সিদ্ধিনাথ নিজের মনে বলে যেতে লাগলেন, হাজার হাজার বৎসরেও মেয়েরা সাজতে শিখল না, কেবল ফ্যাশনের অন্ধ নকল। ঠোঁটে রং দেওয়ার ফ্যাশনটাই ধর। যারা চম্পকগৌরী অল্পবয়সী তাদেরই বিম্বাধার মানায়। সাদা বা কালোকে বা বুড়ীকে মানায় না। আজ বিকেলে চৌরঙ্গী রোডে দুটি অদ্ভুত প্রাণী দেখেছি। একজন বুড়ী মেম, চুল পেকে শণের নুড়ি হয়ে গেছে, গাল তুবড়ে চামড়া কুঁচকে গেছে, তবু ঠোঁটে রগরগে লাল রং লাগিয়েছে। দেখাচ্ছে যেন তাড়কা রক্ষসী, সদ্য ঋষি খেয়েছে। আর একজন বাঙালী যুবতী, বেশ মোটা, অসিতার চাইতেও কালো, সেও ঠোঁটে লাল রং দিয়েছে।
অসিতা। কেমন দেখাচ্ছে?
সিদ্ধিনাথ। যেন ভাল্লুকে রাঙা আলু খাচ্ছে।
অসিতা। সার, আমি কখনও ঠোঁটে রং লাগাই না।
সিদ্ধিনাথ। তোমার বুদ্ধি আছে, আমার ছাত্রী তো। কালো মেয়ের যদি অধরচর্চা করবার শখ হয় তবে ঠোঁটে সোনালী তবক এঁটে দিলেই পারে, দামী পানের খিলির ওপর যা থাকে।
অসিতা। কী ভয়ানক!
সিদ্ধিনাথ। ভয়ানক কেন? মা কালীর যদি সোনার চোখ আর সোনার জিভ মানায় তবে কালো মেয়ের সোনালী ঠোঁট নিশ্চয় মানাবে। তুমি পরীক্ষা করে দেখতে পার।
অসিতা। কি যে বলেন আপনি!
সিদ্ধিনাথ। অর্থাৎ নতুন ফ্যাশন চালাবার সাহস তোমার নেই। কিন্তু সিনেমার অমুকা দেবী বা অমুক মন্ত্রীর কন্যা যদি ঠোঁটে সোনালী তবক আঁটে তবে তোমরাও আঁটবে। আচ্ছা ডাক্তার বাবাজী, তুমি এই কালো মেয়েটাকে বিয়ে করলে কেন?
রমেশ তার লজ্জা দমন করে বললে, কালো তো নয়, উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ।
সিদ্ধিনাথ। ডাক্তার, তুমি চশমা বদলাও। তোমার বউ মোটেই উজ্জ্বল নয়, দস্তুর মতন কালো। কালোকেই লোক আদর করে শ্যামবর্ণ বলে। তবে হাঁ, তেল মেখে চুকচুকে হলে উজ্জ্বল বলা যেতে পারে।
অসিতা। জানেন, একটি খুব ফরসা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ওঁর সম্বন্ধ হয়েছিল, কিন্তু তাকে ছেড়ে আমাকেই পছন্দ করলেন।
সিদ্ধিনাথ। শুনে খুশী হলুম, ডাক্তারের আর্টিস্টিক বুদ্ধি আছে। গৌর বর্ণের ওপর লোকের ঝোঁক একটা মস্ত কুসংস্কার, স্নবারিও বটে। লোকে কি শুধু সাদা কুকুর সাদা গরু সাদা ঘোড়া পোষে? মারবেলের মূর্তির চাইতে কষ্টি পাথর আর ব্রঞ্জের মূর্তির আদর বেশী কেন? প্রাচ্যদেশবাসী খুব ফরসা হলে কুশ্রী দেখায়, গায়ের রং আর কালো চুলের কনট্রাস্ট দৃষ্টিকটু হয়। তার চাইতে কুচকুচে কালো বরং ভাল, যদিও চোখ আর দাঁত বেশী প্রকট হয়। আমাদের অসিতা হচ্ছে কপিলা গাইএর মতন সুন্দরী। গায়ে আরসোলা বসলে টের পাওয়া যায় না, কিন্ত ডেয়ে পিঁপড়ে বসলে বোঝা যায়।
গোপাল। অসিতার ভাগ্য ভাল, অল্পেই রেহাই পেয়েছে, আবার সুন্দরী সার্টিফিকেটও আদায় করেছে।
