অসিতা সিদ্ধিনাথের কাছে পড়েছে, তাঁকে শ্রদ্ধাও করে। সবিনয়ে বললে, সার, মল্লিক মশায়ের ছেলে বেকার হতে যাবে কেন? পৈতৃক ব্যবসাতে ভাল রোজগারও তো করতে পারে। পরের অন্নেই বা ভাগ পাড়বে কেন, তার বাপের তো অভাব নেই।
সিদ্ধিনাথ বললেন, মল্লিকের ছেলে হাইকোর্টের জজ হতে পারে, জওহরলাল বা বিড়লা—ডালমিয়াও হতে পারে, বহু লোককে অন্নদানও করতে পারে। কিন্তু আমি শুধু তাকে উদ্দেশ করে বলি নি, যারা জন্মাচ্ছে তাদের অধিকাংশেরও যে দশা হবে তাই ভেবে বলেছি।
গোপালবাবু বললেন, দেখ সিধু, আমরা তোমার মতন পণ্ডিত নই, কিন্তু এটুকু জানি, দেশে যে খাদ্য জন্মায় তাতে সকলের কুলয় না, আর লোকসংখ্যাও অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রতিকার অবশ্যই করতে হবে তার চেষ্টাও হচ্ছে। কিন্তু হতাশ হবার কোনও কারণ নেই। যিনি জীবের সৃষ্টিকর্তা তিনিই রক্ষাকর্তা এবং আহারদাতা।
সিদ্ধিনাথ। সৃষ্টিকর্তা সব সময় রক্ষা করেন না, আহারও দেন না। পঞ্চাশ—ষাট বৎসর আগে ওসব মোলায়েম কথা বলা চলত, যখন দেশ ভাগ হয়নি, লোকসংখ্যাও অনেক কম ছিল। তখন এক কবি সুজলাং সুফলাং শস্যশ্যামলাং বলে জন্মভূমির বন্দনা করেছিলেন, আর এক কবি গেয়েছিলেন–চিরকল্যাণময়ী তুমি ধন্য, দেশবিদেশে বিতরিছ অন্ন। এখন দেশ বিদেশ থেকে অন্ন আমদানি করতে হচ্ছে।
গোপাল। সরকার ফসল বাড়াবার যে পরিকল্পনা করেছেন তাতে এক বছরের মধ্যেই আমরা নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করতে পারব।
সিদ্ধিনাথ। হ্যাঁ, যদি কর্তাদের উপদেশ অনুসারে চাল আটার বদলে টাপিওকা রাঙা আলু আর মহামূল্য ফল খেয়ে পেট ভরাতে পার। যদি ঘাস হজম করতে শেখ, আসল দুধের বদলে সয়াবীন বা চীনে বাদাম গোলা জলে তুষ্ট হও, যদি উপোসী বেড়ালের মতন মাছের অভাবে আরসোলা টিকটিকি খেতে পার তবে আরও চটপট স্বয়ম্ভর হতে পারবে।
গোপাল। শুনছি দক্ষিণ আমেরিকা থেকে দুগ্ধতরু আসছে যা পয়স্বিনী গাভীর মতন দুগ্ধ ক্ষরণ করে।
সিদ্ধিনাথ। আরও কত কি শুনবে। রাশিয়া থেকে এক্সপার্ট আসবেন যিনি ব্যাং থেকে রুই কাতলা তৈরি করবেন। শোন গোপাল, কর্তারা যতই বলুন, লোক না কমালে খাদ্যাভাব যাবে না।
রমেশ ডাক্তার লাজুক লোক, পত্নীর ভূতপূর্ব শিক্ষককে একটু ভয়ও করে। আস্তে আস্তে বললে, আমার মতে জনসাধারণকে বার্থ কনট্রোল শেখাবার জন্য হাজার হাজার ক্লিনিক খোলা দরকার।
সিদ্ধিনাথ। তাতে ছাই হবে। শিক্ষিত অবস্থাপন্ন লোকেদের মধ্যে কিছু ফল হতে পারে, কিন্তু আর সকলেই বেপরোয়া বংশবৃদ্ধি করতে থাকবে। যত দুর্দশা বাড়বে ততই মা ষষ্ঠীর দয়া হবে, কেল্টে ভুল্টু, বুঁচী পেঁচীতে ঘর ভরে যাবে। বহুকাল পূর্বেই হার্বার্ট স্পেনসার আবিষ্কার করেছিলেন যে যারা ভাল খায় তাদের সন্তান অল্প হয়, যাদের অন্নাভাব তাদেরই বংশবৃদ্ধি বেশী।
গোপাল। তা তুমি কি করতে বল।
সিদ্ধিনাথ। প্রাচীন কালে গ্রীসে স্পার্টা প্রদেশের কি প্রথা ছিল জান? সন্তান ভূমিষ্ঠ হলেই তার বাপ তাকে একটা চাঙারিতে শুইয়ে পাহাড়ের ওপর রেখে আসত। পরদিন পর্যন্ত বেঁচে থাকলে তাকে ঘরে আনা হত। এর ফলে খুব মজবুত শিশুরাই রক্ষা পেত রোগা পটকারা বেঁচে থেকে সুস্থ বলিষ্ঠ প্রজার অন্নে ভাগ বসাত না। এদেশেরও সেইরকম একটা কিছু ব্যবস্থা দরকার।
গোপাল। কিরকম ব্যবস্থা চাও বলে ফেল।
সিদ্ধিনাথ। কোনও লোকের দুটোর বেশী সন্তান থাকবে না–
গোপাল। ব্রহ্মচর্য চালাতে চাও নাকি?
