দণ্ডকারণ্যে আমার একটা সঙ্গিনী জুটেছিল, জম্ভলা রাক্ষসী, গোদাবরীতীরে থাকত। সে আমাকে বলল, সখী, তুমি ভেবো না, আমি একটি সুন্দর তরুণ ঋষি যোগাড় করে দেব। জম্ভলা খুব চালাক আর কাজের মেয়ে, চারদিকে ঘুরে সন্ধান নিতে লাগল। তার পর একদিন বলল, চমৎকার একটি ছোকরা ঋষি পেয়েছি দিদিরানী, আমাকে মুক্তোর হার বকশিশ দিতে হবে কিন্তু। জম্ভলা যে খবর দিল তাতে জানলুম, মুদগল নামে একটি সুন্দর তরুণ ঋষি সম্প্রতি জনস্থানে এসেছেন, গোদাবরী নদীর ধারে কুটীর বানিয়ে তপস্যা করছেন। সেই দিনই বিকেলে তাঁকে দেখতে গেলুম।
পুষ্কলা প্রশ্ন করলেন, খুব সেজেগুজে গিয়েছিলে তো?
আরও পঁচিশ খিলি পান মুখে পুরে শূর্পনখা বললেন, তা আর তোকে বলতে হবে না। চোখে কাজল, কপালে তেলাপোকার টীপ, গালের রং যেন দুধে—আলতা, ঠোঁটে পাকা তেলাকুচো, খোঁপায় শিমুল ফুল, কানে ঝুমকো—জবা, গলায় সাতনরী মুক্তোর মালা, পরনে নীল শাড়ি, বুকে সোনালী কাঁচুলি, আর এক গা গহনা। দেখলে পুরুষের মুণ্ডু ঘুরে যায়। মুদগল ঋষির আশ্রমে যখন পৌঁছলুম, তখন তিনি বেদপাঠ করছিলেন। তাঁকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলুম, আমার আগেকার স্বামীর চাইতে ঢের ভাল দেখতে। আমি ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলে তিনি বললেন, ভদ্রে, তুমি কে? কি প্রয়োজনে এসেছ? আমি উত্তর দিলুম, তপোধন, আমি রাজকন্যা শুক্তিনখা—
পুষ্কলা বললেন, ও নাম আবার কোথা থেকে পেলে?
—আসল নামটা ভদ্রলোকের কাছে বলতে ইচ্ছে হল না। বাবা বিশ্রবার যেমন বুদ্ধি, তাই একটা বিশ্রী নাম রেখেছেন। শুক্তিনখা—কিনা ঝিনুকের মতন যার নখ। তার পর আমি বললুম, দ্বিজশ্রেষ্ঠ, আমি কাছেই থাকি। তিন মাস ধরে বিভীতক ব্রত পালন করছি, অহোরাত্রে শুধু একটি বিভীতক ফল অর্থাৎ বয়ড়া আহার করি। কাল আমার ব্রতের পারণ হবে, সেজন্যে একটি ব্রাহ্মণভোজন করাতে চাই। আপনি কৃপা করে কাল মধাহ্নে এই দাসীর কুটীরে পদধূলি দেবেন।
—আচ্ছা পিসীমা, সেই কচি ঋষিটিকে দেখে তোমার নোলা সপসপিয়ে উঠল না?
