বললুম—মাদার লক্ষ্মী , আমার কোমরে বাত। নাচতে কবিরাজের বারণ আছে।
—তবে তুমি গান গাও, আমরাই নাচি!
কি আর করা যায়, পড়েছি যবনের হাতে। একটা রামপ্রসাদী ধরলুম।
সমস্ত পথটা এই রকম চলল, অবশেষে মোগলসরাই এল। মেম বললে, কলকাতায় গিয়েই তাদের বিয়ে হবে, আমি যেন তিন দিন পরে গ্রাণ্ড হোটেলে অতি অবশ্য তাদের সঙ্গে দেখা করি। বিস্তর শেকহ্যাণ্ড, বিস্তর অনুরোধ, তারপর নেমে কাশীর গাড়ি ধরলুম।…পরদিন আবার কলকাতা যাত্রা।’
বিনোদবাবু বলিলেন—’আচ্ছা চাটুজ্যেমশায় গিন্নী সব কথা শুনেছেন?’
‘কেন শুনবেন না। সতীলক্ষ্মী, তার পঞ্চাশ বছর বয়স হয়েছে। তোমাদের নবীনাদের মতন অবুঝ নন যে অভিমানে চৌচির হবেন। আমি বাড়ি ফিরে এসেই তাঁকে সমস্ত বলেছি।’
‘চাটুজ্যেগিন্নী শুনে কি বললেন?’
‘তক্ষুনি একটা উড়ে নাপিত ডেকে বললেন—’দে তো রে, বুড়োর মুখখানা আচ্ছা ক’রে চেঁচে, ম্লেচ্ছ মাগী উচ্ছিষ্টি ক’রে দিয়েছে!’ তারপর সেই চুনির আংটিটা কেড়ে নিয়ে গঙ্গাজলে ধুয়ে নিজের আঙুলে পরলেন।’
‘বউভাতের ভোজটা কি রকম খেলেন?’
‘সে দুঃখের কথা আর না—ই শুনলে। গ্রাণ্ড হোটেলে গিয়ে জানলুম ওরা কেউ নেই। একটা খানসামা বললে—বিয়ের পরদিনই বেটী পালিয়েছে। সায়েব তাকে খুঁজতে গেছে।’
স্মৃতিকথা
নয়নচাঁদ পাইনের ঘড়ির দোকান আছে, নানারকম শখও আছে। তিনি শাস্ত্র পড়েন, পাখোয়াজ বাজান, মাছ ধরেন, সাহিত্যের খবরও রাখেন। প্রবীণ লোক, পাড়ার সকলেই খাতির করে। সকালবেলা আমার কাছে এসে বললেন, এই নাও তোমার ঘড়ি। হেয়ারস্প্রিং বদলে দিয়েছি, পনরো টাকা দিও, তুমি পাড়ার ছেলে, অয়েলিং—এর চার্জ আর তোমার কাছে নেব না।
টাকা নিয়ে নয়নচাঁদ বললেন, ও কি লেখা হচ্ছে?
উত্তর দিলুম, একটা স্মৃতিকথা লিখছি।
—বেশ বেশ, গল্পের চাইতে ঢের ভাল। কিন্তু বেশী মিছে কথা লিখো না, যা রয় সয় তাই লিখবে। কলেরা থেকে উঠেই ফুটবল ম্যাচ খেলেছ, দেশের জন্যে দশ বছর জেল খেটেছ, তিনটে মেয়ে তোমাকে প্রেমপত্র লিখেছিল, রবীন্দ্রনাথ নিজের হাতে তোমার পিঠ চাপড়েছিলেন, এসব লিখতে যেয়ো না। আর একটি কাজ তোমাদের করা উচিত, কিছু লেখবার আগে এক্সপার্ট ওপিনিয়ন নেবে, ডাক্তার উকিল প্রফেসর ব্যবসাদার এইসব লোকের। তা হলে আর মারাত্মক ভুল করে বসবে না।
পাইন মশায়ের উপদেশ মনে লাগল। যা লেখবার আগেই স্থির করে ফেলেছি, তবে বিশেষজ্ঞদের মত এখনও নেওয়া যেতে পারে।
প্রথমেই গেলুম ডাক্তার নির্মল মুখুজ্যের কাছে। তিনি বললেন, কি খবর, কোমরের বেদনাটা আবার বেড়েছে নাকি?
