—’আর?’
—’আর এই ক্যাদার চাটুজ্যে। কেন বলব না? তোমাদের ভয় করব নাকি?’
—’যাক যাক, আপনি আরম্ভ করুন।’
চাটুজ্যেমশায় আরম্ভ করিলেন—’আর বছরের ঘটনা। আমি এক অপরূপ সুন্দরী নারীর পাল্লায় পড়েছিলুম।’
নগেন বলিল—’এই যে বলছিলেন বাঘিনীর পাল্লায়?’
বিনোদ বলিলেন—’একই কথা।’
চাটুজ্যে বলিলেন—’ওরে মুখখু বাঘিনীর পাল্লায় পড়েছিলুম মুঙ্গেরে, আর এই নারীর ব্যাপার ঘটেছিল পঞ্জাব মেলে টুণ্ডলার এদিকে। যাক, ঘটনাটা শোন।—
গেল বছর মাঘ মাসে চরণ ঘোষ বললে তার ছোট মেয়েটিকে টুণ্ডলায় রেখে আসতে,—জামাই সেখানেই কর্ম করে কিনা। সুবিধেই হ’ল, পরের পয়সায় সেকেণ্ড ক্লাসে ভ্রমণ, আবার ফেরবার পথে একদিন কাশীবাসও হবে। মেয়েটাকে তো নির্বিবাদে পৌঁছিয়ে দিলুম। ফেরবার সময় টুণ্ডলা স্টেশনে দেখি গাড়িতে তিলার্ধ জায়গা নেই, আগ্রার ফেরত এক পাল মার্কিন ভবঘুরে সমস্ত ফার্স্ট সেকেণ্ড ক্লাসের বেঞ্চি দখল ক’রে আছে। ভাগ্যিস জামাই রেলের ডাক্তার, তাই গার্ডকে ব’লে ক’য়ে আমায় একটা ফার্স্ট ক্লাসে ঠেলে তুলে দিলে। গাড়িও তখনই ছাড়ল।
তখন সকাল সাতটা হবে, কিন্তু কুয়াশায় চারিদিক আচ্ছন্ন, গাড়ির মধ্যে সমস্ত ঝাপসা। কিছুক্ষণ ধাঁধা লেগে চুপটি ক’রে দাঁড়িয়ে রইলুম, তারপর ক্রমে ক্রমে কামরার ভেতরটা ফুটে উঠল।
দেখেই চক্ষু স্থির। ওধারের বেঞ্চিতে একটা অসুরের মতন আখাম্বা ঢ্যাঙা সায়েব চিতপাত হ’য়ে চোখ বুঁজে হাঁ করে শুয়ে আছে, আর মাঝে মাঝে বিড়বিড় ক’রে কি বলছে। দু—বেঞ্চির মাঝে মেঝের ওপর আর একটা বেঁটে মোটা সায়েব মুখ গুঁজে ঘুমুচ্ছে, তার মাথার কাছে একটা খালি বোতল গড়াগড়ি যাচ্ছে। এধারের বেঞ্চিতে কেউ নেই, কিন্তু তাতে দামী বিছানা পাতা, তার ওপর একটা অদ্ভুত পোশাক —বোধ হয় ভাল্লুকের চামড়ার,—আর নানা রকম জিনিসপত্র ছড়ানো রয়েছে। গাড়ি চলছে, পালাবার উপায় নেই। বেঞ্চির শেষদিকে একটা চেয়ারের মতন জায়গা ছিল, তাইতে ব’সে দুর্গানাম জপতে লাগলুম। কোনও গতিকে সময় কাটতে লাগল, সায়েব দুটো শুয়েই রইল, আমারও একটু একটু ক’রে মনে সাহস এল।
হঠাৎ বাথরুমের দরজা খুলে বেরিয়ে এল এক অপরূপ মূর্তি। দূর থেকে বিস্তর মেমসায়েব দেখেছি, কিন্তু এমন সামনাসামনি দেখবার সুযোগ কখনও ঘটে নি। মুখখানি চীনে করমচা, ঠোঁট দুটি পাকা লঙ্কা, মারবেলে কোঁদা আজানুলম্বিত দুই বাহু। চোস্ত ঘাড়—ছাঁটা, কেবল কানের কাছে শণের মতন দু—গাছি চুল কুণ্ডলী পাকিয়ে আছে। পরনে একটি দেড়হাতী গামছা—’
বিনোদবাবু বলিলেন—’গামছা নয় চাটুজ্যেমশায়, ওকে বলে স্কার্ট।’
