সরলাক্ষ বললে, একটা খুব সোজা উপায় বাতলাতে পারি। আপনি হিন্দু তো? এখনও বহু—বিবাহ—নিষেধের আইন পাস হয় নি। শ্রীগদাধরের কন্যাকে বিবাহ করে ফেলুন, যত পারেন সম্পত্তি আদায় করেন নিন। ছ মাস পরে মিস খঞ্জনাকেও বিবাহ করবেন, তাঁকেই সুয়োরানীর পোস্ট দেবেন?
বরুণ বললে, আপনি গদাধর ঘোষকে জানেন না, ধড়িবাজ দুর্দান্ত লোক। সম্পত্তি যা দেবার তিনি মেয়েকেই দেবেন। খঞ্জনাকে বিয়ে করলে তৎক্ষণাৎ আমার চাকরিটি খাবেন আর মেয়েকে নিজের কাছে নিয়ে যাবেন।
বটুক সেন বললে, আমি একটি ডাক্তারী উপায় বলছি শুনুন। মিস মাণ্ডবীকে বিয়ে করে ফেলুন। আপনাকে দু পুরিয়া আর্সেনিক দেব, একটা শ্বশুরকে আর একটা শ্বশুর—কন্যাকে চায়ের সঙ্গে খাওয়াবেন। দুজনেই পঞ্চত্ব পেলে সম্পত্তি আপনার হাতে আসবে, চাকরিও থাকবে, তখন মিস খঞ্জনাকে দ্বিতীয় পক্ষে বিয়ে করবেন।
—বিষ দিতে বলছেন?
আর্সেনিকে আপত্তি থাকলে কলেরা জার্ম দিতে পারি, কাজ সমানই হবে।
বরুণ রেগে গিয়ে বললে, আপনাদের সঙ্গে ইয়ারকি দিতে এখানে আসি নি, আমার সময়ের মূল্য আছে।
সরলাক্ষ বললে, না না রাগ করবেন না, আপনার প্রবলেমটি বড় শক্ত কিনা তাই বটুক—দা একটু ঠাট্টা করেছেন। আমি বলি শুনুন—আপনার আকাঙ্ক্ষাটি বড্ড বেশী নয় কি? কিছু কমিয়ে ফেলুন, দুধও খাবেন তামাকও খাবেন তা তো হয় না।
—আচ্ছা, সম্পত্তির আশা না হয় ছেড়ে দিচ্ছি। আপনি এমন উপায় বলতে পারেন যাতে মাণ্ডবীর সঙ্গে আমার বিয়ে ভেস্তে যায় অথচ চাকরির ক্ষতি না হয়, অর্থাৎ গদাধর ঘোষ রাগ না করেন?
—আমাকে একটু সময় দিন, ভেবে চিন্তে উপায় বার করতে হবে। আপনি সাত দিন পরে আসবেন। ফী জানতে চান? আজ ষোল টাকা দিন, তার পর কাজ উদ্ধার হলে তার গুরুত্ব বুঝে আরও টাকা দেবেন।
বরুণ টাকা দিয়ে চলে গেল।
মাণ্ডবী পর্দা ঠেলে ঘরে এল। তার গা কাঁপছে, মুখ লাল, চোখ ফুলো ফুলো, দেখেই বোঝা যায় যে জোর করে কান্না চেপে রেখেছে।
বটুক সেন বললে, একি মিস ঘোষ, আপনি বড্ড আপসেট হয়ে পড়েছেন দেখছি। স্থির হয়ে বসুন, দু মিনিটের মধ্যে একটা ওষুধ নিয়ে আসছি।
মাণ্ডবী বললে, ওষুধ চাই না, একটু জল।
সরলাক্ষ তাড়াতাড়ি এক গ্লাস জল এনে দিলে। মাণ্ডবী চোখে মুখে জল দিয়ে ভাঙা গলায় বললে, সরলাক্ষবাবু, আর কিচ্ছু করবার দরকার নেই, বরুণদাকে আমি বিয়ে করব না।
সরলাক্ষ বললে, না না, ঝোঁকের মাথায় কোনও প্রতিজ্ঞা করবেন না। অপনার বাবা খুব খাঁটী কথা বলেছেন, বিয়ে হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি—খঞ্জনার খপ্পর থেকে আপনার বরুণদাকে উদ্ধার করবই। যদি তিনি অনুতপ্ত হয়ে আপনার কাছে ক্ষমা চান তবে তাঁকে বিয়ে করবেন না কেন?
