ব্লটো বোধ হয় আড়ি পেতে সমস্ত শুনছিল। হঠাৎ কামরায় ছুটে ফিরে এসে ঘুষি তুলে বললে, কে হতভাগা, কে মাতাল, কে বেঁটে বজ্জাত?
সকলেরই বিশ্বাস যে গান আর গালাগালি হিন্দীতেই ভাল রকম জমে। হিন্দী গালাগালের প্রসাদগুণ খুব বেশী তা স্বীকার করি। কিন্তু যদি নিছক আওয়াজ আর দাপট চাও তবে বিলিতী গাল শুনো—বিশেষ ক’রে মার্কিনী গাল। এক—একটি লবজ যেন তোপ, কানের ভেতর দিয়ে মরমে পশে। ইংরিজী আমি ভাল জানি না, সব গালাগালির অর্থ বুঝতে পারি নি, কিন্তু তাতে রসগ্রহণের কিছু মাত্র বাধা হয় নি।
দেখলুম এক বিষয়ে সায়েবরা আমাদের চেয়ে দুর্বল—তারা বাগযুদ্ধ বেশীক্ষণ চালাতে পারে না। দু—মিনিট যেতে না যেতেই হাতাহাতি আরম্ভ হ’ল। আমি হতভম্ভ হ’য়ে দেখতে লাগলুম, গাড়ি যখন কানপুরে এসে থামল, তা টের পাই নি।
হনহন ক’রে মেমসাহেব এসে পড়ল। এই গজ—কচ্ছপের লড়াই থামানো কি তার কাজ? বললে—টিমি ডিয়ার, ডোণ্ট —ব্লটো ডারলিং, ডোণ্ট—প্লিজ প্লিজ ডোন্ট। কিছুই ফল হ’ল না। আমি বেগতিক দেখে গাড়ি থেকে নেমে ছুটলুম।
ফার্স্ট সেকেণ্ড ক্লাস সমস্ত খালি। ডাইনিং কারে সকলে তখনও খানা খাচ্ছে। কাকে বলি? ওই যে—একটা সাদা ফ্লানেলের পেন্টুলুন—পরা সায়েব প্লাটফর্মে পাইচারি ক’রে শিস দিচ্ছে। হন্তদন্ত হ’য়ে তাকে বললুম—কাম সার, লেডির মহা বিপদ। সায়েব হুশ ক’রে একটি জোর শিস দিয়ে আমার সঙ্গে ছুটল।
মেম তখন আমার লাঠিটা নিয়ে অপক্ষপাতে দু—ব্যাটাকেই পিটছিলেন। কিন্তু তাদের ভ্রূক্ষেপ নেই, সমানে ঝুটোপুটি করছে। আগন্তুক সায়েবটি মেমকে জিজ্ঞাসা করলে—হেলো জোন, ব্যাপার কি? মেম তাড়াতাড়ি ব্যাপার বুঝিয়ে দিলেন। সাহেব টিমি আর ব্লটোকে থামাবার চেষ্টা করলে, কিন্তু তারা তাকেই মারতে এল। নতুন সায়েবের তখন হাত ছুটল।
বাপ কি ঘুষির বহর? টিমি ঠিকরে গিয়ে দরজায় মাথা ঠুকে প’ড়ে চতুর্দশ ভুবন অন্ধকার দেখতে লাগল। ব্লটো কোঁক ক’রে বেঞ্চের তলায় চিতপাত হ’য়ে পড়ল। বিলকুল ঠাণ্ডা।
একটু জিরিয়ে নিয়ে মেম আমার সঙ্গে নতুন সায়েবটির পরিচয় করিয়ে দিলেন—ইনি বিখ্যাত মিস্টার বিল বাউণ্ডার, খুব ভাল ঘুষি লড়তে পারেন। আর ইনি মিস্টার চ্যাটার্জি, ভেরি ডিয়ার ওল্ড ফ্রেণ্ড।
সায়েব আমার মুখখানা দেখে বললে—সাম বিয়ার্ড!
মেম বললেন—থাকুক দাড়ি। ইনি অতি জ্ঞানী লোক।
সায়েব আমার হাতটা খুব ক’রে নেড়ে দিয়ে বললে—হা—ডু—ডু? বেশ শীত পড়েছে নয়?
