সরলাক্ষ বললে, যে আজ্ঞে, আমি তার সঙ্গে দেখা করে সাধ্য মত চেষ্টা করব।
পরদিন শ্রীগদাধর সরলাক্ষকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি হল হে, রাজী করাতে পারলে?
—উঁহু, বরুণের উপর ভীষণ চটে গেছেন, শুধু ছুঁচো নয়, মীন মাইণ্ডেড মংকিও বলেছেন। আমার মতে চটপট তাঁর অন্যত্র বিবাহ হওয়া দরকার, নয়তো মনের শান্তি ফিরে পাবেন না। দারুণ একটা শক পেয়েছেন কিনা। তাঁর হৃদয়ে যে ভ্যাকুয়ম হয়েছে সেটা ভরতি করাতে হবে।
—কিন্তু এত তাড়াতাড়ি অন্য লোককে বিয়ে করতে রাজী হবে কেন? ভাল পাত্রই বা পাই কোথা?
—যদি অভয় দেন তো নিবেদন করি। অনুমতি পেলে নিজের জন্যে একটু চেষ্টা করে দেখতে পারি।
—তুমি! তোমাকে বিয়ে করতে চাইবে কেন? ধর মাণ্ডবী রাজী হল, কিন্তু আমার হোমরা চোমরা আত্মীয় স্বজনের কাছে জামাইয়ের পরিচয় কি দেব? মুশকিল আসান অধিকর্তা বললে তো চলবে না, লোকে হাসবে।
—আপনার কৃপা হলেই আমি একটা বড় পোস্ট পেয়ে যেতে পারি, আপনার জামাইএর উপযুক্ত।
কোন কাজ পারবে তুমি?
সরকার তো হরেক রকম পরিকল্পনা করছেন, মাটির তলায় রেল, শহরের চারদিক ঘিরে চক্রবেড়ে রেল, সমুদ্র থেকে মাছ, ড্রেনের ময়লা থেকে গ্যাস, আরও কত কি। আমিও ভাল স্কীম বাতলাতে পারি।
—বল না একটা।
—এই ধরুন, উপকণ্ঠ—গির্যাশ্রম।
—সে আবার কি, গির্জে বানাতে চাও নাকি?
—আজ্ঞে না। গিরি—আশ্রম হল গির্যাশ্রম, উপকণ্ঠ—গির্যাশ্রম মানে সাবর্বান হিল স্টেশন। সহজেই হতে পারবে। কলকাতার কাছে লম্বা চওড়ায় এক শ মাইল একটা জমি চাই, তাতে প্রকাণ্ড একটা লেক কাটা হবে, তার মাটি স্তূপাকার করে লেকের মধ্যিখানে দশ—বারো হাজার ফুট উঁচু একটা পিরামিড বা কৃত্রিম পাহাড় তৈরি হবে। দার্জিলিং যাবার দরকার হবে না, পাহাড়ের গায়ে আর মাথায় একটি চমৎকার শহর গড়ে উঠবে, বিস্তর সেলামী দিয়ে লোকে জমি লীজ নেবে। আঙুর আপেল পীচ আখরোট বাদাম কমলালেবু ফলবে, নীচের লেকে অজস্র মাছ জন্মাবে। পাহাড়ের মাথা থেকে বিনা পয়সায় বরফ পাবেন, ঢালু গা দিয়ে আপনিই হড়াক করে নেমে আসবে—
—চমৎকার, চমৎকার, আর বলতে হবে না। কালই আমি মিনিস্টার ইন চার্জ অভ ল্যাণ্ড আপলিফটের সঙ্গে কথা বলব। কিন্তু তোমার পোস্টের নামটা কি হবে?