—’কাঠ—ফাট জানি নে বাবা। পষ্ট দেখলুম বাঁদিপোতার গামছা খাটো ক’রে পরা, তার নীচে নেমে এসেছে গোলাপী কলাগাছের মতন দুই পা, মোজা আছে কি নেই বুঝতে পারলুম না। দেহযষ্টি কথাটা এতদিন ছাপার হরফেই পড়েছি, এখন স্বচক্ষে দেখলুম,—হাঁ, যষ্টি বটে, মাথা থেকে বুক—কোমর অবধি একদম চাঁচাছোলা, কোথাও একটু উঁচুনীচু টক্কর নেই। সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতেব নয়, একবারে জ্বলন্ত হাউই—এর কাঠি। দেখে বড়ই ভক্তি হ’ল। কপালে হাত ঠেকিয়ে বললুম—সেলাম মেমসাহেব।
ফিক ক’রে হাসলেন। পাকা লঙ্কার ফাঁক দিয়ে গুটিকতক কাঁচা ভুট্টার দানা দেখা গেল। ঘাড় নেড়ে বললেন—ঘুৎ মর্নিং।
মেম নৃত্যপরা অপ্সরার মতন চঞ্চল ভঙ্গীতে এসে বেঞ্চে বসলেন। আমি কাঁচু—মাচু হ’য়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লুম। মেম বললেন—সিট ডাউন বাবু, ডরো মৎ।
দেবীর এক হাতে বরাভয়, অপর হাতে সিগারেট। বুঝলুম প্রসন্ন হয়েছেন, আর আমায় মারে কে। ইংরিজী ভাল জানি না। হিন্দি ইংরিজী মিশিয়ে নিবেদন করলুম,—নিতান্ত স্থান না পেয়েই এই অনধিকারপ্রবেশ করেছি, অবশ্য গার্ডের হুকুম নিয়ে; মেমসাহেব যেন কসুর মাফ করেন। মেম আবার অভয় দিলেন, আমিও ফের ব’সে পড়লুম।
কিন্তু নিস্তার নেই। মেমসায়েব আমার পাশে ব’সে একটু দাঁত বার ক’রে আমাকে একদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলেন।
এই কেদার চাটুজ্যেকে সাপে তাড়া করেছে, বাঘে পেছু নিয়েছে, ভূতে ভয় দেখিয়েছে, হনুমানে দাঁত খিঁচিয়েছে, পুলিসকোর্টের উকিল জেরা করেছে, কিন্তু এমন দুরবস্থা কখনও ঘটে নি। ষাট বছর বয়েস, রংটি উজ্জ্বল শ্যাম বলা চলে না, পাঁচ দিন ক্ষৌরি হয় নি, মুখ যেন কদম ফুল,—কিন্তু এই সমস্ত বাধা ভেদ ক’রে লজ্জা এসে আমার আকর্ণ বেগনী ক’রে দিলে। থাকতে না পেরে বললুম—মেমসাব, কেয়া দেখতা?
মেম হু—হু ক’রে হেসে বললেন—কুছ নেই, নো অফেন্স। তুম কোন হ্যায় বাবু?
আমার আত্মমর্যাদায় ঘা পড়ল। আমি কি সঙ না চিড়িয়াখানার জন্তু? বুক চিতিয়ে মাথা খাড়া ক’রে বললুম—আই কেদার চাটুজ্যে, নো জু—গার্ডেন।
মেম আবার হু—হু করে হেসে বললেন—বেঙ্গলী?
আমি সগর্বে উত্তর দিলুম—ইয়েস সার, হাই কাস্ট বেঙ্গলী ব্রাহ্মিণ। পইতেটা টেনে বার ক’রে বললুম—সী? আপ কোন হ্যায় ম্যাডাম?’
বিনোদবাবু বলিলেন—’ছি চাটুজ্যোমশায়, মেয়ের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন! ওটা যে এটিকেটে বারণ।’
‘কেন করব না?’ মেম যখন আমার পরিচয় নিলে তখন আমিই বা ছাড়ব কেন? মেম মোটেই রাগ করলেন না, জানালেন তাঁর নাম জোন জিলটার, নিবাস আমেরিকা, এদেশে এর পূর্বেও ক—বার এসেছিলেন, ইণ্ডিয়া বড় আশ্চর্য জায়গা!