আমি সাহস পেয়ে সায়েব দুটোকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম—ঁরা কারা?
মেমটি বড়ই সরলা। বেঞ্চির উপরের ঢ্যাঙা সায়েবের দিকে কড়ে আঙুল বাড়িয়ে বললেন—দ্যাট চ্যাপি হচ্ছেন টিমথি টোপার, নিবাস কালিফোর্নিয়া, আমাকে বিবাহ করতে চান। ইনি দশ কোটির মালিক। আর যিনি গড়াগড়ি যাচ্ছেন, উনি হচ্ছেন ক্রিস্টফার কলম্বস ব্লটো, ইনিও আমাকে বিবাহ করতে চান, এঁরও দশ কোটি ডলার আছে।
আমি গম্ভীরভাবে বললুম—কলম্বস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন।
মেম বললেন—সে অন্য লোক। এঁরা আমেরিকায় থেকেও কিছু আবিষ্কার করতে পারেন নি। দেশটা একদম শুকিয়ে গেছে, মেথিলেটেড স্পিরিট ছাড়া কিছুই মেলে না। তাই এঁরা দেশত্যাগী হ’য়ে খাঁটি জিনিসের সন্ধানে পৃথিবীময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
জিজ্ঞাসা করলুম—এঁরা বুঝি মস্ত স্পিরিচুয়ালিস্ট?
মেম বললেন—ভেরি!
এমন সময় ঢ্যাঙা সায়েবটা চোখ মেলে কটমট ক’রে চেয়ে আমার দিকে ঘুষি তুলে বললে—ইউ—ইউ গেট আউট কুইক। বেঁটেটাও হঠাৎ হাত—পা ছুড়তে শুরু করলে।
আমি আমার লাঠিটা বাগিয়ে ধ’রে ঠক ঠক ক’রে ঠুকতে লাগলুম। মেমসায়েব বিছানা থেকে তাঁর পালকমোড়া চটিজুতো তুলে নিয়ে ঢ্যাঙার দুই গালে পিটিয়ে আদর ক’রে বললেন—ইউ পগ ইউ পগ। বেঁটেটাকে লাথি মেরে বললেন—ইউ পিগ, ইউ পিগ। দুটোই তখনই আবার হাঁ ক’রে ঘুমিয়ে পড়ল। মেম তাদের বুকের ওপর এক—এক পাটি চটি রেখে দিয়ে স্বস্থানে ফিরে এসে বললেন—ভয় নেই বাবু।
ভরসাই বা কই? আরব্য উপন্যাসে পড়েছিলুম একটা দৈত্য এক রাজকন্যাকে সিন্দুকে পুরে মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াত। দৈত্যটা ঘুমুলে রাজকন্যা তার বুকের ওপর একটা ঢিল রেখে দিয়ে যত রাজ্যের রাজপুত্তুর জুটিয়ে আংটি আদায় করতেন। ভাবলুম এইবার সেরেছে রে! এই মেমসায়েব দু—দুটো দৈত্যের ঘাড়ে চ’ড়ে বেড়াচ্ছে, এখনই নিরানব্বই আংটির মালা বার করবে।
যা ভয় করছিলুম ঠিক তাই। আমার হাতে একটা রূপো আর তামার তারে জড়ানো পলা—বসানো আংটি ছিল। মেম হঠাৎ সেটাকে দেখে বললেন—হাউ লভলি! দেখি বাবু কি রকম আংটি।
আমি ভয়ে ভয়ে হাতটি এগিয়ে দিলুম, যেন আঙুলহাড়া অস্তর করাচ্ছি। মেম ফস করে আংটিটি খুলে নিয়ে নিজের আঙুলে পরিয়ে বললেন—বিউচিফুঃ!
হরে রাম! এ যে আমার ত্রিসন্ধ্যা জপ করার আংটি,—হায় হায়, এই ম্লেচ্ছ মাগী সেটাকে অপবিত্র ক’রে দিলে! আমার চোখ ছলছল ক’রে উঠল, কিন্তু কৌতূহলও খুব হ’ল। বললুম—মেমসায়েব, আপকা আর কয়ঠো আংটি হ্যায়? নাইন্টিনাইন?
