সরলাক্ষর প্রতিহাররক্ষী ছোকরা সোনালাল একটি স্লিপ নিয়ে এল। সরলাক্ষ পড়ে বললে, এ যে দেখছি একজন মহিলা, মাণ্ডবী ঘোষ। পাঠিয়ে দে এখানে।
কুড়ি—বাইশ বছরের একটি মেয়ে ঘরে এল। দুজন লোক দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললে, মিস্টার হোমের সঙ্গে কিছু প্রাইভেট কথা বলতে চাই।
সরলাক্ষ বললে, আমিই হোম, ইনি আমার সহকর্মী ডাক্তার বটুক সেন। আপনি এঁর সামনে সব কথা বলতে পারেন, কোনও দ্বিধা করবেন না। বসুন আপনি।
মাণ্ডবী কিছুক্ষণ ঘাড় নীচু করে বসে রইল। তার পর আস্তে আস্তে বললে, আমার বাবার নাম শুনে থাকবেন, শ্রীগদাধর ঘোষ।
সরলাক্ষ বললে, ও, তাঁরই কন্যা আপনি?
—হাঁ। বরুণ—দার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা অনেক কাল থেকে ঠিক করা আছে—বানর—নির্বাসন—অধিকর্তা বরুণ বিশ্বাস।
হাঁ হাঁ এই নতুন পোস্টের কথা কাগজে পড়েছি বটে। খুব ভাল সম্বন্ধ, কংগ্রাটস মিস ঘোষ।
মাণ্ডবী বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বললে, একটা বিশ্রী গুজব শুনছি, বরুণ—দা তার অ্যাসিস্টাণ্ট খঞ্জনা দাসের প্রেমে পড়েছে।
—আপনার বাবা জানেন?
—জানেন, কিন্তু তিনি তেমন গা করছেন না। বলছেন, ইয়ংম্যানরা অমন একটু—আধটু বেচাল হয়ে থাকে, বিয়ে হলেই সেরে যাবে।
—কথাটা ঠিক, চটপট বিয়ে হয়ে যাওয়াই ভাল।
—এক জ্যোতিষী বলেছেন আমার একটা ফাঁড়া আছে, তিন মাস পরে কেটে যাবে। তার পর বিয়ে হবে। কিন্তু তার মধ্যে বরুণ—দা কি করে বসবে কে জানে।
—দেখি আপনার হাত।
মাণ্ডবীর করতল দেখে সরলাক্ষ বললে, হুঁ, ফাঁড়া একটা আছে বটে, কিন্তু তিন মাস নয়, মাস খানিকের মধ্যেই আমি কাটিয়ে দেব। খঞ্জনা দাসের খপ্পর থেকে আপনি শ্রীবিশ্বাসকে উদ্ধার করতে চান তো?
—হাঁ। আপনি দু জনের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দিন, ভীষণ ঝগড়া, যাতে মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়। খরচ যা লাগে আমি দেব, এখন এই একশ টাকা আগাম দিচ্ছি।
সরলাক্ষ সাহাস্যে বললে, ব্যস্ত হবেন না, আমার প্রথম ফী ষোল টাকা মাত্র। কাজ উদ্ধার হলে আর যা ইচ্ছে দেবেন।
বটুক বললে, মিস ঘোষ, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, সরলাক্ষর অসাধ্য কিছু নেই, ঠিক ঝগড়া বাধিয়ে দেবে।
মাণ্ডবী মাথা নেড়ে বললে, উঁহু, অত সহজ ভাববেন না। খঞ্জনাকে আপনারা চেনেন না, ভীষণ বদমাশ মেয়ে, দারুণ ছিনে জোঁক, সহজে ছাড়বে না। আর বরুণ—দাও ভীষণ বোকা।
সরলাক্ষ প্রশ্ন করলে, বরুণ—দাকে আপনি কত দিন থেকে জানেন?
—সেই ছেলেবেলা থেকে। আমার বাবাই ওকে মানুষ করেছেন, চাকরিও জুটিয়ে দিয়েছেন।
সোনালাল আবার ঘরে এসে একটা কার্ড দিলে। সরলাক্ষ দেখে বললে, আরে স্বয়ং বরুণ বিশ্বাস দেখা করতে এসেছেন!
মাণ্ডবী চমকে উঠে বললে, সর্বনাশ, আমাকে তো দেখে ফেলবে! কি করি বলুন তো?
