সিদ্ধিনাথ। আমার কথা আলাদা, বেঁচে থাকলে জগতের লাভ। আমার মতন স্পষ্টবাদী জ্ঞানী উপদেষ্টা এদেশে আর নেই।
গোপালবাবুর গৃহিণী নমিতা দেবী একটা ট্রেতে চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। বয়স বেশী না হলেও এঁর ধাতটি সেকেলে। অসিতা তার দিদিকে আধুনিকী করবার জন্য অনেক চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছে। নমিতা এই সান্ধ আড্ডাটির জন্য খুশী নন, বিশেষত সিদ্ধিনাথকে তিনি দুচক্ষে দেখতে পারেন না; বলেন, পাগল না হাতি, শুধু ভিটকিলিমি, কুকথার ধুকড়ি। গতকাল সেকরা নমিতার ফরমাশী নথ দিয়ে গিয়েছিল। তা দেখতে পেয়ে সিদ্ধিনাথ কিঞ্চিৎ অপ্রিয় মন্তব্য করেছিলেন। তারই শোধ তোলবার জন্য আজ নমিতা যুদ্ধের সাজে দর্শন দিলেন। নাকে নথ, কানে মাকড়ি, গলায় চিক, হাতে অনন্ত আর বালা, কোমরে গোট। কোথা থেকে একটা বাঁকমলও যোগাড় করে পায়ে পরেছেন।
সিদ্ধিনাথ বললেন, আসুন মিসেস মুখুজ্যে।
নমিতা। মিসেস আবার কি? আমি ফিরিঙ্গী হয়ে গেছি নাকি? বউদিদি বলতে মুখে বাধল কেন?
সিদ্ধিনাথ। আর বলা চলবে না, এতদিন ভুল ধারণার বসে বলেছি। আজ সকালে হিসাব করে দেখলুম গোপাল আমার চাইতে আট দিনের ছোট। যদি অনুমতি দেন তো এখন থেকে বউমা বলতে পারি।
নমিতা। বেশ, তাই না হয় বলবেন।
সিদ্ধিনাথ। বউমা, একটু সামনে দাঁড়াও তো।
নমিতা কোমরে হাত দিয়ে বীরঙ্গনার মতন সগর্বে দাঁড়ালেন। সিদ্ধিনাথ এক মিনিট নিরীক্ষণ করে চোখ বুজলেন। নমিতা বললেন, চোখ ঝলসে গেল নাকি?
সিদ্ধিনাথ। উঁহু, আমি এখন ধ্যানস্থ। বিশ হাজার বৎসর পূর্বের ব্যাপার মানসনেত্রে দেখতে পাচ্ছি। মানুষ তখন বন্য, গুহায় বাস করে; পাথর আর হাড়ের অস্ত্র দিয়ে শিকার করে। জনসংখ্যা খুব কম, গৃহিণী সহজে জোটে না, জবরদস্তি করে ধরে আনতে হয়। দেখছি—একটা ষণ্ডা লেংটা পুরুষ, আমাদের গোপালের সঙ্গে একটু আদল আছে, কিন্তু মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল, মাথায় জটা—পড়া চুল, হাতে একটা হাড়ের ডাণ্ডা। সে বউ খুঁজতে বেরিয়েছে। নদীর ধারে একটা মেয়ে গুগলি কুড়চ্ছে, এই বউমার সঙ্গে একটু মিল আছে। পুরুষটা কোনও প্রেমের কথা বললে না, উপহার দিলে না, খোশামোদও করলে না, এসেই ধাঁই করে এক ঘা লাগালে! মেয়েটা মুখ থুবড়ে পড়ল, কপাল ফেটে রক্ত পড়তে লাগল। তারপর তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে লোকটা নিজের আস্তানায় এল এবং নাকে বেতের আংটি পরিয়ে তাতে দড়ি লাগিয়ে একটা খুঁটির সঙ্গে বেঁধে দিলে, যেমন বলদকে বাঁধা হয়। তবু মেয়েটা পালাবার চেষ্টা করছে দেখে তার পায়ের পাতা চিরে রক্তপাত করলে দু কান ফুঁড়ে কড়া পরিয়ে দিলে, গলায় হাতে