মেম বললেন—সে একটি সমস্যা। আমি এখনও মনস্থির করতে পারি নি। কখনও মনে হয় টিমিই উপযুক্ত পাত্র, বেশ লম্বা সুপুরুষ, আমাকে ভালও বাসে খুব। কিন্তু মদ খেলেই ওর মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আর ঐ ব্লটো, যদিও বেঁটে মোটা, আর একটু বয়স হয়েছে, কিন্তু আমার অত্যন্ত বাধ্য আর নরম মন। একটু মদ খেলেই কেঁদে ফেলে। বড় মুশকিলে পড়েছি, দুজনেই নাছোড়বান্দা। যা হক এখনও ক—ঘন্টা সময় পাওয়া যাবে, হাওড়া পৌঁছবার আগেই স্থির ক’রে ফেলব। আচ্ছা চ্যাটার্জি, তুমিই বল না—এদের মধ্যে কাকে বিয়ে করা উচিত।
বললুম—মেমসায়েব, আপনি এঁদের স্বভাবচরিত্র যে প্রকার বর্ণনা করলেন তাতে বোধ হয় দুটিই অতি সুপাত্র। তবে কি না এঁরা যেরকম বেহুঁশ হয়ে আছেন—
মেম বললেন—ও কিছু নয়। একটু পরেই দুজনে চাঙ্গা হ’য়ে উঠবে।
আমি বললুম—আপনার নিজের যদি কোনওটির ওপর বেশী ঝোঁক না থাকে, তবে আপনার বাপ—মার ওপর স্থির করার ভার দিন না?
মেম বললেন—আমার বাপ—মা কেউ নেই, নিজেই নিজের অভিভাবক। দেখ চ্যাটার্জি, তোমার ওপরেই ভার দিলুম। তুমি বেশ ক’রে দুটোকে ঠাউরে দেখ। মোগলসরাই এ নেমে যাবার আগেই তোমার মত আমাকে জানাবে। ভেবেছিলুম একটা টাকা ছুঁড়ে চিত—উবুড় করে দেখে মনস্থির করব, কিন্তু তুমি যখন রয়েছ তখন আর দরকার নেই।
ব্যবস্থা মন্দ নয়। আত্মীয়—বন্ধুদের জন্যে এ পর্যন্ত বিস্তর বর—কনে ঠিক ক’রে দিয়েছি, কিন্তু এমন অদ্ভুত পাত্র দেখার ভার কখনও পাই নি। দুজনেই ক্রোরপতি, দুটোই পাঁড়মাতাল। একটা লম্বায় বড়, আর একটা ওজনে পুষিয়ে নিয়েছে। বিদ্যা—বুদ্ধির পরিচয় এ যাবৎ যা পেয়েছি তা শুধু ঘোঁত ঘোঁত। চুলোয় যাক, মেমের যখন আপত্তি নেই তখন যেটার হয় নাম বলব। আর যদি বুঝি যে মেম আমার কথা রাখবে, তবে বলব—মা লক্ষ্মী, মাথা যখন আগেই মুড়িয়েছ তখন বাকী কাজটুকুও সেরে ফেল।—এই দু—ব্যাটা ভাবী স্বামীকে ঝেঁটিয়ে নরকস্থ কর।
গল্প করতে করতে বেলা প্রায় সাড়ে নটা হ’য়ে এল। এর পরেই একটা ছোট স্টেশনে গাড়ি থামবে, সেই অবসরে সায়েব—মেমরা হাজরি খেতে খানা কামরায় যাবে। এতক্ষণ ঠাওর হয় নি, এখন দেখতে পেলুম চা খেয়ে মেমের ঠোঁট ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বুঝলুম রংটি কাঁচা। মেম একটি সোনার কৌটো খুললেন, তা থেকে বেরুল একটি ছোট আরশি, একটি লাল বাতি, একটি পাউডারের পুঁটুঁলি। লালবাতি ঠোঁটে ঘ’ষে নাকে একটু পাউডার লাগিয়ে মুখখানি মেরামত ক’রে নিলেন।
গাড়ি থামল। মেম বললেন—চ্যাটার্জি, আমি ব্রেকফাস্ট খেতে চললুম। টিমি আর ব্লটো রইল, এদের দিকে একটু নজর রেখো, যেন জেগে উঠে মারামারি না করে। যদি সামলাতে না পার তবে শেকল টেনো।
