—সেটি হবার জো নেই। খঞ্জনা হচ্ছে চতুর্ভুজ খাবলদারের তৃতীয় পক্ষের শালী। চতুর্ভুজকে চটানো আমার পলিসি নয়, আমার ছেলে দিল্লিতে তারই কম্পানিতে কাজ করে।
—বরুণকে দূরে বদলী করিয়ে দিন।
—সে কথা আমি যে ভাবিনি এমন নয়। কিন্তু বিচ্ছেদের ফলে প্রেম যে আরও চাগিয়ে উঠবে, চিঠিতে লম্বা লম্বা প্রেমালাপ চলবে, তার কি করবেন?
—তারও উপায় আছে। অন্য কারও সঙ্গে চটপট খঞ্জনার বিয়ে দিতে হবে।
—খেপেছেন? খঞ্জনা আমাদের ফরমাশ মত বিয়ে করবে কেন?
—জুতসই পাত্র পেলেই করবে। শুনুন সার—বরুণকে দূরে বদলী করান, তার জায়গায় এমন একজন বহাল করুন যে খঞ্জনাকে বিয়ে করতে রাজী আছে।
—কোথায় পাব এমন লোক?
বটুককে ঠেলা দিয়ে সরলাক্ষ বললে, কি বল বটুক—দা?
বটুক প্রশ্ন করলে, মাইনে কত?
শ্রীগদাধর বললেন, তা ভালই, আড়াই হাজার।
সরলাক্ষ বললে, রাজী আছ বটুক—দা? এমন চাকরি পেলে খঞ্জনাকে আত্মসাৎ করতে পারবে না?
—খুব পারব, খঞ্জনা গঞ্জনা ঝঞ্জনা কিছুতেই আমার আপত্তি নেই।
শ্রীগদাধর বললেন, বরুণকে ছেড়ে খঞ্জনাকে বিয়ে করতে চাইবে কেন? চাকরি বদল যত সহজে হয় প্রেমের বদল তত সহজে হয় না।
বটুক বললেন, সেজন্য আপনি ভাববেন না স্যর, আমি খঞ্জনাকে ঠিক পটিয়ে নেব।
—কিন্তু জন্তুর সায়েন্স না জানলে তো বানর—নির্বাসন—অধিকর্তা হতে পারবে না। তুমি তো নাড়ী—টেপা ডাক্তার?
সরলাক্ষ বললেন, শুনুন স্যার। এমন বিদ্যে নেই যা ডাক্তাররা শেখে না, ফিজিক্স কেমিস্ট্রি বটানি জোঅলজি আরও কত কি। নয় বটুক—দা?
বটুক বললে, নিশ্চয়। জোঅলজি, বিশেষ করে মংকিলজি, আমার খুব ভাল রকম জানা আছে।
গদাধর একটু ভেবে বললেন, বেশ, কালই আমি মিনিস্টার ইন চার্জকে বলব। কিন্তু প্রথমটা টেম্পোরারি হবে, যদি দুমাসের মধ্যে খঞ্জনাকে বিয়ে করতে পার তবেই চাকরি পাকা হবে, নয়তো ডিসমিস।
বটুক বলে, দু মাস লাগবে না, এক মাসের মধ্যেই আমি তাকে বাগিয়ে নেব।
গদাধর বললে, বেশ। বড় আনন্দ হল তোমাদের সঙ্গে আলাপ করে। কাল আমাকে একবার দিল্লি যেতে হবে, গিন্নীকে ছেলের কাছে রেখে আসব, পাঁচ দিন পরে ফিরব। তার পরের রবিবারে বিকেল চারটার সময় তোমরা আমার বাড়িতে চা খাবে, কেমন? আমার মেয়ে মাণ্ডবীর সঙ্গেও আলাপ করিয়ে দেব।
সরলাক্ষ আর বটুক সবিনয়ে বললেন, যে আজ্ঞে!
