আর্তনাদ করে মুদগল বললেন, আছি আছি।
—আকাশে দিবাকর, আমার চতুর্দিকে এই চেড়ীবৃন্দ, আর সম্মুখে ওই উচ্ছিষ্ট লোভী কুকুর, সবাই সাক্ষী রইল। আবার বল, রাজী আছ?
—ওরে বাপ রে! আছি আছি। রাক্ষসী, তুমিই আমার প্রাণেশ্বরী।
তখন হাত তুলে নিয়ে আমি বললুম, আজই রাত্রির প্রথম লগ্নে বিবাহ।
কাতর হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মুদগল বললেন, প্রিয়ে, একটি দিন অপেক্ষা কর, আমার গায়ের ব্যথা মরুক, পিঠ সোজা হক। কাল আমার গুরুদেব মহর্ষি কুলত্থ আসবেন, তাঁর অনুমতি আর আশীর্বাদ নিয়ে তোমাকে পত্নীত্বে বরণ করব।
আমি বললুম, বেশ তাই হবে। কিন্তু খবরদার, যদি সত্যভ্রষ্ট হও তবে আমার জঠরে যাবে, সেখান থেকে সোজা নরকে।
একদিন পরে মুদগলের আশ্রমে গিয়ে দেখলুম, তার গুরু মহর্ষি কুলত্থ এসেছেন। আমি প্রণিপাত করলে তিনি প্রসন্ন হাস্য করে বললেন, রাক্ষসনন্দিনী, তোমাদের প্রণয়ব্যাপার শুনে আমি অতীব প্রীত হয়েছি। আশীর্বাদ করি, তোমাদের দাম্পত্যজীবন মধুময় হক। দেখি তোমার হাতখানা।
আমার কররেখা অনেকক্ষণ ধরে দেখে কুলত্থ বললেন, হুঁ, ভালই দেখছি, তোমার ভাগ্যে অদ্বিতীয় রূপবান পতিলাভ আছে। তা আমার এই শিষ্যটি কিঞ্চিৎ খর্বকায় আর দুর্বল হলেও রূপবান বটে।
আমি বললুম, ভগবান, ওই রূপেই আমি তুষ্ট। আপনি শিষ্যের কররেখা দেখেছেন?
মহর্ষি বললেন, দেখেছি বইকি। এক অদ্বিতীয়া সুন্দরীকে মুদগল পত্নীরূপে লাভ করবে।
হৃষ্ট হয়ে আমি বললুম, মহর্ষি, আপনার গণনা একেবারে নির্ভুল, রূপের জন্য আমি লঙ্কাশ্রী উপাধি পেয়েছি। সমগ্র জম্বুদ্বীপেও আমার তুল্য সুন্দরী পাবেন না।
কুলত্থ বললেন, তাই নাকি? তবে তোমাকে আমি জম্বুশ্রী উপাধি দিলুম। কিন্তু রাক্ষসনন্দিনী, তোমার কিঞ্চিৎ ন্যূনতা আছে। সম্প্রতি দশরথপুত্র রাম—লক্ষ্মণ বনবাসে এসেছেন, নিকটেই পঞ্চবটীতে কুটীর নির্মাণ করে বাস করছেন। রামের ভার্যা জনকতনয়া সীতাও তাঁদের সঙ্গে আছেন। তিনি তোমার চাইতে একটু বেশী সুন্দরী।
আমি রেগে গিয়ে বললুম, আমার চাইতে সুন্দরী এই তল্লাটে কেউ থাকবে না, সীতাকে আমি ভক্ষণ করে ফেলব। তার কাছে নিয়ে চলুন আমাকে।
মহর্ষি বললেন, তোমার সংকল্প অতি সাধু। এস আমার সঙ্গে।
কুলত্থ আর মুদগলের সঙ্গে তখনই পঞ্চবটীতে গেলুম। একটু দূরে বনের আড়ালে লুকিয়ে থেকে দেখলুম, কুটীরের দাওয়ায় বসে সীতা তরকারি কুটছে। পুরুষ জাতটাই অন্ধ, বলে কিনা আমার চাইতে সুন্দরী! বড়দা পর্যন্ত সীতার জন্যে খেপেছিলেন। তারপর দেখলুম, দুর্বাদলশ্যাম ধনুর্ধর এক যুবা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করল, তার পিছনে আর একটি যুবা এক ঝুড়ি ফল মাথায় করে নিয়ে এল। বুঝলুম এরাই রাম—লক্ষ্মণ।
পুষ্কলা বললেন, দেখেই তোমার মুণ্ডু ঘুরে গেল তো?