কোমরে আর পায়ে চামড়ার বেড়ি লাগিয়ে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ফেললে। এইরকম আষ্টেপৃষ্টে বন্ধনের পর ক্রমে ক্রমে মেয়েটা পোষ মানল, স্বামীর ওপর ভালবাসাও হল। অল্প কালের মধ্যে সকল মেয়েরই ধারণা হল যে নির্যাতনের চিহ্নই হচ্ছে অলংকার আর সৌভাগ্যবতীর লক্ষণ। তারপর হাজার হাজার বৎসর কেটে গেল, ঘরে বউ আনা সহজ হল, সোনা রুপোর গহনার চলন হল, কিন্তু প্রসাধনের রীতি আর গহনার ছাঁদে আদিম বর্বরতার ছাপ রয়ে গেল। সেকালে যা কপালের রক্ত ছিল তা হল সিঁদুর, পায়ের রক্ত হল আলতা। পূর্বে যা বউ বাঁধবার আংটা কড়া আর বেড়ি ছিল, পরে তা নথ মাকড়ি হার বালা গোট আর মলে পরিবর্তিত হল। সংস্কৃতে ‘নাথ’—এর একটি অর্থ বলদের নাকের দড়ি। তা থেকেই নথ আর নথি শব্দ হয়েছে। আজকালকার যা শৌখিন গহনা তাতেও বর্বর যুগের ছাপ আছে। বউমা, জন্মান্তরের ইতিহাস শুনে চটে গেলে নাকি? তোমার বাপ মা নিশ্চয় সব জানতেন, তাই সার্থক নাম রেখেছেন নমিতা, অর্থাৎ যাকে নোয়ানো হয়েছে।
নমিতা বললেন, আপনার বাপ মাও সার্থক নাম রেখেছিলেন। সিদ্ধিনাথের বদলে গাঁজানাথ হলে আরও ঠিক হত। এখানে যা সব বললেন বাড়ি গিয়ে গিন্নীর কাছে বলুন না, মজা টের পাবেন। এই বলে নমিতা চলে গেলেন।
গোপালবাবু বললেন, ওহে সিদ্ধিনাথ, বক্তৃতার চোটে আমার গিন্নীকে তো ঘর থেকে তাড়ালে, এইবার শালীটিকে একটা লেকচার দাও, ছাত্রী বলে দয়া করো না।
সিদ্ধিনাথ অসিতার দিকে চেয়ে বললেন, হাতদুটো অমন করে ঘোরাচ্ছ কেন।
অসিতা। ঘোরাচ্ছি আবার কোথা। দেখছেন না, একটা মফলার বুনছি। আপনারই জন্য।
সিদ্ধিনাথ। কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। হাত সুড়সুড় করছে বলেই বুনছ, আমাকে দেবে সে একটা উপলক্ষ্য মাত্র। লেস—পশম বোনা, চরকা কাটা, মালা জপা, বাঁয়া তবলায় চাঁটি লাগানো, গল্প কবিতা লেখা, ছবি আঁকা, ইও ইও ঘোরানো–এসবের কারণ একই। দরকারী জিনিস তৈরি করছি, দেশের মঙ্গল করছি, ভগবানের নাম নিচ্ছি, কলা চর্চা করছি; সাহিত্য রচনা করছি–এসব ছুতো মাত্র, আসল কারণ হাত সুড়সুড় করছে। এই সমস্ত কাজের মধ্যে ইও ইও ঘোরানোই নির্দোষ। কোনও ছল নেই, শুধুই খেলা।
পাশের ঘর থেকে নমিতা বললেন, মফলারটা খবরদার ওঁকে দিস নি অসিতা, বিশ্বনিন্দুক নিমকহারাম লোক।
সিদ্ধিনাথ। আমার চেয়ে যোগ্য পাত্র পাবে কোথা। আমার যদি ঠাণ্ডা না লাগে, হাঁপানি যদি না বাড়ে, তবে সকল লোকেরই লাভ। অসিতাও এই ভেবে কৃতার্থ হবে যে একজন অসাধারণ গুণী লোকের জন্যই সে মফলার বুনেছে।
গোপাল। ওসব বাজে কথা রাখ। নমিতাকে দেখে তো পুরাকালের ইতিহাস আবিষ্কার করে ফেললে। এখন অসিতাকে দেখে কি মনে হয় বল।