দাশু মল্লিককে নমস্কার করে বিদায় নিলুম। এখনও অনেক এক্সপার্ট বাকী, দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী, প্রত্নবিশারদ, পুরাণজ্ঞ, আরও কত কি। অত অভিমত নেবার সময় নেই, একটু না হয় ভুলই হবে। এখন স্মৃতিকথা আরম্ভ করা যাক।—
রাজনন্দিনী পুষ্কলা বললেন, পিসীমা, এই দেখ দু শ খিলি পান সেজেছি। মুক্তোপোড়া চুন, কেরল দেশের কেয়াখয়ের, ঘিএ ভাজা সুপুরি আর তুমি যেসব মশলা ভালবাস—এলাচ লবঙ্গ দারচিনি জাফরান কর্পূর হিং রসুন বিটনুন ইত্যাদি তেত্রিশ রকম সব দিয়েছি। তোমার পানের বাটা ভরতি হয়ে গেছে। এইবারে স্মৃতিকথা বলতে হবে কিন্তু।
রাজভগিনী শূর্পনখা খুশী হয়ে বললেন, লক্ষ্মী মেয়ে তুই। আশীর্বাদ করি রূপে গুণে নিখুঁত একটি বরের সঙ্গে তোর বিয়ে হয়ে যাক, তা হলেই আমরা নিশ্চিন্ত হই।
—বর এখন থাকুক, তুমি স্মৃতিকথা বল।
—সে সব দুঃখের কাহিনী শুনে কি হবে? ওঃ, অযোধ্যার সেই বজ্জাতদের কথা মনে পড়লেই আমার মাথা বিগড়ে যায়, দাঁত কিড়মিড় করে, রক্ত টগবগিয়ে ফোটে, শোক উথলে ওঠে।
—তা হ’ক, তুমি বল।
বিকাল বেলা দোতলার বারান্দায় বাঘের চামড়ার উপর বসে তাকিয়ায় ঠেস দিয়ে শূর্পনখা সমুদ্রবায়ু সেবন করছিলেন, পুষ্কলা পানের বাটা এনে তাঁর পাশে বসলেন।
রাবণবধের পর দু বৎসর কেটে গেছে। বিভীষণ রাজা হয়েই লঙ্কার প্রাসাদ মন্দির উপবন প্রভৃতি মেরামত করিয়েছেন। হনুমান যে ভীষণ ক্ষতি করেছিলেন তার চিহ্ন এখন বেশী দেখা যায় না। বিভীষণ তাঁর ছোটবোনকে একটি আলাদা মহল দিয়েছেন, শূর্পনখা তাঁর চেড়ীদের সঙ্গে সেখানে বাস করেন। বিভীষণ আর সরমার উপর মনে মনে প্রচণ্ড আক্রোশ থাকলেও তাঁদের কিশোরী কন্যা পুষ্কলাকে তিনি স্নেহ করেন।
রাক্ষস ছলৎকারু, খুব ভাল কারিগর, যুদ্ধের সময় ইন্দ্রজিতের আজ্ঞায় সে মায়াসীতা গড়েছিল। ইন্দ্রজিৎ তাঁর রথের উপরে সেই মূর্তি কেটে ফেলে হনুমানকে উদভ্রান্ত করেছিলেন। শূর্পনখা এখন যে সুঁদরী কাঠের নাসাকর্ণ ধারণ করেন তাও ওই ছলৎকারুর রচনা। দেখতে প্রায় স্বাভাবিক, সহজে ধরা যায় না, কিন্তু শূর্পনখার কথার নাকী সুর দূর হয় নি।
পঁচিশ খিলি পান একসঙ্গে মুখগহ্বরে নিক্ষেপ করে শূর্পনখা তাঁর স্মৃতিকথা বলতে লাগলেন। —জানিস কলা, লঙ্কার এই রাজবংশ যেমন মহান তেমনি বিপুল। আমাদের মাতামহ ছিলেন প্রবল—প্রতাপ সুমালী, বিষ্ণুর সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে তিনি লঙ্কা ত্যাগ করে রসাতলে আশ্রয় নেন। তখন যক্ষদের রাজা কুবের লঙ্কা অধিকার করল। সুমালীর কন্যা কৈকসী (যাঁর অন্য নাম নিকষা) মহামুনি বিশ্রবার ঔরসে তিন পুত্র আর এক কন্যা লাভ করেন। বড় ছেলে রাবণ, মেজো কুম্ভকর্ণ, ছোট তোর বাপ বিভীষণ, আর তাঁদের ছোট আমি। বিশ্রবার প্রথম পক্ষে এক ছেলে ছিল, সেই হল কুবের। রাবণ ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠলেন, তখন বিশ্রবা মুনির উপদেশে কুবের লঙ্কা ছেড়ে হিমালয়ের ওপারে পালিয়ে গেল, লঙ্কা আবার আমাদের দখলে এল।
পুষ্কলা বললেন, ওসব ইতিহাস তো আমার জানা আছে, তুমি নিজের কথা বল। তোমার একবার বিয়ে হয়েছিল না?