—ওঃ কি রূপ, কি রূপ! মানুষ অত সুন্দর হয় আমার জানা ছিল না। নিমেষের মধ্যে আমার মনোরথ বদলে গেল। কুলত্থকে বললুম, মহর্ষি, আমি ওই সীতাকে এখনই ভক্ষণ করছি, কিন্তু আপনার শিষ্য মুদগলকে আমার আর প্রয়োজন নেই, অদ্বিতীয় রূপবান ওই রামই আমার বিধিনির্দিষ্ট পতি, ওঁকেই আমি বরণ করব, ওঁর কাছে আপনার শিষ্য মর্কট মাত্র।
মহর্ষি বললেন, ছি রাক্ষসী, ও কথা বলতে নেই, তুমি যে বাগদত্তা।
উত্তর দিলুম, কথা আমি দিই নি, আপনার শিষ্যই দিয়েছিল, তাও স্বেচ্ছায় নয়, তিন মন চাপে কাবু হয়ে প্রাণেশ্বরী বলেছিল। ওকে আমি মুক্তি দিলুম। আমি এখনই রামের সঙ্গে মিলিত হব, আপনারা এখানে থেকে কি করবেন, চলে যান।
আমার কথা শেষ হতে না হতে মুদগলের হাত ধরে মহর্ষি কুলত্থ বেগে প্রস্থান করলেন।
শূর্পনখা অন্যমনস্ক হলেন দেখে পুষ্কলা বললেন, থামলে কেন পিসীমা, তার পর কি হল?
—ন্যাকামি করিস নি, কি হল তুই জানিস না নাকি?
হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে শূর্পনখা চিৎকার করে উঠলেন—ওরে রেমো সর্বনেশে, কি করলি রে! তারপর ছটফট করে হাত পা ছুঁড়তে লাগলেন, তাঁর কাঠের নাক—কান খসে পড়ল, মুখ দিয়ে ফেনা বেরুতে লাগল, দাঁত কিড়মিড় করতে লাগল, চোখ কপালে উঠল।
পুষ্কলা চেঁচিয়ে বললেন, এই চেড়ীরা, শিগগির আয়, পিসীমা ভিরমি গেছেন। মুখে জলের ছিটে দে, জোরে বাতাস কর, লংকা পুড়িয়ে নাকের ফুটোয় ধোঁয়া দে।
১৩৬২ (১৯৫৫)
হনুমানের স্বপ্ন
রাম রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হইয়া অপ্রতিহত প্রভাবে রাজ্যশাসন ও অপত্যনির্বিশেষে প্রজাপালন করিতে লাগিলেন। কোশলরাজ্য শান্তির ও স্বাস্থ্যের নিলয় হইল, প্রজার গৃহ ধনধান্যে ভরিয়া উঠিল, তস্কর, বঞ্চক ও পণ্ডিতমূর্খগণ বৃত্তিনাশহেতু পলায়ন করিল। দেশে আর্ত পীড়িত নাই, ধর্মাধিকরণে বাদী প্রতিবাদী নাই, কারাগার জনশূন্য। ভিষগগণ রোগীর অভাবে ভোগীর পরিচর্যায় নিযুক্ত হইলেন, বিচারকগণ পরস্পরের ছিদ্রানুসন্ধানে রত হইয়া অবসরবিনোদন করিতে লাগিলেন।
হনুমান এখন অযোধ্যাতেই বাস করেন। রাম তাঁহার জন্য এক সুরম্য কদলী—কাননে সপ্ততল কাষ্ঠভবন নির্মাণ করিয়া দিয়াছেন। মহাবীর তথায় পরম সুখে বাস করিতে লাগিলেন এবং ভক্ত প্রজাবর্গের সমাদরে সর্বাঙ্গীন পরিপুষ্টি লাভ করিলেন।
কিন্তু কয়েক মাস পরেই তাঁহার ভাবান্তর লক্ষিত হইল। অযোধ্যাবাসী উদবিগ্ন হইয়া দেখিল পবননন্দন দিন দিন কৃশ হইতেছেন, তাঁহার কান্তি ম্লান হইতেছে, তাঁহার আর তেমন স্ফূর্তি নাই। রামের আদেশে রাজবৈদ্যগণ হনুমানের চিকিৎসা করিলেন, বিস্তর অরিষ্ট মোদক রসায়নাদির ব্যবস্থা হইল, কিন্তু কোনও উপকার দর্শিল না। ভিষগগণ হতাশ হইয়া বলিলেন, মহাবীরের যে ব্যাধি তাহা আধ্যাত্মিক, ঔষধে সারিবার নয়। অগত্যা বশিষ্ঠ ঋষি হনুমানের মঙ্গলকামনায় এক বিরাট যজ্ঞের উদযোগ করিতে লাগিলেন।