—তুই কিছুই বুঝিস না। যার প্রতি অনুরাগ হয় তাকে উদরসাৎ করা চলে না। মানুষটাকে যদি খেয়েই ফেলি তবে প্রেমের আর রইল কি? তার পর শোন। —মৃদগল ঋষি বললেন, সুন্দরী, তোমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলুম, কাল মধ্যাহ্নে তোমার ওখানেই ভোজন হবে।
পরদিন মুদগল এলে তাঁকে খুব খাওয়ালুম, নানা রকম ফল, মৃগমাংস আর পায়সান্ন। তাঁর ভোজন শেষ হলে বললুম, তপোধন, এক ঘটি এক মাধ্বীক পান করে দেখুন, অতি স্নিগ্ধ পানীয়, বনজাত পুষ্প থেকে মধুকর যে মধু আহরণ করে তাই দিয়ে আমি নিজে এই মাধ্বীক তৈরি করেছি। মুদগল বললেন, খেলে মত্ততা আসবে না তো? বললুম, না না, মাদক দ্রব্য কি আপনাকে দিতে পারি? খেলে মন প্রফুল্ল হবে, একটু পুলক আসবে। আপনি নির্ভয়ে পান করুন।
মুদগল চেখে চেখে সবটা খেলেন। বললেন, হুঁ, খুব ভালই তৈরি করেছ, বেশ ঝাঁজ। আর আছে? বললুম, আছে বইকি। মুদগল চোঁ চোঁ করে আর এক ঘটি খেলেন, তারপর আরও পাঁচ ঘটি। দেখলুম তাঁর চোখ বেশ ড্যাবডেবে হয়েছে, নাকের ডগায় গোলাপী রং ধরেছে, ঠোঁটে একটু বোকা—বোকা হাসি ফুটেছে, হাত একটু কাঁপছে। এইবারে এঁকে বলা যায়।
বললুম, মুনিবর, আপনাকে দেখে আমি মোহিত হয়েছি, আপনিই আমার প্রাণেশ্বর। আমাকে গন্ধর্ব মতে বিবাহ করুন।
মুদগল কিন্তু তখনও বাগে আসেন নি। বললেন, সুন্দরী, তোমার কুল শীল কিছুই জানি না, পাণিগ্রহণ করব কী করে? তা ছাড়া শাস্ত্রে বলে, স্ত্রীজাতি স্বাতন্ত্র্যের যোগ্য নয়। তুমি অবলা নারী, পিতা—মাতার অধীন, তাঁরাই তোমাকে পাত্রস্থ করবেন।
আমি বললুম, আমার পিতা—মাতা না থাকারই মধ্যে তাঁরা আমার খোঁজ নেন না। আমার আসল পরিচয় শুনুন, আমি হচ্ছি লঙ্কেশ্বর রাবণের ভগিনী।
চমকে উঠে ঋষি বললেন, অ্যাঁ, তুমিই শূর্পনখা। যতই রূপবতী হও রাক্ষসীকে আমি বিবাহ করতে পারি না। শুনেছি শূর্পনখা অতি ভয়ংকরী, নিশ্চয় তুমি মায়ারূপ ধারণ করে এসেছ।
আমি বললুম, ওহে মুদগল, রূপ তো নিতান্তই বাহ্য। আমি যদি মায়াবলে আমার বাহ্য রূপ বর্ধিত করি তাতে অন্যায়টা কি? তোমার ভয় নেই, এই মনোহর রূপেই আমি সর্বদা তোমাকে দর্শন দেব, কেবল রাত্রিতে শয়নকালে রূপসজ্জা বর্জন করব, নইলে আমার ঘুম হবে না। প্রদীপ নিবিয়ে অন্ধকারে আমি তোমার পাশে শোব।
—তোমাকে বিশ্বাস কী? যদি রাত্রিতে তোমার ক্ষুধার উদ্রেক হয় তবে হয়তো আমাকে ভক্ষণ করে ফেলবে।
—ভয় নেই, যাকে তাকে আমি খাই না, আর পতি তো নিতান্ত অভক্ষ্য। শোন মুদগল, আমাকে বিবাহ করলে অতুল ঐশ্বর্য পাবে, দশানন রাবণ, যাঁর ভয়ে ত্রিভুবন কম্পমান, মহাকায় মহাবল কুম্ভকর্ণ, আর সুবুদ্ধি ধর্মপ্রাণ বিভীষণ—এই তিনজকে শ্যালকরূপে পেয়ে ধন্য হবে।
মুদগল ঋষি দেখতে বোকার মতন হলেও অত্যন্ত একগুঁয়ে, কিছুতেই বশে এলেন না। আমার রাগ হল, বললুম, আমাকে অবলা ললনা ঠাউরেছ, নয়? দেখ আমার বল।
মুদগলের দুই কাঁধে হাত দিয়ে চেপে বললুম, লাগছে?
—ছাড় ছাড়।
—এই এক মন চাপ দিলুম, লাগছে?
—উঃ, ছাড় ছাড়।
—এই দু মন চাপ দিলুম, বিয়ে করতে রাজী আছ?
মুদগল যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠলেন, মাধ্বীক যা খেয়েছিলেন, মুখ দিয়ে সব হড়হড় করে বেরিয়ে গেল। আমি বললাম, এই তিন মন চাপ দিলুম, আর একটু দিলেই তোমার মেরুদণ্ড মচকে ভেঙে যাবে। বল, প্রাণেশ্বর হতে রাজী আছ?