচ্ছদ ধারণ করিব এবং রাত্রিকালে এই উপাদেয় ভোজ্যসকল আহার করিব।
এই বলিয়া হনুমান সেই বিচিত্র বসন উত্তরীয়াদি পরিধান করিলেন এবং মস্তকে উষ্ণীষ স্থাপন করিয়া অতিশয় শোভমান হইলেন। তাহার পর শয্যায় উপবেশন করিয়া ভাবিলেন—’এখনও বেলা অবসান হয় নাই, ভোজনের বিলম্ব আছে, ততক্ষণ আমি এই বীণা বাজাইয়া দেখি।’
মহাবীর সাবধানে বীণাটি পাড়িলেন, কিন্তু বাদ্যের উপক্রম করিতেই তাঁহার প্রবল অঙ্গুলিস্পর্শে সমস্ত তাঁর ছিড়িয়া গেল। হনুমান বিরক্ত হইয়া বলিলেন— ‘এই ক্ষণভঙ্গুর যন্ত্র মাদৃশ বীরের অস্পৃশ্য।’ তখন তিনি মৃগচর্মে শয়ান হইয়া ভাবী ভার্যার বিষয় চিন্তা করিতে লাগিলেন।
তাঁহার কান্তা কেমন হইবে? তম্বী না স্থূলা, পীঙ্গলবর্ণা না রক্ত—কপিশপ্রভা, ধীরা না চপলা, কলকন্ঠী না কর্কশনাদিনী? ভাবিতে ভাবিতে সহসা তাঁহার চিত্তে নির্বেদ উপস্থিত হইল। হনুমান স্বগত কহিতে লাগিলেন— ‘অহোবত, আমি এ কী ঘোর কর্মে ব্যবসিত হইয়াছি! আমি সমুদ্র লঙ্ঘন করিয়াছি, লঙ্কা দগ্ধ করিয়াছি, গন্ধমাদন উৎপাটিত করিয়াছি। সাগরে—অম্বরে—পর্বতে—অরণ্যে আমার অজ্ঞাত কিছু নাই। আমি সমরে অভিজ্ঞ, সংকটে ধীর, দেবচরিত্র, কাকচরিত্র আমার নখদর্পণে। কিন্তু স্ত্রীজাতির রহস্য আমি কি—ই বা জানি! এই অদ্ভুত প্রাণীর গুম্ফ নাই শ্মশ্রু নাই বল নাই বুদ্ধি নাই। অথচ দেখ ইহারা শিশুকে স্তন্যদান করে, কিন্তু আমরা তাহা পারি না। ইহারা অকারণে হাস্য করে, অকারণে ক্রন্দন করে, তুচ্ছ মুক্তা প্রবাল ইহাদের প্রিয়, সন্তানপালন ও নিরর্থক বস্তুসংগ্রহই একমাত্র কার্য। ঈদৃশী কোমলাঙ্গী মসৃণবদনী পয়স্বিনী শিশুপালিনী ভার্যার সহিত অমি কিরূপ ব্যবহার করিব? যদি সে আমার প্রিয়কার্য করে তবে কি মস্তকে উত্তোলন করিয়া সমাদর করিব? যদি অবাধ্য হয় তবে কি চপেটাঘাতে বিনীত করিব? বানর ধর্মশাস্ত্রে এবংবিধ শাসনের বিধান আছে বটে, কিন্তু মানবশাস্ত্র কি বলে?’