—পরিকল্পন—মহোপদেষ্টা, অর্থাৎ অ্যাডভাইজার—জেনারেল অভ স্কীমস। সাড়ে তিন হাজার টাকা মাইনে দিলেই চলবে।
—নিশ্চিত থাক বাবাজী, চার—পাঁচ দিনের মধ্যেই আমি সব পাকা করে ফেলব। তুমি দেরি করো না, লেগে যাও, এখন থেকেই মাণ্ডবীকে বাগাবার চেষ্টা কর।
মাণ্ডবী অতি লক্ষ্মী মেয়ে, আর সরলাক্ষর প্রেমের প্যাঁচ অর্থাৎ টেকনিকও খুব উঁচুদরের। পাঁচ দিনের মধ্যেই সে মাণ্ডবীকে বাগিয়ে ফেললেন।
কিন্তু বরুণ বিশ্বাসের কি হল? তার কথা আর জিজ্ঞাসা করবেন না। তাকে বিয়ে করবার জন্যে একটা মাদ্রাজী, দুটো পাঞ্জাবী আর তিনটে ফিরিঙ্গী মেয়ে ছেঁকে ধরেছে, তা ছাড়া ওখানকার জজ—গিন্নী, ডেপুটি—গিন্নী আর উকিল—গিন্নীও নিজের নিজের আইবড় মেয়েদের বরুণের পিছনে লেলিয়ে দিয়েছেন। বেচারা কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।
১৩৬০ (১৯৫৩)
সাড়ে সাত লাখ
হেমন্ত পাল চৌধুরীর বয়স ত্রিশের বেশী নয়, কিন্তু সে একজন পোকা ব্যবসাদার, পৈতৃক কাঠের কারবার ভাল করেই চালাচ্ছে। রাত প্রায় নটা, বাড়ির একতলার অফিস ঘরে বসে হেমন্ত হিসাবের খাতাপত্র দেখছে। তার জ্ঞাতি-ভাই নীতীশ হঠাৎ ঘরে এসে বলল, তোমার সঙ্গে অত্যন্ত জরুরী কথা আছে। বড় ব্যস্ত নাকি?
হেমন্ত বলল, না, আমার কাজ কাল সকালে করলেও চলবে। ব্যাপার কি, এমন হন্তদন্ত হয়ে এসেছ কেন? তোমাদের তো এই সময় জোর তাসের আড্ডা বসে। কোনও মন্দ খবর নাকি?
নীতীশ বলল, ভাল কি মন্দ জানি না, আমার মাথা গলিয়ে গেছে। যা বলছি স্থির হয়ে শোন।
নীতীশের কথার আগে তার সঙ্গে হেমন্তর সম্পর্কটা জানা দরকার। এদের দুজনেরই প্রপিতামহ ছিলেন মদনমোহন পাল চৌধুরী, প্রবলপ্রতাপ জমিদার। তাঁর দুই পুত্র অনঙ্গ আর কন্দর্প বৈমাত্র ভাই, বাপের মত্যুর পর বিষয় ভাগ করে পৃথক হন। অনঙ্গ অত্যন্ত বিলাসী ছিলেন, অনেক সম্পত্তি বন্ধক রেখে কন্দপের কাছ থেকে বিস্তর টাকা ধার নিয়েছিলেন। অল্পবয়স্ক পুত্র বসন্তকে রেখে অনঙ্গ
অকালে মারা যান। কন্দর্প তাঁর ভাইপোর সঙ্গে আজীবন মকদ্দমা চালান। অবশেষে তিনি জয়ী হন এবং বসন্ত প্রায় সর্বস্বান্ত হন। পরে বসন্ত কাঠের কারবার আরম্ভ করেন। তিনি গত হলে তাঁর পত্র হেমন্ত সেই কারবারের খুব উন্নতি করেছে।
কন্দর্প আর তাঁর পুত্র যতীশও গত হয়েছেন। যতীশের পত্র নীতীশ এখন পৈতৃক সম্পত্তির অধিকারী। জমিদারি আর নেই, আগেকার ঐশ্বর্যও কমে গেছে, কিন্তু পৈতৃক সঞ্চয় যা আছে তা থেকে নীতীশের আয় ভালই হয়। রোজগারের জন্যে তাকে খাটতে হয় না, বদখেয়ালও তার নেই, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আর সাহিত্য সিনেমা ফটবল ক্রিকেট রাজনীতি চর্চা করে সময় কাটায়। হেমন্ত তার সমবয়স্ক, দুজনে একসঙ্গে কলেজে পড়েছিল। এদের বাপদের মধ্যে বাক্যালাপ ছিল না, কিন্তু হেমন্ত আর নীতীশের মধ্যে পৈতৃক মনোমালিন্য মোটেই নেই, অন্তরঙ্গতাও বেশী নেই।
মাথায় দু হাত দিয়ে নীতীশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার পর বলল, ভাই হেমন্ত, মহাপাপ থেকে আমাকে উদ্ধার কর।