–আপনি কি করতে বলেন?
-আমি যা চাই তা শুনলে নেহেরজীর মতন রাশনাল লোকও কানে আঙুল দেবেন। আমি বলি—লীভ ইট টু নেচার। কিছু, কালের জন্যে সব হাসপাতাল বন্ধ রাখতে হবে, ডাক্তারদের ইনটান করতে হবে, পেনিসিলিন স্ট্রেপটোমাইসিন প্রভৃতি আধুনিক ওষুধ নিষিদ্ধ করতে হবে, ডিডিটি আর সারের কারখানা বন্ধ রাখতে হবে। কলেরা বসন্ত প্লেগ যক্ষমা দুর্ভিক্ষ বার্ধক্য ইত্যাদি হল প্রকৃতির সেফটি ভালভ, এদের অবাধে কাজ করতে দিন, তাতে অনেকটা ভূভার হরণ হবে। শায়েস্তা খাঁর আমলে দু, আনায় এক মন চাল পাওয়া যেত। তার কারণ এ নয় যে তিনি ধানের চাষ বাড়িয়েছিলেন কিংবা কালোবাজারীদের শায়েস্তা করেছিলেন। তিনি প্রকৃতির সঙ্গে লড়েন নি, ফ্রী হ্যাণ্ড দিয়েছিলেন। আর আমাদের এখনকার দয়াময় দেশনেতাদের দেখন, বলেন কিনা প্রাণদণ্ড তুলে দাও! আমার মতে শ, খুনী আসামী নয়, চোর ডাকাত জালিয়াত ঘুষখোর ভেজাল ওয়ালা কালোবাজারী দাঙ্গাবাজ ধর্ষক রাষ্ট্রদ্রোহী—সবাইকে সরাসরি ফাঁসি দেওয়া উচিত। তাতে যতটুকু লোকক্ষয় হয় ততটুকুই লাভ। আতুরাশ্রম সেবাশ্রম হাসপাতাল আর হেল্ফ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করলে দেশের সর্বনাশ হবে। প্রকৃতিকে বাধা দেবেন না মশাই, কাজ করতে দিন। তার পর দেশের বাড়তি জঞ্জাল যখন দূর হবে, লোকসংখ্যা যখন চল্লিশ কোটি থেকে নেমে দশ কোটিতে দাঁড়াবে, তখন জনহিত কমে কোমর বেঁধে লাগবেন।
হেমন্ত বলল, তা হলে নীতীশের টাকাটার কোনও সদগতি হবে না?
–কেন হবে না, অবশ্যই হবে। ওই টাকায় প্রোপাগান্ডা করে লোকমত তৈরি করতে হবে, সরেন বাঁড়ুজ্যে যেমন বলতেন, এজিটেশন এজিটেশন অ্যান্ড এজিটেশন। আমার একটা থিসিস লেখা আছে, তার লক্ষ কপি ছাপিয়ে লোকসভা রাজ্যসভা আর বিধানসভার সদস্যদের মধ্যে বিলি করতে হবে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ যাকে ক্ষদ্র হদয়দৌর্বল্য বলেছেন তা ঝেড়ে না ফেললে নিস্তার নেই। দেশের ওআথলেস ব্লগ অথব অক্ষম লোকদের উচ্ছেদ করে শুধু বলবান বুদ্ধিমান কাজের লোকদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শুনুন নীতীশবাবু হেমন্তবাবু আগে আমাদের দেশনেতাদের নির্মম বজ্ৰাদপি কঠোর হওয়া দরকার, তার পর জমি তৈরী হলে মনের সাধে লোকহিত করবেন।
হাততালি দিয়ে হেমন্ত বলল, চমৎকার। গীতার শ্রীভগবানবাচ’ আর Nietzsche Thus spake Zarathustraর চাইতে টের ভাল বলেছেন। বহ, ধন্যবাদ ডক্টর খাণ্ডারী, আপনার বাণী আমরা গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখব! এই কড়ি টাকা দয়া করে নিন, যৎকিঞ্চিৎ প্রণামী। আচ্ছা আজ উঠি, নমস্কার।