শ্রীগদাধরের সুপারিশের ফলে তিন দিনের মধ্যে বরুণের জায়গায় বটুক সেন বাহাল হল এবং বরুণ দহরমগঞ্জে বদলী হয়ে গেল। তার নতুন পদের নাম— কুক্কুটাণ্ড—বিবর্ধন—পরীক্ষা—সংস্থা—আযুক্তক, অর্থাৎ অফিসার ইন চার্জ হেনস এগ এনলার্জমেণ্ট এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন।
নির্দিষ্ট দিনে সরলাক্ষ আর বটুক গদাধরবাবুর বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গেল। গদাধর বললেন, এই যে, এস এস। ওরে মাণ্ডবী, এদিকে আয়। এই ইনি হচ্ছেন শ্রীসরলাক্ষ হোম, মুশকিল আসান এক্সপার্ট। আর ইনি ডাক্তার বটুক সেন, আমাদের নতুন বানর—নির্বাসন—অধিকর্তা। খাসা লোক এঁরা।
নমস্কার বিনিময়ের পর বটুক বললে, সার, একটি অপরাধ হয়ে গেছে, আপনাকে আগে খবর দেওয়া উচিত ছিল, বড্ড তাড়াতাড়ি হল কিনা তাই পারি নি, মাপ করবেন। শ্রীমতী খঞ্জনার সঙ্গে কাল আমার শুভ পরিণয় হয়ে গেছে।
বটুকের পিঠ চাপড়ে, শ্রীগদাধর বললেন, জিতা রহো, বাহবা, বাহবা, বলিহারি, শাবাশ! আমরা ভারী খুশী হলুম শুনে, কি বলিস মাণ্ডবী? খেতে শুরু কর তোমরা, আমি চট করে গিন্নীকে একটি টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিয়ে আসছি।
মাণ্ডবী বটুককে বললেন, ধন্য রুচি আপনার, বাবার কাছে ঘুষ খেয়ে সেই শূর্পনখাটাকে বিয়ে করে ফেললেন! খঞ্জনাই বা কি রকম মেয়ে, দু দিনের মধ্যে বরুণ—দাকে ভুলে গিয়ে আপনার গলায় মালা দিলে?
সরলাক্ষ বললেন, তিনি অতি সুবুদ্ধি মহিলা, বরুণ—দার চাকরিটি মারেন নি, বটুক—দার চাকরি পাকা করে দিয়েছে, আমারও মুখরক্ষা করেছেন।
মাণ্ডবী বললেন, আপনারা আবার কি করলেন?
—আপনাকে কথা দিয়েছিলুম দুজনের মধ্যে ভীষণ ঝগড়া বাধিয়ে দেব, মনে নেই? আপনি শুনে খুশী হবেন খঞ্জনা বউ—দি মিস্টার বরুণকে ভীষণ গালাগালি দিয়ে একটি চিঠি লিখেছেন, আমিই সেটা ড্রাফট করে দিয়েছি। এখন আপনার লাইন ক্লিয়ার। যদি বরুণ—দাকে আপনি একটি মোলায়েম চিঠি লেখেন তবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমার ফী—এর বাকী টাকাটা আপনাকে আর দিতে হবে না, আপনার বাবাই তো শোধ করবেন।
—উঃ, আপনাদের কি কোনও প্রিনসিপল নেই, সেন্টিমেণ্ট নেই, হৃদয় নেই, শোভন অশোভন জ্ঞান নেই? কি ভীষণ মানুষ আপনারা! মাপ করবেন, আপনাদের কাণ্ড দেখে হতভম্ব হয়ে যা তা বলে ফেলেছি।
গদাধরবাবু তার পাঠিয়ে ফিরে এলেন। অনেকক্ষণ নানা রকম আলাপ চলল, তার পর সরলাক্ষ আর বটুক চলে গেল।
পরদিন বরুণের কাছ থেকে মাণ্ডবী একটা আট পাতা চিঠি পেলে।
এখানেই থামা যেতে পারে, কারণ এর পরে যা হল তা আপনারা নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছেন। কিন্তু এমন পাঠক অনেক আছেন যাঁরা নায়ক নায়িকার একটা হেস্তনেস্ত না দেখলে নিশ্চিত হতে পারেন না। তাঁদের অবগতির জন্য বাকীটা বলতে হল।
সন্ধ্যার সময় শ্রী গদাধর সরলাক্ষর কাছে এলেন। সে একাই আছে, বটুক সস্ত্রীক সিনেমায় গেছে। গদাধর বললেন, ওহে সরলাক্ষ, এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল! মাণ্ডবীকে বরুণ মস্ত একটা চিঠি লিখেছে, বেশ ভাল চিঠি, খুব অনুতাপ জানিয়ে অনেক কাকুতি মিনতি করে ক্ষমা চেয়েছে। আমিও অনেক বোঝালুম, কিন্তু মাণ্ডবী গোঁ ধরে বসে আছে—বাঙালে গোঁ, তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে। চিঠিখানা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বললে, ছুঁচোকে আমি বিয়ে করতে পারব না। বাবা সরলাক্ষ, তুমি কালই তার সঙ্গে দেখা করে বুঝিয়ে ব’লো। বরুণের মতন পাত্র লাখে একটা মেলে না। তোমার অসাধ্য কাজ নেই, মাণ্ডবীকে রাজী করাতে যদি পার তো তোমাকে খুশী করে দেব।