—না না, ওসব কিছু নয়। আচ্ছা ডাক্তার, আমি যদি কোনও লোকের দুই কাঁধে হাত দিয়ে খুব চাপ দিই তা হলে তার শিরদাঁড়া ভাঙতে পারে?
—কতখানি চাপ?
—এই ধর দু—আড়াই মন।
অর্থাৎ এক শ কিলোগ্রামেরও কম। তাতে লোকটা কাবু হতে পারে, স্ক্যাপিউলা ফ্র্যাকচার হতে পারে, কিন্তু তিন চার মন চাপের কমে শিরদাঁড়া ভাঙবে মনে হয় না। ও কাজ করতে যেয়ো না, ফৌজদারিতে পড়বে।
ডাক্তারকে থ্যাংকস দিয়ে উকিল নগেন সেনের কাছে গেলুম। তিনি বললেন, ওহে, আমার একটা বিল এখনও শোধ কর নি, টাকাটা কালকের মধ্যে পাঠিয়ে দিও।
—যে আজ্ঞে। একটা কথা জানতে এসেছি।—একটি মেয়ে যদি জুলুম ক’রে একজন পুরুষকে বিবাহে রাজী করায় এবং পুরুষটি পরে অস্বীকার করে, তা হলে ব্রীচ অভ প্রমিস মকদ্দমা চলতে পারে?
—যদি প্রমাণ হয় যে জবরদস্তির ফলে পুরুষটি রাজী হয়েছিল তা হলে কেস টিকবে না।
—আচ্ছা, যদি প্রমাণ হয় যে জবরদস্তির পরেও পুরুষটি খোশ—মেজাজে মেয়েটিকে প্রিয়ে বলেছিল?
—তাই বলেছিলে নাকি হে? আচ্ছা বোকা তুমি। নাঃ, তা হলে আর নিস্তার নেই। তোমার এ কুবুদ্ধি হল কেন?
—আজ্ঞে আমি নই। আচ্ছা চললুম, নমস্কার।
তার পর গেলুম দাশু মল্লিকের কাছে। লোকটি বিখ্যাত মাতাল, তবে মেজাজ ভাল। আমাকে দেখেই বললেন, আরে তোমাকেই খুঁজছিলুম, একটা দরকারী কথা জানতে চাই। তুমি তো কেমিস্ট্রি পড়েছিলে?
—সে বহুকাল আগে, এখন সব ভুলে গেছি।
—একটু তো মনে আছে, তাতেই কাজ চলবে। দেখ ভাই, বড়ই মুশকিলে পড়েছি, কান্ট্রি আমার সয় না, অথচ বিলিতী একবারে আগুন, শুনছি সবরকম মদই বন্ধ করা হবে, যত সব গো মুখখু আইন তৈরী করছে। আচ্ছা, মিষ্টি জিনিস গেঁজে উঠলেই তো মদ হয়?
—তা হয়। কিন্তু বাড়িতে ওসব করতে যাবেন না, ফ্যাসাদে পড়বেন।
—আরে না না। আমি একটা মতলব ঠাউরেছি, আবগারির বাবার সাধ্য নেই যে ধরে। মনে কর আমি এক পো চিনি কিংবা গুড় খেলুম, সেই সঙ্গে একটু ঈস্ট বা পাঁউরুটিওয়ালাদের খামি খেলুম। তাতে পেটের মধ্যে বুঁদি কেটে স্পিরিট হবে না?
—আজ্ঞে না, আপনার পেটটি তো ভাঁটি নয়। গেঁজে উঠবার আগেই হজম হয়ে যাবে, না হয় প্রস্রাবের সঙ্গে বেরুবে।
—তবেই তো মুশকিল। যাক তোমার কি দরকার বল।
—আচ্ছা মল্লিক মশায়, যদি মদ খাওয়ার অভ্যাস না থাকে তবে কতটা খেলে নেশা হবে?
—বেশ বেশ, ওদিকে তোমার মতি হয়েছে জেনে খুশী হলুম। ট্রাই করেই দেখ না, এক আউন্স রম বা জিন থেকে শুরু করতে পার।
—আজ্ঞে আমি নই, আমার স্মৃতিকথার একটি লোককে খাওয়াতে চাই।
—আরে দূর দূর। তা আউন্স চারেক খাওয়াতে পার, গল্পের নেশায় তো দাম লাগবে না।