ফেরার পথে নীতীশ বলল, লোকটা উন্মাদ না পিশাচ? হেমন্ত বলল, তেত্রিশ নয়ে পইসে উন্মাদ, তেত্রিশ পিশাচ আর চৌত্রিশ জবরদস্ত জনহিতৈষী। মনুস্মৃতি, মার্কসবাদ গান্ধীবাদ, সবই এখন সেকেলে হয়ে গেছে, তাই ডক্টর প্রেমসি, খাণ্ডারী নতুন বাণী প্রচার করে যুগাবতার হবার মতলবে আছেন। তবে এর প্রলাপবাক্যের মধ্যে সত্যের ছিটেফোঁটাও কিঞ্চিৎ আছে। শোন নীতীশ, তোমার দানসত্রের ভার পরের হাতে দিও না, তাতে নিশ্চিন্ত হতে পারবে না, কেবলই মনে হবে ব্যাটা চুরি করছে। নিজের খুশিতে দান কর, সেবাশ্রমে আতুরাশ্রমে হাসপাতালে স্কুল-কলেজে, যেখানে তোমার মন চায়। যদি ভুলক্রমে অপাত্রে কিছু দিয়ে ফেল তাতেও বিশেষ ক্ষতি হবে না। কিন্তু ফতুর হয়ে দান করে না। নিজের সংসারযাত্রার জন্যেও কিছু রেখো। তোমার স্ত্রী আর ছেলে মেয়ে যদি কষ্টে পড়ে, তোমাকে যদি রোজগারের জন্যে ব্যস্ত থাকতে হয়, তবে লোকসেবায় মন দিতে পারবে না।
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে নীতীশ বলল, বেশ, তাই হবে। কিন্তু টাকাটা তো আসলে তোমার, অতএব লোকসেবার ভার তুমিই নেবে, আমি তোমার সহকারী হব।
-আঃ, তোমার খতখাতুনি এখনও গেল না দেখছি। বেশ, টাকাটা হয় আমারই। কিন্তু আমার ফুরসত কম, দানসত্রের ভার তোমাকেই নিতে হবে, তবে আমি যথাসাধ্য সাহায্য করতে রাজী আছি। জান তো, ভক্ত বৈষ্ণব তাঁর সব কমের ফল শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করেন। তুমিও নিষ্কামভাবে লোকহিতে লেগে যাও, কর্মের ফল শ্রীকৃষ্ণের বদলে আমাকেই অপণ করো। পিতৃপুরুষদের দেনা শোধ করে তুমি তৃপ্তিলাভ করবে, স্বহস্তে দান করে ধন্য হবে। আর, তোমার দানের পণ্যফল আমি ভোগ করব। ফণীবাবুর ব্যবস্থার চাইতে এই রকম ভাগাভাগি ভাল নয় কি?
সিদ্ধিনাথের প্রলাপ
সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় পাশের বাড়িতে পোঁ করে শাঁখ বেজে উঠল। সিদ্ধিনাথবাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন, আর একটি বেকারের আগমন হল।
গৃহস্বামী গোপাল মুখুজ্যে বললেন, সিধু, তুমি দিন দিন দুর্মুখ হচ্ছ। কত হোম যাগ আর মানত করে বুড়ো বয়সে মল্লিক মশায় একটি বংশধর লাভ করলেন। প্রতিবেশীর সৌভাগ্যে আমাদের সকলেরই খুশী হবার কথা, আর তুমি ধরে নিচ্ছ যে ছেলেটি বেকার হবে!
আবার একটি নিঃশ্বাস ফেলে সিদ্ধিনাথ বললেন, দেশবাসীর আধপেটা অন্নের আর একজন ভাগীদার জুটল।
ঘরে চার জন আছেন। গোপালবাবু উকিল, বয়স চল্লিশ, বেশ পশার করেছেন। সিদ্ধিনাথ তাঁর সমবয়সী বাল্যবন্ধু, গোপালবাবুর বাড়ির পিছনেই তাঁর বাড়ি। পূর্বে সরকারী কলেজে প্রোফেসারি করতেন, বিদ্যার খ্যাতিও ছিল, কিন্তু মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় চাকরি গেছে। এখন আগের চাইতে অনেক ভাল আছেন, কিন্তু মাথার গোলমাল সম্পূর্ণ দূর হয়নি। সামান্য পেনশনে এবং বাড়িতে দু—চারটি ছাত্র পড়িয়ে কোনও রকমে সংসার চালান। তৃতীয় লোকটি রমেশ ডাক্তার, বয়স ত্রিশ, কাছেই বাড়ি, সম্প্রতি গোপালবাবুর শালী অসিতার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। রমেশ তার স্ত্রীর সঙ্গে রোজ এই সান্ধ্য আড্ডায় আসে। আজও দুজনে এসেছে।