দূর থেকে একটা কাঁসির খ্যানখেনে আওয়াজ এল। সিদ্ধিনাথ চমকে উঠলেন। নমিতা ঘরে এসে বললেন, শুনতে পাচ্ছেন না? যান যান দৌড়ে যান নইলে গিন্নী আপনার দফা সারবে।
সিদ্ধিনাথের পত্নী রান্না হয়ে গেলেই স্বামীকে ডাকবার জন্য একটা ভাঙ্গা কাঁসি বাজান। সিদ্ধিনাথ তাঁর মুখরা গৃহিণীকে ভয় করেন। বিনা বাক্যব্যয়ে হনহন করে বাড়ির দিকে চললেন।
১৩৫৭ (১৯৫১)
স্বয়ম্বরা
চাটুজ্যেমশায় পাঁজি দেখিয়া বলিলেন—’রাত্রি ন—টা সাতান্ন মিনিট গতে অম্বুবাচী নিবৃত্তি। তার আগে এই বৃষ্টি থামবে না। এখন তো সবে সন্ধ্যে।’
বিনোদ উকিল বলিলেন—’তাই তো, বাসায় ফেরা যায় কি ক’রে।’
গৃহস্বামী বংশলোচনবাবু বলিলেন—’বৃষ্টি থামলে সে চিন্তা ক’রো। আপাতত এখানেই খাওয়া—দাওয়ার ব্যবস্থা হোক। উদো, ব’লে আয় তো বাড়ির ভেতর।’
চাটুজ্যে বলিলেন—’মসুর ডালের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজা।’
বিনোদবাবু তাকিয়াটা টানিয়া লইয়া বলিলেন—’তা তো হ’ল, কিন্তু ততক্ষণ সময় কাটে কিসে। চাটুজ্যেমশায়, একটা গল্প বলুন।’
চাটুজ্যে ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন—’আর—বছর মুঙ্গেরে থাকতে আমি এক বাঘিনীর পাল্লায় পড়েছিলুম।’
বিনোদবাবু বাধা দিয়া বলিলেন—’দোহাই চাটুজ্যেমশায়, বাঘের গল্প আর নয়।’
চাটুজ্যে একটু ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিলেন—’তবে কিসের কথা বলব, ভূতের না সাপের?’
—’এই বর্ষায় বাঘ ভূত সাপ সমস্ত অচল, একটি মোলায়েম দেখে প্রেমের গল্প বলুন।’
—’গল্প আমি বলি না। যা বলি, সমস্ত নিছক সত্য কথা।’
—’বেশ তো একটি নিছক সত্য প্রেমের কথাই বলুন।’
নগেন বলিল—’তবেই হয়েছে, চাটুজ্যেমশায় প্রেমের কথা বলবেন! বয়স কত হ’ল চাটুজ্যেমশায়? আর কটা দাঁত বাকী আছে?’
—’প্রেম কি চিবিয়ে খাবার জিনিস? ওরে গর্দভ, দাঁতে প্রেম হয় না, প্রেম হয় মনে।’
নগেন বলিল—’মন তো শুকিয়ে আমসি হয়ে গেছে। প্রেমের আপনি জানেন কি? সব ভুলে মেরে দিয়েছেন। প্রেমের কথা বলবে তরুণরা। কি বলিস উদো?’
—’তরুণ কি রে বাপু ? সোজা বাংলায় বল চ্যাংড়া। তিন কুড়ি বয়েস হ’ল, কেদার চাটুজ্যে প্রেমের কথা জানে না, জানে যত হ্যাংলা চ্যাংড়ার দল!’
বিনোদবাবু বলিলেন— ‘আঃ হা, কেন ব্রাহ্মণকেও চটাও, শোনই না ব্যাপারটা।’
চাটুজ্যে বলিলেন—’বর্ণের শ্রেষ্ঠ হলেন ব্রাহ্মণ। দর্শন বল, কাব্য বল, প্রেমতত্ত্ব বল, সমস্ত বেরিয়েছে ব্রাহ্মণের মাথা থেকে। আবার ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠ হলেন চাটুজ্যে। যথা—বঙ্কিম চাটুজ্যে, শরৎ চাটুজ্যে—’