সরলাক্ষ বললে, কোনও চিন্তা নেই, আপনি ওই পিছনের ঘরে যান, মোটা পর্দা আছে, কিছু দেখা যাবে না। শ্রীবিশ্বাস চলে গেলে আপনি আবার এ ঘরে আসবেন।
মাণ্ডবী তাড়াতাড়ি পিছনের ঘরে গেল এবং পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আড়ি পাততে লাগল।
বরুণ বিশ্বাস ঘরে ঢুকে বললেন, মিস্টার হোমের সঙ্গে আমার কথা আছে, অত্যন্ত প্রাইভেট।
সরলাক্ষ বললে, আমিই সরলাক্ষ হোম, ইনি আমার কোলীগ ডাক্তার বটুক সেন। এঁর সামনে আপনি স্বচ্ছন্দে সব কথা বলতে পারেন।
বরুণ তবু ইতস্তত করছে দেখে বটুক বললে, মিস্টার বিশ্বাস, আপনি সংকোচ করবেন না। শার্লক হোমসের জুড়িদার যেমন ডাক্তার ওআটসন, সরলাক্ষ হোমের তেমনি ডাক্তার বটুক সেন—এই আমি। তবে আমি ওআটসনের মতন হাঁদা নই। আপনিই বাঁদর দপ্তরের কর্তা তো?
বরুণ বললে, আমি হচ্ছি ডিরেক্টর অভ মংকি ডিপোর্টেশন। সরলাক্ষবাবু, আমি একটি অত্যন্ত ডেলিকেট ব্যাপারের জন্য আপনার সঙ্গে পরামর্শ করতে এসেছি।
সরলাক্ষ বললে, কিছু ভাববেন না, আপনি খোলসা করে সব কথা বলুন।
—শ্রীগদাধর ঘোষের নাম শুনেছেন তো? তাঁর মেয়ে মাণ্ডবীর সঙ্গে আমার বিবাহ বহু কাল থেকে স্থির হয়ে আছে।
—চমৎকার সম্বন্ধ, কংগ্রাটস মিস্টার বিশ্বাস।
—কিন্তু আমি অন্য একটি মেয়েকে ভালবেসে ফেলেছি।
—বেশ তো, তাঁকেই বিবাহ করুন না।
—তাতে বিস্তর বাধা। শ্রীগদাধর আমার পিতৃবন্ধু, ছেলেবেলার অভিভাবক, এখনও মুরুব্বী। তিনিই আমার চাকরিটি করে দিয়েছেন, চটে গেলে তিনিই আমাকে তাড়াতে পারেন। অথচ তাঁর মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে আমি বিস্তর সম্পত্তি পাব, চাকরিও বজায় থাকবে।
—তবে তাঁর মেয়েকেই বিয়ে করুন না।
—দেখুন, মাণ্ডবীকে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, তাকে ছোট বোন মনে করতে পারি, কিন্তু তার সঙ্গে প্রেম হওয়া অসম্ভব।
—দেখতে বিশ্রী বুঝি?
—ঠিক বিশ্রী হয়তো নয়, কিন্তু আমার পছন্দর সঙ্গে একদম মেলে না। মোটাসোটা গড়ন, ডলিপুতুলের মতন টেবো টেবো গাল। ফোর্থইয়ারে পড়ছে বটে, কিন্তু চালচলন সেকেলে, স্মার্ট নয়, ভুল ইংরিজী বলে। এখনও জরির ফিতে দিয়ে খোঁপা বাঁধে, এক গাদা গহনা পরে জুজুবুড়ী সাজে।
—যাঁকে ভালবেসে ফেলেছেন তিনি কেমন?
—খঞ্জনা? ওঃ, সুপর্ব, চমৎকার। মেমের মতন ইংরিজী বলে, তার সঙ্গে মাণ্ডবীর তুলনাই হয় না।
সরলাক্ষ বললে, দেখুন মিস্টার বরুণ বিশ্বাস, আপনার ইচ্ছেটা বুঝেছি। আপনি চাকরি বজায় রাখতে চান, গদাধরবাবুর সম্পত্তিও চান, অথচ তাঁর কন্যাকে চান না। এই তো?
বরুণ মাথা নীচু করে বললে, সমস্যাটা সেইরকমই দাঁড়িয়েছে বটে। কোন উপায় বলতে পারেন?