সিদ্ধিনাথ। পুলিস বাড়ি বাড়ি খানাতল্লাশ করে বাড়তি ছেলেমেয়ে কেড়ে নেবে, যেমন, মাঝে মাঝে রাস্তা থেকে বেওয়ারিস কুকুর ধরে নিয়ে যায়। তারপর লিথাল ভ্যানে–
গোপাল। মহাভারত! তোমার যদি ছেলেপিলে থাকত তবে এমন বীভৎস কথা মুখে আনতে পারতে না।
সিদ্ধিনাথ। রাষ্ট্রের মঙ্গলের কাছে সন্তানস্নেহ অতি তুচ্ছ। আমি যা বললুম তাই হচ্ছে একমাত্র কার্যকর উপায়। এর ফলে শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই সন্তান নিয়ন্ত্রণের জন্য উঠে পড়ে লাগবে। এ ছাড়া অনুষঙ্গিক আরও কিছু করতে হবে। ডাক্তারদের দমন করা দরকার।
অসিতা। বেওয়ারিস কুকুরের মতন ঠেঙিয়ে মারবেন নাকি?
সিদ্ধিনাথ। তোমার ভয় নেই। ভবিষ্যতে মেডিক্যাল কলেজে খুব কম ভরতি করলেই চলবে।
অসিতা। ডাক্তারদের দ্বারা জগতের কত উপকার হয় জানেন? বসন্তের টিকে, কলেরার স্যালাইন, তারপর ইনসুলিন পেনিসিলিন–আরও কত কি। প্রতি বৎসরে কত লোকের প্রাণরক্ষা হচ্ছে খবর রাখেন?
সিদ্ধিনাথ। ও, তুমি তোমার বরের কাছে এইসব শিখেছ বুঝি? প্রাণরক্ষা করে কৃতার্থ করেছেন! কতকগুলো ক্ষীণজীবী লোক, রোগের সঙ্গে লড়বার যাদের স্বাভাবিক শক্তি নেই, তাদের প্রাণরক্ষায় সমাজের লাভ কি? বিস্তর টাকা খরচ করে ডিসপেপসিয়া ডায়াবিটিস ব্লাডপ্রেশার থ্রম্বোসিস আর প্রস্টেট রোগগ্রস্ত অকর্মণ্য লোকদের বাঁচিয়ে রাখলে দেশের কোন উপকার হয়? যারা স্বাস্থ্যবান পরিশ্রমী কাজের লোক, যারা বীর বিদ্বান প্রজ্ঞাবান কবি কলাবিৎ, কেবল তাদেরই বাঁচবার অধিকার আছে। তাদের সেবা করতে সমর্থ স্ত্রীলোকেরও বাঁচা দরকার। তা ছাড়া আর সকলেই আগাছার মতন উৎপাটিতব্য।
গোপাল। ওহে রমেশ, এবারে সিধুবাবুর হাঁপানির টান হলে ওষুধ দিও না, বিছানা থেকে উৎপাটিত করে একটা রিকশায় তুলে কেওড়াতলায় ফেলে দিও।