ধাঁ করে আমার মাথায় একটা মতলব এল। মেমসায়েবকে চুপি চুপি বললুম—দেখুন মিস জোন, অত গোলমালে কাজ কি? টিমি আর ব্লটো দুজনেই তো কাবু হ’য়ে পড়েছে। আমি বলি কি—আপনি এই বিল সায়েবকে বিয়ে করুন। খাসা লোক।
মেম বললেন—রাইটো। আমার একথা এতক্ষণ মনেই পড়ে নি। আই সে বিল, আমায় বিয়ে করবে?
বিল বললে—রাদার। কে বলে আমি করব না?….
রাধামাধব! সায়েব জাতটা ভারী বেহায়া। বিলকে বাধা দিয়ে বললুম—রোসো সায়েব, এক্ষুনি ও সব কেন। আমি হচ্ছি ব্রাইডমাস্টার—কন্যাকর্তা। তোমার কুলশীল আগে জেনে নি, তার পর আমি মত দেব।
বিল বললে—আমার ঠকুরদা ছিলেন মুচি। আমার বাপও ছেলেবেলায় জুতো সেলাই করতেন।
আমি বললুম—তাতে কুলমর্যাদা কমে না। তোমার আয় কত?
বিল একটু হিসেব করে বললে—মিনিটে হাজার, ঘণ্টায় ছ লাখ; কিন্তু চিন্তা করবেন না, আমার মাসী মারা গেলে আয় আর একটু বাড়বে। তাঁর পঁচিশটা বড় বড় পুকুর আছে, নোনা জলে ভরতি, তাতে তিমি মাছ কিলবিল করছে।
বললুম—থাক, আর বলতে হবে না, আমি মত দিলুম। এগিয়ে এস, আমি আশীর্বাদ করব, রিয়াল হিন্দু স্টাইল।
কিন্তু ধান—দুব্বো কই? জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে বললুম—এই কুলী, জলদি থোড়া ঘাস ছিঁড়কে লাও, পয়সা মিলেগা।
ইংরিজী আশীর্বাদ তো জানি না। বললুম—যদি আপত্তি না থাকে তবে বাংলাতেই বলি।
—নিশ্চয়, নিশ্চয়।
সাহেবের মাথায় এক মুঠো ঘাস দিয়ে বললুম—বেঁচে থাক। ধন তো যথেষ্ট আছে, পুত্রও হবে, লক্ষ্মী এই সঁপে দিলুম। কিন্তু খবরদার ব্যাটা, বেশী মদ—টদ খেয়ো না, তা হ’লে ব্রহ্মশাপ লাগবে। সাহেব আর একবার আমার হাতে ঝাঁকুনি দিয়ে নড়া ছিঁড়ে দিলে।
মেমকে বললুম—মা লক্ষ্মী, তোমার ঠোঁটের সিঁদুর অক্ষয় হ’ক। বীরপ্রসবিনী হ’য়ে কাজ নেই মা—ও আশীর্বাদটা আমাদের অবলাদের জন্যেই তোলা থাক। তুমি আর গরিব কালা—আদমীদের দুঃখের নিমিত্ত হয়ো না,—গুটিকতক শান্তশিষ্ট কাচ্চা বাচ্চা নিয়ে ঘরকন্না কর।
মেম হঠাৎ তার মুখখানা উঁচু ক’রে আমার সেই পাঁচ দিনের খোঁচা—খোঁচা দাড়ির ওপর—’
বিনোদবাবু বলিলেন—’আ ছি ছি ছি।’
চাটুজ্যেমশায় বলিলেন—’হুঁ, দেবীচৌধুরানীতে ঐ রকম লিখেছে বটে।’
‘আচ্ছা চাটুজ্যেমশায়, পাকা লঙ্কার আস্বাদটা কি রকম লাগল?’
‘তাতে ঝাল নেই। আরে, ঐ হ’ল ওদের রেওয়াজ, ঐ রকম ক’রেই ভক্তিশ্রদ্ধা জানায়, তাতে লজ্জা পাবার কি আছে।’
চাটুজ্যেমশায় বলিতে লাগিলেন—’তারপর দেখি ঢ্যাঙা আর বেঁটে মুখ চুন ক’রে নেমে যাচ্ছে, জন—দুই কুলী তাদের মালপত্র নামাচ্ছে।
গাড়ি ছাড়ল। বিল আর জোন হাত ধরাধরি ক’রে নাচ শুরু ক’রে দিলে। আমি ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে দেখতে লাগলুম।
জোন বললে—চ্যাটার্জি, এই আনন্দের দিনে তুমি অমন ম্লান হ’য়ে বসে থেকো না। আমাদের নাচে যোগ দাও।