আরও পঁচিশ খিলি পান মুখে পুরে শূর্পনখা বললেন, বিয়ে তো একবার হয়েছিল। দানবরাজ বিদ্যুৎজ্জিহ্ব আমার স্বামী ছিলেন, অতি সুপুরুষ আর আমার খুব বাধ্য। কিন্তু বড়দার তো কাণ্ডজ্ঞান ছিল না, কালকেয় দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করবার সময় নিজের ভগিনীপতিকেই মেরে ফেললেন। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে লঙ্কেশ্বরকে যাচ্ছেতাই গালাগালি দিলুম। তিনি বললেন, চেঁচাস নি বোন, একটা স্বামী মরেছে তো হয়েছে কি? যুদ্ধের সময় আমি প্রমত্ত হয়ে শরক্ষেপণ করি, তোর স্বামীকে চিনতে না পেরে বধ করে ফেলেছি। যা হবার তাই হয়ে গেছে, এখন শোক সংবরণ কর, তোর জন্যে আমি ভাল ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আমাদের মাসতুতো ভাই খর চোদ্দ হাজার সৈন্য নিয়ে দণ্ডকারণ্যে যাচ্ছে, তুই এর সঙ্গে সেখানে যা। খর তোর সমস্ত আজ্ঞা পালন করবে। দণ্ডকারণ্য খাসা জায়গা, বিস্তর ঋষি সেখানে তপস্যা করেন, অনেক ক্ষত্রিয় রাজাও মৃগয়া করতে যান। সেখানে তুই অনায়াসে আর একটি স্বামী জুটিয়ে নিতে পারবি।
খর—দাদার সঙ্গে দণ্ডকারণ্যে গেলুম। সত্যিই ভাল জায়গা, বিশেষ করে জনস্থান অঞ্চল, সেখানে আমরা বসতি করলুম। কিন্তু বড়দার সব কথা সত্যি নয়, ক্ষত্রিয় সেখানে কেউ আসত না, ঋষিও খুব কম, রাক্ষসের ভয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে তপস্যা করত। তবে খাবার জিনিসের অভাব নেই, বিস্তর আম কাঁঠাল কলা নারকেল, মধুও প্রচুর। নানা জাতের হরিণও পাওয়া যায়।
পুষ্কলা প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা পিসীমা, তুমি ঋষি খেয়েছ?
মুখে আবার পঁচিশ খিলি পান পুরে শূর্পনখা বললেন, আমাদের বাপ মহামুনি বিশ্রবা ঋষি—খাওয়া পছন্দ করতেন না। ছোটলোক রাক্ষসরা নরমাংস ভালবাসে, কিন্তু আমরা রাজবংশের মেয়েপুরুষ বড় একটা খেতুম না। তবে কোনও মানুষের উপর বেশী চটে গেলে তাকে ভক্ষণ করতুম আর পূজো—পার্বণে নিকুম্ভিলা দেবীস্থানে নরবলি দিয়ে সেই পবিত্র মাংস খেতুম। আমি বার পাঁচেক ঋষি খেয়েছি, ছিবড়ে বড় বেশী, কিন্তু ক্ষত্রিয় রাজা আর রাজপুত্রদের মাংস ভাল, কচি পাঁঠার মতন। সে—সব দিন আর নেই রে পুষ্কলা, তোর বাপের কি যে মতিচ্ছন্ন হল, সব বন্ধ করে দিয়েছে। তারপর শোন—দণ্ডকারণ্যে বেশ ফুর্তিতেই ছিলুম, কিন্তু দিন কতক পরে বড় ফাঁকা ফাঁকা ঠেকতে লাগল, মনটা উদাস হয়ে পড়ল। বড় ঘরানার দানব বা রাক্ষস সে অঞ্চলে কেউ নেই, অগত্যা ঋষির সন্ধান করতে লাগলুম। বেশীর ভাগই বুড়ো হাবড়া, মাথায় জটা, এক মুখ দাড়িগোঁফ, তাদের সঙ্গে প্রেম হতে পারে না।