আহা, কি সোজা কাজই দিয়ে গেলেন! প্রায় আধ ঘণ্টা পরে কানপুরে গাড়ি থামবে, তখন মেম আবার এই কামরায় ফিরে আসবেন। ততক্ষণ মরি আর কি! লাঠিটা বাগিয়ে নিয়ে ফের দুর্গানাম জপ করতে লাগলুম।
ঢ্যাঙা সায়েবটা উঠে বসেছে। হাই তুললে, চোখ রগড়ালে, আঙুল মটকালে। আমার দিকে একবার কটমট ক’রে চাইলে, কিন্তু কিছু বললে না। টলতে টলতে বাথরুমে গেল।
তখন বেঁটেটা তড়াং করে উঠে কোলা ব্যাঙের মতন থপ ক’রে আমার পাশে এসে বসল। আমি ভয়ে চেঁচাতে যাচ্ছিলুম, কিন্তু তার আগেই সে আমার হাতটা নেড়ে দিয়ে বললে—গুড় মর্নিং সার, আমি হচ্ছি ক্রিস্টফার কলম্বস ব্লটো।
আমি সাহস পেয়ে বললুম—সেলাম হুজুর।
—আমার দশ কোটি ডলার আছে। প্রতি মিনিটে আমার আয়—
—হুজুর দুনিয়ার মালিক তা আমি জানি।
ব্লটো আমার বুকে আঙুল ঠেকিয়ে বললে—লুক হিয়ার বাবু, আমি তোমাকে পাঁচ টাকা বকশিশ দেবো।
—কেন হুজুর।
—মিস জিলটারকে তোমায় রাজী করাতেই হবে। আমি তোমাদের সমস্ত কথা শুনেছি। তোমারই ওপর সমস্ত ভার, তুমিই কন্যাকর্তা। ঐ টিমথি টোপার—ও অতি পাজী লোক, ওর সমস্ত সম্পত্তি আমার কাছে বাঁধা আছে। ও একটা পাঁড়মাতাল, পপার, ওর সঙ্গে বিয়ে হ’লে মিস জিলটার মনের দুঃখে মারা যাবেন।
এই ব’লে ব্লটো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। একটা বোতলে একটু তলানি পড়ে ছিল, সেটুকু খেয়ে ফেলে বললে—বাবু, তুমি জন্মান্তর মান?
—মানি বইকি।
—আমি আর জন্মে ছিলাম একটি তৃষিত চাতক পক্ষী, আর এই মেম ছিল একটি রূপসী পানকৌড়ি। আমরা দুটিতে—
এমন সময় বাথরুমের দরজা ন’ড়ে উঠল। ব্লটো তাড়াতাড়ি আমাকে পাঁচ আঙুল দেখিয়ে ইশারা ক’রেই ফের নিজের জায়গায় শুয়ে নাক ডাকতে লাগল।
ঢ্যাঙা সায়েব—মেম যাকে টিমি বলে—ফিরে এসে নিজের বেঞ্চে গ্যাঁট হয়ে বসল। তখন ব্লটো জেগে ওঠার ভান ক’রে হাই তুললে, চোখ রগড়ালে, আমার দিকে একবার করুণ নয়নে চেয়ে বাথরুমে ঢুকল।
এবার টিমির পালা। ব্লটো স’রে যেতেই সে কাছে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলে। আমি আগে থাকতেই বললুম—গুড মর্নিং সার।
টিমি আমার হাতটায় ভীষণ মোচড় দিলে।
বললুম —উঃ!
টিমি বললে—তোমার হাড় গুঁড়ো ক’রে দেব।
ভয়ে ভয়ে বললুম—ইয়েস সার।
—তোমায় থেঁতলে জেলি বানাব।
—ইয়েস সার।
—মিস জোন জিলটারকে আমি বিয়ে করবই! আমি সমস্ত শুনেছি। যদি আমার হয়ে তাকে না বল তবে তোমাকে বাঁচতে হবে না।
—ইয়েস সার।
—আমার অগাধ সম্পত্তি। পাঁচটা হোটেল, দশটা জাহাজ কোম্পানি, পঁচিশটা শুঁটকী শুওরের কারখানা। ব্লটোর কি আছে? একটা মদের চোরা ভাঁটি, তাও আমার টাকায়। ব্লটো একটা হতভাগা মাতাল বেঁটে বজ্জাত—