সজোরে মাথা নেড়ে মাণ্ডবী বললে, না না না। আমি মুটকী ধুমসী, আমি সেকালে মুখখু জুজ বুড়ী, আর খঞ্জনা হচ্ছে বিদ্যাধরী—
—ও, আপনি বুঝি আড়ি পাতছিলেন। ভেরি ব্যাড। ওসব কথায় কান দেবেন না, বাঁদরের কর্তা হয়ে আপনার বরুণদা বাঁদুরে বুদ্ধি পেয়েছেন, খঞ্জনার মোহে পড়ে যা তা বলছেন। মোহ কেটে গেলেই আপনার কদর তিনি বুঝবেন। আপনি হচ্ছেন সেই কালিদাস যা বলেছেন—পর্যাপ্ত— পুষ্পস্তবকাবনম্রা সঞ্চারিণী পল্লবিনী লতা, আপনি হচ্ছেন—শ্রোণীভারাদলসগমনা, স্তোকনম্রা—
—চুপ করুন, অসভ্যতা করবেন না। এই নিন আপনার ষোল টাকা, আমি চললুম।
সরলাক্ষ হাতজোড় করে বললেন, মাণ্ডবী দেবী, মন শান্ত করুন, ধৈর্য্য ধরুন। যত শীঘ্র পারি খঞ্জনাকে তাড়িয়ে দেবার ব্যবস্থা করব, দোহাই আপনার, তত দিন কিছু করে বসবেন না।
মাণ্ডবী নমস্কার করে চলে গেল। বটুক বললেন, নাও, ঠেলা সামলাও এখন। সবাই দেখছি ভীষণ, খঞ্জনা ভীষণ বদমাশ, বরুণ—দা ভীষণ বোকা আর মাণ্ডবী ভীষণ ছেলেমানুষ। পাত্রী একদিকে যাচ্ছেন, পাত্র আর একদিকে যাচ্ছেন, কার মন রাখবে? আবার পাত্রীর বাপ আসছেন, তিনি কি চান কে জানে।
সন্ধ্যা সাতটায় শ্রী গদাধর ঘোষ প্রকাণ্ড মোটরে চড়ে উপস্থিত হলেন। সরলাক্ষ খুব খাতির করে তাঁকে নিজের খাস কামরায় নিয়ে গিয়ে বসালে এবং বটুকের পরিচয় দিলে।
পকেট থেকে বিজ্ঞাপনটা বার করে শ্রীগদাধর একটু হেসে বললেন, খাসা ব্যবসা খুলেছেন সরলাক্ষবাবু। ডেলিকেট ব্যাপারে মতলব দিতে পারে এমন একজন তুখড় চৌকশ লোকের বড়ই অভাব ছিল। আপনি বিজ্ঞাপনে ঠিকই লিখেছেন, ডাক্তার উকিল পুলিস জ্যোতিষী গুরু—এদের কি সব কথা বলা চলে, নাকি এরা সব সমস্যার সমাধান করতে পারে? আপনার তো বয়স বেশী নয়, ব্যবসাটি শিখলেন কোথায়? ডিগ্রী কিছু আছে?
সরলাক্ষ বললে, আমি হচ্ছি সাউথ আমেরিকার মায়া—আজটেক—ইংকা ইউনিভার্সিটির পিএচ.ডি, আমার রিসার্চের জন্য সেখানকার অনারারী ডিগ্রী পেয়েছি। বাগবাজার বিবুধ সভাও আমাকে বুদ্ধিবারিধি উপাধি দিয়েছেন।
—বেশ বেশ। এখন আমার মুশকিলটা শুনুন।
শ্রীগদাধর তাঁর মুশকিলটা সবিস্তারে বিবৃত করে অবশেষে বললেন, আপনি ওই খঞ্জনা মাগীর কবল থেকে বরুণকে চটপট উদ্ধার করে দিন, আমার মেয়েটা বড়ই মনমরা হয়ে আছে।
সরলাক্ষ বললে, আপনার তো শুনেছি খুব প্রতিপত্তি, মন্ত্রীরা আপনার কথায় ওঠেন বসেন। আপনি মনে করলেই খঞ্জনাকে আণ্ডামানে বদলী করতে পারেন।