মেম বেঞ্চির তলা থেকে একটি তোরঙ্গ টেনে এনে তা থেকে একটি অদ্ভুত বাক্স খুলে আমাকে দেখালেন। চোখ ঝলসে গেল। দেরাজের পর দেরাজ কোনওটায় গলার হার, কোনওটায় কানের দুল, কোনওটায় আর কিছু। একটা আংটির ট্রে—তাতে কুড়ি—পঁচিশটা হবে—আমার সামনে ধরে বললেন—যেটা খুশি নাও বাবু!
আমি বললুম—সে কি কথা। আমার আংটির দাম মোটে ন—সিকে। আমি, ওটা আপনাকে প্রেজেন্ট করলুম, সাবধানে রাখবেন, ভেরি হোলি আংটি।
মেম বললেন—ইউ ওল্ড ডিয়ার! কিন্তু তোমার উপহার যদি আমি নিই, আমার উপহারও তোমার ফেরত দেওয়া উচিত নয় । এই ব’লে একটা চুনির আংটি আমার আঙুলে পরিয়ে দিলেন। বললুম—থ্যাংক ইউ মেমসায়েব, আমি আপনার গোলাম, ফরগেট মি নট। মনে মনে বললুম—ভয় নেই ব্রাহ্মণী, এ আংটি তোমার জন্যেই রইল।
ট্রেন এটাওআয় এসে পৌঁছল। কেলনারের খানসামা চা রুটি মাখন নিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলে—টি হুজুর? মেম ট্রে রাখলেন। তারপর আমার লাঠিটা নিয়ে ঢ্যাঙা আর বেঁটেকে একটু গুঁতো দিয়ে বললেন—গেট আপ টিমি, গেট আপ ব্লটো। তারা বুনো শুয়োরের মতন ঘোঁত ঘোঁত ক’রে কি বললে শুনতে পেলুম না। আন্দাজে বুঝলুম তাদের ওঠবার অবস্থা হয়নি। মেম আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—চ্যাট্যার্জি, তুমি খাবে। আপত্তি নেই তো?
মহা ফাঁপরে পড়া গেল। ম্লেচ্ছ নারীর স্বহস্তে মিশ্রিত, কিন্তু ভুরভুরে খোশবায়, শীতটাও খুব পড়েছে। শাস্ত্রে চা খেতে বারণ কোথাও নেই। তা ছাড়া রেলগাড়ির মতন বৃহৎ কাষ্ঠে ব’সে শীত নিবারণের জন্যে ঔষধার্থে যদি চা পান করা যায় তবে নিশ্চয়ই দোষ নাস্তি। বললুম—ম্যাডাম লক্ষ্মী, তুমি যখন নিজ হাতে চা দিচ্ছ, তখন কেন খাব না। তবে রুটিটা থাক।
চায়ে মনের কপাট খুলে যায়, খেতে খেতে অনেক বেফাঁস কথা মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। অশ্বত্থামা যেমন দুধের অভাবে পিটুলিগোলা খেয়ে আহ্লাদে নৃত্য করতেন, নিরীহ বাঙালী তেমনি চায়েতেই মদের নেশা জমায়। বঙ্কিম চাটুজ্যে তারিফ ক’রে চা খেতে শেখেন নি, সর্দি—টর্দি হ’লে আদা—নুন দিয়ে খেতেন,—তাতেই লিখতে পেরেছেন—বন্দী আমার প্রাণেশ্বর। আজকাল চায়ের কল্যাণে বাংলা দেশে ভাবের বন্যা এসেছে,—ঘরে ঘরে চা, ঘরে ঘরে প্রেম। সেকালের কবিদের বিস্তর বায়নাক্কা ছিল, —উপবন রে, চাঁদ রে, মলয় রে, কোকিল রে। তবে পঞ্চশর ছুটবে। এখন কোনও ঝঞ্ঝাট নেই,—চাই শুধু দুটো হাতল—ভাঙা বাটি, একটু ছেঁড়া অয়েল ক্লথ, একটা কেরোসিন কাঠের টেবিল, দু’ধারে দুই তরুণ—তরুণী, আর মধ্যিখানে ধূমায়মান কেতলি। ভাগ্যিস বয়েসটা ষাট, তাই বেঁচে গিয়েছিলুম।
মেমকে জিজ্ঞাসা করলুম—আচ্ছা মেমসায়েব, এই যে দুই হুজুর গড়াগড়ি যাচ্ছেন এঁরা দুজনেই তো আপনার পাণিপ্রার্থী। আপনি কোন ভাগ্যবানটিকে বরণ করবেন?